পর্ব - ১
লেখক পরিচিতি
পুরো নাম সৈয়দ আনোয়ার শাহ ইবনে মুয়াজ্জাম শাহ কাশ্মীরী (রহিমাহুল্লাহ)। যিনি ছিলেন তৎকালীন সময়ে ভারতীয় উপমহাদেশের একজন শ্রেষ্ঠ মুসলিম পন্ডিত। যিনি দারুল উলুম দেওবন্দসহ বেশ কিছু খ্যাতনামা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষাদান করেছেন। কিন্তু অতীব দুঃখের বিষয় এই যে, তাঁর মতো একজন নবীর ওয়ারিস পেয়েও পরবর্তীতে দারুল উলুম দেওবন্দ আক্বীদা সংশ্লিষ্ট এমন এমন বিষয় থেকে বিচ্যূত হয়েছে যা কল্পনাতীত। একই সাথে দুঃখের বিষয় এটাও যে, উপমহাদেশের অনেক মুসলিম আলেম এই প্রখ্যাত শাইখের উৎকৃষ্ট গ্রন্থাবলীর আলোচনা থেকে এই নির্যাতিত উম্মাহকে মাহরুম করে রেখেছেন। এমনকি শাইখের বিষয়ে কিছু কিছু বদবখত নামকাওয়াস্তে আলেম যুগের মুনাফিকদের ন্যায় মিথ্যাচার করতেও কার্পণ্য করেনি। কিন্তু, সমস্ত ভয়-ডর ভূলে ঈমান ও কুফরের লড়াইয়ে যারা পিছপা হতে রাজী নয় সে হোক উলামাদের মধ্য থেকে বা তলবে ইলমদের মধ্য থেকে অথবা সাধারণ মুসলিমদের মধ্য থেকে তারা কেউ আনোয়ার শাহ কাশ্মীরী সম্পর্কে জানেনি কিংবা শাইখের লেখনী থেকে উপকৃত হয়নি এমনটি হওয়া অকল্পনীয়। সমকালীন আলেমসমাজে তিনি ‘যুগ শ্রেষ্ঠ ইমামে’র মর্যাদা রাখতেন। তিনি এমনই অদ্বিতীয় ছিলেন যে, বিগত শতাব্দীতে তাঁর সমকক্ষ পাওয়া মুসকিল। পূর্ববর্তী ও পরবর্তী বুযুর্গদের মধ্যে যে পরিপূর্ণতার অধিকারী কতিপয় পবিত্রাত্মা অতিবাহিত হয়েছেন, হযরত শাহ সাহেবও তাঁদের মত বিরল ব্যক্তিত্বের অধিকারী ছিলেন।
তবে, পাঠকের উচিত লেখকের লেখনী পড়েই লেখক সম্পর্কে ধারণা লাভ করা এবং এটাই উত্তম হবে ইনশাআল্লাহ। বাংলায় অনূদিত আক্বীদা সম্পর্কিত কিতাব সমূহের মধ্যে শায়িখের কিছু কিতাব নিতান্তই অতূলনীয় বললে বাড়িয়ে বলা হবে না বলে আমি মনে করি। সেগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য একটি কিতাব হচ্ছে, “ইকফারুল মুলহিদীন ওয়াল মূতাআওইলীন”। বাংলায় “ওরা কাফের কেন?” শিরোনামে হুদহুদ প্রকাশনী বইটি অনুবাদ করেছে। তাই, আমরা এই কিতাবে উল্লেখিত উল্লেখযোগ্য কিছু আলোচনার মাধ্যমে শাইখের উৎকৃষ্ট আক্বিদা থেকে ফায়দা নেয়ার চেষ্টা করবো ইনশাআল্লাহ।
কিতাব রচনার প্রেক্ষাপট
নববী যুগের ন্যায় সিদ্দিকী ও ফারুকী যুগেও ইসলামের দৈনন্দিন উন্নতি ও অগ্রগতির একই ধারা অব্যাহত ছিলো এবং ইসলামের দ্যূতি প্রাচ্য-পাশ্চাত্য সহ সারা দুনিয়ায় নব উদ্ভাসিত সূর্যের আলোকরশ্মির ন্যায় ছড়িয়ে পড়তে থাকে। আল্লাহ’র ইচ্ছায় উসমানী যুগে ফারুকী যুগের মত সতর্কতা ও সচেতনতা বহাল থাকতে পারেনি। কাজেই মুসলিমের মুখোসধারী ইহুদিরা গোপন চক্রান্তে মেতে ওঠে। আলী রদিয়াল্লাহু’র যামানায় এসব ফিৎনা যুদ্ধের রুপ লাভ করে তীব্র আকার ধারণ করে। কিন্তু আল্লাহ আজ্জাওয়াজাল তাঁর প্রজ্ঞা ও দূরদর্শীতার বরকতে দ্বীনের সুরক্ষা দান করেন। যেমনিভাবে সিদ্দীকী যুগে মুরতাদ হওয়া ও যাকাত অস্বীকারের ফিৎনা পূর্ণরুপে আত্মপ্রকাশ করেছিলো এবং আল্লাহ আজ্জাওয়াজাল সিদ্দীকী প্রতিরোধ ও দৃঢ়তার বরকতে ইসলামের হিফাযত করেছিলেন; ঠিক তেমনি খারেজী ও শিয়াদের বাড়াবাড়ির কারণে আলী মুরতাজার খিলাফাতকালে ইসলামের পতনের আশঙ্কা দেখা দিয়েছিলো। ফলশ্রুতিতে জামাল ও সিফ্ফিনের যুদ্ধের মত বেদনাদায়ক ও রক্তবাহী ঘটনার ইতিহাস তৈরি হয়, ইসলামের পূণ্যভূমি সাহাবা ও তাবীয়ীনদের রক্তে রঞ্জিত হয়। ফলে শিয়া, রাফেযী, খারেজী, মু’তাযিলাসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক ও ধর্মীয় ফিৎনার শিকড় দূর-দূরান্ত পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ে এবং প্রথম বারের মত “ঈমান” ও “কুফরে”র মাসাআলা সামনে উপস্থিত হয় এবং এই বিষয়ে কার্যকর গবেষণার প্রয়োজন দেখা দেয়।
মজার বিষয় ছিলো এই যে, খারেজী ও মু’তাযিলা সম্প্রদায়ও তাওহীদের দাবিদার ছিলো এবং শিয়া ও রাফেযী সম্প্রদায়ও ইসলাম ও আহলে বাইতের মহব্বতের দাবিদার ছিলো। তবে উভয় ফিরকা সাহাবায়ে কিরামের কুফরের উপর ঐক্যবদ্ধ ছিলো, আর একইসাথে তারা নিজেদের ঈমানের দাবি করতো। তারপর এই দুই ফিরকা থেকেই “জাহমিয়া”, “মুরজিয়া”, “কাররামিয়া” ইত্যাদি ইসলামের দাবিদার নতুন (বিচ্যূত) শাখার আবির্ভাব হতে থাকে। এই ফিরকাগুলোর প্রত্যেকটি নিজেদের ছাড়া বাকীদেরকে কাফের বলতো।
কাজেই দ্বীনের হিফাযতের জন্য মাপকাঠি ও নাজাতের মানদন্ড কী? ইসলামের হাকীক্বত কী? কুফরের মূল বুনিয়াদ কী? তা গবেষণা করে সমাধান করে দেয়ার তীব্র প্রয়োজন দেখা দেয়।
প্রেক্ষিতে ইমাম আহমাদ ইবনে হাম্বল, আবু বকর ইবনে আবু শায়বা, আবু উবায়দ কাসেম ইবনে সাল্লাম, মুহাম্মাদ ইবনে নাসর মারওয়াযী, মুহাম্মাদ ইবনে আসলাম তূসী, আবুল হাসান ইবনে আব্দুর রহমান ইবনে রুস্তা, ইবনে হিব্বান, আবু বকর বায়হাকীসহ হাদীসের বিভিন্ন ইমাম ঈমান প্রসঙ্গে মুহাদ্দিসী তরীকায় কিতাব সংকলন করেছেন। সম্ভবত শাইখুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়্যা’র “কিতাবুল ঈমান” মুহাদ্দিসী তরীকায় রচিত সর্বশেষ গ্রন্থ। তবে শাস্ত্রীয় দৃষ্টিভঙ্গিতে মুহাদ্দিসী তরীকার পুস্তকাদি যথেষ্ট ছিলো না। কাজেই কালাম-শাস্ত্রবীদগণ এই ময়দানে পদার্পণ করেন এবং পূর্বতন কালাম-শাস্ত্রীদের রচনাবলীতেও এসব মাসআলা আলোচিত হয়। ইমাম আবুল হাসান আশাাআরী থেকে হুজ্জাতুল ইসলাম ইমাম গাযালী পর্যন্ত বড় বড় কালাম-শাস্ত্রীগণ এ বিষয়ে অনেক তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ তুলে ধরেন এবং তুলে ধরেন যথেষ্ট পরিমাণে যুক্তি ও বিবৃতি নির্ভর আলোচনা। সম্ভবত হুজ্জাতুল ইসলাম ইমাম মুহাম্মাদ ইবনে মুহাম্মাদ গাযালী তূসী প্রথম ব্যক্তি, যিনি এই প্রসঙ্গে বিশ্লেষণধর্মী স্বতন্ত্র পুস্তক লেখেন, যার নাম “ফায়সালুত তাফরিকা বায়নাল ইসলামি ওয়ায-যান্দাকাহ”।
আস্তে আস্তে এই মাসআলা ফুকাহায়ে কিরামের সীমানায় প্রবেশ করে। ফুকাহায়ে কিরামও তাদের নিজস্ব ফিকহী ধাঁচে এই প্রসঙ্গে অনেক লিখালিখি করেন। কিন্তু এক দিকে উম্মতের সামনে ছিলো ইমাম আবু হানীফা রহমাতুল্লাহি আলাইহ এর বক্তব্য – “আমরা কোন আহলে কিবলাকে কাফির সাব্যস্ত করবো না”, অন্য দিকে এও তাদের সামনে ছিলো যে, দ্বীনের জরুরী বিষয়াদীর কোন একটি অস্বীকার করা কুফর; বরং দ্বীনের জরুরী বিষয়ে “তাবীল” করাও কুফরের কারণ।
মোট কথা, গুরুত্ব ও স্পর্শকাতরতার বিচারে এই বিষয়টি অধিক থেকে অধিক জটিল হয়ে যায়। এরই ফাঁকে পাঞ্জাব ভূ-খন্ডে এক “নবুয়তের দাবিদার” পয়দা হয়। সে তার স্বতন্ত্র শরীয়তনির্ভর নবুয়ত প্রমাণের জন্য দ্বীনের অকাট্য বিষয়াদি অস্বীকার করা শুরু করে। খতমে নবুয়তের মত সর্বসম্মত ও বুনিয়াদীভাবে প্রতিষ্ঠিত বিষয়কে নতুন করে আলোচনায় নিয়ে আসে। এই যামানায় জিহাদ ও হজ্জ্ব রহিত বলে ঘোষণা করে। একইসাথে গোলকধাঁধা সৃষ্টির জন্য উচ্চস্বরে ‘তাবলীগে ইসলামে’রও শ্লোগান দিতে থাকে। পাশাপাশি উলামায়ে ছু’দের শাসকশ্রেণীর কুফর সাব্যস্ত হওয়ার বিষয়ে সৃষ্ট সংশয়গুলোও সাধারণ মুসলিমদেরকে দ্বিধান্বিত করে তোলে।
সারকথা হচ্ছে বিভিন্ন দিক থেকে দ্বীন হিফাযতের জন্য তীব্র প্রয়োজন দেখা দেয়, যাতে এসব বিষয়ে উম্মাহ’র দিকনির্দেশনার উদ্দেশ্যে একটি বস্তুনিষ্ঠ রচনা সামনে আসে। তাহলে এসব সূক্ষ্ম ও জটিল ক্ষেত্রে কুফর ও ইসলামের ব্যবধান বুঝতে আগামী প্রজন্মকে বেগ পেতে না হয়।
কিন্তু এসব বিষয়ে লিপ্ত হওয়া যে কোন আলেম ও ফক্বীহের কাজ নয়; আবার যে কোন রচনাকার লেখকেরও কাজ নয়; বরং এর জন্য প্রয়োজন এমন এক ব্যক্তিত্বের, যিনি যথাক্রমে মুহাদ্দিস, ফক্বীহ, কালামশাস্ত্রবীদ, উসূলবীদ, ইতিহাসবীদ, আন্তঃধর্ম বিশ্লেষক, দূরদৃষ্টি সম্পন্ন ও নিরপেক্ষ। যার জীবন জ্ঞান-বিজ্ঞান ও বিভিন্ন শাস্ত্রের বিশ্লষণে অতিবাহিত হয়েছে। যিনি মুজতাহিদসুলব রুচির অধিকারী এবং ফিৎনা-ফাসাদ ও দল-উপদল সম্পর্কে সম্যক অবগত।
আল্লাহ তাআলা এই মহান ইলমী ও দ্বীনী খেদমতের জন্য ইমামুল আসর হযরত মাওলানা মুহাম্মাদ আনোয়ার শাহ কাশ্মীরী দেওবন্দী রহমাতুল্লাহি আলাইহকে নির্বাচন করেছেন।
যখন ফুকাহা ও মুহাদ্দিসদের আলোচনায় আহলে ক্বিবলাকে কাফের সাব্যস্ত করার বিষয়টি জটিল হয়ে পড়েছিলো ঠিক তখনই দ্বীনের এরুপ ক্রান্তিকালে রচিত হয় অনন্য এক কিতাব “ইকফারুল মুলহিদীন ওয়াল মূতাআওইলীন”
এই কিতাবের বিষয়ে অভিমত প্রদানকারী উল্লেখযোগ্য উলামাগণ
=> হযরত মাওলানা মুহাম্মাদ আযীযুর রহমান দেওবন্দী
=> হাকীমুল উম্মাহ হযরত আশরাফ আলী থানভী
=> হযরত মাওলানা খলীল আহমাদ সাহারানপুরী
=> হযরত মাওলানা হাকীম রহিমুল্লাহ বিজনূরী
=> হযরত মাওলানা মুফতি কেফায়েতউল্লাহ দেহলভী
=> হযরত মাওলানা সাব্বির আহমাদ
একটি ছোট্ট অনুরোধ
পাঠক মহোদয়ের কাছে অনুরোধ, বর্তমান যামানায় নবীদের ওয়ারিস দাবিদার যে সব উলামা দ্বীনের অকাট্য ও প্রমাণিত বিষয়সমূহে তাদের পূর্বসূরীদের বিপরীত ব্যাখ্যা পেশ করে, যারা শাসক শ্রেণীর কাফের হওয়ার বিষয়ে তাবীল করে, যারা মুজাহিদদেরকে ঢালাওভাবে বাতিল সাব্যস্ত করে, যারা আল্লাহ’র বিধান ব্যতিরেকে মানব রচিত আইন দ্বারা পরিচালিত গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাপনাকে মন্দের ভালো বলে এ ভয়ঙ্কর কুফরকে বৈধতা দেয়ার চেষ্টা করে, যারা তাওহীদুল হাকিমিয়্যাহকে উপেক্ষাকারী ব্যক্তির শুধুমাত্র নামায আদায়ের কারণে মুসলিম বলে প্রচার করে তাদের কাছে এ কিতাব পৌঁছিয়ে দিন। অথবা এ কিতাব নিয়ে তাদের কাছে বসে তাদের থেকেই দারস নিন। ইনশাআল্লাহ, শুধু এতোটুকু করার কারণেই এমন হতে পারে যে কেউ আল্লাহ’র ইচ্ছায় হিদায়াতের উপর দৃঢ় হবে অথবা কেউ কিভাবে দ্বীনের সত্য বিষয়ের উপর মিথ্যারোপ করে বা দ্বীনের সত্য বিষয় দাম্ভিকের ন্যায় এড়িয়ে চলে তা প্রমাণিত হবে।
... চলবে ইনশাআল্লাহ
বইয়ের পিডিএফ লিঙ্ক: https://islamiboi.wordpress.com/2016...re_they_kafir/
Comment