Announcement

Collapse
No announcement yet.

অবশেষে 'নেহরু'কে কি ওস্তাদ মানতে হবে? (পর্ব - ১)

Collapse
This is a sticky topic.
X
X
 
  • Filter
  • Time
  • Show
Clear All
new posts

  • অবশেষে 'নেহরু'কে কি ওস্তাদ মানতে হবে? (পর্ব - ১)

    বাংলাদেশে সম্প্রতি একটি নতুন রাজনৈতিক বয়ান বা ন্যারেটিভ প্রচার করার চেষ্টা করা হচ্ছে, যা জনমনে বিভ্রান্তি ও উদ্বেগ সৃষ্টির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই বয়ান অনুযায়ী, বাংলাদেশকে যদি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব বা কথিত "দাসত্ব" থেকে মুক্ত থাকতে হয়, তবে তার অনিবার্য পরিণতি হিসেবে প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারত পুনরায় দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করবে এবং শাসনব্যবস্থা নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নেবে। এই ধারণাটি যেকোনো সাধারণ কাণ্ডজ্ঞানসম্পন্ন এবং বিচক্ষণ ব্যক্তির কাছে কেবল ভিত্তিহীনই নয়, বরং একটি উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ষড়যন্ত্র বা দূরভিসন্ধিমূলক প্রচারণা হিসেবে প্রতীয়মান হওয়াই স্বাভাবিক।

    যারা আজ এই ধরনের কথা বলছেন যে একটি বৃহৎ শক্তির প্রভাব থেকে বাঁচতে হলে আরেকটি শক্তির অধীনতা মেনে নিতে হবে, তারা যে কেবল একটি সরলীকৃত ও ভ্রান্ত ধারণার জগতে বাস করছেন তা স্পষ্ট। মূল প্রশ্নটি হলো, কেন একটি স্বাধীন সার্বভৌম দেশকে এক প্রভুর দাসত্ব থেকে মুক্তি পেতে আরেক প্রভুর দাসত্ব বরণ করতে হবে? এই ধরনের আলোচনার গভীরে প্রবেশ করলে বোঝা যায়, এর পেছনে একটি বড় কারণ হলো আমাদের সম্মিলিত মানসিকতায় প্রোথিত দাসত্বের দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব। এই মানসিকতা কেবল সাধারণ মানুষের মধ্যেই নয়, বরং যারা এই বয়ান প্রচার করছেন, তাদের মধ্যেও ক্রিয়াশীল।

    ঐতিহাসিকভাবে পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, বাঙালি জাতিগোষ্ঠী বহু শতাব্দী ধরে বিভিন্ন শাসনব্যবস্থার অধীনে নিপীড়িত ও শোষিত হয়েছে। প্রথমে স্থানীয় হিন্দু জমিদার এবং পরবর্তীতে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শক্তির দ্বারা তারা শাসিত ও শোষিত হয়েছে, যা তাদের মনে গভীর দাগ ফেলেছে। ব্রিটিশরা চলে গেলেও তাদের রেখে যাওয়া শাসনকাঠামো, আমলাতন্ত্র এবং ক্ষমতার বিন্যাস আমাদের মন ও মানসিকতার ওপর এমনভাবে চেপে বসেছে যে, সেই ঔপনিবেশিক প্রভুর প্রতি আনুগত্যের অভ্যাস থেকে আমরা পুরোপুরি বের হতে পারিনি। এই ঐতিহাসিক অভিজ্ঞতার ফলে আমাদের মনস্তত্ত্বে এক ধরনের "মনিব" বা অভিভাবক খোঁজার প্রবণতা তৈরি হয়েছে। যখন কোনো বাহ্যিক নিয়ন্ত্রক শক্তি থাকে না, তখন এক ধরনের শূন্যতা বা নিরাপত্তাহীনতা বোধ কাজ করে, যা আমাদের অবচেতনভাবে নতুন কোনো প্রভুর সন্ধান করতে উৎসাহিত করে।

    এই "দাসত্বের মানসিকতা" বা "Slave Mentality" একটি সুপরিচিত মনস্তাত্ত্বিক ধারণা, যা দীর্ঘকাল ধরে পরাধীন থাকা জনগোষ্ঠীর মধ্যে দেখা যায়। এই মানসিকতার কারণে ব্যক্তি বা সমাজ নিজের স্বাধীনতা, শক্তি ও আত্মনিয়ন্ত্রণের ওপর বিশ্বাস হারিয়ে ফেলে এবং ক্ষমতাধর কোনো পক্ষের নির্দেশনা বা আশ্রয় কামনা করে। সুতরাং, "আমেরিকার দাসত্ব নাকি ভারতের দাসত্ব" – এই বিতর্কটি কেবল একটি রাজনৈতিক চাল নয়, এটি আমাদের ঐতিহাসিক অভিজ্ঞতাপ্রসূত এক গভীর মনস্তাত্ত্বিক সংকটেরও প্রতিফলন।

    একটি জাতির "দাসত্বের মানসিকতা" থেকে উত্তরণ এবং প্রকৃত সার্বভৌমত্ব অর্জনের জন্য অপরিহার্যভাবে তিনটি মৌলিক স্তম্ভের ওপর নিরঙ্কুশ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে হয়। এই তিনটি ক্ষেত্র হলো সেই নীতিগত ভিত্তি, যেখানে অন্য কোনো রাষ্ট্রের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ হস্তক্ষেপের সুযোগ থাকবে না। এর মধ্যে দুটি গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভের কথা উল্লেখ হলো: স্বরাষ্ট্র নীতি এবং নিরাপত্তা নীতি। এর সাথে তৃতীয় এবং সমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভটি হলো পররাষ্ট্র নীতি। এই তিনটি নীতির ওপর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণই একটি দেশকে সত্যিকারের আত্মমর্যাদাশীল ও স্বাধীন হিসেবে প্রতিষ্ঠা করে।

    একটি কার্যকর স্বরাষ্ট্র নীতির প্রধানতম লক্ষ্য হলো দেশের অভ্যন্তরে একটি স্থিতিশীল ও নিরাপদ পরিবেশ তৈরি করা, যেখানে আইন সবার জন্য সমান এবং শাসনব্যবস্থায় নাগরিকের আস্থা থাকে। কিন্তু বাংলাদেশের বাস্তবতা হলো, শুরু থেকেই আইন-কানুন এবং শাসনযন্ত্রকে রাজনৈতিক দলগুলো নিজেদের ক্ষমতাকে টিকিয়ে রাখা এবং প্রতিপক্ষকে দমনের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে এসেছে। এর ফলে, আইন তার সর্বজনীনতা ও নিরপেক্ষতা হারিয়ে একটি দলীয় নিপীড়নের যন্ত্রে পরিণত হয়েছে। এই ব্যবস্থার অনিবার্য পরিণতি হলো একটি দীর্ঘস্থায়ী অভ্যন্তরীণ অস্থিতিশীলতা, যেখানে নাগরিকরা নিরাপত্তাহীনতায় ভোগে এবং রাষ্ট্রের ওপর আস্থা হারিয়ে ফেলে।

    যখন একটি দেশ অভ্যন্তরীণভাবে দুর্বল, বিভক্ত এবং অস্থিতিশীল থাকে, তখন তা অনিবার্যভাবে বিদেশি শক্তির হস্তক্ষেপের জন্য একটি উর্বর ক্ষেত্র তৈরি করে দেয়। যে শক্তিশালী দেশগুলো আজকের বিশ্বে সরাসরি সামরিক আগ্রাসনের মাধ্যমে অন্য দেশ দখল করতে পারে না, তারা এই অভ্যন্তরীণ দুর্বলতার সুযোগ নেয়। তারা তাদের নিজস্ব ভূ-রাজনৈতিক স্বার্থ হাসিলের জন্য "স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনা" বা "উন্নয়নে সহায়তা" করার নামে নিজেদের আদর্শ, চিন্তাভাবনা এবং প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করে। একটি দেশ যখন নিজের ঘর সামলাতে ব্যর্থ হয়, তখন বাইরের শক্তি সেই ঘরে প্রবেশ করে অভিভাবকের ভূমিকা নেওয়ার সুযোগ পেয়ে যায়।

    বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এই চিত্রটি অত্যন্ত স্পষ্ট। দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক সংঘাত, সুশাসনের অভাব এবং প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতা দেশকে এমন এক পর্যায়ে নিয়ে গেছে যেখানে বিদেশি শক্তিগুলো নিজেদের প্রভাব বিস্তারের জন্য সহজেই তৎপর হতে পারছে। বিশেষ করে, গত দেড় দশকের বেশি সময় ধরে ভারতের প্রভাব বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি, অর্থনীতি এবং নিরাপত্তা নীতিতে ব্যাপকভাবে অনুভূত হয়েছে, যা আজ আর কোনো গোপন বিষয় নয়। এই হস্তক্ষেপ সম্ভব হয়েছে মূলত দেশের অভ্যন্তরীণ অস্থিতিশীলতা এবং ক্ষমতাসীনদের ক্ষমতা টিকিয়ে রাখার জন্য বিদেশি শক্তির ওপর নির্ভরশীলতার কারণে। যখন একটি সরকার জনগণের সমর্থনের চেয়ে বিদেশি শক্তির সমর্থনে বেশি আস্থাশীল হয়ে পড়ে, তখন দেশের স্থিতিশীলতা অনিবার্যভাবে ক্ষুণ্ণ হয়।

    সুতরাং, বিষয়টি একটি দুষ্টচক্রের মতো কাজ করে: রাজনৈতিক দলগুলো নিজেদের স্বার্থে দেশের স্বরাষ্ট্র নীতিকে ধ্বংস করে একটি অস্থিতিশীল পরিবেশ তৈরি করে, আর সেই অস্থিতিশীলতাই বিদেশি শক্তিকে হস্তক্ষেপ করার এবং নিজেদের এজেন্ডা বাস্তবায়ন করার সুযোগ করে দেয়। এর ফলে দেশ শুধু অভ্যন্তরীণভাবেই দুর্বল হয় না, আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও তার আত্মনিয়ন্ত্রণ ও দর-কষাকষির ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে। আজকের বাংলাদেশে যা ঘটছে, তা এই দীর্ঘ প্রক্রিয়ারই একটি দৃশ্যমান পরিণতি, যেখানে অভ্যন্তরীণ ব্যর্থতা বিদেশি প্রভাবের দরজা খুলে দিয়েছে।

    (চলবে)
    فَاَعۡرِضۡ عَنۡهُمۡ وَ انۡتَظِرۡ اِنَّهُمۡ مُّنۡتَظِرُوۡنَ
Working...
X