কিতাবুল্লাহ ও হুকুমত:
পারস্পরিক সঙ্গতি ও অসঙ্গতি
রাজনৈতিক বিপর্যয় এবং মুসলমানদের ইতিহাসে এর প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে কিছু পর্যবেক্ষণ ও ভাবনা
(প্রথম খণ্ড)
-শাইখ আইমান আয-যাওয়াহিরী হাফিযাহুল্লাহ
মূল প্রকাশনায়:
আস-সাহাব মিডিয়া (উপমহাদেশ)
সফর ১৪৪৩ হিজরী মোতাবেক সেপ্টেম্বর ২০২১ ঈসায়ী
পারস্পরিক সঙ্গতি ও অসঙ্গতি
রাজনৈতিক বিপর্যয় এবং মুসলমানদের ইতিহাসে এর প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে কিছু পর্যবেক্ষণ ও ভাবনা
(প্রথম খণ্ড)
-শাইখ আইমান আয-যাওয়াহিরী হাফিযাহুল্লাহ
মূল প্রকাশনায়:
আস-সাহাব মিডিয়া (উপমহাদেশ)
সফর ১৪৪৩ হিজরী মোতাবেক সেপ্টেম্বর ২০২১ ঈসায়ী
عن معاذ بن جبل -رضي الله عنه- قال: سمعت رسول الله -صلى الله عليه وسلم- يقول: "خذوا العطاء ما دام عطاءً، فإذا صار رشوة على الدين فلا تأخذوه. ولستم بتاركيه، يمنعكم الفقر والحاجة. ألا إن رحى الإسلام دائرة، فدوروا مع الكتاب حيث دار. ألا إن الكتاب والسلطان سيفترقان، فلا تفارقوا الكتاب. ألا إنه سيكون عليكم أمراء، يقضون لأنفسهم ما لا يقضون لكم، إن عصيتموهم قتلوكم، وإن أطعتموهم أضلوكم". قالوا: يا رسول الله كيف نصنع؟ قال: "كما صنع أصحاب عيسى بن مريم، نشروا بالمناشير، وحملوا على الخشب. موت في طاعة الله خير من حياة في معصية الله".
হযরত মুয়াজ ইবনে জাবাল রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি, “তোমরা উপহার গ্রহণ করো যতক্ষণ তা উপহার হিসেবে থাকে। যখন তা দ্বীনের বিরুদ্ধে ঘুষ বা উৎকোচ হয়ে যায়, তখন তোমরা তা নিয়ে আল্লাহর দ্বীনকে পরিত্যাগ করো না। (কিন্তু আমি বলে যাচ্ছি, আমার নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও) তোমরা এই উৎকোচ গ্রহণ পরিত্যাগ করবে না; কারণ অভাব ও দারিদ্র্য তা পরিত্যাগ করতে তোমাদেরকে বারণ করবে। সকলেই শুনে রাখো! ইসলামের চাকা চলমান থাকবে সর্বদাই। তাই কিতাবুল্লাহ তোমাদেরকে যা করতে বলে তোমরা সর্বদা তাই করবে। আমি সাবধান করে দিচ্ছি, কিতাবুল্লাহ ও হুকুমতের পথ কখনও ভিন্ন হয়ে যায়। তাই কোন অবস্থায় তোমরা কিতাবুল্লাহর পথ পরিত্যাগ করবে না। সাবধান! এমন কতক শাসক তোমাদের ক্ষমতা গ্রহণ করবে, যারা নিজেদের জন্য এমন সুযোগ-সুবিধার ব্যবস্থা করে নেবে, যা তারা তোমাদেরকে দেবে না। তোমরা যদি তাদের অবাধ্য হও, তবে তারা তোমাদেরকে হত্যা করবে। আর যদি তাদের আনুগত্য করো, তবে তারা তোমাদেরকে পথভ্রষ্ট করবে।”
লোকেরা জিজ্ঞেস করলঃ হে আল্লাহর রাসূল! তখন আমাদের করণীয় কি হবে? তখন তিনি ইরশাদ করেনঃ “তোমাদেরকে তাই করতে হবে যা ঈসা ইবনে মরিয়মের সঙ্গীরা করেছিলেন। করাত দিয়ে তাদের দেহ ব্যবচ্ছেদ করা হয়েছিল। তাদেরকে শূলে চড়ানো হয়েছিল। আল্লাহর আনুগত্যে মৃত্যুবরণ করা তাঁর অবাধ্য হয়ে বেঁচে থাকার চেয়ে উত্তম।[1]”
***
কবি আহমদ শাওকী হারানো খিলাফতকে সম্বোধন করে বলেন:
عودي إِلى ما كُنتِ في فَجرِ الهُدى عُمَرٌ يَسوسُكِ وَالعَتيقُ يَليكِ
إِنّي أُعيذُكِ أَن تُرَي جَبّارَةً كَالبابَوِيَّةِ في يَدَي رُدريكِ
إِنّي أَرى الشورى الَّتي اِعتَصَموا بِها هِيَ حَبلُ رَبِّكِ أَو زِمامُ نَبيكِ
“হেদায়েতের উদ্ভাসিত প্রভাত নিয়ে ফিরে আস হে খেলাফত!
ওমর নিয়ন্ত্রণ করবে তোমার রাজনীতি আর আতিক শাসন করবে তোমায়
জননিপীড়ক খেলাফত হিসেবে তোমাকে দেখতে চাই না আমি;
চাইনা একনায়কতন্ত্র ও স্বেচ্ছাচার শাসিত পোপতান্ত্রিক রাজ্যের মতো দেখতে তোমায়
পূর্বসূরিরা যেই শুরা ব্যবস্থা আঁকড়ে ধরে রাজ্য শাসন করেছিলেন,
সেটাকে তো আমি মনে করি আল্লাহর রজ্জু অথবা প্রিয় নবীর আঁচল।”
ওমর নিয়ন্ত্রণ করবে তোমার রাজনীতি আর আতিক শাসন করবে তোমায়
জননিপীড়ক খেলাফত হিসেবে তোমাকে দেখতে চাই না আমি;
চাইনা একনায়কতন্ত্র ও স্বেচ্ছাচার শাসিত পোপতান্ত্রিক রাজ্যের মতো দেখতে তোমায়
পূর্বসূরিরা যেই শুরা ব্যবস্থা আঁকড়ে ধরে রাজ্য শাসন করেছিলেন,
সেটাকে তো আমি মনে করি আল্লাহর রজ্জু অথবা প্রিয় নবীর আঁচল।”
নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রশংসা করে কবি বলেন:
بِكَ يا اِبنَ عَبدِ اللَهِ قامَت سَمحَةٌ بِالحَقِّ مِن مِلَلِ الهُدى غَرّاءُ
فَرَسَمتَ بَعدَكَ لِلعِبادِ حُكومَةً لا سوقَةٌ فيها وَلا أُمَراءُ
وَالدينُ يُسرٌ وَالخِلافَةُ بَيعَةٌ وَالأَمرُ شورى وَالحُقوقُ قَضاءُ
“হে আব্দুল্লাহ তনয়! আপনার উছিলায়
সুসভ্য হেদায়েতের অনুগামী সম্প্রদায় বিশ্বের বুকে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে
অতঃপর আপনি মানবজাতিকে এমন রাষ্ট্রব্যবস্থার নমুনা দেখালেন;
যেখানে আমিরে ফকিরে নেই কোন ভেদাভেদ
আল্লাহর দ্বীন হল সহজ আর খেলাফত হলো বাইয়াতের নাম;
সরকারব্যবস্থার খুঁটি হলো শুরা যেখানে মানুষের অধিকার নিশ্চিত করাই হবে প্রাধাণ্যপ্রাপ্ত।”
***
উৎসর্গ
❐সত্যান্বেষী সকলের জন্য আমি এই কিতাব উৎসর্গ করছি।
❐উৎসর্গ করছি দিশেহারা এমন সকল খ্রিষ্টান বন্ধুর প্রতি; যারা সত্য জানতে ইচ্ছুক।
❐আমার এই উপহার ধর্মনিরপেক্ষ সেই ব্যক্তিদের জন্য; যারা সত্যের পথে ফিরে আসার সৎ সাহস রাখেন, যারা সংকীর্ণতা ও অন্ধকারের বাঁধন মুক্ত হতে চান।
❐আমার এই কিতাবের সওয়াব উৎসর্গিত আমার সম্মানিত পিতা-মাতার জন্য, জীবিত ও শাহাদাতবরণকারী সকল মুসলমানের জন্য। (আল্লাহ তা‘আলা সকলকে রহমতের চাদরে আবৃত করুন!)
❐বিশেষত: ওমর আব্দুর রহমান, রেফায়ী তোহা, নাবিল আল মাগরিবী, আবুল খায়ের আলমাসরী, আবুল ফারাজ আলমাসরী, আবুল ফারাজ আল ইয়েমেনি, মারজান সালিম, হিশাম আশমাবী, ইমাদ আব্দুল হুমাইদ, ওমর রেফায়ী সুরূর সহ তাদের সকল শহীদ ভাইয়ের জন্য বিশেষভাবে এই হাদিয়া।
❐এছাড়াও আমি এই হাদিয়া নিবেদন করছি- আমার ভাই ও সতীর্থ রেফায়ী সুরূরকে, যিনি খ্রিস্টান মিশনারী বিরোধী কার্যক্রমের পুরোভাগে ছিলেন।
❐এই হাদিয়া আমি আরো নিবেদন করছি- আমীরুল মু’মিনীন মোল্লা মুহাম্মদ ওমর, মোল্লা আখতার মুহাম্মদ মানসুর, শাইখ জালাল উদ্দিন হাক্কানী সহ আফগানিস্তানে শাহাদাত বরণকারী তাঁদের সকল ভাইয়ের প্রতি।
❐এই উপহার হাতে আমি স্মরণ করছি- মুহাম্মদ জাহাবি, খালেদ আবুল আব্বাস, আবুল হাসান আল বালিদী, আবু ইয়াজ তিউনিসী, আবু মুসআব আব্দুল ওয়াদুদসহ ইসলামী মাগরিবের সকল শাহাদাতবরণকারী ভাইকে।
❐আমার স্মরণে আরও রয়েছেন- আবু বাসির আলউহায়শী, আবু হুরায়রা আসসানআনী, মুহাম্মদ সাঈদ আশশাহরানী সহ জাজিরাতুল আরবের শাহাদাতবরণকারী সকল ভাই।
❐এমনিভাবে আরও রয়েছেন- আবু আব্দুর রহমান আলকিনদী, আব্দুর রহমান এলবিএম, আবু ইয়াহিয়া আলহাউন, আবু ওমর খলিল, আবু দুজানা পাশা, আবু উবাইদা আল মাসরী, হাসান কুল, ফারুক আল কাতারী, কারী সুফিয়ান আল মাগরিবী, আবু উবাইদা আল মাকদিসী, আবু বাশির আল উর্দুনী, আবু আমর আলমাসরী, আব্দুল মালেক আল কুওয়াইতি, হামজা দারনাবী, তাজ আল-মক্কী, ফয়সাল নজদী, মাহাদী কুর্দি, রুবাইবী আহমদ (সালাহ্ আননাজ্জার), আবু মুহসিন, ইলিয়াস কাশ্মীরি, আহমদ ফারুক, কারী ইমরান, ডঃ আবু খালেদ, শাইখ ওমর আছেম, হোসাইন (আল ই'লাম) সহ খোরাসানের শাহাদাতবরণকারী সকল ভাই।
❐আরও রয়েছেন- মুহাম্মদ জুল ইয়াদাইন, আলি জাবাল সহ পূর্ব আফ্রিকায় রিবাতের আমলে নিয়োজিত ও শাহাদাত বরণকারী সকল ভাই।
❐আরও রয়েছেন- আবু ফিরাস আসসূরী, আবুল কাস্সাম, খাল্লাদ, আবু জালবীব সহ সিরিয়ায় শাহাদাত বরণকারী সকল ভাই।
❐সর্বোপরি আমি এ কাজের সওয়াব হাদিয়া করছি- সর্বত্র জিহাদের আমলে নিয়োজিত বন্ধুদেরকে, বিশেষত: তাদের এতিম সন্তান-সন্ততি এবং বিধবা স্ত্রীদেরকে। এই অবলা শিশু ও নারীদের পিতা ও স্বামীদেরকে আমেরিকা বন্দি করে রেখেছে। যুগের ফেরাউনরা বাগরাম, পাকিস্তান, জর্দান, মিশর, ইসলামী মাগরিব, পূর্ব ইউরোপ সহ বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে নিজেদের গুপ্ত কারাগারে তাদেরকে আটকে রেখেছে। এই কাফের গোষ্ঠী জুলুম-অত্যাচার দিয়ে স্বাধীনতা বন্দি করে রেখেছে, মানবাধিকারের নামে তারা মানব সভ্যতাকে বিশেষত: মুসলমানদেরকে দাস বানিয়ে রেখেছে, আন্তর্জাতিক আইনের নামে নিজেদের আগ্রাসন, হত্যা, লুণ্ঠন, ডাকাতি, প্রাকৃতিক জলবায়ুর নেতিবাচক পরিবর্তন ও পরিবেশ দূষণ মূলক কর্মকাণ্ড জিইয়ে রেখেছে। তারা হিরোশিমা, নাগাসাকি, ভিয়েতনাম, জার্মানির ড্রেসডেন, ফিলিস্তিনের গাজা, বাগদাদ, খোস্ত, কুন্দুজ ও ওয়াজিরিস্তান সহ বিশ্বের নানা স্থানে জনমানুষ ও নাগরিকদের ব্যাপক প্রাণ রক্ষা (!) করছে।
❐যাই হোক, সেই সঙ্গে আমি এ কাজের সওয়াব হাদিয়া করছি- নিজেদের কলম ও মিডিয়া শক্তি ব্যবহার করে জিহাদে অংশগ্রহণকারীদেরকে, যারা ইসলামী আকীদা-বিশ্বাসের সীমান্তে অতন্দ্র প্রহরীর দায়িত্ব পালন করছেন, বিশেষত: খ্রিস্টান মিশনারী, নাস্তিক্যবাদ ও ইসলামবিরোধী বিভিন্ন মতবাদের জোরদার মোকাবেলা করছেন। এমন মানুষগুলোর কাছ থেকে আমি অনেক কিছু শিখেছি। তাই আল্লাহ তা'আলা আমার পক্ষ থেকে এবং সকল মুসলমানের পক্ষ থেকে তাঁদেরকে উত্তম প্রতিদান দান করুন! আল্লাহ তা‘আলা তাঁদের মেহনতকে কবুল করুন!! তাঁদের জন্য উপকারী ইলম ও নেক আমলের সুযোগ আরো বৃদ্ধি করে দিন!!!
❐একইভাবে আমি এই কাজের সওয়াব হাদিয়া করছি- আমার কন্যাদেরকে, মুজাহিদ মুহাজির বন্দি ভাইদের কন্যাদেরকে, তাদের স্ত্রী পরিজন, এতিম সন্তান-সন্ততি ও বিধবাদেরকে, যারা সবর ও হিজরতের মাধ্যমে আল্লাহর কাছে প্রতিদানের আশা নিয়ে অপেক্ষা করছেন। আল্লাহ তা‘আলার কাছে কামনা করি, যেন তিনি এমন মা-বোন ও কন্যাদের তাকওয়া, খোদাভীতি, দুনিয়া-আখেরাতে উচ্চ মর্যাদা এবং আল্লাহর প্রতি তাঁদের সন্তুষ্টি আরো বৃদ্ধি করে দেন!
***
প্রাপ্তি স্বীকার
এ পর্যায়ে আমি সে সকল ভাইয়ের জন্য কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে চাই, যারা এই কিতাবটি সম্পন্ন করতে আমাকে বিভিন্ন দিক থেকে সাহায্য সহায়তা করেছেন। ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও আমি তাদের সকলের নাম উচ্চারণ করতে পারছি না। কারণ এতে তাদের ক্ষতির আশঙ্কা রয়েছে।
তবে কারো কারো কথা আমি বলব। তাদের মাঝে রয়েছেন ফজিলতুশ শাইখ আলফাদিল, যিনি আমার প্রয়োজনীয় কিতাবাদি, ভিডিও ফাইল সহ যেকোন ধরনের তথ্যসূত্র সংগ্রহে ব্যাপক সাহায্য করেছেন। আমি ভাইয়ের কাছে প্রয়োজনের কথা উল্লেখ করেছি, আর তিনি ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। প্রতিবারই তিনি আমার কাছে তাঁর এই গভীর আগ্রহ ব্যক্ত করেছেন যে, তিনি আমার জন্য সাধ্যের সবটুকু দিয়ে চেষ্টা করবেন। সেই সঙ্গে তিনি আমাকে একরকম জোর করেছেন, যেন যেকোনো প্রয়োজনের কথা আমি তাকে জানাই।
আমি কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করছি- আমার সম্মানিত পরিবারের সদস্যদেরকে। যারা এই কিতাব রচনার পেছনে যে দীর্ঘ সময় ব্যয় হয়েছে, পুরোটা সময় ধৈর্যের সঙ্গে আমার পাশে থেকেছেন, আমার সেবা-যত্ন করেছেন।
সেই সঙ্গে আমি আরো শুকরিয়া জ্ঞাপন করছি এবং আল্লাহ সুবহানাহুওয়া তা'আলার কাছে দু‘আও করছি- সে সকল ভাইয়ের জন্য, যাদের উত্তম সান্নিধ্যে আমি অনেক সময় কাটিয়েছি। এ জীবনে নানা সময়ে সঙ্গদানকারীদের মাঝে তারা ছিলেন সর্বশ্রেষ্ঠ। তারা নানারকম অস্থিতিশীল পরিস্থিতি-পরিবেশেও তাদের মাঝে আমার ব্যবহারিক জীবনের ছন্দকে যথাসম্ভব সহজ ও সাবলীল রাখতে চেষ্টা করেছেন। আল্লাহ তা‘আলা আমার পক্ষ থেকে তাঁদেরকে উত্তম বিনিময় দান করুন!
একইভাবে আমি এমন সকলের কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করছি এবং আল্লাহর কাছে উত্তম প্রতিদানের দু‘আও করছি, যাদের ইলমী রচনা পাঠ করে অথবা ভিডিও দেখে আমি উপকৃত হয়েছি। তারা নিজেদের কলম ও মিডিয়া শক্তি দ্বারা ইসলামী আকীদা-বিশ্বাসের সীমান্তে নির্ভীক প্রহরীর দায়িত্ব পালন করছেন। তারা তাদের চিন্তা ও গবেষণা লব্ধ তত্ত্ব জ্ঞানের মূল্যবান সম্ভার আমাদেরকে উপহার দিয়েছেন।
এমন প্রতিটি মানুষের জন্যই আমার কৃতজ্ঞতা ও দু‘আ। তাদের মাধ্যমে আমরা যেভাবে উপকৃত হয়েছি এবং জ্ঞানের ভুবনে যে সহায়তা লাভ করেছি, সেগুলোর উসিলায় আল্লাহ তা'আলা যেন তাঁদেরকে দুনিয়ায় বরকত দান করেন এবং এই কাজগুলোকে আখেরাতে পূণ্যসম্ভার হিসেবে কবুল করেন। (আমীন ইয়া রব্বাল আলামীন)
***
__________________________________________________ _____________________________________________
কিতাবুল্লাহ ও হুকুমত:
পারস্পরিক সঙ্গতি ও অসঙ্গতি-
রাজনৈতিক বিপর্যয় এবং মুসলমানদের ইতিহাসে এর প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে কিছু পর্যবেক্ষণ ও ভাবনা:
পারস্পরিক সঙ্গতি ও অসঙ্গতি-
রাজনৈতিক বিপর্যয় এবং মুসলমানদের ইতিহাসে এর প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে কিছু পর্যবেক্ষণ ও ভাবনা:
-ভূমিকা
-প্রথম ভাগ: ইসলামী শরীয়তের আলোকে রাজনৈতিক ব্যবস্থা প্রসঙ্গে কিছু মৌলিক নীতি
-দ্বিতীয় ভাগ: মুসলমানদের ইতিহাসে রাজনৈতিক বিপর্যয়ের পাঠ
-তৃতীয় ভাগঃ নব উত্থান
***
প্রথম খণ্ডের ভূমিকা
إن الحمد لله نحمده ونستعينه ونستهديه ونستغفره ونعوذ بالله من شرور أنفسنا ومن سيئات أعمالنا، من يهده الله فلا مضل له، ومن يضلل فلا هادي له. وأشهد أن لا إله إلا الله وحده لا شريك له، وأشهد أن محمدًا عبده ورسوله.
.
নিশ্চয়ই সকল প্রশংসা আল্লাহর জন্য। আমরা তাঁর গুণকীর্তন করছি, তাঁর কাছে সাহায্য, হেদায়েত ও ক্ষমা প্রার্থনা করছি, আমাদের প্রবৃত্তির অনিষ্ট থেকে এবং অন্যায় কাজ থেকে তাঁর কাছে আশ্রয় কামনা করছি। যাকে আল্লাহ সঠিক পথ দেখান তাকে কেউ বিভ্রান্ত করতে পারে না। আর যাকে তিনি পথভ্রষ্ট করেন, তার নেই কোন পথ প্রদর্শক।
আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, এক আল্লাহ ছাড়া আর কেউ এবাদতের উপযুক্ত নেই। তাঁর কোন শরীক নেই। আমি আরো সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর বান্দা ও রাসূল।
কুরআনে কারীমে এসেছে—
﴿يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُواْ اتَّقُواْ اللّهَ حَقَّ تُقَاتِهِ وَلاَ تَمُوتُنَّ إِلاَّ وَأَنتُم مُّسْلِمُونَ﴾[2]
অন্যত্র এসেছে—
﴿يَا أَيُّهَا النَّاسُ اتَّقُواْ رَبَّكُمُ الَّذِي خَلَقَكُم مِّن نَّفْسٍ وَاحِدَةٍ وَخَلَقَ مِنْهَا زَوْجَهَا وَبَثَّ مِنْهُمَا رِجَالاً كَثِيراً وَنِسَاء وَاتَّقُواْ اللّهَ الَّذِي تَسَاءلُونَ بِهِ وَالأَرْحَامَ إِنَّ اللّهَ كَانَ عَلَيْكُمْ رَقِيباً﴾[3]
আরো ইরশাদ হয়েছে—
﴿يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا اتَّقُوا اللَّهَ وَقُولُوا قَوْلاً سَدِيداً، يُصْلِحْ لَكُمْ أَعْمَالَكُمْ وَيَغْفِرْ لَكُمْ ذُنُوبَكُمْ وَمَن يُطِعْ اللَّهَ وَرَسُولَهُ فَقَدْ فَازَ فَوْزاً عَظِيماً﴾[4]
হামদ ও সালাতের পর...
এ পর্যায়ে আমি বক্ষ্যমাণ গ্রন্থটি রচনার প্রারম্ভিক মুহূর্তে রয়েছি। এই গ্রন্থটি যেন আল্লাহ তা‘আলা কবুল করেন এবং আমি সহ অন্য সকলের জন্য উপকারী গ্রন্থ হিসেবে প্রমাণিত করেন, সেই আশাবাদ নিবেদন করছি আল্লাহর দরবারে।
এই গ্রন্থে আমি আলোচনা করতে যাচ্ছি, ইসলামের ইতিহাসে রাজনৈতিক বিপর্যয়ের দরুন কত রকম দুর্যোগ-দুর্বিপাক, ফিতনা-ফাসাদ, বিশৃঙ্খলা ও অঘটন দেখা দিয়েছে— সে সম্পর্কে।
আমি দেখাতে চেষ্টা করব, ইসলামের ইতিহাসের প্রায় প্রথম দিক থেকেই যে রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলা তৈরি হয়েছে, তা কিভাবে বৃদ্ধি পেতে থেকেছে এবং আরও অধিক সংক্রমিত হয়েছে। আর এই পুরো সময়ে উম্মাহর কল্যাণ অভিমুখী, মুত্তাকী ও পুণ্যবান একটি অংশ কিভাবে এই বিশৃঙ্খলাকে মোকাবেলার ধারা জারি রেখেছে। অবশেষে কেমন করে আমরা লাঞ্ছনা-গঞ্জনা, পরাজয়-পতন, বিচ্ছিন্নতা ও পারস্পরিক বিভাগ-বিভাজনের এই সমস্যা জর্জরিত পর্যায়ে এসে ঠেকেছি।
এই যে বিপর্যয় সৃষ্টি হয়ে আসছে এবং সামনেও হতে থাকবে আর তার পাশাপাশি এগুলোর প্রতিরোধ প্রয়াসের যে ধারা অব্যাহত আছে এবং থাকবে, সবই আমাদের সত্য নবী মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ভবিষ্যৎবাণী।
এক হাদীসে তিনি এরশাদ করেন—
"لَتُنْقَضَنَّ عُرَى الإِسْلامِ، عُرْوَةً عُرْوَةً، فكُلَّمَا انْتَقَضَتْ عُرْوَةٌ، تَشَبَّثَ النَّاسُ بِالَّتِي تَلِيهَا، فَأَوَّلُهُنَّ نَقْضًا الْحُكْمُ، وَآخِرُهُنَّ الصَّلاةُ"[5]
“ইসলামের নীতি-বাঁধনগুলো একটি একটি করে খুলে যেতে থাকবে। যখনই কোনো একটি বাঁধন খুলে যাবে, তখন লোকেরা তারপরেরটি নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়বে। তন্মধ্যে সর্বপ্রথম যে নীতি উঠে যাবে তা হলো- ইসলামী শাসনব্যবস্থা আর সর্বশেষ হল সালাত”।
অপর হাদিসে নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন—
"تَكُونُ النُّبُوَّةُ فِيكُمْ مَا شَاءَ اللَّهُ أَنْ تَكُونَ، ثُمَّ يَرْفَعُهَا إِذَا شَاءَ أَنْ يَرْفَعَهَا، ثُمَّ تَكُونُ خِلَافَةٌ عَلَى مِنْهَاجِ النُّبُوَّةِ، فَتَكُونُ مَا شَاءَ اللَّهُ أَنْ تَكُونَ، ثُمَّ يَرْفَعُهَا إِذَا شَاءَ اللَّهُ أَنْ يَرْفَعَهَا، ثُمَّ تَكُونُ مُلْكًا عَاضًّا، فَيَكُونُ مَا شَاءَ اللَّهُ أَنْ يَكُونَ، ثُمَّ يَرْفَعُهَا إِذَا شَاءَ أَنْ يَرْفَعَهَا، ثُمَّ تَكُونُ مُلْكًا جَبْرِيَّا، فَتَكُونُ مَا شَاءَ اللَّهُ أَنْ تَكُونَ، ثُمَّ يَرْفَعُهَا إِذَا شَاءَ أَنْ يَرْفَعَهَا، ثُمَّ تَكُونُ خِلَافَةً عَلَى مِنْهَاجِ نُبُوَّةٍ"[6]
“তোমাদের মাঝে নবুয়াত থাকবে ততদিন যতদিন আল্লাহ তা'আলা চান। অতঃপর যখন তিনি তা তুলে নিতে চাইবেন, তখন তা তুলে নেবেন। অতঃপর নবুয়তের আদলে খেলাফতব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হবে। আল্লাহ তা‘আলা যতদিন চাইবেন ততদিন তা প্রতিষ্ঠিত থাকবে। অতঃপর যখন তিনি তুলে নিতে চাইবেন, তখন এই খেলাফতব্যবস্থা তুলে নেবেন। অতঃপর অত্যাচারী রাজাদের আগমন ঘটবে। আল্লাহ পাক স্বীয় ইচ্ছামত তাদেরকে বহাল রাখবেন। তারপর উঠিয়ে নিবেন। অতঃপর জবর দখলকারী শাসকদের যুগ শুরু হবে। আল্লাহ পাক স্বীয় ইচ্ছামত তাদেরকে বহাল রাখবেন। অতঃপর উঠিয়ে নেবেন। এরপরে নবুওয়াতের তরীকায় পুনরায় খেলাফত কায়েম হবে।” এই পর্যন্ত বলার পর আল্লাহ’র রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) চুপ হয়ে গেলেন।
***
এই গ্রন্থ রচনার আকাঙ্ক্ষা আমার অনেক পুরনো। যাকে বলে আরব বসন্তের বিপ্লব, তার আগে থেকেই। তখনই এই গ্রন্থ প্রণয়নের জন্য আমি নানা উপকরণ এবং আনুষঙ্গিক বিষয়াবলী সংগ্রহ করতে আরম্ভ করে দিয়েছিলাম। কিন্তু আল্লাহর ইচ্ছায় সেগুলো হারিয়ে যায়। তাই আবার নতুন করে সবকিছু শুরু করতে হয়।
গ্রন্থ প্রণয়নের আকাঙ্ক্ষার পেছনে যে জিনিসটি বড় ভূমিকা পালন করেছে, তা হলো- আমি আশা নিয়ে দেখছিলাম, জিহাদী আন্দোলনগুলো ধীরে ধীরে অগ্রসর হচ্ছে, ইসলামী বলয় ধীরে ধীরে সম্প্রসারিত হচ্ছে। এসব দেখে আনন্দের পাশাপাশি আমার ভয় হচ্ছিল, যেকোনো সময় দুর্বলতা ও ত্রুটি-বিচ্যুতির এমন বিভিন্ন উপাদান ইসলামী আন্দোলনের মাঝে সংক্রমিত হয়ে যেতে পারে, যা ইসলামের পুণ্যময় শাসনব্যবস্থাকে একটি স্বৈরাচারমূলক সাম্রাজ্যবাদী শক্তিতে পরিবর্তন করে ফেলবে। আর তখন অন্যায়-অত্যাচার, ফিতনা-ফাসাদ, দাঙ্গা-হাঙ্গামা, খুন-খারাবি ও সমাজ-রাষ্ট্র বিধ্বংসী কর্তৃত্বের এক কাল ইতিহাস রচিত হবে। এদিকে এ রাজনৈতিক বিপর্যয়ের মধ্য দিয়ে ইসলামী সভ্যতা ও আকিদা বিশ্বাস নেতিবাচকভাবে প্রভাবিত হবে।
তাই আমি নসিহত হিসেবে এবং দুর্বলতা ও ত্রুটি-বিচ্যুতির উপাদানগুলো বর্ণনা করার উদ্দেশ্যে একটি গ্রন্থ প্রণয়নের ইচ্ছা পোষণ করি। আমি আশা রেখেছি, প্রণীত গ্রন্থটি উম্মাহকে তার করণীয় বলে দেবে, চোখে আঙ্গুল দিয়ে মুসলিম উম্মাহকে দেখিয়ে দেবে, কোন সব কার্যকারণ ও উপাদানের ক্রিয়াশীলতায় নিকট অতীতে উম্মাহ পরাজিত হয়েছে এবং অদূর ভবিষ্যতে পরাজয়ের আশঙ্কা রয়েছে।
এই গ্রন্থ প্রণয়নের মাধ্যমে আমি উম্মাহর কাছে প্রশ্ন রেখেছি, কেবল শত্রুপক্ষের সক্রিয়তাই কি আমাদের পরাজয়ের কারণ? না মূল কারণগুলো আমাদের একান্ত ভেতরকার ও অভ্যন্তরীণ?? আমাদের জীবন-যাপন, আচার-আচরণ ও চিন্তা-চেতনার ক্ষেত্রেই পরাজয়ের মৌলিক উপাদান ও ভাইরাসগুলো সৃষ্টি ও সংক্রামিত হচ্ছে না তো?
আমি চেয়েছি আমার এই গ্রন্থ যেন উম্মাহকে তার হৃত গৌরব ও হারানো মর্যাদা পুনরুদ্ধারে সহায়তা করে। এর জন্য উম্মাহকে জানতে হবে, প্রথমবার কিভাবে সে এই মর্যাদা লাভ করেছে, কোন পথে এই গৌরব অর্জন করেছে আর যুগের আবর্তনে কোন সব কারণে সেগুলো হারিয়ে বসেছে?
আরব বসন্তের বৈপ্লবিক জাগরণের আগে-পরে জিহাদী জোয়ার যেভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছিল, সে সময় আমি লক্ষ্য করলাম, আমার আশঙ্কাগুলো সমকালীন ঘটনাপ্রবাহের মধ্য দিয়ে ফলতে আরম্ভ করেছে। বাহ্যিকভাবে পরিতুষ্ট হবার মত বিভিন্ন ঘটনাই বিশুদ্ধ পথকে বাতিল-মিশ্রিত ও বিকৃত করে দিচ্ছে। তখনই আমি নিশ্চিত হয়ে যাই, কেবল ঐতিহ্যের চেতনা ও সংবেদনশীলতার মাধ্যমে বিচ্যুতি ও পদস্খলন থেকে রক্ষা পাওয়া সম্ভব নয়। বরং বিশুদ্ধ ইলম চর্চা এবং তদনুযায়ী আমল করার মাধ্যমেই বিভ্রান্তি ও স্খলন থেকে রক্ষা লাভ করা সম্ভব।
সে সময় আমি দেখেছি, ইলম চর্চার সঙ্গে সম্বন্ধিত করা হয় এমন বিভিন্ন লোক যাদের কেউ কেউ নিজেদেরকে আলেম দাবি করে। আবার কাউকে কাউকে অন্যরা আলেম বলে পরিচয় দিয়ে থাকে; এমন মানুষগুলো খুবই সুচারুরূপে জনমানুষের সঙ্গে প্রতারণা করে তাদেরকে পথভ্রষ্ট করছে। আর এ অবস্থায় প্রকৃত ও বিশুদ্ধ ইলমের ধ্বনি এবং পূণ্যবান ওলামায়ে কেরামের কণ্ঠস্বর স্তব্ধ করে দেয়া হচ্ছে। তাদের ব্যাপারে গুজব ও প্রোপাগান্ডা ছড়ানো হচ্ছে। পরিস্থিতির চাপে কেউ কেউ লোক চক্ষুর অন্তরালে চলে যাচ্ছে।
আমি এবার উল্লেখ করতে চাই যে, শাইখ ওমর আব্দুর রহমান (রহিমাহুল্লাহ তা‘আলা) যখন এক ব্যক্তির কাছে অজ্ঞতার দরুন ওজর কবুল করার ব্যাপারে জিজ্ঞাসিত হন, তখন প্রশ্নকারী লোকটিকে তিনি বলেন— “হে ওজর-আপত্তির পেছনে পড়ে থাকা ব্যক্তি! অজ্ঞতা ও মূর্খতার মাধ্যমে আজ তো ফিতনা কিছুই হচ্ছে না বললেই চলে; ফিতনা যা হচ্ছে সবই তো ইলমের নামে। বস্তুত ইলমটাই আজ বিকৃত হয়ে গিয়েছে।”
আমি আরও দেখতে পাই, ইসলামের শত্রুরা একটা ব্যাপারে খুবই আগ্রহী। সেটার জন্য তারা প্রাণান্তকর প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখতে প্রস্তুত। সেটা বাস্তবায়ন করার জন্য তারা যে কোনো মূল্য পরিশোধ করতে রাজি। আর সেই ব্যাপারটা হচ্ছে, উম্মাহর মাঝে বিভ্রান্তি, পথভ্রষ্টতা, শতধা বিভক্তি, বিশুদ্ধ জ্ঞানের বিকৃতি ও ধোঁকা প্রতারণার মতো বিষয়গুলো ছড়িয়ে দেয়া। এতদুদ্দেশ্যে তারা বিপুল সম্পদ ব্যয় করে। প্রচুর অর্থ খরচ করে। তারা শত শত মাশাইখ ও ইসলামিক স্কলার তৈরি করে। তাদের জন্য মিডিয়ায় সুযোগ করে দেয়। আর দরবারী এসব লোক কুফরি আগ্রাসনের প্রতি আনুগত্য করাকে শরীয়তের নির্দেশনা বলে অভিহিত করে। একে তারা বৈধতা দেয়। এর প্রতি সমর্থন ব্যক্ত করে।
সেই সঙ্গে জুলুম-অত্যাচার, কুফুরি শক্তির আগ্রাসন ও বিজাতীয় সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে সত্যনিষ্ঠ প্রতিরোধ-যোদ্ধাদেরকে নানান কুৎসা ও অপবাদে জর্জরিত করে। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ের বিভিন্ন নিয়ম নীতি ও আইন কানুন যেগুলো বৈশ্বিক কুফরি সাম্রাজ্যবাদী শক্তির স্বার্থে রচিত হয়েছে; আরো বিশেষায়িত করে বললে— কুফরি সংঘগুলো কর্তৃক রচিত বিভিন্ন আন্তর্জাতিক নীতিমালা ও বিশ্ব মহলে স্বীকৃত বিষয়াদি— চাই সেগুলো যতই স্বল্প পরিসরে বাস্তবায়নযোগ্য হোক না কেন, বিশ্বের বুকে এসব নিয়ম কানুন অনুসরণের উদাহরণ খোঁজার জন্য মানচিত্রের উপর ম্যাগনিফাইং গ্লাস ও মাইক্রোস্কোপের সাহায্য নিতে হোক না কেন— সেগুলোকে শরীয়তে স্বীকৃত মূলনীতি ও ইসলাম কর্তৃক নির্দেশিত অবশ্যকরণীয় বিষয় প্রমাণ করতে দরবারী আলেম গোষ্ঠীটির এতোটুকু বুক কাঁপে না।
এই দরবারী আলেমরা পুণ্যবান, নেককার, মুত্তাকী— এমনকি মুসলমানদের সুলতান, আল্লাহর দ্বীনের সাহায্যকারী ইত্যাকার অভিধাগুলো জায়নবাদী, ধর্মনিরপেক্ষ সেক্যুলার কুফুরি বিশ্বের তাবেদার শাসকদের নামের সঙ্গে জুড়ে দিতে পারে অনায়াসেই। আর খেলাফত পুনরুদ্ধারের জন্য কেউ যদি চেষ্টা করে, তবে তাদেরকে মূর্খ, কপট, ধোঁকাবাজ, উগ্র ও উন্মাদ বলে আখ্যায়িত করে তারা।
এভাবেই আমেরিকা, পশ্চিমা বিশ্ব, রাশিয়া সহ বিশ্বের মোড়লগুলো পরোক্ষভাবে অথবা প্রত্যক্ষভাবে ইসলামী আন্দোলনের টুঁটি চেপে ধরে রাখতে পারে। তারা এর জন্য অর্থ ব্যয় করে এবং সফল হয়। মুসলিম নামধারী তাদের অনুচরদেরকে নিজেদের কাছে ডেকে এনে তাদের সঙ্গে শলা-পরামর্শ করে কুফুরি বিশ্ব তাদের সামরিক শিবিরকে জমজমাট রাখতে পারে।
আমি দেখতে পাই, বড় বড় পাগড়িধারী, সরকারি এনাম প্রাপ্ত, কিতাবের বোঝা বহনকারী এবং আল্লাহর দ্বীন ও নিজেদের স্বকীয়তার সওদাগর মানুষগুলোর জন্য বিভিন্ন সংঘ, প্রতিষ্ঠান ও সংস্থা তৈরি করা হচ্ছে। এই মানুষগুলো যেন তাগুত গোষ্ঠী ও মুরতাদ শাসকদের ছায়াতলে মুসলমানদের জন্য কিছু উপাসনালয়, গির্জা ও দেবালয় তৈরি করতে চাচ্ছে। সম্মানীত পাঠক! আমাদের বক্ষ্যমাণ গ্রন্থের এই খণ্ড পাঠ করলে দেখতে পাবেন, খ্রিস্টধর্ম বিকৃতির কারণ ও ইতিহাস কি ছিল? কিতাবে তুলে ধরা হয়েছে, গির্জা কেমন করে রোমক একনায়কতান্ত্রিক শাসনের অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। তো বর্তমানে দরবারী লোকগুলোর কার্যকলাপ যেন সেই ঐতিহাসিক চিত্রেরই সমকালীন রূপায়ণ।
আমি দেখতে পাই, ইসলামী আন্দোলনের দাবিদার বহু মানুষ বুঝে হোক না বুঝে হোক বিভিন্ন ইসলামিক মূল্যবোধ, মূল লক্ষ্য ও মৌলিক চেতনা কিভাবে বিকৃত করে দিচ্ছে। তারা ইসলামী আন্দোলনের সত্যিকারের সাহায্যকারী হবার পরিবর্তে ইসলামী আন্দোলনের পথে বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে। ইসলামের শক্তি হবার বদলে দুর্বলতার কারণ বলে প্রমাণিত হচ্ছে। কোথায় ইসলামী আন্দোলনকে তারা পরিশুদ্ধ করবে, উল্টো তারাই আন্দোলনকে সঠিক পথ থেকে বিচ্যুত করে দিচ্ছে। আর এভাবেই নিজেদের জাগতিক লোভ-লালসা, প্রবৃত্তির অনুসরণ ও নৈতিক দুর্বলতাগুলোকে ইসলামী আন্দোলনের নামে চালিয়ে দিচ্ছে।
আমি দেখতে পেলাম, নীতি-নৈতিকতার কি ভয়ানক অবক্ষয় ইসলামী আন্দোলন ও জিহাদী কার্যকলাপকে দূষিত ও কলুষিত করে দিচ্ছে। অধিকাংশ না হলেও অনেকেরই অবস্থা এমন যে, সততা, ন্যায়-নিষ্ঠা, বিশ্বস্ততা, অঙ্গীকার রক্ষা, একতা ও ঐক্যবদ্ধতার প্রতিশ্রুতি, শরীয়তের বিধি-নিষেধের প্রতি গুরুত্বারোপ, জনমানুষের সম্ভ্রম ও রক্তের অবমাননার ব্যাপারে হুঁশিয়ারি ও সর্তকতা ইত্যাকার ইসলামী আন্দোলনের জন্য অবশ্য পালনীয় বিষয়গুলোকে পশ্চাৎপদতা, প্রগতির পথে বাধা, বোকামি ও সরলতা এবং মেধা ও বুদ্ধির স্থবিরতা বলে বিবেচনা করছে।
পক্ষান্তরে মিথ্যা রটনা, অপবাদ আরোপ, ধোঁকা-প্রতারণা, কূটচাল ও চতুরতা, হালাল হারামের ব্যাপারে বেপরোয়া ভাব ও সীমালংঘন ইত্যাদি গর্বের বিষয় এবং প্রশংসনীয় গুণাবলী বলে পরিচিত হচ্ছে।
ক্ষমতা, কর্তৃত্ব ও গদি দখলের লড়াই এমনই এক সাধারণ প্রবণতা হয়ে দাঁড়িয়েছে, যার জন্য রক্তপাত, খুন-খারাবি, প্রতিশ্রুতি লংঘন, বিভেদ-বিভাজন, হিংসা-বিদ্বেষ চর্চা, মিথ্যা অপবাদ রটনা, গালাগাল নিন্দাবাদ সবই যেনো বৈধ ব্যাপার হয়ে গিয়েছে।
এসবের জন্য বিভিন্ন খোঁড়া যুক্তি জোড়াতালি দিয়ে উপস্থাপন করা হয়েছে, কারো কারো ব্যাপারে বলা হয়েছে খলিফা, কেউ কেউ অভিধা পেয়েছে মুসলিম সুলতান আবার কারো কারো ব্যাপারে বলা হয়েছে ক্ষমতা জবর দখলকারী মুসলিম শাসক। এখন ইসলামিক খলিফা হোক মুসলিম সুলতান হোক অথবা স্বৈরাচারী মুসলিম শাসক হোক, সকলের মাঝে একটা ব্যাপারে আশ্চর্যজনক সামঞ্জস্য রয়েছে আর তা হলো, ইসলামের শত্রুদের কর্তৃত্ব, প্রভাব ও প্রবল পরাক্রমের সামনে তারা নিতান্তই নিরুপায়।
ইনশা আল্লাহ, আমি বক্ষ্যমাণ গ্রন্থে আল্লাহর তৌফিকে জবরদখলকারী মুসলিম শাসকের হুকুম সম্পর্কে কিছুটা আলোকপাত করব। দেখাতে চেষ্টা করব ইসলামী আইন শাস্ত্রে কিভাবে প্রসঙ্গটি এল, আর এর প্রকৃত বাস্তবতা কি? আমি আল্লাহ তা‘আলার কাছে প্রার্থনা করি- যেন তিনি তাঁর পছন্দ মতো এ কাজটি সম্পন্ন করার তৌফিক দান করেন।
আমি দেখতে পেয়েছি যে, একতা ও জামাতবদ্ধ হাওয়াকে এক শ্রেণীর লোক মানুষের উপর প্রভাব বিস্তার ও স্বার্থ রক্ষার পথ হিসেবে ব্যবহার করছে। স্বার্থ হাসিল হয়ে গেলে তারাই আবার জামাতের বিরুদ্ধে যাবার দুঃসাহস দেখাচ্ছে অথবা প্রতারণা করছে। সৎ উদ্দেশ্যে লালিত একতা ও সংঘবদ্ধতা স্বৈরাচার ও একনায়কতন্ত্রের বেদীতে বলি হয়ে যাচ্ছে।
তাগুত গোষ্ঠীর লেজুড়বৃত্তিকে বলা হচ্ছে ইসলামী রাজনীতি। মৌলিক ইসলামী আকীদা-বিশ্বাসসমূহের বিরুদ্ধাচারণের প্রতিবাদকে বলা হচ্ছে উগ্রতা ও মৌলবাদ। ইসলামী শরীয়তের মৌলিক নীতিমালা লংঘন করাকে বলা হচ্ছে ইজতিহাদ ও ইসলামিক গবেষণা। আর মিথ্যা, প্রতারণা, চালবাজি ও কুটিলতাকে বলা হচ্ছে শুদ্ধির প্রচেষ্টা ও সংশোধনের প্রয়াস।
আমি দেখতে পাই, হাজ্জাজ বিন ইউসুফ, আবু মুসলিম খোরাসানী, বুশর ইবনে আবী আরতাতের অন্যায়-অত্যাচার ও অপরাধসমূহ নতুনভাবে চর্চিত হচ্ছে। দেখতে পাই বাইবার্স সুলতান সাইফুদ্দিন কুতুজকে হত্যা করে তাঁর প্রতি অঙ্গীকার ভঙ্গ ও বিশ্বাসঘাতকতা সত্ত্বেও ঐতিহাসিক বীর হিসেবে প্রশংসা পাচ্ছে।
আমি দেখতে পাই, যুব মহলে তর্ক-বিতর্ক, ঝগড়া-ফ্যাসাদ ও অপ্রয়োজনীয় বাকবিতণ্ডা ছড়িয়ে পড়ছে। বিশেষত: জেলের ভেতরে, ইব্রাহিম আল বদরীর জামাতে যুবকদের মাঝে এমনটা ঘটছে। ইলমি বিষয়ে সূক্ষ্ম তাত্ত্বিক কোন মাসআলা নিয়ে যদি প্রশ্ন উঠেছে, তবে তা নিয়ে বাদানুবাদ করতে গিয়ে অন্য আরেকটি মাসআলার ব্যাপারে বিতর্কের অবতারণা ঘটছে।
দুঃখজনক হলেও আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে, যে মানুষগুলোকে দেখেছি ধর্মীয় বিভিন্ন বিষয়ে খুবই কঠোর, তাদেরকে আরও দেখেছি, নিচু ব্যাপার, নিম্নস্তরের আলোচনা এবং এখানকার সেখানকার খবর নিয়ে অবান্তর আলাপচারিতার মাঝে ডুবে থাকছে। কাফেরদের সাংস্কৃতিক অঙ্গনের লোকদেরকে তারা প্রশংসার সঙ্গে উচ্চারণ করছে। তাদের সঙ্গে প্রেম ভালোবাসা বিনিময় করছে। অথচ যুদ্ধ ও যোদ্ধাদের বিরুদ্ধে কাফেরদের যৌথ হামলায় তাদের সাংস্কৃতিক অঙ্গনের তারকাদের অংশগ্রহণ এসব ইসলামপন্থী বেমালুম ভুলে যাচ্ছে। এসব দেখে আমি বুঝতে পেরেছি, তাদের ধর্মীয় কঠোরতা ইসলামিক মর্যাদাবোধ থেকে নয়, শরীয়তের প্রতি দায়িত্বশীলতা থেকে নয়; বরং এর মূল কারণ হলো তাদের স্বভাবগত রূঢ়তা ও অমার্জিত চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য।
আমি আরো দেখতে পাই, তাকফির তথা অন্যকে কাফের আখ্যায়িত করার ব্যাপারে, অন্যদেরকে ফাসেক, পাপিষ্ঠ, বিদআতপন্থী, বেদাতি বলে ঘোষণা দেয়ার ক্ষেত্রে কঠোরতায় লোকজন যেন রীতিমতো প্রতিযোগিতার মাঠে নেমে পড়েছে। এমন লোকদেরকে সর্বশ্রেষ্ঠ ও ধর্মীয় বিষয়ে অগ্রগামী মনে করা হচ্ছে, যারা এগুলোর ব্যাপারে কঠোরতায় অগ্রসর। অথচ বাস্তবে এগুলো হলো চারিত্রিক পদস্খলন, অন্যদেরকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করার মন্দ বৈশিষ্ট্য, আত্মম্ভরিতা ও দাম্ভিকতার উন্মাদনা এবং ইসলামী ফিকহের বিভিন্ন পরিভাষা সম্পর্কে বাড়াবাড়ি ও ধৃষ্টতা।
আমি লোকদের মাঝে আরও এক প্রকার তাকফীরের চর্চা দেখতে পাই, যার নাম হল স্বার্থ হাসিলের তাকফির। এই তাকফীরের মূল কথা হলো, যে লোককে ক্ষমতার ব্যাপারে প্রতিপক্ষ মনে করা হবে, তাকফিরকারী যাকে নিজের কর্তৃত্ব ও নেতৃত্বের বিরুদ্ধে হুমকি মনে করবে, নিজের শক্তি অর্জনের পথে যাকে বাধা মনে করবে অথবা অন্তত নিজের কোনো মতামতের বিরুদ্ধাচরণকারী মনে করবে, আপদ দূর করার উদ্দেশ্যে সরাসরি সে মানুষটাকে তাকফীর করে বসা।
কেউ যখন অন্যের কাছ থেকে মুক্তি পেতে চায়, তখন যে কোনো ছোটখাটো সংশয় বা আপত্তি এনে তাকে কাফের অথবা পাপিষ্ঠ ফাজের বলে আখ্যায়িত করে। এই তাকফীরের এমনই বৈশিষ্ট্য। আবার কখনও কখনও বাস্তবসম্মত ছোটখাটো আপত্তি করার মতো বিষয় না পেলে সরাসরি মিথ্যা রটনা ও অপবাদ আরোপের মাধ্যমে তার থেকে মুক্তি পেতে চেষ্টা করা হয়। এরাই আবার দু‘আর মধ্যে উঁচু গলায় বিভিন্ন বাক্য টান দিতে থাকে, চেতনা উদ্দীপক কবিতা আওড়াতে থাকে।
আমি আরো দেখতে পেলাম, মুসলমানদের যতো গোপন বিষয় রয়েছে, সবই খোলামেলাভাবে আলোচনা হচ্ছে। মুসলমানদের গোপনীয়তা যার তার কাছে উপস্থাপন করা হচ্ছে। এ যেন মিশরে প্রচলিত সেই প্রবাদের বাস্তব রূপায়ণ—“কিনতে না চাইলেও দেখা তো যায়”।
আরব বসন্তে জাতীয়তাবাদী অহংবোধের যে গর্জনকারী তুফান ছিল, তাগুতি শক্তির কৃপাদৃষ্টি লাভের প্রতিযোগিতায় তা মিলিয়ে যেতে দেখেছি। বড় বড় অপরাধী চক্র, ধর্ম নিরপেক্ষতাবাদী, ধর্মীয় বিধি-নিষেধ লঙ্ঘনকারী গোষ্ঠীর বাহবা পাবার জন্য জাতিগত চেতনার বেলুন ফুটো হয়ে যেতে দেখেছি।
আর জিহাদের আমল পালনের দাবিদার লোকদেরকে ক্রমে ক্রমে শাসকগোষ্ঠীর হাতের পুতুল, তোষামুদে ও চাটুকার হয়ে যেতে দেখেছি। দেখেছি যে, তারা কাফের সরকারের সেনাবাহিনীর পক্ষে ইতিবাচক ভূমিকা পালন করছে। শুধু তাই নয় বরং তাদের পতাকাতলে এসব আলেমরা যুদ্ধে অংশ নিচ্ছে। অপরদিকে যারা মুসলমানদের পুণ্যভূমিগুলো রক্ষার সৌভাগ্য অর্জনের দাবিদার, তারা ইসলামের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত থেকে মুসলমানদের হাতে নিহত লোকদেরকে পুণ্যভূমির শহীদ অভিধায় ভূষিত করছে।
এই সবকিছু যখন আমি আমার সামনে দেখতে পাই, তখন এই গ্রন্থ রচনার ইচ্ছা আমার আরো দৃঢ়মূল হয়ে যায়।
***
দুঃখজনক উপরোক্ত চিত্রগুলোর বিপরীতে আমি আরো দেখতে পাই, পৃথিবীর বুকে জিহাদ দিনদিন শক্তি লাভ করছে। মুসলিম উম্মাহ ধীরে ধীরে জাগ্রত হয়ে উঠছে। যুবসমাজ আল্লাহর সন্তুষ্টির পথে অগ্রসর হওয়ার জন্য আগ্রহী হচ্ছে। উম্মাহর হাজার হাজার সন্তানের মাঝে অস্ত্র ধারণ, তাগুতের প্রতি কুফরি, উম্মাহর ঐক্য ও মুসলিম ভ্রাতৃত্বের চেতনা, অভিন্ন মুসলিম রাষ্ট্রের ধারণার মতো আরো বহু ইতিবাচকতা তৈরি হচ্ছে। মুসলিম শক্তি ঐক্যবদ্ধ হচ্ছে। চেতনা উদ্দীপিত হচ্ছে। মনোবল বৃদ্ধি পাচ্ছে। মুসলিম বন্দিরা মুক্তিলাভ করছে। সাহায্য ও বিজয়ের ধারা আরম্ভ হচ্ছে। মুসলিম ভূমিগুলো আগ্রাসনমুক্ত হচ্ছে। ইসলামিক সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠা লাভ করছে। অপরাধী চক্র পিছু হটছে। তাদের কোলাবোরেটর গোষ্ঠী দিশেহারা হয়ে যাচ্ছে।
﴿وَاللَّهُ غَالِبٌ عَلَى أَمْرِهِ وَلَكِنَّ أَكْثَرَ النَّاسِ لَا يَعْلَمُونَ﴾.
অর্থঃ আল্লাহ নিজ কাজে প্রবল থাকেন, কিন্তু অধিকাংশ লোক তা জানে না।)
***
কিতাব লিখতে আরম্ভ করার পর মনে হল, সমস্যাগুলো একেবারে গোড়া থেকে আলোচনা করা প্রয়োজন। তাছাড়া সঠিক পথের নির্দেশনা লাভের জন্য ভুল পথ চিহ্নিত হয়ে থাকা প্রয়োজন বলে আমি মনে করি। কারণ হক-বাতিলের মাঝে যদি সুস্পষ্ট পার্থক্যরেখা না থাকে, তাহলে বিপথগামী হয়ে যাবার প্রবল আশঙ্কা থাকে। এ কারণেই আমি ধর্মনিরপেক্ষ ও জাতীয়তাবাদী রাষ্ট্রগুলোর অবৈধতা ও সমস্যা নিয়ে আলোচনা করা জরুরি বলে স্থির করি। সমকালীন বিশ্বে রাজনৈতিক ও সামাজিক বিপর্যয়ের সর্বাধিক কিংবা অন্তত একাধিক বিষাক্ত উপাদান সরবরাহ করছে এসব রাষ্ট্র। আর আন্তর্জাতিক মহল এসব রাষ্ট্রের প্রতি অনুগত থাকতে আমাদেরকে উপদেশ দিচ্ছে। আমি অনেক নবীন ও প্রবীণ আলেমকে দেখেছি, আন্তর্জাতিক এসব নিয়ম-কানুনকে তারা এতটা গুরুত্ব দিয়ে থাকে যে, তারা মনে করে এগুলোর প্রয়োজনীয়তা ও গভীরতা বোঝার ক্ষমতা মানব মস্তিষ্কের নেই। ইসলামী আন্দোলনের দাবিদার অনেকেও এমন চিন্তা দ্বারা প্রভাবিত। ইসলামী আন্দোলনের নামে যত রকমের চিন্তাধারা বা স্কুল অব থট রয়েছে, তন্মধ্যে বিরাট অংশ ধর্মনিরপেক্ষ জাতীয়তাবাদী রাষ্ট্র কর্তৃক নির্দেশিত চিন্তার সীমানা পার হতে অক্ষম।
আমি আরো দেখতে পাই, চিন্তা ক্ষেত্রের এই দৈন্য নিছক ভ্রান্ত ধ্যান-ধারণার কিছু অপমিশ্রণ নয়, বরং তা বাস্তব আচরণে প্রভাবক স্বয়ংসম্পূর্ণ একটা সমস্যা। অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় যে, ইসলামী আন্দোলনের দাবীদার অধিকাংশ লোক পশ্চিমা ধ্যান-ধারণা ও দৃষ্টিভঙ্গির প্রশ্নে অত্যন্ত পরাজিত মানসিকতা পোষণ করে।
এই কারণগুলো সামনে রেখে আমি এসব জাতিরাষ্ট্রের শেকড় অনুসন্ধান দিয়ে আরম্ভ করার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করি। যখন আমি এগুলোর বাস্তবতা তুলে ধরতে পারবো যে, কিভাবে এগুলো তৈরি হয়েছে এবং অস্তিত্বে এসেছে, তখন আমি ইতিহাসের বাঁকে বাঁকে মুসলমানদের উপর আপতিত বিপর্যয়ের বয়ান সামনে আনবো। আর তারপর অভীষ্ট লক্ষ্য ও কাঙ্খিত সমাধান সুস্পষ্টভাবে বর্ণনা করার মাধ্যমে আমি আলোচনা শেষ করব।
অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় যে, অধিকাংশ সময় বলতে গেলে ইচ্ছাকৃতভাবেই বিশুদ্ধ ইসলামী মানহাজের সঙ্গে ত্রুটিযুক্ত পন্থাসমূহকে মিলিয়ে ফেলা হয়।
তারচেয়ে বড় আফসোসের বিষয় হচ্ছে, যারা এই কাজগুলো করে তাদের মাঝে অনেকেই হয় নিজেরা ইসলামী আন্দোলনের দাবিদার, অথবা তাদের কিছু কিছু ভক্ত-অনুরাগী তাদেরকে ইসলামী আন্দোলনের দিকে সম্বন্ধিত করে থাকে।
অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তারা এই কাজটা করে থাকে ইচ্ছাকৃতভাবে। আর প্রায়ই এই ইচ্ছাটা তারা করে থাকে ব্যক্তিস্বার্থ চরিতার্থ করার উদ্দেশ্যে।
আবার কেউ কেউ এমন রয়েছে; যাদের এই কাজে অংশগ্রহণের পেছনে যে কারণ সক্রিয় থাকে, তা হলো- তাদের নিজেদের চর্চিত বিভিন্ন ভ্রান্ত দৃষ্টিভঙ্গি অথবা অন্যদের সরবরাহকৃত বিভিন্ন ভুল চিন্তা-ভাবনা; যা তারা অনুসরণ করে থাকে, কিংবা বহু মানুষের দেখাদেখি কোন ভুল চিন্তার পুনরাবৃত্তি।
এই মানুষগুলোর মাঝে কেউ কেউ এমন রয়েছে, যারা এ ধরনের কিছু ভুল চিন্তার আবহে বেড়ে উঠেছে। অবশেষে তারা নিজেদের সেই পরিবেশ ধরে রেখেছে, আর দীর্ঘ সময় অতিক্রান্ত হবার ফলে সেই চিন্তা ও দৃষ্টিভঙ্গি তাদের কাছে সর্বসম্মত বলে মনে হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে যা আপত্তিকর, সেটাই তাদের কাছে সর্বজনস্বীকৃত বলে পরিচিতি লাভ করেছে।
এ কারণে আমার ভঙ্গুর প্রচেষ্টা ও স্বল্প ইলম সত্ত্বেও হক ও বাতিলের মাঝে একটি পার্থক্য রেখা অংকন করাকে শুধু উপকারীই নয় বরং প্রয়োজনীয় বলে মনে হয়েছে। দৃষ্টিভঙ্গির মাঝে ভুল ও সঠিকের মধ্যকার এই পার্থক্যরেখা শাসনব্যবস্থায় শুদ্ধি পরিচালনা, রাজনৈতিক বিপর্যয় প্রতিরোধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে বলে আমি আশাবাদী। মুসলিম ইতিহাসের যুগে যুগে সংক্রমিত হয়ে আসা এবং অদ্যবধি ছড়াতে থাকা রাজনৈতিক এসব ভাইরাস প্রতিরোধ করার জন্য এ কাজটি অতি গুরুত্বপূর্ণ বলে আমি মনে করি।
তবে আমি একথা ভালো করেই জানি এবং দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, সব না হলেও এই জাতীয় বিভ্রান্তিকর দৃষ্টিভঙ্গির অধিকাংশই এবং সবাই না হলেও এসব দৃষ্টিভঙ্গি লালনকারী অধিকাংশ লোকই দলিল-প্রমাণের ভিত্তিতে, সত্যানুসন্ধানের অনুভূতি থেকে এবং প্রকৃত বাস্তবতা উদ্ঘাটনের আকুলতা থেকে এসব লালন করে না। তারা তো এগুলো করে থাকে প্রবৃত্তির অনুসরণ ও ব্যক্তিস্বার্থ চরিতার্থ করার হীন উদ্দেশ্যে। তাদের বদভ্যাস ও নৈতিকতার অভাব এগুলোর জন্য দায়ী।
***
এ পর্যায়ে সংশোধনমূলক কর্মকাণ্ড, আল্লাহমুখী ব্যক্তিত্ব তৈরীর প্রচেষ্টা ইত্যাদির গুরুত্ব প্রতীয়মান হয়ে ওঠে। এর মাধ্যমে একদল আল্লাহ ওয়ালা সত্যের জন্য সংগ্রাম করবে, মিথ্যার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ দাঁড় করাবে, এসবের জন্য আল্লাহর সন্তুষ্টি কামনা করবে। আর প্রিয় রবের সন্তুষ্টি কামনা করাই হবে তাদের পরম লক্ষ্য। তাই যে কাজের জন্যই তারা আদিষ্ট হোক না কেন, রবের পথে যত বড় ত্যাগ তাদেরকে সহ্য করতে হোক না কেন, তারা কিছুতেই পিছু হটবে না।
কি কারণে সংশোধনমূলক একটি কর্মযজ্ঞ প্রয়োজন তা বোঝানোর জন্য একটি উদাহরণ পেশ করি। আপনি যদি কোনো স্বৈরাচারী শাসক অথবা যদি একনায়কতান্ত্রিক কোন রাজার কাছে যান, যার বৈশিষ্ট্য হচ্ছে নিজের রাজ্য বিস্তৃত করার আকাঙ্ক্ষা, নিজের লাভ বৃদ্ধির প্রচেষ্টা, বিলাসিতায় গা ভাসিয়ে দেওয়ার প্রবণতা, নিজের সন্তানদের উত্তরাধিকার নিশ্চিতকরণ; এমন রাজা বা শাসকের কাছে গিয়ে যদি আপনি তার পথ ও পন্থা, তার প্রচলিত ব্যবস্থা ও চালচলন ভুল হবার ব্যাপারে বিভিন্ন দলিল-প্রমাণ হাজির করেন, তবে আপনি বলুন, সত্য তার কাছে স্পষ্ট হয়ে যাবার পরেও কি সে আপনার ডাকে সাড়া দেবে?
এমনিভাবে যদি আপনি এমন কোন আলেমের কাছে যান, যে নিজের দ্বীন ও দুনিয়া বিক্রি করে দিয়েছে; অথবা যদি কোন বিচারকের কাছে যান, যাকে জালেম সরকার তার মান ও বৈধতা রক্ষার জন্য নিযুক্ত করেছে; অথবা যদি কোন জল্লাদের কাছে যান, যাকে অর্থ-সম্পদ ও মান-মর্যাদার লোভ দেখিয়ে প্রভুরা তাদের প্রতিপক্ষ ও শত্রুদের পেছনে কুকুরের মত লেলিয়ে দিয়েছে; অথবা যদি কোন সাংবাদিক বা লেখকের কাছে যান, যে সততা, নিষ্ঠা ও নিরপেক্ষতার দাবিদার হয়ে তার উল্টোটা করে যাচ্ছে, তবে কি এ মানুষগুলোর সামনে কেবল সত্য সুস্পষ্টভাবে তুলে ধরলেই তারা আপনার ডাকে সাড়া দিয়ে দেবে?
আমাদের সত্য উপস্থাপনে তাদের প্রতিক্রিয়া থেকে দৃষ্টি এড়িয়ে সর্বাবস্থায় আমাদের জন্য আবশ্যক হলো- সত্যকে স্পষ্ট করা, মিথ্যার মুখোশ উন্মোচন করা, বিভ্রান্তদেরকে সঠিক পথের নির্দেশনা দেওয়া, দাওয়াত দিয়ে পরবর্তীতে তাদের অজুহাত দেখানোর পথ বন্ধ করা এবং তাদের ভিন্ন অন্যদেরকে সতর্ক ও হুঁশিয়ার করা।
কিন্তু এ প্রসঙ্গটি এখানে আমার আনার উদ্দেশ্য হলো এ কথা বোঝানো, কেবল সত্য বর্ণনা এবং মিথ্যাকে মিথ্যা বলে প্রতিপন্ন করার মাধ্যমেই সমাধান আসবে না; বরং আল্লাহর একান্ত অনুগত হওয়া, তাঁর ক্ষমা লাভের ব্যাপারে আশাবাদী হওয়া, তাঁর ক্রোধের ব্যাপারে ভীতসন্ত্রস্ত হওয়া এবং তাঁর এবাদতের প্রতি মনোনিবেশের আন্তরিক আকুলতা জাগ্রত করার মধ্য দিয়ে আল্লাহর নির্দেশনার আলোকে আত্মিক পরিশুদ্ধি নিশ্চিত করলে তবেই কাঙ্খিত সমাধানের বাস্তবায়ন আমরা আশা করতে পারি।
আনফাল (যুদ্ধক্ষেত্র থেকে লব্ধ গনিমতের প্রকার বিশেষ) মাসআলার প্রশ্নে মু’মিনদেরকে সঠিক পথের নির্দেশনা দিয়ে আল্লাহ সুবহানাহুওয়া তা‘আলা ইরশাদ করেন—
﴿يَسْأَلُونَكَ عَنِ الْأَنْفَالِ قُلِ الْأَنْفَالُ لِلَّهِ وَالرَّسُولِ فَاتَّقُوا اللَّهَ وَأَصْلِحُوا ذَاتَ بَيْنِكُمْ وَأَطِيعُوا اللَّهَ وَرَسُولَهُ إِنْ كُنْتُمْ مُؤْمِنِينَ (1) إِنَّمَا الْمُؤْمِنُونَ الَّذِينَ إِذَا ذُكِرَ اللَّهُ وَجِلَتْ قُلُوبُهُمْ وَإِذَا تُلِيَتْ عَلَيْهِمْ آيَاتُهُ زَادَتْهُمْ إِيمَانًا وَعَلَى رَبِّهِمْ يَتَوَكَّلُونَ (2) الَّذِينَ يُقِيمُونَ الصَّلَاةَ وَمِمَّا رَزَقْنَاهُمْ يُنْفِقُونَ (3) أُولَئِكَ هُمُ الْمُؤْمِنُونَ حَقًّا لَهُمْ دَرَجَاتٌ عِنْدَ رَبِّهِمْ وَمَغْفِرَةٌ وَرِزْقٌ كَرِيمٌ﴾[7]
হজের কার্যাবলী ইসলামের এমন কিছু নিদর্শন, যা বাস্তব আচার ও প্রথাগত তথা অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের দ্বারা আমলযোগ্য ও চর্চিত। এগুলোর প্রশংসা করে আল্লাহ সুবহানাহুওয়া তা‘আলা এরশাদ করেন—
﴿ذَلِكَ وَمَنْ يُعَظِّمْ شَعَائِرَ اللَّهِ فَإِنَّهَا مِنْ تَقْوَى الْقُلُوبِ (32) لَكُمْ فِيهَا مَنَافِعُ إِلَى أَجَلٍ مُسَمًّى ثُمَّ مَحِلُّهَا إِلَى الْبَيْتِ الْعَتِيقِ (33) وَلِكُلِّ أُمَّةٍ جَعَلْنَا مَنْسَكًا لِيَذْكُرُوا اسْمَ اللَّهِ عَلَى مَا رَزَقَهُمْ مِنْ بَهِيمَةِ الْأَنْعَامِ فَإِلَهُكُمْ إِلَهٌ وَاحِدٌ فَلَهُ أَسْلِمُوا وَبَشِّرِ الْمُخْبِتِينَ (34) الَّذِينَ إِذَا ذُكِرَ اللَّهُ وَجِلَتْ قُلُوبُهُمْ وَالصَّابِرِينَ عَلَى مَا أَصَابَهُمْ وَالْمُقِيمِي الصَّلَاةِ وَمِمَّا رَزَقْنَاهُمْ يُنْفِقُونَ﴾[8]
এই যে কিছু মানুষের অন্তর তাদের রবের স্মরণে ভীতসন্ত্রস্ত বিগলিত হয়ে পড়ছে, এরাই মূলত ওই সমস্ত লোক যাদের ব্যাপারে আল্লাহ সুবহানাহুওয়া তা‘আলা এরশাদ করেছেন—
﴿ الَّذِينَ إِنْ مَكَّنَّاهُمْ فِي الْأَرْضِ أَقَامُوا الصَّلَاةَ وَآتَوُا الزَّكَاةَ وَأَمَرُوا بِالْمَعْرُوفِ وَنَهَوْا عَنِ الْمُنْكَرِ وَلِلَّهِ عَاقِبَةُ الْأُمُورِ﴾[9]
ব্যক্তি পর্যায়ে, পারিবারিক, সামাজিক, রাষ্ট্রীয় ও উম্মাহর আন্তর্জাতিক পর্যায়ে এমন ঈমানী তরবিয়ত ও প্রশিক্ষণের বিকল্প নেই। এখন এ কাজ ব্যক্তি পর্যায়ে দাওয়াত দেওয়ার মাধ্যমে হোক অথবা সামাজিকভাবে দাওয়াত প্রচার করে হোক। কিন্তু মনে রাখতে হবে, এই দাওয়াতের পক্ষে একটি শক্ত অবস্থান তৈরি হতেই হবে।
এখানে আমি অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ ও উম্মাহর আন্তর্জাতিক মহলে একটি ঈমানী শুদ্ধি পরিচালনা ও সংশোধনী প্রক্রিয়ার মাধ্যমে আল্লাহওয়ালা ব্যক্তি গঠন ও সমাজ গঠনের কথা উল্লেখ করব। কারণ সব না হলেও আমাদের অধিকাংশ সমস্যাই দলিল-প্রমাণ ও তথ্যাদি সঠিক হওয়া না-হওয়া নিয়ে নয়; বরং বাস্তবে আমরা যা দেখতে পাচ্ছি তা আমাদের নৈতিক পদস্খলন, নীতি নৈতিকতার অবক্ষয় এবং চারিত্রিক অধঃপতনের ফলাফল মাত্র।
নৈতিকতার বিপর্যয় দিয়ে আরম্ভ হওয়ার পর ধর্মীয় বিষয়ের বিকৃতি ও গোঁজামিলগুলোকে বিভিন্ন ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ, তাবিল-তাফসীর, নানা রকম অজুহাত ও সংশয়-সন্দেহ এমনকি বিভিন্ন অপবাদ ও মিথ্যা রটনার মাধ্যমে আচ্ছাদিত করা হয়।
এই ঈমানী অনুশীলন ও প্রশিক্ষণের অনুপস্থিতি বলি, দুর্বলতা বলি অথবা অপর্যাপ্ততা বলি, এটাই রাষ্ট্র শক্তির সামনে নির্ভীক চিত্তে আমর বিল মা'রূফ ও নাহি আনিল মুনকারের দায়িত্ব পালনের চেতনা হারাবার পেছনে, জাগতিক বিভিন্ন স্বার্থ হাসিলের প্রতিযোগিতায়, দলান্ধতা, দলাদলি ও সংকীর্ণ মানসিকতার জন্য এবং অভ্যন্তরীণ ও বহিরাগত উৎস থেকে বৈষয়িক স্বার্থ চরিতার্থ করার মত বিচ্যুতিগুলোর পেছনে প্রধান দায়ী।
কারো কারো মতে তো শরীয়ত কর্তৃক নির্দেশিত বিধানাবলী তথা বিধি-নিষেধ দুই প্রকারের: এক প্রকার হলো- গরীব অসহায় ও সমাজের তৃতীয় শ্রেণীর লোকদের জন্য। আরেক প্রকার হলো- ধনিক শ্রেণী, সমাজের প্রতিষ্ঠিত ব্যক্তিবর্গ ও নেতা গোছের লোকদের জন্য। যদিও তাদের সমস্ত শক্তিমত্তা, নেতৃত্ব ও কর্তৃত্ব শিকড়হীন অস্থায়ী ও কৃত্রিম কিংবা বহির্শক্তির সমর্থন ও পৃষ্ঠপোষকতায় সাময়িক জাঁকজমক মাত্র।
এই প্রকারভেদের পর প্রথম শ্রেণীর লোকদেরকে যে কোনো মূল্যে নিষ্ঠাবান সততার অধিকারী ও নীতিবাদী হতে হবে। আর দ্বিতীয় শ্রেণীর লোকেরা, যাকে বলে বৃহৎ স্বার্থ রক্ষা ও বিশেষ কল্যাণ, সেসবকে সামনে রেখেই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করার বৈধতা পেয়ে যায়। বস্তুত সেগুলো তাদের লোভ-লালসা এবং স্বার্থ হাসিলের ফন্দি মাত্র।
মুসলমানদের রাজনৈতিক বিপর্যয়ের ইতিহাসে এমন চিত্র বারবার দেখা গেছে। যখন অন্তরসমূহ ঈমানের শক্তিতে বলীয়ান ছিল, কথা ও কাজে আমর বিল মা'রূফ ও নাহি আনিল মুনকারের ঐশ্বর্য দীপ্তিমান ছিল, তখন রাজনৈতিক বিপর্যয় মাথা তুলে দাঁড়াবার সাহস করতে পারেনি। পরিস্থিতি তখন ক্ষমতালিপ্সু গোষ্ঠী ও অর্থ বিত্তের লালসাকারীদেরকে দুঃসাহস দেখাতে দেয়নি।
কিন্তু ঈমানের সঙ্গে যখন দুনিয়ার ভালোবাসা ও জাগতিক মোহ মিশ্রিত হয়ে গিয়েছে, তখনই রাজনৈতিক বিপর্যয় মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে। সময় গড়াতে গড়াতে সেই বিপর্যয়ের বীজ মহীরুহে পরিণত হয়েছে।
এটা মূলত: রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের একটি হাদিসের বাস্তবায়ন।
ইমাম বুখারী রহমতুল্লাহি আমর ইবনে আউফ রাযিয়াল্লাহু আনহুর সূত্রে হাদীসটি এভাবে বর্ণনা করেন যে,
"أَنَّ رَسُولَ اللَّهِ -صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ- بَعَثَ أَبَا عُبَيْدَةَ بْنَ الجَرَّاحِ إِلَى البَحْرَيْنِ يَأْتِي بِجِزْيَتِهَا، .............. فَسَمِعَتِ الأَنْصَارُ بِقُدُومِ أَبِي عُبَيْدَةَ، فَوَافَتْ صَلاَةَ الصُّبْحِ مَعَ النَّبِيِّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ، فَلَمَّا صَلَّى بِهِمُ الفَجْرَ انْصَرَفَ، فَتَعَرَّضُوا لَهُ، فَتَبَسَّمَ رَسُولُ اللَّهِ -صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ- حِينَ رَآهُمْ، وَقَالَ: "أَظُنُّكُمْ قَدْ سَمِعْتُمْ أَنَّ أَبَا عُبَيْدَةَ قَدْ جَاءَ بِشَيْءٍ؟". قَالُوا: أَجَلْ يَا رَسُولَ اللَّهِ. قَالَ: "فَأَبْشِرُوا وَأَمِّلُوا مَا يَسُرُّكُمْ، فَوَاللَّهِ لاَ الفَقْرَ أَخْشَى عَلَيْكُمْ، وَلَكِنْ أَخَشَى عَلَيْكُمْ أَنْ تُبْسَطَ عَلَيْكُمُ الدُّنْيَا كَمَا بُسِطَتْ عَلَى مَنْ كَانَ قَبْلَكُمْ، فَتَنَافَسُوهَا كَمَا تَنَافَسُوهَا وَتُهْلِكَكُمْ كَمَا أَهْلَكَتْهُمْ"[10]
“রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আবু উবাইদা ইবনে জাররাহকে বাহারাইনে প্রেরণ করেন জিজিয়া তুলে আনার জন্য, ... আনসারগণ আবূ ‘উবাইদাহর আগমন বার্তা শুনে আল্লাহ্র রসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর সঙ্গে ফজরের সলাতে সবাই হাযির হলেন। যখন আল্লাহর রসূল তাঁদের নিয়ে ফজরের সলাত আদায় করে ফিরলেন, তখন তারা তাঁর সামনে হাযির হলেন। আল্লাহর রসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাদের দেখে মুচকি হাসলেন এবং বললেন, আমার মনে হয় তোমরা শুনেছ, আবূ ‘উবাইদাহ (রাঃ) কিছু নিয়ে এসেছেন। তারা বললেন, হ্যাঁ, হে আল্লাহর রসূল। আল্লাহ্র রসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন, ‘সুসংবাদ গ্রহণ কর এবং যা তোমাদের খুশি করে তাঁর আকাঙ্ক্ষা রাখ। আল্লাহ্র কসম! আমি তোমাদের ব্যাপারে দারিদ্রের ভয় করি না। কিন্তু তোমাদের ব্যাপারে এ আশঙ্কা করি যে, তোমাদের উপর দুনিয়া এরূপ প্রসারিত হয়ে পড়বে, যেমন তোমাদের অগ্রবর্তীদের উপর প্রসারিত হয়েছিল। আর তোমরাও দুনিয়ার প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়বে, যেমন তারা আকৃষ্ট হয়েছিল। আর তা তোমাদের বিনাশ করবে, যেমন তাদের বিনাশ করেছিল।”
আমাদের এটা আশা করা অবশ্যই দুরাশার শামিল হবে যে, সমাজের মাঝে হোক অথবা ইসলামপন্থীদের মাঝে হোক, শতভাগ ঈমানী তরবিয়ত, প্রশিক্ষণ, অনুশীলন ও সংশোধন সাধিত হয়ে যাবে, যার দরুন সমাজের সাধারণ মানুষেরা লোভ-লালসা, প্রবৃত্তির তাড়না, স্বার্থ হাসিলের চিন্তা, বিভিন্ন ধোঁকা-প্রতারণা এবং বদ অভ্যাস ও অনৈতিকতার বেড়াজাল থেকে মুক্ত হয়ে যাবে। নিশ্চয়ই এগুলো অলীক কল্পনা বৈ কিছুই নয়। বাস্তবে মানব চরিত্র ও তার সহজাত প্রবণতা বিভিন্ন ত্রুটি-বিচ্যুতি ও আত্মিক ব্যাধির উপাদান নিয়েই বসবাস করে। এটা চিরায়ত।
কিন্তু আমাদের যেটা আশা-আকাঙ্ক্ষা— আমি মনে করি, কল্যাণকামী, উম্মাহর শুভাকাঙ্ক্ষী ব্যক্তি মাত্রেরই এটা আকাঙ্ক্ষা যে, মুসলিম উম্মাহ, সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম জনসাধারণ এবং সাধারণ ইসলামপন্থীরা তাকওয়া, পরহেজগারি এবং আমর বিল মা'রূফ ও নাহি আনিল মুনকারের গুরুত্ব অনুধাবনের এমন একটা পর্যায়ে উন্নীত হোক, যা ক্ষমতালিপ্সু গোষ্ঠী ও প্রবৃত্তি পূজারীদেরকে ক্ষমতা ও কর্তৃত্বের অপব্যবহার করতে বারণ করবে, নেতৃবৃন্দের ভুল-ত্রুটি, পদস্খলন এবং কিছুমাত্র হলেও বাতিল গোষ্ঠীর সঙ্গে তাদের আঁতাত রোধ করবে; আরো অগ্রসর হয়ে বললে, সৎ লোকেরা যেন সেই পরিস্থিতিতে প্রবৃত্তি, সংশয়-সন্দেহ ও লোভনীয় বিষয়াদির দ্বারা প্রভাবিত প্রতারিত না হতে পারে, সৎ থাকার পর এভাবে যেন তারা পদস্খলনের শিকার না হয়, সরল পথে চলার পর তারা যেন আবার বিপথগামী না হয়ে যায় এবং যেসবের সঙ্গে একসময় তারা সম্পর্কচ্ছেদের ঘোষণা করত: পরবর্তীতে যেন তারা সেগুলোর বৈধতা বলে না বেড়ায়।
আমার উদ্দিষ্ট মূলকথা হলো, সাধারণভাবে উম্মাহর মাঝে এবং বিশেষভাবে ইসলামী আন্দোলনের মাঝে আমর বিল মা'রূফ ও নাহি আনিল মুনকারের চেতনা ম্লান হয়ে যাওয়াটা সকল ধ্বংসাত্মক প্রতিক্রিয়া সহকারে রাজনৈতিক বিপর্যয় সৃষ্টি হওয়া ও সর্বস্তরে সংক্রমিত হওয়ার পেছনে মুখ্য ভূমিকা পালন করে।
****
পাঠকবর্গ লক্ষ্য করে থাকবেন, গবেষণার প্রাককথনগুলোতে বিভিন্ন বিষয়ে মোটামুটি দীর্ঘ আলোচনা করা হয়েছে। যখন আমি রচনা আরম্ভ করি, আর এ বিষয়টি লক্ষ্য করি, তখন আল্লাহ তা'আলার কাছে ইস্তিখারা করি। ফলে আমার অন্তর এ বিষয়ে আশ্বস্ত হয়ে যায়।
এ কারণেই আমি স্থির করি গ্রন্থটি আমি কয়েক খণ্ডে সমাপ্ত করব। তো এটি সিরিজের প্রথম খণ্ড। এটি পূর্ণ করার প্রয়াস থাকবে আমার পক্ষ থেকে ইনশা আল্লাহ। আমি তাঁর কাছে শুকরিয়া আদায় করি এবং আশা রাখি, তিনি আমার এই প্রয়াস অব্যাহত রাখার তৌফিক দানের মাধ্যমে, ইলম দান করে এবং লেখার সুযোগ করে দিয়ে সাহায্য করবেন। তবে আমি যদি এই সিরিজ সমাপ্ত করার সুযোগ না পাই, তাহলে তো এটুকুই। আমার পর কেউ যদি এ কাজ সমাপ্ত করে দেন, তবে সেটা হবে তার কৃতিত্ব। প্রয়াস গ্রহণকারী প্রতিটি ব্যক্তি কৃতিত্বের দাবিদার।
****
এই ভূমিকার শেষাংশে আমি দুটো নোট লিখে যেতে চাই:
প্রথমটি হলো- এ গ্রন্থে যা কিছু লেখা হয়েছে সবকিছুর দায় আমার নিজের। অন্য কোন ব্যক্তি, কোন জামায়াত বা সংগঠন এই কিতাবের কোন ভুল-ত্রুটি বা বিচ্যুতির জন্য দায়ী নয়। এ গ্রন্থে যা কিছু ভালো রয়েছে সবই আল্লাহ তা‘আলার দয়া ও অনুগ্রহের ফসল। আল্লাহ তা‘আলার কাছে কামনা- তিনি এই গ্রন্থের সেসব কল্যাণকর বিষয়ের দ্বারা প্রথমে আমাকে, অতঃপর তাঁর অন্যান্য বান্দা-বান্দীদেরকে উপকৃত করবেন!
আর কল্যাণের বাইরে যা কিছু রয়েছে এ গ্রন্থে, সেগুলোর দায় আমার নিজের। আল্লাহ তা‘আলার কাছে কামনা- তিনি যেন আমার ভুল-ত্রুটি সংশোধন করে দেন! পদস্খলন থেকে আমাকে হেফাজত করেন!! এ বিষয়ে পাঠকবর্গের কাছেও আমার আবদার থাকবে, আপনারা ভুল সংশোধনে আমাকে সহায়তা করবেন।
দ্বিতীয়টি হলো- আমি এই গ্রন্থ থেকে উদ্ধৃতি, কপি, অংশবিশেষ অথবা সারসংক্ষেপ যার যতটুকু ইচ্ছা, সংগ্রহের ব্যাপক অনুমতি দিয়ে দিচ্ছি। এর দ্বারা বৈষয়িক বা আধ্যাত্মিক যেকোনভাবে উপকৃত হওয়ার বৈধতা ঘোষণা করছি। তবে এক্ষেত্রে দুটো শর্ত প্রযোজ্য:
প্রথম শর্ত: উদ্ধৃতি প্রদানে বিশ্বস্ত হতে হবে।
দ্বিতীয় শর্ত: আলোচনার মূল লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যের বিরোধী হওয়া যাবে না।
وما توفيقي إلا بالله، عليه توكلت وإليه أنيب.
وآخر دعوانا أن الحمد لله رب العالمين، وصلى الله على محمد وآله وصحبه وسلم.
وآخر دعوانا أن الحمد لله رب العالمين، وصلى الله على محمد وآله وصحبه وسلم.
আল্লাহর সন্তুষ্টি ও প্রতিদান লাভের আশায়
লিখেছেন—
শাইখ আইমান আয-যাওয়াহিরী হাফিযাহুল্লাহ
শাবান ১৪৪২ হিজরী মোতাবেক এপ্রিল ২০২১ খ্রিস্টাব্দ
(চলবে, ইন শা আল্লাহ)
[1] হাইসামি বলেন, ইমাম তাবারানী হাদীসটি বর্ণনা করেছেন। তবে ইয়াজিদ ইবনে মারসাদ হজরত মুআয থেকে কোন হাদিস বর্ণনা করেননি। আর ইবনে হিব্বান সহ অন্যান্য মুহাদ্দিসগণ ওয়াযীন ইবনে আতাকে নির্ভরযোগ্য বলেছেন। তবে একদল মুহাদ্দিস তাকে হাদীস বর্ণনার ক্ষেত্রে দুর্বল বলেছেন। এছাড়া এ হাদীসের অন্য সকল বর্ণনাকারী নির্ভরযোগ্য। (মাজমাউজ জাওয়ায়েদ: আল্লাহর নাফরমানীতে কারো আনুগত্যের অনুমতি না থাকা প্রসঙ্গে অধ্যায়: ৫/২২৭, ২২৮, ২৩৮)
[2] অর্থঃ হে ঈমানদারগণ তোমরা যথার্থরূপে আল্লাহকে ভয় করো এবং মুসলমান না হয়ে কিছুতেই মৃত্যুবরণ করো না। (সূরা আলে-ইমরান: ১০২)
[3] অর্থঃ হে মানব সম্প্রদায়! তোমরা তোমাদের ওই রবকে ভয় করো যিনি একটি প্রাণ থেকে তোমাদেরকে সৃষ্টি করেছেন এবং যিনি তার থেকে তার সঙ্গীনীকে সৃষ্টি করেছেন; আর বিস্তার করেছেন তাদের দু’জন থেকে অগণিত পুরুষ ও নারী। আর আল্লাহকে ভয় কর, যাঁর নামে তোমরা একে অপরের নিকট যাঞা করে থাক এবং আত্মীয়-স্বজনের ব্যাপারে সতর্কতা অবলম্বন কর। নিশ্চয় আল্লাহ তোমাদের ব্যাপারে সচেতন রয়েছেন। (সূরা নিসা: ০১)
[4] অর্থঃ হে ঈমানদারগণ! তোমরা আল্লাহকে ভয় কর এবং সঠিক কথা বল তিনি তোমাদের আমল-আচরণ সংশোধন করবেন এবং তোমাদের পাপসমূহ ক্ষমা করবেন। যে কেউ আল্লাহ ও তাঁর রসূলের আনুগত্য করে, সে অবশ্যই মহা সাফল্য অর্জন করবে। (সূরা আহযাব: ৭০-৭১)
[5] শাইখ আলবানী রহিমাহুল্লাহ হাদীসটি সহীহ বলেছেন। (সহীহ ওয়া জয়ীফুল জামে সগীর, হাদিস নং: ৯২০৬, খণ্ড নং: ১৯, পৃষ্ঠা নং: ২৫৩)। আর শাইখ শুয়াইব আর্নাউৎ বলেন: হাদিসের সনদ ঠিক আছে। (মুসনাদে ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল, তাহকীক: শুয়াইব আল আর্নাউৎ, আদেল মুরশেদ ও অন্যান্য, আর রিসালা ফাউন্ডেশন, প্রথম প্রকাশ: ১৪২১ হিজরী মোতাবেক ২০০১ খ্রিস্টাব্দ, আল-মাকতাবাতুশ শামিলা আয-যাহাবিয়া থেকে উদ্ধৃত)
[6] আলবানী রহিমাহুল্লাহ হাদীসটি সহীহ বলেছেন। (আল সিলসিলা আস সহীহাহ্ আল কামেলা: হাদিস নং: ০৫, খণ্ড নং: ০১, পৃষ্ঠা নং: ০৪)। শুয়াইব আর্নাউৎ বলেন: হাদীসের সনদ হাসান: (মুসনাদে ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল, হাদিস নং: ১৮৪০৬, খণ্ড নং: ৩০, পৃষ্ঠা নং: ৩৫৬)
[7] অর্থঃ আপনার কাছে জিজ্ঞেস করে, গনীমতের হুকুম। বলে দিন, গণীমতের মাল হল আল্লাহর এবং রসূলের। অতএব, তোমরা আল্লাহকে ভয় কর এবং নিজেদের অবস্থা সংশোধন করে নাও। আর আল্লাহ এবং তাঁর রসূলের হুকুম মান্য কর, যদি ঈমানদার হয়ে থাক। যারা ঈমানদার, তারা এমন যে, যখন আল্লাহর নাম নেয়া হয়, তখন ভীত হয়ে পড়ে তাদের অন্তর। আর যখন তাদের সামনে পাঠ করা হয় কালাম, তখন তাদের ঈমান বেড়ে যায় এবং তারা স্বীয় পরওয়ারদেগারের প্রতি ভরসা পোষণ করে। সে সমস্ত লোক যারা নামায প্রতিষ্ঠা করে এবং আমি তাদেরকে যে রুযী দিয়েছি তা থেকে ব্যয় করে, তারাই হল সত্যিকার ঈমানদার। তাদের জন্য রয়েছে স্বীয় পরওয়ারদেগারের নিকট মর্যাদা, ক্ষমা এবং সম্মানজনক রুযী। (সূরা আনফাল: ১-৪)
[8] অর্থ: এটা শ্রবণযোগ্য। আর কেউ আল্লাহর নামযুক্ত বস্তুসমূহের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করলে তা তো তার হৃদয়ের আল্লাহভীতি প্রসূত। চতুস্পদ জন্তুসমূহের মধ্যে তোমাদের জন্যে নির্দিষ্টকাল পর্যন্ত উপকার রয়েছে। অতঃপর এগুলোকে পৌছাতে হবে মুক্ত গৃহ পর্যন্ত। আমি প্রত্যেক উম্মতের জন্যে কুরবানী নির্ধারণ করেছি, যাতে তারা আল্লাহর দেয়া চতুস্পদ জন্তু যবেহ কারার সময় আল্লাহর নাম উচ্চারণ করে। অতএব তোমাদের আল্লাহ তো একমাত্র আল্লাহ। সুতরাং তাঁরই আজ্ঞাধীন থাক এবং বিনয়ীগণকে সুসংবাদ দাও; যাদের অন্তর আল্লাহর নাম স্মরণ করা হলে ভীত হয় এবং যারা তাদের বিপদাপদে ধৈর্য্যধারণ করে এবং যারা নামায কায়েম করে ও আমি যা দিয়েছি, তা থেকে ব্যয় করে। (সূরা হজ্জ: ৩২-৩৫)
[9] অর্থ: [তারা এমন লোক যাদেরকে আমি পৃথিবীতে শক্তি-সামর্থ্য দান করলে তারা নামায কায়েম করবে, যাকাত দেবে এবং সৎকাজে আদেশ ও অসৎকাজে নিষেধ করবে। প্রত্যেক কর্মের পরিণাম আল্লাহর এখতিয়ারর্ভুক্ত।] (সূরা হজ্জঃ ৪১)
[10] মুত্তাফাকুন আলাইহি (ইমাম বুখারী ও ইমাম মুসলিম উভয়ই হাদীসটি বর্ণনা করেছেন।) তবে হাদিসের ভাষ্য ইমাম বুখারীর বর্ণনানুযায়ী। কিতাবুল জিজিয়া, পরিচ্ছেদ: জিজিয়া এবং হারবিদের সঙ্গে সন্ধিস্থাপন প্রসঙ্গে, হাদিস নং: ৩১৫৮, খণ্ড নং: ০২, পৃষ্ঠা নং: ৪০৬
Comment