৭১- এর হাঙ্গামায় হতাহতদের হুকুম
৭১ কি তাহলে আমাদের জাহিলিয়াতের ইতিহাস - এই পোস্টের প্রেক্ষিতে এক ভাই কমেন্ট করেছিলেন: ‘৭১ যদি জাহিলিয়াত হয়, তাহলে এই জাহিলিয়াতে যারা হতাহত হয়েছেন, তাদের বিধান কি?’ভাবছিলাম কমেন্টেই উত্তর দিবো, পরে মনে হলো স্বতন্ত্র পোস্ট হলে ভালো হবে।
@ প্রথমত: হতাহত উভয়পক্ষেই হয়েছে। উভয় পক্ষের হতাহতদেরই হুকুম বুঝা দরকার।
@ দ্বিতীয়ত: কোনো একটা জাহিলিয়াতেই বলি বা সহীহ প্লাটফর্মেই বলি: সকল হতাহতের হুকুম এক হয় না। একেক জন বা একেক শ্রেণীর হুকুম একেক রকম হয়।
ধরুন:
ক. কোনো একটা সহীহ জিহাদে একজন মুজাহিদ ময়দান ছেড়ে পালাতে গিয়ে পাহাড় থেকে পড়ে বা নদীতে ডুবে মারা যায়। তাকে কি শহীদ মুজাহিদ বলা যাবে? যাবে না। সে জিহাদের ময়দানে মারা গেলেও মূলত সে জিহাদ ছেড়ে দিয়ে পালিয়ে যাওয়ার মতো হারামে ছিল, জিহাদে টিকে থাকেনি।
খ. ক্ষমতা লিপ্সায় পতিত দুটি রাজনৈতিক দলের মারামারির মাঝখানে পড়ে একজন সাধারণ মুসলমান মারা যায়, যে কোনো দলেই ছিল না, বাজার করতে গিয়েছিলো। উভয়পক্ষের গুলাগুলিতে হাঙ্গামায় পড়ে সে মারা যায়। আমরা তাকে এক পর্যায়ের শহীদ বলবো, যদিও ফি সাবিলিল্লাহয় জিহাদের শহীদের মতো না।
পক্ষান্তরে ঐ উভয় রাজনৈতিক দলের যেসব সদস্য মারা যাবে তারা জাহান্নামী।
একাত্তরের হতাহতদের আপনি এভাবে বিশ্লেষণ করতে পারেন, সকলের হুকুম এক হবে না।
হতাহতদের কয়েক শ্রেণিতে ভাগ করতে পারি:
ক. পাকিস্তানী সামরিক সদস্য
খ. পাকিস্তানী সাধারণ সরকারি মুসলিম কর্মচারী
গ. পাকিস্তানী সাধারণ মুসলিম জনগণ বা ব্যবসায়ী।
ঘ. বাংলাদেশী সামরিক সদস্য
ঙ. বাংলাদেশি সাধারণ সরকারি মুসলিম কর্মচারী
চ. বাংলাদেশি সাধারণ মুসলিম জনগণ
ছ. বাংলাদেশি বা ভারতীয় সাধারণ বা সামরিক হিন্দু।
যারা হতাহত হয়েছে:
- কেউ পাকিস্তানিদের হাতে
- কেউ বাংলাদেশিদের হাতে
- কেউ ভারতীয় বাহিনি, মুক্তিবাহিনি বা মুজিব বাহিনির হাতে
- কেউ স্বাধীনতার সময়ে, কেউ স্বাধীনতার পরের নিকটবর্তী সময়ে।
হয়তো আপনি একটা সোজা সমীকরণ চাইছেন: যুদ্ধ করতে গিয়ে যেসমস্ত বাংলাদেশি মুসলিম সৈন্য বা মুসলিম মিলিটারি মারা গেছে তাদের কি হুকুম? তারা কি শহীদ? তারা কি জান্নাতী? নাকি জাহান্নামী?
উত্তরে বলবো যেমনটা মূসা আলাইহিস সালামের ব্যাপারে কুরআনে কারীমে এসেছে,
قَالَ فَمَا بَالُ الْقُرُونِ الْأُولَى (51) قَالَ عِلْمُهَا عِنْدَ رَبِّي فِي كِتَابٍ لَا يَضِلُّ رَبِّي وَلَا يَنْسَى (52) {طه: 51-52}[1]
“ফেরাউন (মূসাকে দমানোর উদ্দেশ্যে) বললো, তাহলে পূর্বে যেসব জাতি (যেমন আদ, সামুদ) গত হয়েছে তাদের কি পরিণতি (হবে? তুমি কি মনে করো তাদের সবাই জাহান্নামী)? (উত্তরে) মূসা (বিতর্ক এড়িয়ে হেকমতের পথ ধরে) বললো, তাদের জ্ঞান আমার প্রতিপালকের কাছে এক কিতাবে সংরক্ষিত আছে। আমার রবের কাছ থেকে কোনো কিছু হারায় না, তিনি কিছু ভুলেও যান না (কাজেই ভালো মন্দ যার যা পাওনা সময়মতো বুঝিয়ে দিবেন, সে প্রসঙ্গ টেনে আনার প্রয়োজন এখানে নেই)।” –সূরা ত্বহা: ৫১-৫২
ভালো হয় আমরা এই বিষয়ের বেশি গভীরে না ঢুকি। যা গেছে গেছে। আমরা নতুন করে ইতিহাস রচনা করি এটাই আমাদের জন্য ভালো হবে।
তবে কয়েকটা কথা বলে রাখতে পারি:
০১. দ্বীনকে বিজয়ী করার জন্য যুদ্ধ করে মরলে শহীদ, জাতীয়তাবাদি চেতনায় মরলে শহীদ নয়। শহীদ তো এখন ব্যাপক হয়ে গেছে। কুফরি চেতনার জন্য জীবন গেলেও শহীদ, এমনকি নাস্তিক হলেও।
০২. আমি এমন লোকের কথা শুনেছি, যিনি মুক্তিযুদ্ধ ভাতা নেন না। তিনি বলেন, আমি ভুল করেছি, এর বিনিময়ে অর্থ নিতে পারি না।
০৩. সম্পর্ক খারাপ করে আত্মীয়দের থেকে আলাদা হয়ে যাওয়া এবং মুসলিম-ঐক্যবদ্ধতার মতো জাতীয় পর্যায়ের নেআমতের নাশুকরি করে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া- এমন দুটি অপরাধ, যার শাস্তি আল্লাহ তাআলা দুনিয়াতেই দিয়ে থাকেন। আমরা বাংলাদেশের মুসলিমরা জাতিগতভাবে এই শাস্তি একাত্তর থেকে আজ পর্যন্ত পেয়ে আসছি। কখনও মুজিবের হাতে নিষ্পেষিত, কখনও হাসিনার হাতে নির্যাতিত। আর সামগ্রিকভাবে ভারত ও কুফরি বিশ্বের গোলাম হয়ে থাকার লাঞ্ছনা তো আছেই।
যারা একাত্তর ঘটিয়ে মুসলিমদেরকে একতার নেআমত থেকে বঞ্চিত করেছিলো, তারাও যে সুখে আছে তা নয়। স্বজাতীর হাতেই বরং নিজের দল, নিজের লোক, নিজের কাজের সঙ্গীদের হাতেই কেউ নিহত, কেউ নির্যাতিত, কেউ পলাতক-দেশছাড়া।
এ ইতিহাস আমাদের চোখের সামনে, অস্বীকার করার সুযোগ নেই। সবচেয়ে ভালো হয়: এই কালো অধ্যায় গুটিয়ে রেখে নতুন জীবনে পা রাখা, নতুন ইতিহাস রচনা করা। আল্লাহ তাআলা আমাদের এই বাঙালী মুসলিম জাতিকে যেসব ভালো সিফাত-বৈশিষ্ট্য দিয়েছেন সেগুলোকে আল্লাহর দ্বীনের জন্য কাজে লাগানো- এটিই হবে এখন আমাদের জন্য সবচেয়ে ভালো কাজ।
[1] وقَالَ بَعْضُهُمْ: قوله: (فَمَا بَالُ الْقُرُونِ الْأُولَى) إنما سأله عن حال القرون الأولى أهم في الجنة أو في النار. تفسير الماتريدي = تأويلات أهل السنة (7/ 285)
قالَ فَما بالُ يعنى ما حال الْقُرُونِ الْأُولى (51) من قوم نوح وعاد وثمود وغيرهم الذين عبدوا الأصنام وأنكروا البعث فماذا يفعل بهم بعد موتهم؟ قالَ عِلْمُها عِنْدَ رَبِّي اى أعمالهم محفوظة عند ربّى فِي كِتابٍ مثبت في اللوح المحفوظ ... لا يضلّ ربّى اى لا يغيب عنه شيء ولا يغيب هو عن شيء- ولا ينسى ما كان من أمرهم- والمعنى ان الله مجازيهم على ما عملوا من خير او شر-. التفسير المظهري (6/ 144)
Comment