কিতাবুল্লাহ ও হুকুমত:
পারস্পরিক সঙ্গতি ও অসঙ্গতি
রাজনৈতিক বিপর্যয় এবং মুসলমানদের ইতিহাসে এর প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে কিছু পর্যবেক্ষণ ও ভাবনা
(প্রথম খণ্ড)
-শাইখ আইমান আয-যাওয়াহিরী হাফিযাহুল্লাহ
মূল প্রকাশনায়:
আস-সাহাব মিডিয়া (উপমহাদেশ)
সফর ১৪৪৩ হিজরী মোতাবেক সেপ্টেম্বর ২০২১ ঈসায়ী
দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ:
একমাত্র আল্লাহ সুবহানাহুওয়া তা'আলা কর্তৃক শাসনের অধিকার অবধারিতভাবে সংরক্ষিত থাকার ব্যাপারে শরীয়তের দলীল-প্রমাণসমূহের সংক্ষিপ্ত উপস্থাপন
একমাত্র আল্লাহ সুবহানাহুওয়া তা'আলার কাছে বিচার প্রার্থনা করা আর তার প্রক্রিয়া হিসেবে আল্লাহ কর্তৃক অবতীর্ণ কিতাব ও সুন্নতে নববীতে যে শরীয়ত বিধৃত, তদনুযায়ী বিচার-ফয়সালা করা তাওহীদি আকীদার একটি শক্ত খুঁটি ও মৌলিক ভিত্তি। এই ভিত্তি নির্মিত না হলে তাওহীদ অস্তিত্বে আসতে পারে না। যুগ যুগ ধরে হক ও বাতিলের মধ্যকার সংঘাত ইসলামের এই আকীদাকে ঘিরেই। প্রশ্ন একটাই। শাসন ক্ষমতা ও বিধান দেবার অধিকার কার? একমাত্র আল্লাহ সুবহানাহুওয়া তা'আলার নাকি আল্লাহ ভিন্ন অন্যান্য শরিক ও অংশীদারের? ইতিহাসের ধারাবাহিকতায় বর্তমান যুগেও ইসলামের যুদ্ধ অতি গুরুত্বপূর্ণ এই প্রশ্নের সমাধানের জন্যই। মুসলমানরা এবং তাদের শত্রুরা তাওহীদের ভিত্তিমূল সমূহের মধ্যে থেকে অতি গুরুত্বপূর্ণ এই স্তম্ভকে ঘিরেই আজ পরস্পর যুদ্ধরত।
এমনিভাবে আজ পর্যন্ত সমকালীন যতগুলো ইসলামী আন্দোলন সাফল্য লাভ করেছে অথবা ব্যর্থ হয়েছে, তাদের সেই সাফল্য ও ব্যর্থতার মাপকাঠি এটাই ছিল যে, তারা ঈমানের স্তম্ভ কতটা নির্মাণ করতে পেরেছে, আর কতটা করতে পারেনি।
ইসলামী আকীদার মৌলিক এই স্তম্ভ সম্পর্কে আমি সংক্ষেপে কিছু আলোকপাত করব।
এ বিষয়ে আমি আমার আলোচনাকে কয়েক ভাগে বিভক্ত করব:
*প্রথম বিষয়: কুরআনে কারীম থেকে দলীল-প্রমাণ উপস্থাপন
*দ্বিতীয় বিষয়: পবিত্র সুন্নতে নববী থেকে দলীল-প্রমাণ উপস্থাপন
*তৃতীয় বিষয়: কতক আলিমের উক্তি
***
প্রথম বিষয়:
কুরআনে কারীম থেকে দলীল-প্রমাণ উপস্থাপন
১) আল্লাহ সুবহানাহুওয়া তা‘আলা ইরশাদ করেন—
﴿ أَلَمْ تَرَ إِلَى الَّذِينَ يَزْعُمُونَ أَنَّهُمْ آمَنُواْ بِمَا أُنزِلَ إِلَيْكَ وَمَا أُنزِلَ مِن قَبْلِكَ يُرِيدُونَ أَن يَتَحَاكَمُواْ إِلَى الطَّاغُوتِ وَقَدْ أُمِرُواْ أَن يَكْفُرُواْ بِهِ وَيُرِيدُ الشَّيْطَانُ أَن يُضِلَّهُمْ ضَلاَلاً بَعِيدًا (60) وَإِذَا قِيلَ لَهُمْ تَعَالَوْاْ إِلَى مَا أَنزَلَ اللَّهُ وَإِلَى الرَّسُولِ رَأَيْتَ الْمُنَافِقِينَ يَصُدُّونَ عَنكَ صُدُودًا (61) فَكَيْفَ إِذَا أَصَابَتْهُم مُّصِيبَةٌ بِمَا قَدَّمَتْ أَيْدِيهِمْ ثُمَّ جَآؤُوكَ يَحْلِفُونَ بِاللَّهِ إِنْ أَرَدْنَا إِلاَّ إِحْسَانًا وَتَوْفِيقًا (62) أُولَئِكَ الَّذِينَ يَعْلَمُ اللَّهُ مَا فِي قُلُوبِهِمْ فَأَعْرِضْ عَنْهُمْ وَعِظْهُمْ وَقُل لَّهُمْ فِي أَنفُسِهِمْ قَوْلاً بَلِيغًا (63) وَمَا أَرْسَلْنَا مِن رَّسُولٍ إِلاَّ لِيُطَاعَ بِإِذْنِ اللَّهِ وَلَوْ أَنَّهُمْ إِذ ظَّلَمُواْ أَنفُسَهُمْ جَآؤُوكَ فَاسْتَغْفَرُواْ اللَّهَ وَاسْتَغْفَرَ لَهُمُ الرَّسُولُ لَوَجَدُواْ اللَّهَ تَوَّابًا رَّحِيمًا (64) فَلاَ وَرَبِّكَ لاَ يُؤْمِنُونَ حَتَّىَ يُحَكِّمُوكَ فِيمَا شَجَرَ بَيْنَهُمْ ثُمَّ لاَ يَجِدُواْ فِي أَنفُسِهِمْ حَرَجًا مِّمَّا قَضَيْتَ وَيُسَلِّمُواْ تَسْلِيمًا﴾[1]
উপরোক্ত আয়াতগুলোর তাফসীরে ইবনে জারীর তাবারী রহিমাহুল্লাহ বলেন: “আল্লাহ সুবহানাহুওয়া তা‘আলা বোঝাতে চাচ্ছেন, হে মুহাম্মদ! আপনি কি অন্তর্চক্ষু দিয়ে সেই মানুষগুলোর অবস্থা দেখে বুঝতে পারেননি, যারা দাবি করে, তারা আপনার নিকট যে কিতাব অবতীর্ণ হয়েছে তার প্রতি বিশ্বস্ত ও সত্যনিষ্ঠ; আর সে সমস্ত মানুষ যারা দাবি করে, তারা আপনার পূর্বে অবতীর্ণ কিতাবসমূহের প্রতি ঈমান এনেছে, এই মানুষগুলো নিজেদের দ্বন্দ্ব-বিবাদগুলোতে তাগুতের কাছে বিচার চায় অর্থাৎ আল্লাহর হুকুম ও বিচারের পরিবর্তে অন্য যেগুলোকে তারা সম্মান করে, শ্রদ্ধা করে, অন্য যে ব্যবস্থার প্রতি তারা সম্মতি প্রকাশ করে এবং যেই আইনকে তারা সর্বোচ্চ জ্ঞান করে, সেগুলোই তাগুত। আর সেই তাগুতের কাছে তারা বিচার নিয়ে যায় {অথচ তাদের প্রতি নির্দেশ হয়েছে, যাতে তারা ওকে মান্য না করে তথা তাগুতের প্রতি কুফরি করে} অর্থাৎ, আল্লাহ সুবহানাহুওয়া তা‘আলা বলতে চাচ্ছেন, আল্লাহ নির্দেশ দিয়েছেন, তাদের বিচার প্রার্থনা স্থল তাগুত তাদেরকে যে বিচার ও ফয়সালা প্রদান করে, সেগুলো যেন তারা প্রত্যাখ্যান করে। অথচ আল্লাহর আদেশ অমান্য করে তারা শয়তানের পদাঙ্ক অনুসরণ করেছে।[2]”
শাইখুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া রহিমাহুল্লাহ বলেন, “আরবি শব্দ ব্যাকরণে তাগুত শব্দটি طغيان শব্দ থেকে فعلوت. যেমনিভাবে ملكوت শব্দটি ملك থেকে فعلوت. তেমনিভাবে الرحموت والرهبوت والرغبوت -এর মধ্য থেকে প্রতিটি শব্দ যথাক্রমে الرحمة والرهبة والرغبة থেকে فعلوت তথা একই কাঠামোর শব্দ।
আর সীমালংঘন করাকে বলা হয় الطغيان. অর্থাৎ জুলুম ও বিরুদ্ধাচরণ। অতএব আল্লাহ ভিন্ন অন্য কোন কিছু যদি নিজের উপাসিত হওয়াকে অপছন্দ না করে তবেই সে তাগুত। এ কারণেই সহীহ হাদিসে নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মূর্তিকে তাগুত বলেছেন। হাদিসে এভাবে এসেছে—
“আর যারা তাগুতের এবাদত করত, তারা তাগুত'দেরকে অনুসরণ করবে।” মোটকথা আল্লাহর নাফরমানি করে যার আনুগত্য করা হয়, হেদায়েত ও দ্বীন ইসলাম ভিন্ন অন্য কিছুতে যাদেরকে অনুসরণ করা হয়, চাই আল্লাহর কিতাব বিরোধী তার প্রদত্ত কোন সংবাদ ভক্তবৃন্দের কাছে সত্য বলে বিবেচিত হোক, অথবা আল্লাহর নির্দেশ বিরোধী তার কোনো নির্দেশ পালিত হোক, সেই তাগুত।
এ কারণে যদি কারো কাছে বিচার চাওয়া হয় আর সে আল্লাহর কিতাব ভিন্ন অন্য কোন আইন দ্বারা বিচার করে তবে তাকে তাগুত বলা হয়েছে।[3]
উস্তায সাইয়্যেদ কুতুব শহীদ (আমরা তাঁর শাহাদাতের আশা রাখি) রহিমাহুল্লাহ উপরোক্ত আয়াতগুলোর তাফসীরে লিখেন—
“ঈমানের শর্ত, ইসলামের সীমারেখা, মুসলিম উম্মাহর মৌলিক জীবনব্যবস্থা, আইন ও বিধান প্রণয়ন ও সংবিধান রচনার ভিত্তি ইত্যাদি বর্ণনার মাধ্যমে যখন এক প্রসঙ্গে আলোচনা শেষ হলো, এ পর্যায়ে সে সমস্ত লোকের আলোচনা আনা হলো যারা মৌলিক এই ভিত্তি থেকে বিচ্যুত। তথাপি তারা দাবি করে যে তারা ঈমানদার। অথচ তারা ঈমানের শর্ত ও ইসলামের সীমারেখা লঙ্ঘনকারী। কারণ তারা আল্লাহর শরীয়ত ভিন্ন অন্য আইনের কাছে বিচার নিয়ে যেতে চায়। তারা তাগুতের কাছে বিচার নিয়ে যায় অথচ তাদেরকে আদেশ করা হয়েছে তাগুতের প্রতি কুফুরি করতে।
তাদের আলোচনা আনা হয়েছে তাদের ব্যাপারে বিস্ময় প্রকাশ করার জন্য। তাদের আলোচনা তাদের আচার আচরণের প্রতি ঘৃণা প্রকাশের জন্য। সেই সঙ্গে এই আলোচনার উদ্দেশ্য হলো, তাদেরকে এবং তাদের মত অন্যদেরকে এ ব্যাপারে সতর্ক করা যে, শয়তান তাদেরকে বিভ্রান্ত করতে চায়।
আয়াতে তাদের সে সময়ের অবস্থা বর্ণনা করা হয়েছে, যখন তাদেরকে আল্লাহর অবতীর্ণ বিধান ও রাসূলের ফয়সালার প্রতি আহ্বান করা হয় আর তারা প্রত্যাখ্যান করে। তাদের এই প্রত্যাখানকে মুনাফেকি আখ্যা দান করা হয়েছে। আর তাগুতের কাছে বিচার নিয়ে যাওয়ার ইচ্ছাকে ঈমান থেকে বহিস্কৃত হবার কারণ বলা হয়েছে। বরং ঈমানের সীমারেখা ছেড়ে বেরিয়ে যাবে কি, তারা তো পূর্ব থেকেই কখনো ঈমানের সীমারেখায় প্রবেশ করেনি এমনটা বলা হয়েছে। ..............
আল্লাহর মানহাজ ও শরীয়তের বিচার মেনে নিতে অপ্রস্তুত প্রতিটা মানুষের দাবি সদাসর্বদা এমনই হয়ে থাকে। আল্লাহর শরীয়তের বিধান মেনে নেবার দরুন বিভিন্ন সমস্যা তৈরি, প্রতিকূলতা সৃষ্টি এবং দুঃখ কষ্টের মুখোমুখি হবার কথা তারা বলে থাকে, যা তারা এড়িয়ে চলতে চায়। তারা বিভিন্ন ধর্ম ও মতাদর্শ থেকে কিছু কিছু নিয়ে, বিভিন্ন মতবাদ ও দৃষ্টিভঙ্গি থেকে আংশিক মিলিয়ে এবং বিভিন্ন আকীদা-বিশ্বাসের জোড়াতালি দিয়ে সম্মিলিত কিছু একটা দাঁড় করাতে চায়।[4]
ঈমানদার না হয়েও যারা ঈমানের দাবি করে, যারা মুনাফিক ও মিথ্যাবাদী, তাদের যুক্তি ও অজুহাতগুলো সদাসর্বদা এমনই হয়ে থাকে! ..............................
কিন্তু এ বিষয়গুলো বর্ণনার আগে এ আয়াতে মৌলিক নীতিমালা বর্ণনা করে দেয়া হয়েছে, আর তা হলো আল্লাহ সুবহানাহুওয়া তা‘আলা রাসূলদেরকে প্রেরণ করেছে যেন তাদের আনুগত্য করা হয়। রাসূলের প্রতি আনুগত্য আল্লাহর অনুমতিক্রমেই। রাসূলদেরকে এ জন্য প্রেরণ করা হয়নি যে, তাদের বিধি নিষেধ অমান্য করা হবে। এমনিভাবে রাসূলদেরকে কেবল উপদেশদাতা ও পথ প্রদর্শক হিসেবে প্রেরণ করা হয়নি!
{বস্তুতঃ আমি একমাত্র এই উদ্দেশ্যেই রসূল প্রেরণ করেছি, যাতে আল্লাহর নির্দেশানুযায়ী তাঁদের আদেশ-নিষেধ মান্য করা হয়। আর সেসব লোক যখন নিজেদের অনিষ্ট সাধন করেছিল, তখন যদি আপনার কাছে আসত অতঃপর আল্লাহর নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করত এবং রসূলও যদি তাদেরকে ক্ষমা করিয়ে দিতেন। অবশ্যই তারা আল্লাহকে ক্ষমাকারী, মেহেরবানরূপে পেত। }
আসলেই এটা একটা ওজনদার বাস্তবতা। রাসূলগণ নিছক ওয়াজকারী নন। তারা তাদের বক্তব্য শুনিয়ে চলে যাবেন আর আমরা বসেই থাকবো এরকম নয়। মানুষের উপর রাসূলদের কোন কর্তৃত্ব থাকবে না; নিজেদের খেয়ালখুশিমতো মানুষকে চলতে দেয়া হবে, তা কখনোই নয় যেমনটা ধোঁকাবাজ লোকেরা বলে থাকে রাসূলদের ও দ্বীনের বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে। অথবা যারা ‘দ্বীন’ শব্দের মর্ম বোঝেনি তারাই একথা বলতে পারে।
দ্বীন হল একটা জীবনব্যবস্থা। বাস্তব জীবনব্যবস্থা। এতে রয়েছে নিজস্ব নিয়ম-নীতি, আচার-রীতি, নিজস্ব আকীদা-বিশ্বাস, জীবন বান্ধব স্বতন্ত্র নীতিমালা, নিজস্ব ইবাদত পদ্ধতি ও নিদর্শনাবলী ইত্যাদি।
আর এসব কিছুর দাবী হল, যিনি রাসূল হবেন তাঁর কর্তৃত্ব থাকতে হবে। রাসূল সেই কর্তৃত্বের মাধ্যমে মানহাজ বাস্তবায়ন করবেন। সেই কর্তৃত্ব দেখে জনমানুষ তাঁর আনুগত্য করবে, তাঁকে মান্য করবে এবং তাঁর নির্দেশাবলী বাস্তবায়ন করবে। আল্লাহ তা'আলা তাঁদেরকে প্রেরণ করেছেন যেন তাঁদের আনুগত্য করা হয়। এ আনুগত্য হবে আল্লাহর অনুমতিক্রমে এবং তাঁর শরীয়তের সীমারেখার ভেতরে। এর উদ্দেশ্য হল আল্লাহর দ্বীনের মানহাজ বাস্তবায়ন ও প্রতিষ্ঠা করা। এটি আল্লাহর দ্বীনের সেই মানহাজ, জীবন পরিচালনার জন্য যা তিনি নির্ধারণ করেছেন। আল্লাহ তা‘আলা কোন রাসূল প্রেরণ করেননি, আল্লাহর অনুমতিক্রমে যার আনুগত্যের কথা বলা হয়নি। এ কারণে রাসূলের আনুগত্য প্রকৃতপক্ষে আল্লাহর আনুগত্য। কেবলমাত্র আবেগ উদ্দীপ্ত করা এবং মানসিকভাবে মানব সম্প্রদায়কে প্রভাবিত করার জন্য রসূলগণ প্রেরিত হননি। দ্বীনের প্রকৃতি অনুধাবনের ক্ষেত্রে এটা একটা ভ্রান্তি। রাসূল প্রেরণে আল্লাহর হেকমত ও প্রজ্ঞার সঙ্গে কিছুতেই এটা যায় না। রাসূল প্রেরণের উদ্দেশ্য হলো জীবনের একটি সুনির্দিষ্ট রীতি ও পন্থা প্রতিষ্ঠা করা। এই প্রতিষ্ঠা হতে হবে বাস্তব জীবনে। আর নয় তো রসূলের দায়িত্ব দুনিয়ায় এতটাই গৌণ যে, তিনি শুধু ওয়াজ নসিহত করে যাবেন? নিজের বক্তব্য শুনিয়ে চলে যাবেন, আর ঠাট্টাকারীরা ঠাট্টা করে যাবে, অসদাচরণকারীরা শেষ পর্যন্ত তাদের তামাশা চালিয়ে যাবে!!!
এ কারণেই ইসলামের ইতিহাসের দিকে তাকালে আমরা দেখতে পাই, তা ছিল দাওয়াত ও সৎ কাজের প্রতি আহ্বানের ইতিহাস, ছিল রাজ্য শাসন ও রাষ্ট্রপরিচালনার ইতিহাস, ছিল রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পর বিশ্বময় খেলাফত পরিচালনার ইতিহাস, যেখানে রাষ্ট্রীয় শক্তির মাধ্যমে শরীয়ত বাস্তবায়ন করা হয়েছে বিশ্বের বুকে। আর এভাবেই রাসূলের আনুগত্য করার মধ্য দিয়ে রসূল প্রেরণের ঐশী উদ্দেশ্য সাধিত হয়েছে।
দ্বীন ইসলাম পৃথিবীর বুকে ছড়িয়ে পড়ার ধারা প্রক্রিয়া কেবল এটাই যে, কোন একটি পরিবেশ বা জামাতের মাঝে রাসূলের আনুগত্য আরম্ভ হবে। অতঃপর সেই পরিবেশের মাঝে বিচিত্র পরিবর্তনের পরেও তার মূল ভিত্তি ও আদর্শ সুদৃঢ় ও সুস্থির থাকবে। সেই আদর্শ হচ্ছে, আল্লাহর মানহাজের সামনে আত্মসমর্পণ, রাসূলের মানহাজ বাস্তবায়ন, আল্লাহর শরীয়তকে শাসনতন্ত্র হিসেবে গ্রহণ, আল্লাহর পক্ষ থেকে রাসূলের আনীত বিষয়াদির অনুসরণ, একমাত্র আল্লাহ সুবহানাহুওয়া তা‘আলাকে ইলাহ্ তথা ইবাদতের উপাস্য হিসেবে গ্রহণ তথা এ কথার সাক্ষ্যদান—আল্লাহ তা‘আলা ছাড়া অন্য কেউ এবাদতের উপযুক্ত নয়; আর তারই ধারাবাহিকতায় বিধানদার একক বৈশিষ্ট্য আল্লাহ সুবহানাহুওয়া তা'আলার জন্য বিশেষায়িতকরণ, যেখানে অন্য কারো কোন অংশীদারিত্ব থাকতে পারবে না; আর ছোট-বড় যে কোন বিষয়ে তাগুতের কাছে বিচার প্রার্থনা বর্জন। ..............................
অবশেষে প্রত্যয়দীপ্ত আবশ্যকীয়তা-ব্যঞ্জক সেই ঘোষণা ব্যক্ত হচ্ছে যেখানে আল্লাহ সুবহানাহুওয়া তা‘আলা নিজের মহান সত্তার নামে শপথ করছেন যে, কোন ব্যক্তি ততক্ষণ পর্যন্ত মুমিন হতে পারবে না যতক্ষণ তার সর্ব বিষয়ে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে ফয়সালাকারী হিসেবে গ্রহণ না করবে, অতঃপর তাঁর বিচার ফায়সালা সন্তুষ্টচিত্তে মেনে না নেবে। এমতাবস্থায় তার অন্তরে কোন প্রকার সংকীর্ণতা এবং নবীজির ফয়সালা মেনে নেয়ার ব্যাপারে কোনও দ্বিধা-দ্বন্দ্ব বা সংশয় থাকতে পারবে না।
{অতএব, তোমার পালনকর্তার কসম, সে লোক ঈমানদার হবে না, যতক্ষণ না তাদের মধ্যে সৃষ্ট বিবাদের ব্যাপারে তোমাকে ন্যায়বিচারক বলে মনে না করে। অতঃপর তোমার মীমাংসার ব্যাপারে নিজের মনে কোন রকম সংকীর্ণতা পাবে না এবং তা হৃষ্টচিত্তে কবুল করে নেবে।}
আসুন! আরো একবার আমরা ঈমানের শর্ত ও ইসলামের সীমারেখা সামনে রেখে নিজেদের অবস্থা যাচাই করে দেখি। এই শর্ত ও সীমারেখা স্বয়ং আল্লাহ সুবহানাহুওয়া তা‘আলা নির্ধারণ করেছেন এবং নিজের মহান সত্তার নামে শপথ করে আমাদের কাছে সেই সীমারেখা বর্ণনা করেছেন। এরপর ঈমানের শর্ত ও ইসলামের সীমারেখা নির্ধারণের ব্যাপারে আর কোনো কথা এবং কোন প্রকার ব্যাখ্যার সুযোগ থাকতে পারে না।
এখন কেউ যদি অভদ্র তর্ক-বিতর্কে লিপ্ত হয় আর বলে, কুরআনের এই ঘোষণা যুগ বিশেষের সঙ্গে সম্বন্ধিত এবং নির্দিষ্ট কোন সম্প্রদায়ের সঙ্গে বিশেষায়িত, তবে তাদের কথা ভিন্ন। এসব কথা এমন লোকদের পক্ষে বলা সম্ভব; যারা ইসলাম সম্পর্কে কিছুই জানে না, কুরআনের ভাষারীতি ও বর্ণনাশৈলী সম্পর্কে কমবেশি কোন জ্ঞান যাদের নেই। অথচ বাস্তবতা হলো, কুরআনের উক্ত আয়াতে ইসলামের একটি মৌলিক নীতি আলোচিত হয়েছে। যে কোন শর্ত থেকে মুক্ত ও তাগিদযুক্ত একটি শপথ বাক্যের আদলে ইসলামের মূলনীতিটি কুরআনে এসেছে।
..............................
মানুষজন মুসলিম কি-না তথা তাদের ইসলাম প্রমাণিত করার জন্য যদিও এতটুকুই যথেষ্ট যে, তারা আল্লাহর শরীয়ত ও রসূলের ফয়সালা মেনে নিয়ে বিচার প্রার্থনা করে, কিন্তু এতোটুকুই কারো ঈমান প্রমাণিত করার জন্য যথেষ্ট নয় যতক্ষণ পর্যন্ত বিচার প্রার্থনাকারীরা আন্তরিকভাবে আল্লাহর রাসূলের বিচার মেনে না নেবে, সন্তুষ্টচিত্তে সেই ফায়সালা কবুল না করবে এবং শরীয়তের আলোকে প্রদত্ত সিদ্ধান্তের ব্যাপারে তাদের মন স্থির প্রশান্ত ও আশ্বস্ত না হবে।
এটাই হল আসল ইসলাম আর এটাই হল ঈমান। তাই প্রত্যেকেরই চিন্তা করা উচিত, সে কতটুকু ইসলামের সীমারেখায় রয়েছে, আর কতটুকু ঈমানের সীমারেখায় রয়েছে? ইসলাম ও ঈমানের দাবী করার পূর্বে নিজেদের অবস্থা যাচাই করে দেখা উচিত![5]”
২) আল্লাহ সুবহানাহুওয়া তা‘আলা ইরশাদ করেন—
﴿إِنَّا أَنْزَلْنَا التَّوْرَاةَ فِيهَا هُدًى وَنُورٌ يَحْكُمُ بِهَا النَّبِيُّونَ الَّذِينَ أَسْلَمُوا لِلَّذِينَ هَادُوا وَالرَّبَّانِيُّونَ وَالْأَحْبَارُ بِمَا اسْتُحْفِظُوا مِنْ كِتَابِ اللَّهِ وَكَانُوا عَلَيْهِ شُهَدَاءَ فَلَا تَخْشَوُا النَّاسَ وَاخْشَوْنِ وَلَا تَشْتَرُوا بِآيَاتِي ثَمَنًا قَلِيلًا وَمَنْ لَمْ يَحْكُمْ بِمَا أَنْزَلَ اللَّهُ فَأُولَئِكَ هُمُ الْكَافِرُونَ (44) وَكَتَبْنَا عَلَيْهِمْ فِيهَا أَنَّ النَّفْسَ بِالنَّفْسِ وَالْعَيْنَ بِالْعَيْنِ وَالْأَنْفَ بِالْأَنْفِ وَالْأُذُنَ بِالْأُذُنِ وَالسِّنَّ بِالسِّنِّ وَالْجُرُوحَ قِصَاصٌ فَمَنْ تَصَدَّقَ بِهِ فَهُوَ كَفَّارَةٌ لَهُ وَمَنْ لَمْ يَحْكُمْ بِمَا أَنْزَلَ اللَّهُ فَأُولَئِكَ هُمُ الظَّالِمُونَ (45) وَقَفَّيْنَا عَلَى آثَارِهِمْ بِعِيسَى ابْنِ مَرْيَمَ مُصَدِّقًا لِمَا بَيْنَ يَدَيْهِ مِنَ التَّوْرَاةِ وَآتَيْنَاهُ الْإِنْجِيلَ فِيهِ هُدًى وَنُورٌ وَمُصَدِّقًا لِمَا بَيْنَ يَدَيْهِ مِنَ التَّوْرَاةِ وَهُدًى وَمَوْعِظَةً لِلْمُتَّقِينَ (46) وَلْيَحْكُمْ أَهْلُ الْإِنْجِيلِ بِمَا أَنْزَلَ اللَّهُ فِيهِ وَمَنْ لَمْ يَحْكُمْ بِمَا أَنْزَلَ اللَّهُ فَأُولَئِكَ هُمُ الْفَاسِقُونَ (47) وَأَنْزَلْنَا إِلَيْكَ الْكِتَابَ بِالْحَقِّ مُصَدِّقًا لِمَا بَيْنَ يَدَيْهِ مِنَ الْكِتَابِ وَمُهَيْمِنًا عَلَيْهِ فَاحْكُمْ بَيْنَهُمْ بِمَا أَنْزَلَ اللَّهُ وَلَا تَتَّبِعْ أَهْوَاءَهُمْ عَمَّا جَاءَكَ مِنَ الْحَقِّ لِكُلٍّ جَعَلْنَا مِنْكُمْ شِرْعَةً وَمِنْهَاجًا وَلَوْ شَاءَ اللَّهُ لَجَعَلَكُمْ أُمَّةً وَاحِدَةً وَلَكِنْ لِيَبْلُوَكُمْ فِي مَا آتَاكُمْ فَاسْتَبِقُوا الْخَيْرَاتِ إِلَى اللَّهِ مَرْجِعُكُمْ جَمِيعًا فَيُنَبِّئُكُمْ بِمَا كُنْتُمْ فِيهِ تَخْتَلِفُونَ (48) وَأَنِ احْكُمْ بَيْنَهُمْ بِمَا أَنْزَلَ اللَّهُ وَلَا تَتَّبِعْ أَهْوَاءَهُمْ وَاحْذَرْهُمْ أَنْ يَفْتِنُوكَ عَنْ بَعْضِ مَا أَنْزَلَ اللَّهُ إِلَيْكَ فَإِنْ تَوَلَّوْا فَاعْلَمْ أَنَّمَا يُرِيدُ اللَّهُ أَنْ يُصِيبَهُمْ بِبَعْضِ ذُنُوبِهِمْ وَإِنَّ كَثِيرًا مِنَ النَّاسِ لَفَاسِقُونَ (49) أَفَحُكْمَ الْجَاهِلِيَّةِ يَبْغُونَ وَمَنْ أَحْسَنُ مِنَ اللَّهِ حُكْمًا لِقَوْمٍ يُوقِنُونَ﴾[6]
উস্তায সাইয়্যেদ কুতুব শহীদ (আমরা তাঁর শাহাদাতের আশা রাখি) রহিমাহুল্লাহ উপরোক্ত আয়াতগুলোর তাফসীরে বলেন—
“বিষয়টি এভাবেই স্পষ্ট হয়ে যাবে। এবাদতের উপযুক্ত একজন। স্রষ্টা একজন। মালিক একজন। অতএব, বিধানদাতা একজনই হবেন। শরীয়ত প্রণেতা একজনকেই হতে হবে। বৈধতা-অবৈধতা নির্ণয়ক একজন হবেন। আর এই কারণেই শরীয়ত একটিই হবে। মানহাজ একটিই হবে। আইন ও সংবিধান একটিই হবে। আর এরই ধারাবাহিকতায় আল্লাহর অবতীর্ণ বিষয়ের দ্বারা বিচার করতে হবে, অবতীর্ণ সেই কিতাবের অনুসরণ-অনুকরণ ও আনুগত্য করতে হবে। আর এরই নাম ঈমান ও ইসলাম। আর এর বিপরীতে রয়েছে নাফরমানি, অবাধ্যতা, বিদ্রোহ এবং আল্লাহর অবতীর্ণ কিতাব ভিন্ন অন্য আইনের সাহায্যে বিচার ফায়সালা প্রদান, যেগুলো হলো হলো কুফরি, জুলুম ও পাপাচার। এ বিষয়গুলো মেনে নেয়ার নাম হলো দ্বীন। এই দ্বীন পালনের ব্যাপারে আল্লাহ সকল বান্দা-বান্দীর কাছ থেকে প্রতিশ্রুতি গ্রহণ করেছেন। আল্লাহর পক্ষ থেকে সকল রসূল এটিই নিয়ে এসেছেন। এ বিষয়ে উম্মতে মোহাম্মদী এবং পূর্ববর্তী সকল উম্মাহ সমান ও বরাবর।
আল্লাহর অবতীর্ণ বিধি বিধান দ্বারা বিচার ফায়সালা ও শাসনতন্ত্র পরিচালনা করার নামই যে আল্লাহর দ্বীন, তা চিরায়ত ও অবধারিত বিষয়। এছাড়া অপর কিছুকে আল্লাহর দ্বীন বলার কোন সুযোগ নেই। কারণ এই সংবিধান ও আইন কানুনগুলোই তো আল্লাহর কর্তৃত্ব এবং তাঁর বিধান প্রদানের একক বৈশিষ্ট্য ও অধিকার প্রকাশের মাধ্যম। এগুলোর মাধ্যমেই তো প্রকাশ্যে প্রমাণিত হয়, লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ তথা আল্লাহ ছাড়া এবাদতের উপযুক্ত আর কেউ নেই।
এই যে আবশ্যকতা অর্থাৎ আল্লাহর দ্বীনের সঙ্গে আল্লাহর বিধি-বিধান দ্বারা শাসনতন্ত্র পরিচালনার ওতপ্রোত সম্পর্ক, তা শুধু এ কারণেই নয় যে, আল্লাহর বিধি-বিধানগুলো মানব রচিত আইন-কানুন, বিধি-বিধান ও সংবিধান অপেক্ষা মানব সম্প্রদায়ের স্বার্থেই অধিক কল্যাণকর ও শ্রেষ্ঠ; তবে হ্যাঁ, এটি আবশ্যকতার একটি কারণ বটে, কিন্তু এটিই প্রধান ও একমাত্র কারণ নয়। এই ওতপ্রোত সম্পর্কের মূল উপাদান, প্রধান উপকরণ এবং এই আবশ্যকতা তৈরির পেছনে ক্রিয়াশীল মূল কারণ হলো, আল্লাহর বিধি-বিধান দ্বারা বিচার-ফয়সালা করা ও শাসনতন্ত্র পরিচালনার দ্বারা এবাদতের উপযুক্ততা, উপাস্য হবার একক খোদায়ী বৈশিষ্ট্য স্বীকার করে নেয়া হয় এবং আল্লাহ ভিন্ন অন্য সব কিছুর ব্যাপারে এই বৈশিষ্ট্য অস্বীকার করা হয়। অর্থাৎ আল্লাহ ছাড়া অন্য কোন কিছুর এমন বৈশিষ্ট্য হতে পারে, এমন চিন্তা পুরোপুরিভাবে প্রত্যাখ্যান করা হয়।
আর এটাই হলো ইসলাম। শাব্দিক অর্থে: আত্মসমর্পণ। আর পারিভাষিক অর্থে: আল্লাহ তা‘আলার কাছে আত্মসমর্পণ, তাঁর সঙ্গে অন্য কারও এবাদতের উপযুক্ত হবার দাবি প্রত্যাখ্যান, আর উপাস্য হবার অতি বিশেষ ও গুরুত্বপূর্ণ অংশ তথা বিধান প্রণয়নের ক্ষমতা, কর্তৃত্ব, অনুগতদেরকে শাসন এবং তাদের জন্য আইন-কানুন ও নীতিমালা প্রণয়নের একচ্ছত্র অধিকারে আল্লাহর সঙ্গে অন্য যে কোন কিছুর অংশীদারিত্ব বর্জন।
অতএব, ইসলাম উপস্থিত থাকার জন্য শুধু এতোটুকুই যথেষ্ট নয় যে, মানুষ আল্লাহর শরীয়ত বান্ধব এবং আল্লাহর বিধি-বিধানের অনুরূপ নিজেদের জন্য বিভিন্ন আইন-কানুন প্রণয়ন করে নেবে অথবা সরাসরি আল্লাহর শরীয়তকেই বহাল রাখবে কিন্তু সেটার রচনাকারী হিসেবে নিজেদেরকে উপস্থাপন করবে, আল্লাহর দিকে সম্বন্ধিত না করে তাঁর শরীয়তের উপর নিজেদের সিল বসাবে; দেখা যাবে, মানুষ আল্লাহর শরীয়ত ঠিকই বাস্তবায়ন করছে কিন্তু আল্লাহর কর্তৃত্ব, শরীয়ত ও সংবিধান প্রণয়নের ব্যাপারে তাঁর একক অধিকার স্বীকার না করে এবং আল্লাহর নাম সর্বাগ্রে না রেখে নিজেদের নামে আল্লাহর শরীয়ত পরিচালনা করছে; প্রকৃতপক্ষে যেখানে আল্লাহর নির্দেশ বাস্তবায়ন করা ছাড়া আইন প্রণয়ন, সংবিধান রচনা ও একচ্ছত্র আধিপত্যে বান্দাদের কোন দখল নেই, সেখানে আল্লাহর আইন কার্যকর থাকলেও তার একচ্ছত্র কর্তৃত্বের স্বীকারোক্তি থাকবে না।[7]”
উস্তায সাইয়্যেদ কুতুব শহীদ (আমরা তাঁর শাহাদাতের আশা রাখি) রহিমাহুল্লাহ আরও বলেন:
“ইসলামী আকীদা ও মানহাজ, ইসলামী জীবন ও শাসনব্যবস্থা প্রসঙ্গে উক্ত আলোচনায় সর্বাধিক স্পর্শকাতর ও তাৎপর্যপূর্ণ একটি বিষয় এসেছে। স্পর্শকাতর সে বিষয়টি নিয়ে ইতিপূর্বে সূরা আলে ইমরান ও সূরা নিসায় আলোকপাত করা হয়েছিল। কিন্তু এই সূরায় বিশেষ গুরুত্বারোপ সহকারে জোরালোভাবে সুনির্দিষ্ট পন্থা ও আঙ্গিকে আয়াতের একেবারে মূল আক্ষরিক কাঠামোতে আলোচনা এসেছে; কেবল ভাব ও মর্ম এবং ইশারা-ইঙ্গিতকে যথেষ্ট মনে করা হয়নি।
বিষয়টি হলো শাসনতন্ত্র, সংবিধান রচনা ও শরীয়ত প্রণয়নের প্রশ্ন।
আর এরই সমাধানের ওপর নির্ভর করছে এবাদতের উপযুক্ততা নির্ধারণ এবং ঈমান ও তাওহীদের মাসআলা। আমরা ইলাহ্ তথা ইবাদতের উপযুক্ত বা উপাস্য কজনকে মানছি, আমরা তাওহীদের উপর রয়েছি কি-না, কেবলমাত্র এক আল্লাহর প্রতি আমাদের ঈমান কি-না, এমন প্রশ্নগুলোর উত্তর নির্ভর করছে নিচের এই প্রশ্নের সমাধানের উপর— শাসনতন্ত্র নির্ধারণ, শরীয়ত ও সংবিধান রচনা এবং বিচার ফায়সালা ইত্যাকার বিষয়গুলো আল্লাহর প্রতিশ্রুতি, নির্দেশনা ও শরীয়ত—যেগুলোর ওপর পর্যায়ক্রমে পূর্বেকার ঐশী ধর্মগুলোর ধারক বাহকেরা আমল করে এসেছে, সেগুলো অনুসারে চলবে? রাসূলদের উপর এবং পূর্বের রাসূলের শরীয়তের অনুগামী নবীদের উপর অবতীর্ণ ঐশী গ্রন্থাবলীর আলোকে উপরোক্ত বিষয়গুলো পরিচালিত হবে?? নাকি এই সবকিছু মানব বিবেচনাবোধ, মানুষের স্বার্থ ও কল্যাণ চিন্তা এবং জাগতিক বিভিন্ন প্রয়োজন ও দাবির আলোকে পরিচালিত হবে, যার সঙ্গে আল্লাহর শরীয়তের কোন মূলনীতির সম্পর্ক থাকবে না?? কোন এক বা একাধিক প্রজন্ম যে প্রথা প্রচলনের ব্যাপারে একমত হয়ে গেছে, সেটার আলোকেই সাধারণতন্ত্র নির্ধারিত হবে এবং বিচার ফায়সালা, মামলা-মোকদ্দমার মীমাংসা ইত্যাকার বিষয়গুলো পরিচালিত হবে?
অন্যভাবে বললে, পৃথিবীর বুকে এবং মানুষের জীবনে কর্তৃত্ব ও সর্বময় শাসন কি আল্লাহর হবে নাকি সর্বময় শাসন কিংবা আংশিক সৃষ্টিকুলের অন্য কারো অধিকারভুক্ত থাকবে, যারা মানুষের জন্য এমন আইন প্রণয়ন করবে; যার অনুমতি আল্লাহ দেননি?? ..............................
*****
(চলবে, ইন শা আল্লাহ)
পারস্পরিক সঙ্গতি ও অসঙ্গতি
রাজনৈতিক বিপর্যয় এবং মুসলমানদের ইতিহাসে এর প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে কিছু পর্যবেক্ষণ ও ভাবনা
(প্রথম খণ্ড)
-শাইখ আইমান আয-যাওয়াহিরী হাফিযাহুল্লাহ
মূল প্রকাশনায়:
আস-সাহাব মিডিয়া (উপমহাদেশ)
সফর ১৪৪৩ হিজরী মোতাবেক সেপ্টেম্বর ২০২১ ঈসায়ী
একমাত্র আল্লাহ সুবহানাহুওয়া তা'আলা কর্তৃক শাসনের অধিকার অবধারিতভাবে সংরক্ষিত থাকার ব্যাপারে শরীয়তের দলীল-প্রমাণসমূহের সংক্ষিপ্ত উপস্থাপন
একমাত্র আল্লাহ সুবহানাহুওয়া তা'আলার কাছে বিচার প্রার্থনা করা আর তার প্রক্রিয়া হিসেবে আল্লাহ কর্তৃক অবতীর্ণ কিতাব ও সুন্নতে নববীতে যে শরীয়ত বিধৃত, তদনুযায়ী বিচার-ফয়সালা করা তাওহীদি আকীদার একটি শক্ত খুঁটি ও মৌলিক ভিত্তি। এই ভিত্তি নির্মিত না হলে তাওহীদ অস্তিত্বে আসতে পারে না। যুগ যুগ ধরে হক ও বাতিলের মধ্যকার সংঘাত ইসলামের এই আকীদাকে ঘিরেই। প্রশ্ন একটাই। শাসন ক্ষমতা ও বিধান দেবার অধিকার কার? একমাত্র আল্লাহ সুবহানাহুওয়া তা'আলার নাকি আল্লাহ ভিন্ন অন্যান্য শরিক ও অংশীদারের? ইতিহাসের ধারাবাহিকতায় বর্তমান যুগেও ইসলামের যুদ্ধ অতি গুরুত্বপূর্ণ এই প্রশ্নের সমাধানের জন্যই। মুসলমানরা এবং তাদের শত্রুরা তাওহীদের ভিত্তিমূল সমূহের মধ্যে থেকে অতি গুরুত্বপূর্ণ এই স্তম্ভকে ঘিরেই আজ পরস্পর যুদ্ধরত।
এমনিভাবে আজ পর্যন্ত সমকালীন যতগুলো ইসলামী আন্দোলন সাফল্য লাভ করেছে অথবা ব্যর্থ হয়েছে, তাদের সেই সাফল্য ও ব্যর্থতার মাপকাঠি এটাই ছিল যে, তারা ঈমানের স্তম্ভ কতটা নির্মাণ করতে পেরেছে, আর কতটা করতে পারেনি।
ইসলামী আকীদার মৌলিক এই স্তম্ভ সম্পর্কে আমি সংক্ষেপে কিছু আলোকপাত করব।
এ বিষয়ে আমি আমার আলোচনাকে কয়েক ভাগে বিভক্ত করব:
*প্রথম বিষয়: কুরআনে কারীম থেকে দলীল-প্রমাণ উপস্থাপন
*দ্বিতীয় বিষয়: পবিত্র সুন্নতে নববী থেকে দলীল-প্রমাণ উপস্থাপন
*তৃতীয় বিষয়: কতক আলিমের উক্তি
কুরআনে কারীম থেকে দলীল-প্রমাণ উপস্থাপন
১) আল্লাহ সুবহানাহুওয়া তা‘আলা ইরশাদ করেন—
﴿ أَلَمْ تَرَ إِلَى الَّذِينَ يَزْعُمُونَ أَنَّهُمْ آمَنُواْ بِمَا أُنزِلَ إِلَيْكَ وَمَا أُنزِلَ مِن قَبْلِكَ يُرِيدُونَ أَن يَتَحَاكَمُواْ إِلَى الطَّاغُوتِ وَقَدْ أُمِرُواْ أَن يَكْفُرُواْ بِهِ وَيُرِيدُ الشَّيْطَانُ أَن يُضِلَّهُمْ ضَلاَلاً بَعِيدًا (60) وَإِذَا قِيلَ لَهُمْ تَعَالَوْاْ إِلَى مَا أَنزَلَ اللَّهُ وَإِلَى الرَّسُولِ رَأَيْتَ الْمُنَافِقِينَ يَصُدُّونَ عَنكَ صُدُودًا (61) فَكَيْفَ إِذَا أَصَابَتْهُم مُّصِيبَةٌ بِمَا قَدَّمَتْ أَيْدِيهِمْ ثُمَّ جَآؤُوكَ يَحْلِفُونَ بِاللَّهِ إِنْ أَرَدْنَا إِلاَّ إِحْسَانًا وَتَوْفِيقًا (62) أُولَئِكَ الَّذِينَ يَعْلَمُ اللَّهُ مَا فِي قُلُوبِهِمْ فَأَعْرِضْ عَنْهُمْ وَعِظْهُمْ وَقُل لَّهُمْ فِي أَنفُسِهِمْ قَوْلاً بَلِيغًا (63) وَمَا أَرْسَلْنَا مِن رَّسُولٍ إِلاَّ لِيُطَاعَ بِإِذْنِ اللَّهِ وَلَوْ أَنَّهُمْ إِذ ظَّلَمُواْ أَنفُسَهُمْ جَآؤُوكَ فَاسْتَغْفَرُواْ اللَّهَ وَاسْتَغْفَرَ لَهُمُ الرَّسُولُ لَوَجَدُواْ اللَّهَ تَوَّابًا رَّحِيمًا (64) فَلاَ وَرَبِّكَ لاَ يُؤْمِنُونَ حَتَّىَ يُحَكِّمُوكَ فِيمَا شَجَرَ بَيْنَهُمْ ثُمَّ لاَ يَجِدُواْ فِي أَنفُسِهِمْ حَرَجًا مِّمَّا قَضَيْتَ وَيُسَلِّمُواْ تَسْلِيمًا﴾[1]
উপরোক্ত আয়াতগুলোর তাফসীরে ইবনে জারীর তাবারী রহিমাহুল্লাহ বলেন: “আল্লাহ সুবহানাহুওয়া তা‘আলা বোঝাতে চাচ্ছেন, হে মুহাম্মদ! আপনি কি অন্তর্চক্ষু দিয়ে সেই মানুষগুলোর অবস্থা দেখে বুঝতে পারেননি, যারা দাবি করে, তারা আপনার নিকট যে কিতাব অবতীর্ণ হয়েছে তার প্রতি বিশ্বস্ত ও সত্যনিষ্ঠ; আর সে সমস্ত মানুষ যারা দাবি করে, তারা আপনার পূর্বে অবতীর্ণ কিতাবসমূহের প্রতি ঈমান এনেছে, এই মানুষগুলো নিজেদের দ্বন্দ্ব-বিবাদগুলোতে তাগুতের কাছে বিচার চায় অর্থাৎ আল্লাহর হুকুম ও বিচারের পরিবর্তে অন্য যেগুলোকে তারা সম্মান করে, শ্রদ্ধা করে, অন্য যে ব্যবস্থার প্রতি তারা সম্মতি প্রকাশ করে এবং যেই আইনকে তারা সর্বোচ্চ জ্ঞান করে, সেগুলোই তাগুত। আর সেই তাগুতের কাছে তারা বিচার নিয়ে যায় {অথচ তাদের প্রতি নির্দেশ হয়েছে, যাতে তারা ওকে মান্য না করে তথা তাগুতের প্রতি কুফরি করে} অর্থাৎ, আল্লাহ সুবহানাহুওয়া তা‘আলা বলতে চাচ্ছেন, আল্লাহ নির্দেশ দিয়েছেন, তাদের বিচার প্রার্থনা স্থল তাগুত তাদেরকে যে বিচার ও ফয়সালা প্রদান করে, সেগুলো যেন তারা প্রত্যাখ্যান করে। অথচ আল্লাহর আদেশ অমান্য করে তারা শয়তানের পদাঙ্ক অনুসরণ করেছে।[2]”
শাইখুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া রহিমাহুল্লাহ বলেন, “আরবি শব্দ ব্যাকরণে তাগুত শব্দটি طغيان শব্দ থেকে فعلوت. যেমনিভাবে ملكوت শব্দটি ملك থেকে فعلوت. তেমনিভাবে الرحموت والرهبوت والرغبوت -এর মধ্য থেকে প্রতিটি শব্দ যথাক্রমে الرحمة والرهبة والرغبة থেকে فعلوت তথা একই কাঠামোর শব্দ।
আর সীমালংঘন করাকে বলা হয় الطغيان. অর্থাৎ জুলুম ও বিরুদ্ধাচরণ। অতএব আল্লাহ ভিন্ন অন্য কোন কিছু যদি নিজের উপাসিত হওয়াকে অপছন্দ না করে তবেই সে তাগুত। এ কারণেই সহীহ হাদিসে নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মূর্তিকে তাগুত বলেছেন। হাদিসে এভাবে এসেছে—
“আর যারা তাগুতের এবাদত করত, তারা তাগুত'দেরকে অনুসরণ করবে।” মোটকথা আল্লাহর নাফরমানি করে যার আনুগত্য করা হয়, হেদায়েত ও দ্বীন ইসলাম ভিন্ন অন্য কিছুতে যাদেরকে অনুসরণ করা হয়, চাই আল্লাহর কিতাব বিরোধী তার প্রদত্ত কোন সংবাদ ভক্তবৃন্দের কাছে সত্য বলে বিবেচিত হোক, অথবা আল্লাহর নির্দেশ বিরোধী তার কোনো নির্দেশ পালিত হোক, সেই তাগুত।
এ কারণে যদি কারো কাছে বিচার চাওয়া হয় আর সে আল্লাহর কিতাব ভিন্ন অন্য কোন আইন দ্বারা বিচার করে তবে তাকে তাগুত বলা হয়েছে।[3]
উস্তায সাইয়্যেদ কুতুব শহীদ (আমরা তাঁর শাহাদাতের আশা রাখি) রহিমাহুল্লাহ উপরোক্ত আয়াতগুলোর তাফসীরে লিখেন—
“ঈমানের শর্ত, ইসলামের সীমারেখা, মুসলিম উম্মাহর মৌলিক জীবনব্যবস্থা, আইন ও বিধান প্রণয়ন ও সংবিধান রচনার ভিত্তি ইত্যাদি বর্ণনার মাধ্যমে যখন এক প্রসঙ্গে আলোচনা শেষ হলো, এ পর্যায়ে সে সমস্ত লোকের আলোচনা আনা হলো যারা মৌলিক এই ভিত্তি থেকে বিচ্যুত। তথাপি তারা দাবি করে যে তারা ঈমানদার। অথচ তারা ঈমানের শর্ত ও ইসলামের সীমারেখা লঙ্ঘনকারী। কারণ তারা আল্লাহর শরীয়ত ভিন্ন অন্য আইনের কাছে বিচার নিয়ে যেতে চায়। তারা তাগুতের কাছে বিচার নিয়ে যায় অথচ তাদেরকে আদেশ করা হয়েছে তাগুতের প্রতি কুফুরি করতে।
তাদের আলোচনা আনা হয়েছে তাদের ব্যাপারে বিস্ময় প্রকাশ করার জন্য। তাদের আলোচনা তাদের আচার আচরণের প্রতি ঘৃণা প্রকাশের জন্য। সেই সঙ্গে এই আলোচনার উদ্দেশ্য হলো, তাদেরকে এবং তাদের মত অন্যদেরকে এ ব্যাপারে সতর্ক করা যে, শয়তান তাদেরকে বিভ্রান্ত করতে চায়।
আয়াতে তাদের সে সময়ের অবস্থা বর্ণনা করা হয়েছে, যখন তাদেরকে আল্লাহর অবতীর্ণ বিধান ও রাসূলের ফয়সালার প্রতি আহ্বান করা হয় আর তারা প্রত্যাখ্যান করে। তাদের এই প্রত্যাখানকে মুনাফেকি আখ্যা দান করা হয়েছে। আর তাগুতের কাছে বিচার নিয়ে যাওয়ার ইচ্ছাকে ঈমান থেকে বহিস্কৃত হবার কারণ বলা হয়েছে। বরং ঈমানের সীমারেখা ছেড়ে বেরিয়ে যাবে কি, তারা তো পূর্ব থেকেই কখনো ঈমানের সীমারেখায় প্রবেশ করেনি এমনটা বলা হয়েছে।
পুরো প্রসঙ্গের উপসংহারে আল্লাহ সুবহানাহুওয়া তা‘আলা কর্তৃক রাসূলদেরকে প্রেরণের উদ্দেশ্য বলা হয়েছে আর তা হল, রাসূলদেরকে যেন অনুসরণ করা হয়। উপসংহারের শেষাংশে ঈমানের শর্ত ও ইসলামের সীমারেখা দ্ব্যর্থহীনভাবে পুনর্ব্যক্ত করা হয়েছে।
..............................—{আপনি কি তাদেরকে দেখেননি, যারা দাবী করে যে, যা আপনার প্রতি অবর্তীর্ণ হয়েছে আমরা সে বিষয়ের উপর ঈমান এনেছি এবং আপনার পূর্বে যা অবর্তীণ হয়েছে। তারা বিরোধীয় বিষয়কে শয়তানের দিকে নিয়ে যেতে চায়, অথচ তাদের প্রতি নির্দেশ হয়েছে, যাতে তারা ওকে মান্য না করে। পক্ষান্তরে শয়তান তাদেরকে প্রতারিত করে পথভ্রষ্ট করে ফেলতে চায়।}-
আপনি কি এই অত্যাশ্চর্য ও বিস্ময়কর বিষয় দেখেননি? এক সম্প্রদায় ঈমান আনার দাবি করছে অথচ একই সময়ে তারা এই দাবি বিরোধী কাজে লিপ্ত?! এক সম্প্রদায় দাবি করছে তারা আপনার নিকট অবতীর্ণ কিতাব এবং আপনার পূর্বে অবতীর্ণ অন্য সকল কিতাবের প্রতি ঈমান এনেছে তথাপি তারা আপনার নিকট অবতীর্ণ কিতাব এবং আপনার পূর্বে অবতীর্ণ অন্য সকল কিতাবের বিধান অনুযায়ী বিচার মেনে নিতে চাচ্ছে না। তারা অপর কোন আইনের দ্বারা, অপর কোনো মানহাজের দ্বারা এবং শরীয়ত ভিন্ন বিচার প্রক্রিয়া দ্বারা ফয়সালা করা হোক এমনটা চাচ্ছে।
তারা তাগুতের কাছে বিচার নিয়ে যেতে চাচ্ছে। যে তাগুত আপনার নিকট অবতীর্ণ কিতাব এবং আপনার পূর্বে অবতীর্ণ অন্যান্য কিতাবাদিতে বর্ণিত আল্লাহর আইনের ব্যাপারে কোনো পরোয়া করে না সেই তাগুতের কাছে তারা যেতে চাচ্ছে; যেই তাগুতি ব্যবস্থায় আপনার নিকট অবতীর্ণ কিতাব এবং আপনার পূর্বে অবতীর্ণ অন্যান্য আসমানী কিতাবের কোন মূলনীতি বা মাপকাঠি গৃহীতব্য নয়। আর এই কারণেই তো সেই ব্যবস্থা তাগুতি ব্যবস্থা হয়েছে। যেহেতু সে আল্লাহর একক বৈশিষ্ট্যে হস্তক্ষেপ করেছে এ কারণেই তো সে তাগুত। যেহেতু সে ব্যবস্থায় শরীয়তের মজবুত হাতল আঁকড়ে ধরার কথা নেই এ কারণেই তো সেটা তাগুতি ব্যবস্থা।
আর এই ব্যবস্থার কাছে বিচার নিয়ে যাওয়া মানুষগুলো মূর্খতার কারণে অথবা সন্দেহবশত এ কাজগুলো করছে না। তারা ভালোভাবে জেনে বুঝেই এ কাজগুলো করছে। তারা জানে এই তাগুতের কাছে বিচার নিয়ে যাওয়া হারাম এবং এর প্রতি কুফরি করার আদেশ তাদেরকে দেয়া হয়েছে। অতএব, এ বিষয়ে অজ্ঞতা বা সন্দেহের ওজর আপত্তি গ্রহণযোগ্য নয়। বরং এগুলো ইচ্ছাকৃত করা হচ্ছে। এ কারণেই তাদের দাবি আর সঠিক থাকেনি। তারা দাবি করেছিল আপনার উপর অবতীর্ণ কিতাব এবং আপনার পূর্বে অবতীর্ণ অন্যান্য কিতাবের প্রতি তারা ঈমানদার। বস্তুত শয়তান তাদেরকে এমন বিভ্রান্তিতে ফেলতে চাচ্ছে যা থেকে উঠে আসার কোন সুযোগ নেই।
শয়তান তাদেরকে এমনভাবে পথচ্যুত করে ছাড়ছে, যার দরুন তাদের ফিরে আসাটা সুদূরপরাহত।
তাগুতের কাছে বিচার নিয়ে যেতে চাওয়ার পেছনে এই কারণই নিহিত। তাদেরকে ঈমানের সীমারেখা থেকে বহিস্কৃত করার কার্যকারণ এটাই। তাগুতের কাছে বিচার নিয়ে যেতে চাওয়ার কারণেই তারা ঈমানের শর্ত লঙ্ঘন করেছে। ভয়ানক এই কারণ তাদের সামনে স্পষ্ট করে দেয়া হয়েছে যাতে তারা সতর্ক হয় এবং ফিরে আসে। সেই সঙ্গে মুসলমানদের সামনেও এই কারণ স্পষ্ট করা হয়েছে যাতে তারা সেই শ্রেণীর লোকগুলোকে চিনতে পারে, যারা এ জাতীয় কাজে লিপ্ত থেকে মুসলিম উম্মাহর মাঝে গা ঢাকা দিয়ে আছে।
আয়াতের মাঝে তাদের অবস্থার বর্ণনা ধারা চালু রেখে আরো বলা হয়েছে, যখন তাদেরকে আল্লাহর অবতীর্ণ কিতাব, রাসূলের ফয়সালা এবং রাসূলের পূর্বে অবতীর্ণ অন্যান্য কিতাবের বিধানাবলীর প্রতি আহ্বান করা হয়, তখন তারা কিরূপ আচরণ করে থাকে? এরাই আবার দাবি করে এই আসমানী কিতাবগুলোর প্রতি নাকি তারা ঈমান এনেছে।
{আর যখন আপনি তাদেরকে বলবেন, আল্লাহর নির্দেশের দিকে এসো-যা তিনি রসূলের প্রতি নাযিল করেছেন, তখন আপনি মুনাফেকদিগকে দেখবেন, ওরা আপনার কাছ থেকে সম্পূর্ণ ভাবে সরে যাচ্ছে।}
সুবাহানাল্লাহ, কি আশ্চর্যের বিষয়! মুনাফেকি এমন বিষয় যা নিজেই নিজের অবস্থা বলে দেয়। স্বভাবজাত ও চিরাচরিত বিষয়ের বিরোধিতা করে মুনাফেক নিজেই নিজের কথা জানান দেয়।
ঈমান আনয়নের পর স্বাভাবিক অবস্থায় এটাই হওয়ার কথা ছিল যে, ঈমানদার ব্যক্তি যে বিষয়ের প্রতি ঈমান এনেছে এবং যে সত্তার প্রতি ঈমান এনেছে তাঁর কাছেই বিচার নিয়ে যাবে। এখন যখন কেউ দাবি করল, সে আল্লাহর প্রতি এবং তাঁর অবতীর্ণ কিতাবের প্রতি ঈমান এনেছে, অতঃপর যখন সেই আল্লাহর কিতাব, শরীয়ত ও মানহাজ অনুযায়ী সে ব্যক্তিকে বিচার মেনে নিতে বলা হলো, তখন সর্বান্তকরণে সেই বিচার মেনে নেয়াই তো নিষ্ঠার দাবি। এখন যদি সে ব্যক্তি ওই বিচার মেনে নিতে অস্বীকার করে, তবে সে নিষ্ঠা ও স্বভাবজাত প্রবণতার পরিপন্থী কাজ করেছে বলে বিবেচিত হবে। ঈমান আনয়নের যে দাবী সে করেছে, তা মিথ্যা প্রতিপন্ন হবে।
মানুষের স্বভাবজাত ও জন্মগত সাধারণ ফিতরত দিয়েই আল্লাহ সুবহানাহুওয়া তা‘আলা ওই সমস্ত লোকদের বিচারের ভার আমাদের কাছে ন্যস্ত করছেন যারা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের প্রতি ঈমান আনয়নের দাবি করা সত্ত্বেও আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের কাছে বিচার নিয়ে যেতে ইচ্ছুক নয়। বরং তাদেরকে আহবান করা হলে তারা আল্লাহ ও তাঁর রসূলের মানহাজ প্রত্যাখ্যান করে বসে।
আয়াতের মাঝে এর পরের অংশে মুনাফিকদের বাহ্যিক আচরণের একটা চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের কাছে বিচার নিয়ে যেতে বলার আহ্বানে সাড়া না দেওয়ার কারণে অথবা তাগুতের কাছে বিচার নিয়ে যেতে চাওয়ার কারণে যখন তারা কোন সমস্যা বা বিপদে পতিত হয়, তখন তারা ওজর-আপত্তি পেশ করে। এ সমস্ত ওজর-আপত্তি মুনাফিকদের লক্ষণ— {এমতাবস্থায় যদি তাদের কৃতকর্মের দরুন বিপদ আরোপিত হয়, তবে তাতে কি হল! অতঃপর তারা আপনার কাছে আল্লাহর নামে কসম খেয়ে খেয়ে ফিরে আসবে যে, মঙ্গল ও সম্প্রীতি ছাড়া আমাদের অন্য কোন উদ্দেশ্য ছিল না। }
..............................আপনি কি এই অত্যাশ্চর্য ও বিস্ময়কর বিষয় দেখেননি? এক সম্প্রদায় ঈমান আনার দাবি করছে অথচ একই সময়ে তারা এই দাবি বিরোধী কাজে লিপ্ত?! এক সম্প্রদায় দাবি করছে তারা আপনার নিকট অবতীর্ণ কিতাব এবং আপনার পূর্বে অবতীর্ণ অন্য সকল কিতাবের প্রতি ঈমান এনেছে তথাপি তারা আপনার নিকট অবতীর্ণ কিতাব এবং আপনার পূর্বে অবতীর্ণ অন্য সকল কিতাবের বিধান অনুযায়ী বিচার মেনে নিতে চাচ্ছে না। তারা অপর কোন আইনের দ্বারা, অপর কোনো মানহাজের দ্বারা এবং শরীয়ত ভিন্ন বিচার প্রক্রিয়া দ্বারা ফয়সালা করা হোক এমনটা চাচ্ছে।
তারা তাগুতের কাছে বিচার নিয়ে যেতে চাচ্ছে। যে তাগুত আপনার নিকট অবতীর্ণ কিতাব এবং আপনার পূর্বে অবতীর্ণ অন্যান্য কিতাবাদিতে বর্ণিত আল্লাহর আইনের ব্যাপারে কোনো পরোয়া করে না সেই তাগুতের কাছে তারা যেতে চাচ্ছে; যেই তাগুতি ব্যবস্থায় আপনার নিকট অবতীর্ণ কিতাব এবং আপনার পূর্বে অবতীর্ণ অন্যান্য আসমানী কিতাবের কোন মূলনীতি বা মাপকাঠি গৃহীতব্য নয়। আর এই কারণেই তো সেই ব্যবস্থা তাগুতি ব্যবস্থা হয়েছে। যেহেতু সে আল্লাহর একক বৈশিষ্ট্যে হস্তক্ষেপ করেছে এ কারণেই তো সে তাগুত। যেহেতু সে ব্যবস্থায় শরীয়তের মজবুত হাতল আঁকড়ে ধরার কথা নেই এ কারণেই তো সেটা তাগুতি ব্যবস্থা।
আর এই ব্যবস্থার কাছে বিচার নিয়ে যাওয়া মানুষগুলো মূর্খতার কারণে অথবা সন্দেহবশত এ কাজগুলো করছে না। তারা ভালোভাবে জেনে বুঝেই এ কাজগুলো করছে। তারা জানে এই তাগুতের কাছে বিচার নিয়ে যাওয়া হারাম এবং এর প্রতি কুফরি করার আদেশ তাদেরকে দেয়া হয়েছে। অতএব, এ বিষয়ে অজ্ঞতা বা সন্দেহের ওজর আপত্তি গ্রহণযোগ্য নয়। বরং এগুলো ইচ্ছাকৃত করা হচ্ছে। এ কারণেই তাদের দাবি আর সঠিক থাকেনি। তারা দাবি করেছিল আপনার উপর অবতীর্ণ কিতাব এবং আপনার পূর্বে অবতীর্ণ অন্যান্য কিতাবের প্রতি তারা ঈমানদার। বস্তুত শয়তান তাদেরকে এমন বিভ্রান্তিতে ফেলতে চাচ্ছে যা থেকে উঠে আসার কোন সুযোগ নেই।
শয়তান তাদেরকে এমনভাবে পথচ্যুত করে ছাড়ছে, যার দরুন তাদের ফিরে আসাটা সুদূরপরাহত।
তাগুতের কাছে বিচার নিয়ে যেতে চাওয়ার পেছনে এই কারণই নিহিত। তাদেরকে ঈমানের সীমারেখা থেকে বহিস্কৃত করার কার্যকারণ এটাই। তাগুতের কাছে বিচার নিয়ে যেতে চাওয়ার কারণেই তারা ঈমানের শর্ত লঙ্ঘন করেছে। ভয়ানক এই কারণ তাদের সামনে স্পষ্ট করে দেয়া হয়েছে যাতে তারা সতর্ক হয় এবং ফিরে আসে। সেই সঙ্গে মুসলমানদের সামনেও এই কারণ স্পষ্ট করা হয়েছে যাতে তারা সেই শ্রেণীর লোকগুলোকে চিনতে পারে, যারা এ জাতীয় কাজে লিপ্ত থেকে মুসলিম উম্মাহর মাঝে গা ঢাকা দিয়ে আছে।
আয়াতের মাঝে তাদের অবস্থার বর্ণনা ধারা চালু রেখে আরো বলা হয়েছে, যখন তাদেরকে আল্লাহর অবতীর্ণ কিতাব, রাসূলের ফয়সালা এবং রাসূলের পূর্বে অবতীর্ণ অন্যান্য কিতাবের বিধানাবলীর প্রতি আহ্বান করা হয়, তখন তারা কিরূপ আচরণ করে থাকে? এরাই আবার দাবি করে এই আসমানী কিতাবগুলোর প্রতি নাকি তারা ঈমান এনেছে।
{আর যখন আপনি তাদেরকে বলবেন, আল্লাহর নির্দেশের দিকে এসো-যা তিনি রসূলের প্রতি নাযিল করেছেন, তখন আপনি মুনাফেকদিগকে দেখবেন, ওরা আপনার কাছ থেকে সম্পূর্ণ ভাবে সরে যাচ্ছে।}
সুবাহানাল্লাহ, কি আশ্চর্যের বিষয়! মুনাফেকি এমন বিষয় যা নিজেই নিজের অবস্থা বলে দেয়। স্বভাবজাত ও চিরাচরিত বিষয়ের বিরোধিতা করে মুনাফেক নিজেই নিজের কথা জানান দেয়।
ঈমান আনয়নের পর স্বাভাবিক অবস্থায় এটাই হওয়ার কথা ছিল যে, ঈমানদার ব্যক্তি যে বিষয়ের প্রতি ঈমান এনেছে এবং যে সত্তার প্রতি ঈমান এনেছে তাঁর কাছেই বিচার নিয়ে যাবে। এখন যখন কেউ দাবি করল, সে আল্লাহর প্রতি এবং তাঁর অবতীর্ণ কিতাবের প্রতি ঈমান এনেছে, অতঃপর যখন সেই আল্লাহর কিতাব, শরীয়ত ও মানহাজ অনুযায়ী সে ব্যক্তিকে বিচার মেনে নিতে বলা হলো, তখন সর্বান্তকরণে সেই বিচার মেনে নেয়াই তো নিষ্ঠার দাবি। এখন যদি সে ব্যক্তি ওই বিচার মেনে নিতে অস্বীকার করে, তবে সে নিষ্ঠা ও স্বভাবজাত প্রবণতার পরিপন্থী কাজ করেছে বলে বিবেচিত হবে। ঈমান আনয়নের যে দাবী সে করেছে, তা মিথ্যা প্রতিপন্ন হবে।
মানুষের স্বভাবজাত ও জন্মগত সাধারণ ফিতরত দিয়েই আল্লাহ সুবহানাহুওয়া তা‘আলা ওই সমস্ত লোকদের বিচারের ভার আমাদের কাছে ন্যস্ত করছেন যারা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের প্রতি ঈমান আনয়নের দাবি করা সত্ত্বেও আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের কাছে বিচার নিয়ে যেতে ইচ্ছুক নয়। বরং তাদেরকে আহবান করা হলে তারা আল্লাহ ও তাঁর রসূলের মানহাজ প্রত্যাখ্যান করে বসে।
আয়াতের মাঝে এর পরের অংশে মুনাফিকদের বাহ্যিক আচরণের একটা চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের কাছে বিচার নিয়ে যেতে বলার আহ্বানে সাড়া না দেওয়ার কারণে অথবা তাগুতের কাছে বিচার নিয়ে যেতে চাওয়ার কারণে যখন তারা কোন সমস্যা বা বিপদে পতিত হয়, তখন তারা ওজর-আপত্তি পেশ করে। এ সমস্ত ওজর-আপত্তি মুনাফিকদের লক্ষণ— {এমতাবস্থায় যদি তাদের কৃতকর্মের দরুন বিপদ আরোপিত হয়, তবে তাতে কি হল! অতঃপর তারা আপনার কাছে আল্লাহর নামে কসম খেয়ে খেয়ে ফিরে আসবে যে, মঙ্গল ও সম্প্রীতি ছাড়া আমাদের অন্য কোন উদ্দেশ্য ছিল না। }
আল্লাহর মানহাজ ও শরীয়তের বিচার মেনে নিতে অপ্রস্তুত প্রতিটা মানুষের দাবি সদাসর্বদা এমনই হয়ে থাকে। আল্লাহর শরীয়তের বিধান মেনে নেবার দরুন বিভিন্ন সমস্যা তৈরি, প্রতিকূলতা সৃষ্টি এবং দুঃখ কষ্টের মুখোমুখি হবার কথা তারা বলে থাকে, যা তারা এড়িয়ে চলতে চায়। তারা বিভিন্ন ধর্ম ও মতাদর্শ থেকে কিছু কিছু নিয়ে, বিভিন্ন মতবাদ ও দৃষ্টিভঙ্গি থেকে আংশিক মিলিয়ে এবং বিভিন্ন আকীদা-বিশ্বাসের জোড়াতালি দিয়ে সম্মিলিত কিছু একটা দাঁড় করাতে চায়।[4]
ঈমানদার না হয়েও যারা ঈমানের দাবি করে, যারা মুনাফিক ও মিথ্যাবাদী, তাদের যুক্তি ও অজুহাতগুলো সদাসর্বদা এমনই হয়ে থাকে!
কিন্তু এ বিষয়গুলো বর্ণনার আগে এ আয়াতে মৌলিক নীতিমালা বর্ণনা করে দেয়া হয়েছে, আর তা হলো আল্লাহ সুবহানাহুওয়া তা‘আলা রাসূলদেরকে প্রেরণ করেছে যেন তাদের আনুগত্য করা হয়। রাসূলের প্রতি আনুগত্য আল্লাহর অনুমতিক্রমেই। রাসূলদেরকে এ জন্য প্রেরণ করা হয়নি যে, তাদের বিধি নিষেধ অমান্য করা হবে। এমনিভাবে রাসূলদেরকে কেবল উপদেশদাতা ও পথ প্রদর্শক হিসেবে প্রেরণ করা হয়নি!
{বস্তুতঃ আমি একমাত্র এই উদ্দেশ্যেই রসূল প্রেরণ করেছি, যাতে আল্লাহর নির্দেশানুযায়ী তাঁদের আদেশ-নিষেধ মান্য করা হয়। আর সেসব লোক যখন নিজেদের অনিষ্ট সাধন করেছিল, তখন যদি আপনার কাছে আসত অতঃপর আল্লাহর নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করত এবং রসূলও যদি তাদেরকে ক্ষমা করিয়ে দিতেন। অবশ্যই তারা আল্লাহকে ক্ষমাকারী, মেহেরবানরূপে পেত। }
আসলেই এটা একটা ওজনদার বাস্তবতা। রাসূলগণ নিছক ওয়াজকারী নন। তারা তাদের বক্তব্য শুনিয়ে চলে যাবেন আর আমরা বসেই থাকবো এরকম নয়। মানুষের উপর রাসূলদের কোন কর্তৃত্ব থাকবে না; নিজেদের খেয়ালখুশিমতো মানুষকে চলতে দেয়া হবে, তা কখনোই নয় যেমনটা ধোঁকাবাজ লোকেরা বলে থাকে রাসূলদের ও দ্বীনের বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে। অথবা যারা ‘দ্বীন’ শব্দের মর্ম বোঝেনি তারাই একথা বলতে পারে।
দ্বীন হল একটা জীবনব্যবস্থা। বাস্তব জীবনব্যবস্থা। এতে রয়েছে নিজস্ব নিয়ম-নীতি, আচার-রীতি, নিজস্ব আকীদা-বিশ্বাস, জীবন বান্ধব স্বতন্ত্র নীতিমালা, নিজস্ব ইবাদত পদ্ধতি ও নিদর্শনাবলী ইত্যাদি।
আর এসব কিছুর দাবী হল, যিনি রাসূল হবেন তাঁর কর্তৃত্ব থাকতে হবে। রাসূল সেই কর্তৃত্বের মাধ্যমে মানহাজ বাস্তবায়ন করবেন। সেই কর্তৃত্ব দেখে জনমানুষ তাঁর আনুগত্য করবে, তাঁকে মান্য করবে এবং তাঁর নির্দেশাবলী বাস্তবায়ন করবে। আল্লাহ তা'আলা তাঁদেরকে প্রেরণ করেছেন যেন তাঁদের আনুগত্য করা হয়। এ আনুগত্য হবে আল্লাহর অনুমতিক্রমে এবং তাঁর শরীয়তের সীমারেখার ভেতরে। এর উদ্দেশ্য হল আল্লাহর দ্বীনের মানহাজ বাস্তবায়ন ও প্রতিষ্ঠা করা। এটি আল্লাহর দ্বীনের সেই মানহাজ, জীবন পরিচালনার জন্য যা তিনি নির্ধারণ করেছেন। আল্লাহ তা‘আলা কোন রাসূল প্রেরণ করেননি, আল্লাহর অনুমতিক্রমে যার আনুগত্যের কথা বলা হয়নি। এ কারণে রাসূলের আনুগত্য প্রকৃতপক্ষে আল্লাহর আনুগত্য। কেবলমাত্র আবেগ উদ্দীপ্ত করা এবং মানসিকভাবে মানব সম্প্রদায়কে প্রভাবিত করার জন্য রসূলগণ প্রেরিত হননি। দ্বীনের প্রকৃতি অনুধাবনের ক্ষেত্রে এটা একটা ভ্রান্তি। রাসূল প্রেরণে আল্লাহর হেকমত ও প্রজ্ঞার সঙ্গে কিছুতেই এটা যায় না। রাসূল প্রেরণের উদ্দেশ্য হলো জীবনের একটি সুনির্দিষ্ট রীতি ও পন্থা প্রতিষ্ঠা করা। এই প্রতিষ্ঠা হতে হবে বাস্তব জীবনে। আর নয় তো রসূলের দায়িত্ব দুনিয়ায় এতটাই গৌণ যে, তিনি শুধু ওয়াজ নসিহত করে যাবেন? নিজের বক্তব্য শুনিয়ে চলে যাবেন, আর ঠাট্টাকারীরা ঠাট্টা করে যাবে, অসদাচরণকারীরা শেষ পর্যন্ত তাদের তামাশা চালিয়ে যাবে!!!
এ কারণেই ইসলামের ইতিহাসের দিকে তাকালে আমরা দেখতে পাই, তা ছিল দাওয়াত ও সৎ কাজের প্রতি আহ্বানের ইতিহাস, ছিল রাজ্য শাসন ও রাষ্ট্রপরিচালনার ইতিহাস, ছিল রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পর বিশ্বময় খেলাফত পরিচালনার ইতিহাস, যেখানে রাষ্ট্রীয় শক্তির মাধ্যমে শরীয়ত বাস্তবায়ন করা হয়েছে বিশ্বের বুকে। আর এভাবেই রাসূলের আনুগত্য করার মধ্য দিয়ে রসূল প্রেরণের ঐশী উদ্দেশ্য সাধিত হয়েছে।
দ্বীন ইসলাম পৃথিবীর বুকে ছড়িয়ে পড়ার ধারা প্রক্রিয়া কেবল এটাই যে, কোন একটি পরিবেশ বা জামাতের মাঝে রাসূলের আনুগত্য আরম্ভ হবে। অতঃপর সেই পরিবেশের মাঝে বিচিত্র পরিবর্তনের পরেও তার মূল ভিত্তি ও আদর্শ সুদৃঢ় ও সুস্থির থাকবে। সেই আদর্শ হচ্ছে, আল্লাহর মানহাজের সামনে আত্মসমর্পণ, রাসূলের মানহাজ বাস্তবায়ন, আল্লাহর শরীয়তকে শাসনতন্ত্র হিসেবে গ্রহণ, আল্লাহর পক্ষ থেকে রাসূলের আনীত বিষয়াদির অনুসরণ, একমাত্র আল্লাহ সুবহানাহুওয়া তা‘আলাকে ইলাহ্ তথা ইবাদতের উপাস্য হিসেবে গ্রহণ তথা এ কথার সাক্ষ্যদান—আল্লাহ তা‘আলা ছাড়া অন্য কেউ এবাদতের উপযুক্ত নয়; আর তারই ধারাবাহিকতায় বিধানদার একক বৈশিষ্ট্য আল্লাহ সুবহানাহুওয়া তা'আলার জন্য বিশেষায়িতকরণ, যেখানে অন্য কারো কোন অংশীদারিত্ব থাকতে পারবে না; আর ছোট-বড় যে কোন বিষয়ে তাগুতের কাছে বিচার প্রার্থনা বর্জন।
অবশেষে প্রত্যয়দীপ্ত আবশ্যকীয়তা-ব্যঞ্জক সেই ঘোষণা ব্যক্ত হচ্ছে যেখানে আল্লাহ সুবহানাহুওয়া তা‘আলা নিজের মহান সত্তার নামে শপথ করছেন যে, কোন ব্যক্তি ততক্ষণ পর্যন্ত মুমিন হতে পারবে না যতক্ষণ তার সর্ব বিষয়ে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে ফয়সালাকারী হিসেবে গ্রহণ না করবে, অতঃপর তাঁর বিচার ফায়সালা সন্তুষ্টচিত্তে মেনে না নেবে। এমতাবস্থায় তার অন্তরে কোন প্রকার সংকীর্ণতা এবং নবীজির ফয়সালা মেনে নেয়ার ব্যাপারে কোনও দ্বিধা-দ্বন্দ্ব বা সংশয় থাকতে পারবে না।
{অতএব, তোমার পালনকর্তার কসম, সে লোক ঈমানদার হবে না, যতক্ষণ না তাদের মধ্যে সৃষ্ট বিবাদের ব্যাপারে তোমাকে ন্যায়বিচারক বলে মনে না করে। অতঃপর তোমার মীমাংসার ব্যাপারে নিজের মনে কোন রকম সংকীর্ণতা পাবে না এবং তা হৃষ্টচিত্তে কবুল করে নেবে।}
আসুন! আরো একবার আমরা ঈমানের শর্ত ও ইসলামের সীমারেখা সামনে রেখে নিজেদের অবস্থা যাচাই করে দেখি। এই শর্ত ও সীমারেখা স্বয়ং আল্লাহ সুবহানাহুওয়া তা‘আলা নির্ধারণ করেছেন এবং নিজের মহান সত্তার নামে শপথ করে আমাদের কাছে সেই সীমারেখা বর্ণনা করেছেন। এরপর ঈমানের শর্ত ও ইসলামের সীমারেখা নির্ধারণের ব্যাপারে আর কোনো কথা এবং কোন প্রকার ব্যাখ্যার সুযোগ থাকতে পারে না।
এখন কেউ যদি অভদ্র তর্ক-বিতর্কে লিপ্ত হয় আর বলে, কুরআনের এই ঘোষণা যুগ বিশেষের সঙ্গে সম্বন্ধিত এবং নির্দিষ্ট কোন সম্প্রদায়ের সঙ্গে বিশেষায়িত, তবে তাদের কথা ভিন্ন। এসব কথা এমন লোকদের পক্ষে বলা সম্ভব; যারা ইসলাম সম্পর্কে কিছুই জানে না, কুরআনের ভাষারীতি ও বর্ণনাশৈলী সম্পর্কে কমবেশি কোন জ্ঞান যাদের নেই। অথচ বাস্তবতা হলো, কুরআনের উক্ত আয়াতে ইসলামের একটি মৌলিক নীতি আলোচিত হয়েছে। যে কোন শর্ত থেকে মুক্ত ও তাগিদযুক্ত একটি শপথ বাক্যের আদলে ইসলামের মূলনীতিটি কুরআনে এসেছে।
মানুষজন মুসলিম কি-না তথা তাদের ইসলাম প্রমাণিত করার জন্য যদিও এতটুকুই যথেষ্ট যে, তারা আল্লাহর শরীয়ত ও রসূলের ফয়সালা মেনে নিয়ে বিচার প্রার্থনা করে, কিন্তু এতোটুকুই কারো ঈমান প্রমাণিত করার জন্য যথেষ্ট নয় যতক্ষণ পর্যন্ত বিচার প্রার্থনাকারীরা আন্তরিকভাবে আল্লাহর রাসূলের বিচার মেনে না নেবে, সন্তুষ্টচিত্তে সেই ফায়সালা কবুল না করবে এবং শরীয়তের আলোকে প্রদত্ত সিদ্ধান্তের ব্যাপারে তাদের মন স্থির প্রশান্ত ও আশ্বস্ত না হবে।
এটাই হল আসল ইসলাম আর এটাই হল ঈমান। তাই প্রত্যেকেরই চিন্তা করা উচিত, সে কতটুকু ইসলামের সীমারেখায় রয়েছে, আর কতটুকু ঈমানের সীমারেখায় রয়েছে? ইসলাম ও ঈমানের দাবী করার পূর্বে নিজেদের অবস্থা যাচাই করে দেখা উচিত![5]”
২) আল্লাহ সুবহানাহুওয়া তা‘আলা ইরশাদ করেন—
﴿إِنَّا أَنْزَلْنَا التَّوْرَاةَ فِيهَا هُدًى وَنُورٌ يَحْكُمُ بِهَا النَّبِيُّونَ الَّذِينَ أَسْلَمُوا لِلَّذِينَ هَادُوا وَالرَّبَّانِيُّونَ وَالْأَحْبَارُ بِمَا اسْتُحْفِظُوا مِنْ كِتَابِ اللَّهِ وَكَانُوا عَلَيْهِ شُهَدَاءَ فَلَا تَخْشَوُا النَّاسَ وَاخْشَوْنِ وَلَا تَشْتَرُوا بِآيَاتِي ثَمَنًا قَلِيلًا وَمَنْ لَمْ يَحْكُمْ بِمَا أَنْزَلَ اللَّهُ فَأُولَئِكَ هُمُ الْكَافِرُونَ (44) وَكَتَبْنَا عَلَيْهِمْ فِيهَا أَنَّ النَّفْسَ بِالنَّفْسِ وَالْعَيْنَ بِالْعَيْنِ وَالْأَنْفَ بِالْأَنْفِ وَالْأُذُنَ بِالْأُذُنِ وَالسِّنَّ بِالسِّنِّ وَالْجُرُوحَ قِصَاصٌ فَمَنْ تَصَدَّقَ بِهِ فَهُوَ كَفَّارَةٌ لَهُ وَمَنْ لَمْ يَحْكُمْ بِمَا أَنْزَلَ اللَّهُ فَأُولَئِكَ هُمُ الظَّالِمُونَ (45) وَقَفَّيْنَا عَلَى آثَارِهِمْ بِعِيسَى ابْنِ مَرْيَمَ مُصَدِّقًا لِمَا بَيْنَ يَدَيْهِ مِنَ التَّوْرَاةِ وَآتَيْنَاهُ الْإِنْجِيلَ فِيهِ هُدًى وَنُورٌ وَمُصَدِّقًا لِمَا بَيْنَ يَدَيْهِ مِنَ التَّوْرَاةِ وَهُدًى وَمَوْعِظَةً لِلْمُتَّقِينَ (46) وَلْيَحْكُمْ أَهْلُ الْإِنْجِيلِ بِمَا أَنْزَلَ اللَّهُ فِيهِ وَمَنْ لَمْ يَحْكُمْ بِمَا أَنْزَلَ اللَّهُ فَأُولَئِكَ هُمُ الْفَاسِقُونَ (47) وَأَنْزَلْنَا إِلَيْكَ الْكِتَابَ بِالْحَقِّ مُصَدِّقًا لِمَا بَيْنَ يَدَيْهِ مِنَ الْكِتَابِ وَمُهَيْمِنًا عَلَيْهِ فَاحْكُمْ بَيْنَهُمْ بِمَا أَنْزَلَ اللَّهُ وَلَا تَتَّبِعْ أَهْوَاءَهُمْ عَمَّا جَاءَكَ مِنَ الْحَقِّ لِكُلٍّ جَعَلْنَا مِنْكُمْ شِرْعَةً وَمِنْهَاجًا وَلَوْ شَاءَ اللَّهُ لَجَعَلَكُمْ أُمَّةً وَاحِدَةً وَلَكِنْ لِيَبْلُوَكُمْ فِي مَا آتَاكُمْ فَاسْتَبِقُوا الْخَيْرَاتِ إِلَى اللَّهِ مَرْجِعُكُمْ جَمِيعًا فَيُنَبِّئُكُمْ بِمَا كُنْتُمْ فِيهِ تَخْتَلِفُونَ (48) وَأَنِ احْكُمْ بَيْنَهُمْ بِمَا أَنْزَلَ اللَّهُ وَلَا تَتَّبِعْ أَهْوَاءَهُمْ وَاحْذَرْهُمْ أَنْ يَفْتِنُوكَ عَنْ بَعْضِ مَا أَنْزَلَ اللَّهُ إِلَيْكَ فَإِنْ تَوَلَّوْا فَاعْلَمْ أَنَّمَا يُرِيدُ اللَّهُ أَنْ يُصِيبَهُمْ بِبَعْضِ ذُنُوبِهِمْ وَإِنَّ كَثِيرًا مِنَ النَّاسِ لَفَاسِقُونَ (49) أَفَحُكْمَ الْجَاهِلِيَّةِ يَبْغُونَ وَمَنْ أَحْسَنُ مِنَ اللَّهِ حُكْمًا لِقَوْمٍ يُوقِنُونَ﴾[6]
উস্তায সাইয়্যেদ কুতুব শহীদ (আমরা তাঁর শাহাদাতের আশা রাখি) রহিমাহুল্লাহ উপরোক্ত আয়াতগুলোর তাফসীরে বলেন—
“বিষয়টি এভাবেই স্পষ্ট হয়ে যাবে। এবাদতের উপযুক্ত একজন। স্রষ্টা একজন। মালিক একজন। অতএব, বিধানদাতা একজনই হবেন। শরীয়ত প্রণেতা একজনকেই হতে হবে। বৈধতা-অবৈধতা নির্ণয়ক একজন হবেন। আর এই কারণেই শরীয়ত একটিই হবে। মানহাজ একটিই হবে। আইন ও সংবিধান একটিই হবে। আর এরই ধারাবাহিকতায় আল্লাহর অবতীর্ণ বিষয়ের দ্বারা বিচার করতে হবে, অবতীর্ণ সেই কিতাবের অনুসরণ-অনুকরণ ও আনুগত্য করতে হবে। আর এরই নাম ঈমান ও ইসলাম। আর এর বিপরীতে রয়েছে নাফরমানি, অবাধ্যতা, বিদ্রোহ এবং আল্লাহর অবতীর্ণ কিতাব ভিন্ন অন্য আইনের সাহায্যে বিচার ফায়সালা প্রদান, যেগুলো হলো হলো কুফরি, জুলুম ও পাপাচার। এ বিষয়গুলো মেনে নেয়ার নাম হলো দ্বীন। এই দ্বীন পালনের ব্যাপারে আল্লাহ সকল বান্দা-বান্দীর কাছ থেকে প্রতিশ্রুতি গ্রহণ করেছেন। আল্লাহর পক্ষ থেকে সকল রসূল এটিই নিয়ে এসেছেন। এ বিষয়ে উম্মতে মোহাম্মদী এবং পূর্ববর্তী সকল উম্মাহ সমান ও বরাবর।
আল্লাহর অবতীর্ণ বিধি বিধান দ্বারা বিচার ফায়সালা ও শাসনতন্ত্র পরিচালনা করার নামই যে আল্লাহর দ্বীন, তা চিরায়ত ও অবধারিত বিষয়। এছাড়া অপর কিছুকে আল্লাহর দ্বীন বলার কোন সুযোগ নেই। কারণ এই সংবিধান ও আইন কানুনগুলোই তো আল্লাহর কর্তৃত্ব এবং তাঁর বিধান প্রদানের একক বৈশিষ্ট্য ও অধিকার প্রকাশের মাধ্যম। এগুলোর মাধ্যমেই তো প্রকাশ্যে প্রমাণিত হয়, লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ তথা আল্লাহ ছাড়া এবাদতের উপযুক্ত আর কেউ নেই।
এই যে আবশ্যকতা অর্থাৎ আল্লাহর দ্বীনের সঙ্গে আল্লাহর বিধি-বিধান দ্বারা শাসনতন্ত্র পরিচালনার ওতপ্রোত সম্পর্ক, তা শুধু এ কারণেই নয় যে, আল্লাহর বিধি-বিধানগুলো মানব রচিত আইন-কানুন, বিধি-বিধান ও সংবিধান অপেক্ষা মানব সম্প্রদায়ের স্বার্থেই অধিক কল্যাণকর ও শ্রেষ্ঠ; তবে হ্যাঁ, এটি আবশ্যকতার একটি কারণ বটে, কিন্তু এটিই প্রধান ও একমাত্র কারণ নয়। এই ওতপ্রোত সম্পর্কের মূল উপাদান, প্রধান উপকরণ এবং এই আবশ্যকতা তৈরির পেছনে ক্রিয়াশীল মূল কারণ হলো, আল্লাহর বিধি-বিধান দ্বারা বিচার-ফয়সালা করা ও শাসনতন্ত্র পরিচালনার দ্বারা এবাদতের উপযুক্ততা, উপাস্য হবার একক খোদায়ী বৈশিষ্ট্য স্বীকার করে নেয়া হয় এবং আল্লাহ ভিন্ন অন্য সব কিছুর ব্যাপারে এই বৈশিষ্ট্য অস্বীকার করা হয়। অর্থাৎ আল্লাহ ছাড়া অন্য কোন কিছুর এমন বৈশিষ্ট্য হতে পারে, এমন চিন্তা পুরোপুরিভাবে প্রত্যাখ্যান করা হয়।
আর এটাই হলো ইসলাম। শাব্দিক অর্থে: আত্মসমর্পণ। আর পারিভাষিক অর্থে: আল্লাহ তা‘আলার কাছে আত্মসমর্পণ, তাঁর সঙ্গে অন্য কারও এবাদতের উপযুক্ত হবার দাবি প্রত্যাখ্যান, আর উপাস্য হবার অতি বিশেষ ও গুরুত্বপূর্ণ অংশ তথা বিধান প্রণয়নের ক্ষমতা, কর্তৃত্ব, অনুগতদেরকে শাসন এবং তাদের জন্য আইন-কানুন ও নীতিমালা প্রণয়নের একচ্ছত্র অধিকারে আল্লাহর সঙ্গে অন্য যে কোন কিছুর অংশীদারিত্ব বর্জন।
অতএব, ইসলাম উপস্থিত থাকার জন্য শুধু এতোটুকুই যথেষ্ট নয় যে, মানুষ আল্লাহর শরীয়ত বান্ধব এবং আল্লাহর বিধি-বিধানের অনুরূপ নিজেদের জন্য বিভিন্ন আইন-কানুন প্রণয়ন করে নেবে অথবা সরাসরি আল্লাহর শরীয়তকেই বহাল রাখবে কিন্তু সেটার রচনাকারী হিসেবে নিজেদেরকে উপস্থাপন করবে, আল্লাহর দিকে সম্বন্ধিত না করে তাঁর শরীয়তের উপর নিজেদের সিল বসাবে; দেখা যাবে, মানুষ আল্লাহর শরীয়ত ঠিকই বাস্তবায়ন করছে কিন্তু আল্লাহর কর্তৃত্ব, শরীয়ত ও সংবিধান প্রণয়নের ব্যাপারে তাঁর একক অধিকার স্বীকার না করে এবং আল্লাহর নাম সর্বাগ্রে না রেখে নিজেদের নামে আল্লাহর শরীয়ত পরিচালনা করছে; প্রকৃতপক্ষে যেখানে আল্লাহর নির্দেশ বাস্তবায়ন করা ছাড়া আইন প্রণয়ন, সংবিধান রচনা ও একচ্ছত্র আধিপত্যে বান্দাদের কোন দখল নেই, সেখানে আল্লাহর আইন কার্যকর থাকলেও তার একচ্ছত্র কর্তৃত্বের স্বীকারোক্তি থাকবে না।[7]”
উস্তায সাইয়্যেদ কুতুব শহীদ (আমরা তাঁর শাহাদাতের আশা রাখি) রহিমাহুল্লাহ আরও বলেন:
“ইসলামী আকীদা ও মানহাজ, ইসলামী জীবন ও শাসনব্যবস্থা প্রসঙ্গে উক্ত আলোচনায় সর্বাধিক স্পর্শকাতর ও তাৎপর্যপূর্ণ একটি বিষয় এসেছে। স্পর্শকাতর সে বিষয়টি নিয়ে ইতিপূর্বে সূরা আলে ইমরান ও সূরা নিসায় আলোকপাত করা হয়েছিল। কিন্তু এই সূরায় বিশেষ গুরুত্বারোপ সহকারে জোরালোভাবে সুনির্দিষ্ট পন্থা ও আঙ্গিকে আয়াতের একেবারে মূল আক্ষরিক কাঠামোতে আলোচনা এসেছে; কেবল ভাব ও মর্ম এবং ইশারা-ইঙ্গিতকে যথেষ্ট মনে করা হয়নি।
বিষয়টি হলো শাসনতন্ত্র, সংবিধান রচনা ও শরীয়ত প্রণয়নের প্রশ্ন।
আর এরই সমাধানের ওপর নির্ভর করছে এবাদতের উপযুক্ততা নির্ধারণ এবং ঈমান ও তাওহীদের মাসআলা। আমরা ইলাহ্ তথা ইবাদতের উপযুক্ত বা উপাস্য কজনকে মানছি, আমরা তাওহীদের উপর রয়েছি কি-না, কেবলমাত্র এক আল্লাহর প্রতি আমাদের ঈমান কি-না, এমন প্রশ্নগুলোর উত্তর নির্ভর করছে নিচের এই প্রশ্নের সমাধানের উপর— শাসনতন্ত্র নির্ধারণ, শরীয়ত ও সংবিধান রচনা এবং বিচার ফায়সালা ইত্যাকার বিষয়গুলো আল্লাহর প্রতিশ্রুতি, নির্দেশনা ও শরীয়ত—যেগুলোর ওপর পর্যায়ক্রমে পূর্বেকার ঐশী ধর্মগুলোর ধারক বাহকেরা আমল করে এসেছে, সেগুলো অনুসারে চলবে? রাসূলদের উপর এবং পূর্বের রাসূলের শরীয়তের অনুগামী নবীদের উপর অবতীর্ণ ঐশী গ্রন্থাবলীর আলোকে উপরোক্ত বিষয়গুলো পরিচালিত হবে?? নাকি এই সবকিছু মানব বিবেচনাবোধ, মানুষের স্বার্থ ও কল্যাণ চিন্তা এবং জাগতিক বিভিন্ন প্রয়োজন ও দাবির আলোকে পরিচালিত হবে, যার সঙ্গে আল্লাহর শরীয়তের কোন মূলনীতির সম্পর্ক থাকবে না?? কোন এক বা একাধিক প্রজন্ম যে প্রথা প্রচলনের ব্যাপারে একমত হয়ে গেছে, সেটার আলোকেই সাধারণতন্ত্র নির্ধারিত হবে এবং বিচার ফায়সালা, মামলা-মোকদ্দমার মীমাংসা ইত্যাকার বিষয়গুলো পরিচালিত হবে?
অন্যভাবে বললে, পৃথিবীর বুকে এবং মানুষের জীবনে কর্তৃত্ব ও সর্বময় শাসন কি আল্লাহর হবে নাকি সর্বময় শাসন কিংবা আংশিক সৃষ্টিকুলের অন্য কারো অধিকারভুক্ত থাকবে, যারা মানুষের জন্য এমন আইন প্রণয়ন করবে; যার অনুমতি আল্লাহ দেননি??
(চলবে, ইন শা আল্লাহ)
[1] অর্থঃ আপনি কি তাদেরকে দেখেননি, যারা দাবী করে যে, যা আপনার প্রতি অবর্তীর্ণ হয়েছে; আমরা সে বিষয়ের উপর ঈমান এনেছি এবং আপনার পূর্বে যা অবর্তীণ হয়েছে। তারা বিরোধপূর্ণ বিষয়কে শয়তানের দিকে নিয়ে যেতে চায়, অথচ তাদের প্রতি নির্দেশ হয়েছে, যাতে তারা ওকে মান্য না করে। পক্ষান্তরে শয়তান তাদেরকে প্রতারিত করে পথভ্রষ্ট করে ফেলতে চায়। আর যখন আপনি তাদেরকে বলবেন, আল্লাহর নির্দেশের দিকে এসো-যা তিনি রসূলের প্রতি নাযিল করেছেন, তখন আপনি মুনাফেকদিগকে দেখবেন, ওরা আপনার কাছ থেকে সম্পূর্ণভাবে সরে যাচ্ছে। এমতাবস্থায় যদি তাদের কৃতকর্মের দরুন বিপদ আরোপিত হয়, তবে তাতে কি হল! অতঃপর তারা আপনার কাছে আল্লাহর নামে কসম খেয়ে খেয়ে ফিরে আসবে যে, মঙ্গল ও সম্প্রীতি ছাড়া আমাদের অন্য কোন উদ্দেশ্য ছিল না। এরা হলো সে সমস্ত লোক, যাদের মনের গোপন বিষয় সম্পর্কেও আল্লাহ তা’আলা অবগত। অতএব, আপনি ওদেরকে উপেক্ষা করুন এবং ওদেরকে সদুপদেশ দিয়ে এমন কোন কথা বলুন যা তাদের জন্য কল্যাণকর। বস্তুতঃ আমি একমাত্র এই উদ্দেশ্যেই রসূল প্রেরণ করেছি, যাতে আল্লাহর নির্দেশানুযায়ী তাঁদের আদেশ-নিষেধ মান্য করা হয়। আর সেসব লোক যখন নিজেদের অনিষ্ট সাধন করেছিল, তখন যদি আপনার কাছে আসত অতঃপর আল্লাহর নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করত এবং রসূলও যদি তাদেরকে ক্ষমা করিয়ে দিতেন। অবশ্যই তারা আল্লাহকে ক্ষমাকারী, মেহেরবানরূপে পেত। অতএব, তোমার পালনকর্তার কসম, সে লোক ঈমানদার হবে না, যতক্ষণ না তাদের মধ্যে সৃষ্ট বিবাদের ব্যাপারে তোমাকে ন্যায়বিচারক বলে মনে না করে। অতঃপর তোমার মীমাংসার ব্যাপারে নিজের মনে কোন রকম সংকীর্ণতা পাবে না এবং তা হৃষ্টচিত্তে কবুল করে নেবে। (সূরা আন নিসা, আয়াত নং: ৬০-৬৫)
[2] তাফসীরে তাবারী: ৫/১৫২
[3] মাজমুউল ফাতাওয়া: ২৮/২০০, ২০১
[4] জানুয়ারির অভ্যুত্থানের পর যখন ইখওয়ানুল মুসলিমীন “শরীয়তের বিধি-বিধান আইন প্রণয়নের একমাত্র উৎস” একথা সংবিধান থেকে তুলে দিতে বাধ্য হল, এর জন্য যখন তাদেরকে জোরাজুরি করা হয়, আর এ কারণে তারাও সংবিধানে পূর্বের এই বিধি বসিয়ে দেয় যে, “শরীয়তের বিধি-বিধান ও নীতিমালা হবে আইন প্রণয়নের মৌলিক উৎস”, তখন ইখওয়ানুল মুসলিমিনের দলিল ছিল একথাই যে, এর দ্বারা তাদের স্বাদেশিক ঐক্য রক্ষা পাবে। ফলশ্রুতিতে যাদেরকে নিয়ে ঐক্য হবে তারাই ইখওয়ানুল মুসলিমীনের বিরুদ্ধে অভ্যুত্থান ঘটায়!!!! তখন পুনরায় ইখওয়ান ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
একই দলিল ও দাবির ভিত্তিতে মুহাম্মদ মুরসি ঘোষণা করেন, তার সরকার শরীয়ত বাস্তবায়ন করবে না, আমেরিকার সঙ্গে তিনি সামরিক ও নিরাপত্তা চুক্তি রক্ষার ঘোষণা করেন, ইসরাইলের সঙ্গে শান্তিচুক্তির ঘোষণা দেন, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদেরকে আশ্বস্ত করে দেন যে, তাদের অপরাধের কারণে কোন শাস্তি তাদেরকে পেতে হবে না, তখন এরা সবাই মিলে তার বিরুদ্ধে অভ্যুত্থান ঘটায়!!!
[5] তাফসীর ফী যিলালিল কুরআন: ২/৬৯৩-৬৯৭
[6] অর্থঃ আমি তওরাত অবতীর্ণ করেছি। এতে হেদায়াত ও আলো রয়েছে। আল্লাহর আজ্ঞাবহ পয়গম্বর, দরবেশ ও আলেমরা এর মাধ্যমে ইহুদীদেরকে ফয়সালা দিতেন। কেননা, তাদেরকে এ খোদায়ী গ্রন্থের দেখাশোনা করার নির্দেশ দেয়া হয়েছিল এবং তাঁরা এর রক্ষণাবেক্ষণে নিযুক্ত ছিলেন। অতএব, তোমরা মানুষকে ভয় করো না; আমাকে ভয় কর এবং আমার আয়াতসমূহের বিনিময়ে স্বল্পমূল্য গ্রহণ করো না, যেসব লোক আল্লাহ যা অবতীর্ণ করেছেন, তদনুযায়ী ফায়সালা করে না, তারাই কাফের। আমি এ গ্রন্থে তাদের প্রতি লিখে দিয়েছি যে, প্রাণের বিনিময়ে প্রাণ, চক্ষুর বিনিময়ে চক্ষু, নাকের বিনিময়ে নাক, কানের বিনিময়ে কান, দাঁতের বিনিময়ে দাঁত এবং যখমসমূহের বিনিময়ে সমান যখম। অতঃপর যে ক্ষমা করে, সে গোনাহ থেকে পাক হয়ে যায়। যেসব লোক আল্লাহ যা অবতীর্ণ করেছেন, তদনুযায়ী ফয়সালা করে না তারাই জালেম। আমি তাদের পেছনে মরিয়ম তনয় ঈসাকে প্রেরণ করেছি। তিনি পূর্ববর্তী গ্রন্থ তওরাতের সত্যায়নকারী ছিলেন। আমি তাঁকে ইঞ্জিল প্রদান করেছি। এতে হেদায়াত ও আলো রয়েছে। এটি পূর্ববতী গ্রন্থ তওরাতের সত্যায়ন করে পথ প্রদর্শন করে এবং এটি খোদাভীরুদের জন্যে হেদায়েত ও উপদেশবাণী। ইঞ্জিলের অধিকারীদের উচিত, আল্লাহ তাতে যা অবতীর্ণ করেছেন, তদনুযায়ী ফয়সালা করা। যারা আল্লাহ যা অবতীর্ণ করেছেন, তদনুযায়ী ফয়সালা করে না, তারাই পাপাচারী। আমি আপনার প্রতি অবতীর্ণ করেছি সত্যগ্রন্থ, যা পূর্ববতী গ্রন্থসমূহের সত্যায়নকারী এবং সেগুলোর বিষয়বস্তুর রক্ষণাবেক্ষণকারী। অতএব, আপনি তাদের পারস্পারিক ব্যাপারাদিতে আল্লাহ যা অবতীর্ণ করেছেন, তদনুযায়ী ফয়সালা করুন এবং আপনার কাছে যে সৎপথ এসেছে, তা ছেড়ে তাদের প্রবৃত্তির অনুসরণ করবেন না। আমি তোমাদের প্রত্যেককে একটি আইন ও পথ দিয়েছি। যদি আল্লাহ চাইতেন, তবে তোমাদের সবাইকে এক উম্মত করে দিতেন, কিন্তু এরূপ করেননি-যাতে তোমাদেরকে যে ধর্ম দিয়েছেন, তাতে তোমাদের পরীক্ষা নেন। অতএব, দৌঁড়ে কল্যাণকর বিষয়াদি অর্জন কর। তোমাদের সবাইকে আল্লাহর কাছে প্রত্যাবর্তন করতে হবে। অতঃপর তিনি অবহিত করবেন সে বিষয়, যাতে তোমরা মতবিরোধ করতে। আর আমি আদেশ করছি যে, আপনি তাদের পারস্পরিক ব্যাপারাদিতে আল্লাহ যা নাযিল করেছেন তদনুযায়ী ফয়সালা করুন; তাদের প্রবৃত্তির অনুসরণ করবেন না এবং তাদের থেকে সতর্ক থাকুন-যেন তারা আপনাকে এমন কোন নির্দেশ থেকে বিচ্যুত না করে, যা আল্লাহ আপনার প্রতি নাযিল করেছেন। অনন্তর যদি তারা মুখ ফিরিয়ে নেয়, তবে জেনে নিন, আল্লাহ তাদেরকে তাদের গোনাহের কিছু শাস্তি দিতেই চেয়েছেন। মানুষের মধ্যে অনেকেই নাফরমান। তারা কি জাহেলিয়াত আমলের ফয়সালা কামনা করে? আল্লাহ অপেক্ষা বিশ্বাসীদের জন্যে উত্তম ফয়সালাকারী কে? (সূরা আল মায়েদা:৪৪-৫০)
[7] তাফসীর ফী যিলালিল কুরআন: ২/৮২৭, ৮২৮
[2] তাফসীরে তাবারী: ৫/১৫২
[3] মাজমুউল ফাতাওয়া: ২৮/২০০, ২০১
[4] জানুয়ারির অভ্যুত্থানের পর যখন ইখওয়ানুল মুসলিমীন “শরীয়তের বিধি-বিধান আইন প্রণয়নের একমাত্র উৎস” একথা সংবিধান থেকে তুলে দিতে বাধ্য হল, এর জন্য যখন তাদেরকে জোরাজুরি করা হয়, আর এ কারণে তারাও সংবিধানে পূর্বের এই বিধি বসিয়ে দেয় যে, “শরীয়তের বিধি-বিধান ও নীতিমালা হবে আইন প্রণয়নের মৌলিক উৎস”, তখন ইখওয়ানুল মুসলিমিনের দলিল ছিল একথাই যে, এর দ্বারা তাদের স্বাদেশিক ঐক্য রক্ষা পাবে। ফলশ্রুতিতে যাদেরকে নিয়ে ঐক্য হবে তারাই ইখওয়ানুল মুসলিমীনের বিরুদ্ধে অভ্যুত্থান ঘটায়!!!! তখন পুনরায় ইখওয়ান ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
একই দলিল ও দাবির ভিত্তিতে মুহাম্মদ মুরসি ঘোষণা করেন, তার সরকার শরীয়ত বাস্তবায়ন করবে না, আমেরিকার সঙ্গে তিনি সামরিক ও নিরাপত্তা চুক্তি রক্ষার ঘোষণা করেন, ইসরাইলের সঙ্গে শান্তিচুক্তির ঘোষণা দেন, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদেরকে আশ্বস্ত করে দেন যে, তাদের অপরাধের কারণে কোন শাস্তি তাদেরকে পেতে হবে না, তখন এরা সবাই মিলে তার বিরুদ্ধে অভ্যুত্থান ঘটায়!!!
[5] তাফসীর ফী যিলালিল কুরআন: ২/৬৯৩-৬৯৭
[6] অর্থঃ আমি তওরাত অবতীর্ণ করেছি। এতে হেদায়াত ও আলো রয়েছে। আল্লাহর আজ্ঞাবহ পয়গম্বর, দরবেশ ও আলেমরা এর মাধ্যমে ইহুদীদেরকে ফয়সালা দিতেন। কেননা, তাদেরকে এ খোদায়ী গ্রন্থের দেখাশোনা করার নির্দেশ দেয়া হয়েছিল এবং তাঁরা এর রক্ষণাবেক্ষণে নিযুক্ত ছিলেন। অতএব, তোমরা মানুষকে ভয় করো না; আমাকে ভয় কর এবং আমার আয়াতসমূহের বিনিময়ে স্বল্পমূল্য গ্রহণ করো না, যেসব লোক আল্লাহ যা অবতীর্ণ করেছেন, তদনুযায়ী ফায়সালা করে না, তারাই কাফের। আমি এ গ্রন্থে তাদের প্রতি লিখে দিয়েছি যে, প্রাণের বিনিময়ে প্রাণ, চক্ষুর বিনিময়ে চক্ষু, নাকের বিনিময়ে নাক, কানের বিনিময়ে কান, দাঁতের বিনিময়ে দাঁত এবং যখমসমূহের বিনিময়ে সমান যখম। অতঃপর যে ক্ষমা করে, সে গোনাহ থেকে পাক হয়ে যায়। যেসব লোক আল্লাহ যা অবতীর্ণ করেছেন, তদনুযায়ী ফয়সালা করে না তারাই জালেম। আমি তাদের পেছনে মরিয়ম তনয় ঈসাকে প্রেরণ করেছি। তিনি পূর্ববর্তী গ্রন্থ তওরাতের সত্যায়নকারী ছিলেন। আমি তাঁকে ইঞ্জিল প্রদান করেছি। এতে হেদায়াত ও আলো রয়েছে। এটি পূর্ববতী গ্রন্থ তওরাতের সত্যায়ন করে পথ প্রদর্শন করে এবং এটি খোদাভীরুদের জন্যে হেদায়েত ও উপদেশবাণী। ইঞ্জিলের অধিকারীদের উচিত, আল্লাহ তাতে যা অবতীর্ণ করেছেন, তদনুযায়ী ফয়সালা করা। যারা আল্লাহ যা অবতীর্ণ করেছেন, তদনুযায়ী ফয়সালা করে না, তারাই পাপাচারী। আমি আপনার প্রতি অবতীর্ণ করেছি সত্যগ্রন্থ, যা পূর্ববতী গ্রন্থসমূহের সত্যায়নকারী এবং সেগুলোর বিষয়বস্তুর রক্ষণাবেক্ষণকারী। অতএব, আপনি তাদের পারস্পারিক ব্যাপারাদিতে আল্লাহ যা অবতীর্ণ করেছেন, তদনুযায়ী ফয়সালা করুন এবং আপনার কাছে যে সৎপথ এসেছে, তা ছেড়ে তাদের প্রবৃত্তির অনুসরণ করবেন না। আমি তোমাদের প্রত্যেককে একটি আইন ও পথ দিয়েছি। যদি আল্লাহ চাইতেন, তবে তোমাদের সবাইকে এক উম্মত করে দিতেন, কিন্তু এরূপ করেননি-যাতে তোমাদেরকে যে ধর্ম দিয়েছেন, তাতে তোমাদের পরীক্ষা নেন। অতএব, দৌঁড়ে কল্যাণকর বিষয়াদি অর্জন কর। তোমাদের সবাইকে আল্লাহর কাছে প্রত্যাবর্তন করতে হবে। অতঃপর তিনি অবহিত করবেন সে বিষয়, যাতে তোমরা মতবিরোধ করতে। আর আমি আদেশ করছি যে, আপনি তাদের পারস্পরিক ব্যাপারাদিতে আল্লাহ যা নাযিল করেছেন তদনুযায়ী ফয়সালা করুন; তাদের প্রবৃত্তির অনুসরণ করবেন না এবং তাদের থেকে সতর্ক থাকুন-যেন তারা আপনাকে এমন কোন নির্দেশ থেকে বিচ্যুত না করে, যা আল্লাহ আপনার প্রতি নাযিল করেছেন। অনন্তর যদি তারা মুখ ফিরিয়ে নেয়, তবে জেনে নিন, আল্লাহ তাদেরকে তাদের গোনাহের কিছু শাস্তি দিতেই চেয়েছেন। মানুষের মধ্যে অনেকেই নাফরমান। তারা কি জাহেলিয়াত আমলের ফয়সালা কামনা করে? আল্লাহ অপেক্ষা বিশ্বাসীদের জন্যে উত্তম ফয়সালাকারী কে? (সূরা আল মায়েদা:৪৪-৫০)
[7] তাফসীর ফী যিলালিল কুরআন: ২/৮২৭, ৮২৮
Comment