Announcement

Collapse
No announcement yet.

অবশেষে 'নেহরু'কে কি ওস্তাদ মানতে হবে? (পর্ব - ৩)

Collapse
This is a sticky topic.
X
X
 
  • Filter
  • Time
  • Show
Clear All
new posts

  • অবশেষে 'নেহরু'কে কি ওস্তাদ মানতে হবে? (পর্ব - ৩)

    একটি রাষ্ট্রের আন্তর্জাতিক পরিচয় ও তার অস্তিত্বের সক্ষমতা নির্মিত হয় তার পররাষ্ট্রনীতির স্থাপত্যে। এই নীতি কেবল কূটনৈতিক আদান-প্রদানের একটি সরল নির্দেশিকা নয়, বরং এটি একটি জাতির ঐতিহাসিক অভিজ্ঞতা, ভূ-রাজনৈতিক প্রজ্ঞা এবং সভ্যতার দূরদৃষ্টির সম্মিলিত প্রতিফলন। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ভাষায়, পররাষ্ট্রনীতি হলো একটি রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ আকাঙ্ক্ষার আন্তর্জাতিক বহিঃপ্রকাশ। কিন্তু বাংলাদেশ, তার অর্ধশতাব্দীর যাত্রাপথে, "সকলের সাথে বন্ধুত্ব, কারো সাথে বৈরিতা নয়" শীর্ষক একটি আপাতদৃষ্টিতে মহৎ কিন্তু কার্যত একটি কৌশলগত শূন্যতার জন্ম দেওয়া নীতি অনুসরণ করে চলেছে। এই নীতিটি আন্তর্জাতিক সম্পর্কের বাস্তবতাবাদী (Realist) তত্ত্বের সম্পূর্ণ বিপরীত, যা মনে করে যে আন্তর্জাতিক ব্যবস্থা নৈরাজ্যমূলক (Anarchic) এবং প্রতিটি রাষ্ট্র কেবল নিজের স্বার্থ (National Interest) রক্ষায় সচেষ্ট। বাংলাদেশের এই নীতিটি তাই শান্তিপ্রিয়তার চেয়েও বেশি করে একটি দিকনির্দেশনাহীন ও সুবিধাবাদী রাষ্ট্রাচারে পরিণত হয়েছে, যা দীর্ঘমেয়াদে জাতীয় সার্বভৌমত্ব ও আত্মমর্যাদাকে ক্ষয়ের দিকে ঠেলে দিয়েছে।

    "সকলের সাথে বন্ধুত্ব" নীতিটি মূলত আদর্শবাদ (Idealism) দ্বারা প্রভাবিত, যা বিশ্বাস করে যে পারস্পরিক সহযোগিতা ও নৈতিকতার মাধ্যমে আন্তর্জাতিক শান্তি প্রতিষ্ঠা সম্ভব। কিন্তু এই নীতির সবচেয়ে বড় দুর্বলতা হলো, এটি ভূ-রাজনৈতিক ক্ষমতার অসম বণ্টন এবং রাষ্ট্রগুলোর স্বার্থের সংঘাতকে উপেক্ষা করে। যখন একটি রাষ্ট্র নৈতিকভাবে বা আইনগতভাবে কোনো আগ্রাসী শক্তির বিরুদ্ধে অবস্থান নিতে ব্যর্থ হয়, তখন তার এই "বন্ধুত্ব" নীতিটি একটি কৌশলগত পলায়নপরতার (Strategic Escapism) নামান্তর হয়ে দাঁড়ায়।

    উদাহরণস্বরূপ, ফিলিস্তিনের উপর ইসরায়েলি আগ্রাসনের মতো একটি স্পষ্ট নৈতিক সংকটের সময়েও বাংলাদেশ তার অবস্থানকে জোরালো করতে পারেনি। বরং, паспоর্ট থেকে "ইসরায়েল ব্যতীত" (Except Israel) বাক্যটি অপসারণের মতো পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে, যা এই "সকলের সাথে বন্ধুত্ব" নীতির আড়ালে একটি আপসকামী ও সুবিধাবাদী মানসিকতারই পরিচায়ক।

    মিয়ানমার কর্তৃক রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর উপর চালানো গণহত্যা এবং তাদের বাংলাদেশে ঠেলে দেওয়ার ঘটনাটি বিবেচনা করা যাক। এটি ছিল বাংলাদেশের জাতীয় নিরাপত্তার উপর সরাসরি আঘাত। কিন্তু "বন্ধুত্ব" নীতির কারণে বাংলাদেশ মিয়ানমারের বিরুদ্ধে কোনো কঠোর শাস্তিমূলক (Punitive) ব্যবস্থা গ্রহণ বা আন্তর্জাতিক অঙ্গনে কার্যকর চাপ সৃষ্টি করতে ব্যর্থ হয়েছে।

    চীনের ভূ-রাজনৈতিক স্বার্থ এবং ভারতের দ্বিধান্বিত অবস্থানের কারণে বাংলাদেশ কার্যত একাই এই সংকট মোকাবিলা করছে। এখানে "বন্ধুত্ব" নীতিটি আমাদের কোনো কৌশলগত সুবিধা এনে দেয়নি, বরং সংকটকে আরও দীর্ঘায়িত করেছে। একইভাবে, তিস্তার পানি বণ্টনের মতো গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে ভারতের সাথে কার্যকর দর-কষাকষিতে ব্যর্থতাও এই নীতির সীমাবদ্ধতাকে স্পষ্ট করে।

    এই নীতি একটি দেশকে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে একজন নিয়ম-প্রণেতা (Rule-Shaper) হওয়ার পরিবর্তে কেবলই একজন নিয়ম-গ্রহণকারী (Rule-Taker) হিসেবে সীমাবদ্ধ রাখে, যা আধুনিক বিশ্বে একটি রাষ্ট্রের জন্য আত্মঘাতী। এটি প্রমাণ করে, অর্থনৈতিক বা ভূ-রাজনৈতিক চাপের মুখে আমাদের নৈতিক অবস্থান কতটা ভঙ্গুর। এই নীতি একটি দেশকে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে সিদ্ধান্ত গ্রহণকারী (Decision Maker) হিসেবে প্রতিষ্ঠা না করে, কেবলই একজন নিষ্ক্রিয় পর্যবেক্ষক (Passive Observer) বানিয়ে রাখে।

    এখানেই আসে, জওহরলাল নেহেরুর জোট-নিরপেক্ষ আন্দোলন (NAM)। যা ছিল একটি সুচিন্তিত ভূ-রাজনৈতিক কৌশল। এর মূল ভিত্তি ছিল স্নায়ুযুদ্ধের দুই পরাশক্তির ক্ষমতার লড়াই থেকে কৌশলগত স্বায়ত্তশাসন (Strategic Autonomy) আদায় করা। নেহেরু, টিটো, নাসের, সুকর্ণ—তাঁরা বুঝতে পেরেছিলেন যে নতুন স্বাধীন হওয়া দেশগুলোর জন্য কোনো একটি ব্লকে যোগদান করা মানে হলো ঔপনিবেশিক শাসনেরই একটি নতুন রূপে প্রত্যাবর্তন। NAM ছিল তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোর জন্য একটি সম্মিলিত দর-কষাকষির প্ল্যাটফর্ম।

    যদিও পরবর্তীকালে, বিশেষ করে ১৯৭১ সালের ভারত-সোভিয়েত মৈত্রী চুক্তি এবং "ইন্দিরা ডকট্রিন"-এর মাধ্যমে ভারত নিজেই তার জোট-নিরপেক্ষ অবস্থান থেকে কিছুটা সরে আসে এবং আঞ্চলিক আধিপত্যবাদের (Regional Hegemony) চর্চা শুরু করে, তবুও এর পেছনের মূল দর্শন ছিল একটি স্বাধীন পরিচিতি নির্মাণের আকাঙ্ক্ষা। ভারত তার জাতীয় স্বার্থে শত্রু-মিত্র নির্ধারণ করেছে, যা একটি শক্তিশালী রাষ্ট্রের পরিচায়ক।

    বিপরীতে, বাংলাদেশের নীতিটি জোট-নিরপেক্ষতার দর্শন থেকে উৎসারিত নয়, বরং এটি একটি প্রতিক্রিয়ামূলক সুবিধাবাদ (Reactive Opportunism)। এখানে কোনো দীর্ঘমেয়াদী কৌশলগত লক্ষ্য নেই। ক্ষমতার পালাবদলের সাথে সাথে আনুগত্যের কেন্দ্রবদল হয়েছে—কখনো ভারত, কখনো চীন, কখনো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, আবার কখনো মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন শক্তি। এই নীতিহীনতার ফলে বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক অঙ্গনে একটি নির্ভরযোগ্য অংশীদার (Reliable Partner) হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করতে ব্যর্থ হয়েছে। একটি রাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতি যখন কেবল অভ্যন্তরীণ ক্ষমতার সমীকরণ দ্বারা নির্ধারিত হয়, তখন তা আন্তর্জাতিক গ্রহণযোগ্যতা হারায়।

    এই রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক অবক্ষয়ের গভীরে রয়েছে এক ধরনের দার্শনিক সংকট। ইসলামকে একটি "পরিপূর্ণ জীবন ব্যবস্থা" হিসেবে স্বীকার করার পরও, রাষ্ট্রীয় দর্শনের ক্ষেত্রে আমরা পশ্চিমা সেক্যুলার মডেল অথবা পরাশক্তির উপর নির্ভরশীলতাকে একমাত্র পথ বলে ধরে নিয়েছি। এটি ইসলামের মূল চেতনার সাথে এক বিরাট বোঝাপড়ার ফারাক তৈরি করে।

    ইসলামী দর্শনে সার্বভৌমত্বের ধারণাটি দ্বিমাত্রিক। চূড়ান্ত সার্বভৌমত্ব (Ultimate Sovereignty) আল্লাহর, কিন্তু জাগতিক পরিমণ্ডলে সেই সার্বভৌমত্বের প্রতিনিধিত্ব করে মুসলিম উম্মাহ বা তার দ্বারা গঠিত রাষ্ট্র। এই রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি হলো العدل (আল-আদল বা ন্যায়বিচার) এবং الشورى (আশ-শূরা বা পরামর্শ)। পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে, ইসলামের ভিত্তি হলো "আল-ওয়ালা ওয়াল-বারা" (আনুগত্য ও বিচ্ছেদ), যার অর্থ ন্যায়ের পক্ষে থাকা এবং অন্যায়ের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করা। এটি কোনো জাতি বা বর্ণের ভিত্তিতে নির্ধারিত হয় না, বরং আদর্শ ও নৈতিকতার ভিত্তিতে নির্ধারিত হয়।

    আল্লাহ জ্ঞান অর্জন ও প্রচেষ্টা করতে বলেছেন; ফলাফল তাঁর হাতে। আধ্যাত্মিকতা এখানে নিষ্ক্রিয়তা শেখায় না, বরং সর্বোচ্চ চেষ্টার পর আল্লাহর উপর তাওয়াক্কুল বা ভরসা করতে শেখায়। এই দর্শন অনুযায়ী, অর্থনৈতিক স্বনির্ভরতা, সামরিক সক্ষমতা অর্জন এবং জ্ঞানভিত্তিক সমাজ গঠন করাও ইবাদতের অংশ। আধ্যাত্মিকতার মূল শক্তি এখানেই নিহিত যে, মানুষ তার সাধ্যমতো চেষ্টা করবে এবং বাকিটা আল্লাহর উপর ন্যস্ত করবে। সবকিছু যদি কেবল জাগতিক হিসাব-নিকাশের উপর নির্ভরশীল হতো, তবে পশ্চিমা বস্তুবাদী বা কমিউনিস্ট দর্শনই সবচেয়ে সফল হওয়ার কথা ছিল, কারণ তাদের তাত্ত্বিক কাঠামো অত্যন্ত বিস্তারিত।

    একটি রাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতির শক্তি তার অর্থনৈতিক কাঠামোর উপর অনেকাংশে নির্ভরশীল। যে রাষ্ট্র তার জনগণের মৌলিক চাহিদা ও বিলাসের জন্য আমদানির উপর নির্ভরশীল, সে রাষ্ট্র কখনোই স্বাধীন পররাষ্ট্রনীতি অনুসরণ করতে পারে না। একে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে "নির্ভরশীলতা তত্ত্ব" (Dependency Theory) দ্বারা ব্যাখ্যা করা হয়, যেখানে উন্নয়নশীল দেশগুলো উন্নত দেশগুলোর উপর অর্থনৈতিকভাবে নির্ভরশীল থাকার কারণে একটি শোষণমূলক চক্রে আবদ্ধ থাকে।

    এর থেকে উত্তরণের পথ হলো উৎপাদনমুখী অর্থনীতি এবং ভোগবাদী সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে আসা। বিলাসিতা (ইসরাফ) পরিহার করে অর্জিত সম্পদকে উৎপাদনশীল খাতে বিনিয়োগের যে ধারণা ইসলাম দেয়, তা একটি দেশকে অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী করে তুলতে পারে। যখন একটি জাতি নিজের খাদ্য, বস্ত্র, প্রযুক্তি ও প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম নিজে উৎপাদন করতে শেখে, তখনই সে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে মাথা উঁচু করে কথা বলার নৈতিক ও বস্তুগত অধিকার অর্জন করে।

    বাংলাদেশের বর্তমান সেক্যুলার নেতৃত্ব যেভাবে একটি মেরুদণ্ডহীন পররাষ্ট্রনীতি এবং পরজীবী অর্থনীতিকে আঁকড়ে ধরে আছে, তা জাতিকে এক অন্ধকার ভবিষ্যতের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। এই অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য প্রয়োজন একটি আদর্শিক জাগরণ। সেই আদর্শ হতে পারে ইসলামের কালজয়ী দর্শন, যা একটি জাতিকে শেখায় কীভাবে আত্মমর্যাদা, জ্ঞান এবং বিশ্বাসের উপর ভিত্তি করে একটি শক্তিশালী ও স্বাধীন রাষ্ট্র গঠন করতে হয়। অন্যথায়, এই চাটুকারিতা ও সুবিধাবাদের পথ আমাদের চিরস্থায়ী দাসত্বের দিকেই নিয়ে যাবে।

    যতক্ষণ না আমরা এই আদর্শিক ভিত্তি নির্মাণ করতে পারব, ততক্ষণ "সকলের সাথে বন্ধুত্ব" নীতিটি আমাদের দুর্বলতার প্রতীক হয়েই থাকবে এবং আমরা সার্বভৌমত্বের এক বিভ্রান্তিকর প্যারাডক্সের মধ্যেই ঘুরপাক খেতে থাকব। একটি স্বাধীন পররাষ্ট্রনীতির জন্য প্রয়োজন স্বাধীন অর্থনীতি ও স্বাধীন চিন্তা। এই সত্য অনুধাবন করার মধ্যেই নিহিত রয়েছে বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ।

    (সমাপ্ত)
    فَاَعۡرِضۡ عَنۡهُمۡ وَ انۡتَظِرۡ اِنَّهُمۡ مُّنۡتَظِرُوۡنَ
Working...
X