আরবীয় মুশরিক নেতাদের শরীয়ত বিরোধি আইন প্রণয়ন
আল্লাহ তাআলার শরীয়ত বিরোধি আইন প্রণয়ন যে কুফরে আকবার এর অত্যন্ত সুস্পষ্ট দলীল সূরা তাওবার ৩৭ নং আয়াত যেখানে আল্লাহ তাআলা জাহিলী যামানার আরবীয় মুশরিক নেতাদের শরীয়ত বিরোধি আইন প্রণয়নের বিবরণ দিয়েছেন এবং সেটাকে কুফরে আকবার সাব্যস্ত করেছেন।
আরবের মুশরিকরা মিল্লাতে ইবরাহীমিয়্যা’র বিকৃতি সাধন সত্ত্বেও আশহুরে হুরুম তথা নিষিদ্ধ ও সম্মানিত মাসগুলোর তা’জীম করত। হারাম মাস চারটি। তিনটি লাগাতার আর একটি আলাদা। লাগাতার তিনটি: ১. যিলকদ ২. যিলহজ্ব ৩. মুহাররাম। অপরটি: ৪. রজব। এ চার মাসে সব ধরণের যুদ্ধ বিগ্রহ নিষিদ্ধ ছিল। আরবরা কঠোরভাবে তা মেনে চলত। তারা অতি যুদ্ধ পিপাসু জাতি হওয়া সত্ত্বেও এ চার মাসে কোনরূপ যুদ্ধ বিগ্রহে জড়াত না। এমনকি কোন মুশরিক তার পিতার হত্যাকরীকে পেলেও এ মাসে তাকে কিছু না করেই ছেড়ে দিত।
এভাবে যুগের পর যুগ চলে আসছিল। এক সময় কিনানা গোত্রের ‘ক্বালাম্মাস’ নামক ব্যক্তি আরবের নেতৃত্ব পায়। সে এসে প্রস্তাব পেশ করে যে, প্রতি বছর যিলকদ-যিলহজ্ব-মুহাররাম লাগাতার এই তিন মাস যুদ্ধ ছাড়া থাকা আমাদে জন্য অত্যন্ত কষ্টকর। তাই আমরা মুহাররাম মাসের হুরমত ও নিষিদ্ধতাকে তার পরের মাস অর্থাৎ সফর মাসে নিয়ে যাব। এবারের বছর সফর মাসকে আমরা ধরব হারাম তথা যুদ্ধ-নিষিদ্ধ মাস আর মুহাররাম মাসকে বানিয়ে নেব হালাল তথা যুদ্ধের অনুমোদিত মাস। এভাবে আমরা মুহাররাম মাসে যুদ্ধ করব আর তার পরের সফর মাসে যুদ্ধ থেকে বিরত থাকব। তার প্রস্তাব আরবরা মেনে নিল।
পরের বছর তারা এর বিপরীত করত। অর্থাৎ ইব্রাহীমি ধর্ম মতে মুহাররাম মাস হারাম হিসেবেই বহাল থাকত আর সফর মাস যেটাকে তারা গত বছর হারাম সাব্যস্ত করেছিল এবারের বছর সেটা ধর্মে যেমন হালাল ছিল তেমন হালালই ধরা হত। এভাবে তারা আল্লাহ তাআলার হারামকৃত মাসকে হালাল আর হালালকৃত মাসকে হারাম করে যুদ্ধ বিগ্রহের সুযোগ করে নিত।
তাদের এ পরিবর্তিত রীতির ফলে বছরের হারাম মাসের সংখ্যা যদিও চারটি চারটিই থাকত কিন্তু হারাম মাস হালাল হয়ে যেত আবার হারাম মাস হালাল হয়ে যেত। আল্লাহ তাআলার হারামকৃত মুহাররাম মাস হালাল হত আর হালালকৃত সফর মাস হালাল হত।
‘ক্বালাম্মাস’ এর মৃত্যুর পর তার বংশধরদের মাঝে নেতৃত্বের ধারা চলে আসতে থাকে। তারা তাদের পিতৃপুরূষ ক্বালাম্মাসের রেখে যাওয়া রীতি অনুসারে হারাম মাসকে হালাল আর হালাল মাসকে হারাম করে যুদ্ধ-বিগ্রহ করতে থাকে। এভাবে আসতে আসতে সর্বশেষ তাদের নেতৃত্ব আসে তারই বংশধর ‘জুনাদাহ্ ইবনে আউফ’ এর হাতে। তার নেতৃত্বের সময়ই ইসলামের আবির্ভাব ঘটে। আরবরা যখন হজ্ব থেকে ফারেগ হত তখন সে সকলের উদ্দেশ্যে ভাষণ দিত। রজব, যিলকদ এবং যিলহজ্ব মাসকে ধর্মের নিয়ামানুযায়ী হারাম ঘোষণা করত আর আর মুহাররাম মাসকে যুদ্ধের স্বার্থে হালাল বলে ঘোষণা দিত। মুহাররামের পরিবর্তে তার পরবর্তী সফর মাসকে হারাম ঘোষণা দিত। পরবর্তী বছর ধর্মের নিয়মানুযায়ী মুহাররামকে হারাম আর সফরকে হালাল ঘোষণা দিত।
শরীয়তের হারামকে হালাল আর হালালকে হারাম করণের এ জঘন্য কর্মকে কুফর সাব্যস্ত করে আল্লাহ তাআলা সূরা তাওবার নিম্নোক্ত আয়াত নাযিল করেন,
إِنَّمَا النَّسِيءُ زِيَادَةٌ فِي الْكُفْرِ يُضَلُّ بِهِ الَّذِينَ كَفَرُوا يُحِلُّونَهُ عَامًا وَيُحَرِّمُونَهُ عَامًا لِيُوَاطِئُوا عِدَّةَ مَا حَرَّمَ اللَّهُ فَيُحِلُّوا مَا حَرَّمَ اللَّهُ زُيِّنَ لَهُمْ سُوءُ أَعْمَالِهِمْ وَاللَّهُ لَا يَهْدِي الْقَوْمَ الْكَافِرِينَ
[নিশ্চয় কোন মাসকে পিছিয়ে দেয়া (কাফেরদের পূর্ববৎ কুফরের উপর আরোও নতুন) কুফর বৃদ্ধি করে। এর দ্বারা কাফেররা (তাদের পূর্ববৎ পথভ্রষ্টতার উপর আরোও) পথভ্রষ্ট হয়। তারা এ (পিছিয়ে দেয়া মাস) টি এক বছর হালাল করে এবং আরেক বছর হারাম করে, যাতে তারা আল্লাহ যা হারাম করেছেন তার সংখ্যা (অর্থাৎ চার) ঠিক রাখতে পারে। ফলশ্রুতিতে আল্লাহ যা হারাম করেছেন তা তারা হালাল করে। তাদের মন্দ আমলসমূহ তাদের জন্য সুশোভিত করা হয়েছে। আল্লাহ কাফের কওমকে হিদায়াত দেন না।] [তাওবা: ৩৭] “কুফর বৃদ্ধি করে” অর্থ- কাফেররা কুফরী আকীদা বিশ্বাসের কারণে পূর্ব থেকে কাফের হয়েই ছিল। এখন হারাম মাসকে হালাল আর হালাল মাসকে হারাম করার দ্বারা কর্মগত কুফরে লিপ্ত হয়ে তাদের পূর্বের কুফরের সাথে আরোও কুফর যুক্ত করল।
এ আয়াত থেকে পরিষ্কার যে, শরীয়তের হারামকে হালাল করা কিংবা হালালকে হরাম করা কুফরে আকবার।
আল্লাম শানকীতি রহ. বলেন,
ومن أصرح الأدلة في هذا أن الكفار إذا أحلوا شيئاً، يعلمون أن الله حرمه وحرموا شيئاً يعلمون أن الله أحله، فإنهم يزدادون كفراً جديداً بذلك، مع كفرهم الأول، وذلك في قوله تعالى: (إِنَّمَا النَّسِيءُ زِيَادَةٌ فِي الْكُفْر) إلى قوله: (وَاللَّهُ لا يَهْدِي الْقَوْمَ الْكَافِرِينَ). (الحاكمية في تفسير أضواء البيان : 18)
“শরীয়ত বিরোধি আইন প্রণয়ন যে কুফরে আকবার এর অত্যন্ত সুস্পষ্ট একটি দলীল এই যে, কাফেররা যদি এমন কোন জিনিসকে হালাল (বৈধ) করে যার ব্যাপারে তারা জানে যে, আল্লাহ তাআলা সেটা হারাম (অবৈধ) করেছেন; কিংবা এমন কোন জিনিসকে হারাম করে যার ব্যাপারে তারা জানে যে, আল্লাহ তাআলা সেটা হালাল করেছেন- তাহলে এর দ্বারা তাদের পূর্ববৎ কুফরের সাথে আরোও নতুন কুফর বৃদ্ধি পায়। যেমনটা আল্লাহ তাআলার এ বাণীতে বলা হয়েছে,
(إِنَّمَا النَّسِيءُ زِيَادَةٌ فِي الْكُفْر) (নিশ্চয় কোন মাসকে পিছিয়ে দেয়া কুফর বৃদ্ধি করে)। ...
(وَاللَّهُ لا يَهْدِي الْقَوْمَ الْكَافِرِينَ) (আল্লাহ কাফের কওমকে হিদায়াত দেন না)।” (আদওয়াউল বয়ান: তাফসীরে সূরা ‘আশ-শূরা’)
***
(এ আয়াত সংক্রান্ত বাকি আলোচনা সামনে আসবে ইনশাআল্লাহ!)
Comment