বিশিষ্ট হানাফী ফকীহ ও মুহাদ্দিস আল্লামা বদরুদ্দীন আইনী রহ. (মৃত্যু: ৮৫৫হি.) – যিনি বুখারী শরীফের শরাহ ‘উমদাতুল কারী’ এর লিখক – হেদায়ার শরাহ ‘বিনায়া’ তে দারুল ইসলাম ও দারুল হরবের নিম্নোক্ত সংজ্ঞা দিয়েছেন,
المراد بدار الإسلام بلاد تجري فيها أحكام الإسلام، وبلاد الحرب بلاد يجري فيها أمر عظيمهم، وتكون تحت قهره.اهـ
“দারুল ইসলাম দ্বারা উদ্দেশ্য হচ্ছে ঐসব রাষ্ট্র যেগুলো ইসলামী আইন অনুযায়ী চলে। আর দারুল হরব হচ্ছে ঐসব রাষ্ট্র যেগুলো কাফেরদের রাষ্ট্রপ্রধানের আদেশানুযায়ী চলে এবং সেগুলো তার আয়ত্বাধীন।”
“দারুল ইসলাম দ্বারা উদ্দেশ্য হচ্ছে ঐসব রাষ্ট্র যেগুলো ইসলামী আইন অনুযায়ী চলে। আর দারুল হরব হচ্ছে ঐসব রাষ্ট্র যেগুলো কাফেরদের রাষ্ট্রপ্রধানের আদেশানুযায়ী চলে এবং সেগুলো তার আয়ত্বাধীন।”
(আল-বিনায়া: ৭/২১৭, কিতাবুস সিয়ার, বাবুল মুসতা’মান।)
লক্ষণীয়:
এখানে লক্ষ্যণীয় যে, তিনি দারুল ইসলামের সংজ্ঞা এভাবে দেননি যে,
"فإن دار الإسلام اسم للموضع الذي يكون تحت يد المسلمين"
“‘দারুল ইসলাম’ ঐ ভূখন্ডের নাম যা মুসলমানদের কব্জায় রয়েছে।”
“‘দারুল ইসলাম’ ঐ ভূখন্ডের নাম যা মুসলমানদের কব্জায় রয়েছে।”
যেমনটা বলেছেন শামসুল আইম্মা সারাখসী রহ. (মৃত্যু: ৪৯০হি.)। দেখুন: (শরহুস সিয়ারীল কাবীর: পরিচ্ছেদ-১২৭, খন্ড-৪, পৃষ্ঠা-৮৬)
এভাবেও দেননি যে,
"دار الاسلام ما يجري فيه حكم امام المسلمين و كانوا فيه آمنين."
“‘দারুল ইসলাম’ ঐ ভূখন্ড যাতে মুসলমানদের ইমাম (রাষ্ট্র প্রধান) এর শাসন চলে এবং মুসলমানরা সেখানে নিরাপত্তার সাথে বসবাস করে।”
যেমনটা বলেছেন কুহুসতানী রহ. (মৃত্যু: ৯৫০হি.)। দেখুন: (জামিউর *রুমুজ:খন্ড-৪, পৃষ্ঠা-৫৫৬)“‘দারুল ইসলাম’ ঐ ভূখন্ড যাতে মুসলমানদের ইমাম (রাষ্ট্র প্রধান) এর শাসন চলে এবং মুসলমানরা সেখানে নিরাপত্তার সাথে বসবাস করে।”
বরং তিনি সংজ্ঞা এভাবে দিয়েছেন,
بلاد تجري فيها أحكام الإسلام
(যেসব রাষ্ট্র ইসলামী আইন অনুযায়ী চলে)।
(যেসব রাষ্ট্র ইসলামী আইন অনুযায়ী চলে)।
তিনি মুসলমানদের হাতে থাকা না থাকার উপর ভিত্তি করে হুকুম লাগাননি। তিনি হুকুম লাগিয়েছেন আইনের উপর ভিত্তি করে। অতএব, রাষ্ট্র ইসলামী হওয়ার জন্য রাষ্ট্রীয় আইন ইসলামী হওয়া আবশ্যক।
অপরদিকে তিনি দারুল হরবের সংজ্ঞায় বলেছেন,
بلاد يجري فيها أمر عظيمهم
(যেসব রাষ্ট্র কাফেরদের রাষ্ট্রপ্রধানের আদেশানুযায়ী চলে)।
(যেসব রাষ্ট্র কাফেরদের রাষ্ট্রপ্রধানের আদেশানুযায়ী চলে)।
অর্থাৎ যেগুলো আল্লাহর আইন দিয়ে চলে না বরং গাইরুল্লাহর আইন দিয়ে চলে। কাফেরদের রাষ্ট্রপ্রধানের আদেশ দ্বারা এটাই বুঝা যাচ্ছে যে, সেখানকার কর্তৃত্ব গাইরুল্লাহর কাছে। আল্লাহ তাআলার শরীয়তের সেখানে কর্তৃত্ব নেই।
অতএব, তাঁর সংজ্ঞা থেকে বুঝা যাচ্ছে যে, দারুল ইসলাম হওয়ার জন্য রাষ্ট্র ইসলামী আইন অনুযায়ী শাসিত হওয়া আবশ্যক। পক্ষান্তরে যেসব রাষ্ট্র ইসলাম অনুযায়ী চলে না বরং মানুষের আদেশ নিষেধ ও তাদের বানানো আইন অনুযায়ী চলে সেগুলো দারুল ইসলাম নয়।
এ থেকে বুঝে আসে যে, সারাখসীরহ. এবংকুহুসতানীরহ. এরবক্তব্যে যে, মুসলমানদের হাতে থাকা কিংবা ইমামুল মুসলিমীনের শাসন চলার কথা বলা হয়েছে এর দ্বারা মূলত ইসলামী শাসন জারি থাকাই উদ্দেশ্য।অধিকন্তু বাহ্যিকভাবে উনাদের বক্তব্যথেকেওএটাবুঝাযায়নাযে, আইনইসলামীনাহলেওরাষ্ট্রদারুলইসলামহয়েযাবে।বরংএরবিপরীতটাইবুঝাযায়।তাকীউসমানীসাহেবেরদাবিরখণ্ডনেইতিপূর্বেআমিতাআলোচনাকরেছি।
একটি সংশয়:
তাকী উসমানী সাহেবের দাবির পক্ষে কেউ হয়তো বলতে পারেন, তিনি যেহেতু গণতান্ত্রিক শাসকদেরকে কাফের মনে করেনে না তাই তার মতে বাহ্যিক দৃষ্টিতে রাষ্ট্রগুলো মুসলমানদের হাতে। ফলে সারাখসী রহ. এবং কুহুসতানী রহ. এর বক্তব্যের উপর ভিত্তি করে তিনি সেগুলোকে দারুল ইসলাম বলেছেন।
কিন্তু এ বক্তব্যে আমাদের যথেষ্ট আপত্তি আছে। কারণ,
প্রথমত:
এসব শাসক কাফের হওয়াটা শরয়ী দলীল দ্বারা প্রমাণিত। আর এ ব্যাপারে বিশ্ববরেণ্য উলামায়ে কেরামের ফতোয়াও বিদ্যমান রয়েছে। তিনি এর বিপরীতে কোন দলীল দেননি এবং উলামায়ে কেরামের ফতোয়াগুলোর কোন জওয়াবও দেননি, অথচ তা জরুরী ছিল। কেননা, বিষয়টি একদিকে যেমন বর্তমান বিশ্বে একটি বহুল আলোচিত বিষয় অপর দিকে এর সাথে আরোও অনেক বিধি বিধান সংশ্লিষ্ট।
দ্বিতীয়ত:
যদি মেনেও নেই যে, তিনি শাসকদেরকে কাফের মনে না করার কারণে ফুকাহায়ে কেরামের কারো কারো বক্তব্য থেকে তার সংশয় হতে পারে যে, এসব রাষ্ট্র দারুল ইসলাম- তবুও উনার দাবি ও আলোচনার উপর যথেষ্ট আপত্তি রয়েছে। কারণ, দারুল দারুল ইসলাম ও দারুল হরবের ব্যাপারে আইম্মায়ে কেরামের অসংখ্য বক্তব্য রয়েছে। অনেকের বক্তব্য অনেকটাই সুস্পষ্ট। যেমন, দারুল ইসলামের ব্যাপারে আইনী রহ. এর বক্তব্য সুস্পষ্ট্য।
المراد بدار الإسلام بلاد تجري فيها أحكام الإسلام
“দারুল ইসলাম দ্বারা উদ্দেশ্য হচ্ছে ঐসব রাষ্ট্র যেগুলো ইসলামী আইন অনুযায়ী চলে।”
আরো কয়েকটি সুষ্পষ্ট বক্তব্য:
কাজী আবু ইয়ালা হাম্বলী রহ. (মৃত্যুঃ ৪৫৮ হি.) বলেন,
وكل دار كانت الغلبة فيها لأحكام الإسلام دون أحكام الكفر: فهي دار إسلام، وكل دار كانت الغلبة فيها لأحكام الكفر دون أحكام الإسلام: فهي دار كفر.اهـ
“প্রত্যেক ঐ রাষ্ট্র যেখানে ইসলামী বিধান বিজয়ী তা দারুল ইসলাম। আর প্রত্যেক ঐ রাষ্ট্র যেখানে কুফরী বিধান বিজয়ী তা দারুল কুফর।” (আল-মু’তামাদ ফিল
উসূলঃ ২৭৬)
“প্রত্যেক ঐ রাষ্ট্র যেখানে ইসলামী বিধান বিজয়ী তা দারুল ইসলাম। আর প্রত্যেক ঐ রাষ্ট্র যেখানে কুফরী বিধান বিজয়ী তা দারুল কুফর।” (আল-মু’তামাদ ফিল
উসূলঃ ২৭৬)
এ বক্তব্য একেবারেই সুস্পষ্ট যে, দারের হুকুম নির্ভর করে তাতে প্রচলিত বিধানের উপর। বিধান ইসলামী হলে দারুল ইসলাম, কুফরী হলে দারুল কুফর।
ইমাম মারদাবী রহ. (মৃত্যু: ৮৮৫হি.)বলেন,
ودارالحرب: ما يغلب فيها حكم الكفر
“দারুল হরব ঐ ভূখন্ড যেখানে কুফরী বিধান বিজয়ী।” [আল-ইনসাফঃ৪/১২১]
দারুল হরবের ব্যাপারে এ বক্তব্য স্পষ্ট।
ইবনু মুফলীহ আল-হাম্বলী রহ. (মৃত্যু: ৭৬৩হি.)- যিনি শাইখুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া রহ. এর শাগরেদ - বলেন,
فكل دارغلب عليها أحكام المسلمين فدارالإسلام، وإن غلب عليها أحكام الكفار فدارالكفر، ولا دار لغيرهما
“প্রত্যেক ঐ রাষ্ট্র যেখানে মুসলমানদের আহকাম বিজয়ী তা দারুল ইসলাম। আর যদি তাতে কাফেরদের আহকাম বিজয়ী হয় তাহলে তা দারুল কুফর। এই দুই প্রকার রাষ্ট্র ব্যতীত অন্যকোন রাষ্ট্র নেই।” [আল-আদাবুশ শরঈয়্যাহঃ ১/২১২]
“প্রত্যেক ঐ রাষ্ট্র যেখানে মুসলমানদের আহকাম বিজয়ী তা দারুল ইসলাম। আর যদি তাতে কাফেরদের আহকাম বিজয়ী হয় তাহলে তা দারুল কুফর। এই দুই প্রকার রাষ্ট্র ব্যতীত অন্যকোন রাষ্ট্র নেই।” [আল-আদাবুশ শরঈয়্যাহঃ ১/২১২]
সন্দেহ নেই যে, মুসলমানদের আহকাম বলতে ইসলামী আহকাম আর কাফেরদের আহকাম বলতে কুফরী আহকাম উদ্দেশ্য। কাজেই এ বক্তব্যও সুস্পষ্ট।
‘আল-মাওসূআতুল ফিকহিয়্যাহ্ আল-কুয়েতিয়্যাহ’ তে দারুল ইসলাম ও দারুল হরবের নিম্নোক্ত সংজ্ঞা দেয়া হয়েছে-
دارالإسلام هي: كل بقعة تكون فيها أحكام الإسلام ظاهرة.اهـ
“দারুল ইসলাম প্রত্যেক এমন ভূখন্ড যেখানে ইসলামী বিধান বিজয়ী রয়েছে।”
“দারুল ইসলাম প্রত্যেক এমন ভূখন্ড যেখানে ইসলামী বিধান বিজয়ী রয়েছে।”
دارالحرب هي: كل بقعة تكون فيها أحكام الكفر ظاهرة.اهـ
“দারুল হরব প্রত্যেক এমন ভূখন্ড যেখানে কুফরী বিধান বিজয়ী রয়েছে।”
[‘আল-মাওসূআতুল ফিকহিয়্যাহ্ আল-কুয়েতিয়্যাহ’: ২০/২০১, হরফ: দাল]
“দারুল হরব প্রত্যেক এমন ভূখন্ড যেখানে কুফরী বিধান বিজয়ী রয়েছে।”
[‘আল-মাওসূআতুল ফিকহিয়্যাহ্ আল-কুয়েতিয়্যাহ’: ২০/২০১, হরফ: দাল]
এ বক্তব্যও স্পষ্ট।
উচিৎ ছিল তাদের সামগ্রীক বক্তব্যের আলোকে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা। কিন্তু তিনি তা না করে বরং কয়েকটা অস্পষ্ট বক্তব্যকে নিজের মতো করে ব্যখ্যা করে দাবি প্রমাণের চেষ্টা করেছেন। আলহামদুলিল্লাহ আমি পর্যালোচনায় দেখিয়েছি যে, আইম্মায়ে কেরামের যেসব উদ্ধৃতি দিয়ে তিনি দলীল দেয়ার চেষ্টা করেছেন সেগুলোর কোনটাই তার পক্ষের দলীল হয় না। বরং সেগুলো থেকে তার বিপরীত বুঝে আসে।
তৃতীয়ত:
ফুকাহায়ে কেরাম স্পষ্ট বলে গেছেন যে, রাষ্ট্র হয়তো দারুল ইসলাম হবে নয়তো দারুল হরব হবে। মাঝামাঝি কোন সূরত নেই। আর আইনী রহ. এর বক্তব্য সহ আরো অনেকের বক্তব্য থেকে বুঝা যায় যে, দারুল ইসলাম হওয়ার জন্য আইন ইসলামী হওয়া আবশ্যক। আর অন্যান্য আইম্মার বক্তব্য থেকে এটা প্রমাণিত হয় না যে, আইন ইসলামী না হলেও রাষ্ট্র দারুল ইসলাম হয়ে যাবে। দারুল ইসলাম যদি না হয় তাহলে তো দারুল হরবই হবে। কারণ, মাঝামাঝি কোন সূরত নেই। এ হিসেবে আইম্মায়ে কেরামের সামগ্রীক বক্তব্যের আলোকে এসব রাষ্ট্র দারুল হরব হওয়াটাই যুক্তিযুক্ত হয়। দারুল ইসলাম প্রমাণিত হয় না।
চতুর্থত:
ফিকহের কিতাবাদিতে বলা হয়, ‘দারুল ইসলাম’। ‘দারুল মুসলিমীন’ বলা হয় না। অর্থাৎ রাষ্ট্রকে ইসলামের দিকে সম্বন্ধিত করা হয়, মুসলমানদের দিকে নয়। এ থেকে বুঝে আসে, কোন রাষ্ট্র ‘দারুল ইসলাম’ হওয়ার জন্য তাতে মুসলমান থাকা জরুরী নয়, কিন্তু ইসলাম থাকা জরুরী। আবার ইসলাম পরাজিত হয়ে থাকলে হবে না। বিজয়ী বেশে থাকা শর্ত। রশীদ আহমদ গাঙ্গুহী রহ. তাঁর ফতোয়ায় এ সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। অতএব, যেখানে ইসলাম বিজয়ী তা দারুল ইসলাম যদিও তাতে মুসলমান না থাকে। যেমন, দারুল ইসলামের ঐ অংশ যেখানে যিম্মি কাফেররা বসবাস করে। আর যেখানে ইসলাম বিজয়ী নয় তা দারুল ইসলাম নয় যদিও তাতে অনেক মুসলমান থাকে। যেমন, ঐ দারুল হরব যেখানে মুসলমানরা কাফেরদের অনুমতি নিয়ে বা তাদের গাফলতির সুযোগে বসবাস করে। এ হিসেবেও কুফর শাসিত রাষ্ট্র দারুল ইসলাম প্রমাণিত হয় না।
এতএব, শাসকদেরকে কাফের না ধরলেও এসব রাষ্ট্র দারুল ইসলাম প্রমাণিত হয় না। আইম্মায়ে কেরামের সামগ্রীক বক্তব্যের দিকে তাকালে বরং এর বিপরীতই বুঝে আসে। কাজেই তাকী উসমানী সাহেবের সংশয়কে মেনে নিলেও উনার দাবি ও আলোচনাকে যথার্থ বলার কোন সুযোগ নেই। ওয়াল্লাহু সুবহানাহু ওয়া তাআলা আ’লাম।
Comment