কিতাবুল্লাহ ও হুকুমত:
পারস্পরিক সঙ্গতি ও অসঙ্গতি
রাজনৈতিক বিপর্যয় এবং মুসলমানদের ইতিহাসে এর প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে কিছু পর্যবেক্ষণ ও ভাবনা
(প্রথম খণ্ড)
-শাইখ আইমান আয-যাওয়াহিরী হাফিযাহুল্লাহ
মূল প্রকাশনায়:
আস-সাহাব মিডিয়া (উপমহাদেশ)
সফর ১৪৪৩ হিজরী মোতাবেক সেপ্টেম্বর ২০২১ ঈসায়ী
পারস্পরিক সঙ্গতি ও অসঙ্গতি
রাজনৈতিক বিপর্যয় এবং মুসলমানদের ইতিহাসে এর প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে কিছু পর্যবেক্ষণ ও ভাবনা
(প্রথম খণ্ড)
-শাইখ আইমান আয-যাওয়াহিরী হাফিযাহুল্লাহ
মূল প্রকাশনায়:
আস-সাহাব মিডিয়া (উপমহাদেশ)
সফর ১৪৪৩ হিজরী মোতাবেক সেপ্টেম্বর ২০২১ ঈসায়ী
দ্বিতীয় বিষয়:
পবিত্র সুন্নতে নববী থেকে দলীল-প্রমাণ উপস্থাপন
ইমাম তিরমিজি রহিমাহুল্লাহু তা'আলা সহ অন্যান্য মুহাদ্দিসগণ হাসান সূত্রে আদী ইবনে হাতেম তাঈ রাযিআল্লাহু তা'আলা আনহু থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন,
" أَتَيْتُ النَّبِيَّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ وَفِي عُنُقِي صَلِيبٌ مِنْ ذَهَبٍ . فَقَالَ : " " يَا عَدِيُّ اطْرَحْ عَنْكَ هَذَا الوَثَنَ " " ، وَسَمِعْتُهُ يَقْرَأُ فِي سُورَةِ بَرَاءَةٌ : { اتَّخَذُوا أَحْبَارَهُمْ وَرُهْبَانَهُمْ أَرْبَابًا مِنْ دُونِ اللَّهِ } ، قَالَ : " " أَمَا إِنَّهُمْ لَمْ يَكُونُوا يَعْبُدُونَهُمْ ، وَلَكِنَّهُمْ كَانُوا إِذَا أَحَلُّوا لَهُمْ شَيْئًا اسْتَحَلُّوهُ ، وَإِذَا حَرَّمُوا عَلَيْهِمْ شَيْئًا حَرَّمُوهُ "
“আমি নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে এ অবস্থায় উপস্থিত হলাম যখন আমার গলায় স্বর্ণের একটি ক্রুশ ঝোলানো ছিল। তখন তিনি ইরশাদ করলেন, "হে আদী! এই মুহূর্তে এটা তোমার থেকে ফেলে দাও!" তখন আমি তাঁকে সূরা আল বারাআর এই আয়াত পাঠ করতে শুনলাম— { اتَّخَذُوا أَحْبَارَهُمْ وَرُهْبَانَهُمْ أَرْبَابًا مِنْ دُونِ اللَّهِ }—অর্থ: (তারা তাদের জ্ঞানী ব্যক্তি ও পাদ্রীদেরকে আল্লাহর পরিবর্তে রব বানিয়ে বসেছে।) তখন তিনি ইরশাদ করেন, "তারা যদিও সরাসরি তাদের ইবাদত করত না, কিন্তু যখন তারা (জ্ঞানী ব্যক্তি ও পাদ্রীরা) তাদের জন্য কোন কিছু হালাল বলে স্থির করতো, তখন তারা সেটাকে হালাল বলে মেনে নিত। আর যখন তারা কোন কিছু তাদের জন্য হারাম ঘোষণা করত, তখন তারা সেটা হারাম বলে মেনে নিত।”[1]
উক্ত হাদীসে নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আদী ইবনে হাতেম তাঈ রাযিয়াল্লাহু আনহুর সামনে সুস্পষ্টভাবে ব্যাখ্যা করে দিয়েছেন যে, আল্লাহ সুবহানাহুওয়া তা‘আলা খ্রিস্টানদেরকে মুশরিক বলে আখ্যা দিয়েছেন। তবে সেটা এই কারণে নয় যে, আল্লাহর পরিবর্তে তাদের ধর্মযাজকদের জন্য তারা প্রথাগত ইবাদত উপাসনা করত; বরং এই কারণে যে, আল্লাহর কিতাবে বর্ণিত হারাম বিষয়কে হালাল মনে করার এবং হালাল বিষয়কে হারাম মনে করার ক্ষেত্রে তারা ধর্মযাজকদের অনুসরণ করতো।
আদী ইবনে হাতেম রাযিয়াল্লাহু আনহু স্বাভাবিকভাবেই ধরে নিয়েছিলেন, কেবল প্রথাগত আচার-আচরণের মাঝেই এবাদত সীমাবদ্ধ। যেমন- সালাত আদায় করা, সিয়াম পালন করা ইত্যাদি। কিন্তু যখন তিনি মিলিয়ে দেখলেন, খ্রিস্টানরা তাদের ধর্মযাজক ও পাদ্রিদের উদ্দেশ্যে সালাত আদায় করত না, সিয়াম পালন করত না; তখন তিনি মনে করলেন, খ্রিস্টানরা তো তাহলে তাদেরকে রব বলে স্থির করেনি; কিন্তু রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর এই সংশয় দূর করে দিলেন এবং ব্যাখ্যা দিয়ে দিলেন যে, শরীয়তের বিরোধিতা করে হালাল হারাম নির্ধারণে পাদ্রীদের অনুসরণই মূলত তাদের ইবাদত বলে বিবেচিত হবে। এই অনুসরণের কারণেই ধরা হবে, তারা আল্লাহ ভিন্ন অন্যদেরকে রব বলে মেনে নিয়েছে। এই তাফসীর হুজাইফা ইবনুল ইয়ামান এবং আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহুমা থেকে বর্ণিত হয়েছে।
ইমাম তাবারী রহিমাহুল্লাহু তা‘আলা বলেন—
“আবুল বাখতারী থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, হুজাইফাকে জিজ্ঞেস করা হয়, আল্লাহ তা‘আলার এই উক্তির ব্যাপারে আপনি কি বলেন—(তারা তাদের ধর্মযাজকদেরকে রব বানিয়েছে)? তখন তিনি জবাবে বলেন, যদিও তারা তাদের জন্য সিয়াম পালন করত না এবং তাদের কাছে সালাত নিবেদন করত না, কিন্তু যখন তাদের কাছে কোন বিষয়কে হালাল বলা হতো, তখন তারা সেটা হালাল বলে মেনে নিত, আর যখন কোন বিষয়কে হারাম বলা হতো, যেটাকে আল্লাহ হালাল বলে স্থির করেছেন, তখন তারা সে বিষয়কে হারাম বলে মেনে নিত। আর এভাবেই তারা রুবুবিয়াতের ক্ষেত্রে শিরিক করে।
………………….
সুদদী থেকে বর্ণিত — { اتَّخَذُوا أَحْبَارَهُمْ وَرُهْبَانَهُمْ أَرْبَابًا مِنْ دُونِ اللَّهِ } (তারা তাদের ধর্মযাজক ও পাদ্রীদেরকে আল্লাহর পরিবর্তে রব বানিয়ে বসেছে) আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস বলেন: তারা অনুসারীদেরকে এই নির্দেশ দেয়নি, যেন তাদের উদ্দেশ্যে সিজদা নিবেদন করে। তারা তো নির্দেশ দিয়েছিল আল্লাহর নাফরমানির। আর অনুসারীরা সেই নাফরমানীর ক্ষেত্রে তাদেরকে অনুসরণ করেছিল। আর এটাকেই আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন রব বলে মেনে নেয়া।[2]
সালফে সালেহীন উলামায়ে কেরাম এই ব্যাখ্যার ব্যাপারে একমত। আমি এখানে তাদের কিছু উক্তি উদ্ধৃত করবো।
তাবারি রহিমাহুল্লাহু তা'আলা বলেন:
“{أَرْبَابًا مِنْ دُونِ اللَّهِ } (আল্লাহর ভিন্ন রব বানানো) অর্থাৎ আল্লাহ ভিন্ন নিজেদের নেতা ও বড় ব্যক্তিদেরকে আল্লাহর অবাধ্যতার ক্ষেত্রে অনুসরণ করা। ফলে আল্লাহ বান্দাদের জন্য যেটা হারাম করেছেন, বড় ব্যক্তিরা সে বিষয়কে হালাল বলে স্থির করার কারণে তা হালাল বলে মেনে নেয়া। আর আল্লাহ বান্দাদের জন্য যে বিষয় হালাল করেছেন, বড় ব্যক্তিরা সে বিষয় অনুসারীদের কাছে হারাম বলে ঘোষণা করার কারণে অনুসারীরা তা হারাম বলে মেনে নেয়া।
………………….
আয়াতের পরবর্তী অংশে আল্লাহ তা‘আলা বলছেন— {وَمَا أُمِرُوا إِلَّا لِيَعْبُدُوا إِلَٰهًا وَاحِدًا}(অথচ তাদেরকে শুধুমাত্র এক উপাস্যের ইবাদতের নির্দেশ দেয়া হয়েছে) এই বক্তব্যে আল্লাহ বোঝাতে চাচ্ছেন, ইহুদী-নাসারাদের মধ্যে যারা ধর্মযাজক, পাদ্রী ও ঈসা মসীহকে রব বানিয়ে বসেছে, তাদেরকে কেবল এক মাবুদের ইবাদত করতে এবং এক রবের আনুগত্য করতে আদেশ দেয়া হয়েছে; বহু রবের নয়। আর সেই এক মাবুদ হলেন আল্লাহ, সকল কিছুর এবাদত প্রাপ্তি এবং সকল সৃষ্টির আনুগত্য লাভ করা যার অধিকার। তাঁর একত্ব ও রুবুবিয়াত মেনে নেয়া না নেয়ার প্রেক্ষিতে সৃষ্টিকূলকে বিচার করার অধিকার তাঁর। —لَّا إِلَٰهَ إِلَّا هُو—অর্থাৎ আল্লাহ সুবহানাহুওয়া তা'আলা বোঝাতে চাচ্ছেন: উলুহিয়াত একমাত্র সেই একক সত্তার, যিনি সৃষ্টিকূলকে তাঁর ইবাদতের নির্দেশ দিয়েছেন এবং গোটা সৃষ্টি জগত তাঁর আনুগত্য করতে বাধ্য।—سُبْحَانَهُ عَمَّا يُشْرِكُونَ —আল্লাহ তা‘আলা বলছেন: তাঁর আনুগত্যে যেরূপ শিরিক করা হয়, তিনি সেগুলো থেকে পুরোপুরি পাক-পবিত্র।[3]
কুরতুবী রহিমাহুল্লাহু তা'আলা বলেন—
“আল্লাহ তা‘আলার বাণী-وَلَا يَتَّخِذَ بَعْضُنَا بَعْضًا أَرْبَابًا مِّن دُونِ اللَّهِ-অর্থ: (আমরা একে অপরকে আল্লাহর পরিবর্তে রব বলে গ্রহণ করি না) অর্থাৎ আল্লাহ তা‘আলা যেসব বিষয়কে হালাল করেছেন, আমরা সেসব বিষয় ছাড়া অন্য কোন বিষয়কে হালাল বলে মেনে নেয়ার ক্ষেত্রে আমাদের কাউকে অনুসরণ করি না। এই আয়াতটি আল্লাহর নিম্নোক্ত বাণীর অনুরূপ—{ اتَّخَذُوا أَحْبَارَهُمْ وَرُهْبَانَهُمْ أَرْبَابًا مِنْ دُونِ اللَّهِ } এর অর্থ হচ্ছে: এমন বিষয়াবলীতে হালাল-হারাম নির্ধারণের প্রশ্নে তারা তাদের অনুসরণীয় ব্যক্তিদেরকে রবের স্থান দিয়ে দিয়েছে যেসব বিষয়কে আল্লাহ হারাম অথবা হালাল করেননি।[4]
আবু বকর জাসসাস রহিমাহুল্লাহু তা'আলা বলেন—
“আল্লাহ তা‘আলা তাদের ব্যাপারে এমনটা বলেছেন যে, তারা তাদেরকে রব বানিয়ে নিয়েছে; কারণ আল্লাহ যেসব বিষয়কে হারাম অথবা হালাল করেননি সেসব বিষয়কে হারাম অথবা হালাল বলে মেনে নেয়ার ক্ষেত্রে তারা তাদেরকে রব ও স্রষ্টার স্থান দিয়ে দিয়েছে। আর আল্লাহ ছাড়া অন্য কেউ এতটা আনুগত্য লাভের অধিকার রাখতে পারে না। আল্লাহ হলেন স্রষ্টা। ইবাদতের ব্যাপারে আদিষ্ট সৃষ্টিকুল আল্লাহর ইবাদতের বাধ্যবাধকতা, তাঁর নির্দেশ পালনের অপরিহার্যতা এবং একমাত্র তাঁর নিকট সকল প্রকার এবাদত নিবেদনের আবশ্যকতার ক্ষেত্রে সমান ও বরাবর।”[5]
ইবনে হাযম রহিমাহুল্লাহ আল্লাহর উক্ত বাণীর ব্যাপারে বলেন—
“যখন ইহুদী-খ্রিস্টান গোষ্ঠী তাদের ধর্মযাজক ও পাদ্রীদের হারাম বলে স্থিরীকৃত বিষয়কে হারাম হিসেবে মেনে নেয় এবং হালাল বলে স্থিরীকৃত বিষয়কে হালাল হিসেবে মেনে নেয়, তখন তাদের এরূপ আচরণ ধর্মযাজক ও পাদ্রীদের উদ্দেশ্যে বিশুদ্ধ রুবুবিয়্যাত ও এবাদত নিবেদনে পরিণত হয়। আর এই কাজকেই আল্লাহ তা‘আলা আল্লাহ ভিন্ন অন্যদেরকে রব বানানো এবং অন্যদের জন্য ইবাদত নিবেদন বলে আখ্যা দেন। আর এই বিষয়টা নির্বিবাদে আল্লাহর সঙ্গে শিরিক বলে প্রমাণিত।”[6]
পূর্বোক্ত আদী ইবনে হাতেমের হাদিস উল্লেখ করার পর শাইখুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া রহিমাহুল্লাহ তা'আলা বলেন—
“অতএব, নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বর্ণনা করে দিয়েছেন, হারামকে হালাল বলে মেনে নেয়া এবং হালালকে হারাম বলে মেনে নেয়াই হল তাদের এবাদত। এবাদত সাব্যস্ত হওয়ার জন্য আল্লাহর পরিবর্তে ধর্মযাজক ও পাদ্রিদের উদ্দেশ্যে সালাত সিয়াম ও মোনাজাত নিবেদন করার প্রয়োজন নেই। এটাই হলো মানুষের ইবাদত। আর আল্লাহ তা‘আলা বলে দিয়েছেন এমন কাজ শিরিক। আয়াতের শেষাংশে তিনি এরশাদ করেছেন— لَّا إِلَٰهَ إِلَّا هُوَ ۚ سُبْحَانَهُ عَمَّا يُشْرِكُونَ—অর্থ: (তিনি ব্যতীত অন্য কোন ইলাহ বা উপাস্য নেই; তারা যেই শিরিক করে তা হতে তিনি পবিত্র)”[7]
ইবনে কাসীর রহিমাহুল্লাহ তা'আলা বলেন—
“আল্লাহ তা‘আলার বাণী- وَإِنْ أَطَعْتُمُوهُمْ إِنَّكُمْ لَمُشْرِكُونَ-অর্থ: (আর যদি তোমরা তাদেরকে অনুসরণ করো তবে নিশ্চয়ই তোমরা মুশরিক হয়ে যাবে)
অর্থাৎ আল্লাহর প্রতি তোমাদের যে নির্দেশ, সে নির্দেশ ও শরীয়ত থেকে যদি তোমরা বিচ্যুত হয়ে অন্য কারো কথা গ্রহণ করো, সেটাকে যদি তোমরা প্রাধান্য দাও, তবে সেটাই হবে শিরিক। এমনিভাবে আল্লাহ তা‘আলার বাণী রয়েছে—
{ اتَّخَذُوا أَحْبَارَهُمْ وَرُهْبَانَهُمْ أَرْبَابًا مِنْ دُونِ اللَّهِ }
আর তিরমিজি (৩০৯৫) আদী ইবনে হাতেম থেকে এই আয়াতের তাফসীরে বর্ণনা করেছেন, আদী ইবনে হাতেম বলেন: হে আল্লাহর রাসূল! তারা তো তাদের এবাদত করেনি! তখন নবীজি এরশাদ করেন: অবশ্যই করেছে। তারা অনুসারীদের জন্য হারামকে হালাল বলে ঘোষণা করেছে এবং হালালকে হারাম বলে ঘোষণা করেছে। আর অনুসারীরা তাদেরকে মেনে নিয়েছে। এটাই তো তাদের একের প্রতি অপরের এবাদত।”[8]
সূরা তাওবার উক্ত আয়াতের তাফসীরে তিনি আরো বলেন—
“সুদদী বলেছেন, তারা বড়দের কাছে পরামর্শ চেয়েছিল এবং আল্লাহর কিতাব তাদের পেছনে ছুঁড়ে মেরেছিল। এজন্যই আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন—{وَمَا أُمِرُوا إِلَّا لِيَعْبُدُوا إِلَٰهًا وَاحِدًا}—অর্থাৎ তিনি এমন এক সত্ত্বা; যিনি কোনো বিষয়কে হারাম বলে স্থির করলে সেটাই চূড়ান্তভাবে হারাম আর তিনি যেটা হালাল বলে স্থির করবেন সেটাই চূড়ান্ত হালাল। তিনি যে আইন করবেন সেটাই অবশ্য পালনীয়, তিনি যে ফায়সালা করবেন সেটাই একমাত্র বাস্তবায়নযোগ্য। — لَّا إِلَٰهَ إِلَّا هُوَ ۚ سُبْحَانَهُ عَمَّا يُشْرِكُونَ -অর্থ: (তিনি ব্যতীত কোন ইলাহ নেই তারা যে শিরিক করে তা হতে তিনি পবিত্র) অর্থাৎ সকল শরিক, সকল সাহায্যকারী ও প্রতিপক্ষ, তার অনুরূপ হবার সকল দাবিদার এবং সন্তান-সন্ততি থেকে তিনি পবিত্র। তিনি ব্যতীত নেই কোন উপাস্য, নেই কোনো রব।”[9]
শাওকানী রহিমাহুল্লাহ বলেন—
“আয়াতের অর্থ হলো, তারা যখন বড়দেরকে সে বিষয়ে আনুগত্য করে যে বিষয়ে বড়রা তাদেরকে আদেশ দেয়; আর সেই বিষয় থেকে বেঁচে থাকে যে বিষয়ে বড়রা তাদেরকে বারণ করে, এরূপ আচরণের কারণে তারা বড়দেরকে রবের আসন দিয়েছে বলে ধরা হয়। কারণ তারা বড়দেরকে রবের মতো করেই অনুসরণ করছে।”[10]
******
তৃতীয় বিষয়:
উলামায়ে কেরামের কিছু উক্তি ও বর্ণনা
ইতিপূর্বে বর্ণিত আয়াত ও হাদীসের ব্যাখ্যায় আমি উলামায়ে কেরামের কিছু উক্তি উল্লেখ করেছি। সেগুলোর সঙ্গে আমি এখন আল্লাহর বিধান দ্বারা বিচার-ফায়সালা করা প্রসঙ্গে এবং এর বিরোধিতার পরিণাম প্রসঙ্গে উলামায়ে কেরামের কিছু উক্তি ও বক্তব্য সংযোজন করতে চাচ্ছি।
১) শাইখুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া রহিমাহুল্লাহু তা'আলা বলেন—
“মুসলমানদের জরুরিয়াতে দ্বীনের অংশ হিসেবে এবং সকল মুসলমানের সর্বসম্মতিক্রমে প্রমাণিত, যে ব্যক্তি দ্বীনে ইসলাম অথবা শরীয়তে মুহাম্মদী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ভিন্ন অন্য কোন মতবাদের অনুসরণ জায়েজ ও বৈধ মনে করবে সে ব্যক্তি কাফের। সে ব্যক্তির কুফরি এমন ব্যক্তির আচরণের মত, যে কিতাবের কিছু অংশের প্রতি ঈমান এনেছে আর কিছু অংশের প্রতি কুফরি করেছে। তাইতো আল্লাহ সুবহানাহুওয়া তা‘আলা বলেনঃ
إِنَّ ٱلَّذِينَ يَكْفُرُونَ بِٱللَّهِ وَرُسُلِهِۦ وَيُرِيدُونَ أَن يُفَرِّقُوا۟ بَيْنَ ٱللَّهِ وَرُسُلِهِۦ وَيَقُولُونَ نُؤْمِنُ بِبَعْضٍ وَنَكْفُرُ بِبَعْضٍ وَيُرِيدُونَ أَن يَتَّخِذُوا۟ بَيْنَ ذَٰلِكَ سَبِيلًا * أُو۟لَٰٓئِكَ هُمُ ٱلْكَٰفِرُونَ حَقًّا وَأَعْتَدْنَا لِلْكَٰفِرِينَ عَذَابًا مُّهِينًا
অর্থঃ (যারা আল্লাহ ও তাঁর রসূলের প্রতি অস্বীকৃতি জ্ঞাপনকারী তদুপরি আল্লাহ ও রসূলের প্রতি বিশ্বাসে তারতম্য করতে চায় আর বলে যে, আমরা কতককে বিশ্বাস করি কিন্তু কতককে প্রত্যাখ্যান করি এবং এরই মধ্যবর্তী কোন পথ অবলম্বন করতে চায়, প্রকৃতপক্ষে এরাই সত্য প্রত্যাখ্যাকারী। আর যারা সত্য প্রত্যাখ্যানকারী তাদের জন্য তৈরী করে রেখেছি অপমানজনক আযাব।) [11]
২) সৌদি আরবের সাবেক মুফতি শাইখ মুহাম্মদ ইবনে ইব্রাহিম রহিমাহুল্লাহু তা‘আলা তৎকালীন রিয়াদের আমীরের প্রতি প্রেরিত তাঁর এক পত্রে বাণিজ্যিক আদালতের আইন-কানুন সম্পর্কে বলেছেন—
“আমাদের হাতে একটি কপি এসে পৌঁছেছে। তাতে শিরোনাম রয়েছে—সৌদি আরব রাষ্ট্রের বাণিজ্যিক আদালত ব্যবস্থা। আমরা তার প্রায় অর্ধেকটুকু পড়ে শেষ করেছি। তাতে আমরা দেখতে পেয়েছি মানব রচিত এক আইন ব্যবস্থা; যা শরীয়তসম্মত নয়। ..... সেসব আইন-কানুনের কিছু অংশ যদি অতি সংক্ষিপ্ত পরিসরে হলেও প্রয়োগের জন্য গ্রহণ করা হয়, তবে কোন সন্দেহ নেই যে, তা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের ফায়সালার ব্যাপারে অসম্মতি বলে বিবেচিত হবে। আর এমন যেকোন কিছু আকীদার জায়গা থেকে গ্রহণ করা এমন কুফুরি বলে গণ্য হবে, যা মিল্লাতে ইসলাম থেকে বহিস্কৃত করে দেয়।”[12]
৩) শাইখ মুহাম্মদ ইবনে ইব্রাহিম রহিমাহুল্লাহু তা‘আলা রিয়াদস্থ হাইকোর্টের প্রধানের কাছে প্রেরিত তাঁর এক পত্রে শ্রম ও শ্রমিক আদালত কর্তৃক পরিচালিত শ্রম ও শ্রমিক আইন প্রসঙ্গে এবং এ বিষয়ে আদালতগুলোর কর্তব্য প্রসঙ্গে লিখেছেন—
“মুহাম্মদ ইবনে ইব্রাহিমের পক্ষ থেকে রিয়াদস্থ সুপ্রিম কোর্টের প্রধান মহোদয়ের নিকট! আস্সালামু আলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহি ওয়া বারাকাতুহু!
পর সমাচার এই যে, শ্রম ও শ্রমিক বিভাগের পরিচালিত কার্যক্রম সম্পর্কে আপনাদের বক্তব্য সম্পর্কে অবহিত হয়েছি। এই বিভাগের কোন সিদ্ধান্ত ও নির্দেশ বাতিলের জন্য যদি আদালতের কাছে আপিল করা হয়, তবে আদালতের কাজ হচ্ছে সেই আপিল গ্রহণ করা। কারণ এটাই তো আদালতের মূল কাজ। তো এই ক্ষেত্রে বিচারব্যবস্থার এই বিভাগের সিদ্ধান্ত অমান্য করা অত্যাবশ্যকীয়। কিন্তু যদি এমন কোনো সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে শ্রম বিভাগের হস্তক্ষেপ কামনা করে আপিল করা হয় যাতে কোন সিদ্ধান্ত বাতিল করে দেয়া হয় এবং নতুন করে এমন বিচার দেয়া হয়, যে বিষয়ে আল্লাহ তা'আলা কোন প্রমাণ অবতীর্ণ করেননি, তবে আদালতের জন্য এমন আপিল গ্রহণ করা জায়েজ হবে না। কারণ এই কাজ আল্লাহর বিধান ভিন্ন অন্য বিধানের দ্বারা বিচার কামনায় সম্মতি প্রদান, এমনকি সহযোগিতা বলে গণ্য হবে।
প্রধান বিচারক ২৩/১০/১৩৭৯ হিজরী”[13]
৪) শাইখ আহমদ মুহাম্মদ শাকির রহিমাহুল্লাহু তা'আলা মানব রচিত আইন-কানুন দ্বারা বিচার-ফয়সালা করা প্রসঙ্গে বলেন—
“এমন কাজ আল্লাহর হুকুমের ব্যাপারে বিমুখতা, আল্লাহর দ্বীনের ব্যাপারে বৈরাগ্য এবং আল্লাহ সুবহানাহুওয়া তা'আলার হুকুমের উপর কাফেরদের বিধি-বিধানকে প্রাধান্য দান। এ কাজ কুফরি। বহু বিষয়ে মতবিরোধ থাকা সত্ত্বেও এমন বিষয়ের প্রবক্তা ও আহ্বানকারীকে তাকফীরের ক্ষেত্রে আহলে কিবলা কারো মাঝে কোন সন্দেহ নেই।”[14]
৫) শাইখ মুহাম্মদ হামিদ আল-ফাকী রহিমাহুল্লাহু তা‘আলা কিতাবুত তাওহীদের টীকাগ্রন্থে মানব রচিত আইন-কানুন বিচারিকভাবে প্রয়োগকারীর ব্যাপারে বলেন—
“কোন সন্দেহ নেই এমন ব্যক্তি কাফের মুরতাদ যদি সে এ কাজ চালিয়ে যায় এবং আল্লাহর অবতীর্ণ বিধান দ্বারা বিচার-ফয়সালা করার পথে ফিরে না আসে। এই অবস্থায় যে নামেই তাকে ডাকা হোক; তাদের কোনো ফায়দা হবে না এবং সালাত সিয়াম হজ্জ সহ যেকোনো বাহ্যিক আমল সে করুক তাতে কোন লাভ হবে না।”[15]
৬) আল্লামা শাইখ মুহাম্মদ আল-আমীন আশশানকীতী রহিমাহুল্লাহু তা‘আলা বলেন—
“আসমান জমিনের স্রষ্টার শরীয়তবিরোধী ব্যবস্থা দ্বারা লোক সমাজে, অর্থ-সম্পদ, ইজ্জত-আব্রু ও বংশধারা বিষয়ে বিচার-ফয়সালা করা আসমান-জমিনের স্রষ্টার প্রতি কুফরি, সৃষ্টিকুলের স্রষ্টা কর্তৃক নিয়ন্ত্রিত আসমানী ব্যবস্থার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ। কারণ একমাত্র তিনি গোটা ব্যবস্থাপনার কল্যাণ-অকল্যাণ সম্পর্কে সর্বজ্ঞ। অপর কোন বিধান প্রণয়নকারী তাঁর শরিক হওয়া থেকে তিনি পাক-পবিত্র। এই কলুষতা থেকে তিনি বহু ঊর্ধ্বে।
أَمْ لَهُمْ شُرَكَٰٓؤُا۟ شَرَعُوا۟ لَهُم مِّنَ ٱلدِّينِ مَا لَمْ يَأْذَنۢ بِهِ ٱللَّهُ وَلَوْلَا كَلِمَةُ ٱلْفَصْلِ لَقُضِىَ بَيْنَهُمْ وَإِنَّ ٱلظَّٰلِمِينَ لَهُمْ عَذَابٌ أَلِيمٌ
অর্থঃ (তাদের কি এমন শরীক দেবতা আছে, যারা তাদের জন্যে সে ধর্ম সিদ্ধ করেছে, যার অনুমতি আল্লাহ দেননি ?)
قُلْ أَرَءَيْتُم مَّآ أَنزَلَ ٱللَّهُ لَكُم مِّن رِّزْقٍ فَجَعَلْتُم مِّنْهُ حَرَامًا وَحَلَٰلًا قُلْ ءَآللَّهُ أَذِنَ لَكُمْ أَمْ عَلَى ٱللَّهِ تَفْتَرُونَ
অর্থঃ (বল, আচ্ছা নিজেই লক্ষ্য করে দেখ, যা কিছু আল্লাহ তোমাদের জন্য রিযিক হিসাবে অবতীর্ণ করেছেন, তোমরা সেগুলোর মধ্য থেকে কোনটাকে হারাম আর কোনটাকে হালাল সাব্যস্ত করেছ? বল, তোমাদের কি আল্লাহ নির্দেশ দিয়েছেন, নাকি আল্লাহর ওপর অপবাদ আরোপ করছ?)”[16]
******
দ্বিতীয় অধ্যায়ঃ
ঈমানী ভ্রাতৃত্ব; স্বাদেশিক ও জাতীয়তাবাদী সম্পর্কসূত্র নয়
প্রথম পরিচ্ছেদঃ ইসলামী রাষ্ট্রে পারস্পরিক সম্পর্ক ঈমানী ভ্রাতৃত্বের সূত্রে গ্রথিত
দ্বিতীয় পরিচ্ছেদঃ স্বাদেশিক চেতনাভিত্তিক জাতীয়তাবাদী রাষ্ট্র
প্রথম পরিচ্ছেদঃ
ইসলামী রাষ্ট্রে পারস্পরিক সম্পর্ক ঈমানী ভ্রাতৃত্বের সূত্রে গ্রথিত
কিতাব ও সুন্নাহে এ বিষয়ে অসংখ্য দলিল-প্রমাণ রয়েছে যে, সকল মুসলমান এক উম্মাহ; জাতীয়তাবাদী আসাবিয়া কিংবা ভৌগোলিক সীমারেখা তাদের মাঝে পার্থক্য সৃষ্টি করতে পারে না।
আল্লাহ সুবহানাহুওয়া তা‘আলা ইরশাদ করেন —
وَٱلْمُؤْمِنُونَ وَٱلْمُؤْمِنَٰتُ بَعْضُهُمْ أَوْلِيَآءُ بَعْضٍ
অর্থঃ আর ঈমানদার পুরুষ ও ঈমানদার নারী একে অপরের সহায়ক।[17]
إِنَّمَا ٱلْمُؤْمِنُونَ إِخْوَةٌ
অর্থঃ মুমিনরা তো পরস্পর ভাই-ভাই।[18]
وَإِن يُرِيدُوٓا۟ أَن يَخْدَعُوكَ فَإِنَّ حَسْبَكَ ٱللَّهُ هُوَ ٱلَّذِىٓ أَيَّدَكَ بِنَصْرِهِۦ وَبِٱلْمُؤْمِنِينَ * وَأَلَّفَ بَيْنَ قُلُوبِهِمْ لَوْ أَنفَقْتَ مَا فِى ٱلْأَرْضِ جَمِيعًا مَّآ أَلَّفْتَ بَيْنَ قُلُوبِهِمْ وَلَٰكِنَّ ٱللَّهَ أَلَّفَ بَيْنَهُمْ إِنَّهُۥ عَزِيزٌ حَكِيمٌ * يَٰٓأَيُّهَا ٱلنَّبِىُّ حَسْبُكَ ٱللَّهُ وَمَنِ ٱتَّبَعَكَ مِنَ ٱلْمُؤْمِنِينَ.
অর্থঃ পক্ষান্তরে তারা যদি তোমাকে প্রতারণা করতে চায়, তবে তোমার জন্য আল্লাহই যথেষ্ট, তিনিই তোমাকে শক্তি যুগিয়েছেন স্বীয় সাহায্যে ও মুসলমানদের মাধ্যমে। আর প্রীতি সঞ্চার করেছেন তাদের অন্তরে। যদি তুমি সেসব কিছু ব্যয় করে ফেলতে, যা কিছু যমীনের বুকে রয়েছে, তাদের মনে প্রীতি সঞ্চার করতে পারতে না। কিন্তু আল্লাহ তাদের মনে প্রীতি সঞ্চার করেছেন। নিঃসন্দেহে তিনি পরাক্রমশালী, সুকৌশলী। হে নবী, আপনার জন্য এবং যেসব মুসলমান আপনার সাথে রয়েছে তাদের সবার জন্য আল্লাহই যথেষ্ট।[19]
নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেছেন—
"المسلمون تتكافأ دماؤهم وهم يد على من سواهم يسعى بذمتهم أدناهم ويرد على أقصاهم"
“মুসলমানদের সকলের জীবনের মূল্য এক সমান। তারা বিজাতীয় শত্রুর বিরুদ্ধে একটি হাতস্বরূপ (একতাবদ্ধ)। তাদের একজন সাধারণ লোকও অপরকে তাদের নিরাপত্তার গ্যারান্টি দিতে পারে। তাদের দূরবর্তী ব্যক্তিও গনীমতে শরীক হবে।”[20]
এ পর্যায়ে আমি চাই, দু'ধরনের রাষ্ট্রসত্তার মধ্যকার মোটা দাগের পার্থক্যগুলোর প্রতি সংক্ষেপে ইঙ্গিত করব। এক প্রকার হলো ইসলামী রাষ্ট্র। অপর প্রকার হলো জাতীয়তাবাদী ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র কিংবা যাকে বলা হয়— আধুনিক সুসভ্য জাতিরাষ্ট্র।
প্রথম পার্থক্যঃ ইসলামী রাষ্ট্রে আইন-কানুন, বিধি-বিধান প্রণয়ন ও শাসন ক্ষমতা আল্লাহ সুবহানাহুওয়া তা'আলার কাছে দায়বদ্ধ থাকে। হাকিমিয়্যাত তথা বিধান প্রণয়ন হয় একমাত্র শরীয়াহ নির্দেশনায়। শাসনব্যবস্থা হয় এমন শুরা ভিত্তিক যেখানে সকল সদস্য শরীয়তের কাছে দায়বদ্ধ; শরীয়তের বিরোধিতা করার অধিকার যেখানে কারো নেই। এই শরীয়তের অবস্থান হয় শাসনব্যবস্থা, সরকারব্যবস্থা ও নেতৃত্বের সর্বোচ্চ আসনে, যাকে আইনশাস্ত্রবিদেরা বলে থাকে ক্ষমতার চূড়ান্ত উৎস।
পক্ষান্তরে ধর্মনিরপেক্ষ জাতীয়তাবাদী রাষ্ট্রে শরীয়ত ভিন্ন মতবাদ এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রে সংখ্যাগরিষ্ঠের খেয়াল-খুশির দ্বারা শাসন পরিচালনা করা হয়ে থাকে। কিংবা তা হয়ে থাকে ভোট প্রদানকারীদের সংখ্যাগরিষ্ঠের ইচ্ছা আকাঙ্ক্ষা নির্ণয়ের ভিত্তিতে। অতএব এমন রাষ্ট্রে ক্ষমতার উৎস হলো জনগণ। আর বিধি-বিধান প্রণয়নের মাধ্যম হলো সংখ্যাগরিষ্ঠের ইচ্ছা আকাঙ্ক্ষা কিংবা সংখ্যাগরিষ্ঠতা দাবিকারী ক্ষমতাসীন পক্ষ। এমন রাষ্ট্রে সরকারব্যবস্থা অধিকাংশ ক্ষেত্রে হয়ে থাকে এমন গণতান্ত্রিক যা সংখ্যাগরিষ্ঠের ইচ্ছা আকাঙ্ক্ষা ও খেয়াল-খুশির প্রতি অঙ্গীকারাবদ্ধ। এ সংখ্যাগরিষ্ঠতার বিরোধিতা করার কোনো সুযোগ নেই কিংবা অন্তত বিরোধিতার দাবী করার সুযোগ নেই। দু'প্রকারের রাষ্ট্রসত্তার মাঝে মোটা দাগের এটাই হলো প্রথম পার্থক্য।
জাতীয়তাবাদী রাষ্ট্র ধর্মনিরপেক্ষ না হবার কোনো সুযোগ নেই। কারণ আল্লাহর দ্বীন তো জনগণের সব শ্রেণীর মাঝে পাওয়া যাবে না। তাই অন্য কোনো সম্পর্ক সূত্র এখানে অনিবার্য।
দ্বিতীয় পার্থক্যঃ অধিকার ও কর্তব্যসমূহের প্রশ্নে ইসলামী রাষ্ট্র সকল মুসলমানকে সমানভাবে বিচার করে। আর এই দুই ক্ষেত্রে মুসলিম-অমুসলিমের মাঝে পার্থক্য করে। অপরদিকে জাতীয়তাবাদী ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র এক মাতৃভূমির সকল সন্তান কিংবা যাকে বলে নাগরিকদের সকলকে এই দুই ক্ষেত্রে সমান পাল্লায় পরিমাপ করে। আর ভিন্ন দেশের নাগরিকদের সঙ্গে নিজ ভূমির নাগরিকদের পার্থক্য করে যদিও তারা একই ধর্মের অনুসারী হোক না কেন। মোটা দাগের এটা হল দ্বিতীয় পার্থক্য।
তৃতীয় পার্থক্যঃ ইসলামী রাষ্ট্র সকল ইসলামী ভূমি সম্পর্কে নিজেকে দায়িত্বশীল মনে করে। কিংবা সেভাবে বলা যায় যেভাবে ফুক্বাহায়ে কেরাম বলেছেন: “মুসলমানদের সকল ভূমি একই দেশের হুকুমে”। পক্ষান্তরে জাতীয়তাবাদী রাষ্ট্র স্ব-স্ব সীমারেখা ও সীমান্তের ভেতরেই মনোযোগ নিবদ্ধ রাখে। সীমান্তের বাইরের কোনো কিছুর প্রতি সে দায়িত্বশীলতা অনুভব করে না। তবে দয়া, কৃপা, সহনশীলতা, সহযোগিতা অথবা অঙ্গীকার ও প্রতিশ্রুতির জন্য হলে ভিন্ন কথা। এমনকি এই অঙ্গীকার বা প্রতিশ্রুতি এমন হয় যে, হালাল হারাম যেকোন স্বার্থে বা কল্যাণে তা ভেঙ্গে ফেলার জোর সম্ভাবনা থাকে। এই বিষয়ের সর্বাধিক জাজ্জ্বল্যমান উদাহরণ হল—
• যৌথ আরব প্রতিরক্ষা চুক্তি। মিসর সরকার ইসরাইলের সঙ্গে শান্তিচুক্তির প্রেক্ষিতে উক্ত প্রতিরক্ষা চুক্তি ভেঙ্গে ফেলে। ইসরাইলের সঙ্গে স্থাপিত সন্ধি-চুক্তিতে জোর দিয়ে বলা হয়, এই চুক্তি পূর্বেকার যেকোনো চুক্তি রহিত করে দেবে। এ বিষয়ে মিশর সরকার সম্মতি দেয়।
• এমনিভাবে পাকিস্তান সরকারের কর্মকাণ্ড। পাক শাসকেরা যখন দেখল, প্রতিবেশী শান্তিবাদী মুসলিম দেশ আফগানিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধে আমেরিকাকে সাহায্য করলে তাদের স্বার্থ রক্ষা হবে, তখন তারা সেটাই করলো।
উপরোক্ত বিষয়াবলীর ভিত্তিতেই জাতীয়তাবাদী রাষ্ট্রে কোন আইন-কানুন—ইসলামিক শরীয়ত মোতাবেক হোক কিংবা বিরোধী হোক— ততক্ষণ পর্যন্ত বিধিবদ্ধ ও বাস্তবায়নযোগ্য বলে ধরা হয় না, যতক্ষণ জনগণ, জনপ্রতিনিধিবৃন্দ অথবা বাস্তবে নিরূপিত ভোটারদের সংখ্যাগরিষ্ঠতা সেই আইনের পক্ষে না থাকবে। পক্ষান্তরে ইসলামী রাষ্ট্রে কোন আইন ঠিক তখনই বিধিবদ্ধ ও বাস্তবায়নযোগ্য বলে ধরা হয়, যখন তা ইসলামিক শরীয়ত মোতাবেক হয় কিংবা অন্তত ইসলামী শরীয়াহ বিরোধী না হয়। এখন যদি কোন আইন ইসলামী শরীয়ার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ না হয়, যদি কোন কানুন ইসলামী শরীয়াহ বিরোধী হয়, তবে তা বিধিবদ্ধ হতে পারে না; যদিও সকল জনগণ তার পক্ষে থাকে।
এসবের ভিত্তিতেই ধর্মনিরপেক্ষ জাতীয়তাবাদী রাষ্ট্রের সকল নাগরিক দায়-দায়িত্ব ও কর্তব্যের প্রশ্নে এক সমান, চাই তারা একই ধর্মের হোক কিংবা ভিন্ন ভিন্ন ধর্মের। তাই যেকোনো নাগরিকের জন্য রাষ্ট্রের যে কোন পদে নিয়োগ পাবার অধিকার রয়েছে যতক্ষণ পর্যন্ত সে পদের জন্য শর্তযুক্ত কোন যোগ্যতার অভাব তার মাঝে না থাকবে। এমতাবস্থায় সে যে ধর্মেরই হোক তাতে কিছু আসে যায় না। আর ইসলামী রাষ্ট্রে নির্দিষ্ট কিছু পদ রয়েছে যা মুসলমানেরা ব্যতীত অন্য ধর্মের কেউ লাভ করতে পারে না। উদাহরণতঃ তার মধ্যে একটি হলো ইমামত বা সাধারণ নেতৃত্ব। এমনিভাবে বিচারকের পদ। এখন কোন মুসলিম ব্যক্তি সুদূর প্রতীচ্যের কোন দেশের হোক কিংবা প্রাচ্যের, কোন প্রকার ভৌগোলিক সীমারেখা, আঞ্চলিক বিভাজন কিংবা স্বাদেশিক ভিন্নতা এখানে পার্থক্য সৃষ্টি করতে পারবে না। উদাহরণতঃ কোন খ্রিস্টান, ইহুদি এমনকি যে কোন নাস্তিকের অধিকার আছে মিশরে সরকার প্রধানের পদ অথবা প্রধান বিচারকের পদ লাভ করার। সেখানে সুদান লিবিয়া অথবা ফিলিস্তিনের কোন মুসলমানের ভোটটুকু দেয়ারও অধিকার নেই। কারণ এই মুসলমানেরা সাইকোস পিকট এবং তারও আগে লর্ড কিচেনার রাষ্ট্রীয় যে সীমারেখা এঁকে দিয়েছে, বেঁধে দেয়া সেই সীমানার বাইরে বসবাস করে।
আর এরই ভিত্তিতে উদাহরণতঃ মিশর সরকার মিশরের সীমান্ত প্রতিরক্ষার ব্যাপারে দায়িত্বশীল, কিন্তু সুদান ফিলিস্তিন অথবা লিবিয়া— কোন রাষ্ট্রেরই সীমান্ত প্রতিরক্ষার ব্যাপারে দায়িত্বশীল নয়। কারণ এই দায়বদ্ধতা সুদানবাসী, ফিলিস্তিনি এবং লিবিয়ানদের। এখন যদি মিশর সরকার আগ্রাসন কবলিত এ সমস্ত রাষ্ট্রের পক্ষে কোনো হস্তক্ষেপ করে, তবে সেটা হতে পারে পরোপকার ও সহযোগিতা হিসেবে। কারণ আগ্রাসন কবলিত এসব রাষ্ট্রের সঙ্গে মিশরের বিভাজন রেখা এঁকে দিয়েছে সাইকোস, পিকট এবং তারও আগে লর্ড কিচেনার।
আর ইসলামী রাষ্ট্রে মুসলমানদের ভূমি প্রতিরক্ষা সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ ফরজে-আইনসমূহের একটি। আল্লাহ তা‘আলা শাইখ মুজাহিদ আবদুল্লাহ আযযাম রহিমাহুল্লাহর উপর রহমত বর্ষণ করুন! ঠিক এই শিরোনামে তাঁর প্রসিদ্ধ একটি কিতাব রয়েছে।
যেকোনো মুসলিম ভূমি যদি আগ্রাসনের কবলে পড়ে তাহলে শরীয়ত সে ভূখণ্ডের অধিবাসীদের ওপর সে ভূমি প্রতিরক্ষা করা ওয়াজিব সাব্যস্ত করে দেয়।
যদি তারা এ কাজ করতে সক্ষম না হয় তাহলে ফরজে আইন এই দায়িত্ব বিস্তৃত হতে হতে পৃথিবীর সকল মুসলমানের কাঁধে এসে পড়ে। মুসলিম ফুক্বাহায়ে কেরাম এ বিষয়ে একমত। শরীয়তের এই নির্দেশনা বাস্তবতা বিবর্জিত অলীক কল্পনা নয়। এটা পূর্ব দিনের চর্চিত কোন ইতিহাস ঐতিহ্য নয়। এটা তো এমন এক বাস্তবতা যা উসমানী সাম্রাজ্য অধঃপতনের সময়ও বর্তমান ছিল। সে সময় এই সাম্রাজ্যের মাঝে বিভিন্ন বিশৃংখলা অস্থিতিশীলতা ও দুর্বলতার উপস্থিতি সত্ত্বেও মুসলমানদের সকল ভূমি প্রতিরক্ষার ব্যাপারে সাম্রাজ্য আপন দায়িত্বশীলতা স্বীকার করত। এ দায়িত্ব পালনার্থে সাম্রাজ্য দীর্ঘ পাঁচ শতাব্দী কাজ করে গেছে। ১৯১৪ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত মিশর নামেমাত্র হলেও উসমানি সাম্রাজ্যের অঙ্গরাজ্য ছিল। অবশেষে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ আরম্ভ হওয়ার পর ইংরেজরা উসমানী সাম্রাজ্যের কাছ থেকে মিশর ছিনিয়ে নেয়।
ইসলামী রাষ্ট্র এবং ধর্মনিরপেক্ষ জাতীয়তাবাদী রাষ্ট্রের প্রসঙ্গে আলোচনা শেষ করার আগে আমি অতি গুরুত্বপূর্ণ একটি পয়েন্ট উল্লেখ করতে চাই। সেটি হল,ধর্মনিরপেক্ষ জাতীয়তাবাদী রাষ্ট্র ইসলামের শত্রু পশ্চিমা ও জায়নবাদী চক্রের স্বার্থ ও প্রয়োজনের বলি ছাড়া আর কিছু নয়। কারণ এই বিভাজন ব্যবস্থা ইসলামী বিশ্বকে পঞ্চাশের অধিক রাষ্ট্রে বিভক্ত করে দিয়েছে। অথচ ইতিপূর্বে এই সকল রাষ্ট্র খিলাফত রাষ্ট্রের অধীনে এক ভূখণ্ডের মত ছিল। আর সেই খিলাফত রাষ্ট্র যা হলো উসমানী সাম্রাজ্য, তা রাষ্ট্রগুলোর এই সংশ্লেষ ধরে রাখতে এবং মুসলমানদের ভূমি রক্ষার্থে পাঁচ শতাব্দীর বেশি সময় ধরে খৃষ্টবাদ ও জায়নবাদ কর্তৃক যৌথভাবে পরিচালিত ক্রুসেডের মোকাবেলা করেছে।
জাতীয়তাবাদী রাষ্ট্রের সঙ্গে ইসলামী রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ পার্থক্যগুলোর নিরূপক ও নির্দেশক চিত্র
ভৌগোলিক জাতীয়তাবাদী রাষ্ট্র | ইসলামী রাষ্ট্র | |
প্রথমতঃ | ধর্মনিরপেক্ষ ধর্মহীন ব্যবস্থা | নেজামে রব্বানী তথা ঐশী ব্যবস্থা |
দ্বিতীয়তঃ | গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা, অন্তত গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার দাবি তথা সংখ্যাগরিষ্ঠের ইচ্ছা আকাঙ্ক্ষার ভিত্তিতে শাসন পরিচালনা ও বিচার আচার | শুরার নেজাম তথা এমন উপদেষ্টা পরিষদের অধীন ব্যবস্থা যার প্রতিনিধিত্বে উম্মাহ শরীয়াহ অনুসরণ করবে |
তৃতীয়তঃ | দেশপ্রেমের অপব্যবহার এবং মানুষের মনোজগত শাসন করতে অক্ষম আইন-কানুনের প্রতি আনুগত্যের প্রতিশ্রুতি | তাকওয়া বা খোদাভীতি, পরকালে জিজ্ঞাসাবাদের ভয় এবং এসবের মাধ্যমে মানুষের মনোজগৎ নিয়ন্ত্রণের মৌলিক ব্যবস্থাপনা |
চতুর্থতঃ | এমন সংকীর্ণ আসাবিয়া মূলক ব্যবস্থা, যা স্বাদেশিক জাতীয়তাবাদী ধারণার ভিত্তিতে তৈরি, যার দরুন বিশ্বের পরাশক্তিগুলোর এঁকে দেয়া কৃত্তিম রাষ্ট্রসীমানার কারণে মানুষে মানুষে বিভেদ তৈরি করে | মুসলমানদের মাঝে সাম্যের চর্চা এবং খেলাফতের ছায়াতলে একক রাষ্ট্রসত্তা ও জাতিসত্তার ধারণা |
পঞ্চমতঃ | কেবল নিজ ভূমি প্রতিরক্ষার দায়িত্ব স্বীকার | মুসলমানদের সকল ভূখণ্ড প্রতিরক্ষাকে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ ফরজে আইন দায়িত্ব বলে স্বীকার |
ষষ্ঠতঃ | ইসলামের শত্রুদের স্বার্থ রক্ষার ফর্মুলা হিসেবে অস্তিত্ব লাভ | মুসলমানদের সার্বিক নিরাপত্তা নিশ্চিতের লক্ষ্যে অস্তিত্ব লাভ |
******
দ্বিতীয় পরিচ্ছেদঃ
স্বাদেশিক জাতীয়তাবাদী রাষ্ট্র
প্রথম অংশঃ স্বাদেশিক জাতীয়তাবাদী রাষ্ট্রের উৎপত্তি ও বিকাশ
দ্বিতীয় অংশঃ স্বাদেশিক জাতীয়তাবাদী রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ নীতিমালা ও মৌলিক দৃষ্টিভঙ্গি
******
প্রথম অংশঃ
স্বাদেশিক জাতীয়তাবাদী রাষ্ট্রের উৎপত্তি ও বিকাশ
প্রথম উপ-পরিচ্ছেদ: বিকৃত খৃষ্টবাদ ও রাজনৈতিক বিপর্যয়
দ্বিতীয় উপ-পরিচ্ছেদ: গির্জার হস্তক্ষেপ বৃদ্ধি; কায়সারের (মধ্যযুগে খ্রিস্টানদের রাজনৈতিক প্রধান ও রাষ্ট্রের অধিপতি) প্রাপ্য কায়সারকে দাও আর আল্লাহর প্রাপ্য পোপকে দাও
তৃতীয় উপ-পরিচ্ছেদ: সম্রাটদের সঙ্গে গির্জার সংঘাত
চতুর্থ উপ-পরিচ্ছেদ: গির্জার বিপর্যয় ও বিকৃতি
পঞ্চম উপ-পরিচ্ছেদ: গির্জার হস্তক্ষেপ থেকে রাষ্ট্রের মুক্তি এবং জাতীয়তাবাদী রাষ্ট্রের উদ্ভব
ষষ্ঠ উপ-পরিচ্ছেদ: গির্জায় ধর্মীয় সংস্কার
সপ্তম উপ-পরিচ্ছেদ: রাজতন্ত্রের পতন এবং ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের উৎপত্তি
******
প্রথম উপ পরিচ্ছেদ:
বিকৃত খৃষ্টবাদ এবং রাজনৈতিক বিপর্যয়
জাতীয়তাবাদী স্বাদেশিক আধুনিক রাষ্ট্রের ক্রমবিকাশের ইতিহাস পাঠ করতে হলে অবশ্যই আমাদেরকে জানতে হবে, ইউরোপে রাষ্ট্রের সঙ্গে গির্জার সম্পর্কের ক্রমবিবর্তন কি ছিল? আর এ সম্পর্কে জানতে হলে বিকৃত খ্রিস্টান ধর্মের মধ্যকার রাজনৈতিক বিপর্যয়ের নাড়ি-নক্ষত্র আমাদের খতিয়ে দেখতে হবে। আর সেইসঙ্গে প্রাসঙ্গিকভাবে এ আলোচনায় চলে আসবে যে, খ্রিস্টান ধর্মে কিভাবে বিকৃতি এসেছে।
এ কারণেই আমি নিম্নোক্ত আলোচনাকে কয়েকভাগে বিভক্ত করেছি।
প্রথমআলোচনাঃ খৃষ্টবাদের বিকৃতি
দ্বিতীয় আলোচনাঃ ধর্মীয় বক্তব্যমূলের বিকৃতি সাধনে রাজনৈতিক বিপর্যয়ের গোড়ার কথা
প্রথম আলোচনাঃ
খৃষ্টবাদের বিকৃতি
আমি মনে করি, আধুনিক স্বাদেশিক ও জাতীয়তাবাদী রাষ্ট্রের উৎপত্তি ও বিকাশের ধারা বোঝার জন্য সংক্ষিপ্তাকারে রাষ্ট্রের সঙ্গে গির্জার সম্পর্ক উপস্থাপন করা একান্ত জরুরী। আর গির্জার অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক বিপর্যয়ের ইতিহাস জানতে হলে খ্রিস্টানদের পবিত্র ধর্মীয় গ্রন্থগুলোতে রাজনৈতিক বিপর্যয় তৈরীর যেসব বীজ লুকিয়ে আছে সেগুলো পাঠ করতে হবে। আর সেসব বীজ ঘেঁটে দেখার জন্য তাদের গ্রন্থগুলোর মাঝে আপতিত বিকৃতি সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত হলেও ধারণা নিতে হবে। তাই এবার চাই, খ্রিস্টান ধর্মে আপতিত বিকৃতি ও পরিবর্তন সংক্ষিপ্তাকারে উপস্থাপন করব। যেহেতু বিশদ গবেষণা হিসেবে আমি লিখছি না তাই আকীদা-বিশ্বাস ও শরীয়তের বিভিন্ন ক্ষেত্রে খ্রিস্টান ধর্মের বিকৃতি সম্পর্কে বিস্তারিত আলোকপাত এখানে আমি করবো না।
সংক্ষিপ্ত এই পরিচ্ছেদে আমি কেবল মৌলিকভাবে পশ্চিমা খ্রিস্টানদের কথাবার্তা ও গ্রন্থের কিছু বিষয় উপস্থাপন করব, যা দ্বারা বোঝা যাবে, খ্রিস্টান ধর্মের পবিত্র গ্রন্থগুলোতে কতটা বিকৃতি সাধিত হয়েছে। আর তাই উলামায়ে কেরাম ও মুসলিম লেখকদের আলোচনা আমি খুবই ক্ষুদ্র পরিসরে প্রসঙ্গক্রমে নিয়ে আসব, যাতে এই বিষয়ে আমাদের ধারণা আরো স্বচ্ছ হয়ে যায় এবং বাস্তবতা পরিস্ফুট হয়ে যায়। আল্লাহ তা‘আলা সকল কল্যাণের তাওফিককদাতা!
এই আলোচনাকে আমি দু'ভাগে বিভক্ত করেছি।
প্রথম সন্দর্ভঃ মৌলিক কিছু প্রাককথন
দ্বিতীয় সন্দর্ভঃ খ্রিস্টানদের আল কিতাবুল মুকাদ্দাস[21] -এর বিকৃতি উপস্থাপন
(চলবে, ইন শা আল্লাহ)
[1] সুনানে তিরমিজি: অধ্যায়-রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে বর্ণিত তাফসীরে কুরআন, পরিচ্ছেদ- সূরা আত তাওবার অংশ, হাদিস নং-৩০৯৫, খণ্ড নং-০৫, পৃষ্ঠা নং-২৭৮,
আরো দ্রষ্টব্য: সুনানে সাঈদ ইবনে মানসুর, খণ্ড নং-০৫, পৃষ্ঠা নং-২৪৫. সুনানে বায়হাকী আল-কুবরা, খণ্ড নং-১০, পৃষ্ঠা নং-১১৬. মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা, খণ্ড নং-০৭, পৃষ্ঠা নং-১৫৬. ইমাম তাবারানী রচিত আল-মু'জামুল কাবির, খণ্ড নং-১৭, পৃষ্ঠা নং-৯২. শুআবুল ঈমান, খণ্ড নং-০৭, পৃষ্ঠা নং-৪৫. ফাতহুল কাদির, খণ্ড নং-০২, পৃষ্ঠা নং-৩৫৫.
[2] তাফসীরে তাবারী খণ্ড নং-১৪, পৃষ্ঠা নং-২১১ ও ২১২.
আরো দ্রষ্টব্য: ফাতহুল কাদীর, খণ্ড নং-০২, পৃষ্ঠা নং: ৩৫৫. তাফসীরে ইবনে কাসীর খণ্ড নং-০২, পৃষ্ঠা নং-৩৫০
[3] তাফসীরে তাবারী, খণ্ড নং-১৪, পৃষ্ঠা নং-২১৩
[4] তাফসীরে কুরতুবী খণ্ড নং-০৫, পৃষ্ঠা নং-১৬২
[5] ইমাম জাসসাস রচিত আহকামুল কুরআন খণ্ড নং-০২, পৃষ্ঠা নং-২৯৭
[6] আল-ফাসল, খণ্ড নং-০৩, পৃষ্ঠা নং-২৬৬
[7] আল-ফাতাওয়া, খণ্ড নং-০৭, পৃষ্ঠা নং-৬৭.
[8] তাফসীরে ইবনে কাসীর, খণ্ড নং-০৩, পৃষ্ঠা নং-২৯৫.
[9] তাফসীরে ইবনে কাসীর, খণ্ড নং-০৪, পৃষ্ঠা নং-১১৯.
[10] ফাতহুল কাদীর, খণ্ড নং-০২, পৃষ্ঠা নং-৩৫৩.
[11] মাজমুউল ফাতাওয়া: ৪/৩৪১.
[12] সৌদি আরবের সাবেক মুফতি শাইখ মুহাম্মাদ ইবনে ইব্রাহিম রাহিমাহুল্লাহ'র ফতোয়া সংকলন: ১২/২৫১.
[13] প্রাগুক্ত
[14] উমদাতুল তাফসীর: ৪/১৫৭.
[15] ফাতহুল মাজীদ শরহু কিতাবিত তাওহীদ, পাদটীকা, পৃষ্ঠা নং: ৩৯৬.
[16] আদওয়াউল বায়ান: ৩/২৬০.
[17] সূরা আত তাওবা: ৭১
[18] সূরা আল হুজুরাত: ১০
[19] সূরা আল আনফাল: ৬২—৬৪
[20] ইবনে মাজাহ্ হাদীসটি তার গ্রন্থে এনেছেন। আলবানী রহিমাহুল্লাহ বলেনঃ "সহীহ"। (সহীহ ইবনে মাজাহ্: ২/১০৫)
[21] আরবিতে আল কিতাবুল মুকাদ্দাস যার বাংলা অর্থ হলো: পবিত্র গ্রন্থ, এটি বাইবেল (Bible) শব্দের আক্ষরিক অনুবাদ নয়। গ্রিক শব্দ biblia থেকে লাতিন ভাষায় বাইবেল শব্দটির উৎপত্তি। গ্রিক শব্দটির অর্থ হচ্ছে: গ্রন্থসমূহ। তাই বাইবেল শব্দের শুদ্ধ অনুবাদ হলো: গ্রন্থসমূহ। [Microsoft Encarta 2009, Bible].
Comment