একিউ দাইশঃ পার্থক্য পর্যালোচনাঃ- ৩
ইন্টেলিজেন্স সার্ভিসগুলো দুইভাবে জিহাদের মোকাবেলা করে:
শিথিলতা প্রদর্শন:
মিশরের আল জামাতুল ইসলামিয়ার ক্ষেত্রে উক্ত নীতির বাস্তবায়ন পরিলক্ষিত হয়েছে। উক্ত ইসলামি জামাআত মিসরের প্রেসিডেন্ট আনোয়ার সাদাতকে হত্যা করতে সক্ষম হয়েছিল। তবে তারা যখন নৈতিক পরিবর্তনের ঘোষণা দেয় তখন মিডিয়া ও ইন্টেলিজেন্স সার্ভিসগুলো সহানুভূতিশীল হবার ভান করে।
তাকফিরের ক্ষেত্রে বাড়াবাড়ি ছড়িয়ে দেওয়া:
আলজেরিয়ার সশস্ত্র ইসলামি জামাআতের ক্ষেত্রে উক্ত নীতির বাস্তবায়ন ঘটানো হয়েছে। উক্ত জামাআতের অবস্থা এমন হয়েছিল যে, তারা নির্বিচারে তাকফির করে নিজেদের বন্ধুবান্ধব ও সহকর্মীদেরকে পর্যন্ত হত্যা করেছিল। একপর্যায়ে তারা গোটা মুসলিম জাতিকে তাকফির করে।
তাকফিরের ক্ষেত্রে বাড়াবাড়ির সাম্প্রতিকতম দৃষ্টান্ত হলো - সাম্প্রতিক দাইশ।
ইন্টেলিজেন্স সার্ভিসগুলো তাদের ক্ষেত্রে বাড়াবাড়ি ছড়িয়ে দেওয়ার নীতি ষোলআনা কাজে লাগিয়েছে। যে সময় জিহাদি দলসমূহের জন্য মুসলিম উম্মাহর সাহায্য-সহযোগিতা ছিল অতি প্রয়োজনীয়, সে সময়টিতে তাদের বাড়াবাড়ি তাদেরকে উম্মাহ থেকে বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছে।
ইন্টেলিজেন্স সার্ভিসগুলো সবসময়ই বাড়াবাড়ি ছড়িয়ে দেওয়ার নীতি বাস্তবায়ন করতে উপযুক্ত পরিবেশ খুঁজতে থাকে। তাদের খোঁজখবর জেলখানার বন্দিদের থেকে শুরু করে জিহাদের ময়দান পর্যন্ত সর্বত্রই চলতে থাকে।
ইরাকের দিকে দৃষ্টি ফেরালে দেখা যাবে যে, বাড়াবাড়ির বিস্তার প্রথম থেকেই শুরু হয়েছিল। দাইশের বদৌলতে ধীরে ধীরে তা বর্তমান পর্যায়ে পৌঁছে।
প্রথম দিকে ইন্টেলিজেন্স সার্ভিস ও মিডিয়া ব্যাপকভাবে তাদের বাড়াবাড়ি প্রচার করে এবং আইএসকে একিউর সেকেন্ড জেনারেশন (২g) তথা উন্নত ও দ্বিতীয় প্রজন্ম বলে প্রচারণা চালায়।
ফলে অনেকেই দাইশকে একিউর চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ ও কার্যকর ভাবতে থাকে এবং তাদের দলে ভিড়তে শুরু করে।
সেই সাথে আবু মুসআব যারকাভী রহিমাহুল্লাহ’র কিছু কঠোর অভিমতের আশ্রয় নিয়ে এমন একটি ধারনা ছড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করা হয়ে যে, উক্ত 2g (দাইশ) তিনিই প্রতিষ্ঠা করেছেন।
বাস্তবে এই 2g বানিয়েছেন বাগদাদী, শাইখ যারকাভী নয়।
বাড়াবাড়ির সূচনা:
ইরাকে আমেরিকার যুদ্ধ চলাকালীন সময়ে দিকনির্দেশনা দেওয়ার মতো আলেম-উলামা ছিল না বললেই চলে। উম্মাহর আলেমদের লক্ষ্যে এক বার্তায় [إلحاق بالقافلة](কাফেলাবদ্ধ হও) শাইখ যারকাভী বলেন, ‘আল্লাহর কসম! আপনি আমাদের মাঝে এমন কোনও আলেম পাবেন না, আমরা যার শরণাপন্ন হতে পারি’।
ইরাকে উলামায়ে কেরামের অনুপস্থিতির ফলে শরিয়ত সম্পর্কে অজ্ঞতা বিস্তার লাভ করে। সেইসাথে জিহাদি দলসমূহের মাঝে তাকফিরের ক্ষেত্রে বাড়াবাড়ির প্রবণতা ছড়িয়ে পরে।
ইরাকে বাড়াবাড়ি কোন পর্যায়ে পৌঁছেছিল তার একটি ধারণা পাওয়া যায় শাইখ মায়সারা আল-গরীরের বক্তব্যে। তিনি ছিলেন একউর শরিয়া বোর্ডের প্রধান। পরবর্তীতে দাওলাতুল ইরাক আল ইসলামিয়ার শরিয়া বোর্ডের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন।
الزرقاوي كماعرفته’’ (আমার দেখা যারকাভী)
শিরোনামে এক বার্তায় তিনি বলেন, ‘সৌদির এক যুবক ইরাকের জিহাদে অংশগ্রহণ করতে চাচ্ছিল। জেলা পর্যায়ের একজন আমীর তাকে এই কারণে ফিরিয়ে দেন যে, সে শাইখ বিন বাজ ও শাইখ উসাইমীনকে তাকফির করে না’।
শাইখ মায়সারা আল-গরীর বলেন,
‘শাইখ যারকাভী বিষয়টি জানতে পেরে খুব রাগান্বিত হন এবং বলেন, “জাজিরাতুল আরবের উক্ত ভাই বাদশা ফাহাদকে তাকফির না করলেও আমি তাকে জিহাদ থেকে বঞ্চিত করতাম না।”
মোটকথা,
শাইখ মায়সারা শাইখ যারকাভীকে এবং বাড়াবাড়িতে লিপ্তদেরকে এক চোখে দেখতেন না। শাইখ যারকাভী আলেম-উলামাদের সাথে দেখা সাক্ষাত করতেন এবং তাদের থেকে তিনি শিক্ষাও গ্রহণ করেছেন। আর বর্তমানে যারা নিজেদেরকে শাইখ যারকাভীর অনুসারী বলে দাবি করছে তারা আলেম-উলামা ও ইলম থেকে সবচেয়ে বেশি দূরে অবস্থান করছে।
ইরাক থেকে ফিরে আসা লোকদের অধিকাংশই বাড়াবাড়ির ভাইরাস নিয়ে ফিরে আসে। জেলখানায় আমার এক বন্ধুর কথা মনে পড়েছে, ইরাক থেকে ফেরার পর তিনি বন্দি হয়েছিলেন। তিনি জেলখানায় ইখওয়ানের বিরুদ্ধে লেখালেখি করতেন এবং তা প্রচার করতেন। তিনি লিখতেন, ‘ইখওয়ানুল মুসলিমীন মুরতাদদের দল’। আমার উক্ত সঙ্গীর ইলম-কালাম মোটামুটি ছিল। তারই যখন এই অবস্থা তাহলে নিরক্ষরদের অবস্থা কী হতে পারে ভাবা যায়?!
দাইশের আবির্ভাবের পূর্বেই ইরাকের মাটিতে বাড়াবাড়ি বিদ্যমান ছিল। তার প্রমাণ পাওয়া যায় জাইশুল মুজাহিদিনের এক কমান্ডার আবু আব্দুল্লাহ মানসূরের রচিত (আদদাওলাতুল ইসলামিয়্যাহ বাইনাল হাকীকতি ওয়াল ওহমি) নামক গ্রন্থে। কিতাবটির এক জায়গায় এসেছে, ‘বর্তমানে নেতৃত্ব - যাদেরকে তথাকথিত দাওলাতুল ইরাক আল-ইসলামিয়া বলা হয়; নিঃসন্দেহে তাকফিরের ক্ষেত্রে বাড়াবাড়ি, অন্যায়ভাবে হত্যা ইত্যাদিসহ আরও বহু অপকর্ম তারা খারেজীদের মত করেছে।’
বাড়াবাড়ি ছড়িয়ে দেয়ার পেছনে জিহাদি সংগঠনসমূহের ভূমিকা:
বহু জিহাদি সংগঠন ইন্টারনেটে মুজাহিদগণের সংবাদ পরিবেশন করতো। উম্মাহর মাঝে মুজাহিদদের খবর পৌঁছানোর সাথে তারা বাড়াবাড়ি ধারনারও বিস্তার ঘটিয়েছিল।
কারণ ইরাকের সংগঠনসমূহের সিংহভাগই ছিল বাড়াবাড়ি ও সীমালঙ্ঘনের আদর্শের ধারক বাহক। তাই যুবকরা এসব মাধ্যম থেকে মুজাহিদগণের সংবাদ সংগ্রহের পাশাপাশি বাড়াবাড়ির ভাইরাসে আক্রান্ত হচ্ছিল।
এখানে আমি দুইটি ঘটনা উল্লেখ করব। আশাকরি এর মাধ্যমে জিহাদি যুবকদের উপর এই সংগঠনসমূহের প্রভাব এবং এগুলোর পেছনে যুবকদের ছুটে চলার প্রবণতা অনুমান করা যাবে।
প্রথম ঘটনা:
একিউর নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিত্ব শাইখ আতিয়্যাতুল্লাহর একটি প্রবন্ধ ‘ইখলাস আল-ইসলামিয়া ফোরামে’ প্রকাশিত হয়। সেখানে তিনি ইরাকের জিহাদ নিয়ে আলোচনা করেন। তার আলোচনায় তাদের কিছু ত্রুটি-বিচ্যুতির কথাও স্থান পায়। ফলে সংগঠনগুলোর পক্ষ থেকে প্রতিবাদের ঝড় বইতে থাকে। পরিস্থিতির লাগাম টেনে ধরতে শাইখ যারকাভী নিজেই এগিয়ে আসেন। তিনি এ বিষয়ে তার বিবৃতি প্রকাশ করেন। এর শিরোনাম ছিল “আতিয়্যাতুল্লাহর বিষয় ছাড়ো; তিনি যা বলেন তা তিনি ভালো করে বুঝেই বলেন।”
উক্ত বিবৃতিতে তিনি বলেন, ‘প্রথমেই শাইখকে পরিচয় করিয়ে দেওয়া সমীচীন হবে। আতিয়্যাতুল্লাহ আমার এবং তোমাদের বড় ভাই, আর আমি তোমাদের ছোট ভাই। প্রকৃত শাইখ তিনিই, আমি নই। আমি এসব বিনয় প্রকাশার্থে বলছি না, বরং এটিই বাস্তবতা।’ অতঃপর পরিস্থিতি শান্ত হয়।
দ্বিতীয় ঘটনা:
ইরাকের মুজাহিদগণ যখন ‘দাওলাতুল ইরাক আল-ইসলামিয়া’ ঘোষণা করলেন তখন শাইখ হামিদ আলী এই ঘোষণার বিরোধিতা করেন। সংগঠনগুলো তার বিরুদ্ধে ফুঁসে উঠতে শুরু করলে তাকে পদচ্যুত করা হয়। অথচ তাকে ইরাকী জিহাদের প্রথম সারির নেতৃবৃন্দের মাঝে গণ্য করা হয়।
ইরাকীদের বাড়াবাড়ি সম্পর্কে একিউ কি নিষ্ক্রিয় ছিল?:
দাইশের আত্মপ্রকাশের পূর্বেও একিউর নেতৃবৃন্দ ইরাকী মুজাহিদগণের বেশকিছু বিষয়ে সমালোচনা করতেন। সেগুলোর কয়েকটি হলো-
তাকফিরের ক্ষেত্রে বাড়াবাড়ি করা এবং ব্যাপক রক্তপাত ঘটানো।
☞ মসজিদ, বাজার ও গণজমায়েতে হামলা করা।
☞ সাধারণ ও নিরস্ত্র শিয়াদের উপর হামলা করা।
☞ ছুরি দিয়ে জবাই করা এবং তা ক্যামেরায় ধারণ করা।
এই বিষয়ে শাইখ আইমান হাফিঃ, শাইখ আতিয়্যাতুল্লাহ সহ একিউর আরও কতিপয় দায়িত্বশীলের বক্তৃতা, বিবৃতি ও পুস্তিকা প্রকাশিত হয়েছে।
এই বিষয়ের উপর শাইখ আবু মুহাম্মদ মাকদিসীর একটি বার্তা রয়েছে। বার্তাটির শিরোনাম ‘শরিয়ত ও বাস্তবতার সঠিক ধারণা ছাড়া জিহাদের পরিণতি’।
শাইখ মাকদিসী আল-কায়েদার সাথে জড়িত নন। তবে তাঁকে বৈশ্বিক-জিহাদের পক্ষশক্তি গণ্য করা হয়।
একিউ যদিও উপরোক্ত বাড়াবাড়িমূলক কর্মকাণ্ড করত না, তবুও তারা জিহাদের স্বার্থে এবং মুজাহিদগণের ঐক্য অটুট রাখতে মঙ্গলকামিতা, নম্রতা ও সদুপদেশ প্রদানের কৌশল গ্রহণ করেছিলেন।
মুজাহিদগণ কোনও কোনও সময় সেই সদুপদেশ শুনেছেন এবং মেনেছেন। তবে এখন যা ঘটছে তাতে চুপ থাকার বা শিথিলতা প্রদর্শনের কোনও সুযোগ নেই। জিহাদকে চরমভাবে বিকৃত করে দাইশ ঘৃণ্য ও বীভৎস রূপ নিয়ে আত্মপ্রকাশ করেছে।
অগত্যা একিউ তাদের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করেছে। শুধু একিউই নয় বরং সাধারণভাবে অন্য সকল জিহাদি তানজিম তাদের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করেছে।
২১শে রবিউল আওয়াল ১৪৩৫ হিজরিতে একিউর এক বিবৃতিতে এসেছে-
একিউ ঘোষণা করছে যে, আদ দাওলাতুল ইসলামিয়া ফিল ইরাক ওয়াশ-শামের (দাইশ) সাথে একিউর কোনও সম্পর্ক নেই।
জিহাদি কার্যক্রম পরিচালনা করতে একিউ কয়েকটি বিষয়ের উপর গুরুত্বারোপ করতে চায়। সেগুলোর একটি হলো, ‘আমরা উম্মাহর অংশ’ এবং উম্মাহর অংশ হয়েই থাকতে চাই। স্বেচ্ছাচারীর মতো উম্মাহর ঘাড়ে চেপে বসতে চাই না। আমীর বাছাই করার অধিকার উম্মাহর হাত থেকে ছিনিয়ে নিতে চাই না। আমরা ইসলামি ইমারত বা রাষ্ট্র ঘোষণার ক্ষেত্রে তাড়াহুড়া করা পছন্দ করি না। বরং এক্ষেত্রে উলামায়ে মুজাহিদিন, মুজাহিদ নেতৃবৃন্দ, সাধারণ মুজাহিদ ও মুসলিমগণের পরামর্শ গ্রহণকে আবশ্যক মনে করি। সেই সাথে উম্মাহর পরামর্শ গ্রহণকে আবশ্যক মনে করি। উম্মাহর পরামর্শ ছাড়া নিজেদের খেয়ালখুশি মতো ইসলামি খিলাফাহ ঘোষণা করা এবং এর বিরোধিতাকারীদেরকে মুরতাদ ঘোষণার মতো ধৃষ্টতা দেখানোর প্রশ্নই আসে না।
মূলত একিউ এবং অপরাপর ইসলামি দলসমূহ ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিয়েছেন। তারা আলজেরিয়ার স শ স্ত্র ইসলামি দলের বাড়াবাড়ির পরিণাম দেখেছেন। উক্ত বাড়াবাড়ির মাধ্যমে তারা নিজেদেরকে ধ্বংস করেছে। এসব বিবেচনায় একিউ ও অপরাপর ইসলামি তানজিমসমূহ দাইশের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করতে বাধ্য হয়েছে।
জিহাদি নেতৃবৃন্দ এবং উলামায়ে কেরাম দাইশ'কে ‘খারেজি’ বলে ঘোষণা দিয়েছে। এ বিষয়ে কারো কোনও দ্বিমত আছে বলে আমার জানা নেই। তবে শাইখ আবু মুহাম্মদ মাকদিসী তাদের অনেককে খারেজীদের চেয়েও বেশি ক্ষতিকর বলে মনে করেন।
দাইশের ফিতনা জিহাদের অপূরণীয় ক্ষতি করেছে। তবে তার কিছু ভালো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াও দেখা গেছে। এই ফিতনার পর যুবকরা অনেক কিছু শিখেছে, যা তারা পূর্বে জানত না। যদি একওউর শাইখগণ এই ফিতনার বিরুদ্ধে কঠোর না হতেন এবং উম্মাহকে সতর্ক না করতেন তাহলে হয়তো সিংহভাগ মুজাহিদকে এই ফিতনা গ্রাস করে নিত।
ইন্টেলিজেন্স সার্ভিসগুলো দুইভাবে জিহাদের মোকাবেলা করে:
শিথিলতা প্রদর্শন:
মিশরের আল জামাতুল ইসলামিয়ার ক্ষেত্রে উক্ত নীতির বাস্তবায়ন পরিলক্ষিত হয়েছে। উক্ত ইসলামি জামাআত মিসরের প্রেসিডেন্ট আনোয়ার সাদাতকে হত্যা করতে সক্ষম হয়েছিল। তবে তারা যখন নৈতিক পরিবর্তনের ঘোষণা দেয় তখন মিডিয়া ও ইন্টেলিজেন্স সার্ভিসগুলো সহানুভূতিশীল হবার ভান করে।
তাকফিরের ক্ষেত্রে বাড়াবাড়ি ছড়িয়ে দেওয়া:
আলজেরিয়ার সশস্ত্র ইসলামি জামাআতের ক্ষেত্রে উক্ত নীতির বাস্তবায়ন ঘটানো হয়েছে। উক্ত জামাআতের অবস্থা এমন হয়েছিল যে, তারা নির্বিচারে তাকফির করে নিজেদের বন্ধুবান্ধব ও সহকর্মীদেরকে পর্যন্ত হত্যা করেছিল। একপর্যায়ে তারা গোটা মুসলিম জাতিকে তাকফির করে।
তাকফিরের ক্ষেত্রে বাড়াবাড়ির সাম্প্রতিকতম দৃষ্টান্ত হলো - সাম্প্রতিক দাইশ।
ইন্টেলিজেন্স সার্ভিসগুলো তাদের ক্ষেত্রে বাড়াবাড়ি ছড়িয়ে দেওয়ার নীতি ষোলআনা কাজে লাগিয়েছে। যে সময় জিহাদি দলসমূহের জন্য মুসলিম উম্মাহর সাহায্য-সহযোগিতা ছিল অতি প্রয়োজনীয়, সে সময়টিতে তাদের বাড়াবাড়ি তাদেরকে উম্মাহ থেকে বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছে।
ইন্টেলিজেন্স সার্ভিসগুলো সবসময়ই বাড়াবাড়ি ছড়িয়ে দেওয়ার নীতি বাস্তবায়ন করতে উপযুক্ত পরিবেশ খুঁজতে থাকে। তাদের খোঁজখবর জেলখানার বন্দিদের থেকে শুরু করে জিহাদের ময়দান পর্যন্ত সর্বত্রই চলতে থাকে।
ইরাকের দিকে দৃষ্টি ফেরালে দেখা যাবে যে, বাড়াবাড়ির বিস্তার প্রথম থেকেই শুরু হয়েছিল। দাইশের বদৌলতে ধীরে ধীরে তা বর্তমান পর্যায়ে পৌঁছে।
প্রথম দিকে ইন্টেলিজেন্স সার্ভিস ও মিডিয়া ব্যাপকভাবে তাদের বাড়াবাড়ি প্রচার করে এবং আইএসকে একিউর সেকেন্ড জেনারেশন (২g) তথা উন্নত ও দ্বিতীয় প্রজন্ম বলে প্রচারণা চালায়।
ফলে অনেকেই দাইশকে একিউর চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ ও কার্যকর ভাবতে থাকে এবং তাদের দলে ভিড়তে শুরু করে।
সেই সাথে আবু মুসআব যারকাভী রহিমাহুল্লাহ’র কিছু কঠোর অভিমতের আশ্রয় নিয়ে এমন একটি ধারনা ছড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করা হয়ে যে, উক্ত 2g (দাইশ) তিনিই প্রতিষ্ঠা করেছেন।
বাস্তবে এই 2g বানিয়েছেন বাগদাদী, শাইখ যারকাভী নয়।
বাড়াবাড়ির সূচনা:
ইরাকে আমেরিকার যুদ্ধ চলাকালীন সময়ে দিকনির্দেশনা দেওয়ার মতো আলেম-উলামা ছিল না বললেই চলে। উম্মাহর আলেমদের লক্ষ্যে এক বার্তায় [إلحاق بالقافلة](কাফেলাবদ্ধ হও) শাইখ যারকাভী বলেন, ‘আল্লাহর কসম! আপনি আমাদের মাঝে এমন কোনও আলেম পাবেন না, আমরা যার শরণাপন্ন হতে পারি’।
ইরাকে উলামায়ে কেরামের অনুপস্থিতির ফলে শরিয়ত সম্পর্কে অজ্ঞতা বিস্তার লাভ করে। সেইসাথে জিহাদি দলসমূহের মাঝে তাকফিরের ক্ষেত্রে বাড়াবাড়ির প্রবণতা ছড়িয়ে পরে।
ইরাকে বাড়াবাড়ি কোন পর্যায়ে পৌঁছেছিল তার একটি ধারণা পাওয়া যায় শাইখ মায়সারা আল-গরীরের বক্তব্যে। তিনি ছিলেন একউর শরিয়া বোর্ডের প্রধান। পরবর্তীতে দাওলাতুল ইরাক আল ইসলামিয়ার শরিয়া বোর্ডের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন।
الزرقاوي كماعرفته’’ (আমার দেখা যারকাভী)
শিরোনামে এক বার্তায় তিনি বলেন, ‘সৌদির এক যুবক ইরাকের জিহাদে অংশগ্রহণ করতে চাচ্ছিল। জেলা পর্যায়ের একজন আমীর তাকে এই কারণে ফিরিয়ে দেন যে, সে শাইখ বিন বাজ ও শাইখ উসাইমীনকে তাকফির করে না’।
শাইখ মায়সারা আল-গরীর বলেন,
‘শাইখ যারকাভী বিষয়টি জানতে পেরে খুব রাগান্বিত হন এবং বলেন, “জাজিরাতুল আরবের উক্ত ভাই বাদশা ফাহাদকে তাকফির না করলেও আমি তাকে জিহাদ থেকে বঞ্চিত করতাম না।”
মোটকথা,
শাইখ মায়সারা শাইখ যারকাভীকে এবং বাড়াবাড়িতে লিপ্তদেরকে এক চোখে দেখতেন না। শাইখ যারকাভী আলেম-উলামাদের সাথে দেখা সাক্ষাত করতেন এবং তাদের থেকে তিনি শিক্ষাও গ্রহণ করেছেন। আর বর্তমানে যারা নিজেদেরকে শাইখ যারকাভীর অনুসারী বলে দাবি করছে তারা আলেম-উলামা ও ইলম থেকে সবচেয়ে বেশি দূরে অবস্থান করছে।
ইরাক থেকে ফিরে আসা লোকদের অধিকাংশই বাড়াবাড়ির ভাইরাস নিয়ে ফিরে আসে। জেলখানায় আমার এক বন্ধুর কথা মনে পড়েছে, ইরাক থেকে ফেরার পর তিনি বন্দি হয়েছিলেন। তিনি জেলখানায় ইখওয়ানের বিরুদ্ধে লেখালেখি করতেন এবং তা প্রচার করতেন। তিনি লিখতেন, ‘ইখওয়ানুল মুসলিমীন মুরতাদদের দল’। আমার উক্ত সঙ্গীর ইলম-কালাম মোটামুটি ছিল। তারই যখন এই অবস্থা তাহলে নিরক্ষরদের অবস্থা কী হতে পারে ভাবা যায়?!
দাইশের আবির্ভাবের পূর্বেই ইরাকের মাটিতে বাড়াবাড়ি বিদ্যমান ছিল। তার প্রমাণ পাওয়া যায় জাইশুল মুজাহিদিনের এক কমান্ডার আবু আব্দুল্লাহ মানসূরের রচিত (আদদাওলাতুল ইসলামিয়্যাহ বাইনাল হাকীকতি ওয়াল ওহমি) নামক গ্রন্থে। কিতাবটির এক জায়গায় এসেছে, ‘বর্তমানে নেতৃত্ব - যাদেরকে তথাকথিত দাওলাতুল ইরাক আল-ইসলামিয়া বলা হয়; নিঃসন্দেহে তাকফিরের ক্ষেত্রে বাড়াবাড়ি, অন্যায়ভাবে হত্যা ইত্যাদিসহ আরও বহু অপকর্ম তারা খারেজীদের মত করেছে।’
বাড়াবাড়ি ছড়িয়ে দেয়ার পেছনে জিহাদি সংগঠনসমূহের ভূমিকা:
বহু জিহাদি সংগঠন ইন্টারনেটে মুজাহিদগণের সংবাদ পরিবেশন করতো। উম্মাহর মাঝে মুজাহিদদের খবর পৌঁছানোর সাথে তারা বাড়াবাড়ি ধারনারও বিস্তার ঘটিয়েছিল।
কারণ ইরাকের সংগঠনসমূহের সিংহভাগই ছিল বাড়াবাড়ি ও সীমালঙ্ঘনের আদর্শের ধারক বাহক। তাই যুবকরা এসব মাধ্যম থেকে মুজাহিদগণের সংবাদ সংগ্রহের পাশাপাশি বাড়াবাড়ির ভাইরাসে আক্রান্ত হচ্ছিল।
এখানে আমি দুইটি ঘটনা উল্লেখ করব। আশাকরি এর মাধ্যমে জিহাদি যুবকদের উপর এই সংগঠনসমূহের প্রভাব এবং এগুলোর পেছনে যুবকদের ছুটে চলার প্রবণতা অনুমান করা যাবে।
প্রথম ঘটনা:
একিউর নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিত্ব শাইখ আতিয়্যাতুল্লাহর একটি প্রবন্ধ ‘ইখলাস আল-ইসলামিয়া ফোরামে’ প্রকাশিত হয়। সেখানে তিনি ইরাকের জিহাদ নিয়ে আলোচনা করেন। তার আলোচনায় তাদের কিছু ত্রুটি-বিচ্যুতির কথাও স্থান পায়। ফলে সংগঠনগুলোর পক্ষ থেকে প্রতিবাদের ঝড় বইতে থাকে। পরিস্থিতির লাগাম টেনে ধরতে শাইখ যারকাভী নিজেই এগিয়ে আসেন। তিনি এ বিষয়ে তার বিবৃতি প্রকাশ করেন। এর শিরোনাম ছিল “আতিয়্যাতুল্লাহর বিষয় ছাড়ো; তিনি যা বলেন তা তিনি ভালো করে বুঝেই বলেন।”
উক্ত বিবৃতিতে তিনি বলেন, ‘প্রথমেই শাইখকে পরিচয় করিয়ে দেওয়া সমীচীন হবে। আতিয়্যাতুল্লাহ আমার এবং তোমাদের বড় ভাই, আর আমি তোমাদের ছোট ভাই। প্রকৃত শাইখ তিনিই, আমি নই। আমি এসব বিনয় প্রকাশার্থে বলছি না, বরং এটিই বাস্তবতা।’ অতঃপর পরিস্থিতি শান্ত হয়।
দ্বিতীয় ঘটনা:
ইরাকের মুজাহিদগণ যখন ‘দাওলাতুল ইরাক আল-ইসলামিয়া’ ঘোষণা করলেন তখন শাইখ হামিদ আলী এই ঘোষণার বিরোধিতা করেন। সংগঠনগুলো তার বিরুদ্ধে ফুঁসে উঠতে শুরু করলে তাকে পদচ্যুত করা হয়। অথচ তাকে ইরাকী জিহাদের প্রথম সারির নেতৃবৃন্দের মাঝে গণ্য করা হয়।
ইরাকীদের বাড়াবাড়ি সম্পর্কে একিউ কি নিষ্ক্রিয় ছিল?:
দাইশের আত্মপ্রকাশের পূর্বেও একিউর নেতৃবৃন্দ ইরাকী মুজাহিদগণের বেশকিছু বিষয়ে সমালোচনা করতেন। সেগুলোর কয়েকটি হলো-
তাকফিরের ক্ষেত্রে বাড়াবাড়ি করা এবং ব্যাপক রক্তপাত ঘটানো।
☞ মসজিদ, বাজার ও গণজমায়েতে হামলা করা।
☞ সাধারণ ও নিরস্ত্র শিয়াদের উপর হামলা করা।
☞ ছুরি দিয়ে জবাই করা এবং তা ক্যামেরায় ধারণ করা।
এই বিষয়ে শাইখ আইমান হাফিঃ, শাইখ আতিয়্যাতুল্লাহ সহ একিউর আরও কতিপয় দায়িত্বশীলের বক্তৃতা, বিবৃতি ও পুস্তিকা প্রকাশিত হয়েছে।
এই বিষয়ের উপর শাইখ আবু মুহাম্মদ মাকদিসীর একটি বার্তা রয়েছে। বার্তাটির শিরোনাম ‘শরিয়ত ও বাস্তবতার সঠিক ধারণা ছাড়া জিহাদের পরিণতি’।
শাইখ মাকদিসী আল-কায়েদার সাথে জড়িত নন। তবে তাঁকে বৈশ্বিক-জিহাদের পক্ষশক্তি গণ্য করা হয়।
একিউ যদিও উপরোক্ত বাড়াবাড়িমূলক কর্মকাণ্ড করত না, তবুও তারা জিহাদের স্বার্থে এবং মুজাহিদগণের ঐক্য অটুট রাখতে মঙ্গলকামিতা, নম্রতা ও সদুপদেশ প্রদানের কৌশল গ্রহণ করেছিলেন।
মুজাহিদগণ কোনও কোনও সময় সেই সদুপদেশ শুনেছেন এবং মেনেছেন। তবে এখন যা ঘটছে তাতে চুপ থাকার বা শিথিলতা প্রদর্শনের কোনও সুযোগ নেই। জিহাদকে চরমভাবে বিকৃত করে দাইশ ঘৃণ্য ও বীভৎস রূপ নিয়ে আত্মপ্রকাশ করেছে।
অগত্যা একিউ তাদের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করেছে। শুধু একিউই নয় বরং সাধারণভাবে অন্য সকল জিহাদি তানজিম তাদের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করেছে।
২১শে রবিউল আওয়াল ১৪৩৫ হিজরিতে একিউর এক বিবৃতিতে এসেছে-
একিউ ঘোষণা করছে যে, আদ দাওলাতুল ইসলামিয়া ফিল ইরাক ওয়াশ-শামের (দাইশ) সাথে একিউর কোনও সম্পর্ক নেই।
জিহাদি কার্যক্রম পরিচালনা করতে একিউ কয়েকটি বিষয়ের উপর গুরুত্বারোপ করতে চায়। সেগুলোর একটি হলো, ‘আমরা উম্মাহর অংশ’ এবং উম্মাহর অংশ হয়েই থাকতে চাই। স্বেচ্ছাচারীর মতো উম্মাহর ঘাড়ে চেপে বসতে চাই না। আমীর বাছাই করার অধিকার উম্মাহর হাত থেকে ছিনিয়ে নিতে চাই না। আমরা ইসলামি ইমারত বা রাষ্ট্র ঘোষণার ক্ষেত্রে তাড়াহুড়া করা পছন্দ করি না। বরং এক্ষেত্রে উলামায়ে মুজাহিদিন, মুজাহিদ নেতৃবৃন্দ, সাধারণ মুজাহিদ ও মুসলিমগণের পরামর্শ গ্রহণকে আবশ্যক মনে করি। সেই সাথে উম্মাহর পরামর্শ গ্রহণকে আবশ্যক মনে করি। উম্মাহর পরামর্শ ছাড়া নিজেদের খেয়ালখুশি মতো ইসলামি খিলাফাহ ঘোষণা করা এবং এর বিরোধিতাকারীদেরকে মুরতাদ ঘোষণার মতো ধৃষ্টতা দেখানোর প্রশ্নই আসে না।
মূলত একিউ এবং অপরাপর ইসলামি দলসমূহ ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিয়েছেন। তারা আলজেরিয়ার স শ স্ত্র ইসলামি দলের বাড়াবাড়ির পরিণাম দেখেছেন। উক্ত বাড়াবাড়ির মাধ্যমে তারা নিজেদেরকে ধ্বংস করেছে। এসব বিবেচনায় একিউ ও অপরাপর ইসলামি তানজিমসমূহ দাইশের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করতে বাধ্য হয়েছে।
জিহাদি নেতৃবৃন্দ এবং উলামায়ে কেরাম দাইশ'কে ‘খারেজি’ বলে ঘোষণা দিয়েছে। এ বিষয়ে কারো কোনও দ্বিমত আছে বলে আমার জানা নেই। তবে শাইখ আবু মুহাম্মদ মাকদিসী তাদের অনেককে খারেজীদের চেয়েও বেশি ক্ষতিকর বলে মনে করেন।
দাইশের ফিতনা জিহাদের অপূরণীয় ক্ষতি করেছে। তবে তার কিছু ভালো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াও দেখা গেছে। এই ফিতনার পর যুবকরা অনেক কিছু শিখেছে, যা তারা পূর্বে জানত না। যদি একওউর শাইখগণ এই ফিতনার বিরুদ্ধে কঠোর না হতেন এবং উম্মাহকে সতর্ক না করতেন তাহলে হয়তো সিংহভাগ মুজাহিদকে এই ফিতনা গ্রাস করে নিত।
লেখকঃ- যুবায়ের মুশরিফ