আকিদা সিরিজ: ৩য় পর্ব - তাওহিদুর রুবুবিয়্যাহ
-শাইখ তামিম আল-আদনানী হাফিজাহুল্লাহ
সিরিজের গত পর্বে আমরা তাওহিদের প্রকার তিনটির সংক্ষিপ্ত পরিচয় তুলে ধরেছিলাম। এবার আমরা প্রতিটি প্রকার সম্পর্কে বিস্তারিত জানাব। এই মজলিসে আমরা আলোচনা করব তাওহিদের প্রথম প্রকার তাওহিদুর রুবুবিয়্যাহ নিয়ে।
তাওহিদুর রুবুবিয়্যাহর পরিচয়:
তাওহিদুর রুবুবিয়্যাহর সংজ্ঞা দিতে গিয়ে শাইখ হাফিজ বিন আহমাদ আল-হাকিমি রহিমাহুল্লাহ বলেন:
هُوَ الْإِقْرَارُ الْجَازِمُ بِأَنََّ اللهَ تَعَالَی رَبُّ كُلِّ شَيْءٍ وَمَلِيْكُهُ٭ وَخَالِقُهُ٭ وَمُدَبِّرُهُ٭ وَالْمُتَصَرِّفُ فِيْهِ٭ لَمْ يَكُنْ لَهُ شَرِيْكٌ فِيْ الْمُلْكِ٭ وَلَمْ يَكُنْ لَهُ وَلِيٌّ مِنَ الذُّلِّ٭ وَلَارَادَّ لِأَمْرِهِ٭ وَلَا مُعَقِّبَ لِحُكْمِهِ٭ وَلَا مُضَادَّ لَهُ٭ وَلَا مُمُاثِلَ لَهُ ٭ وَلَا سَمِيَّ لَهُ ٭ وَلَا مُنَازِعَ فِيْ شَيْءٍ مِّنْ مَعَانِيْ رُبُوْ بِيَّتِهِ وَمُقْتَضَيَاتِ أَسْمَائَهِ وَصِفَاتِهِ
"তাওহিদুর রুবুবিয়্যাহ হলো, এই কথার নিরষ্কুশ স্বীকৃতি দেয়া যে, আল্লাহ তাআলা সব কিছুর সৃষ্টিকর্তা, তিনিই সবকিছুর মালিক, গোটা বিশ্বজগতের তিনিই একমাত্র পরিচালক ও নিয়ন্ত্রক, তিনিই সব কিছুর প্রতিপালক: তার রাজত্বে কেউ শরিক নেই, তার কোনো সহযোগী নেই, তাঁর আদেশকে রহিত করার শক্তি কারও নেই, তাঁর নির্দেশকে অগ্রাহ্য করার কেউ নেই, তাঁর কোনো প্রতিপক্ষ নেই- সমকক্ষও নেই। রুবুবিয়্যাহ ও প্রভুত্বের কোনো ক্ষেত্রেই তার বিরোধিতা করার কেউ নেই এবং তাঁর নাম ও গুণাবলিতেও তার প্রতিদ্বন্দ্বী নেই।" (আ"লামুস সুন্নাতিল মানশুরাহ: ৪৫)
আবার অনেকে তাওহিদুর রুবুবিয়্যাহকে সংজ্ঞায়িত করেছেন এভাবে _
اَلْاِعْتِقادُ بِأَنَّ اللهَ هُوَ الْخَالِقُ الرَّازَّاقُ الْمُدَبِّرُ لِكُلِّ شَیْءٍ وَحْدَهُ لَا شَرِيْكَ لَهُ
" আল্লাহ তা'আলা এক ও অদ্বিতীয়, তাঁর কোনো শরিক নেই এবং তিনিই বিশ্বজগতের একমাত্র স্রষ্টা, রিজিকদাতা ও নিয়ন্ত্রক_ এই বিশ্বাসকেই তাওহিদুর রুবুবিয়্যাহ বলে।"
তাহলে তাওহিদুর রুবুবিয়্যাহতে আমরা মৌলিকভাবে দুটি পয়েন্ট পাচ্ছি:
১. আল্লাহর অস্তিত্বে ইমান আনা।
২. আল্লাহ তাআলাকে একমাত্র সৃষ্টিকর্তা, পালনকর্তা, রিজিকদাতা ও নিয়ন্ত্রক বলে বিশ্বাস করা।
সুতরাং কেউ যদি আল্লাহর অস্তিত্ব অস্বীকার করে, সে মুমিন হতে পারবে না। বিকৃত মস্তিষ্কের অধিকারী নাস্তিকরা ছাড়া কেউ আল্লাহ তায়া'লার অস্তিত্বের মতো সহজাত ও স্বতঃসিদ্ধ বিষয়কে অস্বীকার করে না। এ নিয়ে আমরা সামনে আলোচনা করব। অনুরুপভাবে কেউ যদি বিশ্বজগতের সৃষ্টি, প্রতিপালন, নিয়ন্ত্রণ ইত্যাদির ক্ষেত্রে আল্লাহর সঙ্গে কাউকে শরিক করে, তবে সেও তাওহিদের গণ্ডি থেকে বের হয়ে শিরকের গণ্ডিতে প্রবেশ করে। অলি-বুজুর্গরা পৃথিবী পরিচালনা করেন, তারা মানুষের লাভ-ক্ষতির মালিক, তারা সন্তান দিতে পারেন_ধরনের অপবিশ্বাস যদি কেউ লালন করে তবে সে মুশরিক। মোট কথা, আল্লাহর রুবুবিয়্যাহর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট যত গুণ ও বৈশিষ্ট্য আছে এগুলোর একটিও যদি গাইরুল্লাহর জন্য সাব্যস্ত করা হয় তবে তা শিরক বলে গণ্য হবে।
তাওহিদুর রুবুবিয়্যাহর দলিল:
আল্লাহর অস্তিত্বে বিশ্বাস মানুষের সহজাত প্রবৃত্তি। এর জন্য বাহ্যিক কোনো দলিলের মোটেও দরকার নেই। আল্লাহ রব্বুল আলামিন আমাদের এই বিশ্বাস দিয়েই সৃষ্টি করেছেন। আল্লাহর অস্তিত্ব একটি প্রাকৃতিক ও সহজাত অনুভূতি। আমরা জানি আল্লাহ আছেন। সেই সঙ্গে আল্লাহর সামনে নত হওয়ার এবং তাঁর কাছে নিজেদের সমর্পণ করার ব্যাকুলতাও আমাদের অবচেতন মনে কাজ করে। শরিয়াহর পরিভাষায় এটিকে বলা হয় 'ফিতরাহা' আল্লাহ তায়া'লা বলেন:
ا فِطْرَتَ اللَّـهِ الَّتِي فَطَرَ النَّاسَ عَلَيْهَا لَا تَبْدِيلَ لِخَلْقِ اللَّـهِ ذَلِكَ الدِّينُ الْقَيِّمُ وَلَكِنَّ أَكْثَرَ النَّاسِ لَا يَعْلَمُون
"আল্লাহর ফিতরাহ ও প্রকৃতির অনুসরণ করো, যে ফিতরাহ ও প্রকৃতি অনুযায়ী তিনি মানুষ সৃষ্টি করেছেন; আল্লাহর সৃষ্টির কোনো পরিবর্তন নেই। এটিই সরল দ্বীন; কিন্তুু অধিকাংশ মানুষ জানে না '। (সূরা রুম, ৩০:৩০)
প্রতিটি শিশুকেই আল্লাহ তায়া'লা এই ফিতরাহ দিয়েই সৃষ্টি করেছেন। মুসনাদে আহমাদে বর্ণিত একটি সহিহ হাদিসে এসেছে রাসূল ﷺইরশাদ করেন :
مَامِنْ مَولودٍ يُولَدُ إِلَّا عَلی هَذِهِ الْفِطرَةِ
"এমন কোনো শিশু নেই যাকে আল্লাহ তাআলা এই ফিতরাহর ওপর সৃষ্টি করেননি।" ( মুসনাদু আহমাদ: ৮১৭৯)
আধুনিক বিজ্ঞানও এই বিষয়টি প্রমাণ করতে সক্ষম হয়েছে। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ডেভলোপমেন্টাল সাইন্টিস্ট ডক্টর জাস্টিন এল ব্যারেট তার বিখ্যাত 'বর্ন বিলিভার্স' গ্রন্থে সুস্পষ্ট ভাষায় উল্লেখ করেছেন :
শিশুরা জন্মগতভাবেই স্রষ্টার অস্তিত্বে বিশ্বাসী, যাকে আমি বলি সহজাত ধর্ম...। (Born Believers: ১৩৬)১
প্রিয় ভাই! সৃষ্টির পরতে পরতে আমরা খুঁজে পাই একজন মহা পরাক্রমশালী স্রষ্টার অস্তিত্ব। প্রতিটি মাখলুকই একজন খালিকের অস্তিত্বের কথা ঘোষণা করে। তাই প্রতিটি সৃষ্টিই স্রষ্টার অস্তিত্বের একেকটি দলিল। কুরআনুল কারিম আমাদের দিকে কত প্রজ্ঞাপূর্ণ একটি প্রশ্ন তুলে ধরেছে দেখুন__
أَمْ خُلِقُوا مِنْ غَيْرِ شَيْءٍ أَمْ هُمُ الْخَالِقُونَ
"তারা কি স্রষ্টা ব্যতীতই সৃষ্টি হয়েছে, না তারা নিজেরাই স্রষ্টা? ( সূরা তুর, ৫২:৩৫)
একজন গণ্ডমূর্খ অশিক্ষিত সাধারণ মানুষও সৃষ্টি নিয়ে ফিকির করে আল্লাহ রব্বুল আলামিনের অস্তিত্ব অনুভব করতে পারে। আরবের এক বেদুইনকে জিজ্ঞেস করা হয়, আল্লাহ যে আছেন তা তুমি কীভাবে বুঝতে পারলে? সে উত্তর দেয়__
اَلْبَعرَةُ تَدُلُّ عَلی الْبَعِيْرِ ٭ وَلْأَثَرُ يَدُلُّ عَلَی الْمَسِيْرِ٭ فَسَمَاءٌ ذَاتُ أَبْرَاجٍ٭ وَأَرْضٌ ذَاتٌ فِجَاجٍ٭ وَبَحَرٌ ذَاتُ أَمْوَاجٍ أَلَا يَدُلُّ ذَلِكَ عَلَی الْلَّطِيْفِ اَلْخَبِْيرِ
"উটের মল দেখে বোঝা যায় এখানে উট ছিল, পথিকের পদচিহ্ন দেখে বোঝা যায় পথিকের অস্তিত্ব। অগণিত নক্ষত্র-খচিত এই আসমান, প্রশস্ত পথভরা এই জমিন আর উর্মিমালায় উত্তাল সাগর কি মহান রবের অস্তিত্বের ঘোষণা দেয় না? " (কিতাবুল মাওয়াকিফ: ১/১৫১)
কুরআন ও সুন্নাহয় তাওহিদুর রুবুবিয়্যাহর অসংখ্য দলিল এসেছে। কুরআন-সুন্নাহর যেখানেই(رَّبُّ) শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে অথবা যেখানেই সৃষ্টি, রিজিক, রাজত্ব ইত্যাদির মতো রুবুবিয়্যাহ ও প্রভুত্বের কোনো বিশেষ বৈশিষ্ট্য তুলে ধরা হয়েছে, সেটি তাওহিদুর রুবুবিয়্যাহর দলিলের অন্তর্ভুক্ত। নমুনা হিসাবে আমরা এখানে কয়েকটি দলিল উল্লেখ করব।
আল্লাহ রব্বুল আলামিনই বিশ্বজগতের পালনকর্তা। কুরআনুল কারিমে এসেছে :
الْحَمْدُ لِلَّـهِ رَبِّ الْعَالَمِينَ
"সকল প্রশংসা জগৎসমূহের প্রতিপালক আল্লাহ তাআলার জন্য।" (সূরা ফাতিহা: ১:১)
তিনিই আমাদের সৃষ্টিকর্তা এবং রিজিকদাতা কুরআনে এসেছে:
هَلْ مِنْ خَالِقٍ غَيْرُ اللَّـهِ يَرْزُقُكُم مِّنَ السَّمَاءِ وَالْأَرْضِ لَا إِلَهَ إِلَّا هُوَ فَأَنَّى تُؤْفَكُونَ
"আল্লাহ ব্যতীত কি কোনো স্রষ্টা আছে, যে তোমাদেরকে আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবী থেকে রিজিক দান করে? (সূরা ফাতির, ৩৫:০৩)
তাঁর হাতেই গোটা বিশ্বজগতের একচ্ছত্র রাজত্ব। কুরআনের ভাষায়:
فَسُبْحَانَ الَّذِي بِيَدِهِ مَلَكُوتُ كُلِّ شَيْءٍ وَإِلَيْهِ تُرْجَعُونَ
"অতএব পবিত্র ও মহান তিনি, যাঁর হাতেই প্রত্যেক বিষয়ের সর্বময় কর্তৃত্ব: আর তাঁর নিকটই তোমরা প্রত্যাবর্তিত হবে। " (সূরা ইয়াসিন, ৩৬:৮৩)
তিনিই আমাদের জীবন-মরণের মালিক। কুরআনে এসেছে __
الَّذِي خَلَقَ الْمَوْتَ وَالْحَيَاةَ لِيَبْلُوَكُمْ أَيُّكُمْ أَحْسَنُ عَمَلًا وَهُوَ الْعَزِيزُ الْغَفُورُ
"যিনি সৃষ্টি করেছেন মরণ ও জীবন, তোমাদেরকে পরীক্ষা করার জন্য -কে তোমাদের মধ্যে কর্মে উত্তম।" (সূরা মুলক, ৬৭: ০২)
প্রিয় ভাই! কেবল তাওহিদুর রুবুবিয়্যাহর বিশ্বাস মানুষকে শিরকের গণ্ডি থেকে বের করে ইসলামের গণ্ডিতে প্রবেশ করায় না এবং জাহান্নাম থেকে নাজাতও দেয় না। তাওহিদের বাকি দুই প্রকারের ওপরও বিশ্বাস স্থাপন করা জরুরি। আরবের মুশরিক, ইহুদি, খ্রিষ্টান ও অগ্নিপূজকরাসহ পৃথিবীর প্রায় সকল ধর্মের মানুষই তাওহিদুর রুবুবিয়্যাহয় বিশ্বাস করে। কেবল নাস্তিক ও বর্তমান জামানার কমিউনিস্টদের কথা বাদ দিলে পৃথিবীর প্রায় সব মানুষের জন্যই এটি সত্য। কারণ মানুষের ফিতরাহ ও আকল তাওহিদুর রুবুবিয়্যাহকে স্বতস্ফূর্তভাবে উপলব্ধি করে। মক্কার মুশরিকরা যে তাওহিদুর রুবুবিয়্যাহয় বিশ্বাস করত এ ব্যাপারে কুরআনুল কারিমে বহু আয়াত এসেছে।
وَلَئِن سَأَلْتَهُم مَّنْ خَلَقَ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضَ وَسَخَّرَ الشَّمْسَ وَالْقَمَرَ لَيَقُولُنَّ اللَّـهُ فَأَنَّى يُؤْفَكُونَ
"যদি আপনি তাদের জিজ্ঞাস করেন __কে আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবী সৃষ্টি করেছেন এবং চন্দ্র-সূর্যকে নিয়ন্ত্রন করছেন? তারা অবশ্যই বলবে, আল্লাহ। তবে তারা কোথায় ফিরে যাচ্ছে?' (সূরা আনকাবুত, ২৯:৬১)
وَلَئِن سَأَلْتَهُم مَّنْ خَلَقَ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضَ لَيَقُولُنَّ خَلَقَهُنَّ الْعَزِيزُ الْعَلِيمُ
"যদি আপনি তাদেরকে প্রশ্ন করেন__কে নভোমণ্ডল ও ভূমণ্ডল সৃষ্টি করেছেন? তারা অবশ্যই বলবে, এগুলো তো সৃষ্টি করেছেন পরাক্রমশালী সর্বজ্ঞ আল্লাহ তাআলা। '( সূরা জুখরুফ, ৪৩:৯)
এই আয়াতগুলো থেকে আমরা বুঝতে পারলাম মক্কার মুশরিকরা তাওহিদুর রুবুবিয়্যাহতে বিশ্বাস করত। কিন্তু এই বিশ্বাস তাদের মুমিন বানাতে পারেনি। কারণ তারা তাওহিদুল উলুহিয়্যাতে বিশ্বাস করত না। তাবলিগের ভাইয়েরা কেবল এই তাওহিদুর রুবুবিয়্যাহকেই কালিমায়ে তাওহিদের উদ্দেশ্য বলে বয়ান করে থাকেন। অথচ কালিমায়ে তাওহিদের মূল উদ্দেশ্য তাওহিদুল উলুহিয়্যাহ, রুবুবিয়্যাহ নয়। এটি অনেক বড় একটি ভ্রান্তি। দোয়া করি, আল্লাহ তাদের এই মারাত্মক ভুল শুধরে ওঠার তাওফিক দিন। সামনের কোনো পর্বে এই বিষয়ে আরও বিস্তারিত আলোচনা হবে ইনশাআল্লাহ।
তাওহিদুর রুবুবিয়্যাহর গুরুত্ব ও তাৎপর্য:
বান্দা যখন আল্লাহর অস্তিত্বে বিশ্বাস করে এবং আল্লাহ তাআলাকে বিশ্বজগতের একমাত্র স্রষ্টা, রিজিকদাতা, পালনকর্তা ও নিয়ন্ত্রনকারী হিসেবে মেনে নেয় __এক কথায় সে যখন তাওহিদুর রুবুবিয়্যাহতে বিশ্বাস স্থাপন করে, তখন এই বিশ্বাস তাকে তাওহিদুল উলুহিয়্যাহর দিকে ধাবিত করে। করণ যে ব্যক্তি তাওহিদুর রুবুবিয়্যাহ স্বীকার করে নেয়, সে তাওহিদুল উলুহিয়্যাহ স্বীকার করতেও বাধ্য হয়ে পড়ে। প্রথমে মানুষের অন্তরে তাওহিদুর রুবুবিয়্যাহর কথা আসে, তারপর তা উন্নত হয়ে তাওহিদুল উলুহিয়্যাহয় রূপ নেয়। আর এজন্যই আল্লাহ তাআলা এই তাওহিদুর রুবুবিয়্যাহকে তাওহিদুল উলুহিয়্যাহর জন্য দলিল হিসাবে পেশ করেছেন এবং তাওহিদুল উলুহিয়্যহকে অস্বীকার করার কারণে তাওহিদুর রুবুবিয়্যাহও যে অর্থহীন হয়ে পড়ে তা সুন্দরভাবে বুঝিয়ে বলেছেন।
বিষয়টি একটু খুলে বলি। মানুষ যখন বিশ্বাস করে নেয় যে, আল্লাহ তাআলাই বিশ্বজগতের একমাত্র সৃষ্টিকর্তা, পালনকর্তা ও রিজিকদাতা, তিনিই জীবন ও মরণের মালিক, ভালো ও মন্দ সব তারই হাতে, সৌভাগ্য ও দূর্ভাগ্য তাঁর পক্ষ থেকেই আসে; তখন সে পরিপূর্ণভাবে নিজেকে আল্লাহর কাছে সোর্পদ করে দেয়। সে মনে করে, তার সঙ্গে যা ঘটে তা আল্লাহর হুকুমে ঘটে। সে যদি জান্নাতে প্রবেশ করে তবে তা আল্লাহর তাওফিক ও রহমতেই সম্ভব হবে। আর সে যদি জাহান্নামে যায় তবে তা আল্লাহর প্রজ্ঞা ও ইনসাফের কারণেই যাবে। এই বিশ্বাসের কারণে সে কল্যাণ লাভ করতে আল্লাহর তাআলারই শরানাপন্ন হয় এবং অকল্যাণ থেকে বাঁচতে তার কাছেই আশ্রয় প্রার্থনা করে। আল্লাহর কাছেই সে হিদায়াত চায়। এটি বান্দার হৃদয়ে তার রবের প্রতি প্রবল ভালোবাসা সৃষ্টি করে। তখন সে কথা ও কাজে আল্লাহর প্রিয় হতে চায়। পাশাপাশি তার হৃদয়ে আল্লাহর প্রতি সম্মান ও ভয়ও জেগে ওঠে। আর এটাই তার অন্তরে তাওহিদুল উলুহিয়্যাহ সৃষ্টির আলামত। এভাবে তাওহিদুর রুবুবিয়্যাহর দরোজা দিয়ে সে তাওহিদুল উলুহিয়্যাহতে প্রবেশ করে। এখান থেকে আমরা তাওহিদুর রুবুবিয়্যাহর গুরুত্ব ও তাৎপর্য অনুধাবন করতে পারি।
তাওহিদুর রুবুবিয়্যাহর আলোচনা এখানেই শেষ করছি। আগামী মজলিসে আমরা তাওহিদুল উলুহিয়্যাহ নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করব ইনশাআল্লাহ।
-------------------------
-শাইখ তামিম আল-আদনানী হাফিজাহুল্লাহ
সিরিজের গত পর্বে আমরা তাওহিদের প্রকার তিনটির সংক্ষিপ্ত পরিচয় তুলে ধরেছিলাম। এবার আমরা প্রতিটি প্রকার সম্পর্কে বিস্তারিত জানাব। এই মজলিসে আমরা আলোচনা করব তাওহিদের প্রথম প্রকার তাওহিদুর রুবুবিয়্যাহ নিয়ে।
তাওহিদুর রুবুবিয়্যাহর পরিচয়:
তাওহিদুর রুবুবিয়্যাহর সংজ্ঞা দিতে গিয়ে শাইখ হাফিজ বিন আহমাদ আল-হাকিমি রহিমাহুল্লাহ বলেন:
هُوَ الْإِقْرَارُ الْجَازِمُ بِأَنََّ اللهَ تَعَالَی رَبُّ كُلِّ شَيْءٍ وَمَلِيْكُهُ٭ وَخَالِقُهُ٭ وَمُدَبِّرُهُ٭ وَالْمُتَصَرِّفُ فِيْهِ٭ لَمْ يَكُنْ لَهُ شَرِيْكٌ فِيْ الْمُلْكِ٭ وَلَمْ يَكُنْ لَهُ وَلِيٌّ مِنَ الذُّلِّ٭ وَلَارَادَّ لِأَمْرِهِ٭ وَلَا مُعَقِّبَ لِحُكْمِهِ٭ وَلَا مُضَادَّ لَهُ٭ وَلَا مُمُاثِلَ لَهُ ٭ وَلَا سَمِيَّ لَهُ ٭ وَلَا مُنَازِعَ فِيْ شَيْءٍ مِّنْ مَعَانِيْ رُبُوْ بِيَّتِهِ وَمُقْتَضَيَاتِ أَسْمَائَهِ وَصِفَاتِهِ
"তাওহিদুর রুবুবিয়্যাহ হলো, এই কথার নিরষ্কুশ স্বীকৃতি দেয়া যে, আল্লাহ তাআলা সব কিছুর সৃষ্টিকর্তা, তিনিই সবকিছুর মালিক, গোটা বিশ্বজগতের তিনিই একমাত্র পরিচালক ও নিয়ন্ত্রক, তিনিই সব কিছুর প্রতিপালক: তার রাজত্বে কেউ শরিক নেই, তার কোনো সহযোগী নেই, তাঁর আদেশকে রহিত করার শক্তি কারও নেই, তাঁর নির্দেশকে অগ্রাহ্য করার কেউ নেই, তাঁর কোনো প্রতিপক্ষ নেই- সমকক্ষও নেই। রুবুবিয়্যাহ ও প্রভুত্বের কোনো ক্ষেত্রেই তার বিরোধিতা করার কেউ নেই এবং তাঁর নাম ও গুণাবলিতেও তার প্রতিদ্বন্দ্বী নেই।" (আ"লামুস সুন্নাতিল মানশুরাহ: ৪৫)
আবার অনেকে তাওহিদুর রুবুবিয়্যাহকে সংজ্ঞায়িত করেছেন এভাবে _
اَلْاِعْتِقادُ بِأَنَّ اللهَ هُوَ الْخَالِقُ الرَّازَّاقُ الْمُدَبِّرُ لِكُلِّ شَیْءٍ وَحْدَهُ لَا شَرِيْكَ لَهُ
" আল্লাহ তা'আলা এক ও অদ্বিতীয়, তাঁর কোনো শরিক নেই এবং তিনিই বিশ্বজগতের একমাত্র স্রষ্টা, রিজিকদাতা ও নিয়ন্ত্রক_ এই বিশ্বাসকেই তাওহিদুর রুবুবিয়্যাহ বলে।"
তাহলে তাওহিদুর রুবুবিয়্যাহতে আমরা মৌলিকভাবে দুটি পয়েন্ট পাচ্ছি:
১. আল্লাহর অস্তিত্বে ইমান আনা।
২. আল্লাহ তাআলাকে একমাত্র সৃষ্টিকর্তা, পালনকর্তা, রিজিকদাতা ও নিয়ন্ত্রক বলে বিশ্বাস করা।
সুতরাং কেউ যদি আল্লাহর অস্তিত্ব অস্বীকার করে, সে মুমিন হতে পারবে না। বিকৃত মস্তিষ্কের অধিকারী নাস্তিকরা ছাড়া কেউ আল্লাহ তায়া'লার অস্তিত্বের মতো সহজাত ও স্বতঃসিদ্ধ বিষয়কে অস্বীকার করে না। এ নিয়ে আমরা সামনে আলোচনা করব। অনুরুপভাবে কেউ যদি বিশ্বজগতের সৃষ্টি, প্রতিপালন, নিয়ন্ত্রণ ইত্যাদির ক্ষেত্রে আল্লাহর সঙ্গে কাউকে শরিক করে, তবে সেও তাওহিদের গণ্ডি থেকে বের হয়ে শিরকের গণ্ডিতে প্রবেশ করে। অলি-বুজুর্গরা পৃথিবী পরিচালনা করেন, তারা মানুষের লাভ-ক্ষতির মালিক, তারা সন্তান দিতে পারেন_ধরনের অপবিশ্বাস যদি কেউ লালন করে তবে সে মুশরিক। মোট কথা, আল্লাহর রুবুবিয়্যাহর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট যত গুণ ও বৈশিষ্ট্য আছে এগুলোর একটিও যদি গাইরুল্লাহর জন্য সাব্যস্ত করা হয় তবে তা শিরক বলে গণ্য হবে।
তাওহিদুর রুবুবিয়্যাহর দলিল:
আল্লাহর অস্তিত্বে বিশ্বাস মানুষের সহজাত প্রবৃত্তি। এর জন্য বাহ্যিক কোনো দলিলের মোটেও দরকার নেই। আল্লাহ রব্বুল আলামিন আমাদের এই বিশ্বাস দিয়েই সৃষ্টি করেছেন। আল্লাহর অস্তিত্ব একটি প্রাকৃতিক ও সহজাত অনুভূতি। আমরা জানি আল্লাহ আছেন। সেই সঙ্গে আল্লাহর সামনে নত হওয়ার এবং তাঁর কাছে নিজেদের সমর্পণ করার ব্যাকুলতাও আমাদের অবচেতন মনে কাজ করে। শরিয়াহর পরিভাষায় এটিকে বলা হয় 'ফিতরাহা' আল্লাহ তায়া'লা বলেন:
ا فِطْرَتَ اللَّـهِ الَّتِي فَطَرَ النَّاسَ عَلَيْهَا لَا تَبْدِيلَ لِخَلْقِ اللَّـهِ ذَلِكَ الدِّينُ الْقَيِّمُ وَلَكِنَّ أَكْثَرَ النَّاسِ لَا يَعْلَمُون
"আল্লাহর ফিতরাহ ও প্রকৃতির অনুসরণ করো, যে ফিতরাহ ও প্রকৃতি অনুযায়ী তিনি মানুষ সৃষ্টি করেছেন; আল্লাহর সৃষ্টির কোনো পরিবর্তন নেই। এটিই সরল দ্বীন; কিন্তুু অধিকাংশ মানুষ জানে না '। (সূরা রুম, ৩০:৩০)
প্রতিটি শিশুকেই আল্লাহ তায়া'লা এই ফিতরাহ দিয়েই সৃষ্টি করেছেন। মুসনাদে আহমাদে বর্ণিত একটি সহিহ হাদিসে এসেছে রাসূল ﷺইরশাদ করেন :
مَامِنْ مَولودٍ يُولَدُ إِلَّا عَلی هَذِهِ الْفِطرَةِ
"এমন কোনো শিশু নেই যাকে আল্লাহ তাআলা এই ফিতরাহর ওপর সৃষ্টি করেননি।" ( মুসনাদু আহমাদ: ৮১৭৯)
আধুনিক বিজ্ঞানও এই বিষয়টি প্রমাণ করতে সক্ষম হয়েছে। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ডেভলোপমেন্টাল সাইন্টিস্ট ডক্টর জাস্টিন এল ব্যারেট তার বিখ্যাত 'বর্ন বিলিভার্স' গ্রন্থে সুস্পষ্ট ভাষায় উল্লেখ করেছেন :
শিশুরা জন্মগতভাবেই স্রষ্টার অস্তিত্বে বিশ্বাসী, যাকে আমি বলি সহজাত ধর্ম...। (Born Believers: ১৩৬)১
প্রিয় ভাই! সৃষ্টির পরতে পরতে আমরা খুঁজে পাই একজন মহা পরাক্রমশালী স্রষ্টার অস্তিত্ব। প্রতিটি মাখলুকই একজন খালিকের অস্তিত্বের কথা ঘোষণা করে। তাই প্রতিটি সৃষ্টিই স্রষ্টার অস্তিত্বের একেকটি দলিল। কুরআনুল কারিম আমাদের দিকে কত প্রজ্ঞাপূর্ণ একটি প্রশ্ন তুলে ধরেছে দেখুন__
أَمْ خُلِقُوا مِنْ غَيْرِ شَيْءٍ أَمْ هُمُ الْخَالِقُونَ
"তারা কি স্রষ্টা ব্যতীতই সৃষ্টি হয়েছে, না তারা নিজেরাই স্রষ্টা? ( সূরা তুর, ৫২:৩৫)
একজন গণ্ডমূর্খ অশিক্ষিত সাধারণ মানুষও সৃষ্টি নিয়ে ফিকির করে আল্লাহ রব্বুল আলামিনের অস্তিত্ব অনুভব করতে পারে। আরবের এক বেদুইনকে জিজ্ঞেস করা হয়, আল্লাহ যে আছেন তা তুমি কীভাবে বুঝতে পারলে? সে উত্তর দেয়__
اَلْبَعرَةُ تَدُلُّ عَلی الْبَعِيْرِ ٭ وَلْأَثَرُ يَدُلُّ عَلَی الْمَسِيْرِ٭ فَسَمَاءٌ ذَاتُ أَبْرَاجٍ٭ وَأَرْضٌ ذَاتٌ فِجَاجٍ٭ وَبَحَرٌ ذَاتُ أَمْوَاجٍ أَلَا يَدُلُّ ذَلِكَ عَلَی الْلَّطِيْفِ اَلْخَبِْيرِ
"উটের মল দেখে বোঝা যায় এখানে উট ছিল, পথিকের পদচিহ্ন দেখে বোঝা যায় পথিকের অস্তিত্ব। অগণিত নক্ষত্র-খচিত এই আসমান, প্রশস্ত পথভরা এই জমিন আর উর্মিমালায় উত্তাল সাগর কি মহান রবের অস্তিত্বের ঘোষণা দেয় না? " (কিতাবুল মাওয়াকিফ: ১/১৫১)
কুরআন ও সুন্নাহয় তাওহিদুর রুবুবিয়্যাহর অসংখ্য দলিল এসেছে। কুরআন-সুন্নাহর যেখানেই(رَّبُّ) শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে অথবা যেখানেই সৃষ্টি, রিজিক, রাজত্ব ইত্যাদির মতো রুবুবিয়্যাহ ও প্রভুত্বের কোনো বিশেষ বৈশিষ্ট্য তুলে ধরা হয়েছে, সেটি তাওহিদুর রুবুবিয়্যাহর দলিলের অন্তর্ভুক্ত। নমুনা হিসাবে আমরা এখানে কয়েকটি দলিল উল্লেখ করব।
আল্লাহ রব্বুল আলামিনই বিশ্বজগতের পালনকর্তা। কুরআনুল কারিমে এসেছে :
الْحَمْدُ لِلَّـهِ رَبِّ الْعَالَمِينَ
"সকল প্রশংসা জগৎসমূহের প্রতিপালক আল্লাহ তাআলার জন্য।" (সূরা ফাতিহা: ১:১)
তিনিই আমাদের সৃষ্টিকর্তা এবং রিজিকদাতা কুরআনে এসেছে:
هَلْ مِنْ خَالِقٍ غَيْرُ اللَّـهِ يَرْزُقُكُم مِّنَ السَّمَاءِ وَالْأَرْضِ لَا إِلَهَ إِلَّا هُوَ فَأَنَّى تُؤْفَكُونَ
"আল্লাহ ব্যতীত কি কোনো স্রষ্টা আছে, যে তোমাদেরকে আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবী থেকে রিজিক দান করে? (সূরা ফাতির, ৩৫:০৩)
তাঁর হাতেই গোটা বিশ্বজগতের একচ্ছত্র রাজত্ব। কুরআনের ভাষায়:
فَسُبْحَانَ الَّذِي بِيَدِهِ مَلَكُوتُ كُلِّ شَيْءٍ وَإِلَيْهِ تُرْجَعُونَ
"অতএব পবিত্র ও মহান তিনি, যাঁর হাতেই প্রত্যেক বিষয়ের সর্বময় কর্তৃত্ব: আর তাঁর নিকটই তোমরা প্রত্যাবর্তিত হবে। " (সূরা ইয়াসিন, ৩৬:৮৩)
তিনিই আমাদের জীবন-মরণের মালিক। কুরআনে এসেছে __
الَّذِي خَلَقَ الْمَوْتَ وَالْحَيَاةَ لِيَبْلُوَكُمْ أَيُّكُمْ أَحْسَنُ عَمَلًا وَهُوَ الْعَزِيزُ الْغَفُورُ
"যিনি সৃষ্টি করেছেন মরণ ও জীবন, তোমাদেরকে পরীক্ষা করার জন্য -কে তোমাদের মধ্যে কর্মে উত্তম।" (সূরা মুলক, ৬৭: ০২)
প্রিয় ভাই! কেবল তাওহিদুর রুবুবিয়্যাহর বিশ্বাস মানুষকে শিরকের গণ্ডি থেকে বের করে ইসলামের গণ্ডিতে প্রবেশ করায় না এবং জাহান্নাম থেকে নাজাতও দেয় না। তাওহিদের বাকি দুই প্রকারের ওপরও বিশ্বাস স্থাপন করা জরুরি। আরবের মুশরিক, ইহুদি, খ্রিষ্টান ও অগ্নিপূজকরাসহ পৃথিবীর প্রায় সকল ধর্মের মানুষই তাওহিদুর রুবুবিয়্যাহয় বিশ্বাস করে। কেবল নাস্তিক ও বর্তমান জামানার কমিউনিস্টদের কথা বাদ দিলে পৃথিবীর প্রায় সব মানুষের জন্যই এটি সত্য। কারণ মানুষের ফিতরাহ ও আকল তাওহিদুর রুবুবিয়্যাহকে স্বতস্ফূর্তভাবে উপলব্ধি করে। মক্কার মুশরিকরা যে তাওহিদুর রুবুবিয়্যাহয় বিশ্বাস করত এ ব্যাপারে কুরআনুল কারিমে বহু আয়াত এসেছে।
وَلَئِن سَأَلْتَهُم مَّنْ خَلَقَ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضَ وَسَخَّرَ الشَّمْسَ وَالْقَمَرَ لَيَقُولُنَّ اللَّـهُ فَأَنَّى يُؤْفَكُونَ
"যদি আপনি তাদের জিজ্ঞাস করেন __কে আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবী সৃষ্টি করেছেন এবং চন্দ্র-সূর্যকে নিয়ন্ত্রন করছেন? তারা অবশ্যই বলবে, আল্লাহ। তবে তারা কোথায় ফিরে যাচ্ছে?' (সূরা আনকাবুত, ২৯:৬১)
وَلَئِن سَأَلْتَهُم مَّنْ خَلَقَ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضَ لَيَقُولُنَّ خَلَقَهُنَّ الْعَزِيزُ الْعَلِيمُ
"যদি আপনি তাদেরকে প্রশ্ন করেন__কে নভোমণ্ডল ও ভূমণ্ডল সৃষ্টি করেছেন? তারা অবশ্যই বলবে, এগুলো তো সৃষ্টি করেছেন পরাক্রমশালী সর্বজ্ঞ আল্লাহ তাআলা। '( সূরা জুখরুফ, ৪৩:৯)
এই আয়াতগুলো থেকে আমরা বুঝতে পারলাম মক্কার মুশরিকরা তাওহিদুর রুবুবিয়্যাহতে বিশ্বাস করত। কিন্তু এই বিশ্বাস তাদের মুমিন বানাতে পারেনি। কারণ তারা তাওহিদুল উলুহিয়্যাতে বিশ্বাস করত না। তাবলিগের ভাইয়েরা কেবল এই তাওহিদুর রুবুবিয়্যাহকেই কালিমায়ে তাওহিদের উদ্দেশ্য বলে বয়ান করে থাকেন। অথচ কালিমায়ে তাওহিদের মূল উদ্দেশ্য তাওহিদুল উলুহিয়্যাহ, রুবুবিয়্যাহ নয়। এটি অনেক বড় একটি ভ্রান্তি। দোয়া করি, আল্লাহ তাদের এই মারাত্মক ভুল শুধরে ওঠার তাওফিক দিন। সামনের কোনো পর্বে এই বিষয়ে আরও বিস্তারিত আলোচনা হবে ইনশাআল্লাহ।
তাওহিদুর রুবুবিয়্যাহর গুরুত্ব ও তাৎপর্য:
বান্দা যখন আল্লাহর অস্তিত্বে বিশ্বাস করে এবং আল্লাহ তাআলাকে বিশ্বজগতের একমাত্র স্রষ্টা, রিজিকদাতা, পালনকর্তা ও নিয়ন্ত্রনকারী হিসেবে মেনে নেয় __এক কথায় সে যখন তাওহিদুর রুবুবিয়্যাহতে বিশ্বাস স্থাপন করে, তখন এই বিশ্বাস তাকে তাওহিদুল উলুহিয়্যাহর দিকে ধাবিত করে। করণ যে ব্যক্তি তাওহিদুর রুবুবিয়্যাহ স্বীকার করে নেয়, সে তাওহিদুল উলুহিয়্যাহ স্বীকার করতেও বাধ্য হয়ে পড়ে। প্রথমে মানুষের অন্তরে তাওহিদুর রুবুবিয়্যাহর কথা আসে, তারপর তা উন্নত হয়ে তাওহিদুল উলুহিয়্যাহয় রূপ নেয়। আর এজন্যই আল্লাহ তাআলা এই তাওহিদুর রুবুবিয়্যাহকে তাওহিদুল উলুহিয়্যাহর জন্য দলিল হিসাবে পেশ করেছেন এবং তাওহিদুল উলুহিয়্যহকে অস্বীকার করার কারণে তাওহিদুর রুবুবিয়্যাহও যে অর্থহীন হয়ে পড়ে তা সুন্দরভাবে বুঝিয়ে বলেছেন।
বিষয়টি একটু খুলে বলি। মানুষ যখন বিশ্বাস করে নেয় যে, আল্লাহ তাআলাই বিশ্বজগতের একমাত্র সৃষ্টিকর্তা, পালনকর্তা ও রিজিকদাতা, তিনিই জীবন ও মরণের মালিক, ভালো ও মন্দ সব তারই হাতে, সৌভাগ্য ও দূর্ভাগ্য তাঁর পক্ষ থেকেই আসে; তখন সে পরিপূর্ণভাবে নিজেকে আল্লাহর কাছে সোর্পদ করে দেয়। সে মনে করে, তার সঙ্গে যা ঘটে তা আল্লাহর হুকুমে ঘটে। সে যদি জান্নাতে প্রবেশ করে তবে তা আল্লাহর তাওফিক ও রহমতেই সম্ভব হবে। আর সে যদি জাহান্নামে যায় তবে তা আল্লাহর প্রজ্ঞা ও ইনসাফের কারণেই যাবে। এই বিশ্বাসের কারণে সে কল্যাণ লাভ করতে আল্লাহর তাআলারই শরানাপন্ন হয় এবং অকল্যাণ থেকে বাঁচতে তার কাছেই আশ্রয় প্রার্থনা করে। আল্লাহর কাছেই সে হিদায়াত চায়। এটি বান্দার হৃদয়ে তার রবের প্রতি প্রবল ভালোবাসা সৃষ্টি করে। তখন সে কথা ও কাজে আল্লাহর প্রিয় হতে চায়। পাশাপাশি তার হৃদয়ে আল্লাহর প্রতি সম্মান ও ভয়ও জেগে ওঠে। আর এটাই তার অন্তরে তাওহিদুল উলুহিয়্যাহ সৃষ্টির আলামত। এভাবে তাওহিদুর রুবুবিয়্যাহর দরোজা দিয়ে সে তাওহিদুল উলুহিয়্যাহতে প্রবেশ করে। এখান থেকে আমরা তাওহিদুর রুবুবিয়্যাহর গুরুত্ব ও তাৎপর্য অনুধাবন করতে পারি।
তাওহিদুর রুবুবিয়্যাহর আলোচনা এখানেই শেষ করছি। আগামী মজলিসে আমরা তাওহিদুল উলুহিয়্যাহ নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করব ইনশাআল্লাহ।
-------------------------
আকিদাসিরিজ: ৩য় পর্ব PDF লিংক।
https://mega.nz/file/eL5nGQaC#NFN4e2...qK3Ucy45_c3njY [/CENTER]
Comment