'ক্ষমতার অংশীদার' বা 'Stakeholder of Power' শব্দগুচ্ছ বাংলাদেশের রাজনৈতিক আলোচনায় একটি নতুন মাত্রা যোগ করেছে। বিশেষ করে ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর এই ধারণাটি ব্যাপক প্রচলন লাভ করেছে। এই শব্দের ব্যবহার শুধু রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নেই, বরং সাধারণ জনগণ, বিশেষ করে ইসলামী চিন্তাধারার মানুষদের মধ্যেও এর ব্যাপক প্রচলন ঘটেছে।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এই ধারণাটি বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে কারণ ২০২৪ সালের গণঅভ্যুত্থানে বিভিন্ন শক্তির সমন্বয়ে যে আন্দোলন গড়ে উঠেছিল, তাতে ইসলামপন্থী দল ও গোষ্ঠীগুলোর ভূমিকা ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। মাদ্রাসার ছাত্র-শিক্ষক, আলেম-ওলামা, ইসলামী দলের কর্মী এবং অনলাইন ইসলামী দাওয়াতি কার্যক্রমে জড়িত ব্যক্তিরা এই আন্দোলনে ব্যাপক অংশগ্রহণ করেছিলেন। তাদের এই অংশগ্রহণ শুধু সংখ্যাগত দিক থেকেই গুরুত্বপূর্ণ ছিল না, বরং আন্দোলনের দিক নির্ধারণে এবং জনমত গঠনে তাদের ভূমিকা ছিল অপরিহার্য।এই প্রেক্ষাপটে অনেকেই মনে করেছিলেন যে হাসিনা সরকারের পতনের পর বাংলাদেশের রাজনৈতিক ক্ষমতার কাঠামোতে ইসলামপন্থীদের একটি উল্লেখযোগ্য অংশীদারিত্ব প্রতিষ্ঠিত হবে। তাদের প্রত্যাশা ছিল যে নতুন সরকার গঠনে, নীতি নির্ধারণে এবং রাষ্ট্রীয় কাঠামো পুনর্গঠনে তাদের মতামত ও অবদানকে যথাযথ মূল্যায়ন করা হবে।
হাসিনা সরকারের পতনের পর ইসলামপন্থী মহলে যে প্রত্যাশা তৈরি হয়েছিল, তা ছিল বহুমুখী। প্রথমত, তারা আশা করেছিল যে নতুন সরকার গঠনে তাদের মতামত ও অংশগ্রহণ থাকবে। দ্বিতীয়ত, তারা প্রত্যাশা করেছিল যে রাষ্ট্রীয় নীতি নির্ধারণে ইসলামী মূল্যবোধের প্রতিফলন ঘটবে। তৃতীয়ত, তারা আশা করেছিল যে দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক নিপীড়নের অবসান ঘটবে এবং তাদের রাজনৈতিক কার্যক্রমের পূর্ণ স্বাধীনতা ফিরে পাবে। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে যে এই প্রত্যাশাগুলোর অধিকাংশই পূরণ হয়নি। ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে গঠিত অন্তর্বর্তীকালীন সরকারে ইসলামপন্থীদের প্রত্যক্ষ প্রতিনিধিত্ব নেই। সরকারের নীতি নির্ধারণে তাদের মতামতের প্রভাব সীমিত। এমনকি কিছু ক্ষেত্রে তারা অনুভব করছেন যে তাদের অবদানকে যথাযথ স্বীকৃতি দেওয়া হচ্ছে না।
তাই আমাদের কেন এমনটা হল? ঠিক কি কারনে ইসলামিস্টরা বা মুসলিমরা যথাযথ পরিমাণ স্বীকৃতি পেল না? রাজনৈতিক সমীকরণের এই জটিল অংক বুঝতে হলে আমাদের আগে জেনে নিতে হবে Stakehold Holder of Power কি এবং তা কিভাবে কাজ করে?
তাত্ত্বিকভাবে বলতে গেলে, অংশীদার' শব্দটি সাধারণত এমন একজন ব্যক্তি, গোষ্ঠী বা সংস্থাকে বোঝায় যার একটি কোম্পানি, প্রকল্প বা বৃহত্তর অর্থে একটি সিস্টেম বা প্রচেষ্টার প্রতি একটি নির্দিষ্ট আগ্রহ রয়েছে। এই আগ্রহ প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ হতে পারে এবং তারা সেই সত্তার কার্যক্রম, সিদ্ধান্ত এবং ফলাফল দ্বারা প্রভাবিত হতে পারে বা প্রভাবিত করতে পারে। যখন আমরা 'ক্ষমতা'র মাত্রা যোগ করি, তখন আমরা সেই অংশীদারদের বোঝাই যারা একটি নির্দিষ্ট সিস্টেমের মধ্যে, বিশেষ করে একটি রাষ্ট্র বা রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে সিদ্ধান্ত, নীতি বা ফলাফলকে প্রভাবিত, নিয়ন্ত্রণ বা উল্লেখযোগ্যভাবে প্রভাবিত করার ক্ষমতা রাখে। মূলত, 'ক্ষমতার অংশীদার' কেবল তারাই নয় যারা সিদ্ধান্ত দ্বারা প্রভাবিত হয়, বরং তারাই যারা সক্রিয়ভাবে সেগুলোকে আকার দিতে পারে। তাদের এই প্রভাব তাদের অবস্থান, সম্পদ, বৈধতা, জরুরি অবস্থা বা অন্যদের একত্রিত করার ক্ষমতা সহ বিভিন্ন উৎস থেকে উদ্ভূত হতে পারে।
ক্ষমতার অংশীদারিত্ব একটি জটিল রাজনৈতিক ধারণা যা বিভিন্ন মাত্রায় বিশ্লেষণ করা যায়। রাজনৈতিক বিজ্ঞানের দৃষ্টিকোণ থেকে, ক্ষমতার অংশীদার হতে হলে একটি গোষ্ঠী বা সত্তার মধ্যে কয়েকটি মৌলিক বৈশিষ্ট্য থাকতে হয়। প্রথমত, তাদের থাকতে হয় বৈধতা (Legitimacy) - অর্থাৎ সমাজের একটি উল্লেখযোগ্য অংশের কাছে তাদের দাবি ও অবস্থান গ্রহণযোগ্য হতে হয়। দ্বিতীয়ত, তাদের থাকতে হয় ক্ষমতা (Power) - যা হতে পারে অর্থনৈতিক, সামাজিক, ধর্মীয় বা রাজনৈতিক। তৃতীয়ত, তাদের থাকতে হয় জরুরিত্ব (Urgency) - অর্থাৎ তাদের দাবি ও প্রয়োজনগুলো সময়োপযোগী এবং গুরুত্বপূর্ণ হতে হয়।
বাংলাদেশের ইসলামপন্থী দল ও গোষ্ঠীগুলোর ক্ষেত্রে এই তিনটি বৈশিষ্ট্যই কমবেশি বিদ্যমান। বৈধতার দিক থেকে, বাংলাদেশের জনসংখ্যার ৯০ শতাংশেরও বেশি মুসলমান হওয়ায় ইসলামী মূল্যবোধ ও নীতির প্রতি সাধারণ জনগণের একটি স্বাভাবিক আকর্ষণ রয়েছে। ২০২৪ সালের আন্দোলনে তাদের সক্রিয় অংশগ্রহণ এই বৈধতাকে আরও শক্তিশালী করেছে। ক্ষমতার দিক থেকে, তাদের রয়েছে সংগঠিত জনশক্তি, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের নেটওয়ার্ক, এবং জনমত গঠনে প্রভাব বিস্তারের ক্ষমতা। জরুরিত্বের দিক থেকে, দেশের বর্তমান রাজনৈতিক সংকট ও পুনর্গঠনের প্রয়োজনে তাদের অবদান ও মতামত গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু, ক্ষমতার অংশীদারিত্ব শুধু এই তিনটি বৈশিষ্ট্যের উপস্থিতিতেই নিশ্চিত হয় না।
(চলবে)
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এই ধারণাটি বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে কারণ ২০২৪ সালের গণঅভ্যুত্থানে বিভিন্ন শক্তির সমন্বয়ে যে আন্দোলন গড়ে উঠেছিল, তাতে ইসলামপন্থী দল ও গোষ্ঠীগুলোর ভূমিকা ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। মাদ্রাসার ছাত্র-শিক্ষক, আলেম-ওলামা, ইসলামী দলের কর্মী এবং অনলাইন ইসলামী দাওয়াতি কার্যক্রমে জড়িত ব্যক্তিরা এই আন্দোলনে ব্যাপক অংশগ্রহণ করেছিলেন। তাদের এই অংশগ্রহণ শুধু সংখ্যাগত দিক থেকেই গুরুত্বপূর্ণ ছিল না, বরং আন্দোলনের দিক নির্ধারণে এবং জনমত গঠনে তাদের ভূমিকা ছিল অপরিহার্য।এই প্রেক্ষাপটে অনেকেই মনে করেছিলেন যে হাসিনা সরকারের পতনের পর বাংলাদেশের রাজনৈতিক ক্ষমতার কাঠামোতে ইসলামপন্থীদের একটি উল্লেখযোগ্য অংশীদারিত্ব প্রতিষ্ঠিত হবে। তাদের প্রত্যাশা ছিল যে নতুন সরকার গঠনে, নীতি নির্ধারণে এবং রাষ্ট্রীয় কাঠামো পুনর্গঠনে তাদের মতামত ও অবদানকে যথাযথ মূল্যায়ন করা হবে।
হাসিনা সরকারের পতনের পর ইসলামপন্থী মহলে যে প্রত্যাশা তৈরি হয়েছিল, তা ছিল বহুমুখী। প্রথমত, তারা আশা করেছিল যে নতুন সরকার গঠনে তাদের মতামত ও অংশগ্রহণ থাকবে। দ্বিতীয়ত, তারা প্রত্যাশা করেছিল যে রাষ্ট্রীয় নীতি নির্ধারণে ইসলামী মূল্যবোধের প্রতিফলন ঘটবে। তৃতীয়ত, তারা আশা করেছিল যে দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক নিপীড়নের অবসান ঘটবে এবং তাদের রাজনৈতিক কার্যক্রমের পূর্ণ স্বাধীনতা ফিরে পাবে। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে যে এই প্রত্যাশাগুলোর অধিকাংশই পূরণ হয়নি। ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে গঠিত অন্তর্বর্তীকালীন সরকারে ইসলামপন্থীদের প্রত্যক্ষ প্রতিনিধিত্ব নেই। সরকারের নীতি নির্ধারণে তাদের মতামতের প্রভাব সীমিত। এমনকি কিছু ক্ষেত্রে তারা অনুভব করছেন যে তাদের অবদানকে যথাযথ স্বীকৃতি দেওয়া হচ্ছে না।
তাই আমাদের কেন এমনটা হল? ঠিক কি কারনে ইসলামিস্টরা বা মুসলিমরা যথাযথ পরিমাণ স্বীকৃতি পেল না? রাজনৈতিক সমীকরণের এই জটিল অংক বুঝতে হলে আমাদের আগে জেনে নিতে হবে Stakehold Holder of Power কি এবং তা কিভাবে কাজ করে?
তাত্ত্বিকভাবে বলতে গেলে, অংশীদার' শব্দটি সাধারণত এমন একজন ব্যক্তি, গোষ্ঠী বা সংস্থাকে বোঝায় যার একটি কোম্পানি, প্রকল্প বা বৃহত্তর অর্থে একটি সিস্টেম বা প্রচেষ্টার প্রতি একটি নির্দিষ্ট আগ্রহ রয়েছে। এই আগ্রহ প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ হতে পারে এবং তারা সেই সত্তার কার্যক্রম, সিদ্ধান্ত এবং ফলাফল দ্বারা প্রভাবিত হতে পারে বা প্রভাবিত করতে পারে। যখন আমরা 'ক্ষমতা'র মাত্রা যোগ করি, তখন আমরা সেই অংশীদারদের বোঝাই যারা একটি নির্দিষ্ট সিস্টেমের মধ্যে, বিশেষ করে একটি রাষ্ট্র বা রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে সিদ্ধান্ত, নীতি বা ফলাফলকে প্রভাবিত, নিয়ন্ত্রণ বা উল্লেখযোগ্যভাবে প্রভাবিত করার ক্ষমতা রাখে। মূলত, 'ক্ষমতার অংশীদার' কেবল তারাই নয় যারা সিদ্ধান্ত দ্বারা প্রভাবিত হয়, বরং তারাই যারা সক্রিয়ভাবে সেগুলোকে আকার দিতে পারে। তাদের এই প্রভাব তাদের অবস্থান, সম্পদ, বৈধতা, জরুরি অবস্থা বা অন্যদের একত্রিত করার ক্ষমতা সহ বিভিন্ন উৎস থেকে উদ্ভূত হতে পারে।
ক্ষমতার অংশীদারিত্ব একটি জটিল রাজনৈতিক ধারণা যা বিভিন্ন মাত্রায় বিশ্লেষণ করা যায়। রাজনৈতিক বিজ্ঞানের দৃষ্টিকোণ থেকে, ক্ষমতার অংশীদার হতে হলে একটি গোষ্ঠী বা সত্তার মধ্যে কয়েকটি মৌলিক বৈশিষ্ট্য থাকতে হয়। প্রথমত, তাদের থাকতে হয় বৈধতা (Legitimacy) - অর্থাৎ সমাজের একটি উল্লেখযোগ্য অংশের কাছে তাদের দাবি ও অবস্থান গ্রহণযোগ্য হতে হয়। দ্বিতীয়ত, তাদের থাকতে হয় ক্ষমতা (Power) - যা হতে পারে অর্থনৈতিক, সামাজিক, ধর্মীয় বা রাজনৈতিক। তৃতীয়ত, তাদের থাকতে হয় জরুরিত্ব (Urgency) - অর্থাৎ তাদের দাবি ও প্রয়োজনগুলো সময়োপযোগী এবং গুরুত্বপূর্ণ হতে হয়।
বাংলাদেশের ইসলামপন্থী দল ও গোষ্ঠীগুলোর ক্ষেত্রে এই তিনটি বৈশিষ্ট্যই কমবেশি বিদ্যমান। বৈধতার দিক থেকে, বাংলাদেশের জনসংখ্যার ৯০ শতাংশেরও বেশি মুসলমান হওয়ায় ইসলামী মূল্যবোধ ও নীতির প্রতি সাধারণ জনগণের একটি স্বাভাবিক আকর্ষণ রয়েছে। ২০২৪ সালের আন্দোলনে তাদের সক্রিয় অংশগ্রহণ এই বৈধতাকে আরও শক্তিশালী করেছে। ক্ষমতার দিক থেকে, তাদের রয়েছে সংগঠিত জনশক্তি, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের নেটওয়ার্ক, এবং জনমত গঠনে প্রভাব বিস্তারের ক্ষমতা। জরুরিত্বের দিক থেকে, দেশের বর্তমান রাজনৈতিক সংকট ও পুনর্গঠনের প্রয়োজনে তাদের অবদান ও মতামত গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু, ক্ষমতার অংশীদারিত্ব শুধু এই তিনটি বৈশিষ্ট্যের উপস্থিতিতেই নিশ্চিত হয় না।
(চলবে)
Comment