আল্লামা ইবনে হাযম রহ. (মৃত্যু ৪৫৬হি.) এর সংশয় নিরসক বক্তব্য:
আল্লামা ইবনে হাযম রহ. বলেন,
"وقال عز وجل: {إنما النسيء زيادة في الكفر يُضَلُّ به الذين كفروا يحلونه عاماً ويحرمونه عاماً ليواطئوا عدة ما حرم الله } ... وبحكم اللغة التي نزل بها القرآن أن الزيادة في الشيء لا تكون إلا منه لا من غيره. فصح أن النسيء كفر، وهو عمل من الأعمال وهو تحليل ما حرم الله تعالى. فمن أحل ما حرم الله تعالى وهو عالم بأن الله تعالى حرمه فهو كافر بذلك الفعل نفسه.." اهـ
“আল্লাহ আযযা ওয়া জাল্লা ইরশাদ করেন, (নিশ্চয় কোন মাসকে পিছিয়ে দেয়া কুফর বৃদ্ধি করে। এর দ্বারা কাফেররা পথভ্রষ্ট হয়। তারা এটি এক বছর হালাল করে এবং আরেক বছর হারাম করে, যাতে তারা আল্লাহ যা হারাম করেছেন তার সংখ্যা ঠিক রাখতে পারে।) … কুরআন যে ভাষায় নাযিল হয়েছে সে ভাষারই বিধান মতে, যা দ্বারা কোন বস্তুর বৃদ্ধি হয় তা ঐ জাতীয় বস্তুই হয়, অন্য জাতীয় নয়। অতএব, প্রমাণিত হল মাস পিছিয়ে দেয়া কুফর। অথচ তা একটা কর্ম মাত্র। আর তা হচ্ছে আল্লাহ তাআলা যা অবৈধ করেছেন তা বৈধ করা। অতএব, যে আল্লাহ তাআলার অবৈধকৃত কোন কিছুকে বৈধ করবে অথচ সে জানে যে, আল্লাহ তাআলা তা অবৈধ করেছেন- সে কেবল উক্ত কর্মের দ্বারাই কাফের হয়ে যাবে।” (আল-ফিছাল: ৩/২৪৫)ইবনে হাযম রহ. এর বক্তব্যের বিশ্লেষণ:
শরীয়ত বিরোধি আইন প্রণয়ন একটা স্বয়ংসম্পূর্ণ কুফর এবং তাতে লিপ্ত ব্যক্তির আকীদা বিশ্বাস যাই হোক সে কাফের- এ ব্যাপারে ইবনে হাযম রহ. এর উপরোক্ত বক্তব্য অত্যন্ত সুস্পষ্ট এবং গুরুত্ববাহী। এ জন্য আমরা ইবনে হাযম রহ. এর বক্তব্যটাকে একটু বিশ্লেষণ করব। এতে ইনশাআল্লাহ জরুরী কয়েকটা বিষয় স্পষ্ট হয়ে যাবে।
প্রথমত: আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন, (إِنَّمَا النَّسِيءُ زِيَادَةٌ فِي الْكُفْر) (নিশ্চয় কোন মাসকে পিছিয়ে দেয়া কুফর বৃদ্ধি করে)।
‘কুফর বৃদ্ধি করে’ দ্বারা কোন ধরণের কুফর বৃদ্ধি উদ্দেশ্য? কুফরে আকবার-বড় কুফর, না কুফরে আসগার-ছোট কুফর? স্পষ্টই যে, এখানে কুফরে আকবার উদ্দেশ্য। কারণ,
আল্লাহ তাআলা কাফেরদের উক্ত কর্মের কারণে তাদের পূর্বের কুফরের সাথে নতুন কুফর যুক্ত করেছেন। স্পষ্ট যে, কাফেররা আগে থেকে যে কুফরে লিপ্ত ছিল তা কুফরে আকবার; কুফরে আসগার নয়। তাদের পূর্বের কুফরের সাথে নতুন যে কুফর যুক্ত হয়ে তাদের কুফরে আরোও বৃদ্ধি করেছে তা ঐ কুফরই হবে যে কুফরে তারা পূর্ব থেকে লিপ্ত ছিল। তারা কুফরে আকবারে লিপ্ত ছিল। কাজেই তাদের কুফরের সাথে নতুন যে কুফর বৃদ্ধি হয়েছে তাও কুফরে আকবার। আরবী ভাষার বিধান এটাই যে, কোন কিছুর বৃদ্ধি পাওয়ার অর্থ ঐ বস্তু যা, হুবহু একই জিনিস তাতে সংযুক্ত হওয়া।
শুধু আরবী নয়, অন্যান্য ভাষার বিধানও একই। যেমন উদাহরণ স্বরূপ: যদি বলা হয়, ‘গোলায় ধান বৃদ্ধি পেয়েছে’ তাহলে এর অর্থ হবে, গোলায় আগের ধানের সাথে নতুন করে আরোও ধান যোগ হয়েছে। আগের ধানের সাথে গম বা ভূট্টা মেশালে সেটাকে ধান বৃদ্ধি পেয়েছে বলা যাবে না। ধান বৃদ্ধি পেয়েছে তখনই বলা হবে যখন তাতে আরোও নতুন ধান যোগ করা হবে। তদ্রূপ দুধ বৃদ্ধি পাওয়ার অর্থ আগের দুধের সাথে নতুন দুধ যুক্ত হয়েছে। পানি বৃদ্ধি পাওয়ার অর্থ আগের পানির সাথে নতুন করে পানি যুক্ত হয়েছে। স্বর্ণ বৃদ্ধি পাওয়ার অর্থ আগের স্বর্ণের সাথে আরোও স্বর্ণ যুক্ত হয়েছে। জনসংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে অর্থ আগের জনসংখ্যার সাথে আরোও জনসংখ্যা যুক্ত হয়েছে।
তদ্রূপ, কুফর বৃদ্ধি পেয়েছে অর্থ আগের কুফরের সাথে নতুন কুফর যুক্ত হয়েছে। কাফেররা আগে থেকেই কাফের ছিল। এখন হারাম মাসকে হালাল এবং হালাল মাসকে হারাম করার দ্বারা তাদের কুফর আরোও বৃদ্ধি পেয়েছে। অতএব, হালালকে হারাম বা হারামকে হালাল করা কুফর। যদি কুফর না হত তাহলে এর কারণে কাফেরদের কুফর বৃদ্ধি পেত না। কাজেই বুঝা গেল, হারামকে হালাল বা হালালকে হারাম করা কুফর এবং তা ঐ কুফর যে কুফরের কারণে কাফেররা আগে থেকে কাফের ছিল। কাফেররা আগে থেকে কাফের ছিল কুফরে আকবারের দ্বারা। কাজেই, হারামকে হালাল বা হালালকে হারাম করার দ্বারা কুফরে আকবার বৃদ্ধি পেয়েছে। অতএব, হারামকে হালাল বা হালালকে হারাম করা কুফরে আকবার।
ইবনে হাযম রহ.তাঁর বক্তব্যের [কুরআন যে ভাষায় নাযিল হয়েছে সে ভাষারই বিধান মতে, যা দ্বারা কোন বস্তুর বৃদ্ধি হয় তা ঐ জাতীয় বস্তুই হয়, অন্য জাতীয় নয়। অতএব, প্রমাণিত হল মাস পিছিয়ে দেয়া কুফর।] এ অংশের মধ্য দিয়ে এ বিষয়টিই পরিষ্কার করেছেন।
শুধু ইবনে হাযম রহ. নয়, অন্যান্য ইমামগণও একই কথা বলেছেন। এটি ভাষার একটি সার্বজনীন মূলনীতি। যেমন- ইমাম জাসসাস রহ. বলেন,
فأخبر الله أن النسيء الذي كانوا يفعلونه كفر لأن الزيادة في الكفر لا تكون إلا كفرا لاستحلالهم ما حرم الله وتحريمهم ما أحل الله فكان القوم كفارا باعتقادهم الشرك ثم ازدادوا كفرا بالنسيء. اهـ
“আল্লাহ তাআলা জানিয়ে দিয়েছেন, মাস পিছিয়ে দেয়ার যে কাজটা তারা করত তা কুফর। কেননা, কুফরে বৃদ্ধি হবে যা দ্বারা তা কুফরই হতে হবে। আর তা এ কারণে যে, তারা আল্লাহর হারামকে হালাল আর আল্লাহর হালালকে হারাম করত। তারা প্রথমত কুফরী আকীদা বিশ্বাসে কারণে কাফের ছিল পরে মাস পিছিয়ে দেয়ার দ্বারা তাদের কুফর আরোও বৃদ্ধি পেয়েছে।” (আহকামুল কুরআন: ৪/৩০৯)দ্বিতীয়ত: কাফেরদের মাস পিছিয়ে দেয়াটা কি? কারো কাছে অস্পষ্ট নয় যে, তা একটা আমল তথা বাহ্যিক কর্ম। আল্লাহ তাআলা এ কর্মকেই কুফর সাব্যস্ত করেছেন। তাদের আকীদা বিশ্বাস কি ছিল সেদিকে কোন ভ্রুক্ষেপই করা হয়নি। আয়াতে আকীদা বিশ্বাসের দিকে সামান্য ইশারা ঈঙ্গিতও করা হয়নি। অতএব, বুঝা গেল মাস পিছিয়ে দেয়ার এ বাহ্যিক কর্মটিই কুফর। তাতে লিপ্ত হলেই কাফের হয়ে যাবে। তার আকীদা বিশ্বাস কি সেদিকে লক্ষ্য করার কোনই প্রয়োজন নেই।
ইবনে হাযম রহ. এ বিষয়টিই স্পষ্ট করেছেন তারঁ বক্তব্যের নিম্নোক্ত অংশে,
[অতএব, প্রমাণিত হল মাস পিছিয়ে দেয়া কুফর। অথচ তা একটা কর্ম মাত্র। আর তা হচ্ছে আল্লাহ তাআলা যা অবৈধ করেছেন তা বৈধ করা। অতএব, যে আল্লাহ তাআলার অবৈধকৃত কোন কিছুকে বৈধ করবে অথচ সে জানে যে, আল্লাহ তাআলা তা অবৈধ করেছেন- সে কেবল উক্ত কর্মের দ্বারাই কাফের হয়ে যাবে।]
--------------------------------------------------
------------------------------------------------
আশাকরি বিষয়টি স্পষ্ট হয়েছে। বিষয়টি আরোও স্পষ্ট করার জন্য আমরা সায়্যিদ কুতুব রহ., আলী ত্বনত্ববী রহ. এবং আব্দুল্লাহ আযযাম রহ. এর বক্তব্য উল্লেখ করবো। ইতিপূর্বে আল্লামা শানকীতি রহ. এর বক্তব্য উল্লেখ করে এসেছি।
সায়্যিদ কুতুব রহ. বলেন,
فجاءت هذه النصوص تبطل النسيء وتبين مخالفته ابتداء لدين الله، الذي يجعل التحليل والتحريم (والتشريع كله) حقاً خالصا لله وتجعل مزاولته من البشر- بغير ما أذن الله- كفرا.. بل زيادة في الكفر... اهـ
“এইসব আয়াত মাস পিছিয়ে দেয়াকে বাতিল সাব্যস্ত করেছে এবং পরিষ্কার করে দিয়েছে যে, তা আল্লাহ তাআলার দ্বীনের গোড়ার সাথেই সাংঘর্ষিক। কেননা, আল্লাহ তাআলার দ্বীনে হালাল ও হারাম করা এবং সর্বপ্রকার আইন প্রণয়নের অধিকার শুধু আল্লাহ তাআলাকেই দেয়া হয়েছে। আল্লাহ তাআলার অনুমোদন ব্যতীত কোন মানুষ তাতে লিপ্ত হওয়াকে কুফর বরং কুফরের উপর কুফর সাব্যস্ত করা হয়েছে।” (ফী যিলালিল কুরআন: ৩/১৬৫১) তিনি আরোও বলেন,
أن النسيء زيادة في الكفر. لأنه مزاولة للتشريع بغير ما أنزل الله، فهو كفر يضاف إلى الكفر الاعتقادي ويزيد فيه.اهـ
“মাস পিছিয়ে দেয়া কুফর বৃদ্ধি করে। কেননা, তা হচ্ছে আল্লাহ তাআলা যা নাযিল করেছেন তার বিপরীত আইন প্রণয়ন। এতএব, তা এমন কুফর যা আকীদা বিশ্বাসগত কুফরের সাথে যুক্ত হয়ে আরোও কুফর বৃদ্ধি করবে।” (ফী যিলালিল কুরআন: ৩/১৬৫১) আলী ত্বনত্ববী রহ. বলেন,
إنما النسئ الذى يفعله المشركون ، من تأخيرهم حرمة شهر إلى آخر ، { زِيَادَةٌ فِي الكفر } أى : زيادة فى كفرهم؛ لأنهم قد ضموا إلى كفرهم آخر ، هو تحليلهم لما حرمه الله وتحريمهم لما أحله وبذلك يكونون قد جمعوا بين الكفر فى العقيدة والكفر فى التشريع.اهـ
“এক মাসের হুরমত তথা সম্মান ও নিষিদ্ধতাকে অন্য মাসে স্থানান্তরের যে কাজটা মুশরিকরা করত তা তাদের কুফর বৃদ্ধি করেছে। কেননা, তারা তাদের পূর্ববৎ কুফরের সাথে আরেকটা কুফর সংযুক্ত করেছে। আর তা হচ্ছে আল্লাহর হারামকে হালাল এবং তাঁর হালালকে হারাম করা। এভাবে তারা তাদের মাঝে দুই ধরণের কুফরের সমাবেশ ঘটিয়েছে: (এক) আকীদা বিশ্বাসগত কুফর (দুই) শরীয়ত বিরোধি আইন প্রণয়ন।” (তাফসীরে ত্বনত্ববী: ১৮৪৭) আব্দুল্লাহ আযযাম রহ. বলেন,
وإذا كان رب العزة سمى النسيء زيادة في الكفر -النسيء تأخير حرمة شهر إلى شهر آخر- فماذا نسمي الذين يسمون الجهاد جريمة قانونية يعلن عن عقوبات مرتكبيها في أجهزة الإعلام دون خشية ولا خجل ولا حياء ولا وجل؟ أليس الحكم الشرعي لهؤلاء أشد بكثير وأعظم جرما من أولئك الذين كانوا يراعون قداسة الأشهر الحرم ويراعون عدتها فلا يحلون في العدد.اهـ
“রাব্বুল ইজ্জত যখন এক মাসের হুরমতকে অন্য মাসে স্থানান্তরকে কুফরের উপর কুফর আখ্যা দিয়েছেন তখন আমরা ঐ সব লোককে কি আখ্যায়িত করবো যারা জিহাদকে আইনত দন্ডনীয় অপরাধ সাব্যস্ত করে? মিডিয়া ও প্রচার মাধ্যমসমূহে তাতে লিপ্ত ব্যক্তিদের বিভিন্ন প্রকার শাস্তির ঘোষণা দেয়? তাদের না আছে কোন ভীতি, না আছে কোন অনুতপ্ততা! না আছে কোন লজ্জা-শরম, আর না আছে কোন ব্যথা! শরীয়তে কি এদের বিধান ঐ সব মুশরিকদের তুলনায় অনেক বেশি কঠোর এবং এদের অপরাধ তাদের চেয়ে অনেক জঘন্য হবে না, যারা আশহুরে হুরুম তথা সম্মানিত মাসগুলোর সম্মান রক্ষা করত এবং সেগুলোর সংখ্যার প্রতি লক্ষ্য রাখত, যার ফলে সংখ্যায় কোন পরিবর্তন করত না??” (জিহাদু শা’বিন মুসলিম: ১/৩৪) নিশ্চয়ই এদের অপরাধ ঐ সব মুশরিকদের চেয়ে জঘন্য এবং অবশ্যই শরীয়তে এদের বিধান তাদের চেয়ে কঠিন!
***
বি.দ্র.: ইসতিহলাল বাহ্যিক কর্মের মাধ্যমেও হতে পারে।
উপরোক্ত আয়াত এবং তার ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ থেকে বুঝা গেল ‘ইসতিহলাল’ তথা হালালকে হারাম ও হারামকে হালাল করা (অন্য ভাষায় একে ‘তাহলীল’ ও ‘তাহরীম’ও বলা হয়) আকীদা বিশ্বাসের মাধ্যমে যেমন হতে পারে, শুধু বাহ্যিক কর্মের মাধ্যমেও হতে পারে। এ উভয়টাই কুফর। অতএব, কোন ব্যক্তি কোন অকাট্য হারামকে হালাল কিংবা কোন অকাট্য হালালকে হারাম মনে করলে যেমন কাফের হয়ে যায়, আন্তরিক বিশ্বাস ব্যতীত শুধু বাহ্যিক আইন প্রণয়ন করে তার বৈধতা দিয়ে দিলে কিংবা তাকে অবৈধ ঘোষণা করলেও কাফের হয়ে যায়।
***
Comment