পশ্চিমা নৈতিক মূল্যবোধ
আল্লাহ সুবহানাহু তাআলা ফিতরাতান মানুষের মধ্যে কিছু নৈতিক মূল্যবোধ দিয়েছেন। যেমন সততা, বিশ্বস্ততার, ন্যায়পরায়ণতা, লজ্জাশীলতা ইত্যাদি। তারপর তিনি তার নবী-রাসূলদের এই সহজাত স্বভাব ও মূল্যবোধ অনুযায়ী জীবনব্যবস্থা দিয়ে প্রেরণ করেছেন, যাতে সমাজ প্রতিষ্ঠা করা সহজ হয়।
فَاَقِمۡ وَجۡہَکَ لِلدِّیۡنِ حَنِیۡفًا ؕ فِطۡرَتَ اللّٰہِ الَّتِیۡ فَطَرَ النَّاسَ عَلَیۡہَا ؕ لَا تَبۡدِیۡلَ لِخَلۡقِ اللّٰہِ ؕ ذٰلِکَ الدِّیۡنُ الۡقَیِّمُ ٭ۙ وَ لٰکِنَّ اَکۡثَرَ النَّاسِ لَا یَعۡلَمُوۡنَ ﴿٭ۙ۳۰﴾
অর্থঃ কাজেই আপনি একনিষ্ঠ হয়ে নিজ চেহারাকে দ্বীনে প্রতিষ্ঠিত রাখুন। আল্লাহর ফিতরাত (স্বাভাবিক রীতি বা দ্বীন ইসলাম), যার উপর (চলার যোগ্য করে) তিনি মানুষ সৃষ্টি করেছেন; আল্লাহর সৃষ্টির কোন পরিবর্তন নেই। এটাই প্রতিষ্ঠিত দ্বীন; কিন্তু অধিকাংশ মানুষ জানে না। [সূরা রূমঃ ৩০]
একজন ঈমানদার এ সকল নৈতিক মূল্যবোধগুলো মেনে চলার কারণ হচ্ছে এটা তার ঈমানের দাবী। এবং ইসলামের শিক্ষা তাকে এই সকল মূল্যবোধ মেনে চলতে প্ররোচিত করে এবং পরকালের পুরস্কারের প্রতিশ্রুতি দেয়।
অন্যদিকে ধর্মনিরপেক্ষতা এমন এক বিষাক্ত সমাজব্যবস্থা যা ব্যাক্তিগত জীবন ব্যতীত জীবনের অন্য সকল ক্ষেত্র থেকে ধর্মকে অপসারণ করে। ধর্মের গুরুত্বকে অস্বীকার করে এবং সমাজ পরিচালনার ক্ষেত্রে মানুষের সহজাত মূল্যবোধের পরিবর্তে সমাজে স্বৈরাচারী শাসন ব্যবস্থা, নাহয় গণতান্ত্রিক সংখ্যাগরিষ্ঠ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করতে চায়।
"اَرَءَیۡتَ مَنِ اتَّخَذَ اِلٰـہَہٗ ہَوٰىہُ ... "
অর্থঃ "আপনি কি তাকে দেখেছেন, যে তার প্রবৃত্তিকে ইলাহরূপে গ্ৰহণ করে? ..." [সূরা ফুরকানঃ ৪৩]
যেহেতু মানুষের ইচ্ছা-আকাঙ্ক্ষা প্রতিনিয়ত পরিবর্তনশীল তাই এই পরিবর্তনের ওপর ভিত্তি করে ধর্মনিরপেক্ষ সমাজে মূল্যবোধ ও নৈতিকতার পরিবর্তন হয়। অর্থাৎ আজকে যা অপরাধ, যে কাজের জন্য কঠোর শাস্তি প্রদান করা হচ্ছে আগামীকালকে হয়ত তা অনুমোদিত বা কিছু কিছু ক্ষেত্রে প্রশংসনীয় হতে পারে। আর কেউ যদি এই ব্যবস্থার প্রতি আপত্তি পোষণ করে তাহলে সে ধর্মান্ধ, গোড়া মৌলবাদী হিসেবে চিহ্নিত হবে।
وَ اِذَا دُعُوۡۤا اِلَی اللّٰہِ وَ رَسُوۡلِہٖ لِیَحۡکُمَ بَیۡنَہُمۡ اِذَا فَرِیۡقٌ مِّنۡہُمۡ مُّعۡرِضُوۡنَ ﴿۴۸﴾
অর্থঃ আর যখন তাদেরকে ডাকা হয় আল্লাহ্ ও তাঁর রাসূলের দিকে, তাদের মধ্যে বিচার-ফয়সালা করে দেয়ার জন্য, তখন তাদের একদল মুখ ফিরিয়ে নেয়। [সূরা আন-নূরঃ ৪৮]
সত্যের সাথে তাদের সম্পর্ক হচ্ছে শয়তানের সম্পর্কের মতো। যেমন, এক ঘটনার প্রেক্ষিতে শয়তান আবু হুরায়রা রাদিআল্লাহু তাআ'লা আনহু--কে ঘুমানোর আগে পূর্বে আয়াতুল কুরসি পড়ার পরামর্শ দিয়েছিল। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাই সাল্লাম এই কথা জানতে পেরে বলেছিলেন, "সে (শয়তান) তোমাকে সত্য বলেছে, যদিও সে একজন মিথ্যাবাদী।"
সমসাময়িক পশ্চিমা ধর্মনিরপেক্ষ সমাজ আরবদের জাহিলী সমাজের এক নিকৃষ্ট ও স্পষ্ট উদাহরণ। এই সমস্যার উৎস হচ্ছে সে দুটি মৌলিক নীতি যার উপর ভিত্তি করে ধর্মনিরপেক্ষ সমাজ গড়ে উঠেছে। প্রথমটি হচ্ছে, সংখ্যাগরিষ্ঠ নীতি - যা সমাজের ভালো-মন্দের মানদণ্ড হিসেবে কাজ করছে; আর দ্বিতীয়টি হচ্ছে, ব্যক্তিস্বাধীনতার নীতি। ভালোভাবে লক্ষ্য করলে আমরা দেখতে পাবো যে, এই দুইটি নীতি পরস্পর বিরোধী। আর এই দুটির মাঝে কেবল তখনই সমন্বয় করা সম্ভব অথবা এই দুটি নীতি থেকে তখনই পর্যাপ্ত উপকার পাওয়া সম্ভব যখন তৃতীয় কোন নীতির উপর ভিত্তি করে এই নীতিদ্বয়কে বিচার করা হবে।
ধর্মনিরপেক্ষতার প্রধান বৈশিষ্ট্য হচ্ছে ধর্মকে প্রত্যাখ্যান করা। কিন্তু ধর্মনিরপেক্ষতার পশ্চিমা সংস্করণটি আরো অনেক বেশি ভয়ঙ্কর। কারণ তারা সে শুধু ধর্মকে প্রত্যাখ্যান করে তা নয়; বরং তারা ভালো-মন্দ নির্ধারণের ক্ষেত্রে মানুষের সামগ্রিক মূল্যবোধকে অস্বীকার করে। বর্তমান সমাজে বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়য়ে ধর্মনিরপেক্ষতার মূলনীতি "ব্যাক্তি স্বাধীনতা ও সংখ্যাগরিষ্ঠতা"-র মধ্যে বৈপরীত্য ও দ্বন্দ্ব পরিলক্ষিত হচ্ছে।
উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, যারা সমকামিতার পক্ষে কথা বলছে বা সমকামীদের সব ক্ষেত্রে সমান অধিকার প্রদানের জন্য আন্দোলন করছে, তাদের তর্কের ভিত্তি হচ্ছে "ব্যক্তি স্বাধীনতার নীতি"। ঠিক একইভাবে, গর্ভপাতকে আইনি করার পক্ষে যুক্তি হচ্ছে "ব্যক্তিগত বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণে কেন বাধা দেওয়া হবে?" বা "আমার শরীরের উপর আমার অধিকার আছে" এই ধরনের ব্যক্তি স্বাধীনতা কেন্দ্রিক কথাসমূহ। আর যারা সমকামিতা ও গর্ভপাতের বৈধতার বিরুদ্ধে সোচ্চার তারা এই কুকর্মে বাধা সৃষ্টি করছেন সংখ্যাগরিষ্ঠ নীতির ভিত্তিতে। যেমন, জণমত তৈরির মাধ্যমে, আইন প্রণয়নের মাধ্যমে অথবা তাদের বিপক্ষে উত্থাপিত আইনগুলোর খারিজের মাধ্যমে।
ধর্মনিরপেক্ষ মতাবলম্বীদের মত আমরাও যদি মেনেনি, যেকোন মূল্যবোধের ভিত্তি হচ্ছে সংখ্যাগরিষ্ঠতা ও ব্যক্তি স্বাধীনতা। তাহলে আমাদের এটাও মেনে নিতে হবে যে সমাজ ও সময়ভেদে মূল্যবোধের পরিবর্তন হবে। কারণ প্রতিটি সমাজ ও সময়ের মানুষের রুচি, অভ্যাস, আকাঙ্ক্ষা এক নয়। অর্থাৎ ধর্ষণ বা শিশুদের যৌন নিপীড়ন আজকে আমাদের সমাজে নিষিদ্ধ ও গুরুতর অপরাধ হলেও অন্য কোন সমাজে বা অন্য কোন সময়ে ব্যক্তি স্বাধীনতা ও সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠতে পারে। তাই না?
কমপক্ষে যুক্তির ভিত্তিতে উপরোক্ত আলোচনাটি সঠিক। একজন ধর্মনিরপেক্ষবাদী এই ধরনের প্রশ্নের মুখোমুখি হলে বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়ে। কারণ তারা জানে এই সকল মন্দ কাজকে ঘৃণা করার ভিত্তি ব্যক্তি স্বাধীনতা বা সংখ্যাগরিষ্ঠতা নয়; বরং আসল কারণ হলো সেই নৈতিক মূল্যবোধের অবশিষ্টাংশ যে নৈতিক মূল্যবোধ বা ফিতরাত দিয়ে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা'আলা তাদেরকে দুনিয়ায় প্রেরণ করেছেন। এই নৈতিক মূল্যবোধ ভোগবাদ ও ধর্মনিরপেক্ষতার এত বিরোধিতার মুখে প্রবল ভাবে টিকে আছে।
ধর্মনিরপেক্ষ সমাজে মুল্যবোধের দুর্বল ভিত্তি তাদের যেকোনো মূল্যবোধকে (যা এতদিন তাদের প্রিয় ছিল) অন্য মূল্যবোধের দ্বারা পরিবর্তন করতে বাধ্য করে। এটি মূলত পশ্চিমাদের দুর্বল জাতি বা রাষ্ট্রের উপর আগ্রাসন চালানোর ও উপনিবেশ স্থাপনের পথ সুগম করে দেয় এবং নৈতিক সমর্থন প্রদান করে। তাদের এই নৈতিকতা বিবর্জিত কাজ করা থেকে বাধা দেওয়ার কেউ থাকেনা, কারণ তারা নিজেরা সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে না হয় ব্যক্তি স্বাধীনতা রক্ষার নামে প্রতিনিয়ত নতুন নতুন নৈতিকতা তৈরি করছে।
ঠিক এইভাবেই, একদিন একদল স্বার্থন্বেষী ব্যাক্তি ঘোষণা করল জাতীয়তাবাদ একটি সার্বভৌম রাষ্ট্রের জন্য অত্যান্ত গুরুত্বপূর্ণ। জাতীয়তাবাদের মধ্যে রাষ্ট্রের জনগণের জন্য রয়েছে প্রচুর সুবিধা। বিপুলসংখ্যক মানুষ না বুঝেই বা সহজভাবে বলা যায় তাদের ধোকায় পড়ে জাতীয়তাবাদ নীতির উপর বিশ্বাস স্থাপন করে। আর এইভাবে তাদের প্রস্তাবিত নীতি বিভিন্ন দেশের সরকারী নীতিতে পরিণত হয়, সংখ্যাগরিষ্ঠতার মানদন্ডের উপর ভিত্তি করে।
কিন্তু সময়ের পালাবদলে আমরা স্পষ্টভাবে দেখতে পারছি যে, ধর্মনিরপেক্ষতা, গণতন্ত্র বা জাতীয়তাবাদ যেই মতবাদে হোক না কেন কোনোটিই ব্যক্তি স্বাধীনতা বা সংখ্যাগরিষ্ঠতার উপর নির্ভর করে গড়ে উঠেনি। এই মতবাদগুলোর পিছনে রয়েছে পশ্চিমাদের স্বার্থ, তাদের দমন-পীড়ন নীতিকে বৈধতা প্রদানের চেষ্টা এবং সুবিধাভোগী একদল বিশ্বাসঘাতক।
ব্যক্তি স্বাধীনতা বা সংখ্যাগরিষ্ঠতা কোন সমাজের ভিত্তি যোগ্য না। কারণ নৈতিক মূল্যবোধ আপনার স্বাধীনতার পরিধি নির্ধারণ করে দিতে পারে; আপনার ব্যক্তি স্বাধীনতা বা ভোট প্রদানের স্বাধীনতা আপনার মূল্যবোধের মানদণ্ড হতে পারে না।
একটি করুণ অবস্থার পর্যালোচনা পশ্চিমা সমাজে ধর্মনিরপেক্ষতার ফাঁকা বুলির বাস্তবতা অনুধাবন আমাদের সাহায্য করবে। পশ্চিমা দেশগুলোতে ১৮ বছরের বেশি বয়সের কোনো সন্তানের কার্যক্রম বা চিন্তাধারায় হস্তক্ষেপ করার অধিকার মা-বাবার থাকে না। অর্থাৎ যে মা-বাবা এতদিন আদর-যত্ন এবং কষ্ট সহ্য করে সন্তানকে প্রতি পালন করেছে, ব্যক্তি স্বাধীনতা সেই সকল সন্তানকে তাদের বাবা-মা থেকে পৃথক হওয়া এবং তাদের অবহেলা করার সুযোগ তৈরি করে দিচ্ছে। আমেরিকা বিশেষ করে এই ব্যক্তি স্বাধীনতাটির চর্চা অনেক বেশি হয়। কিন্তু মূল সমস্যা ধরা পড়ল মাত্র এক প্রজন্মের পর যখন অবহেলিত এইসকল বাবা-মা আর্থিকভাবে দেউলিয়া হয়ে পড়লেন। মানসিকভাবে বিকারগ্রস্ত হতে শুরু করলেন আর নৈরাশ্যে ও আত্মহত্যার পথ বেছে নিতে আরম্ভ করলেন। তখন আমেরিকার সরকার সংখ্যাগরিষ্ঠতার নীতির ব্যবহার করে এই ব্যক্তি স্বাধীন এর বিপরীতে "বাবা-মার সুরক্ষা আইন" প্রণয়ন করতে বাধ্য হলো।
তাহলে ধর্মনিরপেক্ষ ব্যবস্থায় "স্বাধীন ব্যক্তি" ও "মুক্ত সমাজ"- এর ভিত্তি কি? সামান্যতম সন্দেহ ছাড়াই বলা যায়,
আল্লাহ সুবহানাহু তাআলা ফিতরাতান মানুষের মধ্যে কিছু নৈতিক মূল্যবোধ দিয়েছেন। যেমন সততা, বিশ্বস্ততার, ন্যায়পরায়ণতা, লজ্জাশীলতা ইত্যাদি। তারপর তিনি তার নবী-রাসূলদের এই সহজাত স্বভাব ও মূল্যবোধ অনুযায়ী জীবনব্যবস্থা দিয়ে প্রেরণ করেছেন, যাতে সমাজ প্রতিষ্ঠা করা সহজ হয়।
فَاَقِمۡ وَجۡہَکَ لِلدِّیۡنِ حَنِیۡفًا ؕ فِطۡرَتَ اللّٰہِ الَّتِیۡ فَطَرَ النَّاسَ عَلَیۡہَا ؕ لَا تَبۡدِیۡلَ لِخَلۡقِ اللّٰہِ ؕ ذٰلِکَ الدِّیۡنُ الۡقَیِّمُ ٭ۙ وَ لٰکِنَّ اَکۡثَرَ النَّاسِ لَا یَعۡلَمُوۡنَ ﴿٭ۙ۳۰﴾
অর্থঃ কাজেই আপনি একনিষ্ঠ হয়ে নিজ চেহারাকে দ্বীনে প্রতিষ্ঠিত রাখুন। আল্লাহর ফিতরাত (স্বাভাবিক রীতি বা দ্বীন ইসলাম), যার উপর (চলার যোগ্য করে) তিনি মানুষ সৃষ্টি করেছেন; আল্লাহর সৃষ্টির কোন পরিবর্তন নেই। এটাই প্রতিষ্ঠিত দ্বীন; কিন্তু অধিকাংশ মানুষ জানে না। [সূরা রূমঃ ৩০]
একজন ঈমানদার এ সকল নৈতিক মূল্যবোধগুলো মেনে চলার কারণ হচ্ছে এটা তার ঈমানের দাবী। এবং ইসলামের শিক্ষা তাকে এই সকল মূল্যবোধ মেনে চলতে প্ররোচিত করে এবং পরকালের পুরস্কারের প্রতিশ্রুতি দেয়।
অন্যদিকে ধর্মনিরপেক্ষতা এমন এক বিষাক্ত সমাজব্যবস্থা যা ব্যাক্তিগত জীবন ব্যতীত জীবনের অন্য সকল ক্ষেত্র থেকে ধর্মকে অপসারণ করে। ধর্মের গুরুত্বকে অস্বীকার করে এবং সমাজ পরিচালনার ক্ষেত্রে মানুষের সহজাত মূল্যবোধের পরিবর্তে সমাজে স্বৈরাচারী শাসন ব্যবস্থা, নাহয় গণতান্ত্রিক সংখ্যাগরিষ্ঠ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করতে চায়।
"اَرَءَیۡتَ مَنِ اتَّخَذَ اِلٰـہَہٗ ہَوٰىہُ ... "
অর্থঃ "আপনি কি তাকে দেখেছেন, যে তার প্রবৃত্তিকে ইলাহরূপে গ্ৰহণ করে? ..." [সূরা ফুরকানঃ ৪৩]
যেহেতু মানুষের ইচ্ছা-আকাঙ্ক্ষা প্রতিনিয়ত পরিবর্তনশীল তাই এই পরিবর্তনের ওপর ভিত্তি করে ধর্মনিরপেক্ষ সমাজে মূল্যবোধ ও নৈতিকতার পরিবর্তন হয়। অর্থাৎ আজকে যা অপরাধ, যে কাজের জন্য কঠোর শাস্তি প্রদান করা হচ্ছে আগামীকালকে হয়ত তা অনুমোদিত বা কিছু কিছু ক্ষেত্রে প্রশংসনীয় হতে পারে। আর কেউ যদি এই ব্যবস্থার প্রতি আপত্তি পোষণ করে তাহলে সে ধর্মান্ধ, গোড়া মৌলবাদী হিসেবে চিহ্নিত হবে।
وَ اِذَا دُعُوۡۤا اِلَی اللّٰہِ وَ رَسُوۡلِہٖ لِیَحۡکُمَ بَیۡنَہُمۡ اِذَا فَرِیۡقٌ مِّنۡہُمۡ مُّعۡرِضُوۡنَ ﴿۴۸﴾
অর্থঃ আর যখন তাদেরকে ডাকা হয় আল্লাহ্ ও তাঁর রাসূলের দিকে, তাদের মধ্যে বিচার-ফয়সালা করে দেয়ার জন্য, তখন তাদের একদল মুখ ফিরিয়ে নেয়। [সূরা আন-নূরঃ ৪৮]
সত্যের সাথে তাদের সম্পর্ক হচ্ছে শয়তানের সম্পর্কের মতো। যেমন, এক ঘটনার প্রেক্ষিতে শয়তান আবু হুরায়রা রাদিআল্লাহু তাআ'লা আনহু--কে ঘুমানোর আগে পূর্বে আয়াতুল কুরসি পড়ার পরামর্শ দিয়েছিল। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাই সাল্লাম এই কথা জানতে পেরে বলেছিলেন, "সে (শয়তান) তোমাকে সত্য বলেছে, যদিও সে একজন মিথ্যাবাদী।"
সমসাময়িক পশ্চিমা ধর্মনিরপেক্ষ সমাজ আরবদের জাহিলী সমাজের এক নিকৃষ্ট ও স্পষ্ট উদাহরণ। এই সমস্যার উৎস হচ্ছে সে দুটি মৌলিক নীতি যার উপর ভিত্তি করে ধর্মনিরপেক্ষ সমাজ গড়ে উঠেছে। প্রথমটি হচ্ছে, সংখ্যাগরিষ্ঠ নীতি - যা সমাজের ভালো-মন্দের মানদণ্ড হিসেবে কাজ করছে; আর দ্বিতীয়টি হচ্ছে, ব্যক্তিস্বাধীনতার নীতি। ভালোভাবে লক্ষ্য করলে আমরা দেখতে পাবো যে, এই দুইটি নীতি পরস্পর বিরোধী। আর এই দুটির মাঝে কেবল তখনই সমন্বয় করা সম্ভব অথবা এই দুটি নীতি থেকে তখনই পর্যাপ্ত উপকার পাওয়া সম্ভব যখন তৃতীয় কোন নীতির উপর ভিত্তি করে এই নীতিদ্বয়কে বিচার করা হবে।
ধর্মনিরপেক্ষতার প্রধান বৈশিষ্ট্য হচ্ছে ধর্মকে প্রত্যাখ্যান করা। কিন্তু ধর্মনিরপেক্ষতার পশ্চিমা সংস্করণটি আরো অনেক বেশি ভয়ঙ্কর। কারণ তারা সে শুধু ধর্মকে প্রত্যাখ্যান করে তা নয়; বরং তারা ভালো-মন্দ নির্ধারণের ক্ষেত্রে মানুষের সামগ্রিক মূল্যবোধকে অস্বীকার করে। বর্তমান সমাজে বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়য়ে ধর্মনিরপেক্ষতার মূলনীতি "ব্যাক্তি স্বাধীনতা ও সংখ্যাগরিষ্ঠতা"-র মধ্যে বৈপরীত্য ও দ্বন্দ্ব পরিলক্ষিত হচ্ছে।
উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, যারা সমকামিতার পক্ষে কথা বলছে বা সমকামীদের সব ক্ষেত্রে সমান অধিকার প্রদানের জন্য আন্দোলন করছে, তাদের তর্কের ভিত্তি হচ্ছে "ব্যক্তি স্বাধীনতার নীতি"। ঠিক একইভাবে, গর্ভপাতকে আইনি করার পক্ষে যুক্তি হচ্ছে "ব্যক্তিগত বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণে কেন বাধা দেওয়া হবে?" বা "আমার শরীরের উপর আমার অধিকার আছে" এই ধরনের ব্যক্তি স্বাধীনতা কেন্দ্রিক কথাসমূহ। আর যারা সমকামিতা ও গর্ভপাতের বৈধতার বিরুদ্ধে সোচ্চার তারা এই কুকর্মে বাধা সৃষ্টি করছেন সংখ্যাগরিষ্ঠ নীতির ভিত্তিতে। যেমন, জণমত তৈরির মাধ্যমে, আইন প্রণয়নের মাধ্যমে অথবা তাদের বিপক্ষে উত্থাপিত আইনগুলোর খারিজের মাধ্যমে।
ধর্মনিরপেক্ষ মতাবলম্বীদের মত আমরাও যদি মেনেনি, যেকোন মূল্যবোধের ভিত্তি হচ্ছে সংখ্যাগরিষ্ঠতা ও ব্যক্তি স্বাধীনতা। তাহলে আমাদের এটাও মেনে নিতে হবে যে সমাজ ও সময়ভেদে মূল্যবোধের পরিবর্তন হবে। কারণ প্রতিটি সমাজ ও সময়ের মানুষের রুচি, অভ্যাস, আকাঙ্ক্ষা এক নয়। অর্থাৎ ধর্ষণ বা শিশুদের যৌন নিপীড়ন আজকে আমাদের সমাজে নিষিদ্ধ ও গুরুতর অপরাধ হলেও অন্য কোন সমাজে বা অন্য কোন সময়ে ব্যক্তি স্বাধীনতা ও সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠতে পারে। তাই না?
কমপক্ষে যুক্তির ভিত্তিতে উপরোক্ত আলোচনাটি সঠিক। একজন ধর্মনিরপেক্ষবাদী এই ধরনের প্রশ্নের মুখোমুখি হলে বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়ে। কারণ তারা জানে এই সকল মন্দ কাজকে ঘৃণা করার ভিত্তি ব্যক্তি স্বাধীনতা বা সংখ্যাগরিষ্ঠতা নয়; বরং আসল কারণ হলো সেই নৈতিক মূল্যবোধের অবশিষ্টাংশ যে নৈতিক মূল্যবোধ বা ফিতরাত দিয়ে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা'আলা তাদেরকে দুনিয়ায় প্রেরণ করেছেন। এই নৈতিক মূল্যবোধ ভোগবাদ ও ধর্মনিরপেক্ষতার এত বিরোধিতার মুখে প্রবল ভাবে টিকে আছে।
ধর্মনিরপেক্ষ সমাজে মুল্যবোধের দুর্বল ভিত্তি তাদের যেকোনো মূল্যবোধকে (যা এতদিন তাদের প্রিয় ছিল) অন্য মূল্যবোধের দ্বারা পরিবর্তন করতে বাধ্য করে। এটি মূলত পশ্চিমাদের দুর্বল জাতি বা রাষ্ট্রের উপর আগ্রাসন চালানোর ও উপনিবেশ স্থাপনের পথ সুগম করে দেয় এবং নৈতিক সমর্থন প্রদান করে। তাদের এই নৈতিকতা বিবর্জিত কাজ করা থেকে বাধা দেওয়ার কেউ থাকেনা, কারণ তারা নিজেরা সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে না হয় ব্যক্তি স্বাধীনতা রক্ষার নামে প্রতিনিয়ত নতুন নতুন নৈতিকতা তৈরি করছে।
ঠিক এইভাবেই, একদিন একদল স্বার্থন্বেষী ব্যাক্তি ঘোষণা করল জাতীয়তাবাদ একটি সার্বভৌম রাষ্ট্রের জন্য অত্যান্ত গুরুত্বপূর্ণ। জাতীয়তাবাদের মধ্যে রাষ্ট্রের জনগণের জন্য রয়েছে প্রচুর সুবিধা। বিপুলসংখ্যক মানুষ না বুঝেই বা সহজভাবে বলা যায় তাদের ধোকায় পড়ে জাতীয়তাবাদ নীতির উপর বিশ্বাস স্থাপন করে। আর এইভাবে তাদের প্রস্তাবিত নীতি বিভিন্ন দেশের সরকারী নীতিতে পরিণত হয়, সংখ্যাগরিষ্ঠতার মানদন্ডের উপর ভিত্তি করে।
কিন্তু সময়ের পালাবদলে আমরা স্পষ্টভাবে দেখতে পারছি যে, ধর্মনিরপেক্ষতা, গণতন্ত্র বা জাতীয়তাবাদ যেই মতবাদে হোক না কেন কোনোটিই ব্যক্তি স্বাধীনতা বা সংখ্যাগরিষ্ঠতার উপর নির্ভর করে গড়ে উঠেনি। এই মতবাদগুলোর পিছনে রয়েছে পশ্চিমাদের স্বার্থ, তাদের দমন-পীড়ন নীতিকে বৈধতা প্রদানের চেষ্টা এবং সুবিধাভোগী একদল বিশ্বাসঘাতক।
ব্যক্তি স্বাধীনতা বা সংখ্যাগরিষ্ঠতা কোন সমাজের ভিত্তি যোগ্য না। কারণ নৈতিক মূল্যবোধ আপনার স্বাধীনতার পরিধি নির্ধারণ করে দিতে পারে; আপনার ব্যক্তি স্বাধীনতা বা ভোট প্রদানের স্বাধীনতা আপনার মূল্যবোধের মানদণ্ড হতে পারে না।
একটি করুণ অবস্থার পর্যালোচনা পশ্চিমা সমাজে ধর্মনিরপেক্ষতার ফাঁকা বুলির বাস্তবতা অনুধাবন আমাদের সাহায্য করবে। পশ্চিমা দেশগুলোতে ১৮ বছরের বেশি বয়সের কোনো সন্তানের কার্যক্রম বা চিন্তাধারায় হস্তক্ষেপ করার অধিকার মা-বাবার থাকে না। অর্থাৎ যে মা-বাবা এতদিন আদর-যত্ন এবং কষ্ট সহ্য করে সন্তানকে প্রতি পালন করেছে, ব্যক্তি স্বাধীনতা সেই সকল সন্তানকে তাদের বাবা-মা থেকে পৃথক হওয়া এবং তাদের অবহেলা করার সুযোগ তৈরি করে দিচ্ছে। আমেরিকা বিশেষ করে এই ব্যক্তি স্বাধীনতাটির চর্চা অনেক বেশি হয়। কিন্তু মূল সমস্যা ধরা পড়ল মাত্র এক প্রজন্মের পর যখন অবহেলিত এইসকল বাবা-মা আর্থিকভাবে দেউলিয়া হয়ে পড়লেন। মানসিকভাবে বিকারগ্রস্ত হতে শুরু করলেন আর নৈরাশ্যে ও আত্মহত্যার পথ বেছে নিতে আরম্ভ করলেন। তখন আমেরিকার সরকার সংখ্যাগরিষ্ঠতার নীতির ব্যবহার করে এই ব্যক্তি স্বাধীন এর বিপরীতে "বাবা-মার সুরক্ষা আইন" প্রণয়ন করতে বাধ্য হলো।
তাহলে ধর্মনিরপেক্ষ ব্যবস্থায় "স্বাধীন ব্যক্তি" ও "মুক্ত সমাজ"- এর ভিত্তি কি? সামান্যতম সন্দেহ ছাড়াই বলা যায়,
নাফসের সেসব চাহিদা বা আকাঙ্ক্ষা যা আকীদাগতভাবে রবের অবস্থান দখল করে নিয়েছে।
Comment