.
.
.
তবে বিকল্প ধারার মিডিয়ার জন্য স্বাধীনভাবে সাংবাদিকতাই আমার মন-মেজাজের সাথে অধিক সামঞ্জস্যপূর্ণ। কারণ এ ধরণের কাজ “প্রচলিত ধ্যান ধারণার” বাইরে এসে বাইরে এসে প্রকৃত সত্য উদঘাটন করতে উৎসাহিত করে। ফলে, আমি অপেক্ষাকৃত নিরপেক্ষ অবস্থান থেকে মানুষদেরকে পর্যবেক্ষণ করতে সক্ষম হই। উদাহরণস্বরূপ, আমি আল-কায়েদার সুপরিচিত ব্যক্তিদের নিয়ে বারং বার চিন্তা-ভাবনার বদলে আল-কায়েদা সাংগঠনিক কাঠামোর নিচের ধাপে অবস্থিত লোকদের দিকে মনোযোগ দিতে পারি। বিশ্ব সম্পর্কে তাদের চিন্তা-ভাবনা, তাদের জীবন, পর্দার আড়ালে তাদের অবদান - যা বাস্তবে একটি আন্দোলনের ভাগ্য নির্ধারণ করে থাকে, তা অন্যদেরকে জানানোর চেষ্টা করি। যে সব স্বল্প পরিচিত ব্যাক্তির ব্যাপারে আমি গবেষণা করেছি এবং যাদের সাক্ষাৎকার আমি নিয়েছি তাদের মধ্যে রয়েছে কমান্ডার মুহাম্মাদ ইলিয়াস কাশ্মিরী, সিরাজুদ্দীন হাক্কানি এবং ক্বারী জিয়াউর রহমান। তারা প্রত্যেকেই পরবর্তীতে আন্দোলনের প্রকৃত নেতা হিসেবে আবির্ভূত হয়েছেন।
ওসামা বিন লাদেনকে আজকের দুনিয়া চেনে এমন এক ব্যক্তি হিসাবে যিনি পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ আন্দোলন শুরু করেছিলেন। আল-কায়েদা হল সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী আন্দোলনের বাস্তব প্রতিরূপ। কিন্তু বাস্তবতা হল, বিন লাদেন ছাড়াও আল-কায়েদার আরো অনেক গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র রয়েছে। আল-কায়েদার এই গল্পে ঠিক সেই পরিমান চরিত্র, ব্যক্তি এবং চমক রয়েছে যা রানী শেহেরেজাদে তার স্বামী বাদশা শাহরিয়ারকে কিংবদন্তীর আলিফ লায়লা গল্পে বর্ণনা করেছেন। এই কাহিনীগুলোতে এমন অনেক স্বল্প পরিচিত চরিত্রের আবির্ভাব ঘটেছে যারা তাদের সময়কার পৃথিবীকে প্রভাবিত করেছিলেন সেই একই ধরণের ভালোবাসা অথবা বিশ্বস্ততা দ্বারা যেগুলোকে আজও মানবজাতির অনন্য বৈশিষ্ট হিসেবে গন্য করা হয়।
আলিফ লায়লা হচ্ছে মধ্য প্রাচ্য ও দক্ষিন এশীয় অঞ্চলে প্রচলিত অনেকগুলো গল্প ও লোক-কাহিনী, যা ইসলামি স্বর্ণযুগে আরবীতে সংকলিত হয়। এই গল্পগুলোর লেখক এবং সময়কাল সম্পর্কে নিশ্চিতভাবে তেমন কিছু জানা যায় না। চরিত্রহী প্রথম স্ত্রীর প্রতারণার পর ছলনাময়ী নারীজাতিকে শিক্ষা দেয়ার জন্য রাজা শাহরিয়ার প্রতিদিন একজন নতুন নারীকে বিয়ে ও বাসর রাতে তাকে হত্যা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। শাহরিয়ারের প্রতিশোধ স্পৃহার মধ্যেই আরব্য রজনীর গল্পগুলো এক সুত্রে গাথা। চতুর শেহেরাজাদে -যাকে ভারতীয় বংশদ্ভূত বলে ধারনা করা হয়- এর সমাপ্তি ঘটিয়েছিল। ১০০১ রাতব্যাপী বিস্তৃত গল্পের মাধ্যমে সে শাহরিয়ারকে বিমোহিত করে রেখেছিল যাতে করে মৃত্যু এড়ানো যায় এবং রাজার মনে নারী জাতির প্রতি বিশ্বাস ফিরে আসে।
শেহেরাজাদের এ গল্পগাথা জুড়ে ছিল ভারত, ইরাক, ইরান, মিশর, তুর্কি এবং খুব সম্ভবত গ্রীসের গল্পাবলী। ধারণা করা হয় যে, এ গল্পগুলো প্রাথমিকভাবে মুখেমুখে প্রচারিত হয়েছিল এবং ধীরে ধীরে কয়েক শতাব্দীজুড়ে এগুলো একটি সমন্বিত রূপ লাভ করে। গল্পগুলোর মতোই এ সংকলনের ইতিহাস দীর্ঘ, জটিল এবং আঁকাবাঁকা। আর এ গল্পগুলো জটিল ও চমকপ্রদ বর্ণনাভঙ্গির মাধ্যমে পাঠককে এমন এক মনোমুগ্ধকর কাহিনীর ঘোরপাকে নিয়ে যায় যা থেকে সহজে মুক্তি মেলা ভার।
এগুলো হচ্ছে সেই সব চরিত্রের গল্প যারা পর্দার আড়ালে কাজ করেছেন। আবার একই সময়ে তারা এমন একটি প্রেক্ষাপট তৈরিতে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন, যার ফলে ২০০১ সালে আমেরিকায় বোমা হামলার পর যারা তোরা-বোরা পাহাড়ের ধ্বংসস্তুপের নিচে চাপা পড়ে গেছে বলে ধারনা করা হচ্ছিল, মাত্র কয়েক বছরের মধ্যে সেই আল-কায়েদা উত্তর আফ্রিকা থেকে মধ্য এশিয়া পর্যন্ত তাদের ডানা বিস্তৃত করেছে। পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে একটি বাস্তবমুখী বৈশ্বিক প্রতিরোধ আন্দোলন হিসেবে আবির্ভূত হতে সক্ষম হয়েছে।
আল-কায়েদার বিভিন্ন ব্যাক্তিবর্গের সাথে দেখা করার জন্য আমি ইরাক, লেবানন, উত্তর ওয়াজিরিস্তান এবং আফগানিস্তান ভ্রমণ করেছি। কিন্তু বিস্ময়করভাবে আমার প্রকৃত অনুপ্রেরণা হিসেবে কাজ করেছে খুবই স্বল্প পরিচিত একজন মানুষ। পাকিস্তানের এলিট কমান্ডোদের একজন, পাকিস্তান আর্মীর স্পেশাল সার্ভিস গ্রুপের (SSG) একজন সদস্য রিটায়ার্ড ক্যাপ্টেন খুররাম আশিক (হেলমান্দ প্রদেশে যুক্তরাজ্যের সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াইয়ে নিহত)। যখন আমি তার সাথে দেখা করি, ততোদিনে ক্যাপ্টেন খুররাম আর্মি থেকে স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করে আফগানিস্তানে তালেবানের সাথে যোগ দিয়েছেন।
আল-কায়েদাতে খুররামের অবদান ভোলার মত না। তার মৃত্যুতে তার বন্ধু রিটায়ার্ড মেজর আব্দুল রহমান এবং তার ভাই আরেক রিটায়ার্ড মেজর হারুন, আমার সাথে দেখা করেন এবং আল-কায়দার যুদ্ধকৌশল সম্পর্কে আমার দৃষ্টিভঙ্গি ও ধারনাকে আরো বিস্তৃত করেন। মেজর আব্দুল রহমান ও রিটায়ার্ড মেজর হারুন, পরবর্তীতে ২০০৮ সালের ২৬ নভেম্বর, মুম্বাই হামলার (যে হামলাকে ২৬/১১ বলা হয়) প্রধান দুই মাস্টারমাইন্ডে পরিণত হন এবং পশ্চিমাদের মিত্রশক্তির বিরুদ্ধে আল-কায়েদার যুদ্ধের মোড় ঘুড়িয়ে দেন।
তাদের সাথে দেখা হবার পর সম্পূর্ণ নতুন এক দৃষ্টিভঙ্গিতে আমি আল-কায়েদার দুনিয়াকে দেখা শুরু করি –এক অতুলনীয় কর্মশক্তি যা কেবল বিশ্বাসের দৃঢ়তা এবং উদ্ভাবনী দক্ষতার মাধ্যমে বিশ্বের সবচেয়ে জটিল, উন্নত এবং শক্তিশালী প্রযুক্তির আমেরিকাকে (বিশ্বের একমাত্র সুপার পাওয়ার) ৯/১১ এর মাধ্যমে উস্কে দিয়েছিল। তাদের এ হামলার উদ্দেশ্য ছিল আমেরিকাকে এমন এক অঞ্চলে যুদ্ধে টেনে আনা যেখানকার মানুষেরা প্রস্তর যুগে বসবাস করত — এমন এক যুগ যেখানে উচ্চ প্রযুক্তির কোন মূল্য নেই। যেখানে শুধুমাত্র বেঁচে থাকার সহজাত জ্ঞানটুকুই বিদ্যমান। তাই এটা বিস্ময়কর ছিল না যে, যুদ্ধের প্রথম দিকে আল-কায়েদার অনুগত শত শত যোদ্ধা নিহত হয়েছিল আর বেঁচে যাওয়া যোদ্ধারা দ্রুত পাহাড়ের গুহায় আশ্রয় নিয়েছিল। আর আমেরিকার বিজয় পর্যবেক্ষণ করতে বাধ্য হয়েছিল।
যখন ইবনুল বালাদ অর্থাৎ মাটির সন্তানেরা (স্থানীয় তালিবান) বিদেশী অনুপ্রবেশকারীদের বিরুদ্ধে লড়াই করছিল আল-কায়েদা খুব গভীরভাবে পরিস্থিত পর্যবেক্ষণ করলেও লড়াই থেকে বিরত ছিল। তারা প্রতিনিয়ত ব্যস্ত ছিল অন্য আরেকটি কাজ নিয়ে, আর তা হল এই মাটির সন্তানদেরকে “রক্তের ভাইয়ে” পরিণত করা করা এবং সরাসরি আল-কায়েদার অধীনে নিয়ে আসা।
এই বইটি লেখা হয়েছে সংকটপূর্ণ এমন এক সন্ধিক্ষণে যখন আফগানিস্তানে পশ্চিমা মিত্রশক্তির পরাজয় অবশ্যম্ভাবী হয়ে দাড়িয়েছে। একসময় অনেক বক্তাই পারমানবিক অস্ত্রে সজ্জিত ও মুসলিম রাষ্ট্রগুলোর সমর্থনপুস্ট এক আল-কায়েদার ছবি অংকন করেছিল, বিশ্ববাসীর জন্য একে হুমকি হিসেবে চিত্রায়িত করেছিলেন। কিন্তু বহু বছরের যুদ্ধের পর যা সবকিছুকে ছাপিয়ে উঠেছে তা হল আল-কায়দার অস্ত্রভান্ডার এর মূল হাতিয়ার নয় বরং আল-কায়েদার মূল অস্ত্র হল ঘটনা প্রবাহকে কাজে লাগানোর মাধ্যমে উচ্চ-প্রযুক্তি সম্পন্ন শত্রুকে বিপর্যস্ত করার কৌশলের বিপদজনক সক্ষমতা।
পশ্চিমা মিত্রশক্তি এখন আফগান যুদ্ধের ময়দান থেকে বেড়িয়ে আসার উপায় খুজছে। কিন্তু কখনো যদি পশ্চিমা মিত্রশক্তি তা করতে সক্ষম হয়ও তবুও এর মাধ্যমে পশ্চিমের বিরুদ্ধে আল-কায়েদার যুদ্ধের সমাপ্তি ঘটাবে না। এটা কেবল যুদ্ধের একটি পর্বের সমাপ্তির সংকেত দেবে, এবং আরেকটি পর্বের সূচনা করবে। আর এই দৃষ্টিভঙ্গিটিই আমি পুরো বইটি জুড়ে বিশ্লেষণ করার চেষ্টা করেছি।
.
প্রথম পর্বঃ আরব্য রজনীর নতুন অধ্যায় || নির্বাসনের চিরকুট || অনুবাদকের কথা
দ্বিতীয় পর্বঃ আরব্য রজনীর নতুন অধ্যায় || নির্বাসনের চিরকুট || লেখক পরিচিতি
.
|| লেখকের মুখবন্ধ ||
সায়্যিদ সালীম শাহযাদ
আমার কখনই ভালোভাবে ফান্ড করা কোন আন্তর্জাতিক সংবাদ সংস্থার হয়ে কাজ করা হয়নি। মূলধারার জাতীয় কোন মিডিয়াতেও আমি কাজ করিনি। সব সময়ই আমার সম্পর্ক ছিল ভিন্নধর্মী বা অলটারনেটিভ মিডিয়ার সাথে। ফলে কখনোই আমার হাতে অনেকগুলো বিকল্প থাকতো না। আমাকে কাজ করতে হতো খুবই সংকীর্ণ পরিসরে। রাজনীতির মাঠের গুরুত্বপূর্ণ ও বড় বড় সাংবাদিকরা তাদের মিডিয়া ক্যাম্পেইন পরিচালনার জন্য ভালো মানের ফান্ড করা মূলধারার সংবাদসংস্থাগুলোকে কাজে লাগিয়ে থাকেন। অপরদিকে মানুষের দৃষ্টি আকর্ষনের জন্য সাধারণ মিডিয়ার তুলনায় ভিন্নধর্মী –বিকল্প ধারার মিডিয়াগুলোর লোকদেরকে দ্বিগুন পরিশ্রম করতে হয়।.
সায়্যিদ সালীম শাহযাদ
আমার কখনই ভালোভাবে ফান্ড করা কোন আন্তর্জাতিক সংবাদ সংস্থার হয়ে কাজ করা হয়নি। মূলধারার জাতীয় কোন মিডিয়াতেও আমি কাজ করিনি। সব সময়ই আমার সম্পর্ক ছিল ভিন্নধর্মী বা অলটারনেটিভ মিডিয়ার সাথে। ফলে কখনোই আমার হাতে অনেকগুলো বিকল্প থাকতো না। আমাকে কাজ করতে হতো খুবই সংকীর্ণ পরিসরে। রাজনীতির মাঠের গুরুত্বপূর্ণ ও বড় বড় সাংবাদিকরা তাদের মিডিয়া ক্যাম্পেইন পরিচালনার জন্য ভালো মানের ফান্ড করা মূলধারার সংবাদসংস্থাগুলোকে কাজে লাগিয়ে থাকেন। অপরদিকে মানুষের দৃষ্টি আকর্ষনের জন্য সাধারণ মিডিয়ার তুলনায় ভিন্নধর্মী –বিকল্প ধারার মিডিয়াগুলোর লোকদেরকে দ্বিগুন পরিশ্রম করতে হয়।.
.
.
তবে বিকল্প ধারার মিডিয়ার জন্য স্বাধীনভাবে সাংবাদিকতাই আমার মন-মেজাজের সাথে অধিক সামঞ্জস্যপূর্ণ। কারণ এ ধরণের কাজ “প্রচলিত ধ্যান ধারণার” বাইরে এসে বাইরে এসে প্রকৃত সত্য উদঘাটন করতে উৎসাহিত করে। ফলে, আমি অপেক্ষাকৃত নিরপেক্ষ অবস্থান থেকে মানুষদেরকে পর্যবেক্ষণ করতে সক্ষম হই। উদাহরণস্বরূপ, আমি আল-কায়েদার সুপরিচিত ব্যক্তিদের নিয়ে বারং বার চিন্তা-ভাবনার বদলে আল-কায়েদা সাংগঠনিক কাঠামোর নিচের ধাপে অবস্থিত লোকদের দিকে মনোযোগ দিতে পারি। বিশ্ব সম্পর্কে তাদের চিন্তা-ভাবনা, তাদের জীবন, পর্দার আড়ালে তাদের অবদান - যা বাস্তবে একটি আন্দোলনের ভাগ্য নির্ধারণ করে থাকে, তা অন্যদেরকে জানানোর চেষ্টা করি। যে সব স্বল্প পরিচিত ব্যাক্তির ব্যাপারে আমি গবেষণা করেছি এবং যাদের সাক্ষাৎকার আমি নিয়েছি তাদের মধ্যে রয়েছে কমান্ডার মুহাম্মাদ ইলিয়াস কাশ্মিরী, সিরাজুদ্দীন হাক্কানি এবং ক্বারী জিয়াউর রহমান। তারা প্রত্যেকেই পরবর্তীতে আন্দোলনের প্রকৃত নেতা হিসেবে আবির্ভূত হয়েছেন।
ওসামা বিন লাদেনকে আজকের দুনিয়া চেনে এমন এক ব্যক্তি হিসাবে যিনি পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ আন্দোলন শুরু করেছিলেন। আল-কায়েদা হল সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী আন্দোলনের বাস্তব প্রতিরূপ। কিন্তু বাস্তবতা হল, বিন লাদেন ছাড়াও আল-কায়েদার আরো অনেক গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র রয়েছে। আল-কায়েদার এই গল্পে ঠিক সেই পরিমান চরিত্র, ব্যক্তি এবং চমক রয়েছে যা রানী শেহেরেজাদে তার স্বামী বাদশা শাহরিয়ারকে কিংবদন্তীর আলিফ লায়লা গল্পে বর্ণনা করেছেন। এই কাহিনীগুলোতে এমন অনেক স্বল্প পরিচিত চরিত্রের আবির্ভাব ঘটেছে যারা তাদের সময়কার পৃথিবীকে প্রভাবিত করেছিলেন সেই একই ধরণের ভালোবাসা অথবা বিশ্বস্ততা দ্বারা যেগুলোকে আজও মানবজাতির অনন্য বৈশিষ্ট হিসেবে গন্য করা হয়।
আলিফ লায়লা হচ্ছে মধ্য প্রাচ্য ও দক্ষিন এশীয় অঞ্চলে প্রচলিত অনেকগুলো গল্প ও লোক-কাহিনী, যা ইসলামি স্বর্ণযুগে আরবীতে সংকলিত হয়। এই গল্পগুলোর লেখক এবং সময়কাল সম্পর্কে নিশ্চিতভাবে তেমন কিছু জানা যায় না। চরিত্রহী প্রথম স্ত্রীর প্রতারণার পর ছলনাময়ী নারীজাতিকে শিক্ষা দেয়ার জন্য রাজা শাহরিয়ার প্রতিদিন একজন নতুন নারীকে বিয়ে ও বাসর রাতে তাকে হত্যা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। শাহরিয়ারের প্রতিশোধ স্পৃহার মধ্যেই আরব্য রজনীর গল্পগুলো এক সুত্রে গাথা। চতুর শেহেরাজাদে -যাকে ভারতীয় বংশদ্ভূত বলে ধারনা করা হয়- এর সমাপ্তি ঘটিয়েছিল। ১০০১ রাতব্যাপী বিস্তৃত গল্পের মাধ্যমে সে শাহরিয়ারকে বিমোহিত করে রেখেছিল যাতে করে মৃত্যু এড়ানো যায় এবং রাজার মনে নারী জাতির প্রতি বিশ্বাস ফিরে আসে।
শেহেরাজাদের এ গল্পগাথা জুড়ে ছিল ভারত, ইরাক, ইরান, মিশর, তুর্কি এবং খুব সম্ভবত গ্রীসের গল্পাবলী। ধারণা করা হয় যে, এ গল্পগুলো প্রাথমিকভাবে মুখেমুখে প্রচারিত হয়েছিল এবং ধীরে ধীরে কয়েক শতাব্দীজুড়ে এগুলো একটি সমন্বিত রূপ লাভ করে। গল্পগুলোর মতোই এ সংকলনের ইতিহাস দীর্ঘ, জটিল এবং আঁকাবাঁকা। আর এ গল্পগুলো জটিল ও চমকপ্রদ বর্ণনাভঙ্গির মাধ্যমে পাঠককে এমন এক মনোমুগ্ধকর কাহিনীর ঘোরপাকে নিয়ে যায় যা থেকে সহজে মুক্তি মেলা ভার।
আমি চেষ্টা করেছি আল-কায়দার নিজস্ব আরব্য রজনীর গল্পের
কিংবদন্তীতুল্য কিছু চরিত্রের পেছনের রহস্য উন্মোচন করে তা
সমান্তরালভাবে উস্থাপন করার।
কিংবদন্তীতুল্য কিছু চরিত্রের পেছনের রহস্য উন্মোচন করে তা
সমান্তরালভাবে উস্থাপন করার।
এগুলো হচ্ছে সেই সব চরিত্রের গল্প যারা পর্দার আড়ালে কাজ করেছেন। আবার একই সময়ে তারা এমন একটি প্রেক্ষাপট তৈরিতে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন, যার ফলে ২০০১ সালে আমেরিকায় বোমা হামলার পর যারা তোরা-বোরা পাহাড়ের ধ্বংসস্তুপের নিচে চাপা পড়ে গেছে বলে ধারনা করা হচ্ছিল, মাত্র কয়েক বছরের মধ্যে সেই আল-কায়েদা উত্তর আফ্রিকা থেকে মধ্য এশিয়া পর্যন্ত তাদের ডানা বিস্তৃত করেছে। পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে একটি বাস্তবমুখী বৈশ্বিক প্রতিরোধ আন্দোলন হিসেবে আবির্ভূত হতে সক্ষম হয়েছে।
আল-কায়েদার বিভিন্ন ব্যাক্তিবর্গের সাথে দেখা করার জন্য আমি ইরাক, লেবানন, উত্তর ওয়াজিরিস্তান এবং আফগানিস্তান ভ্রমণ করেছি। কিন্তু বিস্ময়করভাবে আমার প্রকৃত অনুপ্রেরণা হিসেবে কাজ করেছে খুবই স্বল্প পরিচিত একজন মানুষ। পাকিস্তানের এলিট কমান্ডোদের একজন, পাকিস্তান আর্মীর স্পেশাল সার্ভিস গ্রুপের (SSG) একজন সদস্য রিটায়ার্ড ক্যাপ্টেন খুররাম আশিক (হেলমান্দ প্রদেশে যুক্তরাজ্যের সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াইয়ে নিহত)। যখন আমি তার সাথে দেখা করি, ততোদিনে ক্যাপ্টেন খুররাম আর্মি থেকে স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করে আফগানিস্তানে তালেবানের সাথে যোগ দিয়েছেন।
আল-কায়েদাতে খুররামের অবদান ভোলার মত না। তার মৃত্যুতে তার বন্ধু রিটায়ার্ড মেজর আব্দুল রহমান এবং তার ভাই আরেক রিটায়ার্ড মেজর হারুন, আমার সাথে দেখা করেন এবং আল-কায়দার যুদ্ধকৌশল সম্পর্কে আমার দৃষ্টিভঙ্গি ও ধারনাকে আরো বিস্তৃত করেন। মেজর আব্দুল রহমান ও রিটায়ার্ড মেজর হারুন, পরবর্তীতে ২০০৮ সালের ২৬ নভেম্বর, মুম্বাই হামলার (যে হামলাকে ২৬/১১ বলা হয়) প্রধান দুই মাস্টারমাইন্ডে পরিণত হন এবং পশ্চিমাদের মিত্রশক্তির বিরুদ্ধে আল-কায়েদার যুদ্ধের মোড় ঘুড়িয়ে দেন।
তাদের সাথে দেখা হবার পর সম্পূর্ণ নতুন এক দৃষ্টিভঙ্গিতে আমি আল-কায়েদার দুনিয়াকে দেখা শুরু করি –এক অতুলনীয় কর্মশক্তি যা কেবল বিশ্বাসের দৃঢ়তা এবং উদ্ভাবনী দক্ষতার মাধ্যমে বিশ্বের সবচেয়ে জটিল, উন্নত এবং শক্তিশালী প্রযুক্তির আমেরিকাকে (বিশ্বের একমাত্র সুপার পাওয়ার) ৯/১১ এর মাধ্যমে উস্কে দিয়েছিল। তাদের এ হামলার উদ্দেশ্য ছিল আমেরিকাকে এমন এক অঞ্চলে যুদ্ধে টেনে আনা যেখানকার মানুষেরা প্রস্তর যুগে বসবাস করত — এমন এক যুগ যেখানে উচ্চ প্রযুক্তির কোন মূল্য নেই। যেখানে শুধুমাত্র বেঁচে থাকার সহজাত জ্ঞানটুকুই বিদ্যমান। তাই এটা বিস্ময়কর ছিল না যে, যুদ্ধের প্রথম দিকে আল-কায়েদার অনুগত শত শত যোদ্ধা নিহত হয়েছিল আর বেঁচে যাওয়া যোদ্ধারা দ্রুত পাহাড়ের গুহায় আশ্রয় নিয়েছিল। আর আমেরিকার বিজয় পর্যবেক্ষণ করতে বাধ্য হয়েছিল।
যখন ইবনুল বালাদ অর্থাৎ মাটির সন্তানেরা (স্থানীয় তালিবান) বিদেশী অনুপ্রবেশকারীদের বিরুদ্ধে লড়াই করছিল আল-কায়েদা খুব গভীরভাবে পরিস্থিত পর্যবেক্ষণ করলেও লড়াই থেকে বিরত ছিল। তারা প্রতিনিয়ত ব্যস্ত ছিল অন্য আরেকটি কাজ নিয়ে, আর তা হল এই মাটির সন্তানদেরকে “রক্তের ভাইয়ে” পরিণত করা করা এবং সরাসরি আল-কায়েদার অধীনে নিয়ে আসা।
আল-কায়েদার প্রথম লক্ষ্য ছিল আফগানিস্তানের মাটিতে পশ্চিমাদের বিরুদ্ধে জয় লাভ করা। পরবর্তী লক্ষ্য ছিল যুদ্ধকে মধ্য এশিয়া থেকে বাংলাদেশ পর্যন্ত বিস্তৃত করা যাতে মধ্যপ্রাচ্যের চূড়ান্ত যুদ্ধে যাবার আগেই সুপার পাওয়ারের শক্তি সামর্থ্য ও সম্পদক নিঃশেষ করা দেয়া যায়। যাতে খিলাফতের অধীনে মুসলিমদের রাজনৈতিক ক্ষমতা সুসংগত করা যায় যা পরবর্তীতে সকল মুসলিম ভূমিকে স্বাধীনতার দিকে পরিচালিত করবে।
এই বইটি লেখা হয়েছে সংকটপূর্ণ এমন এক সন্ধিক্ষণে যখন আফগানিস্তানে পশ্চিমা মিত্রশক্তির পরাজয় অবশ্যম্ভাবী হয়ে দাড়িয়েছে। একসময় অনেক বক্তাই পারমানবিক অস্ত্রে সজ্জিত ও মুসলিম রাষ্ট্রগুলোর সমর্থনপুস্ট এক আল-কায়েদার ছবি অংকন করেছিল, বিশ্ববাসীর জন্য একে হুমকি হিসেবে চিত্রায়িত করেছিলেন। কিন্তু বহু বছরের যুদ্ধের পর যা সবকিছুকে ছাপিয়ে উঠেছে তা হল আল-কায়দার অস্ত্রভান্ডার এর মূল হাতিয়ার নয় বরং আল-কায়েদার মূল অস্ত্র হল ঘটনা প্রবাহকে কাজে লাগানোর মাধ্যমে উচ্চ-প্রযুক্তি সম্পন্ন শত্রুকে বিপর্যস্ত করার কৌশলের বিপদজনক সক্ষমতা।
পশ্চিমা মিত্রশক্তি এখন আফগান যুদ্ধের ময়দান থেকে বেড়িয়ে আসার উপায় খুজছে। কিন্তু কখনো যদি পশ্চিমা মিত্রশক্তি তা করতে সক্ষম হয়ও তবুও এর মাধ্যমে পশ্চিমের বিরুদ্ধে আল-কায়েদার যুদ্ধের সমাপ্তি ঘটাবে না। এটা কেবল যুদ্ধের একটি পর্বের সমাপ্তির সংকেত দেবে, এবং আরেকটি পর্বের সূচনা করবে। আর এই দৃষ্টিভঙ্গিটিই আমি পুরো বইটি জুড়ে বিশ্লেষণ করার চেষ্টা করেছি।
.
প্রথম পর্বঃ আরব্য রজনীর নতুন অধ্যায় || নির্বাসনের চিরকুট || অনুবাদকের কথা
দ্বিতীয় পর্বঃ আরব্য রজনীর নতুন অধ্যায় || নির্বাসনের চিরকুট || লেখক পরিচিতি
.
(চলবে ইনশাআল্লাহ)
.
.
Comment