Business Deal of a Mad Man (পর্ব-২)
২০০১ সালের পর যুক্তরাষ্ট্র যে বিশ্বব্যাপী তথাকথিত "সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ" ঘোষণা করেছিল, তা আদতে একটি সামরিক প্রজেক্ট ছিল না—বরং ছিল এক দীর্ঘমেয়াদি কৌশলগত পুনঃউপনিবেশনের প্রকল্প। আফগানিস্তান এই প্রজেক্টের প্রধান পরীক্ষাগার হয়ে উঠেছিল, যেখানে যুদ্ধের নামে স্থায়ী দখলদারিত্ব, করপোরেট মুনাফা এবং সাম্রাজ্যিক উপস্থিতির চর্চা চলেছে দুই দশক ধরে। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এই যুদ্ধ নিজেই যুক্তরাষ্ট্রের ঘাড়ে বোঝা হয়ে ওঠে—বিলিয়ন বিলিয়ন ডলারের ব্যয়, ভেঙে পড়া অভ্যন্তরীণ অর্থনীতি, এবং সবচেয়ে বড় কথা, আমেরিকান নাগরিকদের মধ্যকার যুদ্ধবিরোধী ক্ষোভ। এ একধরনের সাম্রাজ্যিক ক্লান্তি, যেখানে আগ্রাসী নীতি বজায় রাখা যায় না, কিন্তু স্বীকার করাও যায় না যে “পরাজয়” হয়ে গেছে।
২০২১ সালে আফগানিস্তান থেকে যুক্তরাষ্ট্রের নাটকীয় পলায়নকে অনেকে পরাজয়ের স্বীকৃতি বললেও বাস্তবতা আরও জটিল। এটি ছিল এক সুপরিকল্পিত 'কৌশলগত ছায়া-প্রস্থান'—যার উদ্দেশ্য ছিল যুদ্ধ ক্লান্ত সাম্রাজ্যের একটি অর্থনৈতিক বিরতি নেওয়া, নতুন লড়াইয়ের জন্য শক্তি সঞ্চয়। এই পিছু হটার ফলে যে অর্থনৈতিক নমনীয়তা ও সামরিক সামর্থ্য তারা অর্জন করেছিল, তা খুব দ্রুতই অন্য কোথাও কাজে লাগানো হলো—গাজা যুদ্ধ তার তাৎক্ষণিক প্রমাণ।
২০২৩ সালের গাজা আগ্রাসনের সময়ে যুক্তরাষ্ট্র ইসরাইলকে যে মাত্রার সামরিক ও কৌশলগত সহায়তা দেয়, তা পূর্ববর্তী প্রায় সব নজির ছাপিয়ে যায়। প্রায় ১৭.৯ বিলিয়ন ডলারের সরাসরি অস্ত্র সহায়তা, আকাশ প্রতিরক্ষা প্রযুক্তির হালনাগাদ, এবং পৃথকভাবে ৪.৮৬ বিলিয়ন ডলারের অতিরিক্ত মোতায়েন ব্যয় যুক্তরাষ্ট্রকে এক নতুন যুদ্ধপন্থী মোডে ফিরিয়ে আনে। এই ব্যয় যদিও আফগান যুদ্ধের বার্ষিক খরচের তুলনায় অপেক্ষাকৃত কম, কিন্তু কৌশলগতভাবে অনেক বেশি লক্ষ্যনীয়। কারণ, আফগানিস্তানে মোতায়েন থাকা অবস্থায় এইরকম একযোগে মধ্যপ্রাচ্যে বড়সড় কৌশল বাস্তবায়ন করার সক্ষমতা ছিল না। অর্থাৎ, আফগান প্রস্থান কেবলই কৌশলগত পিছু হটা ছিল না, বরং নতুন অগ্রযাত্রার প্রস্তুতি।
দক্ষিণ এশিয়াতেও এই নতুন মার্কিন কৌশল ধীরে ধীরে স্পষ্ট হয়ে উঠছে। একদিকে যুক্তরাষ্ট্র ভারতকে অস্ত্র, প্রযুক্তি ও কূটনৈতিক সহায়তার মাধ্যমে চীনের বিরুদ্ধে একটি 'বাফার-রাষ্ট্রীয় ভূমিকায়' ঠেলে দিচ্ছে, অন্যদিকে পাকিস্তানের সঙ্গে সামরিক সম্পর্কের ঐতিহাসিক টানাপোড়েন সত্ত্বেও, পেন্টাগনের সঙ্গে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক টিকে আছে। সাবেক প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের একটি দাবি এই প্রেক্ষাপটে বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ—তিনি বলেছিলেন, তার ব্যক্তিগত হস্তক্ষেপে ভারত-পাকিস্তানের একটি সম্ভাব্য যুদ্ধ থেমে গিয়েছিল। যদিও ভারত এই দাবি অস্বীকার করে, তবুও তাদের পক্ষ থেকে কোনো জোরালো প্রতিবাদ বা কূটনৈতিক প্রতিবেশ প্রতিফলিত হয়নি। এটি ইঙ্গিত দেয় যে, ট্রাম্পের কথার পেছনে কোনো না কোনো বাস্তবতা নিশ্চয় ছিল। অন্যদিকে, পাকিস্তানের সেনাপ্রধানের সঙ্গে তার সৌজন্য ভোজ কিংবা পেন্টাগনের আগ্রহের ধরন স্পষ্ট করে যে, যুক্তরাষ্ট্র এই অঞ্চলকেও একটি নিয়ন্ত্রিত দ্বন্দ্বক্ষেত্র হিসেবে ব্যবহার করছে, যেখানে তারা কখনও আগুন জ্বালায়, আবার কখনও পানি ঢেলে নিভিয়ে দেয়—সবই তাদের বৈশ্বিক শৃঙ্খলা প্রকল্পের অংশ।
সবচেয়ে নাটকীয় এবং চিন্তাশীল উদাহরণ দেখা যায় ইরান-ইসরাইল টানাপোড়েনের সময়। যখন ইরানের প্রতিরোধ এবং ইসরাইলের বেপরোয়া আগ্রাসন বিশ্বযুদ্ধের আশঙ্কা সৃষ্টি করেছিল, তখন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে ঘটে এমন একটি কাণ্ড, যা একদিকে অদ্ভুত, অন্যদিকে আশঙ্কাজনক। ডোনাল্ড ট্রাম্প এক বক্তৃতায় বলেন, “আমি শান্তির জন্য বোমা ফেলছি।” এটি শুনতে যতই হাস্যকর মনে হোক, বোমাটি ফেলার পরপরই যুদ্ধ-উত্তেজনার পারদ এক রহস্যজনকভাবে নেমে আসে এবং শান্তি আলোচনা শুরু হয়। এটিকে কোনো কাকতালীয় ঘটনা হিসেবে দেখার সুযোগ নেই। বরং এটি ছিল একধরনের "coercive diplomacy"—বোমা দিয়ে বার্তা পাঠানোর কৌশল। এর মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র এমন এক বার্তা দেয়: “আমরাই যুদ্ধ শুরু করতে পারি, আমরাই থামাতে পারি।” এই ছায়া-সরকারি নিয়ন্ত্রণ যুক্তরাষ্ট্রকে একটি ‘গ্লোবাল ফায়ারফাইটার’-এর মুখোশে এক ‘পাইরোম্যানিয়াক’ হিসাবে প্রতিষ্ঠা করে—আগুন নিজেরা লাগায়, আবার দমকল বাহিনী হিসেবেও আবির্ভূত হয়।
(চলবে)
Comment