Announcement

Collapse
No announcement yet.

পাঠচক্র- ৪৪ || ইসলাম ও গণতন্ত্র ।। মাওলানা আসেম ওমর রহিমাহুল্লাহ।। চতুর্দশ পর্ব

Collapse
This is a sticky topic.
X
X
 
  • Filter
  • Time
  • Show
Clear All
new posts

  • পাঠচক্র- ৪৪ || ইসলাম ও গণতন্ত্র ।। মাওলানা আসেম ওমর রহিমাহুল্লাহ।। চতুর্দশ পর্ব

    আবাবিল প্রকাশন মিডিয়া পরিবেশিত
    ইসলাম ও গণতন্ত্র
    ।।মাওলানা আসেম ওমররহিমাহুল্লাহ।।
    এর থেকে– চতুর্দশ পর্ব


    কুরআনের আইনের উপর ঈমান আনা…একটি সংশয় এবং তার ব্যাখ্যা

    وَمَن لَّمْ يَحْكُم بِمَا أَنزَلَ اللَّهُএর ব্যাপারে আসলাফগণ যে একথা বলেছেন جاحدابه (অর্থাৎ যে ব্যক্তি আল্লাহর আইন অস্বীকার করে, আল্লাহর আইন অনুযায়ী ফয়সালা করে না, নিঃসন্দেহে সে কাফের।) এর দ্বারা মানুষের সম্ভবত এই সংশয় সৃষ্টি হয়েছে যে, এর দ্বারা উদ্দেশ্য সে এই আইনকে কুরআনের অংশ কিংবা আল্লাহর পক্ষ হতে নাযিলকৃত হওয়ার ইয়াকিন রাখে না। বিধায় কেউ যদি এর ঈমান রেখে কুরআনের আইন ব্যাতিত ফয়সালা করে, তো সেটা কুফরে আকবার নয় বরং কুফরে মাজাযী অথবা كفر دون كفرঅর্থাৎ ছোট কুফরি।


    ব্যাখ্যা

    এমন বোঝা আসলাফের ভাষ্য বুঝার ক্ষেত্রে ক্রটি। খারেজীরা যেভাবে এই আয়াত থেকে সরাসরি কুফরে আকবার উদ্দেশ্য নিয়েছে এবং এতেদালের পথ থেকে সরে গিয়েছে, তেমনিভাবে এই আয়াতে বর্ণিত কুফরিকে সরাসরি كفر دون كفر বা ছোট কুফরি সাব্যস্ত করাও আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের পথ হতে সরে যাওয়া। মনে রাখবেন, সাইয়িদিনা হযরত আবদুল্লাহ বিন আব্বাস রাযিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুমা كفر دون كفرসরাসরি ব্যবহার করেননি। বরং সাহাবায়ে কেরামের মতামত খণ্ডন করতে গিয়ে বর্ণনা করেছেন।

    আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের ওলামায়ে কেরাম এ বিষয়ে তাফসিলের সাথে আলোচনা করেছেন। পূর্বে যা উল্লেখ করা হয়েছে। আমাদের আসলাফ স্পষ্টভাবে এ কথা বলে দিয়েছেন যে, এই বিচারক এ বিষয়ের ইয়াকিন রাখে যে, চলমান মামলায় কুরআনের আইন দ্বারা ফয়সালা করা তার উপর ওয়াজিব। এর ব্যতিক্রম করলে সে গুনাহগার হবে এবং শাস্তির উপযুক্ত বিবেচিত হবে। কিন্তু সে কুরআনের আইন অনুযায়ী ফয়সালা করল না বরং শুধু এ কথা বিশ্বাস করল যে, এ আইনগুলো কুরআনের অংশ- এতটুকু মনে করা তার জন্য যথেষ্ট হবে না। ইহুদীরাও এই আয়াতকে, যা তাওরাতের অংশ ছিল, বিশ্বাস করত। কিন্তু ফয়সালার ব্যাপারে তারা এর স্থলে আরেক আইন বানিয়ে নিয়েছিল এবং সেটাকেই শরয়ী আইন প্রমাণিত করছিল। কুরআন তাদের এই আমলকে কুফরে আকবার ঘোষণা করেছে।

    এ বিষয়টিও ভাবার দাবি রাখে যে, কোনো ব্যক্তি যদি কোরআনের কোনো আয়াতকে منزل من الله অর্থাৎ আল্লাহর পক্ষ হতে নাযিলকৃত বিশ্বাস না করে, সে কেবল এই চিন্তাধারার কারণেই তাৎক্ষণাত কাফের হয়ে যাবে। তার ব্যাপারে এই আলোচনা করাই অনর্থক যে, কুরআনের আইন ব্যাতীত ফয়সালা করার দ্বারা কাফের হয় কি না? সুতরাং এই আয়াত দ্বারা এই উদ্দেশ্য কখনোই হতে পারে না। উম্মতের ওলামায়ে কেরাম এর উদ্দেশ্য এটাই বর্ণনা করেছেন যে, কুরআনের আইন অনুযায়ী ফয়সালা করা ওয়াজিব মনে করে এবং ইহা ব্যাতীত অন্য যে কোনো আইন দ্বারা ফয়সালা করাকে গুনাহ মনে করে। এ বিষয়টি ইমাম বায়যাবী, ইমাম আবু বকর জাসসাস, শাইখুল ইসলাম ইমাম ইবনে তাইমিয়া, ইমাম ইবনে কাইয়িম জাওযিয়া, ইমাম ইবনে আবিল ইজ হানাফী, হাকীমুল উম্মাত মাওলানা আশরাফ আলী থানভী (রাহিমাহুমুল্লাহ) প্রমুখ ব্যক্তিতগণ আরও স্পষ্ট করে বর্ণনা করেছেন। আহলে ইলম হযরতদের ইমাম সাহেব রহমাতুল্লাহি আলাইহির “ইবারত' (ভাষ্য) গভীরভাবে লক্ষ্য করা উচিত। এমনকি অনেক তাফসীরকারকগণ ومن لم يحكمএর তাফসীরে সংক্ষিপ্তভাবে শুধু এতটুকু বলেছেন যে, তারা আল্লাহর নাযিলকৃত (আইনের) উপর ঈমান রাখে না। কিন্তু এর উদ্দেশ্য সেটাই যা উম্মতের অন্যান্য মুফাসসিরগণ করেছেন, যে, এর দ্বারা ফয়সালা ওয়াজিব মনে করে। (দলিল ও প্রমাণাদি সামনে আসছে)।

    قال ابن مسعود والسدي : من ارتشي في الحكم وحكم فيه بغير الله فهو كافر

    হযরত আবদুল্লাহ বিন মাসউদ রাযিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু এবং ইমাম সুদ্দি রহমাতুল্লাহি আলাইহি বলেন, যে ব্যক্তি ফয়সালা করতে ঘুষ নিল এবং আল্লাহর আইন ব্যাতীত অন্য আইনে ফয়সালা করল, সেই বিচারক কাফের।[1]


    ফায়দা

    এই দুই হযরতের নিকট এমন ব্যক্তি পুরোপুরি কাফের।

    قال ابن مسعود وحسن : هي عامة في كل من لم يحكم بما أنزل الله من المسلمين واليهود والكافر أي معتقدا ذلك ومستحلاله فأما من فعل ذلك وهو معتقد أنه راكب محرم فهو من فساق المسلمين....

    হযরত আবদুল্লাহ বিন মাসউদ রাযিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু এবং হযরত হাসান বসরী রহমাতুল্লাহি আলাইহি বলেন, আয়াতটি মুসলমান, ইহুদী এবং অন্যান্য কাফেরদের বেলায়ও প্রযোজ্য। অর্থাৎ যে ব্যক্তি আল্লাহর শরীয়ত দ্বারা ফয়সালা না করবে এবং নিজের কাজকে সঠিক (আইনসম্মত) হওয়ার বিশ্বাস লালন করবে (সে ব্যক্তি স্পষ্ট কাফের)। তবে হ্যাঁ, যে ব্যক্তি এটাকে হারাম মনে করে করবে, সে ব্যক্তি ফাসেক মুসলমানদের অন্তর্ভুক্ত। [2]

    আজকের প্রচলিত গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা নিয়ে একটু ভাবুন এবং ফয়সালা করুন যে, বিচার বিভাগের অধিকাংশ লোক কি এ সব ফয়সালাকে গুনাহ মনে করে? তাদের নিকট এটা তো অনেক বড় কল্যাণের কাজ । অনেক বড় ভালো ও পবিত্র কাজ। বলুন, প্রচলিত বিচার বিভাগ কি কুরআন ব্যতীত অন্য আইন দ্বারা ফয়সালা করাকে হালাল ও আইন সম্মত মনে করে না?

    হযরত হুযাইফা বিন ইয়ামান রাযিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুকে জিজ্ঞাসা করা হয়, এই আয়াতটি কি ইহুদীদের ব্যাপারে নাযিল হয়েছে? তিনি বলেন-
    জি হ্যাঁ, কিন্তু তোমরা (এই উম্মত) ইহুদীদের পথে পায়ে পায়ে চলবে ।[3]

    আল্লামা আলুসী রহমাতুল্লাহি আলাইহি রুহুল মাআনীতে ইমাম শাআবী রহমাতুল্লাহির এই রেওয়ায়েত নকল করেছেন-

    وَمَن لَّمْ يَحْكُم بِمَا أَنزَلَ اللَّهُ فَأُولَٰئِكَ هُمُ الْكَافِرُونَ…. وَمَن لَّمْ يَحْكُم بِمَا أَنزَلَ اللَّهُ فَأُولَٰئِكَ هُمُ الْفَاسِقُونَ..... وَمَن لَّمْ يَحْكُم بِمَا أَنزَلَ اللَّهُ فَأُولَٰئِكَ هُمُ الظَّا لِمُونَ

    সূরা মায়েদার এই আয়াত তিনটির প্রথমটি এই উম্মতের ব্যাপারে, দ্বিতীয়টি ইহুদীদের ব্যাপারে আর তৃতীয়টি খ্রিস্টানদের ব্যাপারে।

    আল্লামা আলুসী রহমাতুল্লাহি আলাইহি বলেন-

    এই ভিত্তিতে আবশ্যক, মুসলমানদের অবস্থা ইহুদী-নাসারাদের থেকেও করুণ হবে।[4]

    বর্তমানের কুফরি বিচার ব্যবস্থাকে ইসলামী প্রমাণকারীরা এবং কুফরি গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে ইসলামী সাব্যস্তকারীরা ইহুদী-নাসারাদের থেকেও এক ধাপ এগিয়ে নয় তো কি?

    তাফসীরে ইবনে জাযী'তেও (تفسير ابن جزي) ইমাম শাফেয়ী রহমাতুল্লাহি আলাইহির এক কওল বর্ণনা করা হয়েছে যে-

    এই আয়াতে কাফের হওয়ার বিষয়টি মুসলমানদের ব্যাপারে। (অর্থাৎ যে ব্যক্তি আল্লাহর শরীয়ত দ্বারা ফয়সালা না করবে)

    বিখ্যাত হানাফী ফকীহ এবং মুফাসসির ইমাম নাসাফী রহমাতুল্লাহি আলাইহি (মৃত্যু: ৭১০ হিজরী) তাফসীরে নাসাফীতে বলেন-

    اي مستهينا به

    অর্থাৎ যে ব্যক্তি আল্লাহর শরীয়তকে কম গুরুত্বপূর্ণ মনে করে এর আলোকে ফয়সালা করে না, সে কাফের।

    বর্তমানের গণতান্ত্রিক জীবনব্যবস্থার মোকাবেলায় নিফাযে শরীয়ত তথা শরীয়তের আইন চালু করাকে কি অবেজ্ঞয় মনে করা হচ্ছে না? তবে তোপ-কামান ও যুদ্ধ কিসের? দিল্লির সুপ্রিমকোর্ট কার মহত্বের দাস্তান শোনায়? ইসলামাবাদের উচ্চ আদালতে আল্লাহর আইনের কি হাশর করা হচ্ছে? সংসদে তৈরিকৃত আইন ওহী থেকেও উপরের, ওহী থেকেও অধিক মর্যাদাপূর্ণ৷ ওহীর আইন ততক্ষণ পর্যন্ত আইন হতে পারে না, যতক্ষণ সংসদ তা অনুমোদন করে না! বলুন, কোনটা বেশি গুরুত্বপূর্ণ আর কোনটা কম গুরুত্বপূর্ণ? কোন আইনের রিট ঠিক রাখার জন্য সোয়াত থেকে ওয়াজিরিস্তান পর্যন্ত যুদ্ধ চলছে? মুজাহিদরা তো আল্লাহর শরীয়তেরই দাবি করছেন?

    ইমাম বায়যাবী রহমাতুল্লাহি আলাইহির (মৃত্যু ৬৯১ হিজরী) নাম কোনো তালেবে ইলমের নিকটই নতুন নয়। তিনি তার তাফসীরে বায়যাবীতে এই আয়াতের তাফসীরে এ কথা বলেন-

    وَمَن لَّمْ يَحْكُم بِمَا أَنزَلَ اللَّهُ مستهينا به منكرا له فَأُولَٰئِكَ هُمُ الْكَافِرُونَ لاستهانتهم به وتمردهم بأن حكموا بغيره" ولذلك وصفهم بقوله الْكَافِرُونَ

    যে ব্যক্তি আল্লাহর শরীয়তের আইনকে কম গুরুত্বপূর্ণ মনে করে (অন্য আইনকে গুরুত্বপূর্ণ মনে করে), এই আইন অনুযায়ী ফয়সালা করার উজুবকে (ওয়াজিব হওয়াকে) অস্বীকার করে, এর আলোকে ফয়সালা করল না, সে ব্যক্তি কাফের। এই আইনকে কম গুরুত্বপূর্ণ মনে করার কারণে এবং এই আইন ব্যতীত অন্য আইন দ্বারা ফয়সালা করার প্রতি অটল থাকার কারণে আল্লাহ তায়ালা তাকে কাফের ঘোষণা করেছেন।

    বলুন, অনৈসলামী আইনের উপর কারা অটল রয়েছে। এর জন্য কারা যুদ্ধ করছে? এমনিভাবে আল্লামা জমখশরী রহমাতুল্লাহি আলাইহিও কারো নিকট অপরিচিত ব্যক্তিত্ব নন। তিনি তার তাফসীরে কাশশাফে এই তাফসীরই করেছেন ।



    সতর্কবাণী

    আল্লামা জমখশরী রহমাতুল্লাহি আলাইহি এবং ইমাম বায়যাবী রহমাতুল্লাহি আলাইহির এই মত যে- আল্লাহর শরীয়ত ব্যতীত অন্য আইন দ্বারা কৃত ফয়সালার উপর অটল থাকার কারণে সে কাফের- বর্তমান সময়ের গণতান্ত্রিক বিচার ব্যবস্থার বেলায় কেমন ফিট হয়? এই বিচার বিভাগ কুরআন ভিন্ন অন্য আইন দ্বারা কৃত ফয়সালার উপর বহু বছর ধরে অটল রয়েছে। বরং কুরআনের বিপরীতে তৈরিকৃত আইনের রিটকে নিশ্চিত করার জন্য লড়াই করাকে জিহাদ বলে...। আহলে হকরা কি এর হুকুম বর্ণনা করবেন?

    আবুল ফরজ ইবনে জাওযী রহমাতুল্লাহি আলাইহি (৫০৮-৫৯৭ হিজরী) যাদুল মাসির গ্রন্থে বলেন-

    وَمَن لَّمْ يَحْكُم بِمَا أَنزَلَ اللَّهُ جاحدا له" وهو يعلم أن الله أنزله" كما فعلت اليهد" فهو كافر....

    যে ব্যক্তি আল্লাহর শরীয়ত অনুযায়ী ফয়সালা করার উজুবকে অস্বীকার করে এর দ্বারা ফয়সালা করল না, অথচ সে জানে, এটা আল্লাহর নাযিলকৃত আইন, যেমন ইহুদীরা করেছিল, সে ব্যক্তি কাফের।

    এর দ্বারা জানা গেল যে, আবদুল্লাহ ইবনে আববাস রাযিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুমা এবং অন্যান্য তাফসীরকারকগণ- যারা এই আয়াতের প্রসঙ্গে বলেছেন যে, যে ব্যক্তি আল্লাহর আইন অস্বীকার করত আল্লাহর আইন বাদ দিয়ে অন্য আইন দ্বারা ফয়সালা করে- এর দ্বারা এটা উদ্দেশ্য নয় যে, সে এটাকে আল্লাহর কিতাবের অংশ বিশ্বাস করে না, বরং এর দ্বারা উদ্দেশ্য সে এই আইন অনুযায়ী ফয়সালা করার ওয়াজিব হওয়ার বিষয় স্বীকার করে না।

    হযরত মুফতী মুহাম্মাদ শফী রহমাতুল্লাহি আলাইহি ‘মাআরিফুল কুরআন'-এ وَمَن لَّمْ يَحْكُم بِمَا أَنزَلَ اللَّهُতাফসীর এভাবে করেছেন-

    যারা আল্লাহর নাযিলকৃত বিধিবিধানকে ওয়াজিব মনে করে না এবং এ অনুযায়ী ফয়সালা দেয় না, বরং এর বিপরীত ফয়সালা করে, তারা কাফের এবং মুনকির। তাদের শাস্তি জাহান্নামের চিরস্থায়ী আযাব। [মাআরেফুল কুরআন, মায়েদা: 8৪]

    হযরত হাসান বসরী রহমাতুল্লাহি আলাইহি বলেন-

    আয়াতটি ইহুদীদের ব্যাপারে নাযিল হয়েছে কিন্তু আমাদের উপরও এটা ওয়াজিব। [তাফসীরে তাবারী, সূরা মায়েদা : ৪৪]

    ইমাম আবু বকর জাসসাস রহমাতুল্লাহি আলাইহি বলেন-

    আর আবদুল্লাহ বিন মাসউদ রাযিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু, হযরত হাসান বসরী রহমাতুল্লাহি আলাইহি এবং হযরত ইবরাহীম রহামতুল্লাহি আলাইহি বলেন, এই হুকুমটি আ'ম। যে ব্যক্তি কুরআন অনুযায়ী ফয়সালা না করে গায়রুল্লাহর আইন অনুযায়ী ফয়সালা করে-তাদের সবার ক্ষেত্রেই এটি প্রযোজ্য। [আহকামূল কুরআন-৩/৫৩, আবু বকর জাসসাস]

    এমনিভাবে আবুল বখতারী রহমাতুল্লাহি আলাইহি বলেন যে, হযরত হুযাইফা বিন ইয়ামান রাযিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুকে এই আয়াত সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হয় যে, আয়াতটি কি বনী ইসরাইল সম্পর্কে নাযিল হয়েছে? উত্তরে তিনি বলেন-

    হ্যাঁ, তেবে মনে রেখো) বনী ইসরাইলও তোমাদের ভাই৷ তোমরা যদি মনে কর, মিঠা মিঠা সব তোমাদের জন্য আর তিতা তিতা সব বনী ইসরাইলের জন্য...। না! তোমরা অবশ্যই তাদের তরিকার অনুসরণ করবে। (আল্লাহ তায়ালা আমাদের হেফাজত করুন।)

    অর্থাৎ নিজেদের জন্য যা কঠিন মনে করবে, সে ক্ষেত্রে বলবে এটা বনী ইসরাইলদের জন্য ছিল। আর যেটা কঠিন মনে না হবে, তা গ্রহণ করবে।

    ইমাম ফখরুদ্দীন রাযি তার তাফসীরে বলেন-

    এই আয়াত সম্পর্কে যারা এ কথা বলেছেন যে, আয়াতটি ইহুদীদের সম্পর্কে, (তিনি বলেন) এটা দুর্বল দলিল। কারণ তাফসীরের ক্ষেত্রে শব্দের ব্যপকতা ধর্তব্য হয়, বিশেষ কারণের নয়।[5]

    তিনি আরও বলেন-

    ইমাম আতা রহমাতুল্লাহি আলাইহি (তাবেয়ী) বলেন, كفر دون كفر অর্থাৎ এখানে কুফর দ্বারা কুফরে আসগার বা ছোট কুফরি উদ্দেশ্য । আর ইমাম তাউস রহমাতুল্লাহি আলাইহি (তাবেয়ী) বলেন, আল্লাহ ও পরকাল অস্বীকার যেমন মিল্লাত থেকে খারেজ করে দেয়, এটি তেমন কুফরি নয়। তার মানে এরা এই আয়াতকে ‘কুফরে নিআমত' বলেছেন। এই মতও দুর্বল। কারণ কুফর শব্দ যখন মুতলক বলা হয়, তখন এর দ্বারা كفر في الدين(অর্থাৎ বড় কুফরি -লেখক) উদ্দেশ্য হয়ে থাকে। (প্রাগুক্ত)

    যে সব ব্যক্তিত্বগণ এ কথা বলেছেন যে, এই আয়াত দ্বারা উদ্দেশ্য হল যে ব্যক্তি সব মামলাতেই আল্লাহর আইনের পরিপন্থি ফয়সালা করে সে কাফের। যারা কিছু কিছু মামলায় এমন করে থাকে, তারা কাফের নয়। ইমাম রাযি রহমাতুল্লাহি আলাইহি তাদের কথা খণ্ডন করেছেন । তিনি বলেন-

    لو كانت هذه الآية وعيداً مخصوصاً بمن خالف حكم الله تعالي في كل ما أنزل الله تعالي لم يتناول هذا الوعيد اليهود بسب مخالفتهم حكم الله في الرجم . وأجمع المفسرون علي أن هذا الوعيد يتناول اليهود بسب مخالفتهم حكم الله في واقعة الرجم. فيدل علي سقوط هذا الجواب. والخامس: قال عكرم: وَمَن لَّمْ يَحْكُم بِمَا أَنزَلَ اللَّه إنما يتناول من أنكر بقلبه وجحد بلسانه. أما من عرف بقلبه كونه حكم الله وأقر بلسانه. إلا أنه أتي بما يضاده فهو حاكم بما أنزل الله تعالي. ولكنه تارك له . فلا يلزم دخوله تحت هذه الآية . وهذا هو الجواب الصحيح والله أعلم

    এই আয়াতে যদি বিশেষত তাদের জন্যই সতর্কবার্তা দেয়া হত, যারা সব ফয়সালাতেই আল্লাহর শরীয়তের বিরোধিতা করে, তাহলে এতে ইহুদীদের জন্য ধমকি বা সতর্কবাণী থাকত না, যারা রজমের হুকুমে আল্লাহর শরীয়তের বিরোধিতা করতেছিল। অথচ সমস্ত মুফাসিসিরগণ এ বিষয়ে একমত (ইজমা') যে এ আয়াতে সে সব ইহুদীদের জন্য ধমকি, যারা রজমের ঘটনায় আল্লাহর শরীয়তের বিরোধিতা করছিল। হযরত ইকরামা রহমাতুল্লাহি আলাইহির বক্তব্য হল, এই আয়াতে ওই ব্যক্তির হুকুম রয়েছে, যে নাকি আল্লাহর আইনকে অন্তর থেকে অস্বীকার করে এবং মুখ দ্বারাও অস্বীকার করে। তবে যে ব্যক্তি অন্তর দ্বারা আল্লাহর আইন হওয়া সত্যায়ন করে এবং মুখেও তা স্বীকার করে, কিন্তু কাজে তার বিপরীত করে, তাকে আল্লাহর আইন অনুযায়ী ফয়সালাকারীই বলা হবে; যদিও সে বিধান বর্জনকারী রূপে বিবেচ্য হবে। সে এই আয়াতের অন্তর্ভুক্ত হবে না(অর্থাৎ কাফের বলে বিবেচিত হবে না)। এই উত্তরই সঠিক।[6]


    একটি ব্যাখ্যা

    এখানে আবারও এ কথা স্মরণ করিয়ে দিচ্ছি যে, ইমাম রাযি রহমাতুল্লাহি আলাইহি, যিনি অন্তরে সত্যায়ন এবং মুখে স্বীকার করার কথা বলেছেন, এর দ্বারা উদ্দেশ্য তাই যা পূর্বে বলা হয়েছে, যে এ অনুযায়ী ফয়সালা করা ওয়াজিব হওয়ার স্বীকার করে। সেই সাথে এ কথাও স্মরণ রাখতে হবে যে, ইমাম রাযি রহমাতুল্লাহি আলাইহি এই হুকুম সেই রাষ্ট্র, বিচারক অথবা জজের ব্যাপারে বর্ণনা করেছেন, যে অন্যান্য সমস্ত বিধান কুরআন অনুযায়ী ফয়সালা করে। শুধু একটা ফয়সালা অকাট্য ও স্পষ্ট শরয়ী হুকুম কুরআনের খেলাফ করে।

    রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মোবারক জামানা থেকে নিয়ে তাতারিদের হাতে বাগদাদ পতন (৬৫৬ হিজরী মোতাবেক ১২৫৭ ঈসায়ী) হওয়া পর্যন্ত কখনোই কুরআনের বিপরীতে অন্য কোনো বিধান আইন হিসেবে প্রবর্তন করা হয়নি। আদালতে কুরআন ব্যতীত অন্য কোনো আইনে ফয়সালা হবে, উম্মত এ কথার কল্পনাও করতে পারেনি। কুরআন পরিপন্থি ফয়সালা বেশির চেয়ে বেশি এমন হত যে, কোনো বিচারক ঘুষ নিয়ে বেত্রাঘাত করে ছেড়ে দিত। উল্লেখিত আয়াত প্রসঙ্গে ছোট কুফরি ও বড় কুফরির যে আলোচনা রয়েছে, তা সেই সুরতহাল সামনে রেখেই করা হত। কারণ ওলামায়ে কেরাম সাধারণত সে কথাগুলোই বর্ণনা করতেন, যা তাদের যুগে সাধারণ মুসলমানদের বেলায় ঘটত ৷

    কিন্তু মুসলিম বিশ্বের উপর যখন তাতারি আক্রমণ করে দারুল খিলাফা বাগদাদ দখল করে নেয়, এরপর এরা মুসলমান হয়ে যায়। কিন্তু রাষ্ট্র ব্যবস্থা কুরআনের পরিবর্তে এমন আইন দ্বারা চালাতে থাকে, যার কিছু ছিল চেঙ্গিস খানের তৈরিকৃত আর কিছু ধারা ছিল ইসলামের। এটাকে ‘ইয়াসিক’ বলা হত।

    এই সুরতহাল দেখে হাফেয ইবনে কাসির রহমাতুল্লাহি আলাইহি এই আইনের ব্যাপারে ফতওয়া দেন যে-

    যে ব্যক্তি এই ‘শরীয়তে মুহকামা' ছেড়ে, যা মুহাম্মাদ ইবনে আবদুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর উপর, যিনি খাতামুন নাবিয়্যিন, নাযিল হয়েছিল এবং রহিত শরীয়ত হতে কোনো একটার নিকট ফয়সালা নিয়ে গিয়েছে, সে কাফের হয়ে গিয়েছে। তাহলে সেই ব্যক্তির কী পরিণতি হবে যে (চেঙ্গিস খানের তৈরিকৃত আইন) ইলয়াস অনুযায়ী ফয়সালা করাবে এবং সেটাকে শরীয়তে মুহাম্মাদির উপর অগ্রাধিকার দিবে? এতে কোনো প্রকার সন্দেহ নেই যে, এমন ব্যক্তি উম্মতের ইজমা অনুযায়ী কাফের সাব্যস্ত হবে। (বিদায়া ওয়ান নিহায়া, লিইবনে কাসির)

    সুতরাং আপনারাই চিন্তা করুন যে কুরআন ভিন্ন অন্য আইন দ্বারা ফয়সালাকারী আদালতকে ইসলামী বলা... কেমন জঘন্য অপরাধ?

    আবু জাফর নুহাস রহমাতুল্লাহি আলাইহি (৩৮৮ হিজরী) বলেন-

    ফুকাহায়ে কেরামের এ বিষয়ের উপর ইজমা রয়েছে যে, যে ব্যক্তি এ কথা বলবে যে, বিবাহিত যেনাকারীকে রজম করা ওয়াজিব নয়, সে কাফের হয়ে গিয়েছে। কারণ সে আল্লাহর এই আইনকে প্রত্যাখ্যান করেছে। [মাআনিল কুরআন]

    বিখ্যাত হানাফী ফকিহ ইমাম আবু লাইস সমরকন্দী রহমাতুল্লাহি আলাইহি (মৃত্যু ৩৭৫ হিজরী) তার তাফসীরে বলেন-

    يعني: اذا لم يقر ولم يبين.... يعني هذه الاية عامة فمن جحد حكم الله فهو من الكفر

    যখন সে কোনো মাসআলায় আল্লাহর শরীয়ত অনুযায়ী শাস্তির হক ও সত্য হওয়া স্বীকার করবে না এবং এই আইন বর্ণনাও করবে না.....। অর্থাৎ এই আয়াতটি আম (ব্যাপক), যে ব্যক্তিই আল্লাহর শরীয়ত অস্বীকার করবে, সে কাফেরদের অন্তর্ভুক্ত। [তাফসীরে বাহরুল উলূম লিসসমরকন্দী]

    উপমহাদেশের ওলামা মহলে নওয়াব সিদ্দিক হোসাইন খান ভূপালী রহমাতুল্লাহি আলাইহি (মৃত্যু ১৩০৭ হিজরী) অপরিচিত কোনো ব্যক্তিত্ব নন। নওয়াব সাহেব ‘নাইলুল মুরাম' গ্রন্থে এই আয়াতের তাফসীরে বলেন-

    এই আয়াতের من শব্দটি আ'ম। যার মর্ম হল, এই হুকুম বিশেষ কোনো জামাত বা দলের জন্য নির্দিষ্ট নয়। এই হুকুম প্রত্যেক বিচারক ও জজের জন্যই প্রযোজ্য। [নাইলুল মুরাম, সূরা মায়েদা : ৪৪]



    [1] প্রাগুক্ত
    [2] الجامع لأحكام القران المعرو تفسير القرطبي. الجزء6.تفسير سورة المائدة: 44 . محمد بن أحمد بن أبي بكر بن فرح القرطبي أبو عبدالله
    [3] - প্রাগুক্ত
    [4] তাফসীরে রুহল মাআনী পারা : ৫,তাফসীরে সূরা মায়েদা : ৪৪
    [5] مفاتيح الغيب المعروف تفسير الرازي: الجزء6. تفسير سورة المائدة 44.أبعبد الله محمد بن عمر بن الحسن بن الحسين التيمي الرازي الملقب بفخر الدين الرازي
    [6] مفاتيح الغيب المعروف تفسير الرازي: الجزء6. تفسير سورة المائدة 44.أبوعبد الله محمد بن عمر بن الحسن بن الحسين التيمي الرازي الملقب بفخر الدين الرازي





    আরও পড়ুন​
Working...
X