শাইখুল হাদিস আশরাফ আলী সাহেব (আল্লাহ তাঁর উপর রহম করুন!) ইন্তেকালের পর কিতালের প্রবক্তা এক শাইখ তাঁর ব্যাপারে 'পথভ্রষ্ট বুড়ো' শব্দচয়ন করেছেন। এতে সর্বমহলে তিনি বিতর্কিত হয়েছেন। তাঁর এমন ক্রিয়ার প্রতিক্রিয়া প্রধানত তিনভাবে ব্যক্ত হয়েছে।
১) মানহাজ বিরোধী শ্রেণি মানহাজের পথভ্রষ্টতা (!) তুলে ধরেছেন তাঁর এমন বক্তব্যের কারণে।
২) মানহাজ সমর্থক ভাইয়েরা তাঁর থেকে দায়মুক্তির ঘোষণা করেছেন মানহাজের পবিত্রতা রক্ষায়।
৩) তৃতীয় আরেকটা শ্রেণি রয়েছে, যারা সরাসরি তাঁর পক্ষে অবস্থান নিয়েছেন।
প্রথম শ্রেণীর ব্যাপারে এখানে খুব বেশি কিছু একটা বলার প্রয়োজন নেই। ফেসবুকে অনেক জনপ্রিয় শাইখ এবং অন্যান্যরা তাদের জবাব দিয়েছেন।
দ্বিতীয় শ্রেণি অর্থাৎ মানহাজ সমর্থক ভাইদের ব্যাপারে বলতে গেলে অনেকেই আমার ব্যাপারে এই ভেবে ভুল করতে পারেন যে, আমি 'পথভ্রষ্ট বুড়ো' এমন শব্দচয়নের পুরোপুরি পক্ষে। কিন্তু না… আমি আগেই জানিয়ে দিচ্ছি আমি এমন কাজকে অনুচিত মনে করেছি।
আমি নিজেই যেহেতু মানহাজ সমর্থক, তাই এটাকে আমাদের আত্মসমালোচনা ধরা যেতে পারে।
যেটা বলতে চাচ্ছি, আমরা মানহাজ সমর্থক ভাইয়েরা আসলেই ওই ভাইয়ের প্রতি অবিচার করেছি। ভাইয়েরা! আসলে আমরা কেউই পরিবেশের প্রভাব থেকে মুক্ত নই। এই যে আমরা 'পথভ্রষ্ট বুড়ো' এমন শব্দের ব্যবহারকে উগ্রতা আখ্যা দিয়েছি, এটা কি আমাদের হেকমতের পরিচয় হলো?? আমরা ঊর্ধ্বে এমন বলতে পারতাম, তার এমন উচ্চারণ হেকমত বিরোধী এবং দাওয়াতের কাজের জন্য ক্ষতিকারক। একটা বিষয় কি আমরা লক্ষ করেছি, আমরা মানহাজ বিরোধী ভাইদের নাকানি-চুবানি থেকে বাঁচার জন্য আমাদেরই একজন তাওহীদবাদী আলেমের ব্যাপারে কেমন অন্যায় আচরণ করলাম?? এই যদি হয় আমাদের অবস্থা,তবে ময়দানে কোন ভাই যদি বাড়াবাড়ির কারণে কখনো বিপদ নিয়ে আসে, তখন কি আমরা সেই বিপদে তাকে একা ফেলে সবাই পালিয়ে যাব?? আমাদের ইসলামী ভ্রাতৃত্ব এতটাই ভঙ্গুর??
আমি আবারো বলতে চাই, আমি অন্ধভাবে উনাকে সমর্থন করছি না এবং তাঁর এমন উচ্চারণের পক্ষে সাফাই গাইছি না। আচ্ছা আমরা একটু নিজেদের বিবেককে প্রশ্ন করি তো, তিনি এমন কি গুরুতর' জঘন্য কাজ করেছেন যে, এর জন্য তাঁকে খারেজী, পথভ্রষ্ট ইত্যাদি আখ্যা দিয়ে নানাভাবে হেয় প্রতিপন্ন করে কথা বলতে হবে?? আমরা যে কারণে তাঁর এমন আচরণ উচ্চারণের প্রতি ক্ষুব্ধ (অর্থাৎ তাঁর হেকমত বিহীন আচরণ উচ্চারণ), প্রতিবাদ করতে গিয়ে সেই একই কারণেরই কি আমরা প্রয়োগ ঘটাচ্ছি না??
তবে সান্তনার কথা হল, আমাদের ফেসবুক ইত্যাদি বিভিন্ন অনলাইন অ্যাক্টিভিটি কোন একক নেতৃত্বের অধীনে নেই বিধায় এ সমস্ত ঘটনাগুলো ঘটছে। কিন্তু বাস্তবে আমরা সকলেই একটি তানজিমের অধীনে রয়েছি আলহামদুলিল্লাহ!তাই প্রয়োজনের সময় সকলেই আমীরের আনুগত্যে ফিরে যাবো তাতে কোন সন্দেহ নেই ইনশাআল্লাহ!! কিন্তু এই যে একেকজন ভাইয়ের প্রতি অবিচার করা হয়ে যাচ্ছে সেটার কি হবে?
আমি কি আমাদের ডাবল স্ট্যান্ডার্ডের বিষয়টা বোঝাতে পেরেছি?!
আমরা মানহাজ বিরোধী ভাইদের নাকানি-চুবানিকে ভয় পাচ্ছি। তাদেরকে কি একথা বলা যেত না, যখন ডক্টর জাকির নায়েক কে কওমি শীর্ষস্থানীয় আলেমরা ইহুদী-খ্রিস্টানদের দালাল আখ্যা দিয়েছেন, তখন কি সে সমস্ত আখ্যা দানকারী আলেমদের প্রতি আমাদের এতটা বিক্ষুব্ধ মনোভাব ছিল?? এটা ঠিক, সমালোচনা হয়েছে কিন্তু তাই বলে আখ্যা দানকারীদের প্রতি কতটুকু ঘৃণা জন্মেছিল?? আর আজ তাওহীদবাদী এক ভাই উপযুক্ত কারণে আবেগ ধরে রাখতে না পেরে তাওহীদ না জানা এক মুরুব্বী আলেমের ব্যাপারে কথা বলাতে তিনি খারেজি ইহুদী-খ্রীষ্টানদের এজেন্ট হয়ে গেলেন??
মানহাজ বিরোধী ভাইদের সঙ্গেও খারাপ ব্যবহারের পক্ষে আমরা নই। আমরা নিজেদের দিকেই তাকিয়ে দেখি তাদের সঙ্গে আমরা কেমন আচরণ করছি অনলাইনে?? আমরা কেন এত সহজে আখলাক ভুলে গেলাম??
আসলে মানহাজ বিরোধী ভাইদের কার্যকলাপে যতটা না কষ্ট পেয়েছি, তার চাইতে বেশি কষ্ট পেয়েছি আমাদের এমন অবিবেচনা দেখে।
##এবার বলি ওই ভাইকে উদ্দেশ্য করে… আসলে ভাই হেকমতের কথা কেন আমরা ভুলে যাই। একথা ঠিক, হেকমতের অপব্যাখ্যা এবং ভ্রান্ত হেকমত ও কৌশলের আমরা বিরোধিতা করে আসছি দীর্ঘদিন ধরে। কিন্তু তাই বলে হেকমত কি দ্বীনে ইসলামের ভেতর নেই?? হে প্রিয় ভাই! আপনি একটু খেয়াল করে দেখুন, কেমন করে আমরা মূল থেকে সরে যেতে যেতে শাখা উপশাখা এসবের ভেতর জড়িয়ে যাচ্ছি?? আমি কেন শুধু শুধু এতগুলো মানুষের পরীক্ষার কারণ হতে যাবো??
প্রিয় ভাই! আপনি মরহুম ওই মুরুব্বী সাহেবের ব্যাপারে যে কথাগুলো বলতে চাচ্ছেন এবং বলতে চেয়েছেন, আমি আপনাকে নিষেধ করি না সেগুলো বলতে। কিন্তু শ্রদ্ধেয় একজন মুরুব্বী আলমের মৃত্যুতে এভাবে আনন্দ প্রকাশ করা…আচ্ছা এটা না করলে এমন কি ক্ষতি হয়ে যেত?? মুমিনদের প্রতি নমনীয় আমাদেরকে হতে বলা হয়েছে তাহলে আমরা কেন পারি না??
আমি আপনার আবেগের প্রতি শ্রদ্ধা রেখে জানতে চাই,"আলহামদুলিল্লাহ" বলে এভাবে আনন্দ প্রকাশ না করলে এমন কি ক্ষতি হয়ে যেত?? আমি একথাও স্বীকার করছি, মানহাজ সমর্থক ভাইয়েরা মৃত্যুর সহানুভূতি দেখানোর ভেতর দিয়ে মুরব্বি আলেমের বাতিল কার্যকলাপ থেকে অনেকটাই বিমুখ হয়ে পড়েছেন সাময়িকভাবে। তাদের সে বিমুখতা কাটানোর জন্য মুরুব্বী আলেমের বাতিল কার্যকলাপ আপনার তুলে ধরা উদ্দেশ্য, কিন্তু সেটার জন্য আনন্দ প্রকাশ…!! * দাওয়াত যদি আমাদের উদ্দেশ্য হয়, তবে আমার এমন আচরণের কারণে কয়জন মানুষ দাওয়াত গ্রহণ করবে??
পরিশেষে মানহাজ সমর্থক ভাইদেরকে আমি আবারো সেই কথা মনে করিয়ে দিতে চাই যা কিছুক্ষণ আগে বলে এসেছি। আমরা যে কাজগুলো করি—অনেকের কাছেই-শ্রদ্ধাভাজন চরমোনাই পীরকে পথভ্রষ্ট বলি, অনেকের কাছেই-শ্রদ্ধাভাজন অনেক আলেমকে নিকৃষ্ট আলেম বলি, ফরিদ উদ্দিন মাসউদ সাহেবকে ব্যঙ্গ করে ফউমা বলি ইত্যাদি।এমনই একটা কাজ একজন ভুল করে ভুল স্থানে বলে করে ফেলাতে আমরা তার থেকে দায়মুক্তি ঘোষণা করে দিলাম এবং তাকে বিভিন্ন ভ্রান্ত ট্যাগ দিয়ে আখ্যায়িত করতে শুরু করলাম? যে ভুলের কারণে আমরা তার প্রতি বিক্ষুব্ধ, তাঁর যে ভুলের কারণে দাওয়াতের পরিবেশ নষ্ট হয়েছে, তার যে ভুলের কারণে অনেকেই মানহাজ সমর্থকদেরকে ভুল ভাবতে শুরু করেছে, সেই একই ভুল করে আমরা কি ভুলকারীর মনে কষ্ট দিলাম না?? সেই একই ভুল করে আমরা কি ভুলকারীকে শোধরানোর পরিবেশ নষ্ট করলাম না?? আমরা কয়জন আছি ভুল কারীর জন্য একান্তে আল্লাহর কাছে দোয়া করেছি?? কয়জন আছি তাকে নম্রভাবে বুঝাতে চেষ্টা করেছি??
হে আল্লাহ আমাদেরকে তায়েফের সুন্নাহ মনে রাখার তৌফিক দাও! আমিন ইয়া রব্বাল আলামিন!
Comment