‘তাফবিয’ প্রসঙ্গে নব্য সালাফিদের দলিল-বিকৃতির নমুনা
নব্য সালাফিরা এ কাজটিতে বেশ পারঙ্গম। শাইখ আসাদুল্লাহ আল-গালিব যেমন সালাফের বক্তব্য থেকে ‘আহলুল হাদিস’ (মুহাদ্দিস অর্থে) শব্দগুলোকে বের করে এনে জাতির সামনে এ বলে প্রদর্শন করেন যে, দেখেছো, সালাফগণ ‘আহলে হাদিসে’র শানে এই বলেছেন-সেই বলেছেন। নব্য সালাফিরা তাদের কাল্পনিক ‘ইসবাত’ (শব্দের প্রকৃত বাহ্যিক অর্থ সাব্যস্ত করা এবং তার রূপের জ্ঞান আল্লাহর ইলমের দিকে ন্যস্ত করা)-এর আকিদা প্রমাণিত করার জন্য এবং অধিকাংশ সালাফের মাযহাব ‘তাফবিয’কে অস্বীকার করার জন্য এই পন্থাটিই অবলম্বন করেছে। তারা যে কী পরিমাণ দলিল-বিকৃতি করে নিজেদের আকিদা প্রমাণ করার চেষ্টা করে তার দু-চারটি নমুনা এই লেখায় তুলে ধরার চেষ্টা করবো ইন শা আল্লাহ।
প্রথমে লক্ষণীয়: সালাফগণের বক্তব্যে কোথাও কোথাও সিফাতকে ‘ইজরা আলায যাহির’ তথা বাহ্যিকের ওপর প্রয়োগ করার কথা এসেছে। এখন এই বাহ্যিকের ওপর প্রয়োগের কী অর্থ? নব্য সালাফিরা এ ধরনের বক্তব্য উদ্ধৃত করে প্রমাণ করতে চায় যে, সালাফগণ সিফাতের বাহ্যিক অর্থ গ্রহণ করার কথা বলেছেন। এই দেখো তার প্রমাণ। অথচ তারা যদি আরও দুই লাইন সামনে পড়ে, তাহলে নির্দ্বিধায় বুঝতে পারবে যে, এখানে তাঁরা বাহ্যিকের ওপর প্রয়োগ দ্বারা বাহ্যিক অর্থ গ্রহণ করা উদ্দেশ্য নেননি; বরং তাঁদের পরবর্তী বক্তব্য এর সঙ্গে পুরোপুরি সাংঘর্ষিক। কিন্তু তারা যে সামনে পড়বে না, বা পড়লেও জাতির সামনে তা তুলে ধরবে না। এটাই তো তাদের অসততা।
উল্লেখ্য, বাহ্যিকের ওপর প্রয়োগ – এর দুই অর্থ: এক অর্থ হলো, যা তারা বলতে চায়, অর্থাৎ শব্দের প্রকৃত বাহ্যিক অর্থ গ্রহণ করা। আরেক অর্থ হলো, ইমাম আহমাদের সেই বক্তব্যের মতো: ‘এগুলো যেভাবে এসেছে সেভাবে রেখে দাও’, অর্থাৎ বাহ্যিক শব্দের ওপরই এগুলোকে ছেড়ে দাও, আর এর অর্থ নিয়ে মাথা না ঘামিয়ে তা আল্লাহর ইলমের দিকে ন্যস্ত করো।
এককথায়, বাহ্যিকের ওপর প্রয়োগের দুই অর্থ: এক হলো, বাহ্যিক অর্থের ওপর প্রয়োগ, আরেক হলো, বাহ্যিক শব্দের ওপর প্রয়োগ আর অর্থ নিয়ে মাথা না ঘামানো। সহজ কথায় বললে, এক অর্থ হলো ‘ইসবাত’, আরেক অর্থ হলো ‘তাফবিয’।
এ কেমন কথা হলো? তবে কি ‘তাফবিযে’র দলিল দিয়ে ‘ইসবাত’ প্রমাণের চেষ্টা করা হচ্ছে? তা নয়তো কী? এটা আমাদের মুখের কোনো ফাঁপা বুলি নয়, ইমামগণের বক্তব্য থেকেই বিষয়টি সহজে অনুমেয়। উনাদের পূর্বাপরের বক্তব্য দেখলেই নব্য সালাফিদের দলিল-বিকৃতির স্বরূপ সহজেই অনুমান করতে পারবেন। এগুলো হয়তো তারা ইচ্ছাকৃতই করে, জেনেশুনে সত্যকে গোপন করে কিংবা সত্যকে পরাজিত করে মিথ্যা প্রতিষ্ঠা করার জন্য এমন করে, অথবা এগুলো তাদের চূড়ান্ত অজ্ঞতার ফল। যে-কোনোটিই হতে পারে। প্রকৃত কারণ আল্লাহই ভালো জানেন।
১. ইমাম খাত্তাবি রহ. ‘সাক’ (বাহ্যিক অর্থ পায়ের গোছা)-সম্পর্কিত হাদিস উল্লেখ করার পর বলেন,
‘এই হাদিস সেই হাদিসগুলোর অন্তর্ভুক্ত, আমাদের শাইখগণ যে ব্যাপারে কথা বলতে ভয় করেছেন। তাই তারা এগুলোকে শব্দের বাহ্যিক অবস্থার (তারা অনুবাদ করবে ‘বাহ্যিক অর্থের) ওপর প্রয়োগ করেছেন।’
এতটুকু উল্লেখ করেই চুপ। এরপর?
‘এবং তারা এগুলোর অর্থ উন্মোচিত করেননি। যেমনটি তাদের মাযহাব: এ ধরনের ক্ষেত্রে, ইলম যার হাকিকত বেষ্টন করতে অক্ষম তার তাফসির না করে থেমে যাওয়া।’ {আকাওয়িলুস সিফাত: ১৭৪}
২. ইমাম ইবনু কুদামা মাকদিসি রহ. বলেন,
‘এসবের এমন ‘তাবিল’ করা যাবে না, যা তার বাহ্যিকের সঙ্গে বিরোধপূর্ণ হয়।’
তারা বলবে, অর্থাৎ এমন ‘তাবিল’ করা নিষিদ্ধ, যা বাহ্যিক অর্থের সঙ্গে বিরোধপূর্ণ হয়। কিন্তু আসলেই কি তা-ই? মহান ইমাম এরপর কী বলছেন দেখুন –
‘এর ওপর কোনো হ্রাস-বৃদ্ধি করা, এর সীমা অতিক্রম করা এবং এর কোনো তাফসির করা যাবে না।’ তো যেভাবে তিনি ‘তাবিল’কে নিষিদ্ধ করলেন, একইভাবে ‘তাফসির’কেও নিষিদ্ধ করলেন।
এরপর তিনি বলছেন, ‘বরং এগুলো যেভাবে এসেছে সেভাবেই রেখে দাও। এর ইলম তার ‘কায়িল’ তথা আল্লাহর দিকে এবং তার অর্থ তার ‘মুতাকাল্লিম’ তথা আল্লাহরই দিকে ন্যস্ত করো।’
এরপর আরও স্পষ্ট ভাষায় বলেন, ‘তারা এগুলোর প্রকৃত অর্থের হাকিকতের জ্ঞান রাখতেন না, তাই তারা যার জ্ঞান রাখতেন না সে ব্যাপারে নীরব থেকেছেন।’ {যাম্মুত তাবিল: ১১}
৩. ইমাম তাজুদদীন সুবকি রহ. বলেন,
‘সিফাত সাব্যস্ত করার ব্যাপারে আশআরিদের দুধরনের বক্তব্য রয়েছে: আল্লাহ মাখলুকের সাদৃশ্য থেকে মুক্ত – এই আকিদা রেখে সিফাতকে তার বাহ্যিকের ওপর প্রয়োগ করা কিংবা তা তাবিল করা।’ এখানেও ‘বাহ্যিক’ শব্দ নিয়ে একই কথা। এরপর দেখুন তিনি কী বলছেন –
‘সবচে বড় মুসিবত এবং সবচে ভয়াবহ দুর্যোগ হলো, শব্দকে তার বাহ্যিক অর্থের ওপর প্রয়োগ করা এবং এই আকিদা রাখা যে বাহ্যিক অর্থই উদ্দেশ্য আর বাহ্যিক অর্থ মহান স্রষ্টার ওপর প্রয়োগ করা অসম্ভব নয়। এ তো তারকাপূজারী দেহবাদীদের বক্তব্য।’ {তাবাকাতুশ শাফিয়িয়্যাহ আল-কুবরা: ৫/১৯১}
৪. ইমাম সাফারিনি হাম্বলি রহ. বলেন,
‘মানুষের ওপর অপরিহার্য হলো সিফাতের বাহ্যিকের ওপর ইমান আনা এবং তার ইলম আল্লাহর দিকে ন্যস্ত করা।’
এটাকে ব্যাখ্যা করা হয় এভাবে: সিফাত থেকে বাহ্যিক অর্থ গ্রহণ করতে হবে এবং এর রূপের জ্ঞান আল্লাহর ইলমের দিকে ন্যস্ত করতে হবে। কিন্তু আসলেই কি তাই? এরপর তাঁর বক্তব্য দেখুন –
‘আল্লাহ তাআলা এ থেকে সম্পূর্ণ পবিত্র।’ এরপর তিনি বলেছেন, ‘সালাফের মাযহাব হলো এগুলো নিয়ে মাথা না ঘামানো, এসবের ব্যাপারে চুপ থাকা এবং তার ইলম আল্লাহর দিকে ন্যস্ত করা।’ {লাওয়ামিউল আনওয়ারিল বাহিয়্যাহ: ১/৯৭}
৫. আল্লামা গানিমি রহ. বলেন,
‘অপরিহার্য হলো এগুলোকে বাহ্যিকের ওপর প্রয়োগ করা।’
কী অর্থ? এরপর শুনুন –
‘এগুলোর ইলম তার ‘কায়িল’ তথা আল্লাহর দিকে ন্যস্ত করা, পাশাপাশি এই বিশ্বাস রাখা আল্লাহ তাআলা অঙ্গ (হাত-পা ইত্যাদি) এবং মাখলুকের সিফাতের সঙ্গে সাদৃশ্য থেকে সম্পূর্ণ পবিত্র।’ {শারহুল আকিদাতিত তাহাবিয়্যাহ: ৩২}
৬. ইমাম খতিবে বাগদাদি রহ. বলেন,
‘সালাফের মাযহাব হলো সিফাতকে সাব্যস্ত করা এবং এগুলোকে তার বাহ্যিকের ওপর প্রয়োগ করা।’
এর কী অর্থ? সামনেই বলছে –
‘সাব্যস্তকারীদের এক দল এটাকে বাস্তবায়ন করেছে, তখন তারা এক ধরনের তাশবিহ (সাদৃশ্যকরণ) এবং তাকয়িফ (আকৃতিবিশিষ্টকরণ)-এর দিকে বেরিয়ে পড়েছে।’ এরপর বলছেন,
‘আমরা যখন বলবো, আল্লাহ তাআলার রয়েছে ‘ইয়াদ’, ‘সাম’, ‘বাসার’ তো এগুলো হলো কিছু সিফাত, আল্লাহ যা নিজের জন্য সাব্যস্ত করেছেন। আমরা বলবো না, ‘ইয়াদ’ অর্থ কুদরত, ‘সাম-বাসার’ অর্থ ইলম। এবং আমরা বলবো না যে, এগুলো অঙ্গ তথা হাত, কান এবং চোখ। এবং আমরা এগুলোকে অঙ্গের সঙ্গে সাদৃশ্যকরণও করবো না, যা কাজকর্মে ব্যবহৃত অঙ্গ এবং উপকরণ। আমরা বলবো, সিফাতকে সাব্যস্ত করা ওয়াজিব, কারণ এ ব্যাপারে নীরব থাকার কথা এসেছে এবং তা থেকে সাদৃশ্য দূর করাকে অপরিহার্য করা হয়েছে।’ এরপর তিনি সুরা শুরার ১১ নম্বর আয়াত এবং সুরা ইখলাসের ৪ নম্বর আয়াত উল্লেখ করেন। {তাযকিরাতুল হুফফাজ: ৩/১১৪}
এ ধরনের দৃষ্টান্ত প্রচুর। এগুলো একত্রিত করলে বিশাল সংকলন হয়ে যাবে। উদাহরণস্বরূপ আরও দ্রষ্টব্য – আকিদাতুস সালাফ আসহাবিল হাদিস: ২২।
প্রকৃত সালাফি মাযহাব আর নব্য সালাফি মতবাদের মধ্যে যে কী পরিমাণ ফারাক – তা যদি মানুষ বুঝতো এবং তাদের গলদ কর্মকাণ্ড সম্পর্কে কিছু কিছু জানতো, তাহলে কিছুতেই তাদের বিছানো ফাঁদে পা দিয়ে নিজের আকিদা-আমলকে ঝুঁকির মুখে ফেলতো না। এরপরও আমরা তাদের জন্য হেদায়াত এবং কল্যাণ প্রত্যাশা করি। ফিতনা-সৃষ্টিকারী হলেও তারা আমাদেরই মুসলিম ভাই। তাওহিদের ঝাণ্ডার নিচে আমরা সকলেই ঐক্যবদ্ধ এবং এক দেহের মতো। স্রেফ সেলফ স্ট্যাডির ওপর নির্ভর করে যারাই জ্ঞানী সাজার চেষ্টা করেছে তাদের অধিকাংশের বরং প্রায় সবারই পরিণতি খুব সুন্দর হয়নি। এজন্যই তো আল্লাহ তাআলা সর্বযুগেই কিতাবুল্লাহর সাথে রিজালুল্লাহও পাঠিয়েছেন। রিজালহীন কিতাব কখনোই যথেষ্ট নয়।
নব্য সালাফিরা এ কাজটিতে বেশ পারঙ্গম। শাইখ আসাদুল্লাহ আল-গালিব যেমন সালাফের বক্তব্য থেকে ‘আহলুল হাদিস’ (মুহাদ্দিস অর্থে) শব্দগুলোকে বের করে এনে জাতির সামনে এ বলে প্রদর্শন করেন যে, দেখেছো, সালাফগণ ‘আহলে হাদিসে’র শানে এই বলেছেন-সেই বলেছেন। নব্য সালাফিরা তাদের কাল্পনিক ‘ইসবাত’ (শব্দের প্রকৃত বাহ্যিক অর্থ সাব্যস্ত করা এবং তার রূপের জ্ঞান আল্লাহর ইলমের দিকে ন্যস্ত করা)-এর আকিদা প্রমাণিত করার জন্য এবং অধিকাংশ সালাফের মাযহাব ‘তাফবিয’কে অস্বীকার করার জন্য এই পন্থাটিই অবলম্বন করেছে। তারা যে কী পরিমাণ দলিল-বিকৃতি করে নিজেদের আকিদা প্রমাণ করার চেষ্টা করে তার দু-চারটি নমুনা এই লেখায় তুলে ধরার চেষ্টা করবো ইন শা আল্লাহ।
প্রথমে লক্ষণীয়: সালাফগণের বক্তব্যে কোথাও কোথাও সিফাতকে ‘ইজরা আলায যাহির’ তথা বাহ্যিকের ওপর প্রয়োগ করার কথা এসেছে। এখন এই বাহ্যিকের ওপর প্রয়োগের কী অর্থ? নব্য সালাফিরা এ ধরনের বক্তব্য উদ্ধৃত করে প্রমাণ করতে চায় যে, সালাফগণ সিফাতের বাহ্যিক অর্থ গ্রহণ করার কথা বলেছেন। এই দেখো তার প্রমাণ। অথচ তারা যদি আরও দুই লাইন সামনে পড়ে, তাহলে নির্দ্বিধায় বুঝতে পারবে যে, এখানে তাঁরা বাহ্যিকের ওপর প্রয়োগ দ্বারা বাহ্যিক অর্থ গ্রহণ করা উদ্দেশ্য নেননি; বরং তাঁদের পরবর্তী বক্তব্য এর সঙ্গে পুরোপুরি সাংঘর্ষিক। কিন্তু তারা যে সামনে পড়বে না, বা পড়লেও জাতির সামনে তা তুলে ধরবে না। এটাই তো তাদের অসততা।
উল্লেখ্য, বাহ্যিকের ওপর প্রয়োগ – এর দুই অর্থ: এক অর্থ হলো, যা তারা বলতে চায়, অর্থাৎ শব্দের প্রকৃত বাহ্যিক অর্থ গ্রহণ করা। আরেক অর্থ হলো, ইমাম আহমাদের সেই বক্তব্যের মতো: ‘এগুলো যেভাবে এসেছে সেভাবে রেখে দাও’, অর্থাৎ বাহ্যিক শব্দের ওপরই এগুলোকে ছেড়ে দাও, আর এর অর্থ নিয়ে মাথা না ঘামিয়ে তা আল্লাহর ইলমের দিকে ন্যস্ত করো।
এককথায়, বাহ্যিকের ওপর প্রয়োগের দুই অর্থ: এক হলো, বাহ্যিক অর্থের ওপর প্রয়োগ, আরেক হলো, বাহ্যিক শব্দের ওপর প্রয়োগ আর অর্থ নিয়ে মাথা না ঘামানো। সহজ কথায় বললে, এক অর্থ হলো ‘ইসবাত’, আরেক অর্থ হলো ‘তাফবিয’।
এ কেমন কথা হলো? তবে কি ‘তাফবিযে’র দলিল দিয়ে ‘ইসবাত’ প্রমাণের চেষ্টা করা হচ্ছে? তা নয়তো কী? এটা আমাদের মুখের কোনো ফাঁপা বুলি নয়, ইমামগণের বক্তব্য থেকেই বিষয়টি সহজে অনুমেয়। উনাদের পূর্বাপরের বক্তব্য দেখলেই নব্য সালাফিদের দলিল-বিকৃতির স্বরূপ সহজেই অনুমান করতে পারবেন। এগুলো হয়তো তারা ইচ্ছাকৃতই করে, জেনেশুনে সত্যকে গোপন করে কিংবা সত্যকে পরাজিত করে মিথ্যা প্রতিষ্ঠা করার জন্য এমন করে, অথবা এগুলো তাদের চূড়ান্ত অজ্ঞতার ফল। যে-কোনোটিই হতে পারে। প্রকৃত কারণ আল্লাহই ভালো জানেন।
১. ইমাম খাত্তাবি রহ. ‘সাক’ (বাহ্যিক অর্থ পায়ের গোছা)-সম্পর্কিত হাদিস উল্লেখ করার পর বলেন,
‘এই হাদিস সেই হাদিসগুলোর অন্তর্ভুক্ত, আমাদের শাইখগণ যে ব্যাপারে কথা বলতে ভয় করেছেন। তাই তারা এগুলোকে শব্দের বাহ্যিক অবস্থার (তারা অনুবাদ করবে ‘বাহ্যিক অর্থের) ওপর প্রয়োগ করেছেন।’
এতটুকু উল্লেখ করেই চুপ। এরপর?
‘এবং তারা এগুলোর অর্থ উন্মোচিত করেননি। যেমনটি তাদের মাযহাব: এ ধরনের ক্ষেত্রে, ইলম যার হাকিকত বেষ্টন করতে অক্ষম তার তাফসির না করে থেমে যাওয়া।’ {আকাওয়িলুস সিফাত: ১৭৪}
২. ইমাম ইবনু কুদামা মাকদিসি রহ. বলেন,
‘এসবের এমন ‘তাবিল’ করা যাবে না, যা তার বাহ্যিকের সঙ্গে বিরোধপূর্ণ হয়।’
তারা বলবে, অর্থাৎ এমন ‘তাবিল’ করা নিষিদ্ধ, যা বাহ্যিক অর্থের সঙ্গে বিরোধপূর্ণ হয়। কিন্তু আসলেই কি তা-ই? মহান ইমাম এরপর কী বলছেন দেখুন –
‘এর ওপর কোনো হ্রাস-বৃদ্ধি করা, এর সীমা অতিক্রম করা এবং এর কোনো তাফসির করা যাবে না।’ তো যেভাবে তিনি ‘তাবিল’কে নিষিদ্ধ করলেন, একইভাবে ‘তাফসির’কেও নিষিদ্ধ করলেন।
এরপর তিনি বলছেন, ‘বরং এগুলো যেভাবে এসেছে সেভাবেই রেখে দাও। এর ইলম তার ‘কায়িল’ তথা আল্লাহর দিকে এবং তার অর্থ তার ‘মুতাকাল্লিম’ তথা আল্লাহরই দিকে ন্যস্ত করো।’
এরপর আরও স্পষ্ট ভাষায় বলেন, ‘তারা এগুলোর প্রকৃত অর্থের হাকিকতের জ্ঞান রাখতেন না, তাই তারা যার জ্ঞান রাখতেন না সে ব্যাপারে নীরব থেকেছেন।’ {যাম্মুত তাবিল: ১১}
৩. ইমাম তাজুদদীন সুবকি রহ. বলেন,
‘সিফাত সাব্যস্ত করার ব্যাপারে আশআরিদের দুধরনের বক্তব্য রয়েছে: আল্লাহ মাখলুকের সাদৃশ্য থেকে মুক্ত – এই আকিদা রেখে সিফাতকে তার বাহ্যিকের ওপর প্রয়োগ করা কিংবা তা তাবিল করা।’ এখানেও ‘বাহ্যিক’ শব্দ নিয়ে একই কথা। এরপর দেখুন তিনি কী বলছেন –
‘সবচে বড় মুসিবত এবং সবচে ভয়াবহ দুর্যোগ হলো, শব্দকে তার বাহ্যিক অর্থের ওপর প্রয়োগ করা এবং এই আকিদা রাখা যে বাহ্যিক অর্থই উদ্দেশ্য আর বাহ্যিক অর্থ মহান স্রষ্টার ওপর প্রয়োগ করা অসম্ভব নয়। এ তো তারকাপূজারী দেহবাদীদের বক্তব্য।’ {তাবাকাতুশ শাফিয়িয়্যাহ আল-কুবরা: ৫/১৯১}
৪. ইমাম সাফারিনি হাম্বলি রহ. বলেন,
‘মানুষের ওপর অপরিহার্য হলো সিফাতের বাহ্যিকের ওপর ইমান আনা এবং তার ইলম আল্লাহর দিকে ন্যস্ত করা।’
এটাকে ব্যাখ্যা করা হয় এভাবে: সিফাত থেকে বাহ্যিক অর্থ গ্রহণ করতে হবে এবং এর রূপের জ্ঞান আল্লাহর ইলমের দিকে ন্যস্ত করতে হবে। কিন্তু আসলেই কি তাই? এরপর তাঁর বক্তব্য দেখুন –
‘আল্লাহ তাআলা এ থেকে সম্পূর্ণ পবিত্র।’ এরপর তিনি বলেছেন, ‘সালাফের মাযহাব হলো এগুলো নিয়ে মাথা না ঘামানো, এসবের ব্যাপারে চুপ থাকা এবং তার ইলম আল্লাহর দিকে ন্যস্ত করা।’ {লাওয়ামিউল আনওয়ারিল বাহিয়্যাহ: ১/৯৭}
৫. আল্লামা গানিমি রহ. বলেন,
‘অপরিহার্য হলো এগুলোকে বাহ্যিকের ওপর প্রয়োগ করা।’
কী অর্থ? এরপর শুনুন –
‘এগুলোর ইলম তার ‘কায়িল’ তথা আল্লাহর দিকে ন্যস্ত করা, পাশাপাশি এই বিশ্বাস রাখা আল্লাহ তাআলা অঙ্গ (হাত-পা ইত্যাদি) এবং মাখলুকের সিফাতের সঙ্গে সাদৃশ্য থেকে সম্পূর্ণ পবিত্র।’ {শারহুল আকিদাতিত তাহাবিয়্যাহ: ৩২}
৬. ইমাম খতিবে বাগদাদি রহ. বলেন,
‘সালাফের মাযহাব হলো সিফাতকে সাব্যস্ত করা এবং এগুলোকে তার বাহ্যিকের ওপর প্রয়োগ করা।’
এর কী অর্থ? সামনেই বলছে –
‘সাব্যস্তকারীদের এক দল এটাকে বাস্তবায়ন করেছে, তখন তারা এক ধরনের তাশবিহ (সাদৃশ্যকরণ) এবং তাকয়িফ (আকৃতিবিশিষ্টকরণ)-এর দিকে বেরিয়ে পড়েছে।’ এরপর বলছেন,
‘আমরা যখন বলবো, আল্লাহ তাআলার রয়েছে ‘ইয়াদ’, ‘সাম’, ‘বাসার’ তো এগুলো হলো কিছু সিফাত, আল্লাহ যা নিজের জন্য সাব্যস্ত করেছেন। আমরা বলবো না, ‘ইয়াদ’ অর্থ কুদরত, ‘সাম-বাসার’ অর্থ ইলম। এবং আমরা বলবো না যে, এগুলো অঙ্গ তথা হাত, কান এবং চোখ। এবং আমরা এগুলোকে অঙ্গের সঙ্গে সাদৃশ্যকরণও করবো না, যা কাজকর্মে ব্যবহৃত অঙ্গ এবং উপকরণ। আমরা বলবো, সিফাতকে সাব্যস্ত করা ওয়াজিব, কারণ এ ব্যাপারে নীরব থাকার কথা এসেছে এবং তা থেকে সাদৃশ্য দূর করাকে অপরিহার্য করা হয়েছে।’ এরপর তিনি সুরা শুরার ১১ নম্বর আয়াত এবং সুরা ইখলাসের ৪ নম্বর আয়াত উল্লেখ করেন। {তাযকিরাতুল হুফফাজ: ৩/১১৪}
এ ধরনের দৃষ্টান্ত প্রচুর। এগুলো একত্রিত করলে বিশাল সংকলন হয়ে যাবে। উদাহরণস্বরূপ আরও দ্রষ্টব্য – আকিদাতুস সালাফ আসহাবিল হাদিস: ২২।
প্রকৃত সালাফি মাযহাব আর নব্য সালাফি মতবাদের মধ্যে যে কী পরিমাণ ফারাক – তা যদি মানুষ বুঝতো এবং তাদের গলদ কর্মকাণ্ড সম্পর্কে কিছু কিছু জানতো, তাহলে কিছুতেই তাদের বিছানো ফাঁদে পা দিয়ে নিজের আকিদা-আমলকে ঝুঁকির মুখে ফেলতো না। এরপরও আমরা তাদের জন্য হেদায়াত এবং কল্যাণ প্রত্যাশা করি। ফিতনা-সৃষ্টিকারী হলেও তারা আমাদেরই মুসলিম ভাই। তাওহিদের ঝাণ্ডার নিচে আমরা সকলেই ঐক্যবদ্ধ এবং এক দেহের মতো। স্রেফ সেলফ স্ট্যাডির ওপর নির্ভর করে যারাই জ্ঞানী সাজার চেষ্টা করেছে তাদের অধিকাংশের বরং প্রায় সবারই পরিণতি খুব সুন্দর হয়নি। এজন্যই তো আল্লাহ তাআলা সর্বযুগেই কিতাবুল্লাহর সাথে রিজালুল্লাহও পাঠিয়েছেন। রিজালহীন কিতাব কখনোই যথেষ্ট নয়।
Comment