জুলাই গণঅভ্যুত্থান-পরবর্তী বাংলাদেশ ও ইসলামের সংকট
দীর্ঘ ১৬ বছরের জুলুম ও নিপীড়নের বিরুদ্ধে তিলে তিলে জমে থাকা ক্ষোভের বিস্ফোরণ ঘটেছিল আজ থেকে ১ বছর আগে। কোটা আন্দোলন তো ছিল দেশের খুবই সীমিত একটি অংশের আন্দোলন। কিন্তু সেই আন্দোলনই বাংলাদেশের মানুষের বুকের ভেতর জমে থাকা বারুদে স্ফুলিঙ্গ হয়ে আগুন ধরিয়ে দিয়েছিল। '২৪-এর কোটা আন্দোলনের আগেও অনেক ছোট-বড় আন্দোলন হয়েছিল, কিন্তু কোনোটিই পারেনি জালেম হাসিনাশাহির পতন ঘটাতে। কিন্তু কথায় আছে,
إذا أراد الله شيئا هيأ له أسبابه
আল্লাহ যখন কোনোকিছু ঘটাতে চান, তখন তিনিই তার পরিবেশ তৈরি করে দেন।
সামান্য কোটা আন্দোলন হয়ে গেল হাসিনাশাহির পতনের গণআন্দোলন। নিশ্চয়ই আল্লাহ তাআলাই সর্বোত্তম পরিকল্পনাকারী।
গণুভ্যুত্থান-পরবর্তী একটি বছর মুসলিম ও ইসলামপন্থার জন্য কেমন গেল? ভবিষ্যতই বা কেমন হবে? এ ধরনের প্রশ্ন এখন অসংখ্য সেমিনার-সিম্পোজিয়ামের আলোচনার বিষয়ে পরিণত হয়েছে। অসংখ্য বুদ্ধিজীবী, গবেষক ও বিশ্লেষক এ নিয়ে কথা বলছেন, আলোচনা করছেন; আসছে নানান প্রস্তাবনাও। তবে এই সংক্ষিপ্ত লেখায় আমরা এমন কিছু সমস্যার দিকে সকলের দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করব, যা হয়তো আমাদের দৃষ্টির অগোচরেই রয়ে গেছে গত একটি বছর। কেউ হয়তো বিষয়গুলো গুরুত্ব দিয়ে দেখেননি, কেউ হয়তো এগুলোকে বড় কোনো সমস্যা মনে করেননি। কিন্তু আকীদা ও বিশ্বাসের প্রশ্নে এ বিষয়গুলোকে হালকাভাবে দেখার কোনোই সুযোগ নেই।
গণুভ্যুত্থান-পরবর্তী বাংলাদেশে ইসলাম ও মুসলিমদের জন্য আকীদা ও বিশ্বাসের ক্ষেত্রে নীরব ভাইরাসরূপে আত্মপ্রকাশ করা সমস্যা অনেক হলেও এখানে আমরা মৌলিক তিনটি সমস্যা নিয়ে আলোচনা করছি।
১. স্বৈরাচার ও খিলাফত
'২৪-এর গণঅভ্যুত্থান ছিল স্বৈরাচার হাসিনা ও তার দীর্ঘ জুলুমের বিরুদ্ধে আক্ষরিক অর্থেই এক গণবিস্ফোরণ। হাসিনার টানা ১৬ বছরের শাসনে শুধু ইসলামপন্থিরাই নয়, গণতান্ত্রিক রাজনীতির অংশীদার বিরোধীদলীয় নেতাকর্মীদেরও কঠোরভাবে দমন করা হয়েছে। অগণতান্ত্রিক ইসলামপন্থিদের দমন করা হয়েছে জঙ্গিবাদের ধোঁয়া তুলে, গণতান্ত্রিক ইসলামপন্থিদের দমন করা হয়েছে রাজাকারের তকমা দিয়ে আর সেকুলার বিরোধীদলীয় নেতাকর্মীদের দমন করা হয়েছে বিভিন্ন মিথ্যা মামলায় ফাঁসিয়ে। এ ছাড়াও ভারতের তাবেদারি ও হিন্দুত্ববাদি এজেন্ডা তো ছিলই। এ সব কারণে স্বাভাবিকভাবেই বাংলাদেশের মুসলিম জনসাধারণের মধ্যে হাসিনার স্বৈরাচারী শাসনের বিরুদ্ধে তীব্র ক্ষোভ জমেছে। যার বিস্ফোরণ ঘটেছে জুলাই গণঅভ্যুত্থানে।
গণঅভ্যুত্থান-পরবর্তী সময়ে আমরা দেখেছি মানুষের মধ্যে স্বৈরাচারবিরোধী মনোভাব কতটা তীব্র আকার ধারণ করেছে। কিন্তু একশ্রেণির বুদ্ধিজীবী মানুষের এই স্বৈরাচারবিরোধী মনোভাবকে কাজে লাগিয়ে ইসলামের খিলাফত ও শরয়ী শাসনব্যবস্থার বিরুদ্ধে বিষোদগার শুরু করেছে। তারা মানুষকে বোঝানোর চেষ্টা করেছে, টানা ১৬ বছর ক্ষমতায় থেকে হাসিনা যেভাবে স্বৈরাচার হয়ে উঠেছে, তেমনই ইসলামী শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হলে, খিলাফত কায়েম হলেও শাসক স্বৈরাচার হয়ে উঠবে। নয়া বন্দোবস্তের ধ্বজাধারীরা জোরেশোরে প্রচার করেছে, তারা স্বৈরাচার তৈরির পথ চিরতরে বন্ধ করতে চায়; হোক সেটা গণতান্ত্রিক স্বৈরাচার, কিংবা 'ইসলামী স্বৈরাচার'। তাদের দৃষ্টিতে শরয়ী শাসনব্যবস্থা স্বৈরাচার তৈরি করে। একজন তো এ কথাও বলেছিল, 'গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় আমরা প্রতি পাঁচ বছরে সরকার পরিবর্তনের সুযোগ পাই, শরয়ী শাসনে তো এ ধরনের কোনো সুযোগও নেই।' এভাবে মানুষের হাসিনা ও স্বৈরাচারবিরোধী ক্ষোভকে কাজে লাগিয়ে ইসলামী খিলাফত ও শরয়ী শাসনব্যবস্থার প্রতি বিরূপ মনোভাব তৈরির কাজ চলছে, যা ইসলাম ও মুসলিমদের জন্য চরম ক্ষতিকর।
গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় তৈরি হওয়া স্বৈরাচার আর ইসলামী শাসনব্যবস্থার আমীর বা খলীফা কি এক? অবশ্যই না। কিন্তু তারা মানুষকে এটাই বোঝানোর চেষ্টা করেন। তারা বলতে চান, ইসলামী শাসনব্যবস্থা কায়েম হলে শাসকরা স্বৈরাচার হবে। কারণ, প্রতি পাঁচ বছরে শাসক পরিবর্তনের কোনো সুযোগ থাকবে না। শাসকরা আজীবন ক্ষমতায় থাকবে। ইত্যাদি...
তাদের এই অপপ্রচার মোটাদাগে ইসলামী শাসনব্যবস্থার প্রতি তীব্র হুমকি তৈরি করছে। জনমনে ইসলামী শাসনব্যবস্থা নিয়ে সংশয় দানা বাঁধছে। মানুষ শরয়ী শাসন নিয়ে দ্বিধান্বিত হতে শুরু করেছে। শরয়ী শাসনের প্রতি আগে থেকেই যে ভীতি তৈরি করে রাখা হয়েছে, নতুন এই অপপ্রচারের ফলে তা আরও বৃদ্ধি পাচ্ছে। এতে ইসলামী শাসন কায়েম করতে চাওয়া দল ও আন্দোলনের জন্য নিজেদের পথচলা আরও কঠিন হয়ে যাচ্ছে। দীনের অতন্দ্র প্রহরী উলামায়ে কেরাম ও মুজাহিদ ভাইদের অবশ্যই এ বিষয়ে নজর দেওয়া উচিত। হাসিনা ১৬ বছর ক্ষমতায় থেকে কেন স্বৈরাচার হয়ে উঠল আর খলীফা ৫০ বছর শাসন করলেও কেন স্বৈরাচার হয়ে উঠবে না, এই প্রশ্নের উত্তর মানুষের সামনে স্পষ্ট করা উচিত। অন্যথায় বাংলাদেশের বাস্তবতায় ইসলামী শাসন প্রতিষ্ঠার পথে অসংখ্য জটিলতার সাথে নতুন মাত্রা যোগ হবে।
২. জাতীয়তাবাদ
দ্বিতীয় যে মৌলিক সমস্যাটি গণঅভ্যুত্থান-পরবর্তী বাংলাদেশে নতুন করে মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে, তা হলো জাতীয়তাবাদ। গণঅভ্যুত্থানে যেহেতু ডান-বাম ও সেকুলার-ইসলামিক সব ভাবধারার অংশগ্রহণ ছিল এবং সকলেরই মৌলিক লক্ষ্য ছিল হাসিনার পতন, তাই গণঅভ্যুত্থান চলাকালে সব ভাবধারার বহিঃপ্রকাশ আমরা দেখেছি। কিন্তু হাসিনার পতনের পর সকলের সম্মিলিত লক্ষ্য যখন অর্জন হয়ে গেল, তখন দেখা দিল আসল সমস্যা। পরস্পরবিরোধী বিশ্বাস ও চিন্তাধারার মানুষদেরকে ঐক্যবদ্ধ রাখতে এখন আর 'স্বৈরাচারী হাসিনা' ছিল না, তাই বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদকে সামনে আনা হলো নতুনভাবে।
গণঅভ্যুত্থানের পর আমরা দেখেছি ইসলামপন্থি রাজনীতি কীভাবে জাতীয়তাবাদকে সাদরে গ্রহণ করেছে। নিজেদের অস্তিত্বের জানান দিতে কিংবা গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে নিজেদের বৈধতা উৎপাদনের জন্য জাতীয়তাবাদ ছাড়া অন্য কোনো উপায় তারা খুঁজে পাননি। যে জাতীয়তাবাদ মুসলিম উম্মাহকে শতধা বিভক্ত করেছে, যে জাতীয়তাবাদের কারণে গাযার ভাইদের আমরা সাহায্য করতে পারছি না, যে জাতীয়তাবাদের কারণে আল-আকসা আজও পরাধীন, সেই জাতীয়তাবাদকেই এখন নতুনভাবে আমাদের সামনে পেশ করা হচ্ছে। আর আমরা গর্বভরে এই জাতীয়তাবাদের আফিম গিলে যাচ্ছি। পূর্ণাঙ্গ ইসলামী বিপ্লবের পথে এই জাতীয়তাবাদ বিরাট বড় একটি বাধা হয়ে দাঁড়াবে। বাংলাদেশপন্থার উত্থান অবশ্যই বৈশ্বিক খিলাফতের অধীনতা মেনে নিতে অস্বীকার করবে। সাধারণ জনগণ তো দূরের কথা, উম্মতের রাহবার উলামায়ে কেরাম যখন জাতীয়তাবাদকে সাদরে গ্রহণ করে নিচ্ছেন, তখন এই বিপদ কতটা ভয়াবহ হবে, তা বলাই বাহুল্য।
সাধারণ মুসলিমদের কাছে জাতীয়তাবাদ আগে থেকেই গ্রহণযোগ্য ছিল, এখন তা আরও শক্তভাবে প্রোথিত হচ্ছে। উলামায়ে কেরামের কাছে জাতীয়তাবাদের গ্রহণযোগ্যতা একে সাধারণ মানুষের মধ্যে আরও বেশি মজবুত করে তুলছে। অথচ এই জাতীয়তাবাদই মুসলিম উম্মাহর পতন ও পরাজয়ের অন্যতম কারণ। আরব জাতীয়তাবাদের উত্থানের কারণেই উসমানী খিলাফতের ধ্বংস ত্বরান্বিত হয়েছিল। সেই ইতিহাস হয়তো আমরা ভুলে গিয়েছি। কিন্তু এই জাতীয়তাবাদই বৈশ্বিক খিলাফতের আনুগত্যের পথে বাধা হয়ে দাঁড়াবে। তাই, এই আসাবিয়্যাত ও জাতীয়তাবাদের ব্যাধি মোকাবিলার পদ্ধতি নিয়েও চিন্তা করা উচিত।
৩. সেকুলারিজম
'২৪-এর গণঅভ্যুত্থান নিঃসন্দেহে কোনো ইসলামী অভ্যুত্থান বা বিপ্লব ছিল না। তবে, এই অভ্যুত্থানে ইসলাম ও মুসলিমদের বিপুল অংশগ্রহণ ছিল। কিন্তু, এই অভ্যুত্থানের নেতৃত্ব ও কর্তৃত্ব ছিল সেকুলারদের হাতে। যার কারণে সেকুলার আদর্শের সাগরে ইসলামী আদর্শ মিলেমিশে একাকার হয়ে গিয়েছে। সেকুলারিজমের চটকদার শিরোনামে প্রতারিত হয়ে সাধারণ জনগণও একে গ্রহণ করে নিচ্ছে। গণঅভ্যুত্থান চলাকালে আমরা দেখেছি মসজিদের মাইক ব্যবহার করে প্রতিরোধের ঘোষণা দেওয়া হচ্ছে। আন্দোলনে যাওয়ার আগে ছেলেমেয়েরা বাবা-মায়ের কাছে চিঠি লিখে যাচ্ছে যে, সে শহীদ হতে চায়। গায়েবানা জানাযার প্রতীকী প্রতিবাদও আমরা দেখেছি। ইসলাম ও ইসলামী শিয়ারের এই ব্যবহারগুলো অনেক শক্তিশালী ছিল, কিন্তু সেকুলারিজমের তোড়ে সব ভেসে গিয়েছে। ইসলামপন্থিদের এই অংশগ্রহণকে স্বীকৃতির নাম দিয়ে সেকুলাররা তাই আজ তামাশা করে। 'মাদরাসা রেজিস্ট্যান্স ডে' নাম দিয়ে একটি অনুষ্ঠান করেই বোঝাতে চায়, ইসলামপন্থিদের ঋণ তারা শোধ করেছে আর আমরাও খুশিমনে মেনে নিই। সেকুলারদের সাথে তাল মিলিয়ে চলার জন্য আমরাও তাই সেকুলার রাজনীতিতে অংশ নিই। ইলমে ওহীর ধারক-বাহক উলামা-তলাবা যখন সমভিব্যাহারে সেকুলার দলে শরীক হন, সেকুলার রাজনীতিতে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন, উলামা উইং গঠন করেন, তখন আমাদের অশ্রু বিসর্জন দেওয়া ছাড়া আর কোনো উপায় থাকে না। নতুন বাংলাদেশ গড়ার নামে আর নিজেদের স্টেক ধরে রাখার দাবিতে সেকুলারিজমকে গ্রহণ করা ও সেকুলার রাজনীতিতে অংশগ্রহণ করা ভবিষ্যৎ ইসলামী বিপ্লবের পথে সবচেয়ে বড় বাধা হয়ে দাঁড়াবে। সাধারণ মানুষ সেকুলার রাজনীতিতে জড়িত উলামায়ে কেরামকে দেখিয়ে প্রশ্ন তুলবে ইসলামী শাসনের বিরুদ্ধে। তাই, সেকুলারিজম প্রশ্নে সাধারণ মানুষকে সঠিক বার্তা দেওয়া উচিত।
এরই সাথে তাল মিলিয়ে শুরু হয়েছে গণতন্ত্রের স্বাভাবিকীকরণ। গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে ইসলামপন্থিদের ব্যাপক অংশগ্রহণ সাধারণ মানুষের মনে গণতন্ত্রের গ্রহণযোগ্যতা ও কার্যকারিতাকে আরও পোক্ত করছে। আমরা ইসলামপন্থিরা আজ অবধি গণতন্ত্রের মোকাবিলায় ইসলামী শাসনব্যবস্থার প্রয়োজনীয়তা, কার্যকারিতা ও উপযুক্ততা নিয়ে কোনো উল্লেখযোগ্য বয়ান তৈরি করতে পারিনি; বরং গণতন্ত্রকেই আমরা গ্রহণ করেছি। গণতন্ত্র শিরক না কুফর, হালাল না হারাম—এই বিতর্ক একপাশে রেখে শুধু এতটুকু চিন্তা করাটাই আমাদের জন্য যথেষ্ট যে, এই পদ্ধতিতে কখনোই ইসলামপন্থিদের বিজয় আসবে না। অতীতেও কখনো আসেনি, আসলেও সেগুলো ছিল ক্ষণস্থায়ী। গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় ক্ষমতায় গিয়েও মুরসি টিকতে পারেননি। সুদান, আলজেরিয়া বা ইয়েমেন—কোথাও গণতন্ত্র ইসলামপন্থিদের ক্ষমতা এনে দিতে পারেনি। পারলেও ইসলামপন্থিরা নিজেদের কাঙ্ক্ষিত ইসলামী শাসনব্যবস্থা কায়েম করতে পারেনি। এত এত ঐতিহাসিক বাস্তবতা সত্ত্বেও আমরা শত বছরের ব্যর্থ এই পদ্ধতিকে গ্রহণ করেছি। বাংলাদেশের মাটিতে আরেকটি ব্যর্থতার সাক্ষী না হওয়া পর্যন্ত হয়তো আমাদের বোধোদয় হবে না।
গণতন্ত্রের প্রতি ইসলামপন্থিদের এই নমনীয়তা এবং অংশগ্রহণের কারণে বাংলার মুসলিমরা তাই আজও মনে করে, কেবল গণতন্ত্রের মাধ্যমেই মানুষের মুক্তি আসবে। গণতন্ত্র যথাযথভাবে প্রতিষ্ঠিত হলেই এ দেশের মানুষের ভাগ্য ফিরবে। সাধারণ মানুষ গণতন্ত্র ছাড়া অন্য কোনো ব্যবস্থার কথা চিন্তাও করতে পারে না, করেও না। কারণ, তাদের সামনে আমরা ইসলামী শাসনব্যবস্থাকে উপস্থাপন করতে পারিনি। গণতন্ত্রের অসারতা প্রমাণ করা তো দূরের কথা, গণতন্ত্রের কার্যকারিতা প্রমাণের প্রতিযোগিতায় মেতে উঠেছি। অথচ এই গণতন্ত্র দিয়ে আজ অবধি কোনো ভালো শাসকের আগমন ঘটেনি, ভালো সরকার প্রতিষ্ঠিত হওয়া তো দূরের বিষয়। বাংলাদেশের ইতিহাসেই গণতন্ত্র বারবার ব্যর্থ হয়েছে। বাংলাদেশে যতজন তুলনামূলক ভালো শাসকের আগমন ঘটেছে, কেউই গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় নির্বাচিত হয়ে আসেননি। কেউ এসেছেন সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে, আর কেউ এসেছেন গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে। গণতন্ত্র কেবলই অথর্ব, দূর্নীতিবাজ ও স্বৈরাচারী শাসক তৈরি করেছে। যার কারণে '৭৫, '৯০ আর সর্বশেষ '২৪-এর অভ্যুত্থান হয়েছে, মানুষ বারবার রক্ত দিয়েছে, কিন্তু মুক্তি মেলেনি। '২৪-এর গণঅভ্যুত্থানের পর আমরা আবারও সেই পুরোনো চক্রে প্রবেশ করতে যাচ্ছি। ইসলামপন্থিদের দায়িত্ব ছিল, গণতন্ত্র নামের এই স্বৈরাচার তৈরির ব্যবস্থাকে প্রত্যাখ্যান করে ইসলামী শাসনব্যবস্থার পক্ষে ঐক্যবদ্ধ অবস্থান গড়ে তোলা, সেখানে তারাই গণতন্ত্রের রক্ষাকারীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছেন। আমরা দোয়া করি, এই জমিনের মানুষের রক্ত যেন আর না ঝরে। কিন্তু আমাদের আশঙ্কা হয়, এবারের গণতন্ত্র হয়তো বাংলাদেশের মাটিতে সুদান বা মিশরের মতো বিপর্যয় ডেকে আনবে।
শেষকথা
গত ১৬টি বছর বাংলাদেশে ইসলাম ও মুসলিমদের জন্য হিন্দুত্ববাদ ও ভারতীয় আধিপত্যবাদের পর সবচেয়ে বড় হুমকি ছিল হাসিনার স্বৈরাচারী শাসন। '২৪-এর গণঅভ্যুত্থানের পর সেই হুমকি হয়তো দূর হয়েছে, কিন্তু নতুন ও জটিল কিছু হুমকি সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। ইসলামী শাসনব্যবস্থাকে স্বৈরাচারী শাসনের সাথে তুলনা করা এবং সেকুলারিজম, জাতীয়তাবাদ ও গণতন্ত্রের এই হুমকিগুলো হাসিনার স্বৈরাচারী শাসন থেকে কম ভয়ংকর নয়। হাসিনার জুলুম তো সকলেই স্বীকার করত, কিন্তু নতুনভাবে আবির্ভূত এই জাতীয়তাবাদ, সেকুলারিজম ও গণতন্ত্রকে সবাই হুমকি মনে করে না; বরং এগুলোকেই নিজেদের মুক্তির সোপান মনে করে। তাই, এই হুমকির মোকাবিলা করা নিঃসন্দেহে পূর্বের চেয়ে কঠিন হবে। ইসলামী শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা এবং বৈশ্বিক ইসলামী খিলাফতের পথ সুগম করার জন্য যারা এ জমিনে মেহনত করছেন, তাদের সামনে এগুলো অনেক বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দেখা দেবে। সাধারণ মুসলিমদের অজান্তে যে 'সুমিষ্ট বিষ' তাদের খাওয়ানো হচ্ছে, সে সম্পর্কে তাদের সচেতন করার সুকঠিন এই কাজ তবু আঞ্জাম দিতেই হবে। ভবিষ্যতের বাংলাদেশে ইসলাম ও মুসলিমদের অবস্থান কেমন হবে, তা সময়ই বলে দেবে। তবে আমাদের দায়িত্ব আমাদের আদায় করে যেতেই হবে। হাসবুনাল্লাহু ওয়া নি'মাল ওয়াকীল।
Comment