যেভাবে আমরা ঈমান বৃদ্ধির মেহনত করব
প্রত্যেকটা মানুষ দুইটি জিনিস দিয়ে চিন্তা করে। একট হচ্ছে তার মস্তিষ্ক/ব্রেইন দিয়ে আরেকটা হচ্ছে তার ক্বলব/অন্তর দিয়ে।
মানুষ তার চোখ, কান, হাত ইত্যাদি পঞ্চইন্দ্রিয় দিয়ে যে জ্ঞান অর্জন করে তার চিন্তা হয় ব্রেইন দিয়ে। অন্যদিকে যা পঞ্চইন্দ্রিয় দ্বারা দেখা যায় না কিন্তু অদৃশ্য বাস্তবতা, তা বুঝা যায় অন্তর বা হৃদয় দিয়ে।
মানুষ চোখ দিয়ে যা দেখে বা কান দিয়ে যা শুনে তা সরাসরি তাকে প্রভাবিত করতে পারে না, তাকে পরিচালিত করতে পারে না। বরং কোন জিনিস যখন অন্তর দিয়ে অনুভব করে তখনই তা কাউকে প্রভাবিত করে।
যেমন ধরুন, কারো পিছনে সাপ। আমি আরবিতে বললাম- খালফাকা হাইয়্যাহ, কিন্তু সে আরবি বুঝে না। তাহলে সে বিপদের কথা শুনেও তার মধ্যে কোন পরিবর্তন আসবে না। অথবা সে চোখে সাপটাকে দেখল, কিন্তু এটা যে সাপ তা বুঝে নি। তাহলেও তার মধ্যে কোন পরিবর্তন আসবে না। কিন্তু যখনই সে অন্তর দিয়ে অনুধাবন করবে যে এটা সাপ, এখন যদিও কামড়ায় নি কিন্তু ভবিষ্যতে দংশন করার সম্ভাবনা আছে, আর এমন হলে আমি মারা যাব। তখনই দেখা যাবে মুহুর্তের মধ্যে সে হাওয়া হয়ে গেছে।
এখানে তার পরিবর্তনটা যতক্ষন পঞ্চইন্দ্রিয় দিয়ে বাহ্যিক তথ্য লাভ করতেছিল ততক্ষন আসে নি, কিন্তু যখনই অন্তর দিয়ে অদৃশ্য হাকিকত বা ভবিষ্যৎ বাস্তবতা অনুধাবন/অনুভব করতে পেরেছে তখনই এসেছে।
আমরা আল্লাহ তায়ালার উপর যত বিষয়ে ঈমান আনি সবই অদৃশ্য, যা পঞ্চইন্দ্রিয় দিয়ে জানা যায় না। আল্লাহ তায়ালা রিজিক দাতা, পরিচালনাকারী, সৃষ্টিকর্তা, পালনকর্তা, ফিরিশতা, আল্লাহর তায়ালার সাহায্য, রোগ দেয়া, সুস্থ করা ইত্যাদি সব অদৃশ্য কাজ। এখন যদি শুধু যা ইন্দ্রিয় জ্ঞানে সীমাবদ্ধ থাকি তাহলে কখনোই ঈমানদার হওয়া যাবে না, কিন্তু যখনই অন্তর দিয়ে অনুভব করব তখনই ঈমান তৈরি হবে ও আমাদের মধ্যে ঈমানী পরিবর্তন শুরু হবে।
যেমন, আল্লাহ তায়ালা রিজিক দাতা, কিন্তু বাহ্যিক ভাবে আমরা দেখি বিভিন্ন কিছু থেকে রিজিক আসছে, আল্লাহ তায়ালাই যে রিজিক দিচ্ছেন তা অদৃশ্য। এখন আল্লাহ তায়ালাহই যে রাজ্জাক এই বিশ্বাস কখনোই যুক্তি দিয়ে অর্জন সম্ভব নয় যতক্ষন না অন্তর দিয়ে হাকিকত চিন্তা করা হবে ও বাস্তব অনুভূতি অর্জন হবে।
অন্যদিকে ধরুন, আমরা যখন কারো সামনে দ্বীনী কথা বলি বা কাজ করি তখন অনেক সময় নিজের মাঝে আত্বগরিমা তৈরি হয়। যা দূর করতে অনেক কষ্ট হয় বা ভুলে থাকার চেষ্টা করি। কারণ আমরা যদিও ভাবছি আমি কাজটা করছি না কিন্তু বাহ্যিকে তো দেখছি আমি করতেছি। যার ফলে অনেকেই এটার সঠিক কোন সমাধান করতে পারেন না। কিন্তু যদি কেহ এটা অনুভব করেন যে, আমি যদিও দেখি না কিন্তু সর্বস্থানে একটা অদৃশ্য ইলাহী শক্তি বিরাজমান যা আমি সহ পৃথীবীর প্রতিটা অনু-পরমানুকেও পরিচালনা করছে, যা আমি দেখছি না। সেই শক্তিই আমার দ্বারা প্রতিটা কাজ করিয়ে নিয়েছেন, তখন নিজের আত্বগরিমা দূর হয়ে যায়। এই অনুভতিটা হচ্ছে আল্লাহ তায়ালা সর্বময় ক্ষমতার অধীকারী, তিনিই সবকিছু পরিচালক হিসেবে অন্তরের ঈমান।
আবার ধরুন, আমরা বাহ্যিক ভাবে দেখি-শুনি ত্বাগুতেরা মুজাহিদদের গ্রেফতার করে, অন্যদিকে আল্লাহ তায়ালা বলেছেন, (ঈমানদারদেরকে সাহায্য করা আমার দ্বায়িত্ব – রুম,৪৭)। কিন্তু দ্বিতীয় বিষয়টা অদৃশ্য যা আমরা এই মুহুর্তে দেখছি না। এখন যারা বাহ্যিকেই বেশি বিশ্বাস করে তারা কখনোই বিপদের মধ্যে দ্বীনের পথে চলতে পারবে না। কিন্তু যারা অন্তর দিয়ে মহান আল্লাহ আল্লাহ তায়ালার অদৃশ্য ইলাহী ক্ষমতার বাস্তব অনুভূতি অর্জনের মাধ্যমে ঈমান আনবে, আল্লাহ তায়ালার ভবিষ্যত সাহায্যের উপর নিশ্চিত বিশ্বাস করবে তারাই আল্লাহ তায়ালা ছাড়া অন্য কাউকে ভয় করবে না। তারা সর্বদাই প্রত্যেকটা জিনিসের পিছনে আল্লাহর অদৃশ্য শক্তির উপস্থিতি অনুভব করবে। মাখলুকাতের শক্তি শুন্যতার অনুভূতি অন্তরের জাগ্রত থাকবে।
এই জন্যেই ঈমানদারদের পরিচয় দিতে গিয়ে কুরআনে কারীমের শুরুতেই মহান রব বলেছেন, ﺍﻟَّﺬِﻳۡﻦَ ﻳُﺆۡﻣِﻨُﻮۡﻥَ ﺑِﺎﻟۡﻐَﻴۡﺐِ যারা গায়েব বা অদৃশ্যের উপর ঈমান আনে।
ঈমান এমন বিষয় যা শুধু জ্ঞান বা ইন্দ্রিয় শক্তি দ্বারা অর্জিত হয় না, বরং আমরা ইন্দ্রিয় শক্তি দ্বারা যে জ্ঞান লাভ করি তা যখন অন্তর দিয়ে ফিকির করা হয়, তখনই ঈমান অর্জিত হয়।
মহান আল্লাহ তায়ালা পূরা কুরআনে ঈমান শিক্ষা দিতে গিয়ে বারবার বলেছেন, তোমরা কি পাখি দেখ না যাকে বাহ্যিক কোন শক্তি ধরে রাখে নি, বরং অদৃশ্য ইলাহী শক্তি দিয়ে পরিচালিত হচ্ছে? তোমরা কি আকাশ দেখ না যাকে বাহ্যিক খুটিবিহীন ইলাহী শক্তি ধরে রেখেছে? তোমরা কি মায়ের পেটে মানুষ দেখ না? তোমরা কি এটা দেখ না / তোমরা কি সেটা দেখ না? ইত্যাদি অসংখ্য উদাহারণ। এখানে সর্বক্ষেত্রেই বাহ্যিকে প্রাপ্ত ইলম নিয়ে অন্তরে অদৃশ্য হাকিকত ও ভবিষ্যত বাস্তবতা নিয়ে চিন্তা করতে বলেছেন।
যারা অন্তর দিয়ে তাদাব্বুর বা গভীর ফিকির করে তাদের ঈমান বাড়ে, তাদের ঈমান দৃঢ় হয়। কুরআন নিয়ে তাদাব্বুর করলে মানুষের অন্তর প্রকম্পিত হয়, ঈমান বাড়ে। কুরআনে আল্লাহ তায়ালা বারবার তাদাব্বুর করার কথা ঈমান বৃদ্ধির জন্যেই বলেছেন।
অন্যদিকে যারা ক্বলব দিয়ে ফিকির করে না তারাই পথভ্রষ্ট হয়ে থাকে। যেমন আল্লাহ তায়ালা জাহান্নামীদের ব্যপারে বলেছেনঃ- لَهُمْ قُلُوبٌ لَّا يَفْقَهُونَ بِهَا তাদের এমন অন্তর রয়েছে যা দিয়ে তারা বিবেচনা, অনুধাবন, চিন্তা-ফিকির করে না।
أَفَلَمْ يَسِيرُوا فِي الْأَرْضِ فَتَكُونَ لَهُمْ قُلُوبٌ يَعْقِلُونَ بِهَا أَوْ آذَانٌ يَسْمَعُونَ بِهَا فَإِنَّهَا لَا تَعْمَى الْأَبْصَارُ وَلَكِن تَعْمَى الْقُلُوبُ الَّتِي فِي الصُّدُورِ
তারা কি এই উদ্দেশ্যে দেশ ভ্রমণ করেনি, যাতে তারা চিন্তাশীল ক্বলব ও শ্রবণ শক্তি সম্পন্ন কর্ণের অধিকারী হতে পারে? বস্তুতঃ চক্ষু তো অন্ধ হয় না, কিন্তু বক্ষ স্থিত অন্তরই অন্ধ হয়। [ সুরা হাজ্জ্ব ২২:৪৬ ]কুরআনকে আল্লাহ তায়ালা মানুষের অন্তরের জন্যেই অবতির্ন করেছেন, অন্তরকে বানিয়েছেন ঈমানের বাসস্থান। তাই আমাদের জীবনের সর্বপ্রথম কাজ হবে, অন্তরের ফিকির বা চিন্তাগুলোকে জাগিয়ে তুলা, যার ফলে আমাদের দুনিয়া আখেরাতের সর্ব বিষয়ের সফলতা লাভ ও ক্ষতি থেকে বেচে থাকতে পারব ইনশাআল্লাহ।
জিহাদী কাজে টিকে থাকতে হলে আমাদেরকে অবশ্যই অন্তরের ফিকিরের মাধ্যমে অনুধাবন করতে হবে ঈমানী শক্তির হাকিকত কি? তা কিভাবে অর্জিত হয়? সেই মহান শক্তির মাধ্যমে আমাদের দ্বীনী সব কাজে বিজয় কিভাবে অর্জিত হয়? তাহলেই আমরা নিজেরা ঈমানদার বাহিনী হিসেবে গড়ে উঠতে পারব, শেষ পর্যন্ত ঈমানের পথে টিকে থাকতে পারব ইনশাআল্লাহ।
আল্লাহ তায়ালা আমাদেরকে পূর্ন ঈমানদার মুজাহিদ বানিয়ে দিন, আমাদের মাধ্যমে সর্বশ্রেষ্ঠ দ্বীনের কাজ সবচেয়ে বেশী করার তাওফীক দান করুন, আখেরাতে সর্বোচ্চ জান্নাত দান করুন।
Comment