নব্য সালাফি মতবাদের অসারতার একটি নমুনা
সালাফি ভাইরা বলে থাকেন, ‘আল্লাহ তাআলা নিজের জন্য যে-সকল সিফাত সাব্যস্ত করেছেন, আমরাও তার জন্য সে-সকল সিফাত সাব্যস্ত করবো।’ এটা তো সুন্দর কথা। এক্ষেত্রে আমরাও তাদের সঙ্গে একমত। কিন্তু এর পরক্ষণেই তারা বলেন, ‘আমরা আল্লাহ তাআলার থেকে শুধু সে-সকল বিষয়কেই নিরোধ করবো, যা তিনি তার থেকে নিরোধ করেছেন।’ অর্থাৎ যে বিষয়গুলো নসে উল্লেখ করে আল্লাহ নিজেকে সেগুলোর থেকে পবিত্র ঘোষণা করেছেন আমরাও শুধু সে বিষয়গুলোকেই তার থেকে নিরোধ করবো। যেহেতু তারা সালাফের নাম বিকিয়ে চলেন, তাই এক্ষেত্রেও তারা দাবি করেন যে, সালাফের মাযহাবই নাকি এটা। এ দেশের বিদআতিরা যেমন নিজেদের ‘আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআত’ নামে অভিহিত করে আর অন্যদের ‘ওয়াহাবি’ বলে আখ্যায়িত করে, তাদের বিষয়টিও অনেকটা এমনই।
শাইখ সালিহ আল-ফাওযান শাইখ সাবুনির খণ্ডন করতে গিয়ে বলেন, ‘সাবুনি বলেন যে, “আমরা আল্লাহ তাআলাকে দৈহিক গঠন, আকৃতি এবং রূপ থেকে পবিত্র ঘোষণা করি।” অথচ এটা সালাফের মাযহাব নয়। কারণ, তারা তা নিরোধ করে, আল্লাহ নিজের থেকে যা নিরোধ করেছেন। আর আল্লাহ তো নিজের থেকে দেহ-আকৃতিকে নিরোধ করেননি।’ {তানবিহাত ফির রাদ আলা মান তায়াওয়ালাস সিফাত: ৬৯}
এরচেয়েও বিস্ময়কর কথা বলেছেন শাইখ বিন বায রহ.। তিনিও শাইখ সাবুনির খণ্ডন করতে গিয়ে বলছেন, ‘এরপর সাবুনি রহ. উল্লেখ করেছেন, “আল্লাহ তাআলা দেহ, চোখের তারা, কর্ণকুহর, জিহ্বা এবং কণ্ঠনালী থেকে পবিত্র।” এটা আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআহর মাযহাব নয়। বরং এগুলো নিন্দিত কালামিদের বক্তব্য এবং তাদের অপপ্রয়াস। কারণ আহলুস সুন্নাহ আল্লাহর থেকে শুধু তা-ই নিরোধ করে, যা তিনি নিজের থেকে নিরোধ করেছেন অথবা তাঁর রাসুল সা. তার থেকে নিরোধ করেছেন।’ {প্রাগুক্ত: ১৯}
এ কেমন কথা হলো? আচ্ছা, তাহলে কি আল্লাহ অসুস্থ হন? তিনি কি ক্ষুধার্ত এবং পিপাসার্ত হন? তিনি কি খাবার খান এবং পানি-পানীয় পান করেন? আল্লাহ তাআলা তো নিজের থেকে এগুলোকে নিরোধ করেননি। এখন আমাদের অবস্থান কী হবে? এ তো এক আজিব ধরনের কথা।
আমাদের এই শ্রেণির সালাফিরা সালাফের নামে যা ইচ্ছে তা-ইই চালান। একটু ঘেটে দেখার প্রয়োজনীয়তাই হয়তো বোধ করেন না। নইলে এমন কথা বলা কীভাবে সম্ভব? সালাফের নামে প্রোপাগান্ডা বৈ কী?
উদাহরণস্বরূপ দ্রষ্টব্য—ইমাম আবু সাইদ দারিমি আল্লাহ তাআলার থেকে অংশ এবং অঙ্গকে নিরোধ করছেন। তিনি আরও বলছেন যে, আল্লাহকে বেষ্টন করা যায় না এবং তিনি কোনো কিছুর সঙ্গে মিশ্রিত বা সংশ্লিষ্ট হন না। {আররাদ্দু আলাল মুরাইসি: ৫১০, ৪৩৭, ৫৬২}
ইমাম আহমাদ ইবনু হাম্বাল রহ. বলেন, ‘আল্লাহ তাআলা কালাম করেন—যেভাবে তিনি চান; অভ্যন্তর, মুখ, দুই ঠোঁট এবং জিহ্বা দ্বারা কথা বলা ছাড়াই।’ {আররাদ্দু আলায যানাদিকা ওয়ায যাহমিয়া: ৮৯} এখানে তিনি আল্লাহ তাআলার থেকে এমন বিষয় নিরোধ করছেন, যা আল্লাহ এবং তাঁর রাসুল করেননি।
(এ ব্যাপারে অন্যান্য সালাফের নিরোধের নমুনা দেখতে প্রয়োজনে আরও দ্রষ্টব্য—শারহু হাদিসিন নুযুল: ৩৩, ৬১; আসসাওয়ায়িকুল মুরসালাহ: ৩/৯৩৯}
এ ছাড়া দলিলের বিচারেও তো তাদের সালাফের নামে চালিয়ে দেয়া এই মতবাদ ধোপে টিকে না। কারণ, আকল এবং নুসুসের অকাট্য দলিলের মাধ্যমে প্রমাণিত যে, আল্লাহ তাআলা ত্রুটি এবং সাদৃশ্য থেকে পবিত্র। {যেমন দেখুন—সুরা শুরা: ১১; সুরা ইখলাস: ৪; সুরা সাফফাত: ১৮০}
এমনকি এ সকল আয়াতের ব্যাপারে ইমাম ইবনু তাইমিয়া রহ. বলেন, ‘এ সকল আয়াত দেহ এবং সাদৃশ্য নাকচের দিকে নির্দেশ করছে।’ {আররিসালাতুল মাদানিয়্যাহ: ১৭; মাজমুউল ফাতাওয়া: ৬/৩৬৮}
এরচে মজার কথা হলো, তারা নিজেরাও কিন্তু এই অসার বৃত্তের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকতে পারছেন না। নিজেদের অজান্তেই এ থেকে বেরিয়ে পড়ছেন। আর অসার নীতির ক্ষেত্রে এটাই বাস্তবতা।
বিন বায রহ. বলছেন, ‘তুমি জেনে রেখো যে, আল্লাহ তাআলা অসুস্থ হন না, ক্ষুধার্ত হন না। তো এ হাদিসে তিনি এর দ্বারা বান্দাদের অসুস্থের সেবা এবং ক্ষুধার্তকে খানা খাওয়ানোর প্রতি উৎসাহিত করেছেন।’ তিনি আরও বলেন, ‘কারও মনে এ কথা আসবে না যে, (নুহ আ.)-এর নৌকা আল্লাহর চোখে রয়েছে বা মুহাম্মাদ সা. আল্লাহর চোখে অবস্থান করছেন। বরং উদ্দেশ্য হলো, নৌকা আল্লাহ তাআলার তত্ত্বাবধানে নির্মিত হয়েছে, মুহাম্মাদ সা. তাঁর প্রতিপালকের সংরক্ষণে রয়েছেন।’ তিনি আরও বলেন, ‘উদ্দেশ্য অবতরণ (দেহ-ধারণ, অর্থাৎ দেহে অবতরণ) বা একীভূত হয়ে যাওয়া নয়। {তানবিহাত ফির-রাদ্দি আলা মান তাআওয়ালাস সিফাত: ২৭২৯}
তো তিনি এখানে যা-কিছুকে নিরোধ করলেন, এগুলোর নুসুস কোথায়? এভাবেই চলছে সালাফিয়াত। সালাফকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে উম্মাহকে অসার কিছু খাওয়ানোর চেষ্টা। আবার দাবিও করা হচ্ছে, সব কাজ বাদ দিয়ে এই আকিদা প্রচার নাকি ফরজে কিফায়াহ। গোটা উম্মাহকে এই আকিদাধারী বানাতে হবে। নাউযুবিল্লাহি মিন যালিকা।
বি. দ্র. এখানে কাউকে হেয় করা উদ্দেশ্য নয়। উম্মাহর ইমামগণকে আমরা ভালোবাসি। এটা ধ্রুবসত্য। এবং এরচে অধিক সত্য হলো, আমরা সত্যকে যে-কোনো ব্যক্তির থেকেও অধিক ভালোবাসি।
Comment