কুফরে আমলী সম্পর্কে জরুরী কয়েকটি বিষয়:
১. কাফের হওয়ার জন্য স্বেচ্ছায় কুফরী কথা বা কাজে লিপ্ত হওয়াই যথেষ্ট; এর দ্বারা কুফর উদ্দেশ্য নেয়া, দ্বীনের অবমাননা কিংবা কাফের হওয়ার ইচ্ছা থাকা জরুরী নয়:
# কোন ব্যক্তি এমন কোন কর্মে লিপ্ত হলো যা আল্লাহ তাআলা, তাঁর কোন নবী বা রাসূল, তাঁর নাযিলকৃত কোন কিতাব, তাঁর দ্বীন বা দ্বীনের কোন সুস্পষ্ট বিষয়ের অবমাননা বুঝায়; কিন্তু সে তাতে লিপ্ত হওয়ার দ্বারা কোন ধরণের অবমাননার ইচ্ছা করেনি, বরং শুধু খাহেশাতের কারণে বা দুনিয়াবী কোন স্বার্থের কারণে তাতে লিপ্ত হয়েছে- তাহলে কি সে কাফের হবে? না’কি কাফের হওয়ার জন্য অবমাননার ইচ্ছা থাকা জরুরী?
উত্তর: সে কাফের হয়ে যাবে। স্বেচ্ছায় কুফরী কর্মে লিপ্ত হওয়াই কাফের হওয়ার জন্য যথেষ্ট। এর দ্বারা অবমাননার ইচ্ছা করা শর্ত নয়।
আল্লামা শামী রহ. বলেন,
ما كان دليل الاستخفاف يكفر به وإن لم يقصد الاستخفاف.اهـ
“যা কিছুই অবমাননা বুঝায় তার দ্বারাই তাকফীর করা হবে, যদিও অবমাননা করা তার উদ্দেশ্য না হয়।” (ফাতাওয়া শামী: ৬/৩৫৬) # কেউ স্বেচ্ছায় কোন কুফরী কথা বলল কিন্তু সে এর কুফরী অর্থ উদ্দেশ্য নেয়নি এবং কাফের হয়ে যাওয়ার কোন ইচ্ছাও করেনি, বরং এমনিতেই কথার কথায়, খেলাচ্ছলে, রসিকতা করে বা ঠাট্টাস্বরূপ বলেছে মাত্র। বলার সময় এবং বলার পরেও তার অন্তরে পরিপূর্ণ ঈমান ও বিশ্বাস বহাল ছিল। এখন কি সে কাফের হয়ে যাবে? লক্ষ্যণীয় যে, সে কুফরী অর্থও উদ্দেশ্য নেয়নি, কাফের হওয়ার নিয়তও করেনি বরং তার অন্তরে পরিপূর্ণ ঈমান ও বিশ্বাস বহাল ছিল এবং আছে।
উত্তর: সে কাফের হয়ে গেছে। তার অন্তরের বিশ্বাস কোন কাজে আসবে না। বান্দার কাছেও সে কাফের আল্লাহ তাআলার কাছেও সে কাফের। দুনিয়াতেও সে কাফের আখেরাতেও সে কাফের এবং চিরস্থায়ী দোযখের অধিবাসী।
ফাতাওয়া আলমগীরিতে বলা হয়েছে,
رجل كفر بلسانه طائعا، وقلبه مطمئن بالإيمان يكون كافرا ولا يكون عند الله مؤمنا كذا في فتاوى قاضي خان.
“ইচ্ছাকৃতভাবে যে ব্যক্তি মুখে কুফরী করল অথচ তার অন্তর ঈমানে পরিপূর্ণ সে কাফের হয়ে গেছে। আল্লাহ তাআলার কাছেও সে ঈমানদার বলে ধর্তব্য হবে না। ফতাওয়া কাজী খানে এমনি আছে।” (ফাতাওয়া আলমগীরি: ২/২৮৩)আরো বলা হয়েছে,
الهازل، أو المستهزئ إذا تكلم بكفر استخفافا واستهزاء ومزاحا يكون كفرا عند الكل، وإن كان اعتقاده خلاف ذلك.
“যে ব্যক্তি অবজ্ঞাপূর্বক, উপহাসস্বরূপ কিংবা রসিকতা করে কুফরী কথা বলল সে সকলের ঐক্যমতে কাফের হয়ে গেছে, যদিও তার অন্তরের বিশ্বাস এর বিপরীত হয়।” (ফাতাওয়া আলমগীরিত: ২/২৭৬)আল্লামা কাশ্মীরী রহ. বলেন,
قال القونوى: ولو تلفظ بكلمة الكفر طائعا غير معتقد له يكفر، لأنه راض بمباشرته وإن لم يرض بحكمه، ولا يعذر بالجهل، وهذا عند عامة العلماء، خلافا للبعض ... "شرح فقه أكبر". وفيه أيضا: ثم أعلم أنه إذا تكلم بكلمة الكفر، عالما بمبناها ولا يعتقد معناها، لكن صدرت عنه من غير إكراه بل مع طواعية في تأديته، فإنه يحكم عليه بالكفر ... وهذا في "شرح الشفاء" أيضا.১/৬৯
“কূনাবী রহ. বলেন, বিশ্বাস করা ছাড়া শুধু মৌখিকভাবেও যদি স্বেচ্ছায় কুফরী কথা উচ্চারণ করে তবুও কাফের হয়ে যাবে। কেননা, সে উক্ত কুফরী কথা বলার কারণে যে বিধান তার উপর আপতিত হবে তাতে সন্তুষ্ট না হলেও, উক্ত কথা বলতে সে রাজি হয়েছে। আর অজ্ঞতার কারণে তাকে মাফ করা হবে না। অধিকাংশ উলামার এটিই মত। তবে কেউ কেউ ভিন্ন কথা বলেন। … ‘শরহু ফিকহিল আকবার’। এতে এও বলা হয়েছে যে, জেনে রাখ, কুফরী কথাকে কুফরী কথা হিসেবে জানার পর স্বেচ্ছায় কোন চাপ প্রয়োগ ব্যতীত যদি তা উচ্চারণ করে তাহলে কাফের হয়ে গেছে বলে হুকুম দেয়া হবে; যদিও অন্তকরণে তা বিশ্বাস না করে। ‘শিফা’র ব্যাখ্যাগ্রন্থেও এমনি বলা হয়েছে।” (ইকফারুল মুলহিদীন: ১/ ৬৯)# কোন ব্যক্তি এমন কোন কথা বলল যা কুফর, কিন্তু সে জানে না যে তা কুফর। সে কি কাফের হয়ে যাবে? না’কি না জানার কারণে মাফ পেয়ে যাবে?
উত্তর: কেউ কেউ বলেন, না জানার কারণে সে কাফের হবে না। তবে সহীহ কথা হলো সে কাফের হয়ে যাবে। কেননা, সে ইচ্ছাকৃতভাব কুফরী কথা বলেছে। না জানার কারণে সে মাফ পাবে না।
ফাতাওয়া আলমগীরিতে বলা হয়েছে,
ومن أتى بلفظة الكفر، وهو لم يعلم أنها كفر إلا أنه أتى بها عن اختيار يكفر عند عامة العلماء خلافا للبعض، ولا يعذر بالجهل كذا في الخلاصة
“যে ব্যক্তি ইচ্ছাকৃতভাবে কোন কুফরী কথা বলল কিন্তু সে জানে না যে, তা কুফর, অধিকাংশ উলামার মতে সে কাফের হয়ে যাবে। তার অজ্ঞতাটা ওজর বলে গণ্য হবে না। তবে কেউ কেউ ভিন্নমত পোষণ করেন। ‘খোলাসা’তে এমনি আছে।” (ফাতাওয়া আলমগীরিত: ২/২৭৬) # مسلم قال: أنا ملحد يكفر، ولو قال: ما علمت أنه كفر لا يعذر بهذا
“ যদি কোন মুসলমান বলে, ‘আমি মুলহিদ-নাস্তিক’ তাহলে কাফের হয়ে যাবে। যদি বলে, এটা যে কুফর আমি তা জানি না- তবুও তা ধর্তব্য হবে না।” (ফাতাওয়া আলমগীরি: ২/২৭৯)
# وفي اليتيمة سألت والدي عن رجل قال: أنا فرعون، أو إبليس فحينئذ يكفر كذا في التتارخانية.
“‘আল-ইয়াতীমাহ্’ কিতাবে আছে, আমি আমার পিতাকে এক মুসলিম ব্যক্তির ব্যাপারে জিজ্ঞেস করলাম যে বলেছে, ‘আমি ফেরআউন’ বা ‘আমি ইবলীস’- (তার কি বিধান?) তিনি উত্তর দিলেন, ‘তাহলে সে কাফের হয়ে যাবে’। ‘তাতারখানিয়া’তে এমনি আছে।” (ফাতাওয়া আলমগীরি: ২/২৭৯)
# কাফেরদের ধর্মীয় প্রতীক ‘পৈতা’ বাঁধার দ্বারা কাফের হয়ে যায়। এমনকি রশি বেঁধে যদি বলে, ‘এটি পৈতা’ তবুও কাফের হয়ে যাবে।
امرأة شدت على وسطها حبلا وقالت: هذا زنار تكفر كذا في الخلاصة.
“যদি কোন মহিলা কোমরে রশি বেঁধে বলে, ‘এটি পৈতা’ তাহলে কাফের হয়ে যাবে। ‘খোলাসা’তে এমনি আছে।” (ফাতাওয়া আলমগীরি: ২/২৭৭) উপরোক্ত মাসআলাগুলো আনার দ্বারা বুঝানো উদ্দেশ্য যে, কাফের হওয়ার জন্য স্বেচ্ছায় কুফরী কথা বা কাজে লিপ্ত হওয়াই যথেষ্ট। কুফর উদ্দেশ্য নেয়া, অবমাননার নিয়ত করা, কাফের হওয়ার ইচ্ছা করা ইত্যাদী কোন কিছুই শর্ত নয়। এমনকি উক্ত কথা বা কাজ যে কুফর অনেক ক্ষেত্রে সেটা জানাও শর্ত নয়।
শেষে আল্লামা কাশ্মীরী রহ. এর একটি বক্তব্য উল্লেখ করছি। তিনি বলেন,
أن من المسلمين من يخرج من الدين من غير أن يقصد الخروج منه، ومن غير أن يختار دينا على دين الإسلام.
“দ্বীন থেকে খারিজ হয়ে যাওয়ার ইচ্ছা ছাড়াই, কিংবা ইসলাম ব্যতীত অন্য কোন ধর্ম গ্রহণ করে নেয়া ব্যতীতই মুসলমান দ্বীন থেকে বের হয়ে যেতে পারে।” (ইকফারুল মুলহিদীন: ১/৩০)২. নামায-রোযা ও অন্যান্য বাহ্যিক ইবাদত বন্দেগির পূর্ণ পাবন্দ হওয়া সত্ত্বেও কাফের হতে পারে:
কোন ব্যক্তি কুফরী কথা বা কাজে লিপ্ত হলেই কাফের হয়ে যাবে। হতে পারে সে কুফরীতে লিপ্ত হওয়ার পরও নামায-রোযা ও অন্যান্য ইবাদত বন্দেগির পূর্ণ পাবন্দি করছে। তার বাহ্যিক ইবাদত বন্দেগি তাকে কাফের হওয়া থেকে বাঁচাত পারবে না।
আল্লামা কাশ্মীরী রহ. বলেন,
فمن أنكر شيئا من الضروريات ... لم يكن من أهل القبلة، ولو كان مجاهدا بالطاعات، وكذلك من باشر شيئا من إمارات التكذيب كسجود الصنم والإهانة بأمر شرعي والاستهزاء عليه، فليس من أهل القبلة
“যে ব্যক্তি জরূরিয়্যাতে দ্বীনের কোন একটাকেও অস্বীকার করে সে আহলে কিবলা (তথা ঈমানদার) বলে গণ্য হতে পারে না, যদিও ইবাদত বন্দেগিতে খুব পাবন্দ হয়। তদ্রূপ সে ব্যক্তিও আহলে কিবলার অন্তর্ভুক্ত হতে পারে না যে এমন কোন কর্মে লিপ্ত হয় যা (রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে) মিথ্যা প্রতিপন্ন করার আলামত। যেমন- মূর্তিকে সাজদা করা, শরীয়তের কোন বিষয়ের অবমাননা করা কিংবা তা নিয়ে উপহাস করা।” (ইকফারুল মুলহিদীন: ১/১৭)মোট কথা, কুফরীতে লিপ্ত হয়ে ইবাদত বন্দেগি যতই করুক ঈমানদার বলে গণ্য হবে না।
৩. নিজেকে মুসলমান মনে করা এবং মুসলমান দাবি করা সত্ত্বেও কাফের হতে পারে:
কুফরীতে লিপ্ত হয়ে কোন ব্যক্তি যদি নিজেকে কাফের মনে নাও করে বরং মুসলমানই মনে করে এবং মুসলমান হিসেবেই নিজেকে দাবি করে এবং পরিচয় দেয়, মুসলমান হিসেবেই সে থাকতে চায়, আখেরাতে মুসলমান হিসেবেই উঠতে চায়, তবুও সে কাফের। নিজেকে মুসলমান মনে করা বা দাবি করার দ্বারা মুসলমান বলে গণ্য হবে না, যতক্ষণ না কুফর থেকে তাওবা করে ঈমানদার হবে।
আল্লামা কাশ্মীরী রহ. বলেন,
وكذلك … نكفر بكل فعل فعله شخص مسلم، أجمع المسلمون على أنه - أي ذلك الفعل - لا يصدر إلا من كافر حقيقة … وإن كان صاحبه - أي من صدر منه - مسلما مصرحا بالإسلام مع فعله ذلك الفعل. "شرح شفاء" للخفاجي ملتقطا ملخصا. ومثله في "شرح الملا على القارئ" سواء.
“প্রত্যেক এমন কর্ম যার ব্যাপারে মুসলমানদের ইজমা প্রতিষ্ঠিত যে, তা প্রকৃত কাফের ব্যতীত অন্য কারো থেকে প্রকাশ পেতে পারে না- কোন মুসলমান তাতে লিপ্ত হলে এর দ্বারা আমরা তাকে তাকফীর করবো, যদিও উক্ত কর্মে লিপ্ত ব্যক্তি তাতে লিপ্ত হওয়ার পরও সুস্পষ্টরূপে নিজেকে মুসলমান হিসেবে ঘোষণা দেয়। খাফফাজী রহ. এর শরহে শিফা থেকে গৃহীত। মোল্লা আলী ক্বারী রহ. এর শরাহ তেও হুবহু এমনি বলা হয়েছে।” (ইকফারুল মুলহিদীন: ১/৫৮) ***
Comment