মূর্তিসংহারক হতে প্রতিমাপ্রহরী; আমাদের বিভ্রান্তির শেষ কোথায়?
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে দুনিয়াতে প্রেরণের অন্যতম একটি উদ্দেশ্য হলো, মূর্তিসংহার, প্রতিমাভঙ্গন। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
أرسلني بصلة الأرحام، وكسر الأوثان
ّআল্লাহ তায়ালা আমাকে প্রেরণ করেছেন আত্মীয়তার সম্পর্ক বজায় রাখা ও মূর্তি ভাঙ্গার আদেশ দিয়ে।" -সহিহ মুসলিম, ৮৩২। মক্কা বিজয়ের পর রাসূল নিজে কাবা শরিফে রাখা ৩৬০ মূর্তি ভাঙ্গেন। -সহিহ বুখারী, ২৪৭৮ সহিহ মুসলিম, ১৭৮০। মদীনায় একটি স্থিতিশীল ইসলামী রাষ্ট্র গড়ে তোলার পর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম শুধু মূর্তি ভাঙ্গার জন্য দিকে দিকে বাহিনী প্রেরণ করেছিলেন। ইয়ামানের সবচেয়ে বড় মন্দির ‘যিল খালাসা’কে ভাঙ্গার জন্য নবীজি জারীর বিন আব্দুল্লাহ বাজালীর নেতৃত্বে দেড়শো ঘোড়সওয়ারের বাহিনী প্রেরণ করেছিলেন। -সহিহ বুখারী, ৪৩৫৬ সহিহ মুসলিম, ২৪৭৬। আলী রাযি. বলেন, “রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহিস সালাম আমাকে এ আদেশ দিয়ে পাঠান যে, আমার সামনে যত মূর্তি পড়বে সব ধ্বংস করে ফেলবো এবং সব উঁচু কবর মাটির সাথে মিশিয়ে সমান করে দিবো। -সহিহ মুসলিম, ৯৬৯। মক্কা বিজয়ের পর রাসূল সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়াসাল্লাম ‘উযযা’কে ভাঙ্গার জন্য খালিদ বিন ওয়ালীদের নেতৃত্বে ত্রিশজন অশ্বারোহী প্রেরণ করেন। ‘লাত’কে ভাঙ্গার জন্য মুগিরাহ বিন শোবা ও আবু সুফিয়ান রাযি. কে প্রেরণ করেন। ‘মানাত’কে ভাঙ্গার জন্য বিশজন অশ্বারোহী সহ সা’দ বিন যায়েদ আশহালীকে পাঠান। ‘হুযাইল’ গোত্রের মূর্তি ভাঙ্গার জন্য প্রেরণ করেন আমর বিন আসকে। ‘তাই’ গোত্রের মূর্তি ভাঙ্গার জন্য প্রেরণ করেন আলী রাযি. কে। তোফায়েল বিন আমর দাউসীকে প্রেরণ করেন আমর বিন হুমামার মূর্তি ভাঙ্গার জন্য। তিনি সে মূর্তিটা ভেঙ্গে আগুনে পুড়িয়ে দেন। -নাসায়ী, আসসুনানুল কুবরা, ১১৪৮৩ মাজমাউয যাওয়ায়েদ, ১০২৫৫ তবাকাতু ইবনি সা’দ, ১/২৪৩; ২/১১০-১১২; ৪/১৮১ ৭/৩৪২ যাদুল মাআদ, ইবনুল কাইয়িম, ৩/৫২৩।
রাসূল যে শুধু ক্ষমতা হাতে পাবার পরেই মূর্তি ভেঙ্গেছিলেন এমন নয়, বরং মক্কায় থাকাকালীন সময়েও রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আলী রাযি. এর সহায়তায় কাবা শরিফের উপরে স্থাপিত মূর্তি ফেলে দিয়ে ভেঙ্গেছিলেন। -মুসনাদে আহমদ, ৬৪৪ মাজমাউয যাওয়ায়েদ, ৯৮৩৬
আর রাসূল কেনই বা মূর্তি ভাঙ্গবেন না? রাসূল তো বংশ ও আদর্শ উভয় দিক দিয়ে ইবরাহীম আলাইহিস সালামের উত্তরসূরী। ইবরাহীম আলাইহিস সালাম কিভাবে মূর্তি ভেঙ্গেছিলেন, এ জন্য কি কি কৌশল অবলম্বন করেছিলেন, এর বিস্তারিত বিবরণ তো কুরআনেই রয়েছে। অথচ তখন ইবরাহীম আলাইহিস সালাম কাফেরদের মাঝে অতি দূর্বল অবস্থায় ছিলেন। এমনকি মূর্তি ভাঙ্গার অপরাধে (?) কাফেররা তাকে আগুনে নিক্ষেপও করেছিল। বলাবাহুল্য, এ সব কিছু কুরআন আমাদের জন্য আদর্শ হিসেবেই পেশ করেছে। -দেখুন, সূরা আলআম্বিয়া, ৫৭-৭০ সুরা সাফফাত, ৮৮-৯৮
নবীদের আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে বিজয়ী সাহাবী ও আমীরগণ মূর্তি ভেঙ্গেছেন। আব্দুর রহমান বিন সামুরাহ রাযি. সিজিস্তান বিজয় করার পর মূর্তি ভাঙ্গেন। -মুজামুল বুলদান, ২/৪৩৪। মাহমুদ গযনবী রহ. সোমনাথের সবচেয়ে বড় মূর্তি ভাঙ্গেন। -আলবিদায়া ওয়াননিহায়া, ৬/২২৩ । জানি না, বর্তমান মুসলিমরা এই মূর্তি ভাঙ্গাকে ভালো মনে করেন, মোল্লা উমরের বৌদ্ধমূর্তি ভাঙ্গা নিয়ে তারা যে শোরগোল করেছেন, এতে মনে হয় তারা বিশ্বাস করেন যে, মাহমুদ গযনবী আসলেই ডাকাত ও লুটেরা ছিলেন, হিন্দুস্তানের সম্পদ লুট করার জন্যই তিনি হিন্দুস্তানে বারবার আক্রমণ করেছেন, যেমনটা বর্তমানে স্কুলের বইয়ে পড়ানো হয়। অথচ মাহমুদ গযনবী, মুহাম্মদ ঘুরী ও বখতিয়ার খিলজীর জিহাদের কল্যাণেই তো আমরা ইসলাম পেয়েছি। তা না হলে তো আজও আমরা মালাউনই থেকে যেতাম। সুতরাং তাদের ডাকাত বলে, ইসলামে আক্রমণাত্মক জিহাদ নেই বলে কি আমরা নিজেদের মুসলিম হওয়ার পথ ও পদ্ধতিকেই প্রশ্নবিদ্ধ করে তুলছি না? যদি মুসলিম হওয়ার প্রকৃত মূল্য আমরা উপলব্ধি করে থাকি তাহলে এ ধরণের বিষয়গুলো নিয়ে আমাদের পুনরায় চিন্তা করা দরকার।
আসলে আজ আমরা কুরআন-হাদিস থেকে দূরে সরে পড়ছি। তাই যে যেভাবে ইচ্ছা আমাদের বিভ্রান্ত করছে। আজ কুরআনের সুস্পষ্ট আদেশ অমান্য করে পারস্পরিক সম্প্রীতি ও ভালোবাসার নামে মুসলিম-কাফের গলাগলি করছে। শুধু তাই নয়, বরং এ সম্প্রীতির চূড়ান্ত প্রকাশ রুপে মুসলিমরা মন্দির পাহারা দিচ্ছে। ইতিপূর্বে হাটহাজারী মাদ্রাসার ছাত্ররা মন্দির পাহারা দিয়েছিল। তা নিয়ে জাতির কর্ণধার আলেমগণ গর্বও করেছিলেন। আজ দেখলাম উত্তর দিল্লীর মুসলিমরাও মন্দির পাহারা দিচ্ছে। আগামীকাল হয়তো দেখবো, মন্দির পাহারা দিতে গিয়ে নিহত মুসলিমদের শহিদও বলা হচ্ছে।
ভারতের মুসলিমরা হয়তো ভেবেছেন, হিন্দুরা নিজেরাই ষড়যন্ত্রমূলকভাবে মূর্তি ভেঙ্গে মুসলিমদের উপর দোষ চাপাবেন। তাই তারা মন্দির পাহারা দিচ্ছেন। কিন্তু মন্দির রক্ষা করতে পারলেই কি হিন্দুরা বসে থাকবে? এভাবেই কি হিন্দুদের হাত থেকে রক্ষা পাওয়া যাবে? আসলে কুরআন-হাদিস থেকে দূরে থাকলে চিরদিনই এভাবে বোকা বনতে হবে। আফসোস, মুসলমানরা এখনও কাফেরদের সাথে ভালোবাসা-সম্প্রীতির মাধ্যমে সুখে-শান্তিতে থাকার দিবা-স্বপ্ন দেখছে। অথচ আল্লাহর তায়ালা তাদের বারবার সতর্ক করে বলেছেন, ‘কাফেররা কখনোই মুসলিমদের প্রতি সন্তুষ্ট হবে না।’ ‘তারা সর্বদা মুসলিমদের সাথে যুদ্ধ করতেই থাকবে, যতক্ষণ না মুসলিমরা তাদের ধর্ম থেকে ফিরে যায়।’ ‘তারা চায় তোমরাও কুফরী করো, যেমনিভাবে তারা কুফরী করেছে।’ ‘তারা তোমাদের ক্ষতি করতে কোন ক্রটি করবে না। তোমাদের কষ্টই তাদের পছন্দনীয়। তোমরা তাদের মহব্বত করলেও তারা তোমাদের মহব্বত করে না।’ ‘সুযোগ পেলে তারা তোমাদের কচুকাটা করবে। এমনকি তোমাদের ব্যাপারে কোন আত্মীয়তার সম্পর্ক কিংবা কোন শান্তিচুক্তির পরোয়াও করবে না। ওরা মিষ্টি মিষ্টি বুলি দিয়ে তোমাদের মন ভুলায়, কিন্তু তাদের অন্তর তোমাদের মহব্বত করতে অস্বীকার করে।’ (দেখুন, সূরা বাকারা, ১২০ ও ২১৭ সূরা আলে ইমরান, ১১৭-১১৮ সুরা নিসা, ৮৯ সুরা তাওবাহ, ৮ সুরা মুমতাহিনাহ, ২)
ভারতের মুসলিম সহ সারা দুনিয়ার মুসলমানদের চিন্তা করা দরকার, কুরআন-হাদীস হতে সরে গিয়ে আমরা কোন পথে হাটছি? এ পথ আমাদের কোথায় নিয়ে যাবে? কুরআন-সুন্নাহ বিরোধী এ ধরণের কর্মপদ্ধতি না আমাদের দুনিয়াতে মুক্তি দিবে না আখেরাতে। নির্যাতিত মুসলিমদের মুক্তির পথ তো একটিই। আল্লাহর পথে সশস্ত্র জিহাদ। আল্লাহ তায়ালা বলেন,
{أُذِنَ لِلَّذِينَ يُقَاتَلُونَ بِأَنَّهُمْ ظُلِمُوا وَإِنَّ اللَّهَ عَلَى نَصْرِهِمْ لَقَدِيرٌ} [الحج: 39]
“যাদের সঙ্গে যুদ্ধ করা হচ্ছে, তাদেরকে অনুমতি দেওয়া যাচ্ছে (তারা নিজেদের প্রতিরক্ষার্থে যুদ্ধ করতে পারে)। যেহেতু তাদের প্রতি যুলুম করা হয়েছে। নিশ্চিত জেনে রেখ, আল্লাহ তাদেরকে জয়যুক্ত করতে পরিপূর্ণ সক্ষম।” -সূরা হাজ্জ, ৩৯
খেলাফতের দ্বায়িত্ব লাভের পর প্রদত্ত সর্বপ্রথম ভাষণে আবু বকর রাযিআল্লাহু আনহু বলেন,
لَا يَدعُ قَوْمٌ الْجِهَادَ فِى سَبِيلِ الله إِلَّا ضَرَبَهُمْ الله بالذُّلِّ، وَلَا تَشِيعُ الْفَاحِشَةُ فِى قَوْمٍ قَطُّ إِلَّا عَمَّهُمُ الله بالْبَلَاءِ. رواه ابن إسحاق في السيرة، قال: وحدثني الزهري، قال: حدثني أنس بن مالك، قال: لما بويع أبو بكر في السقيفة وكان الغد، جلس أبو بكر على المنبر، (ص: 718 ط. دار الكتب العلمية) وقال ابن كثير في البداية والنهاية (5/248 ط. دار الفكر): وهذا إسناد صحيح.
“যে জাতিই জিহাদ পরিত্যাগ করে আল্লাহ তায়ালা তাদের উপরই লাঞ্চনা চাপিয়ে দেন, আর যে জাতির মাঝেই অশ্লীলতা ছড়িয়ে পড়ে আল্লাহ তাদের (নেককার ও বদকার সবাইকেই) ব্যাপকভাবে শাস্তি দেন।” -সীরাতে ইবনে ইসহাক, পৃ: ৭১৮, ইবনে কাসীর রহিমাহুল্লাহ আলবিদায়া ওয়াননিহায়াতে (৫/২৪৮) এই হাদিসটির সনদকে সহিহ বলেছেন।
Comment