আসসালামু আলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহ। নাহমাদুহু ওয়ানু সাল্লি আ’লা রাসূলিহিল কারীম। আম্মা বা’দ-
বিশ্বব্যাপী মুজাহিদীনের মাঝে ফেতনা সৃষ্টিকারী একটি সংগঠনের নাম হলো আইসিস। বিভিন্ন জিহাদী ময়দানে দলটির উপস্থিতি মুজাহিদীন এবং কুফফার বাহিনীর মূল যুদ্ধকে আড়াল করে দিচ্ছে! আফগানিস্তানের পবিত্র জিহাদী ভূমিতেও আইসিস ফেতনার উদ্ভব ঘটেছে! যদিও ফেতনা সৃষ্টিকারী এই দলটির মুখোশ আল্লাহ তা’য়ালা সত্যন্বেষীদের সামনে উন্মোচিত করে দিয়েছেন শুরু লগ্নেই। তবে, চক্রান্তকারীরা তাদের কুচক্রান্ত প্রক্রিয়া থামায়নি। আফগানিস্তানের পবিত্র ভূমিকে ইসলামী শরীয়ার অধীনে পরিচালিত করার জন্য দীর্ঘদিন যাবৎ বহু ত্যাগ স্বীকার করে লড়াই করে আসা তালেবান মুজাহিদীনের ব্যাপারে নানা ধরণের মিথ্যা প্রচারণা চালাচ্ছে আইএস ভক্তরা। ঐ সকল প্রচারণা তাদের মিথ্যাচার এবং শরয়ী জ্ঞানের ব্যাপারে তাদের অজ্ঞতার পরিচয় বহন করে। ২০১৫ সালের ১লা নভেম্বরে আল-জাজিরা সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশিত একটি ভিডিও রিপোর্টের ভিত্তিতে এদেশীয় কিছু আইএসভক্ত জোর গলায় প্রথমে অপবাদ দেয় যে, তালেবান জাতীয়তাবাদী। তারপর, তারা জাতীয়তাবাদের মিথ্যা অভিযোগ আরোপ করে তালেবানকে মুরতাদ প্রমাণের নিকৃষ্ট চেষ্টা চালায়। যদিও জাতীয়তাবাদী মানেই মুরতাদ কিনা সে বিষয়টিও বিশদ আলোচনার দাবি রাখে। যাইহোক, আজ আপনাদের সামনে তালেবান কি জাতীয়তাবাদী কি না সে বিষয়টিই তুলে ধরা উদ্দেশ্য। আইএস ভক্তদের সরবরাহ করা আল-জাজিরার ভিডিওটিতে দেখা যায়- একজন সাবেক তালেবান অফিসিয়াল বলতেছেন যে, ‘ তালেবানরা বলেন- আমরা আফগানিস্তানের ভৌগলিক সীমারেখা অনুযায়ী আফগানিস্তান স্বাধীন করতে চাই। আমরা রাশিয়ায় আক্রমণ করতে চাই না, আমরা আমেরিকাতেও আক্রমণ করতে চাই না।'
সাবেক তালেবান অফিসিয়ালের এই বক্তব্যকে কেন্দ্র করে এ দেশের কিছু আইএসের অনুসারী তালেবানকে প্রথমে জাতীয়তাবাদী এবং পরে মুরতাদ বলে আখ্যায়িত করেছে। আইএস অনুসারীদের ঐ বক্তব্যে তাদের ইসলামী শরীয়ত বিমুখতা এবং শরীয়ত সম্পর্কে অজ্ঞতার বিষয়টি স্পষ্ট হয়েছে বলে মনে করি। যাইহোক, আজ তাদের ঐ ভ্রান্ত চিন্তাধারার শরয়ী বিশ্লেষণপূর্বক জবাব দেওয়ার ইচ্ছা করেছি, ওয়ামা তাওফিকী ইল্লা-বিল্লাহ।
জাতীয়তাবাদ বা আসাবিয়্যাত মানে কি?
তালেবানদের বিরুদ্ধে আইএস অনুসারীদের তোলা জাতীয়তাবাদ বা আসাবিয়্যাতের অভিযোগের বিষয়টি নিয়ে আলোচনার পূর্বে শরীয়তের দৃষ্টিতে জাতীয়তাবাদ বা আসাবিয়্যাহ মানে কী তা বুঝতে হবে। আসাবিয়্যাহ বা জাতীয়তাবাদ সম্পর্কে আবু দাউদ শরীফের ৪৯০৫ নম্বর হাদিসে বর্ণিত হয়েছে-
يا رسول الله ، ما العصبية ؟ قال : " أن تعين قومك على الظلم - قال : قلت رضي الله عنه وعن واثلة بن الأسقع
(رواه أبو داود)
অর্থাৎ, একজন সাহাবী(হাদিসবর্ণনাকারী) আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে জিজ্ঞাসা করলেন- ইয়া রাসূলুল্লাহ!(সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আসাবিয়্যাহ(জাতীয়তাবাদ) মানে কি? আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, ''আসাবিয়্যাহ হলো- জুলুমের ব্যাপারে তোমার কওমকে (জাতিকে) সাহায্য করা।''
সুনানে ইবনে মাজাহ-এর ৩৯৪৯ নম্বর হাদিসে আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আরো সুস্পষ্ট ভাষায় আমাদেরকে আসাবিয়্যাতের সংজ্ঞা জানিয়ে দিয়েছেন। হাদিসটি হলো-
يا رسول الله أمن العصبية أن يحب الرجل قومه قال لا ولكن من العصبية أن يعين الرجل قومه على الظلم
অর্থাৎ, আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে জিজ্ঞাসা করা হলো- হে আল্লাহর রাসূল!(সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) যদি কোন লোক তার জাতিকে ভালোবাসে, তাহলে এটা কি আসাবিয়্যা বলে গণ্য হবে? আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন- না, বরং আসাবিয়্যাহ হলো- কোন লোক তার কওমকে জুলুমের ব্যাপারে সাহায্য করা।
উপরোক্ত হাদিসদুটির আলোকে বুঝে আসে- আসাবিয়্যাত মানে এই না যে, নিজ জাতিকে ভালোবাসা বা একটি নির্দিষ্ট ভূখণ্ডে দৃষ্টি নিবদ্ধ করা। বরং, জাতীয়তাবাদ বা আসাবিয়্যাত মানে হলো- নিজ জাতিকে জুলুমের ব্যাপারে সাহায্য করা। অর্থাৎ, শরীয়তের উপরে নিজ জাতিকে প্রাধান্য দেওয়া।
এখন আমরা মূল আলোচনায় আসতে পারি ইনশাআল্লাহ।
প্রথমত, তালেবানকে জাতীয়তাবাদী বলার ব্যাপারে আইএস অনুসারীদের চিন্তাধারা হলো- কেবল আফগানিস্তানের প্রতি তালেবানের দৃষ্টি নিবদ্ধ করা। আর, এটাকেই আইএস অনুসারীরা জাতীয়তাবাদ বলে চালিয়ে দিচ্ছে এবং তালেবানকে মুরতাদ প্রমাণে এটাকে অন্যতম দলিল হিসেবে পেশ করছে!! কিন্তু, আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের হাদিসে আমরা দেখলাম যে, আইএস অনুসারীদের জাতীয়তাবাদ সম্পর্কে এরূপ চিন্তাধারার শরীয়তে কোন ভিত্তি নেই। বরং, এ ধরণের চিন্তাধারা হলো সেক্যুলার জাতীয়তাবাদী চিন্তাধারা, যেখানে জাতীয়তাবাদকে সংজ্ঞায়িত করা হয় একটি নির্দিষ্ট ভূখণ্ড বা ভাষাভিত্তিক জাতির উপর ভিত্তি করে। অন্যদিকে, শরীয়তের দৃষ্টিতে জাতীয়তাবাদ মানে হলো- ইসলামী শরীয়তের উপরে গোত্র, বর্ণ, জাতিগত পরিচয়কে প্রাধান্য দেওয়া। আর, এই নীতি অবলম্বন করে জুলুমের ব্যাপারে নিজ জাতিকে সাহায্য করা। অর্থাৎ, কেউ যখন তার পিতৃপরিচয়, বা গোত্র পরিচয়- এগুলোর কারণে আল্লাহ বা আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের আনুগত্য করেনি, বা এসব কারণে শরীয়তের হুকুম লঙ্ঘন করেছে বা শরীয়তের নির্ধারিত সীমার মধ্যে থাকেনি তখন সেটাকে বলা হয়েছে জাতীয়তাবাদ। আল-ওয়ালা ওয়াল-বারাআকে জাতীয়তা বা সীমান্ত দিয়ে সংজ্ঞায়িত করা; যেমন- যে বাংলাদেশী সেই আমার বন্ধু, যে বাংলাদেশী নয়, তার ব্যাপারে আমার কোন দায়িত্ব নেই!- এরূপ করাটা হলো শরীয়তের দৃষ্টিতে আসাবিয়্যাহ বা জাতীয়তাবাদ। কিন্তু, এগুলোর কোনোটিই তালেবান মুজাহিদীনের বিরুদ্ধে প্রমাণিত হয় না। সুতরাং, তালেবানদের উপর আইএস অনুসারীদের আনীত জাতীয়তাবাদের অভিযোগ সম্পূর্ণ ভ্রান্ত । আর, এখানে আইএস অনুসারীদের মূর্খতার বিষয়টিও প্রমাণিত হয়েছে। আশা করি, বিষয়টি কারো কাছে এখন অস্পষ্ট নেই।
দ্বিতীয়ত, এখন প্রশ্ন হতে পারে- তালেবান কি আল-ওয়ালা ওয়াল-বারাআকে সীমান্ত দিয়ে সংজ্ঞায়িত করেছে? আমেরিকা বা রাশিয়া অর্থাৎ বহির্বিশ্বে তালেবানের আক্রমণ না করার ব্যাপারে শরীয়ত কী বলে?
এ ব্যাপারে আমি সংক্ষেপে কিছু কথা বলাই যথেষ্ট মনে করছি। আল্লাহু আ’লাম।
আল-ওয়ালা ওয়াল-বারাআর ক্ষেত্রে তালেবানরা যে সীমান্তকে বা জাতীয়তাকে প্রাধান্য দেয়নি, তা সারা বিশ্ববাসীর নিকট সুস্পষ্ট। যখন শায়েখ উসামা বিন লাদেন রহিমাহুল্লাহকে আমেরিকার হাতে তুলে দেওয়ার জন্য তালেবান প্রধানকে বলা হলো, তখন তালেবান প্রধানের প্রতিক্রিয়া সবার কাছে দিনের আলোর ন্যায় পরিষ্কার। তালেবান তখন আল-ওয়ালা ওয়াল-বারাআর ব্যাপারে সীমান্ত বা জাতীয়তাকে প্রাধান্য দেননি। বরং, নিজেদের জান-মালকে হুমকির মুখোমুখি করেও একজন মুসলিম ভাইকে কাফেরদের হাতে তুলে না দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। একইভাবে, সীমান্ত বা জাতীয়তার পার্থক্যকে দূরে ঠেলে সারাবিশ্বের যেখান থেকে মুহাজিরিন ও মুজাহিদীন হিজরত করেছেন তাদের সকলকে তালেবান সরকার আশ্রয় দিয়েছেন, সাহায্য করেছেন। উনাদের তখনো এই শক্তি ছিল না যে, উনারা আফগানিস্তান থেকে বাহিনী নিয়ে বের হয়ে কাশ্মীর মুক্ত করে ফেলবেন। কিন্তু, উনারা কাশ্মীরী মুজাহিদীনকে আফগানিস্তানে ট্রেনিং নিতে দিয়েছেন। সাধ্যমত বিভিন্ন দলকে সহায়তা করার চেষ্টা করেছেন। মাসউদ আজহার সাহেবকে যখন মুক্ত করা হলো, তখন সেই প্লেন আফগানিস্তানে ল্যান্ড করেছে। সুতরাং বাস্তবতা হলো- ইমারত শক্তিশালী থাকাকালীন তাদের আল-ওয়ালা ওয়াল বারাআর নীতি ছিল শরীয়তেরই নীতি। আর আজও তারা সেই নীতির উপরই প্রতিষ্ঠিত আছে বলে মনে করি।
আর, যদি তালেবানের বহির্বিশ্বে আক্রমণের বিষয়ে বলি, তাহলে বুঝতে হবে-
ইসলামী ইমারত কি এখনো পুরো আফগানিস্তান দখল করতে পেরেছে? উনারা কি পুরো খোরাসানে তামকিন পেয়েছেন? - না । বরং, উনারা গেরিলা যুদ্ধে লিপ্ত। যেখানে কখনো শত্রুরা জিতে, কখনো উনারা জিতেন। এই অবস্থায় উনারা কেনো শত্রু সংখ্যা বাড়াতে চাইবেন? এটা নববী সিয়াসা আশ-শরীয়াহ এর একটি নীতি- শত্রু সংখ্যা কম রাখা । দায়েশ যেমন সারা দুনিয়ার মুসলিমদের কাছে বায়াত চেয়েছে, অথচ তাদের ইমারতের তামকিন ছিল ইরাক ও সিরিয়া আর কিছু জায়গার মধ্যে সীমাবদ্ধ। তাদের ঘোষণা গ্লোবাল ছিলো- কিন্তু সেই কথার পেছনে কোন বাস্তবতা ছিল না।
তালেবানের মুজাহিদীনের এখন বহির্বিশ্বে আক্রমণ না করার কথা বলায় তো শরয়ী কোন সমস্যা নেই! আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তো একই সময়ে সবার সাথে যুদ্ধ করেননি! প্রথমে আগ্রাসী কুরাইশের বিরুদ্ধে রক্ষণাত্মকভাবে, তারপর ইহুদী, তারপর বাকি আরববিশ্ব। এই ছিল আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নীতি। আর, তালেবান মুজাহিদীন যদি বহির্বিশ্বে আক্রমণ না করার কথাও বলেন, তারা কি বহির্বিশ্বে আক্রমণ করাকে হারাম সাব্যস্ত করেছেন?!!!! না, বরং এমন একটি দলের (আল-কায়েদা) বায়াত গ্রহণ করেছেন যে দলটি সারাবিশ্বে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন। সুতরাং, তালেবান মুজাহিদীনের বিরুদ্ধে বৈশ্বিক জিহাদবিরোধীর অভিযোগ তোলা মূর্খতা ও শয়তানী বৈ নয় ।
আবার দেখুন- যদি আমি দায়েশের কথা মেনেও নেই, তাহলে সর্বোচ্চ এটা বলা যায় যে, তালিবান একটি স্থানীয় জিহাদী আন্দোলন। তারা আফগানিস্তানে ইসলামী ইমারত কায়েমের জন্য কাজ করে যাচ্ছেন। অর্থাৎ, তারা স্থানীয় জিহাদ করছেন। তাও কিন্তু জাতীয়তাবাদ বলা যায় না।
মূলত: দায়েশের(আইএস) সমস্যা হলো তারা কিছু নতুন পরিভাষা তৈরি করেছে। শাহওয়াত, জাতীয়তাবাদ- এই সব। এগুলোর সংজ্ঞা কী, সেটা তারা পরিষ্কার করে না। এগুলো শরয়ী পরিভাষা নয়। কিন্তু, এই পরিভাষার উপর ভিত্তি করে তারা শরয়ী হুকুম প্রয়োগ করে।
যেমন:-
১। অমুক ব্যক্তি জাতীয়তাবাদী।
২। জাতীয়তাবাদ রিদ্দা(এখানে কিন্তু তাফসিল প্রয়োজন, যে জাতীয়তাবাদ বলতে কী বুঝানো হচ্ছে)
৩। অতএব, অমুক ব্যক্তি মুরতাদ।
এগুলো হলো জাহালতের কথা। আর তাদের বিকৃত মানহাজের পরিচায়ক। তাদের লিডাররা এগুলো বুঝে শুনেই করে। কারণ তারা চায়, দুনিয়াতে তারাই একমাত্র বৈধ জিহাদী জামাআত- এটা প্রমাণ করতে। আর তাদের কর্মীরা বেশিরভাগই মাথামোটা। এরা মুখস্থ কথা বলে, এদের পড়াশোনা কম। সাম্প্রতিক সময়ে অনলাইনে তাদের কার্যক্রমই তাদের মূর্খতার পরিচয় বহন করে! যাইহোক, আল্লাহর কাছে দ্বীনী বিষয়ে মূর্খতা থেকে পানাহ চাই।
বিশ্বব্যাপী মুজাহিদীনের মাঝে ফেতনা সৃষ্টিকারী একটি সংগঠনের নাম হলো আইসিস। বিভিন্ন জিহাদী ময়দানে দলটির উপস্থিতি মুজাহিদীন এবং কুফফার বাহিনীর মূল যুদ্ধকে আড়াল করে দিচ্ছে! আফগানিস্তানের পবিত্র জিহাদী ভূমিতেও আইসিস ফেতনার উদ্ভব ঘটেছে! যদিও ফেতনা সৃষ্টিকারী এই দলটির মুখোশ আল্লাহ তা’য়ালা সত্যন্বেষীদের সামনে উন্মোচিত করে দিয়েছেন শুরু লগ্নেই। তবে, চক্রান্তকারীরা তাদের কুচক্রান্ত প্রক্রিয়া থামায়নি। আফগানিস্তানের পবিত্র ভূমিকে ইসলামী শরীয়ার অধীনে পরিচালিত করার জন্য দীর্ঘদিন যাবৎ বহু ত্যাগ স্বীকার করে লড়াই করে আসা তালেবান মুজাহিদীনের ব্যাপারে নানা ধরণের মিথ্যা প্রচারণা চালাচ্ছে আইএস ভক্তরা। ঐ সকল প্রচারণা তাদের মিথ্যাচার এবং শরয়ী জ্ঞানের ব্যাপারে তাদের অজ্ঞতার পরিচয় বহন করে। ২০১৫ সালের ১লা নভেম্বরে আল-জাজিরা সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশিত একটি ভিডিও রিপোর্টের ভিত্তিতে এদেশীয় কিছু আইএসভক্ত জোর গলায় প্রথমে অপবাদ দেয় যে, তালেবান জাতীয়তাবাদী। তারপর, তারা জাতীয়তাবাদের মিথ্যা অভিযোগ আরোপ করে তালেবানকে মুরতাদ প্রমাণের নিকৃষ্ট চেষ্টা চালায়। যদিও জাতীয়তাবাদী মানেই মুরতাদ কিনা সে বিষয়টিও বিশদ আলোচনার দাবি রাখে। যাইহোক, আজ আপনাদের সামনে তালেবান কি জাতীয়তাবাদী কি না সে বিষয়টিই তুলে ধরা উদ্দেশ্য। আইএস ভক্তদের সরবরাহ করা আল-জাজিরার ভিডিওটিতে দেখা যায়- একজন সাবেক তালেবান অফিসিয়াল বলতেছেন যে, ‘ তালেবানরা বলেন- আমরা আফগানিস্তানের ভৌগলিক সীমারেখা অনুযায়ী আফগানিস্তান স্বাধীন করতে চাই। আমরা রাশিয়ায় আক্রমণ করতে চাই না, আমরা আমেরিকাতেও আক্রমণ করতে চাই না।'
সাবেক তালেবান অফিসিয়ালের এই বক্তব্যকে কেন্দ্র করে এ দেশের কিছু আইএসের অনুসারী তালেবানকে প্রথমে জাতীয়তাবাদী এবং পরে মুরতাদ বলে আখ্যায়িত করেছে। আইএস অনুসারীদের ঐ বক্তব্যে তাদের ইসলামী শরীয়ত বিমুখতা এবং শরীয়ত সম্পর্কে অজ্ঞতার বিষয়টি স্পষ্ট হয়েছে বলে মনে করি। যাইহোক, আজ তাদের ঐ ভ্রান্ত চিন্তাধারার শরয়ী বিশ্লেষণপূর্বক জবাব দেওয়ার ইচ্ছা করেছি, ওয়ামা তাওফিকী ইল্লা-বিল্লাহ।
জাতীয়তাবাদ বা আসাবিয়্যাত মানে কি?
তালেবানদের বিরুদ্ধে আইএস অনুসারীদের তোলা জাতীয়তাবাদ বা আসাবিয়্যাতের অভিযোগের বিষয়টি নিয়ে আলোচনার পূর্বে শরীয়তের দৃষ্টিতে জাতীয়তাবাদ বা আসাবিয়্যাহ মানে কী তা বুঝতে হবে। আসাবিয়্যাহ বা জাতীয়তাবাদ সম্পর্কে আবু দাউদ শরীফের ৪৯০৫ নম্বর হাদিসে বর্ণিত হয়েছে-
يا رسول الله ، ما العصبية ؟ قال : " أن تعين قومك على الظلم - قال : قلت رضي الله عنه وعن واثلة بن الأسقع
(رواه أبو داود)
অর্থাৎ, একজন সাহাবী(হাদিসবর্ণনাকারী) আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে জিজ্ঞাসা করলেন- ইয়া রাসূলুল্লাহ!(সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আসাবিয়্যাহ(জাতীয়তাবাদ) মানে কি? আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, ''আসাবিয়্যাহ হলো- জুলুমের ব্যাপারে তোমার কওমকে (জাতিকে) সাহায্য করা।''
সুনানে ইবনে মাজাহ-এর ৩৯৪৯ নম্বর হাদিসে আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আরো সুস্পষ্ট ভাষায় আমাদেরকে আসাবিয়্যাতের সংজ্ঞা জানিয়ে দিয়েছেন। হাদিসটি হলো-
يا رسول الله أمن العصبية أن يحب الرجل قومه قال لا ولكن من العصبية أن يعين الرجل قومه على الظلم
অর্থাৎ, আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে জিজ্ঞাসা করা হলো- হে আল্লাহর রাসূল!(সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) যদি কোন লোক তার জাতিকে ভালোবাসে, তাহলে এটা কি আসাবিয়্যা বলে গণ্য হবে? আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন- না, বরং আসাবিয়্যাহ হলো- কোন লোক তার কওমকে জুলুমের ব্যাপারে সাহায্য করা।
উপরোক্ত হাদিসদুটির আলোকে বুঝে আসে- আসাবিয়্যাত মানে এই না যে, নিজ জাতিকে ভালোবাসা বা একটি নির্দিষ্ট ভূখণ্ডে দৃষ্টি নিবদ্ধ করা। বরং, জাতীয়তাবাদ বা আসাবিয়্যাত মানে হলো- নিজ জাতিকে জুলুমের ব্যাপারে সাহায্য করা। অর্থাৎ, শরীয়তের উপরে নিজ জাতিকে প্রাধান্য দেওয়া।
এখন আমরা মূল আলোচনায় আসতে পারি ইনশাআল্লাহ।
প্রথমত, তালেবানকে জাতীয়তাবাদী বলার ব্যাপারে আইএস অনুসারীদের চিন্তাধারা হলো- কেবল আফগানিস্তানের প্রতি তালেবানের দৃষ্টি নিবদ্ধ করা। আর, এটাকেই আইএস অনুসারীরা জাতীয়তাবাদ বলে চালিয়ে দিচ্ছে এবং তালেবানকে মুরতাদ প্রমাণে এটাকে অন্যতম দলিল হিসেবে পেশ করছে!! কিন্তু, আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের হাদিসে আমরা দেখলাম যে, আইএস অনুসারীদের জাতীয়তাবাদ সম্পর্কে এরূপ চিন্তাধারার শরীয়তে কোন ভিত্তি নেই। বরং, এ ধরণের চিন্তাধারা হলো সেক্যুলার জাতীয়তাবাদী চিন্তাধারা, যেখানে জাতীয়তাবাদকে সংজ্ঞায়িত করা হয় একটি নির্দিষ্ট ভূখণ্ড বা ভাষাভিত্তিক জাতির উপর ভিত্তি করে। অন্যদিকে, শরীয়তের দৃষ্টিতে জাতীয়তাবাদ মানে হলো- ইসলামী শরীয়তের উপরে গোত্র, বর্ণ, জাতিগত পরিচয়কে প্রাধান্য দেওয়া। আর, এই নীতি অবলম্বন করে জুলুমের ব্যাপারে নিজ জাতিকে সাহায্য করা। অর্থাৎ, কেউ যখন তার পিতৃপরিচয়, বা গোত্র পরিচয়- এগুলোর কারণে আল্লাহ বা আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের আনুগত্য করেনি, বা এসব কারণে শরীয়তের হুকুম লঙ্ঘন করেছে বা শরীয়তের নির্ধারিত সীমার মধ্যে থাকেনি তখন সেটাকে বলা হয়েছে জাতীয়তাবাদ। আল-ওয়ালা ওয়াল-বারাআকে জাতীয়তা বা সীমান্ত দিয়ে সংজ্ঞায়িত করা; যেমন- যে বাংলাদেশী সেই আমার বন্ধু, যে বাংলাদেশী নয়, তার ব্যাপারে আমার কোন দায়িত্ব নেই!- এরূপ করাটা হলো শরীয়তের দৃষ্টিতে আসাবিয়্যাহ বা জাতীয়তাবাদ। কিন্তু, এগুলোর কোনোটিই তালেবান মুজাহিদীনের বিরুদ্ধে প্রমাণিত হয় না। সুতরাং, তালেবানদের উপর আইএস অনুসারীদের আনীত জাতীয়তাবাদের অভিযোগ সম্পূর্ণ ভ্রান্ত । আর, এখানে আইএস অনুসারীদের মূর্খতার বিষয়টিও প্রমাণিত হয়েছে। আশা করি, বিষয়টি কারো কাছে এখন অস্পষ্ট নেই।
দ্বিতীয়ত, এখন প্রশ্ন হতে পারে- তালেবান কি আল-ওয়ালা ওয়াল-বারাআকে সীমান্ত দিয়ে সংজ্ঞায়িত করেছে? আমেরিকা বা রাশিয়া অর্থাৎ বহির্বিশ্বে তালেবানের আক্রমণ না করার ব্যাপারে শরীয়ত কী বলে?
এ ব্যাপারে আমি সংক্ষেপে কিছু কথা বলাই যথেষ্ট মনে করছি। আল্লাহু আ’লাম।
আল-ওয়ালা ওয়াল-বারাআর ক্ষেত্রে তালেবানরা যে সীমান্তকে বা জাতীয়তাকে প্রাধান্য দেয়নি, তা সারা বিশ্ববাসীর নিকট সুস্পষ্ট। যখন শায়েখ উসামা বিন লাদেন রহিমাহুল্লাহকে আমেরিকার হাতে তুলে দেওয়ার জন্য তালেবান প্রধানকে বলা হলো, তখন তালেবান প্রধানের প্রতিক্রিয়া সবার কাছে দিনের আলোর ন্যায় পরিষ্কার। তালেবান তখন আল-ওয়ালা ওয়াল-বারাআর ব্যাপারে সীমান্ত বা জাতীয়তাকে প্রাধান্য দেননি। বরং, নিজেদের জান-মালকে হুমকির মুখোমুখি করেও একজন মুসলিম ভাইকে কাফেরদের হাতে তুলে না দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। একইভাবে, সীমান্ত বা জাতীয়তার পার্থক্যকে দূরে ঠেলে সারাবিশ্বের যেখান থেকে মুহাজিরিন ও মুজাহিদীন হিজরত করেছেন তাদের সকলকে তালেবান সরকার আশ্রয় দিয়েছেন, সাহায্য করেছেন। উনাদের তখনো এই শক্তি ছিল না যে, উনারা আফগানিস্তান থেকে বাহিনী নিয়ে বের হয়ে কাশ্মীর মুক্ত করে ফেলবেন। কিন্তু, উনারা কাশ্মীরী মুজাহিদীনকে আফগানিস্তানে ট্রেনিং নিতে দিয়েছেন। সাধ্যমত বিভিন্ন দলকে সহায়তা করার চেষ্টা করেছেন। মাসউদ আজহার সাহেবকে যখন মুক্ত করা হলো, তখন সেই প্লেন আফগানিস্তানে ল্যান্ড করেছে। সুতরাং বাস্তবতা হলো- ইমারত শক্তিশালী থাকাকালীন তাদের আল-ওয়ালা ওয়াল বারাআর নীতি ছিল শরীয়তেরই নীতি। আর আজও তারা সেই নীতির উপরই প্রতিষ্ঠিত আছে বলে মনে করি।
আর, যদি তালেবানের বহির্বিশ্বে আক্রমণের বিষয়ে বলি, তাহলে বুঝতে হবে-
ইসলামী ইমারত কি এখনো পুরো আফগানিস্তান দখল করতে পেরেছে? উনারা কি পুরো খোরাসানে তামকিন পেয়েছেন? - না । বরং, উনারা গেরিলা যুদ্ধে লিপ্ত। যেখানে কখনো শত্রুরা জিতে, কখনো উনারা জিতেন। এই অবস্থায় উনারা কেনো শত্রু সংখ্যা বাড়াতে চাইবেন? এটা নববী সিয়াসা আশ-শরীয়াহ এর একটি নীতি- শত্রু সংখ্যা কম রাখা । দায়েশ যেমন সারা দুনিয়ার মুসলিমদের কাছে বায়াত চেয়েছে, অথচ তাদের ইমারতের তামকিন ছিল ইরাক ও সিরিয়া আর কিছু জায়গার মধ্যে সীমাবদ্ধ। তাদের ঘোষণা গ্লোবাল ছিলো- কিন্তু সেই কথার পেছনে কোন বাস্তবতা ছিল না।
তালেবানের মুজাহিদীনের এখন বহির্বিশ্বে আক্রমণ না করার কথা বলায় তো শরয়ী কোন সমস্যা নেই! আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তো একই সময়ে সবার সাথে যুদ্ধ করেননি! প্রথমে আগ্রাসী কুরাইশের বিরুদ্ধে রক্ষণাত্মকভাবে, তারপর ইহুদী, তারপর বাকি আরববিশ্ব। এই ছিল আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নীতি। আর, তালেবান মুজাহিদীন যদি বহির্বিশ্বে আক্রমণ না করার কথাও বলেন, তারা কি বহির্বিশ্বে আক্রমণ করাকে হারাম সাব্যস্ত করেছেন?!!!! না, বরং এমন একটি দলের (আল-কায়েদা) বায়াত গ্রহণ করেছেন যে দলটি সারাবিশ্বে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন। সুতরাং, তালেবান মুজাহিদীনের বিরুদ্ধে বৈশ্বিক জিহাদবিরোধীর অভিযোগ তোলা মূর্খতা ও শয়তানী বৈ নয় ।
আবার দেখুন- যদি আমি দায়েশের কথা মেনেও নেই, তাহলে সর্বোচ্চ এটা বলা যায় যে, তালিবান একটি স্থানীয় জিহাদী আন্দোলন। তারা আফগানিস্তানে ইসলামী ইমারত কায়েমের জন্য কাজ করে যাচ্ছেন। অর্থাৎ, তারা স্থানীয় জিহাদ করছেন। তাও কিন্তু জাতীয়তাবাদ বলা যায় না।
মূলত: দায়েশের(আইএস) সমস্যা হলো তারা কিছু নতুন পরিভাষা তৈরি করেছে। শাহওয়াত, জাতীয়তাবাদ- এই সব। এগুলোর সংজ্ঞা কী, সেটা তারা পরিষ্কার করে না। এগুলো শরয়ী পরিভাষা নয়। কিন্তু, এই পরিভাষার উপর ভিত্তি করে তারা শরয়ী হুকুম প্রয়োগ করে।
যেমন:-
১। অমুক ব্যক্তি জাতীয়তাবাদী।
২। জাতীয়তাবাদ রিদ্দা(এখানে কিন্তু তাফসিল প্রয়োজন, যে জাতীয়তাবাদ বলতে কী বুঝানো হচ্ছে)
৩। অতএব, অমুক ব্যক্তি মুরতাদ।
এগুলো হলো জাহালতের কথা। আর তাদের বিকৃত মানহাজের পরিচায়ক। তাদের লিডাররা এগুলো বুঝে শুনেই করে। কারণ তারা চায়, দুনিয়াতে তারাই একমাত্র বৈধ জিহাদী জামাআত- এটা প্রমাণ করতে। আর তাদের কর্মীরা বেশিরভাগই মাথামোটা। এরা মুখস্থ কথা বলে, এদের পড়াশোনা কম। সাম্প্রতিক সময়ে অনলাইনে তাদের কার্যক্রমই তাদের মূর্খতার পরিচয় বহন করে! যাইহোক, আল্লাহর কাছে দ্বীনী বিষয়ে মূর্খতা থেকে পানাহ চাই।
Comment