পৃথিবীর যেকোন দেশে কর্তৃত্ববাদী শাসন টিকিয়ে রাখার জন্য দুটি বিষয় নিশ্চিত করতে হয়। যার একটি হচ্ছে সামাজিক ন্যায়বিচার; এবং, অপরটি হচ্ছে অর্থনৈতিক ন্যায্যতা। কাজাখস্তানের সাবেক প্রেসিডেন্ট নুর-সুলতান নজারবায়েভ প্রথমদিকে এই বিষয়টি নিশ্চিত করে ক্ষমতার মসনদে আসীন হয়েছিলেন। অর্থনৈতিক সাফল্যের বিনিময়ের জনগণের ব্যাপক সমর্থনও জুটেছিল সাবেক প্রেসিডেন্টের ভাগ্যে। কিন্তু, গত এক দশকে ক্রমবর্ধমান সামাজিক অবক্ষয়, বিচারহীনতা ও শ্রেণীবৈষম্য কাজাখস্তানের রাজনৈতিক অঙ্গনে ব্যাপক ভারসাম্যহীনতা তৈরি করে। যার ফলশ্রুতিতে সারা বিশ্ব এমন এক সহিংস আন্দোলনের সাক্ষী হতে বাধ্য হয়েছে।
যদিও বিশ্বের সকল মিডিয়া জোরগলায় এই সংবাদ প্রচার করেছে যে, তেলের দাম বৃদ্ধির ফলে জনগণের মাঝে এই জনবিক্ষোভ বা আক্রোশের সূচনা হয়। কিন্তু, সংবাদটি আংশিক সত্য। মূলত, কাজাখস্তানের আন্দোলনের সূচনা হয়েছে আরো বছর তিনেক আগে।
সোভিয়েত ইউনিয়ন ভাঙ্গার পরে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে যাত্রা শুরু করে কাজাখস্তান। দীর্ঘ তিন দশক দেশটির শাসনকর্তার আসনে ছিলেন নজারবায়েভ। ব্যাপক দুর্নীতি, আত্মীয়-স্বজন ও আস্থাভাজনদের (চাটুকারদের) অবৈধ সুবিধা প্রদান এবং সামাজিক বৈষম্যমূলক অবকাঠামো প্রণয়নের দায়ে জনগণের রোষানলে পড়েন সাবেক প্রেসিডেন্ট। বছর তিনেক আগে ২০১৯ সালে গণআন্দোলনের মাধ্যমে ইতি ঘটে তা নজরবায়েভের 'সরাসরি' শাসনের।
প্রেসিডেন্ট হিসেবে কাসিম জমার্ট তোকায়েভ ক্ষমতা গ্রহণ করলেও তাকে শাসনকার্য পরিচালনা করতে হয়েছে নজারবায়েভ অনুগত থেকে। দেশটির সামগ্রিক রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ ছিল সাবেক প্রেসিডেন্টের হাতে। আর এই বিষয়টিই জনগণের জন্য মেনে নেওয়া সম্ভব ছিল না। যে স্বৈরশাসকের বিরুদ্ধে তারা আন্দোলন করেছে 'সেই শাসক ক্ষমতার না থেকেও দেশ পরিচালনা করছে'- এই ইস্যুটি পুনরায় জনগণের মাঝে ক্ষোভ তৈরি করে।
তোকায়েভ প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার বছরখানেকের মধ্যেই শুরু হয় করোনা মহামারি। বিভিন্ন ধরনের রাষ্ট্রীয় বিধিনিষেধ থাকার ফলে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড ছিল সীমিত। বলতে গেলে, গত তিন বছরে কোন প্রকার রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জ তোকায়েভকে মোকাবেলা করতে হয়নি।
জনগণের দিক থেকে প্রথম রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জ তৈরি হয় এ বছরের প্রথম সপ্তাহে। যখন তোকায়েভ সরকার তেলের দামের উপর থেকে সর্বোচ্চ সীমা প্রত্যাহার করে নেয়। বিদ্যুৎ উৎপাদন, গাড়ি ও কলকারখানা জ্বালানি এবং নিত্যপ্রয়োজনীয় প্রায় প্রতিটি কাজের ক্ষেত্রে তেলের উপর নির্ভরশীল নাগরিকদের ব্যয়ভার হঠাৎ করে অনেক বেশি বেড়ে যায়।
একদিকে দীর্ঘদিনের সামাজিক ও রাজনৈতিক বৈষম্যের শিকার; অন্যদিকে হঠাৎ তৈরি হওয়া অর্থনৈতিক অস্থিরতা জনগণকে কাজাখস্তানের স্মরণকালের ভয়াবহ ও রক্তক্ষয়ী আন্দোলনের দিকে প্ররোচিত করে।
৩ জানুয়ারি কাজাখস্তানের বিভিন্ন শহরে প্রতিবাদ-বিক্ষোভের জন্য হাজার হাজার নাগরিক রাজপথে নেমে আসে। রাজনৈতিকভাবে তাদের দাবি ছিল পরিষ্কার- তেলের দাম কমাতে হবে।
জানুয়ারির ৪ তারিখেই আন্দোলন সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে, যার কেন্দ্রস্থল হয়ে ওঠে পুরাতন রাজধানী আলমাটির - আলমাটি স্কয়ার। আন্দোলনকারীদের শান্ত করতে সরকার ঘোষণা দেয়- তেলের মূল্যের উপর কিছু সীমাবদ্ধতা আবারো আরোপ করা হবে।
কিন্তু, ৫ জানুয়ারী আন্দোলন এক নতুন রূপ ধারণ করে। যখন তেলের দাম নিয়ন্ত্রণের এক দাবি 'প্রশাসনিক ও রাজনৈতিক কাঠামো পরিবর্তনের ৫ দাবি'তে পরিণত হয়।
ক্ষমতার ভিত নাড়িয়ে দেওয়া এই ৫টি দাবি ছিলঃ
১) সরকারের মধ্যে সাবেক প্রেসিডেন্ট নুর-সুলতান নজরবায়েভের প্রভাব কমিয়ে আনা, সরকারের মধ্যে প্রকৃত পরিবর্তন আনা।
২) প্রাদেশিক পরিষদের গভর্নরদের প্রেসিডেন্টের মাধ্যমে নিয়োগের বদলে এদের জন্য নির্বাচনের ব্যবস্থা করা।
৩) ১৯৯৩ সালের সংবিধান ফিরিয়ে আনা, প্রেসিডেন্টের ক্ষমতাকে সুস্পষ্ট করা।
৪) রাজনৈতিক কর্মকান্ডের উপর নিয়ন্ত্রণ ও নির্যাতন বন্ধ করে উন্মুক্ত পরিবেশ নিশ্চিত করা।
৫) নতুন সরকারে স্বার্থের দ্বন্দ্বে পতিত হবে না, এমন ব্যক্তিদের নিয়োগ দেওয়া।
আন্দোলনকারীরা বিভিন্ন সরকারি ভবনে আক্রমণ করে, দুর্নীতিগ্রস্ত প্রশাসনের বিরুদ্ধে প্রকাশ ঘটে জনগণের ক্ষোভের। আগুন জ্বালিয়ে দেওয়া হয় আলমাটি শহরের মেয়রের কার্যালয়ে, আগুন দেওয়া হয় আলমাটির সিটি সেন্টারেও।
জানুয়ারির ৬ তারিখ প্রেসিডেন্ট তোকায়েভ ও আর্মেনিয়ার প্রধানমন্ত্রী ঘোষণা দেন, কাজাখস্তানের পরিস্থিতি সামাল দিতে শান্তিরক্ষী বাহিনী যাবে, যার নেতৃত্বে থাকবে রাশিয়ার সৈন্যরা।
৭ ও ৮ জানুয়ারী ব্যাপক ধরপাকড় চালানো হয় আন্দোলনকারীদের উপর। ২৬ জন আন্দোলনকারীর রক্তে রঞ্জিত হয় কাজাখস্তানের রাজপথ, আহত হয় কয়েক হাজার মানুষ। (আন্দোলনে মোট নিহতের সংখ্যা দুই শতাধিক)। ৮ তারিখেই আন্দোলন অনেকটুকুই স্থিমিত হয়ে যায়।
জানুয়ারির ৯ তারিখে আন্দোলনের কেন্দ্রস্থল আলমাটি স্কয়ার ছিল নীরব। আর এইভাবেই সমাপ্তি ঘটে আরেকটি বহু প্রতিক্ষিত আন্দোলনের।
কেন আন্দোলন ব্যর্থ হলো?- এই নিয়ে সরকারি-বেসরকারি বিশেষজ্ঞদের নানা মত আছে। বিশ্ব জুড়ে চলছে মুখরোচক টক-শো আর সাক্ষাৎকার। কিন্তু প্রায় প্রতিটি আলোচনায় হচ্ছে তেলের দামকে কেন্দ্র করে; যা আন্দোলনের প্রাথমিক কারণ হলেও কখনোই মূল কারণ ছিল না।
অনুসন্ধান আর গবেষণা করলে আন্দোলনের ব্যর্থতার শত শত কারণ উল্লেখ করা যেতে পারে। কিন্তু ব্যর্থতার প্রধান কারণ হলো, 'আন্দোলনকারীরা তাদের প্রতিবেশি ও পাশ্ববর্তী দেশগুলোর আন্দোলন থেকে প্রাপ্ত সাফল্য আর ব্যর্থতা নিয়ামকসমূহ পর্যালোচনায় নেননি।'
কাজাখ আন্দোলনকারীদের সামনে অনেকগুলো ব্যর্থ আন্দোলনের উদাহরণ ছিল। বিশেষ করে গত দেড় দশকে সবচেয়ে বেশি ব্যর্থ আন্দোলন হয়েছে এশিয়ার আরেকটি স্বায়ত্তশাসিত দেশ 'বাংলাদেশ'-এ।
বাংলাদেশ ও কাজাখস্তানের ভৌগলিক অবস্থান, জনসংখ্যা, আয়তন, সংস্কৃতি, রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক অবকাঠামোতে যতই পার্থক্য থাকুক না কেন; বাংলাদেশের ও কাজাখস্তানের আন্দোলন ব্যর্থ হওয়ার কারণ সমূহ মধ্যে তেমন কোন পার্থক্য নেই। যদি শত শত পরোক্ষ কারণ উপেক্ষাও করা হয়; তারপরও মোটাদাগের এমন কয়েকেটি কারণ রয়েছে যা উভয় দেশের আন্দোলনের ব্যর্থতার মধ্যে সাদৃশ্য স্পষ্টভাবে তুলে ধরার জন্য যথেষ্ট।
প্রথমত, কাজাখস্তান ও বাংলাদেশের আন্দোলনের প্রধান লক্ষ্য হলো, রাষ্ট্রের কাঠামোগত পরিবর্তন সাধন করা। কিন্তু আন্দোলনকারী যা অনুধাবনে ব্যর্থ হচ্ছেন তা হলো, কাঠামোগত পরিবর্তন একটি দীর্ঘমেয়াদী প্রক্রিয়া, যার জন্য প্রতিনিয়ত আন্দোলন করে যেতে হয়। দীর্ঘ সময় ধরে একটি আন্দোলন চালিয়ে নিতে হলে প্রয়োজন হয় কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের, যারা সব জায়গায় গ্রহণযোগ্য ভূমিকা রাখবেন। বাংলাদেশের কোন সরকারবিরোধী আন্দোলনে ও কাজাখস্তানে জানুয়ারির শুরুতে ছড়িয়ে পরা আন্দোলনে কেন্দ্রীয় কোন নেতৃত্ব ছিল না; ছিল না কেন্দ্রীয় কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণের কাঠামোও। এই শূন্যতা শুরু থেকেই আন্দোলনের সফলতা অর্জনের ক্ষেত্রে একটি বাধা তৈরি করেছে।
দ্বিতীয়ত, আন্দোলন দমনে বাংলাদেশ সরকার যে বাহিনী ব্যবহার করছে সেই বাহিনী কাগজে-কলমে রাষ্টীয় বাহিনী হলেও; তা সরকারের পোষা বাহিনীতে পরিণত হয়েছে। তাই তারা জনগণের স্বার্থের পরিবর্তে সরকারের স্বার্থের দিকে মনোযোগী হবে এটাই স্বাভাবিক। একই ভাবে তোকায়েভের সরকার বাইরে থেকে আনা বাহিনীর উপর নির্ভর করেছেন। রুশ বাহিনী তাদের দেশ (রাশিয়া) ও তোকায়েভ সরকারের স্বার্থের দিকে গুরুত্ব আরোপ করে জনগণের উপর ব্যপক ক্রাকডাউন করতেও দ্বিধাবোধ করেনি। উভয় দেশের আন্দোলনকারীরা তাদের আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে নিজের স্বার্থে ব্যবহার করতে পারেনি। এমন কি তাদের মাঝে আন্দোলনের দাবিগুলো পর্যন্ত ছড়াতে ব্যর্থ হয়েছে।
তৃতীয়ত, উভয় দেশে মোট সম্পদের অধিকাংশই অল্প কয়েকজন অভিজাতের হাতে কুক্ষিগত, রয়েছে উচ্চ শ্রেণিবৈষম্য। মধ্যবিত্ত জীবনযাপনের ব্যয় বহন করার মত সামর্থ্যও অধিকাংশ নাগরিকের নেই। করোনার কারণে নতুন করে তৈরি হয়েছে অর্থনৈতিক সীমাবদ্ধতা। ব্যাপক দুর্নীতির ফলে প্রতিনিয়ত ধুঁকতে থাকা কাজাখ অর্থনীতি করোনার কারণে খাদের কিনারায় পৌঁছে গিয়েছিল। ফলে, আন্দোলকারীদের সামষ্টিক ও ব্যক্তিগত সীমাবদ্ধতার জায়গা তৈরি হয়েছে। যা দীর্ঘমেয়াদে আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে এক ব্যপক অন্তরায় সৃষ্টি করেছে।
চতুর্থত, দেশের কাঠামোগত পরিবর্তনে সবচেয়ে বড় ও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখার কথা দেশের আমলাতন্ত্রের। কিন্তু আন্দোলনগুলোতে আমলাদের অনুপস্থিতি লক্ষণীয়। বাংলাদশের আমলারা দীর্ঘ সময়যাবত সরকারের শাসন ও শোষণযন্ত্রে পরিণত হয়েছে। তাই তাদের কাছ থেকে কোন প্রকার সাহায্য আশা করা নিছক প্রহসনের নামান্তর।
অন্যদিকে, কাজাখস্তানের সামরিক আর বেসামরিক আমলাতন্ত্র অনেকগুলো স্বার্থগোষ্ঠীতে বিভক্ত হয়ে গেছে। এই ধরনের আমলাতন্ত্র যেসব রাষ্ট্রে থাকে, তারা সাধারণত রাজনৈতিক অধিকারগুলো বিকাশের পক্ষে কাজ করেন না। বুদ্ধিবৃত্তিক জগত থেকেও সমর্থন পাওয়া আন্দোলনকারীদের জন্য দুরূহ ব্যাপার হয়ে যায়। ফলে, আন্দোলনের বুদ্ধিবৃত্তিক সীমাবদ্ধতার কারণে সেটি আটকে যায়। কাজাখস্তান ও বাংলাদেশের উভয়ের ক্ষেত্রে সেটিই হচ্ছে।
কাজাখস্তানের আন্দোলন সফল হওয়া শুধু কাজাখ নাগরিকদের জন্য নয়; বরং সারা বিশ্বের মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ রাষ্ট্রগুলোর জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছিল। কারণ আরব বসন্তের পর থেমে যাওয়া বিক্ষোভের আলোড়ন পুনর্জাগরণের জন্য এই বিজয় অত্যান্ত অত্যবশকীয়। তবুও এই আন্দোলনের মাধ্যমে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ রাষ্ট্রের নাগরিকদের জন্য সাফল্য এটুকুই যে, 'তারা উপলব্ধি করতে সফল হবেন সামনের আন্দোলনগুলোতে প্রয়োজনীয় কোন কোন বিষয়গুলো বিবেচনায় নিতে হবে।'
অর্থনৈতিক সাফল্যের নামে কাজাখ ও বাংলার জনসাধারণ যা পাচ্ছে তা হলো, 'রাস্ত-ঘাট ও সেতু নির্মানের মত অবকাঠামোগত নির্মাণকাজের প্রতারণা'। স্বাধীনতার পর থেকে প্রতিনিয়ত সামাজিক অবক্ষয় ও শ্রেণীবৈষম্য শুধু বৃদ্ধিই পেয়েছে; আর সামনের দিনগুলোতে যে এই প্রক্রিয়ার রেশ থাকবে তা বলাই বাহুল্য।
এমতাবস্থায়, সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অধিকার অর্জনের লক্ষ্যে উভয় দেশের নাগরিকরা পুনরায় এমন আন্দোলনে জড়ালে মোটেই অবাক হবার কিছু থাকবে না। ফলে আগামীর দিনগুলো জালেম সরকারগুলোর জন্য আসলেই হবে পরীক্ষার এক সময়।
আবার ওদিকে আন্দোলনকারীরা যদি যথেষ্ট বুদ্ধিমান এবং বাস্তববাদী হন, তাহলে এই বৈশিষ্ট্যই তাদের ভূ-রাজনীতি বুঝতে শেখাবে। যেটা কাজে লাগবে দেশকে ইসলামিক প্রশাসনিক ধারা তৈরির সঠিক কর্মকৌশল ঠিক করার ক্ষেত্রে। তাই পরিস্থিতি শুধু শঙ্কা এবং হতাশার নয়, হতে পারে আশারও।
যদিও বিশ্বের সকল মিডিয়া জোরগলায় এই সংবাদ প্রচার করেছে যে, তেলের দাম বৃদ্ধির ফলে জনগণের মাঝে এই জনবিক্ষোভ বা আক্রোশের সূচনা হয়। কিন্তু, সংবাদটি আংশিক সত্য। মূলত, কাজাখস্তানের আন্দোলনের সূচনা হয়েছে আরো বছর তিনেক আগে।
সোভিয়েত ইউনিয়ন ভাঙ্গার পরে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে যাত্রা শুরু করে কাজাখস্তান। দীর্ঘ তিন দশক দেশটির শাসনকর্তার আসনে ছিলেন নজারবায়েভ। ব্যাপক দুর্নীতি, আত্মীয়-স্বজন ও আস্থাভাজনদের (চাটুকারদের) অবৈধ সুবিধা প্রদান এবং সামাজিক বৈষম্যমূলক অবকাঠামো প্রণয়নের দায়ে জনগণের রোষানলে পড়েন সাবেক প্রেসিডেন্ট। বছর তিনেক আগে ২০১৯ সালে গণআন্দোলনের মাধ্যমে ইতি ঘটে তা নজরবায়েভের 'সরাসরি' শাসনের।
প্রেসিডেন্ট হিসেবে কাসিম জমার্ট তোকায়েভ ক্ষমতা গ্রহণ করলেও তাকে শাসনকার্য পরিচালনা করতে হয়েছে নজারবায়েভ অনুগত থেকে। দেশটির সামগ্রিক রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ ছিল সাবেক প্রেসিডেন্টের হাতে। আর এই বিষয়টিই জনগণের জন্য মেনে নেওয়া সম্ভব ছিল না। যে স্বৈরশাসকের বিরুদ্ধে তারা আন্দোলন করেছে 'সেই শাসক ক্ষমতার না থেকেও দেশ পরিচালনা করছে'- এই ইস্যুটি পুনরায় জনগণের মাঝে ক্ষোভ তৈরি করে।
তোকায়েভ প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার বছরখানেকের মধ্যেই শুরু হয় করোনা মহামারি। বিভিন্ন ধরনের রাষ্ট্রীয় বিধিনিষেধ থাকার ফলে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড ছিল সীমিত। বলতে গেলে, গত তিন বছরে কোন প্রকার রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জ তোকায়েভকে মোকাবেলা করতে হয়নি।
জনগণের দিক থেকে প্রথম রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জ তৈরি হয় এ বছরের প্রথম সপ্তাহে। যখন তোকায়েভ সরকার তেলের দামের উপর থেকে সর্বোচ্চ সীমা প্রত্যাহার করে নেয়। বিদ্যুৎ উৎপাদন, গাড়ি ও কলকারখানা জ্বালানি এবং নিত্যপ্রয়োজনীয় প্রায় প্রতিটি কাজের ক্ষেত্রে তেলের উপর নির্ভরশীল নাগরিকদের ব্যয়ভার হঠাৎ করে অনেক বেশি বেড়ে যায়।
একদিকে দীর্ঘদিনের সামাজিক ও রাজনৈতিক বৈষম্যের শিকার; অন্যদিকে হঠাৎ তৈরি হওয়া অর্থনৈতিক অস্থিরতা জনগণকে কাজাখস্তানের স্মরণকালের ভয়াবহ ও রক্তক্ষয়ী আন্দোলনের দিকে প্ররোচিত করে।
৩ জানুয়ারি কাজাখস্তানের বিভিন্ন শহরে প্রতিবাদ-বিক্ষোভের জন্য হাজার হাজার নাগরিক রাজপথে নেমে আসে। রাজনৈতিকভাবে তাদের দাবি ছিল পরিষ্কার- তেলের দাম কমাতে হবে।
জানুয়ারির ৪ তারিখেই আন্দোলন সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে, যার কেন্দ্রস্থল হয়ে ওঠে পুরাতন রাজধানী আলমাটির - আলমাটি স্কয়ার। আন্দোলনকারীদের শান্ত করতে সরকার ঘোষণা দেয়- তেলের মূল্যের উপর কিছু সীমাবদ্ধতা আবারো আরোপ করা হবে।
কিন্তু, ৫ জানুয়ারী আন্দোলন এক নতুন রূপ ধারণ করে। যখন তেলের দাম নিয়ন্ত্রণের এক দাবি 'প্রশাসনিক ও রাজনৈতিক কাঠামো পরিবর্তনের ৫ দাবি'তে পরিণত হয়।
ক্ষমতার ভিত নাড়িয়ে দেওয়া এই ৫টি দাবি ছিলঃ
১) সরকারের মধ্যে সাবেক প্রেসিডেন্ট নুর-সুলতান নজরবায়েভের প্রভাব কমিয়ে আনা, সরকারের মধ্যে প্রকৃত পরিবর্তন আনা।
২) প্রাদেশিক পরিষদের গভর্নরদের প্রেসিডেন্টের মাধ্যমে নিয়োগের বদলে এদের জন্য নির্বাচনের ব্যবস্থা করা।
৩) ১৯৯৩ সালের সংবিধান ফিরিয়ে আনা, প্রেসিডেন্টের ক্ষমতাকে সুস্পষ্ট করা।
৪) রাজনৈতিক কর্মকান্ডের উপর নিয়ন্ত্রণ ও নির্যাতন বন্ধ করে উন্মুক্ত পরিবেশ নিশ্চিত করা।
৫) নতুন সরকারে স্বার্থের দ্বন্দ্বে পতিত হবে না, এমন ব্যক্তিদের নিয়োগ দেওয়া।
আন্দোলনকারীরা বিভিন্ন সরকারি ভবনে আক্রমণ করে, দুর্নীতিগ্রস্ত প্রশাসনের বিরুদ্ধে প্রকাশ ঘটে জনগণের ক্ষোভের। আগুন জ্বালিয়ে দেওয়া হয় আলমাটি শহরের মেয়রের কার্যালয়ে, আগুন দেওয়া হয় আলমাটির সিটি সেন্টারেও।
জানুয়ারির ৬ তারিখ প্রেসিডেন্ট তোকায়েভ ও আর্মেনিয়ার প্রধানমন্ত্রী ঘোষণা দেন, কাজাখস্তানের পরিস্থিতি সামাল দিতে শান্তিরক্ষী বাহিনী যাবে, যার নেতৃত্বে থাকবে রাশিয়ার সৈন্যরা।
৭ ও ৮ জানুয়ারী ব্যাপক ধরপাকড় চালানো হয় আন্দোলনকারীদের উপর। ২৬ জন আন্দোলনকারীর রক্তে রঞ্জিত হয় কাজাখস্তানের রাজপথ, আহত হয় কয়েক হাজার মানুষ। (আন্দোলনে মোট নিহতের সংখ্যা দুই শতাধিক)। ৮ তারিখেই আন্দোলন অনেকটুকুই স্থিমিত হয়ে যায়।
জানুয়ারির ৯ তারিখে আন্দোলনের কেন্দ্রস্থল আলমাটি স্কয়ার ছিল নীরব। আর এইভাবেই সমাপ্তি ঘটে আরেকটি বহু প্রতিক্ষিত আন্দোলনের।
কেন আন্দোলন ব্যর্থ হলো?- এই নিয়ে সরকারি-বেসরকারি বিশেষজ্ঞদের নানা মত আছে। বিশ্ব জুড়ে চলছে মুখরোচক টক-শো আর সাক্ষাৎকার। কিন্তু প্রায় প্রতিটি আলোচনায় হচ্ছে তেলের দামকে কেন্দ্র করে; যা আন্দোলনের প্রাথমিক কারণ হলেও কখনোই মূল কারণ ছিল না।
অনুসন্ধান আর গবেষণা করলে আন্দোলনের ব্যর্থতার শত শত কারণ উল্লেখ করা যেতে পারে। কিন্তু ব্যর্থতার প্রধান কারণ হলো, 'আন্দোলনকারীরা তাদের প্রতিবেশি ও পাশ্ববর্তী দেশগুলোর আন্দোলন থেকে প্রাপ্ত সাফল্য আর ব্যর্থতা নিয়ামকসমূহ পর্যালোচনায় নেননি।'
কাজাখ আন্দোলনকারীদের সামনে অনেকগুলো ব্যর্থ আন্দোলনের উদাহরণ ছিল। বিশেষ করে গত দেড় দশকে সবচেয়ে বেশি ব্যর্থ আন্দোলন হয়েছে এশিয়ার আরেকটি স্বায়ত্তশাসিত দেশ 'বাংলাদেশ'-এ।
বাংলাদেশ ও কাজাখস্তানের ভৌগলিক অবস্থান, জনসংখ্যা, আয়তন, সংস্কৃতি, রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক অবকাঠামোতে যতই পার্থক্য থাকুক না কেন; বাংলাদেশের ও কাজাখস্তানের আন্দোলন ব্যর্থ হওয়ার কারণ সমূহ মধ্যে তেমন কোন পার্থক্য নেই। যদি শত শত পরোক্ষ কারণ উপেক্ষাও করা হয়; তারপরও মোটাদাগের এমন কয়েকেটি কারণ রয়েছে যা উভয় দেশের আন্দোলনের ব্যর্থতার মধ্যে সাদৃশ্য স্পষ্টভাবে তুলে ধরার জন্য যথেষ্ট।
প্রথমত, কাজাখস্তান ও বাংলাদেশের আন্দোলনের প্রধান লক্ষ্য হলো, রাষ্ট্রের কাঠামোগত পরিবর্তন সাধন করা। কিন্তু আন্দোলনকারী যা অনুধাবনে ব্যর্থ হচ্ছেন তা হলো, কাঠামোগত পরিবর্তন একটি দীর্ঘমেয়াদী প্রক্রিয়া, যার জন্য প্রতিনিয়ত আন্দোলন করে যেতে হয়। দীর্ঘ সময় ধরে একটি আন্দোলন চালিয়ে নিতে হলে প্রয়োজন হয় কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের, যারা সব জায়গায় গ্রহণযোগ্য ভূমিকা রাখবেন। বাংলাদেশের কোন সরকারবিরোধী আন্দোলনে ও কাজাখস্তানে জানুয়ারির শুরুতে ছড়িয়ে পরা আন্দোলনে কেন্দ্রীয় কোন নেতৃত্ব ছিল না; ছিল না কেন্দ্রীয় কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণের কাঠামোও। এই শূন্যতা শুরু থেকেই আন্দোলনের সফলতা অর্জনের ক্ষেত্রে একটি বাধা তৈরি করেছে।
দ্বিতীয়ত, আন্দোলন দমনে বাংলাদেশ সরকার যে বাহিনী ব্যবহার করছে সেই বাহিনী কাগজে-কলমে রাষ্টীয় বাহিনী হলেও; তা সরকারের পোষা বাহিনীতে পরিণত হয়েছে। তাই তারা জনগণের স্বার্থের পরিবর্তে সরকারের স্বার্থের দিকে মনোযোগী হবে এটাই স্বাভাবিক। একই ভাবে তোকায়েভের সরকার বাইরে থেকে আনা বাহিনীর উপর নির্ভর করেছেন। রুশ বাহিনী তাদের দেশ (রাশিয়া) ও তোকায়েভ সরকারের স্বার্থের দিকে গুরুত্ব আরোপ করে জনগণের উপর ব্যপক ক্রাকডাউন করতেও দ্বিধাবোধ করেনি। উভয় দেশের আন্দোলনকারীরা তাদের আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে নিজের স্বার্থে ব্যবহার করতে পারেনি। এমন কি তাদের মাঝে আন্দোলনের দাবিগুলো পর্যন্ত ছড়াতে ব্যর্থ হয়েছে।
তৃতীয়ত, উভয় দেশে মোট সম্পদের অধিকাংশই অল্প কয়েকজন অভিজাতের হাতে কুক্ষিগত, রয়েছে উচ্চ শ্রেণিবৈষম্য। মধ্যবিত্ত জীবনযাপনের ব্যয় বহন করার মত সামর্থ্যও অধিকাংশ নাগরিকের নেই। করোনার কারণে নতুন করে তৈরি হয়েছে অর্থনৈতিক সীমাবদ্ধতা। ব্যাপক দুর্নীতির ফলে প্রতিনিয়ত ধুঁকতে থাকা কাজাখ অর্থনীতি করোনার কারণে খাদের কিনারায় পৌঁছে গিয়েছিল। ফলে, আন্দোলকারীদের সামষ্টিক ও ব্যক্তিগত সীমাবদ্ধতার জায়গা তৈরি হয়েছে। যা দীর্ঘমেয়াদে আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে এক ব্যপক অন্তরায় সৃষ্টি করেছে।
চতুর্থত, দেশের কাঠামোগত পরিবর্তনে সবচেয়ে বড় ও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখার কথা দেশের আমলাতন্ত্রের। কিন্তু আন্দোলনগুলোতে আমলাদের অনুপস্থিতি লক্ষণীয়। বাংলাদশের আমলারা দীর্ঘ সময়যাবত সরকারের শাসন ও শোষণযন্ত্রে পরিণত হয়েছে। তাই তাদের কাছ থেকে কোন প্রকার সাহায্য আশা করা নিছক প্রহসনের নামান্তর।
অন্যদিকে, কাজাখস্তানের সামরিক আর বেসামরিক আমলাতন্ত্র অনেকগুলো স্বার্থগোষ্ঠীতে বিভক্ত হয়ে গেছে। এই ধরনের আমলাতন্ত্র যেসব রাষ্ট্রে থাকে, তারা সাধারণত রাজনৈতিক অধিকারগুলো বিকাশের পক্ষে কাজ করেন না। বুদ্ধিবৃত্তিক জগত থেকেও সমর্থন পাওয়া আন্দোলনকারীদের জন্য দুরূহ ব্যাপার হয়ে যায়। ফলে, আন্দোলনের বুদ্ধিবৃত্তিক সীমাবদ্ধতার কারণে সেটি আটকে যায়। কাজাখস্তান ও বাংলাদেশের উভয়ের ক্ষেত্রে সেটিই হচ্ছে।
কাজাখস্তানের আন্দোলন সফল হওয়া শুধু কাজাখ নাগরিকদের জন্য নয়; বরং সারা বিশ্বের মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ রাষ্ট্রগুলোর জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছিল। কারণ আরব বসন্তের পর থেমে যাওয়া বিক্ষোভের আলোড়ন পুনর্জাগরণের জন্য এই বিজয় অত্যান্ত অত্যবশকীয়। তবুও এই আন্দোলনের মাধ্যমে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ রাষ্ট্রের নাগরিকদের জন্য সাফল্য এটুকুই যে, 'তারা উপলব্ধি করতে সফল হবেন সামনের আন্দোলনগুলোতে প্রয়োজনীয় কোন কোন বিষয়গুলো বিবেচনায় নিতে হবে।'
অর্থনৈতিক সাফল্যের নামে কাজাখ ও বাংলার জনসাধারণ যা পাচ্ছে তা হলো, 'রাস্ত-ঘাট ও সেতু নির্মানের মত অবকাঠামোগত নির্মাণকাজের প্রতারণা'। স্বাধীনতার পর থেকে প্রতিনিয়ত সামাজিক অবক্ষয় ও শ্রেণীবৈষম্য শুধু বৃদ্ধিই পেয়েছে; আর সামনের দিনগুলোতে যে এই প্রক্রিয়ার রেশ থাকবে তা বলাই বাহুল্য।
এমতাবস্থায়, সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অধিকার অর্জনের লক্ষ্যে উভয় দেশের নাগরিকরা পুনরায় এমন আন্দোলনে জড়ালে মোটেই অবাক হবার কিছু থাকবে না। ফলে আগামীর দিনগুলো জালেম সরকারগুলোর জন্য আসলেই হবে পরীক্ষার এক সময়।
আবার ওদিকে আন্দোলনকারীরা যদি যথেষ্ট বুদ্ধিমান এবং বাস্তববাদী হন, তাহলে এই বৈশিষ্ট্যই তাদের ভূ-রাজনীতি বুঝতে শেখাবে। যেটা কাজে লাগবে দেশকে ইসলামিক প্রশাসনিক ধারা তৈরির সঠিক কর্মকৌশল ঠিক করার ক্ষেত্রে। তাই পরিস্থিতি শুধু শঙ্কা এবং হতাশার নয়, হতে পারে আশারও।
Comment