Announcement

Collapse
No announcement yet.

আমি তৃতীয় শ্রেণীর নাগরিক -২

Collapse
This is a sticky topic.
X
X
 
  • Filter
  • Time
  • Show
Clear All
new posts

  • আমি তৃতীয় শ্রেণীর নাগরিক -২

    বাংলাদেশের রাজনৈতিক ও সামাজিক অঙ্গনে নাগরিকদের অবস্থানকে যদি একটি অদৃশ্য ত্রিস্তরীয় কাঠামোতে বিন্যস্ত করা হয়, তবে এর শীর্ষে রয়েছেন ‘রাজনৈতিক নাগরিক’—ক্ষমতার কেন্দ্রে থাকা সেই শ্রেণি, যারা রাষ্ট্রীয় নীতি ও সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়াকে সরাসরি নিয়ন্ত্রণ করেন। দ্বিতীয় স্তরে রয়েছেন ‘সাধারণ নাগরিক’—এক বিশাল জনগোষ্ঠী, যারা রাষ্ট্রযন্ত্রের নিষ্ক্রিয় ভোক্তা। এই কাঠামোর তৃতীয় এবং সবচেয়ে প্রান্তিক স্তরে অবস্থান করছেন ‘ইসলামপন্থী নাগরিকগণ’। আধুনিক, ধর্মনিরপেক্ষ জাতীয়তাবাদী রাষ্ট্রকাঠামোর সঙ্গে আদর্শগতভাবে একীভূত হতে না পারার কারণে এই জনগোষ্ঠী প্রতিনিয়ত এক ধরনের রাজনৈতিক ও সামাজিক বিচ্ছিন্নতার ও জুলুমের শিকার। এই দীর্ঘস্থায়ী প্রান্তিকীকরণের কারণ কোনো একক ঘটনায় নিহিত নয়, বরং তা তাদের নেতৃত্ব, কৌশল এবং সাংগঠনিক দর্শনের গভীরে প্রোথিত। এর প্রধান তিনটি কারণ নিম্নরূপ:
    ১. নৈতিক দায়বদ্ধতার সংকট (Lack of Moral Responsibility): যেকোনো গণ-আন্দোলনের প্রাণশক্তি হলো তার নেতৃত্বের নৈতিক ভিত্তি এবং অনুসারীদের অটুট আস্থা। বাংলাদেশের ইসলামপন্থী রাজনীতির অন্যতম প্রধান দুর্বলতা হলো এই নৈতিক দায়বদ্ধতার গভীর সংকট। যখন কোনো আন্দোলন কৌশলগত ভুলে বা সাংগঠনিক দুর্বলতার কারণে বিপর্যয়ের সম্মুখীন হয়, তখন নেতৃত্বের প্রধান দায়িত্ব হলো সেই ভুল প্রকাশ্যে স্বীকার করে অনুতপ্ত হওয়া এবং ভবিষ্যৎ কর্মপন্থা সংশোধনের সুস্পষ্ট প্রতিশ্রুতি দেওয়া। এই স্বচ্ছতা ও সততাই সাধারণ কর্মী ও সমর্থকদের মধ্যে এই বিশ্বাস তৈরি করে যে, নেতৃত্ব তাদের প্রতি অঙ্গীকারবদ্ধ এবং তাদের সুরক্ষার জন্য আন্তরিক।

    কিন্তু বাংলাদেশের ইসলামপন্থী রাজনীতির ইতিহাসে বারবার দেখা গেছে, বড় ধরনের বিপর্যয়ের পরও নেতৃত্ব কোনো প্রকার নৈতিক দায় গ্রহণ করতে নারাজ। তারা প্রায়শই সব ব্যর্থতার জন্য কেবল বাহ্যিক ষড়যন্ত্র বা প্রতিপক্ষের দমন-পীড়নকে একমাত্র কারণ হিসেবে চিহ্নিত করে। এই একপেশে ব্যাখ্যা হয়তো সাময়িকভাবে কর্মীদের মনোবল ধরে রাখতে সাহায্য করে, কিন্তু দীর্ঘমেয়াদে তা নেতৃত্বের প্রতি আস্থাহীনতার জন্ম দেয়। যখন সাধারণ কর্মীরা দেখে যে, তাদের ত্যাগ, শ্রম এবং জীবনের ঝুঁকি সত্ত্বেও নেতৃত্ব নিজেদের কৌশলগত ভুলগুলো পর্যালোচনা করতে প্রস্তুত নয়, তখন তাদের মনে এই ধারণা দৃঢ়ভাবে গেঁথে যায় যে, ভবিষ্যতে আরেকটি সংকটে নেতৃত্ব তাদের রক্ষা করতে বা দায়িত্ব নিতে এগিয়ে আসবে না। এই আস্থাহীনতার বীজ একবার রোপিত হলে, পরবর্তীতে বৃহৎ পরিসরের আন্দোলনের ডাকে জনশক্তিকে একত্রিত করা বা সংগঠিত শক্তি প্রয়োগের ক্ষেত্র তৈরি করা কার্যত অসম্ভব হয়ে পড়ে।

    ২. অভ্রান্ত নেতৃত্বের ধারণা (Fault Aversion Symdrom): ইসলামপন্থী রাজনীতির দ্বিতীয় গভীর সংকটটি হলো ‘অভ্রান্ত নেতৃত্বে’র ধারণা—এক ধরনের মনস্তাত্ত্বিক বিশ্বাস যা প্রচার করে যে, নেতারা ভুলের ঊর্ধ্বে এবং তাদের প্রতিটি সিদ্ধান্তই অভ্রান্ত। সমাজবিজ্ঞানী ম্যাক্স ভেবারের ‘ক্যারিশম্যাটিক অথরিটি’ বা সম্মোহনী নেতৃত্বের তত্ত্ব অনুযায়ী, এই ধরনের নেতৃত্ব অনুসারীদের মধ্যে তীব্র আবেগ ও প্রশ্নাতীত আনুগত্য তৈরি করতে পারে। কিন্তু এর প্রধান দুর্বলতা হলো, এটি প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ, যৌক্তিক সমালোচনা এবং আত্মসমালোচনার অভাবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ভঙ্গুর ও স্থবির হয়ে পড়ে। যখন নেতৃত্বকে ভুলের ঊর্ধ্বে স্থাপন করা হয়, তখন তারা বাস্তবতার সঙ্গে সংযোগ হারিয়ে ফেলে এবং কৌশলগত নমনীয়তা বিসর্জন দেয়। ফলে, পরিবর্তিত রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে নতুন কৌশল গ্রহণ বা পুরনো ভুল থেকে শিক্ষা নেওয়ার পথ রুদ্ধ হয়ে যায়।

    ইসলামের ইতিহাসে এর শ্রেষ্ঠ উদাহরণ স্বয়ং মহানবী (সা.)-এর সিরাত। বদর যুদ্ধের মতো গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তেও তিনি সাহাবীদের সঙ্গে পরামর্শ করে নিজের কৌশলগত অবস্থান পরিবর্তন করেছেন, যা নেতৃত্বের নমনীয়তা, দূরদর্শিতা এবং সম্মিলিত প্রজ্ঞার প্রতি শ্রদ্ধার পরিচায়ক। আল্লাহর রাসূল (সা.) যদি মানবজাতির শ্রেষ্ঠ হয়েও ভুল থেকে শিক্ষা নিতে পারেন এবং পরামর্শ গ্রহণ করতে পারেন, তবে সাধারণ মানুষের পক্ষে নেতাদের ভুলের ঊর্ধ্বে ভাবার কোনো অবকাশ নেই। কিন্তু বাংলাদেশে ইসলামপন্থী দলগুলোর মধ্যে এই ‘অভ্রান্ততার সংস্কৃতি’ এতটাই প্রবল যে, যেকোনো ধরনের গঠনমূলক সমালোচনা বা ভিন্নমতকে প্রায়শই ‘বিশ্বাসঘাতকতা’ বা ‘ষড়যন্ত্র’ হিসেবে দেখা হয়। এই চিন্তাগত অচলায়তনের কারণে সাধারণ কর্মী ও সমর্থকদের মধ্যে বাস্তবতার সঙ্গে নেতৃত্বের এক ধরনের মানসিক বিচ্ছিন্নতা তৈরি হয়। তারা নেতাদের কথা ও কাজের মধ্যে অসংগতি খুঁজে পায়, যা তাদের আস্থা ও আনুগত্যকে ভেতর থেকে ক্ষয় করে দেয় এবং সংগঠনকে একটি জীবন্ত সত্তার বদলে একটি অনড় কাঠামোতে পরিণত করে।

    ৩. পশ্চাৎ থেকে নেতৃত্বদানের মানসিকতা (Backseat Driving Mentality): যেকোনো গণ-আন্দোলন বা বিপ্লবের চালিকাশক্তি হলো নেতৃত্বের সম্মুখভাগের উপস্থিতি এবং কর্মীদের সঙ্গে তাদের একাত্মতা। ইসলামপন্থী রাজনীতির তৃতীয় এবং সবচেয়ে বড় কৌশলগত দুর্বলতাটি হলো ‘পশ্চাৎ থেকে নেতৃত্বদানের’ মানসিকতা। যখন হাজার হাজার কর্মীকে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে রাজপথে ঠেলে দেওয়া হয়, আর নেতৃত্ব নিরাপদ দূরত্বে থেকে কেবল নির্দেশনা প্রদান করে, তখন একটি অনিবার্য বিচ্ছিন্নতা ও আস্থাহীনতার সংকট তৈরি হয়। কর্মীরা যখন দেখতে পায় যে, সব ত্যাগ, শ্রম ও ঝুঁকি কেবল তাদেরই নিতে হচ্ছে, কিন্তু নেতৃত্ব তাদের পাশে এসে দাঁড়াচ্ছে না বা একই রকম ত্যাগ স্বীকার করছে না, তখন তাদের প্রাথমিক উদ্যম ও আবেগ ধীরে ধীরে স্তিমিত হয়ে আসে। এই দূরত্ব নেতৃত্বের প্রতি কর্মীদের আস্থা ও মানসিক সংযোগকে মারাত্মকভাবে দুর্বল করে দেয়।

    ইতিহাসে সফল গণ-আন্দোলনের দিকে তাকালে দেখা যায়, যেখানেই নেতৃত্ব মাঠপর্যায়ে কর্মীদের সঙ্গে একাত্ম হয়ে সংগ্রামে অংশ নিয়েছে—যেমনটি দেখা গেছে আফগানিস্তানে তালেবানের ক্ষেত্রে—সেখানেই আন্দোলন এক অটুট শক্তি অর্জন করেছে। নেতৃত্বের সরাসরি অংশগ্রহণ কর্মীদের মধ্যে এই বিশ্বাস তৈরি করে যে, তারা একা নয় এবং তাদের নেতাও একই আদর্শের জন্য জীবন বাজি রাখতে প্রস্তুত। বিপরীতে, যেখানেই নেতৃত্ব সাধারণ কর্মীদের ঝুঁকির মুখে ফেলে নিজেরা নিরাপদ দূরত্ব বজায় রেখেছে, সেখানেই আন্দোলন অভ্যন্তরীণ বিশ্বাসহীনতার কারণে দুর্বল হয়ে পড়েছে।

    বাংলাদেশেও এই ‘ব্যাকসিট ড্রাইভিং’ মানসিকতার কারণে কর্মীদের সঙ্গে নেতৃত্বের যে অদৃশ্য অথচ দুর্ভেদ্য প্রাচীর তৈরি হয়েছে, তা হয়তো আপাতদৃষ্টিতে স্পষ্ট নয়, কিন্তু এটিই ইসলামপন্থী রাজনীতির একটি টেকসই ও শক্তিশালী গণভিত্তি তৈরিতে সবচেয়ে বড় বাধা হিসেবে কাজ করছে। ফলস্বরূপ, এই আদর্শিক ও কৌশলগত সংকটগুলোই ইসলামপন্থী জনগোষ্ঠীকে রাজনৈতিক মূলধারা থেকে বিচ্ছিন্ন করে রেখেছে এবং তাদের মধ্যে ‘তৃতীয় শ্রেণির নাগরিক’ হিসেবে আত্ম-অনুভবের এক দীর্ঘস্থায়ী মনস্তত্ত্ব তৈরি করেছে।
    فَاَعۡرِضۡ عَنۡهُمۡ وَ انۡتَظِرۡ اِنَّهُمۡ مُّنۡتَظِرُوۡنَ

  • #2
    আল্লাহ্‌ তাআলা আমাদের তৃতীয় শ্রেণী থেকে থেকে উন্নীত করে দিন, অবস্থার পরিবর্তন করে দিন, প্রথমেই আমাদের মানসিকতায়। আমীন

    ভাই- রসুলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নামের শেষে পূর্ণ দুরুদ লিখলে ভালো হয়, এতে আপনারও সাওয়াব বৃদ্ধি পাবে ইনশাআল্লাহ্‌
    আর ফন্ট সাইজ ১৮/২০ দিলে ভালো হয়, জাযাকাল্লাহ খাইরান।
    বছর ফুরিয়ে যাবে এতো রিসোর্স আছে https://gazwah.net সাইটে

    Comment

    Working...
    X