জাতীয়তাবাদ একটি আদর্শ ও একটি চেতনার নাম যা ইসলামের সাথে স্পষ্ট সাংঘর্ষিক
—মিসওয়ার তাকী
—মিসওয়ার তাকী
জাতীয়তাবাদের মূল থিসিস হলোঃ
“ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে কোনো কাঁটাতারের আবদ্ধ ভূমিতে থাকেনে ওয়ালা প্রতটি মামুষ এক জাতি”
কাটাতারের ওপারে যারা তারা মানুষ হবে কিন্তু আমার জাতি নয়। আমার জাতি হলো আমার সীমাবদ্ধ কাঁটাতারের বেড়ায় যারা রয়েছে [কাফের,মুশরিক ইত্যাদি হলেও আমার জাতি] আর অন্য ভূখন্ডে মুসলিম থাকলেও সে আমার জাতি নয়।
এখানে ওয়ালা ও বারা'র ভাগ হয় কাঁটাতারের সীমানা হিসেবে। ইসলামের কোন নূন্যতম মূল্যায়ন এখানে নেই। যা সুস্পষ্ট ইসলামের সাথে পরিপূর্ণ সাংঘর্ষিক।
ওস্তাদে মুহতারাম বলেছেনঃ
“জাতীয়তাবাদের মূলভিত্তি হলো পতাকা/কাঁটাতার/গোত্র কিংবা অঞ্চল”।
জাতীয়তাবাদের একাধিক স্তর রয়েছে
১। রাষ্ট্র ভিত্তিক জাতীয়তাবাদ
২। গোত্রভিত্তিক জাতীয়তাবাদ
৩। অঞ্চলভিত্তিক জাতীয়তাবাদ
৪। ভাষাগত জাতীয়তাবাদ
যখন ইসলাম উপরের কোনটির মোকাবেলায় আসে তখন জাতীয়তাবাদীরা ইসলামকে প্রত্যাখ্যান করে কেউ মানচিত্রের জাতীয়তাবাদ, কেউ গোত্রপ্রীতি, কেউ অঞ্চল প্রিতি কেউ ভাষাগত প্রীতির কারণে ইসলামকে প্রত্যাখ্যান করে। যা স্পষ্ট কুফর।
জাতির ঐক্য কীসের উপরঃ
জাতির জাতীয় ঐক্য হবে এই তাওহিদের উপরই। যেমন আল্লাহ তায়ালা বলেন [واعتصموا بحبل الله جميعا] “আল্লাহর রজ্জুকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে আঁকড়ে ধরো।”
দেখুন আয়াতটি ঐক্যবদ্ধ হওয়ার মূল ভিত্তি নির্ধারণ করে দিয়েছেন আল্লাহর রজ্জু তথা তাওহীদ।
সকল মুমিন একজাতিঃ
এ সম্পর্কে আল্লাহ্ তা'আলা ইরশাদ করেন: إِنَّمَا الْمُؤْمِنُونَ إِخْوَةٌ প্রকৃতপক্ষে সকল মুসলমান ভাই ভাই [সূরা হুজুরাত,আয়াত:১০]
পৃথিবীতে মাত্র দুটি জাতিই থাকবেঃ
১। মুমিন।
২। কাফের।
মুমিন এক জাতি আর সকল কাফের এক জাতি, আল্লাহ তায়ালা বলেন-
هُوَ الَّذِي خَلَقَكُمْ فَمِنْكُمْ كَافِرٌ وَمِنْكُمْ مُؤْمِنٌ وَاللَّهُ بِمَا تَعْمَلُونَ بَصِيرٌ
“তিনিই তোমাদেরকে সৃষ্টি করেছেন। অতঃপর তোমাদের মধ্যে কেউ কাফের ও কেউ মুমিন। তোমরা যা-কিছু কর আল্লাহ্ তা ভালভাবে দেখছেন।”
[সূরা তাগাবুন, আয়াত: ২]
জাতীয়তাবাদ আপনাকে বুঝাবেঃ
কিন্তু জাতীয়তাবাদ আপনাকে এটা বুঝাবে যে গোত্র, রাষ্ট্রের ভেতরে যে থাকবে সে সবসময়ই ভালো আর সেই তোমার জাতি [চাই সে কাফের মুশরিক, মুরতাদ বা শাতিম হোকনা কেন] অথচ কাফির কখনোই মুমিনের স্বজাতি হয়না, তার আহল বা পরিবারভুক্তও হয়না যেমনটা হজরত নুহ আলাইহিসসালামকে আল্লাহ তায়ালা বলেছেন [নুহ] তোমার ছেলে তোমার পরিবারের কেউ নয় [إنه ليس من أهلك]
দুটি দর্শন সাংঘর্ষিকনকেন??
দর্শন দুটি-
১। ইসলামি দর্শন।
২। জাতীয়তাবাদি দর্শন।
ইসলামের মূল ভিত্তিঃ
ইসলামের মূল ভিত্তি "তাওহীদ" যা এক আল্লাহর দেয়া ঐশী গ্রন্থে বর্ণিত হয়েছে إن الدين عند الله الإسلام আল্লাহর নিকট একমাত্র মনোনীত 'দ্বীন' [আদর্শ, ধর্ম, বিশ্বাস চেতনা] হলো ইসলাম।
এবং মহান আল্লাহ আরো বলেন-[واعتصموا بحبل الله جميعا] আল্লাহর রজ্জুকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে আঁকড়ে ধরো।
দেখুন আয়াতটি ঐক্যবদ্ধ হওয়ার মূল ভিত্তি নির্ধারণ করে দিয়েছেন আল্লাহর রজ্জু তথা তাওহীদ।
জাতীয়তাবাদের মূলভিত্তিঃ
যেমনটি আমরা উরপরে বলেছি জাতীয়তাবাদের একাধিক স্তর রয়েছে
১। রাষ্ট্র ভিত্তিক জাতীয়তাবাদ
২। গোত্রভিত্তিক জাতীয়তাবাদ
৩। অঞ্চলভিত্তিক জাতীয়তাবাদ
৪। ভাষাগত জাতীয়তাবাদ।
অর্থাৎ সকল কিছুর উপরে এগুলোকে প্রধান্য দেয়া এমনকি তাওহীদের উপরও এরা রাষ্ট্র, গোত্র কিংবা ভাষা ও অঞ্চলকে প্রাধান্য দিয়ে থাকে যা স্পষ্ট কুফর। সেই হিসেবে বাংলাদেশের প্রতিটি অঞ্চল, প্রতিটি গোত্র প্রতিটি জেলার মানুষ আলাদা আলাদা জাতি হয়ে ভাগ হয়ে যাবে।।
সংশয়ঃ
কোরআনে বেশ কিছু জায়গায় নবীগন [বিশেষ করে হজরত মুসা আলাইহিসসালাম] 'ইয়া ক্বওমি' বলে সম্বোধন করেছেন অর্থাৎ হে আমার জাতি। অথচ সেই জাতি তখনো কাফের ছিলো। যদি জাতীয়তাবাদ কুফরিই হয় তাহলে নবীগন কাফিরদেরকে নিজের জাতি বললেন কেন?
জওয়াবঃ
মুফতি মাসুরুল হক হাফিঃ [মুহতামিম রাহমানিয়া] উক্ত অভিযোগের জওয়াবে বলেন- “আভিধানিক অর্থে গোত্রীয় লোকদেরকে জাতি বলা যায়। তবে জাতীয় ঐক্যের ভিত্তি এর উপর রাখা যায় না।”
কারণ আমরা ইতিপূর্বেই বলেছি জাতি মাত্র দুটি-
১। মুসলিম
২। কাফের।
তাই এটা বলার কোনই সুযোগ নেই যে নবীগন কাফিরেদরকে "হে আমার জাতি/সম্প্রদায় বলে ঐক্যের ভিত্তি বুঝিয়েছেন। বরং তা নিছক শাব্দিক অর্থের দিক বিবেচনায়ই বলে থাকবেন" কারণ নবী মুহাম্মদ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন-- সকল কাফের এক জাতি [الكفر ملة واحدة]।
জাতিগত মর্যদা প্রত্যাখ্যাতঃ
ইসলাম দৈহিক গঠন ও বর্ণবাদী দৃষ্টিভঙ্গি এবং ভাষা, ভূখণ্ড, বংশ-গোত্র ইত্যাদিকে কেন্দ্র করে সৃষ্ট জাতীয়তাবাদী চেতনার বুকে কুঠারাঘাত করেছে:
☞ রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,
فَلَيْسَ
لِعَرَبِيٍّ عَلَى عَجَمِيٍّ فَضْلٌ، وَلا لِعَجَمِيٍّ عَلَى عَرَبِيٍّ فَضْلٌ، وَلا لأَسْوَدَ عَلَى أَبْيَضٍ وَلا لأَبْيَضَ عَلَى أَسْوَدَ فَضْلٌ إِلا بِالتَّقْوَى. “একমাত্র তাকওয়া (আল্লাহভীতি) ছাড়া অনারবীর উপর আরবের কোন শ্রেষ্ঠত্ব নেই, আরবের উপর অনারবের কোন শ্রেষ্ঠত্ব নেই, শ্বেতাঙ্গের উপর কৃষ্ণাঙ্গের কোন শ্রেষ্ঠত্ব নেই আবার কৃষ্ণাঙ্গের উপর শ্বেতাঙ্গের কোন শ্রেষ্ঠত্ব নেই।” (মুসনাদে আহমদ, ত্ববারানী…সহীহ)
☞ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আরো বলেন,
إِنَّ اللهَ لاَ يَنْظُرُ إِلَى أَجْسَادِكُمْ، وَلاَ إِلَى صُوَرِكُمْ، وَلكِنْ يَنْظُرُ إِلَى قُلُوبِكُمْ وَأَعْمَالِكُمْ
“নিশ্চয় আল্লাহ তোমাদের দেহ ও আকার-আকৃতি দেখেন না, বরং তিনি তোমাদের অন্তর ও আমল দেখেন।’’ (বুখারী ও মুসলিম)
ইসলাম কেন জাতীয়বাদকে প্রত্যাখ্যান করে সে সম্পর্কিত কয়েকটি দিক হলোঃ
প্রথমত
জাতীয়তাবাদের কারণে ইসলামের একটি মূলনীতি “আল ওয়ালা ওয়াল বারাহ” সুস্পষ্টভাবে লঙ্ঘিত হয়। আল ওয়ালা ওয়াল বারাহ এর মর্মার্থ হলো আল্লাহর জন্যই ভালোবাসা এবং আল্লাহর জন্যই ঘৃণা। একজন মুসলিমের প্রতি আরেকজন মুসলিমের ভালোবাসা থাকতে হবে আল্লাহর জন্যই। ইসলামের প্রতি বিদ্বেষ পোষণকারী কাফির মুনাফিকদের প্রতি অন্তরে ঘৃণা থাকতে হবে আল্লাহর জন্যই। কোন পার্থিব স্বার্থের জন্য নয়। কিন্তু জাতীয়তাবাদ মুসলিমদের এই সম্পর্কের মধ্যে দেয়াল তৈরি করে দেয়। ভিনদেশের মুসলিমকে তখন আর আপন ভাবা যায় না। অন্যদিকে নিজ দেশের আল্লাহদ্রোহীর প্রতিও সহানুভূতি চলে আসে। .
দ্বিতীয়ত
জাতীয়তাবাদ মুসলিম উম্মাহর পারস্পরিক ভ্রাতৃত্ববোধ ধ্বংস করে দেয়। পৃথিবীর যে কোন প্রান্তে একজন মুসলিমের কষ্টে সমস্ত পৃথিবীর মুসলিমের অন্তরে কষ্ট অনুভূত হবে, এটিই ইসলামের শিক্ষা।
অথচ জাতীয়তাবাদ আমাদের সেই অনুভূতি নষ্ট করে দিয়েছে। নিজ দেশের কিংবা নিজ জাতির মানুষ সুখে থাকলেই আমরা খুশি। আর এরূপ স্বার্থপরতাই হচ্ছে জাতীয়তাবাদের মূল শিক্ষা। .
তৃতীয়ত
জাতীয়তাবাদ নিজের জাতিকে অন্যান্য জাতি থেকে শ্রেষ্ঠ ভাবতে শেখায়। ইসলামে নিজ জাতিকে নিয়ে অহংকার কিংবা বংশ মর্যাদার গৌরব চরম নিন্দনীয়। ইসলাম এরূপ কর্মকে জাহেলি যুগের কর্ম বলে উল্লেখ করেছে। প্রকৃতপক্ষে মানুষের সম্মান ও শ্রেষ্ঠত্বের মানদন্ড হলো তাকওয়া। এক্ষেত্রে গায়ের রঙ, বংশ, জাতি, ভাষা, ভূখণ্ড ইত্যাদি মূল্যহীন। .
চতুর্থত
জাতীয়তাবাদ মানুষকে সত্য অস্বীকার করতে শেখায়। নিজ সম্প্রদায় যখন বাতিলের উপর প্রতিষ্ঠিত থাকে এবং অন্য সম্প্রদায়ের নিকট থেকে সত্যের আহ্বান আসে তখন জাতীয়তাবাদের চেতনায় উন্মত্ত ব্যক্তির জন্য স্বাভাবিকভাবেই সত্যকে গ্রহণ করা সম্ভব হয় না। আর ঠিক এরূপ কারণেই ইহুদি সমাজ মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে সত্য রাসূল হিসেবে বিশ্বাস করার পরও ইসলাম গ্রহণ করে সফল হতে পারে নি। .
পঞ্চমত
জাতীয়তাবাদ ন্যায় অন্যায় বোধকে নষ্ট করে দেয়। জাতীয়তাবাদের দাবিই হলো নিজের স্বজাতিকে সাহায্য করা হবে যদিও সে অন্যায় করে এবং অন্য জাতিকে সাহায্য করা হবে না যদিও তারা নিরপরাধ হয়। অথচ ইসলামের শিক্ষা হলো অন্যায়কারীকে শাস্তি দেওয়া হবে এবং অত্যাচারীকে প্রতিরোধ করা হবে, যদিও সে নিজ সম্প্রদায় কিংবা নিজ দেশের নাগরিক হয়।জাতীয়তাবাদ একটি আদর্শ যেখানে জাতিকে মানব সমাজের কেন্দ্রীয় অবস্থানে স্থাপন করা হয়। সহজভাবে বলা যায়, কোন ব্যক্তি যখন শুধুমাত্র নিজের জাতির উন্নতি কামনা করে, নিজের দেশ জাতি ভাষা কিংবা পতাকা নিয়ে গর্ব বোধ করে, অন্যান্য দেশ ও জাতিকে ভিন্ন দৃষ্টিতে বিচার করে, অন্য জাতিকে ঘৃণা করে কিংবা কম ভালোবাসে যদিও তারা মুসলিম হয়, অন্যান্য দেশ ও জাতির তুলনায় নিজের দেশ ও জাতিকে শ্রেষ্ঠ মনে করে, তখন তার সেই মনোভাব বা আদর্শকে জাতীয়তাবাদ বলা হয়।
একটি নিরসঃ
দেশের প্রতি একটি ভালোবাসা বা টান থাকাটা স্বাভাবিক তবে তা তাওহীদ ও আকিদার এগেনেইস্টে নয়। কোন ভূখন্ডকে ভালোবাসলে এই বিষয়ে ভালোবাসুন যে, আমি এই ভূমিতে আল্লাহর শরীয়াহ চালু করবো, তাই এখানের প্রতি আমার আলাদা টান রয়েছে। কিন্তু রাষ্ট্রে কুফর শিরকি শাসনব্যবস্থা চালু রয়েছে, কুফরি ও শিরকি দিবস পালন হচ্ছে, আর আপনি দেশের টানে সেগুলোতেও জড়িয়ে পড়বেন এটা ইসলাম সমর্থন করেনা।
কেউ নিজের পরিচয়ের জন্য কোন গোত্রীয় পরিচয় দিতে পারে, তবে তা আদর্শ, চেতনা বা গৌরব অহংকারের জন্য সাব্যস্ত নয়, হতে পারে না।
ইসলামি রাষ্ট্রগুলোও নিজদেরে সীমানা রক্ষা করবে, তবে তা জাতিগত পার্থক্য করে নয়। অর্থাৎ ভিন্ন রাষ্ট্রে কোন মুসলিম নির্যাতিত হলে তখন এই রাষ্ট্রীয় সীমানা প্রতিবন্ধ থাকবেনা, কারণ মূল হলো ইসলাম, এটার পরে বাকি কাজ।
গেলো ২৬ মার্চ একটি দিবস গেলো। কিছু ইসলাম সমমনা দল দেখা গেলো দিবস পালন করছেন, কিন্তু কেন? ১৭ই রমাদান তো প্রথম ইসলামের বিজয় তারা তো সেটা পালন করেনি তাহলে তারা কীসের জন্য ২৬ মার্চের দিবস পালন করলো?
দেখুন এই দেশ কখনই স্বাধীন নয়, একটি দেশ স্বাধীন তখন বলা হবে যখন তা কুফর শিরক মুক্ত হয়ে শরীয়াহ প্রতিষ্ঠা হবে, কিন্তু এক কুফরি শাসনব্যবস্থা থেকে রুপান্তর হয়ে আরেক কুফরি ব্যবস্থায় পরিবর্তন হওয়া কি স্বাধীনতা?
আর ২৬শে মার্চ তো দ্বিতীয় কুফরে কনভার্ট হওয়ার জন্য স্বাধীনতার ঘোষণা দেয়া হয়েছিলো তাতে মুসলিমদের পালনের কী রয়েছে?
আর তা ছাড়া এসব দিবস পালনের শরঈ মূল্যানই বা কী?
——————
Comment