بسم الله الرحمن الرحيم
الحمد لله رب العالمين. وصلى الله تعالى على خير خلقه محمد و على آله وأصحابه أجمعين. أما بعد...
ইসলামী খেলাফত, রাজনীতি ও রাষ্ট্রনীতি সম্পর্কে তাকী উসমানী সাহেব ‘ইসলাম আউর সিয়াসী নজরিয়্যাত’ নামে একটি কিতাব লিখেছেন। কিতাবটি বাংলাদেশে বেশ সাড়া জাগিয়েছে। কোন কোন দারুল ইফতায় এটি পাঠ্যপুস্তক হিসেবে নেসাবভুক্ত করা হয়েছে। বাংলায় এর একাধিক তরজমাও হয়েছে। الحمد لله رب العالمين. وصلى الله تعالى على خير خلقه محمد و على آله وأصحابه أجمعين. أما بعد...
বর্তমান বিশ্বপরিস্থিতিতে আলেম উলামাদের অনেকের কাছে ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা ও পরিচালনার ময়দানে কিতাবটি দিশারী হিসেবে গৃহিত হয়েছে। কিতাবটি হাতে পেয়ে অনেকে যেন বর্তমান সময়ের অনেক জটিল সমস্যার সঠিক সমাধান পেয়ে গেছেন। ইসলামী রাজনীতির সঠিক নির্দেশনা পেয়ে গেছেন বলে মনে করছেন। বর্তমান পরিস্থিতিতে হিন্দুস্তানী একজন লেখকের এমন একটি কিতাবকে সারা দুনিয়ার মুসলমানদের চলার পথের পাথেয় ও যথাযোগ্য রাহবার বলে মনে করছেন। কিতাব ও কিতাবের লিখককে হিন্দুস্তানের গৌরব বলে মনে করছেন।
কিন্তু যারা দ্বীনে ইসলামের মেজাজ সম্পর্কে মোটামুটি জ্ঞান রাখেন; ইসলামী খেলাফত, রাষ্ট্রনীতি ও ইসলামী ফিকহ সম্পর্কে মোটামুটি অবগত আছেন এবং বর্তমান বিশ্ব-শাসনব্যবস্থার স্বরূপ সম্পর্কে কিছুটা সচেতন রয়েছেন- তাদের কাছে আশাকরি অস্পষ্ট থাকবে না যে, কিতাবটিতে মূলত সঠিক ইসলামী খেলাফত ও রাষ্ট্রনীতি পেশ করার নাম করে প্রচলিত ইসলাম বিরোধি শাসনব্যবস্থাকে ইসলামের নামে বৈধতা দেয়ার চেষ্টা করা হয়েছে। এ হিসেবে কিতাবটিকে হিন্দুস্তানের গৌরব গণ্য করার পরিবর্তে হিন্দুস্তান থেকে উদ্ভূত এক ফিতনা বলে গণ্য করা উচিৎ।
কিতাব সম্পর্কে মন্তব্য:
সার কথায় যদি কিতাব সম্পর্কে মন্তব্য করতে চাই তাহলে বলা যায়,
১. কিতাবের লিখক মনে হয় হীনমন্যতার শিকার, যার বহি:প্রকাশ তার এ কিতাবে ঘটেছে। বর্তমান কুফরী শাসন ব্যবস্থা এবং কাফের ও তাদের দালালদের জয় জয়কার দেখে তিনি হয়তো ভড়কে গিয়েছেন। ফলে তিনি ইসলামের শ্রেষ্ঠত্ব ও সঠিক মেজাজ তুলে ধরার পরিবর্তে ইসলামকে বরং যেন আসামীর কাঠ গড়ায় দাঁড় করিয়ে তার পক্ষে সাফাই গাওয়ার চেষ্টা করেছেন।
২. কাফেররা যে ইসলাম ও মুসলামনদের দুশমন, ইসলাম গ্রহণ কিংবা ইসলামী হুকুমতের অধীনস্থ হয়ে জিযিয়া দিয়ে জীবন যাপনের অধিকার লাভ ব্যতীত যে তাদের দুনিয়াতে বেঁচে থাকার কোন অধিকার নেই- এই ধ্রুব সত্যটি তুলে ধরার পরিবর্তে তিনি কাফেরদের প্রতি সহমর্মিতা পোষণ, তাদের সাথে উত্তম আচরণ, তাদের সাথে কৃত চুক্তি রক্ষার গুরুত্ব ইত্যাদী নরম নরম বিধানাবলীর আলোচনা মন ভরে করেছেন। তাদের সাথে জিহাদের ঘোষণা না দিয়ে বরং সমঝোতার পথ বেঁচে নিয়েছেন। পরিণতিতে কিতাবটিতে ইসলামের সঠিক মেজাজ চরমভাবে প্রহসনের শিকার হয়েছে।
৩. জিহাদের আলোচনা অতি সংক্ষিপ্তাকারে করেছেন অথচ কাফেরদের প্রতি সহমর্মিতা পোষণ, তাদের সাথে উত্তম আচরণ, তাদের সাথে কৃত চুক্তি রক্ষার গুরুত্ব ইত্যাদী আলোচনা বেশ দীর্ঘায়িত করেছেন। শুধু তাই নয়, ইসলামের জিহাদের বিধানকে সুস্পষ্টভাবে বর্ণনা করার পরিবর্তে আলোচনাকে এদিক সেদিক ঘুরিয়েছেন। দিফায়ী জিহাদের কথা কিছুটা সুস্পষ্ট বললেও ইকদামী জিহাদের আলোচনা এমনভাবে করেছেন যে, তাতে ইকদামী জিহাদের মূল রূহটাই নষ্ট হয়ে গেছে।
৪. প্রচলিত কুফরী শাসন ব্যবস্থাকে ইসলামী শাসন, শাসকদেরকে খলিফাতুল মুসলিমীন প্রমাণ করার এবং কুফর শাসনাধীন রাষ্ট্রগুলোকে দারুল ইসলাম তথা ইসলামী রাষ্ট্র প্রমাণ করার সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছেন। যথাসম্ভব শাসকদের কুফরী কর্মের বিরুদ্ধে বলার পরিবর্তে বরং তাদেরকে রক্ষা করার চেষ্টা করেছেন। তাদের আনুগত্যকে ফরয সাব্যস্ত করার চেষ্টা করেছেন। এর অনেক ক্ষেত্রে তিনি কুরআন, হাদীস ও আইম্মায়ে কেরামের সুস্পষ্ট বক্তব্য পেশ করার পরিবর্তে আলোচনাকে এদিক সেদিক ঘুরিয়েছেন। আয়াত ও হাদীসের ব্যাপারে নিজে থেকে মত দিয়ে এবং আইম্মায়ে কেরামের সুস্পষ্ট বক্তব্য পরিত্যাগ করে অস্পষ্ট কিছু বক্তব্য এনে সেগুলোকে নিজের মতো ব্যাখ্যা করে প্রচলিত কুফরী শাসন ও শাসকদের বৈধতা দেয়ার চেষ্টা করেছেন।
৫. অনেক ক্ষেত্রে তাহকীকের বেলায় বড়ই দুর্বলতার প্রমাণ দিয়েছেন। কোন কোন ক্ষেত্রে তো এমন তাহকীক ও মতামত পেশ করেছেন যে, সাধারণ তালিবুল ইলমরাও বুঝতে পারবে, এখানে কারচুপি করা হচ্ছে কিংবা লিখক পক্ষপাতিত্বের শিকার হয়েছেন কিংবা শাসকদের রোষানল থেকে নিজেকে রক্ষার নিমিত্তে সত্য কথাটা গোপন করেছেন কিংবা কিছু একটা এখানে হয়েছে।
৬. আল্লাহ তাআলার শরীয়ত বিরোধি আইন দিয়ে রাষ্ট্র পরিচালনা কুফর, এই ধরণের শাসক মুরতাদ, এদেরকে অপসারণ করা ফরয, এইসব রাষ্ট্র দারুল হরব, গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে বসবাসরত কাফেররা জিম্মি নয়… ইত্যাদী যেসব মাসআলায় বর্তমান মুহাক্কিক উলামায়ে কেরাম এবং কিছুকাল পূর্বের বিশ্ববরেণ্য উলামা মাশায়েখগণ সুস্পষ্ট মত দিয়ে গেছেন সেগুলোতে তিনি ভিন্নমত পোষণ করেই ক্ষান্ত হননি বরং তার নিজের মতামতকে এমনভাবে ব্যক্ত করেছেন যেন এটিই শরীয়তের শত-সিদ্ধ সিদ্ধান্ত।
৭. অনেক ক্ষেত্রে বাস্তবতাকে পরিহার করে এমনভাবে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে আলোচনা করেছেন যে, তাতে বাস্তবতাটা মাটিচাপা পড়ে গেছে।
কিতাব সম্পর্কে এই যা কিছু আমি বললাম এগুলো বানানো কিছু নয়। ক্ষোভের বশবর্তী হয়ে অতিরঞ্জনও নয়। তিলকে তাল বানানোও নয়। কিতাব সকলের সামনেই আছে। পড়ে দেখলেই মন্তব্যের বাস্তবতা বুঝা যাবে।
পাঠকের পক্ষ থেকে আপত্তি:
১. কোন কোন পাঠক হয়তো এখানে আপত্তি উঠাতে পারেন যে, তাকী উসমানী সাহেব তার এ কিতাবে তো আর দুনিয়ার সব কিছু বর্ণনা করার দায়িত্ব নেননি। যতটুকু মুনাসিব মনে করেছেন বর্ণনা করেছেন। বাকিটা ছেড়ে দিয়েছেন। এটা দোষের কি হলো যে সমালোচনা লিখতে হবে??
২. কেউ কেউ হয়তো এও বলতে পারেন, বর্তমান শাসকরা যে কতটা ভয়ংকর তা সকলেরই জানা। এমতাবস্থায় পরিষ্কার সত্য বলতে গেলে জান-মাল, ইজ্জত-আব্রু সব কিছুই হারানোর আশংখা রয়েছে। কাজেই একটু ঘুরিয়ে ফিরিয়ে বললে যাতে শাসকদের বিরুদ্ধে না যায় তাতে দোষের কি আছে??
৩. এও বলা হতে পারে যে, তাকী উসমানী সাহেব কিতাবে নিজের ব্যক্তিগত মতামত পেশ করেছেন। এতে যদি ভুল হয় তো মানুষ হিসেবে ভুল হতেই পারে। এতে সমালোচনা লিখে জন সম্মুখে প্রকাশ করার কি আছে??
৪. তাকী উসমানী সাহেবের মত তো আরো অনেকেই এই ধরণের আকীদা পোষণ করেন। কথায় কাজে, লেখা-লেখিতে, বয়ান-বক্তৃতায় তা প্রকাশও করেন। তাদের সমালোচনা না করে তাকী উসমানী সাহেবের কিতাবের দিকে কেন নজর দিলেন?
আপত্তির জওয়াব:
প্রথম আপত্তির ক্ষেত্রে বলবো, কোন বিষয় আলোচনা না করা এক জিনিস আর ভুল আলোচনা করা বা অনিচ্ছাকৃক ভুলের শিকার হওয়া কিংবা আলোচনা করে তাকে বিকৃত করা এবং বাস্তবতাকে ধামাচাপা দেয়া আরেক জিনিস। প্রথমটা ক্ষেত্র বিশেষে সমালোচনাযোগ্য না হলেও দ্বিতীয়টার সমালোচনা আবশ্যক। কেননা, এতে সাধারণ মানুষ বিভ্রান্তির শিকার হওয়ার প্রবল সম্ভাবনা রয়েছে। বিশেষত লিখক যখন তাকী উসমানী সাহেবের মত গণ্যমান্য ও অনুসরণীয় কেউ হন।
দ্বিতীয় আপত্তির জওয়াব: শাসকের ভয়ে অনেক সময় চুপ থাকার বৈধতা আছে। কিন্তু নিজেকে রক্ষার জন্য এমন আলোচনা ছড়ানোর অনুমতি নেই যার কারণে জনগণ বিভ্রান্তির শিকার হতে পারে। বিশেষত যখন তা শুধু নিজের মধ্যেই সীমাবদ্ধ না থেকে বরং ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ার আশংখা থাকে। যেমনটা তাকী উসমানী সাহেবের এ কিতাবের বেলায় ঘটেছে যে তা গোটা হিন্দুস্তানে ছড়িয়েছে। এমতাবস্থায় এর প্রকাশ্য ও ব্যাপক সমালোচনা ব্যতীত মানুষকে বিভ্রান্তির হাত থেকে রক্ষা করা সম্ভব নয়।
তৃতীয় আপত্তির জওয়াব: তাকী উসমানী সাহেব যা কিছু পেশ করেছেন দু’য়েক জায়গা ব্যতীত বাকি সকল কিছুকেই শরীয়তের সিদ্ধান্ত হিসেবেই পেশ করেছেন। একথা বলেননি যে, এগুলো আমার ব্যক্তিগত অভিমত। এতে অন্যদের দ্বিমত রয়েছে। অধিকন্তু যদি সেগুলো ব্যক্তিগত অভিমতও হয়ে থাকে তবুও পাঠক বিভ্রান্তি থেকে বাঁচতে পারবে না। কারণ, তারা সেটাকে শরীয়তের সিদ্ধান্তু হিসেবেই গ্রহণ করবে, তাকী উসমানী সাহেবের নিজস্ব মতামত হিসেবে নয়। শুধু এতটুকুই নয়, বরং যারা এই মতের বিরুদ্ধে যাবে অনেক পাঠক তাদেরকে গোমরাহ বলে আখ্যায়িত করবে। এমতাবস্থায় এর পর্যালোচনা জরুরী।
চতুর্থ আপত্তির জওয়াব: প্রথমত আমি ব্যক্তির সমালোচনা করছি না, বিষয়বস্তুর সমালোচনা করছি। এতে তাকী উসমানী সাহেবের খণ্ডন হয়ে গেলে বাকি সকলেরই খণ্ডন হয়ে যাবে। দ্বিতীয়ত তাকী উসমানী সাহেবেরটা লোকজনে গ্রহণ করছেন বেশি। তার দ্বারা যতটা প্রভাবিত তারা হচ্ছেন অন্যদের দ্বারা ততটা হচ্ছেন না। এ দৃষ্টিকোণ থেকে তাকী উসমানী সাহেবের কিতাবের পর্যালোচনা আগে শুরু করাটাই যুক্তি যুক্ত।
মোটকথা, তাকী উসমানী সাহেব বাংলাদেশী উলামা-তুলাবার কাছে একজন অনুসরণীয় ব্যক্তিত্ব। তার কথাকে সহজে সকলে মেনে নিচ্ছে এবং নেবে। এমতাবস্থায় যদি কিতাবটির সমালোচনা ও পর্যালোচনা না লিখা হয় তাহলে ব্যাপক বিভ্রান্তির আশংখা আছে। এ দিকে লক্ষ্য করেই পর্যালোচনায় হাত দিয়েছি।
বি.দ্র.
১. কেউ কেউ বলে থাকেন, ‘তাকী উসমানী সাহেব কাফেরদের দালাল।’ আমি এতে একমত নই। কেননা, যথার্থ দলীল প্রমাণ ব্যতীত কারোও ব্যাপারে কিছু বলা যায় না। বরং আমি এতটুকু মনে করি যে, তাকী উসমানী সাহেব অনেক ক্ষেত্রে বুঝতে ভুল করেছেন কিংবা পারিপার্শ্বিকতা ও যুগের অবস্থার দ্বারা প্রভাবিত হয়েছেন।
২. আমি তাকী উসমানী সাহেবের দ্বীনদারির উপর হামলা করছি না। তার নিয়তের উপরও না। তিনি হয়তো যা লিখেছেন খালেছ দ্বীনি উপকারের জন্যই লিখেছেন। কিন্তু দ্বীনদারী কিংবা ইখলাস ভুল-শুদ্ধের মাপকাটি নয়। একান্ত দ্বীনদার এবং মুখলিস ব্যক্তিও ভুলের শিকার হতে পারেন। পারিপার্শ্বিকতার দ্বারা প্রভাবিত হতে পারেন। দলীল প্রমাণ ব্যতীত কারো ইখলাস ও দ্বীনদারির উপর হামলা না করে শরীয়তের নিক্তিতে তার কথার ওজন করাই মূল কাজ।
আল্লাহ তাআলার কাছে প্রার্থনা, যেন তিনি সমালোচনার ক্ষেত্রে ইনসাফ বজায় রাখার তাওফীক দেন। কোন প্রকার ইফরাত-তাফরীত ব্যতীত হকটা প্রকাশ করার তাওফীক দেন। আমীন! আমীন! আমীন!
Comment