নিকট অতীতে আমাদের উপমহাদেশের সমাজ ও সংস্কৃতি এবং আমাদের আজকের সামাজিক প্রেক্ষাপটের দিকে তাকালে যে বিষয়টি সুস্পষ্ট হয় তা হলো, সামাজিক পরিবর্তনের ক্ষেত্রে নেতিবাচক পরিবর্তনের হার ই অপেক্ষাকৃত বেশি। এ অবস্থা কেবল বাঙালি মুসলিম সমাজের বা উপমহাদেশীয় মুসলিম সমাজেরই তা কিন্তু নয়। বরং সমগ্র মুসলিম বিশ্বের অবস্থাই এক ও অভিন্ন। সারা পৃথিবীতে গুটিকয়েক মুসলিমই রয়েছে, যাদের পরিবার এই নেতিবাচক পরিবর্তনের করাল গ্রাসে অসুস্থ চিন্তা-চেতনা গ্রহণ করে তথাকথিত আধুনিক যুগের অন্ধকার জগতে হারিয়ে যায়নি। মূলত বেশিরভাগ মুসলিম-অমুসলিম নির্বিশেষে সবাই এ অন্ধকার জগতে নিজের অজান্তেই প্রবেশ করছে ও এর অতল গহ্বরে নিজেদেরকে হারিয়ে ফেলছে।
প্রাক ঔপনিবেশিক আমলের কথা বাদ দিই। ঔপনিবেশিক শাসনের সময়, এমনকি দেশ ভাগের অনেক পরেও সমাজে গরীবের সংখ্যা বর্তমানের তুলনায় বেশি থাকলেও বর্তমানের মতো ‘সরকারি চাকুরিজীবি/বিসিএস ক্যাডার স্বামী চাই ই চাই’ ও ‘জিপিএ ফাইভ’ ট্রেন্ড ছিলো না। সমাজে টাকা ও কাগুজে শিক্ষা সনদের অসুস্থ প্রতিযোগীতা ছিল না। প্রত্যেক বছর মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার ফলাফলের দিন শিক্ষার্থীদের আত্মহত্যার কোনো অস্তিত্বও ছিল না। সমাজে অনেক কুসংস্কার বিদ্যমান থাকলেও বর্তমানের তুলনায় বস্তুবাদী জীবনের তাড়না তাদের মধ্যে একপ্রকার ছিল না বলা চলে।
সেকালে উপমহাদেশীয় সমাজে নারী-পুরুষের অবাধ মেলামেশা অনৈতিক ও অন্যায় বলে গণ্য হতো। নারী-পুরুষের মেলামেশার কথা যদি বলি, আমাদের বাবা-মায়েরা যখন তরুণ ছিলেন, তখনও এ অবস্থার খুবেকটা পরিবর্তন হয়নি। অথচ এখন আমাদের সমাজের এক বিরাট অংশ এব্যাপারে নিজেদের দৃষ্টিভঙ্গি নিজের অজান্তে ই পালটে ফেলেছে।
গত পনের-বিশ বছর আগেও সমকামিতাকে ঘৃণার চোখে দেখা হতো। কিন্তু এখন সমাজের একটি অংশ এ কাজকে স্বাভাবিক মনে করতে শুরু করেছে। আর কয়েক দশক পর হয়তো বেশিরভাগ মানুষ ই সমকামিতাকে স্বাভাবিক মনে করবে। এ ধারণাকে ভুল ধারণা মনে করার কোনো কারণ নেই। পশ্চিমা সমাজে একসময় সমকামিতাকে স্বাভাবিক বিষয় হিসেবে দেখা হতো না। পরবর্তিতে ধীরে ধীরে সমকামিতাকে পশ্চিমা সমাজে তাদের নৈতিক ও আইনগত উভয় দিক থেকে স্বাভাবিক করা হয়েছে।
১৯০ বছরের ঔপনিবেশিক শাসনের অধীনে থাকার অর্থ হলো প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে একটি গোষ্ঠির দাসত্বে থাকা। সাদাদের দাসত্ব উপমহাদেশীয়দের উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত স্বভাব। এর ই ফলশ্রুতি হিসেবে পশ্চিমা সাদাদের জীবনযাপনের চাকচিক্য দেখে আমরা তাদেরকে সুখী হিসেবে ধরে নিয়েছি। আমাদের রব আমাদেরকে বলেছেন, “নগরীতে কাফিরদের চালচলন চাকচিক্য যেন তোমাদের প্রতারিত না করে,এতো সামান্য ফায়দা,এরপর তাদের ঠিকানা হবে দোযখ।আর সেটি অতি নিকৃষ্ট অবস্থান।”[1] তবুও সুখী হওয়ার লক্ষ্যে তাদের অনুসরণের সিদ্ধান্ত নিয়েছি। অতি আধুনিক হতে গিয়ে শালীনতাবোধ ধীরে ধীরে ত্যাগ করেছি। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা ও গণমাধ্যমের কল্যাণে পশ্চিমা সমাজ থেকে নারী মুক্তির নামে নারীর বেহায়াপনা, নির্লজ্জ্বপনাকে গ্রহণ করেছি। পশ্চিমা সমাজ শিখিয়েছে লম্বা পোশাকে মুক্তি মিলবে না। আমরা দাস-দাসী হিসেবে তা নিজের অজান্তে ‘জ্বি হুজুর’ বলে মেনে নিয়েছি। আমাদের রবের দাসত্বে আমাদের প্রচুর সমস্যা। কিন্তু সাদাদের দাসত্বে কোনো সমস্যা নেই। স্রস্টার দাসত্ব আমাদের প্রবৃত্তিকে আঘাত করে। কিন্তু আমাদের মতোই কিছু মানুষ, যাদের গায়ের চামড়া সাদা, তাদের দাসত্ব করলে আমাদের প্রবৃত্তি আঘাতপ্রাপ্ত হয় না। তারা যা বলে এবং যা দেখায়, তাই আমরা আধুনিকতা ভেবে ,সফলতার মাধ্যম ভেবে গ্রহণ করে নেই। যদিও তাতে আমাদের রবের আনুগত্য থেকে সরে আসা হয় তবুও! একে দাসত্ব না বলে আর কিই বা বলা যেতে পারে?
আধুনিক ও সুখী হওয়ার লক্ষ্যে সমাজব্যবস্থা তথা পরিবার ব্যবস্থা ভেঙ্গে দেয়ার যত পদ্ধতি আছে তা আমরা ধীরে ধীরে আমাদের সমাজে গ্রহণ করে নিয়েছি। স্বামী-স্ত্রীর সুন্দর সম্পর্ককে ওদের চোখে দেখা শুরু করেছি। পুঁজিবাদী অর্থনীতিতে দুজন শিল্পপতির মধ্যে সম্পদ অর্জনের যে প্রতিযোগীতার সম্পর্ক থাকে, আমরা আমাদের সম্পর্কগুলোকে ঠিক তেমনভাবে দেখা শুরু করেছি। সমকামিতাকে আমাদের সমাজের একটি অংশ গ্রহণ করে নিয়েছে ও অন্যদের মাঝেও এটিকে স্বাভাবিক করার প্রক্রিয়া তারা জারি রেখেছে। পশ্চিমা সমাজ শিশুকামিতাকে স্বাভাবিক বলা শুরু করেছে।[2] সামনে একই স্লোগান আমাদের দেশেও চালু হবে। পশ্চিমা সমাজ বিশ্বের সামনে অর্থকে সুখের মানদণ্ড হিসেবে দেখিয়েছে আর আমরা তা বাস্তব সত্য বলে মেনে নিয়েছি। যেভাবে প্রাচীন যুগে উপমহাদেশে বৌদ্ধ ও রামকে অবিনশ্বর সত্য বলে বিশ্বাস করা হতো, ঠিক সেভাবেই নিজেদের অজান্তে আমরা পশ্চিমা বিশ্বাস ও আদর্শকে গ্রহণ করেছি ও করছি। ইসলাম আমাদেরকে যে মানদণ্ড নির্ধারণ করে দিয়েছে সেটি বাদ দিয়ে আমরা পশ্চিমাদের দেখানো বস্তুবাদী ও পুঁজিবাদী ব্যবস্থাকে গ্রহণ করে নিয়েছি। ফলতঃ আমাদের বাবা-মায়েরা আমাদেরকে ইসলামী মানদণ্ড মেনে মানুষ করানো অপেক্ষা অর্থ উপার্জনের মেশিন বানানোর লক্ষ্যে কাজ করতে অধিক আগ্রহী। যার ফলাফল হিসেবে অসুস্থ বিসিএস ও জিপিএ ফাইভ প্রতিযোগীতা এবং সন্তানের উপর পড়াশুনার চাপ বৃদ্ধিসহ নানাবিধ সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে।
আমাদের সমাজে ধর্মত্যাগীর সংখ্যা ছিল একেবারেই নগণ্য। অথচ আজ চারিদিক থেকে ধর্মত্যাগীদের সংখ্যা ধীরে ধীরে বেড়ে চলেছে। আবার অনেকে বাহ্যিকভাবে মুসলিম থাকা সত্ত্বেও নিজেদের অজান্তে ইসলামের গণ্ডী থেকে বেরিয়ে গিয়েছে এবং যাচ্ছে।
দ্বিতীয় শ্রেণির তরুণদের সংখ্যা এত বেশি যা কল্পনায় আনাও অসম্ভব। কেবল ধর্মকর্ম না মানা মানুষই নয়, বরং সালাত আদায় করে, সাওম পালন করে তথা ইসলামের কিছু আনুষ্ঠানিক নিয়ম-কানুন মেনেও অনেকে ইসলামের গণ্ডী থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে। অনেকে আবার মুসলিম হয়েও পর্ণ দেখছে, হারাম সম্পর্কে লিপ্ত হচ্ছে বা নারীদের উত্তক্ত করছে। এরূপ পরিস্থিতিতে থেকে সুষ্ঠুভাবে দ্বীন মেনে চলা অত্যন্ত কষ্টকর বিধায় এসমস্ত ব্যক্তিবর্গের আচরণ ও কর্মকাণ্ড দ্বীন মেনে চলা মুসলিমদের জীবনযাত্রাকে নানাভাবে প্রভাবিত করছে। মানুষ সামাজিক জীব। ফলতঃ একজনের কাজ অন্যকে প্রভাবিত করা স্বাভাবিক। সমাজের একটি শ্রেণীর সমস্যার সাথে অন্য শ্রেণির সমস্যা ওতপ্রোতভাবে জড়িত।
যদি আমাদেরকে প্রশ্ন করা হয় , ‘এ মুহুর্তে যুবক সমাজের অধিকাংশের প্রধান সমস্যা কী?’
অনেকেই উত্তরে বলবেন সঠিক সময়ে বিয়ে করতে না পারা, কেউ কেউ বলবেন দ্বীন পালনে সমস্যা, কেউ বলবেন হারাম সম্পর্ক থেকে বেরিয়ে আসতে না পারা, কেউ কেউ বলবেন পর্ণ আসক্তি, কেউ কেউ হয়তো বলবেন মাদকাসক্তি, কেউ বলবেন ডিপ্রেশন, আবার কেউ কেউ হয়তো বলবেন বাবা-মায়েদের ও সমাজের বস্তুবাদী ও পুঁজিবাদী মানসিকতা, অল্প সংখ্যক ভাই-বোনেরা হয়তো বলবেন ধর্মত্যাগ করা। এ সমস্যার তালিকাটা বেশ দীর্ঘ।
এ সমস্যাগুলো অবশ্যই মুসলিম সমাজে বিদ্যমান। কিছু সমস্যার মধ্যে আন্তঃসম্পর্ক ওঃ রয়েছে। কিন্তু এগুলো মৌলিক সমস্যা নয়। আপনি যতদিন গাছের গোঁড়ায় আঘাত করার বদলে গাছের ডালপালা কাটার চেষ্টা চালিয়ে যাবেন, ততদিন আপনার পরিশ্রম পণ্ডশ্রম ব্যতীত কিছু ই হবে না। গাছের সব ডালপালা ও যদি আপনি কেটে ফেলেন, নতুন ডালপালা ঠিক ই গজাবে। তাই গাছ কেটে ফেলাটা খুব জরুরী। আর এজন্য সে গাছটিকে চেনা জরুরী। আপনি যদি না ই জানেন কোন গাছ, কেমন গাছ , তবে আপনি কীভাবে কাটবেন তাও ঠিক করতে পারবেন না। উপরোক্ত সমস্যাগুলোসহ এরূপ নানাবিধ অপরাধ সংঘটনের পিছনে মৌলিক যে বিষয়টি কাজ করে তা হলো, আল্লাহ্* সুবহানাহু ওয়া তা’আলার দাসত্বের বদলে নিজের নফসের(প্রবৃত্তির) দাসত্ব করা। নিজের যা ভালো লাগে তা করা ও নিজের যা ইচ্ছা করে না তা না করা। নিজের আক্বলকে ওয়াহীর(আল্লাহর বাণী/বিধান) উপর প্রাধান্য দেওয়া, যদিও তা আল্লাহর বিধান অস্বীকার করা বা পালন না করা হয়ে থাকে। নিজের নফস যাতে আনন্দ পায় সেটিকে সঠিক ও নফস যাতে আনন্দ পায় না কিংবা কষ্ট পায় তা নৈতিকতার মানদণ্ডে ভুল মনে করা।[3] অর্থাৎ এটি সম্পূর্ণ ভিন্ন একটি সিস্টেম। ভিন্ন জীবনব্যবস্থা তথা ভিন্ন ধর্ম। যে ধর্মে নিজের নফসকে আল্লাহ্*র ইচ্ছের উপর প্রাধান্য দেওয়া হয়। যে ধর্মে নিজের ইচ্ছে তথা নফসের ইচ্ছেকে প্রাধান্য দেওয়া হয় এবং অনিচ্ছেকে বাদ দেওয়া হয়। এককথায় বলতে গেলে নফসপূজো কিংবা প্রবৃত্তির দাসত্ব।
পশ্চিমা পরিভাষায় এটিকে বলা হয় Liberalism.
এ প্রবন্ধে লিবারেলিজমের স্বরূপ ও অসারতা আলোচনাপূর্বক এটি কীভাবে আধুনিক সমস্ত সমস্যার মূলে রয়েছে তা ব্যাখ্যা করা হবে। লিবারেলিজমের সাথে ইসলামি আইনের তূলনামূলক পর্যালচনাপূর্বক “ইসলাম লিবারেলিজম অপেক্ষা উত্তম ব্যবস্থা”-তা প্রমাণ করা হবে। পাশাপাশি লিবারেলিজমে প্রভাবিত মুসলিমদের কিছু যুক্তি ইসলামি দৃষ্টিকোণ হতে খণ্ডন করা হবে। পরিশেষে লিবারেলিজমের আঘাত থেকে আমাদের সমাজকে রক্ষা করতে কী কী পদক্ষেপ নেওয়া যায় তা নিয়ে সংক্ষিপ্ত আলাপ করা হবে, ইনশাআল্লাহ্*।
লিবারেলিজম
একজন মানুষ যেমন একই সময়ে হিন্দু ধর্ম ও ইসলাম ধর্মকে আকড়ে ধরতে পারে না, তেমনি একজন মানুষ একই সময়ে ইসলাম ধর্মের অনুসারী হয়ে লিবারেলিজমকে গ্রহণ করতে পারে না। একই সময়ে দুটো জীবনব্যবস্থা তথা দুটো দ্বীনের প্রতি বিশ্বাস রাখা ও সৎ হওয়া কখনোই এক আত্মার পক্ষে সম্ভব নয়, কিছুতেই নয়।
আল্লাহ্* সুবহানাহু ওয়া তা’আলা কোর’আনে এ প্রসঙ্গে বলেছেন,
ضَرَبَ ٱللَّهُ مَثَلٗا رَّجُلٗا فِيهِ شُرَكَآءُ مُتَشَٰكِسُونَ وَرَجُلٗا سَلَمٗا لِّرَجُلٍ هَلۡ يَسۡتَوِيَانِ مَثَلًاۚ ٱلۡحَمۡدُ لِلَّهِۚ بَلۡ أَكۡثَرُهُمۡ لَا يَعۡلَمُونَ
“আল্লাহ্* তা’আলা এক দৃষ্টান্ত বর্ণনা করেন। এক ব্যক্তির পরস্পরবিরোধী কয়েকজন মালিক আছে। আরেক ব্যক্তির মালিক মাত্র একজন। তাদের উভয়ের অবস্থা কি সমান? সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর। কিন্তু তাদের অধিকাংশই জানে না।” [4]
একসময় কালামী ভ্রান্ত দলগুলোর ব্যাপারে জানা ও সতর্ক থাকাকে যেভাবে গুরুত্ব দেয়া হতো, বর্তমানে লিবারেলিজম সম্বন্ধে জ্ঞানার্জনকে সেভাবেই গুরুত্ব দেয়া উচিৎ। কেননা লিবারেলিজম বর্তমান বিশ্বের প্রায় সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েছে। অথচ এটি কোনো সমাজের প্রত্যাশিত ব্যবস্থা হতে পারে না। লিবারেলিজম মুখে বলে সমাজে বাস্তবায়নের চেষ্টা চালানো হোক বা বলা ব্যতীতই লিবারেলিজমের আদর্শিক বাস্তবায়নের প্রচেষ্টা করা হোক দুটোই অগ্রহণযোগ্য। কেন? তা জানতে লিবারেলিজমের ব্যাপারে সংক্ষেপে তাত্ত্বিকভাবে জানাটা জরুরী।
লিবারেলিজম মূলত একটি রাজনৈতিক ও নৈতিক দর্শন। এটি এমন একটি মতবাদ, যে মতবাদে জাতিসংঘ কর্তৃক নির্ধারিত ৩০টি মানবাধিকার সংক্রান্ত প্রবন্ধকে সেভাবে বিশ্বাস করা হয় যেভাবে মুসলিমরা কোরআনকে আল্লাহ তাআলার কিতাব হিসেবে বিশ্বাস করে, হিন্দুরা রামের প্রতি ও প্রাচীন যুগের মানুষেরা তাদের দেবতাদের প্রতি বিশ্বাস করতো। Liberal Project এর অন্যতম মূল উদ্দেশ্য হলো, যে সমস্ত জাতি এ দর্শনকে গ্রহণ করেনি তাদের উপর মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার নামে এ দর্শনের আদর্শ ও বিশ্বাসকে চাপিয়ে দেওয়া।[5]
এ প্রসঙ্গে ইমেরিটাস অধ্যাপক জন কার্ভেট তার “The Liberal Project And Human Rights” বলেছেন, “…Liberal states must recognize that the liberal project for world order is unavoidably a long term one, which they need to persue with patience and persistence and not to be seduced by tempting short cuts….”
Liberalism এর সংজ্ঞায়ন করতে গিয়ে তিনি বলেছেন, “Liberalism in both theory and practice is concerned to promote social outcomes that are, as far as possible, the result of free individual choices. However, the choice of one person that does not respect the equal freedom and rights of others is invalid…The principle of equal liberty promotes social outcomes that are, as far as possible, the result of individual choice under circumstances in which all individuals can respect each other as equals. This principle makes no sense without the supporting belief that every normal adult human being has the capacity to decide for herself how she can best live her life and ought to have the right so to decide without being subject to the coercive authority of others.”[6]
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, জন লককে Liberalism এর জনক বলা হয়ে থাকে। জন লকের পর জেরেমি ব্যান্টন লিবারেলিজমে নৈতিকতার মানদণ্ডকে নতুনভাবে সংজ্ঞায়িত করেন। তিনি হেডোনিস্টিক দর্শন দ্বারা প্রভাবিত ছিলেন। তার মতে, মানুষ যা কিছু করতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে তা নৈতিকভাবে সঠিক ও এর বিপরীত হলে তা নৈতিকতার মানদণ্ডে ভুল।[7] জন স্টুয়ার্ট মিল ব্যান্টমের এই “Pleasure and Pain” তত্ত্ব দ্বারা বেশ ভালোভাবেই প্রভাবিত ছিলেন। ব্যান্টমের তত্ত্বের প্রভাব মিলের Harm Principle এ বেশ ভালোভাবেই প্রকাশ পেয়েছে। এছাড়া মিল লকের চিন্তাকে নতুনত্ব দান করেন। বিংশ শতাব্দিতে জন রলসের মতো দার্শনিকগণ এ দর্শনকে শক্তিশালী করতে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখেন। এ প্রবন্ধে এ দর্শন নিয়ে খুব বেশি একাডেমিক আলাপ করতে চাই না। বরং আমাদের মৌলিক সমস্যা হিসেবে Liberalism কে বুঝতে ও এ দর্শন কেন মানবজাতির জন্য কল্যাণকর কিছু নয় সে ব্যাপারে আলাপ করতে গিয়ে যতটুকু একাডেমিক আলাপ দরকার ততটুকু ই করবো।
Liberalism এমন একটি দর্শন যেটির অস্তিত্ব মূলত ব্যক্তিস্বাতন্ত্রবাদের ভিত্তিতে নির্ধারিত হয়েছে। জন গ্রে Liberalism এর ভিত্তি হিসেবে ব্যক্তিস্বাতন্ত্রবাদ, Universalism, Meliorism ও Egalitarianism-কে চিহ্নিত করেছেন। ব্যক্তিস্বাতন্ত্রবাদ হলো ব্যক্তির নৈতিক দৃষ্টিভঙ্গিকে সমাজের সামগ্রিক মূল্যবোধ ও কল্যাণের উপর প্রাধান্য দেওয়া তথা ব্যক্তিকে ই নিজের ভালো মন্দ ঠিক করার মাপকাঠি হিসেবে নির্ধারণ করা।[8]
অর্থাৎ লিবারেলিজম এমন এক আদর্শের কথা বলে,যে আদর্শের মূল লক্ষ্য হলো সামাজিক মূল্যবোধ ,নিয়মকানুন ও সামগ্রিক কল্যাণের উর্ধ্বে উঠে ব্যক্তিগত অধিকার সংরক্ষণ ও ব্যক্তিস্বাধীনতা বৃদ্ধিকরণ তথা ব্যক্তিস্বাতন্ত্রবাদ।
এখন প্রশ্ন হলো, ব্যক্তিস্বাতন্ত্রবাদ কি যৌক্তিক কোনো মতবাদ? যদি হয়ে থাকে তবে কিভাবে? আর যদি না ই হয় তবে Liberalism এর অস্তিত্বকে মেনে নেওয়ার কোনো যৌক্তিক কারণ নেই।
এপিস্টমলজিক্যাল আর্গুমেন্ট এগেইন্সট লিবারেলিজম
লিবারেলিজম ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদকে বিশেষভাবে গুরুত্ব দেয়। জাতিসংঘের মানবাধিকারের ধারাগুলো ব্যতীত এ দর্শনের বিশেষ কোনো ভিত্তি নেই । এখন এ প্রশ্ন উত্থাপন করা যেতে ই পারে, জাতিসংঘ মানবাধিকারের যে ধারাগুলো তৈরি করেছে সেগুলোর মানদণ্ড কী? এগুলো ই যে মানুষের অধিকার সংরক্ষণ করতে পারবে ও অন্য কোনো নীতিতে তা সম্ভব নয় তার ই বা প্রমাণ কী? লিবারেলিজম যে ব্যক্তিস্বাধীনতার কথা বলে সে ব্যক্তিস্বাধীনতার সংজ্ঞা কী? ব্যক্তিস্বাধীনতার সংজ্ঞা যে সত্য তা কীভাবে প্রমাণ করা সম্ভব? ব্যক্তিস্বাধীনতা যে একটি ভালো জিনিস তা লিবারেলরা কিভাবে প্রমাণ করবে?[9] পাশাপাশি অন্যদেরকে,বিশেষত মুসলিমদেরকে কেন লিবারেলিজমে বিশ্বাস করতে হবে? যদি বিশ্বাস করতে বাধ্য না হয়, তবে কেন অনেকক্ষেত্রে মুসলিমরা তাদের ধর্মীয় মতপ্রকাশে বাধাপ্রাপ্ত হয়? তাছাড়া যদি বিশ্বাস করতে বাধ্য না হয়, তবে কেন জন কার্ভেট তার বইয়ে নন-লিবারেলদের,বিশেষত মুসলিমদেরকে লিবারেলেক রুপান্তর করার কথা বলেছেন?
প্রথম প্রশ্নের উত্তরে বেশিরভাগ মানুষ জন স্টুয়ার্ট মিলের Harm Principle নিয়ে আসে। হিউমেন রাইটস ও লিবারেলিজমের কথা বলে। অন্তত তারা যা বলে, সে বক্তব্যের মূলনীতিগুলো মিলের এই তত্ত্বের মূলনীতির সাথে প্রায় মিলে যায়। অথচ এমনও হওয়া সম্ভব যে, তাদের অনেকে কখনো মিলের নাম ই শুনেনি। এখন কারো মনে এ প্রশ্ন আসতে ই পারে যে, মিলের নাম না জানা কেউ মিলের তত্ত্ব কীভাবে প্রয়োগ করবে? এতে অবাক হওয়ার কিছুই নেই। গণমাধ্যম ও শিক্ষাব্যবস্থার বদৌলতে অনেক আগেই আমাদের মগজ ধোলাই হয়ে গিয়েছে। যাইহোক, যারা প্রথম প্রশ্নের উত্তরে মিলের তত্ত্ব এনে কথা বলে, তাদের উত্তরের প্রত্যোত্তর হলো, লিবারেলিজম যেসকল ভিত্তির উপর দাঁড়িয়ে আছে সেসবের সাথে ব্যক্তিস্বাধীনতা বিশেষভাবে জড়িত। তাই লিবারেলিজম দিয়ে একে সংজ্ঞায়ন করা যাবে না। যৌক্তিকতার মানদণ্ডে তা টিকে না। জন স্টুয়ার্ট মিল ব্যক্তিস্বাধীনতাকে পূর্ববিদ্যমান তত্ত্ব হিসেবে ভিত্তি করে Harm Principle প্রবর্তন করেন। দুটো তত্ত্ব ই ব্যক্তিস্বাধীনতাকে সংজ্ঞায়ন করে না। একটি দর্শনের অস্তিত্ব প্রমাণের জন্য এর ভিত্তিগুলোর সংজ্ঞায়ন করা জরুরী। [10]এখন এ প্রশ্নের উত্তরে ঘুরেফিরে মানুষ Harm Principle এর মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে। কিন্তু আমরা কোনোকিছুকে প্রমাণ করার জন্য ঐ বিষয়টিকে ব্যবহার করতে পারি না। যদি তা করার চেষ্টা করি,তবে তা যৌক্তিক হবে না।
আরো একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, স্রস্টার অস্তিত্বে অস্বীকার করতে গিয়ে অনেকে ই বলে, “স্রস্টার অস্তিত্বের কোনো বৈজ্ঞানিক প্রমাণ নেই।” বৈজ্ঞানিক প্রমাণ আছে কি না তা ভিন্ন প্রসঙ্গ। কিন্তু তাদের যুক্তিতে, তাদেরকে এ প্রশ্ন করাটা কি ভুল হবে যে, ব্যক্তিস্বাধীনতার বৈজ্ঞানিক যুক্তি কী? লিবারেলিজমের বৈজ্ঞানিক যুক্তি কী? বৈজ্ঞানিক যুক্তি না পাওয়ার কারণে স্রস্টায় অবিশ্বাস রাখা ব্যক্তিবর্গ কিভাবে ব্যক্তিস্বাধীনতা ও এর ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত দর্শন লিবারেলিজমে বিশ্বাস রাখে?
আরব বংশদ্ভুত যুক্তরাজ্যের মুসলিম দাঈ ও তূলনামূলক ধর্মতত্ত্ব গবেষক, মুহাম্মদ হিজাব লিবারেলিজমের ইতিহাসকে তিনভাগে ভাগ করেছেন। জন লককে প্রবর্তক, মিলকে সংস্কারক ও রলসকে লিবারেলিজমের আধুনিক যুগের পুরোধা হিসেবে উপস্থাপন করে তিনি তাদের নিজেদের লেখনীর অসামঞ্জস্যতা তুলে ধরে তাদের আদর্শিক অবস্থান তথা লিবারেলিজমের অবস্থানকে প্রশ্নবিদ্ধ করেন।[11] এ ব্যাপারে আমি এখানে বিস্তারিত আলাপ করছি না।
জন স্টুয়ার্ট মিলের মূলনীতি অনুসারে কোনো লিবারেল, মুসলিমদের বা যে কোনো ধর্মের অনুসারিদেরকে তার বিশ্বাস মানতে বাধ্য করতে পারে না।[12] জন লক প্রদত্ত তত্ত্ব অনুসারে তারা কোনো ধর্মের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করতে পারে না, ধর্মীয় নিয়মকানুন পালনে বাধা দান করতে পারে না। অথচ তারা ই মুসলিমদের পোশাক নিয়ে মন্তব্য করে। তারাই ফ্র্যান্সে হিজাব নিষিদ্ধ করে, জার্মানের স্কুলে বোরখা নিষিদ্ধ করে, ব্রিটেনে নিক্বাব নিষিদ্ধ্বের দাবী উত্থাপন করে। মানবাধিকার লঙ্গনের নাম দিয়ে তারাই মুসলিম রাষ্ট্রগুলোতে আক্রমণ করে নিরপরাধ মুসলিমদের হত্যা করে। অর্থাৎ লিবারেলিজমের বাস্তবায়নের বেলায় তারা নিজেরাই নিজেদের নীতিতে সৎ না। এমনকি মিল যখন স্বাধীনতার ব্যাখ্যা দিচ্ছিলেন, Harm Principle তত্ত্ব এনেছিলেন, তখন তিনি নিজে কিন্তু ভারতীয়দের স্বাধীনতার বেলায় নিজের নীতিতে সৎ থাকতে পারেননি। যারা নিজেরা ই নিজেদের কল্পিত দর্শনের অনুসরণে সৎ না সে দর্শন অনুসরণ মানবজাতির জন্য কতটুকু সঠিক এ প্রশ্ন অবশ্যই উত্থাপনযোগ্য।
লিবারেলিজমের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট ও ব্যক্তিস্বাতন্ত্রবাদঃ বাস্তবতাবিবর্জিত এক আদর্শিক বিশ্বাস
ব্যক্তিস্বাতন্ত্রবাদের যৌক্তিকতা নিয়ে আলাপের আগে সংক্ষেপে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় উল্লেখ করা জরুরী। তা হলো লিবারেলিজমের উৎপত্তির পিছনে ক্যাথলিক চার্চ ও প্রটেস্টেন্টদের মধ্যকার সংঘাতের এক ইতিহাস রয়েছে। এক দীর্ঘ সংঘাতের ফলে সৃষ্ট পরিস্থিতি জন লক, থমাস হবস ও স্যামুয়েল পুফেন্ডর্ফদের মতো ব্যক্তিবর্গদের চিন্তাচেতনাকে প্রভাবিত করেছিল। এর ফলস্বরূপ তাদের হাতে লিবারেলিজমের ভিত্তিপ্রস্তর নির্মিত হয়।[13]
এ প্রসঙ্গে মুসলিম গবেষক ও দাঈ, হামজা জর্জিস বলেন,
“These theorists viewed the rights of the human being as independent to that of society, and therefore devised on the premise of individualism. This was perfectly consistent in preventing any further religiously inspired atrocities because this individualist viewpoint took the rights of a human being removed away from God’s perceived will for society. In this way an individual belonging to the Catholic or non-Catholic tradition could be tolerated. However this need for an individualist view on rights was based upon the fact that Catholicism did not have a tolerant attitude towards others.” [14]
ভালোভাবে উপরোক্ত বক্তব্যের দিকে লক্ষ্য করলে যে কেউই বুঝতে পারবেন যে, লিবারেলিজম যে তাত্ত্বিক বিশ্বাসের কথা বলে তার অনেকটাই, (“this individualist viewpoint took the rights of a human being removed away from God’s perceived will for society”) Secularism-এর আদর্শিক অবস্থানের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ।
লিবারেলিজম নামক দর্শনের চিন্তা কতটুকু সঠিক তা নিয়ে নন-লিবারেল মুসলিম ও অমুসলিম ঘরানায় বেশ আলাপ আলোচনা হয়েছে। যুক্তির খাতিরে যদি কেউ মেনে নেয় যে, এ চিন্তা সঠিক হতেও পারে, তবুও প্রশ্ন থেকে যায়। হামজা জর্জিস এ প্রসঙ্গে নিজের মত ব্যক্ত করতে গিয়ে বলেন, একটি নির্দিষ্ট ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটকে কেন্দ্র করে সৃষ্ট একটি দর্শন কিভাবে ঐ নির্দিষ্ট প্রেক্ষাপটের অবর্তমানে স্বীয় অবস্থানে যৌক্তিক বলে বিবেচ্য হবে?!
মাইকেল সেন্ডেল লিবারেলিজমের সমালোচনা করতে গিয়ে ব্যক্তিস্বাতন্ত্রবাদ তত্ত্বের যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন এবং তিনি দেখিয়েছেন যে এ তত্ত্ব ভিত্তিগত ভাবেই সমস্যাগ্রস্থ।[15] কেননা ব্যক্তিস্বাতন্ত্রবাদ ব্যক্তিকে সমাজ থেকে আলাদা করে নিজের অধিকার ও স্বাধীনতা চর্চার কথা বলে থাকে। অথচ ব্যক্তি কখনো সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে বেঁচে থাকতে পারে না। প্রত্যেক মানুষ একে অপরের উপর নির্ভরশীল। যেখানে সমাজ ব্যতীত ব্যক্তির অস্তিত্ব ই টিকিয়ে রাখা সম্ভব না, সেখানে কিভাবে ব্যক্তির নিজের ইচ্ছা আকাঙ্ক্ষাকে প্রাধান্য দেওয়ার জন্য সমাজের সামগ্রিক কল্যাণের বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়াটা যৌক্তিক হতে পারে? আর একটি অযৌক্তিক তত্ত্বের ভিত্তিতে সৃষ্ট একটি দর্শন মানুষের জন্য সঠিক দর্শন হিসেবে বিবেচিত হতে পারে? অর্থাৎ ব্যক্তিস্বাতন্ত্রবাদ নিজেই একটি মিথ্যা ও অবাস্তব তত্ত্ব, তাই এর ভিত্তিতে সৃষ্ট দর্শন তথা লিবারেলিজম ও একটি অবাস্তব ও অসত্য দর্শন।
মাইকেল সেন্ডেলের মতো চার্লস টেইলর ও লিবারেলিজমের সমালোচক ছিলেন।
তার মতে, নিছক ব্যক্তিগত অধিকারকে কেন্দ্র করে, ব্যক্তিকেন্দ্রিক একটি দার্শনিক আলাপ তৈরির প্রক্রিয়াটা নিজেই অদ্ভুত। ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদকে প্রাধান্য দিয়ে কেন একটা রাজনৈতিক দর্শন তৈরি হবে-এ প্রশ্ন অবশ্যই উত্থাপন করা যায়। আর তিনি এ প্রশ্ন উত্থাপন করেছেন এবং এ দর্শনকে এটমিজম(Atomism)বলে আখ্যা দিয়েছেন। [16]
মাইকেল সেন্ডেল প্রমুখ দার্শনিকদের বক্তব্য প্রমাণ করা অসম্ভব কিছু নয়।
কাউকে যদি বর্তমান বিশ্বের দুটো লিবারেল স্টেটের উদাহরণ জিজ্ঞেস করা হয়, তিনি প্রত্যোত্তরে অবশ্যই আমেরিকা ও যুক্তরাজ্যের নাম বলবেন। হেলেনা রোজেনব্লাট লিবারেলিজমের ইতিহাস প্রসঙ্গে আলোচনা করতে গিয়ে লিখেছেন, ‘The Lost History Of Liberalism’. তিনি তার বইটির একটি অধ্যায়ের নাম ই দিয়েছেন ‘Liberalism Becomes The American Creed’. এ থেকে বুঝা যায় পশ্চিমে লিবারেলিজমের অবস্থান কোন পর্যায়ে রয়েছে।
পশ্চিমা বিশ্বের দিকে তাকালে এটি দৃশ্যমান হয় যে, তাদের সমাজকাঠামো ধীরে ধীরে ভেঙে পড়েছে। ব্যক্তিস্বাধীনতা পরিভাষা ব্যবহার করে পশ্চিমারা নীতি নৈতিকতার তোয়াক্কা না করে নিজের যা ভালো লাগে তাই করছে। ফলাফলস্বরূপ পৃথিবীর সর্বোত্তম লিবারেল স্টেটগুলোতে সামাজিক অবক্ষয় চুড়ান্তরূপে এসে পৌঁছেছে। তাদের সমাজে ধর্ষণ,সমকামিতা, শিশুকামিতা ও ব্যভিচার সহ সর্বপ্রকার অমানবিক ও অনৈতিক কর্মকাণ্ড বৃদ্ধি পেয়েছে। এরমধ্যে কিছু কাজ আবার বৈধতা ও পেয়েছে। যেমনঃ পর্ণোগ্রাফি, ব্যভিচার, সমকামিতা ইত্যাদি। অর্থাৎ এসব অপরাধ ও অনৈতিক কার্যাবলির মূলে রয়েছে তাদের ব্যক্তিস্বাতন্ত্রবাদে বিশ্বাস, আরো ভালোভাবে বললে লিবারেলিজমে বিশ্বাস। সুতরাং এসমস্ত সমস্যার মূল হচ্ছে লিবারেলিজমের আদর্শিক ভিত্তি। খিলাফাহ পতনের কিছুকাল আগে থেকেই তারা বিভিন্ন কৌশল অবলম্বনের মাধ্যমে মুসলিম সমাজে এসব অবলীলায় প্রবেশ করিয়েছে। ফলস্বরূপ মুসলিম সমাজ ও কলুষিত হয়ে পড়েছে।
যেহেতো লিবারেলিজম দেশগুলোর রাজনৈতিক, সামাজিক সর্বোপরি সর্বক্ষেত্রে প্রভাব ফেলে, তাই সেখানে সৃষ্ট সমস্যাগুলোর দায়ভার অবশ্যই লিবারেল পলিসির উপর বর্তায়। অবশ্যই এসমস্ত বর্তমান পরিস্থিতি লিবারেলিজম বাস্তবায়নের ফলাফল হিসেবেই বিবেচ্য হবে। এর অন্যথা ভাবার কোনো সুযোগ নেই।
মোদ্দাকথা সামাজিক অবকাঠামোর ভঙ্গুর হাল ও সমাজে সৃষ্ট সমস্যাগুলোর মূলে রয়েছে লিবারেলিজম। সে সমস্যা কেবল যুবকদের সমস্যা তা নয় বরং পুরো সমাজের প্রধান সমস্যা। আর পুরো সমাজব্যবস্থার প্রধান সমস্যা নিঃসন্দেহে সমাজে বসবাসরত প্রতিটি শ্রেণীর ও প্রধান সমস্যা তথা যুবকদের ও প্রধান সমস্যা তা নতুন করে ব্যাখ্যা করার কোনও প্রয়োজন নেই। তাই এই মূলে আঘাত করাটা জরুরী। তানাহলে একটার পর একটা নতুন সমস্যা সৃষ্টি হতেই থাকবে।
আল্লাহ্* সুবহানাহু ওয়াতা’আলা আমাদেরকে তাঁর কালামে পাকে বলেই দিয়েছেন যে, প্রবৃত্তির দাসত্ব অনিষ্টতা ব্যতীত অন্যকিছু বয়ে আনবে না। কোরআনে বলা হয়েছেঃ
…وَلَوِ ٱتَّبَعَ ٱلۡحَقُّ أَهۡوَآءَهُمۡ لَفَسَدَتِ ٱلسَّمَٰوَٰتُ وَٱلۡأَرۡضُ
“…আর সত্য যদি তাদের প্রবৃত্তির অনুসরণ করতো তবে আসমান জমিন ও এর মধ্যকার সবকিছু বিশৃঙ্খলায় নিপতিত হতো।”[17]
আল্লাহু আকবর! আল্লাহ্* পাক যা বলেছেন এর ই বাস্তবায়ন পশ্চিমা সমাজে দৃশ্যমান। হামজা জর্জিস তার এক আর্টিকেলে ২০০৯ এ Children Society কর্তৃক “A Good Childhood : Searching For Values in A Competitive Age” শিরোনামে প্রকাশিত একটি রিপোর্ট উপস্থাপন করে প্রমাণ করেন যে, যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রে অন্যান্য রাষ্ট্রের তুলনায় বিবাহবিচ্ছেদের হার বেশি। এতে সন্দেহ নেই যে, বিবাহবিচ্ছেদ পরিবারপ্রথা ভেঙে দেয়ার অন্যতম মুখ্য এক মাধ্যম। রিপোর্টটিতে আরো বলা হয় যে, পরিবারগুলোর সদস্যদের নিজেদের মধ্যে আত্মিক সংযোগ নেই বলা চলে। পরিবারকাঠামোর এহেন অবনতির ফলস্বরূপ সেখানকার শিশুরা একে অপরের প্রতি অনেকক্ষেত্রে অমার্জিত হয়ে থাকে। তাদের মধ্যে মদ, মাদকদ্রব্য গ্রহণের হার অন্যদেশের তুলনায় বেশি। শুধু তাই নয় ,বরং তরুণীদের অন্তঃসত্ত্বা হওয়ার সম্ভাবনা ও অত্যধিক।[18]
ইংল্যান্ড ও ওয়েলসের পরিবার বিভাজন বিভাগের বিচারক, জনাব জাস্টিস কলেরিজ(Justice Coleridge) পরিবারব্যবস্থা ও সমাজ কাঠামো ভেঙ্গে যাওয়া প্রসঙ্গে বলেন,
“…never ending carnival of human misery – a ceaseless river of human distress.”[19]
মার্চ ২০১৮-মার্চ ২০১৯ অবধি কেবল ইংল্যান্ড ও ওয়েলসে ৬৭১ জন খুন হয়েছে। এর মধ্যে মহিলার সংখ্যা ২৪১। মহিলাদের মধ্যে ৩৮% মহিলা খুন হয়েছে তাদের তৎকালীন সঙ্গী বা পূর্বের সঙ্গীর হাতে। [20]
অন্যদিকে আমেরিকায় ২০১৮ সালে ১৬,২১৪ জনের খুন হয়। ৮,০৭,৪১০ জন নারী-পুরুষ Aggravated assault এর শিকার হয়। এছাড়া গাড়ি চুরির ঘটনা ঘটেছে ৭,৪৮,৮৪১টি, সিঁদেল চুরির ঘটনা ঘটেছে ১২,৩০,১৪৯টি, প্রতারণার মাধ্যমে চুরির ঘটনা ঘটেছে ৫,২১,৭,০৫৫টি, ডাকাতি ২,৮২,০৬১টি।[21]
ইউনি ব্রনফেনব্রেনার, “The State of Americans: This Generation and the Next” এর লেখক আমেরিকার সামাজিক সমস্যা প্রসঙ্গে মতব্যক্ত করতে গিয়ে বলেন,
“The signs of this breakdown are all around us in the ever growing rates of alienation, apathy, rebellion, delinquency and violence among American youth…” [22]
লিবারেল স্টেটে নারী ও শিশুদের অবস্থা
উপমহাদেশে বহুল প্রচলিত একটি স্লোগান হলো, “পশ্চিমে মেয়েরা ছোট ছোট পোশাক পরে, ওদের তো ধর্ষণ হয় না। সমস্যা ছেলেদের মানসিকতায়। মেয়েদের ঘরে বন্দী না রেখে, তাদের গায়ে বস্তা না পরিয়ে ছেলেদের দৃষ্টিভঙ্গি পালটানো উচিৎ।” পোশাকের জন্য ধর্ষণ হোক বা যে কারণেই ধর্ষণ হোক, কোনো কারণ ই ধর্ষণকে বৈধতা দিতে পারে না। কিন্তু মুসলিম নারীরা যখন রবের আদেশ মেনে তাদের শরীর ঢেকে রাখে, লিবারেলরা পশ্চিমের উদাহরণ এনে মুসলিম নারীদেরকে পশ্চিমাদের অনুসরণের আহ্বান জানায়। শরীর উলঙ্গ রাখাকে ব্যক্তিস্বাধীনতা ও সম্মানের বলে মুসলিম নারীদের মগজ ধোলাই করে। তাই এখন আমাদের আসলেই প্রশ্ন করা উচিৎ, পশ্চিমে মেয়েরা আসলেই ভালো আছে? উপরে একটা রিপোর্টে বলা হয়েছে কিশোরীদের অত্যধিক অন্তঃসত্ত্বা হওয়ার কথা। এতেই বুঝা যায় তারা কতটা ভালো আছে। তবুও এবার লিবারেলিজম নারীদের কতটুকু নিরাপত্তা দিয়েছে সে ব্যাপারে আরও একটু পরিসংখ্যান দেখে নেওয়া যাক।
CSEW তথা Crime Servey For England And Wales এর মার্চ ২০১৭ সালের রিপোর্ট মতে, ইঙ্গল্যান্ড এবং ওয়েলসে
– শতকরা ২০ ভাগ তথা ৩৪ লাখের কাছাকাছি মেয়েরা ১৬ বছর বয়সে যৌন নির্যাতনের শিকার হয়।
– কেবল ২০১৬ সালেই ৫ লক্ষ ১০ হাজার মেয়ে যৌন নিপীড়নের শিকার হয়েছে।
-৬ জনের ৫ জন নির্যাতিত মহিলা পুলিশের কাছে মামলা করে না।
RCEW(Rape Crisis England & Wales) এর এক রিপোর্টে বলা হয়েছে,
-NSPCC এর ২০১১ সালের রিপোর্ট মতে, ১৮-২৪ বছর বয়সী শতকরা ৩১ ভাগ নারী শৈশবে যৌন নিপীড়নের শিকার হয়েছে।[23]
২০১৩ সালে Ministry Of Justice, Home Office and the Office for National Statistics কর্তৃক “An Overview of Sexual Offending in England and Wales” নামে একটি আনুষ্ঠানিক রিপোর্ট প্রকাশিত হয়। রিপোর্টটি থেকে জানা যায়,
-ইংল্যান্ড ও ওয়েলসে প্রতি বছর গড়ে ৮৫,০০০ নারী ধর্ষণ ও যৌন নিপীড়নের শিকার হয়।
-প্রতি এক ঘন্টায় ১১ জন নারী যৌন নিপীড়নের শিকার হয়।
-১৬-৫৯ বছর বয়সী প্রতি বিশ জনের এক জন মেয়ে ১৬ বছর বয়সে সর্বাধিক ভয়াবহ ও নিকৃষ্ট পদ্ধতির যৌন নির্যাতনের শিকার হয়।
-প্রতি ৫ জনে একজন নারী ১৬ বছর বয়সের মধ্যেই অন্যান্য যৌন নিপীড়নের শিকার হয়। যেমন : শরীরের সংবেদনশীল স্থানে স্পর্শের মাধ্যমে নিপীড়ন, পোশাকের অংশবিশেষ খুলে ফেলা, যৌন নিপীড়নমূলক কথা বলে হুমকি দেয়া ইত্যাদির শিকার হওয়া।
-২০১২ সালে নির্যাতিত মহিলাদের শতকরা ৯০ ভাগের অপরাধীই তাদের পূর্ব পরিচিত।
-২০১২ সালে নির্যাতিতদের মধ্যে কেবল ১৫ ভাগ মহিলা পুলিশের কাছে রিপোর্ট করেছে।
-২০১১-১২ সালে সমগ্র ইংল্যান্ড ও ওয়েলসে পুলিশ রেকর্ডে ৫৩,৭০০ মামলা দায়ের করা হয়েছে। তাদের মধ্যে ভয়াবহভাবে নির্যাতিতের পরিমাণ শতকরা ৭১ ভাগ, যাদের মধ্যে ১৬০০০ মামলা ধর্ষণের ও ২২,১০০ মামলা ভয়াবহ যৌন নিপীড়নের। [24]
একই মন্ত্রণালয় থেকে ২০১৬ সালে প্রকাশিত রিপোর্ট “Violence Against Women And Girls Strategy থেকে জানা যায়:
-সেদেশে প্রতি ৪ জনের ১ জন নারী ডমেস্টিক এবিউজের শিকার হয়।
-প্রতি ৫ জনের ১ জন নারী জীবনে কখনও না কখনও যৌন নিপীড়নের শিকার হয়। [25]
এ পয়েন্টে যদিও পুরুষ নির্যাতিতদের কথা উল্লেখ করা কিছুটা অপ্রয়োজনীয় তাও আমি উল্লেখ করছি।
-CSEW এর পূর্বোক্ত রিপোর্ট অনুযায়ী ৬,৩১,০০০ পুরুষ যৌন নিপীড়নের শিকার হয়ে থাকে।
– কেবল ২০১৬ সালে ইংল্যান্ড ও ওয়েলসে ১৬-৫৯ বছর বয়সী ১,৩৮,০০০ পুরুষ যৌন নিপীড়নের শিকার হয়েছে।
-২০১৮ সালের মার্চ অবধি ইংল্যান্ড ও ওয়েলসে নির্যাতিত পুরুষের সংখ্যা পরিসংখ্যান অনুযায়ী ৬,৯৫,০০০। উল্লেখ্য, বহুপুরুষ নির্যাতনের ব্যাপারে কাউকে জানায় না। তাই প্রকৃত সংখ্যা এর থেকে বেশি হওয়া স্বাভাবিক।
CSEW এর রিপোর্ট অনুযায়ী সাধারণ পুরুষদের তুলনায় বিসেক্সুয়াল (নারী-পুরুষ উভয়ের প্রতি আকর্ষণ থাকা) ও পুরুষ সমকামীরা বেশি নির্যাতিত হয়। সমকামি পুরুষদের ক্ষেত্রে এ সম্ভাবনা সাধারণ পুরুষের তুলনায় দ্বিগুণ।[26]
অপরদিকে, আমেরিকায় RAINN অর্গানাইজেশনের Victims Of Sexual Violence Statistics রিপোর্ট অনুযায়ী,
প্রতি ৭৩ সেকেন্ডে একজন আমেরিকান যৌন নিপীড়নের শিকার হয়।
প্রতি বছর বার বছর উর্ধ্ব বয়সী ৪৩,৩,৬৪৮ জন যৌন নির্যাতনের শিকার হয়।
নির্যাতিতদের মধ্যে ১৮-৩৪ বছর বয়সীদের হার শতকরা ৫৪ ভাগ।
প্রতি ৬ জনে একজন মহিলার জীবনে একবার হলেও ধর্ষণের চেষ্টার কিংবা ধর্ষণের শিকার হতে হয়েছে।
১৬-১৯ বছর বয়সী মেয়েদের ধর্ষণের সম্ভাবনা যেকোনো মানুষের তুলনায় চারগুণ বেশি।
প্রাপ্ত বয়স্ক ধর্ষিতদের মধ্যে নারীদের হার ৯০ ভাগ।
শতকরা ১১ ভাগ শিক্ষার্থী(নারী-পুরুষ নির্বিশেষে) কোনো না কোনোভাবে যৌন নির্যাতনের শিকার হয়।[27]
৩৩ জনের একজন আমেরিকান পুরুষ জীবনের কখনও না কখনও ধর্ষণের চেষ্টা বা ধর্ষণের শিকার হয়েছে।
প্রতি দশজন ধর্ষণের শিকার নির্যাতিতদের মধ্যে একজন নির্যাতিত পুরুষ রয়েছে।
ট্রান্সজেন্ডার শিক্ষার্থিদের মধ্যে ২১ ভাগ ই যৌন নিপীড়নের শিকার হয়েছে।
ধর্ষিত নারীদের শতকরা ৩৩ভাগ আত্মহত্যার কথা ভেবে থাকে ও ১৩ ভাগ আত্মহত্যার চেষ্টা করে। [28]
এছাড়া, RAINN অর্গানাইজেশনের Children and Teens: Statistics রিপোর্ট মতে,
– আমেরিকায় প্রতি ৯ মিনিটে একজন শিশু যৌন নির্যাতনের শিকার হওয়ার অভিযোগ আসে।
-১৮ বছর বয়সের পূর্বেই ৯ জনের ১ জন মেয়ে ও ৩৩ জনের ১ জন ছেলে প্রাপ্তবয়স্ক কারো হাতে যৌন নির্যাতনের শিকার হয়।
-শিশুরা মাত্র ৭% অপরিচিত, ৫৯% পরিচিত ও ৩৪% পরিবারের সদস্যদের হাতে যৌন নির্যাতনের শিকার হয়। এর মধ্যে ৮৮% পুরুষ ও ৯% নারী হয়ে থাকে। বাকি ৩% এর ব্যাপারটা অজ্ঞাত। [29]
২০১৮ সালে আমেরিকায় ১ লক্ষ ৩৯ হাজার ৩৮০ জন (নারী-পুরুষ) ধর্ষণের শিকার হয়। ২০১৭ তে এ সংখ্যা ছিল ১,৩৫,৬৬৬ । [30]
উপরোক্ত তথ্যগুলো এমন একটি রাষ্ট্রের ,যে রাষ্ট্রে সম্মতির ভিত্তিতে বিয়ে বহির্ভূত শারিরিক সম্পর্ক বৈধ। লিবারেলিজমের শস্যভূমিতুল্য দেশগুলোতে যদি এত অধিক হারে অপরাধ সংঘটিত হয় ,তার অর্থ দাঁড়ায় যে, সিস্টেমেই সমস্যা। যদি লিবারেলিজম প্রকৃতপক্ষেই মানবজাতির জন্য উপকারি হতো তবে পৃথিবীর সর্বাধিক বৃহৎ লিবারেল রাষ্ট্রগুলো অবশ্যই এসব অপরাধের হার কমাতে সক্ষম হতো। যেহেতো তারা তা করতে সক্ষম হয়নি, এতে তাদের আদর্শিক বিশ্বাসের দূর্বলতা লিবারেলিজমের ফলে সামাজিক অবক্ষয়ের পরিমাণ বৃদ্ধি পাচ্ছে তা উপরোক্ত তথ্যগুলো থেকে দিনের আলোর ন্যায় পরিষ্কার।
২০১১ সালে বিশ্বের সর্বাধিক হতাশাগ্রস্ত(World’s most depressed countries) মানুষদের দেশের তালিকায় যুক্তরাষ্ট্র দ্বিতীয় স্থান লাভ করে। এমনকি প্রথম পাঁচটি দেশের চারটিই মূলত পশ্চিমা লিবারেল স্টেটস। [31]
অর্থাৎ লিবারেলিজমের ফলে কেবল সমাজে নৈরাজ্য সৃষ্টি হচ্ছে এবং পরিবার ব্যবস্থা ভেঙে যাচ্ছে তা নয়, বরং ব্যক্তিস্বাধীনতা তত্ত্ব তথা ব্যক্তিস্বাতন্ত্রবাদ প্রকৃতপক্ষে মানুষকে সুখী করতে পারে না। ডিপ্রেসড মানুষদের তালিকায় যুক্তরাষ্ট্রের দ্বিতীয় স্থান লাভ করা সেদিকে ই ইঙ্গিত করে। এ থেকে এটিও প্রমাণিত হয় যে, ব্যক্তিস্বাতন্ত্রবাদের স্লোগান সম্পূর্ণ মিথ্যা একটি স্লোগান বৈ কিছুই নয়। তাছাড়া যে দর্শন একটি রাষ্ট্রের সমাজকাঠামো ভেঙে দেয় ও বিভিন্ন সমস্যা সৃষ্টি করে, সে দর্শন কখনোই কল্যাণকর হতে পারে না।
অতএব, ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে মানবজাতির জন্য লিবারেলিজম একটি বাস্তবসম্মত জীবনব্যবস্থা হতে পারে না। তাই লিবারেলিজমে প্রভাবিত সাধারণ জনগণের অবশ্যই উচিৎ এমন একটি সিস্টেম প্রতিষ্ঠায় আগ্রহী হওয়া যে সিস্টেম তাদের জীবন,অর্থকে নিরাপদ রাখবে, যে সিস্টেমে নৈতিকতার ভিত্তি আপেক্ষিক না বরং সুনির্ধারিত ও যে সিস্টেম সমাজকাঠামোকে সুসংহত রাখে।
মুসলিম ও লিবারেলিজম
মুসলিম হিসেবে আমরা বিশ্বাস করি যে, সার্বভৌম ক্ষমতা একমাত্র আল্লাহ্* তাআলার। আমরা বিশ্বাস করি, আমাদের পৃথিবীতে আসাটা কোনো এক্সিডেন্টাল বিষয় নয়, বরং এর পিছনে নির্দিষ্ট উদ্দেশ্য রয়েছে।আমাদের জীবনের নির্দিষ্ট লক্ষ্য রয়েছে। আর এ লক্ষ্য হলো আল্লাহ্* তা’আলার দাসত্ব করা। আমরা তাঁর দাস। তাঁর দাসত্ব করা ই আমাদের কাজ। মানুষ তাঁর দাসত্বের জন্যই সৃষ্টি হয়েছে। আল্লাহ্* সুবহানাহু ওয়া তা’আলা কোরআনে এ ব্যাপারে স্পষ্ট ঘোষণা দিয়েছেন,
যেমন :
১। তিনি বলেছেন,
وَمَا خَلَقۡنَا ٱلسَّمَآءَ وَٱلۡأَرۡضَ وَمَا بَيۡنَهُمَا لَٰعِبِينَ
“ভূমণ্ডল ও নভোমণ্ডলের মাঝে যা কিছু আছে তা আমি ক্রীড়াচ্ছলে সৃষ্টি করিনি।”[32]
২। সূরা দুখানেও তিনি একই ঘোষণা দেওয়ার পর বলেন,
مَا خَلَقۡنَٰهُمَآ إِلَّا بِٱلۡحَقِّ وَلَٰكِنَّ أَكۡثَرَهُمۡ لَا يَعۡلَمُونَ
“আমি এগুলো যথাযথ উদ্দেশ্যে সৃষ্টি করেছি,কিন্তু তাঁদের অধিকাংশই বুঝেনা।”[33]
৩।
وَمَا خَلَقۡتُ ٱلۡجِنَّ وَٱلۡإِنسَ إِلَّا لِيَعۡبُدُون
“আমি জ্বিন ও মানুষকে কেবল আমার ইবাদতের জন্যই সৃস্টি করেছি.”[34]
মানুষের প্রকৃতিতে দাসত্ব মিশে আছে। মানুষ কখনোই এ দাসত্ব থেকে মুক্তি লাভ করতে পারবে না। যদি সে স্রস্টার দাসত্ব না করে, এর অর্থ এ না যে, সে দাসত্ব থেকে মুক্তি পেয়ে গিয়েছে। বরং নিজের খেয়াল খুশির অনুসরণের মাধ্যমে সে নিজের খেয়াল খুশির দাসত্ব করা শুরু করেছে। যার পরিণতি কখনোই সুখকর হয় না। একজন মানুষ যখন আল্লাহর দাসত্বের বদলে খেয়াল খুশির অনুসরণ শুরু করে, তখন তার নফস ই ন্যায়-নৈতিকতাবোধ ঠিক করে দেয়। এটা অস্বাভাবিক নয় যে, নীতি নৈতিকতার মানদণ্ড যদি হয় ম্নানুষের ইচ্ছা ও বিবেকবুদ্ধি, তখন এ মানদণ্ড একটি আপেক্ষিক মানদণ্ডে পরিণত হয়। আর লিবারেলিজমে এটিই নৈতিকতার মানদণ্ড। এখন, যে মানদণ্ড আপেক্ষিক তা কি সমাজে ন্যায়নীতি প্রতিষ্ঠা করতে আদৌ সক্ষম হবে? বরং এ আপেক্ষিকতার কথা বলে সাধারণ থেকে বড় বড় মানুষও নিজের পশুত্বকে বৈধতা দেয়। তাদের কাছে জীবন একবার ই, তাই তারা সেটিকে নিজের খেয়ালখুশি মতো অনুসরণ করে। পশ্চিমা সমাজে ব্যক্তিকেন্দ্রিক আপেক্ষিক নৈতিকতাবোধের মানদণ্ড ও ব্যক্তিস্বাধীনতার অধিকার পর্ণোগ্রাফির মতো অপরাধকেও বৈধতা দিয়ে দেয়। এ হলো লিবারেল মূল্যবোধের ভিত্তিতে তৈরি আইনের অবস্থা।
আল্লাহ্* তা’আলা বলেছেন :
أَفَرَءَيۡتَ مَنِ ٱتَّخَذَ إِلَٰهَهُۥ هَوَىٰهُ…. وَقَالُواْ مَا هِيَ إِلَّا حَيَاتُنَا ٱلدُّنۡيَا نَمُوتُ وَنَحۡيَا وَمَا يُهۡلِكُنَآ إِلَّا ٱلدَّهۡرُۚ وَمَا لَهُم بِذَٰلِكَ مِنۡ عِلۡمٍۖ إِنۡ هُمۡ إِلَّا يَظُنُّونَ
“আপনি কি তার প্রতি লক্ষ্য করেননি যে নিজের খেয়ালখুশিকে স্বীয় উপাস্যরূপে স্থির করেছে?…তারা বলে পার্থিব জীবন ই তো আমাদের শেষজীবন। আমরা মরি ও বাচি,মহাকাল ই আমাদের ধ্বংস করে,তাদের কাছে এ ব্যাপারে কোনো জ্ঞান নেই। তারা কেবল অনুমান করে কথা বলে।”[35]
অপরপক্ষে ইসলামে ন্যায়নীতির মানদণ্ড আপেক্ষিক কোনো বিষয় নয়। বরং, মানদণ্ড হলো আল্লাহ প্রদত্ত কোর’আন ও রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুন্নাহ। একারণে মুসলিমরা ইসলামপ্রদত্ত বিধানের বাইরে যেতে পারে না। ইসলাম নফসের অনুসরণকে সমর্থন করে না। আল্লাহ্* সুবহানাহু ওয়া’তা’আলা এ প্রসঙ্গে নবিজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে উদ্দেশ্য করে বলেছেন,
ثُمَّ جَعَلۡنَٰكَ عَلَىٰ شَرِيعَةٖ مِّنَ ٱلۡأَمۡرِ فَٱتَّبِعۡهَا وَلَا تَتَّبِعۡ أَهۡوَآءَ ٱلَّذِينَ لَا يَعۡلَمُونَ
“অতঃপর আমি আপনাকে রেখেছি এক বিশেষ শরীয়তের উপর। সুতরাং আপনি এর অনুসরণ করুন এবং মূর্খদের খেয়াল খুশির অনুসরণ করবেন না।”[36]
আল্লাহ্* সুবহানাহু ওয়া তা’আলা আরো ইরশাদ করেছেন,
أَمۡ حَسِبَ ٱلَّذِينَ ٱجۡتَرَحُواْ ٱلسَّيِّ*اتِ أَن نَّجۡعَلَهُمۡ كَٱلَّذِينَ ءَامَنُواْ وَعَمِلُواْ ٱلصَّٰلِحَٰتِ سَوَآءٗ مَّحۡيَاهُمۡ وَمَمَاتُهُمۡۚ سَآءَ مَا يَحۡكُمُونَ
“যারা দুস্কর্ম করেছে তারা কি মনে করে যে, আমি তাদেরকে সে লোকদের মত করে দেব যারা ঈমান আনে ও সৎকর্ম করে এবং তাদের জীবন ও মৃত্যু কি সমান হবে? তাদের এ দাবী কতই না মন্দ!”[37]
অতএব মুসলিমদের জন্য কখনোই বৈধ নয় লিবারেলিজমের মূলনীতিকে গ্রহণ করা। কেননা এটি সুস্পষ্ট শিরক ও কুফর। মুসলিমদের ধর্মীয় বিধিনিষেধ ছাড়াও লিবারেলিজম অন্য ধর্মাবলম্বীদের জন্যেও যে ক্ষতিকর তা আমরা ইতিমধ্যে প্রমাণ করার চেষ্টা করেছি। যেহেতো লিবারেলিজম একটি মিথ্যা কল্পনাপ্রসূত বিশ্বাসের ভিত্তিতে সৃষ্ট দর্শন ও যেহেতো এ দর্শন মানবকল্যাণে ভূমিকা রাখতে পারে না তা আমরা ইতিমধ্যেই প্রমাণ করেছি, এ অংশে আমরা লিবারেলিজমের বিকল্প হিসেবে ইসলাম কেন প্রয়োজনীয় ও উত্তম তা নিয়ে আলাপ করবো ইন শা আল্লাহ্*। এ আলোচনা করাটা অত্যন্ত জরুরী। কেননা সাংস্কৃতিক আগ্রাসন ও বুদ্ধিবৃত্তিক ঔপনিবেশিকতার ফলে মুসলিম বিশ্বে লিবারেলিজমের বিষাক্ত ছোবলের প্রভাব ইতিমধ্যেই ছড়িয়ে পড়েছে।
লিবারেলিজম ও ইসলাম
ইনসাফ ও সমাজ কাঠামো রক্ষা
লিবারেল মূল্যবোধের বাস্তবায়নের ফলে লিবারেল সমাজে সৃষ্ট সমস্যা সমাধানের জন্য ইসলাম নিঃসন্দেহে একটি সুন্দর সমাধান হিসেবে ভূমিকা রাখবে। নবিজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি একবার সাহাবীদেরকে একটি জাহাজের উদাহরণ দেন। ঘটনাটি ছিল এমন,
কিছুলোক জাহাজে করে সফরে বের হয়েছিলো। তাদের মধ্যকার কিছু লোক জাহাজের ভিতরে ডেকে আর কিছুলোক জাহাজের উপরে অবস্থান করছিল। ডেকের ভিতরের লোকেদের হঠাৎ পানির প্রয়োজন দেখা দিলে তারা পানি চাইলো। কিন্তু জাহাজের উপরের লোকেরা পানি দিতে অস্বীকার করে। তখন ডেকে থাকা লোকেরা ঠিক করলো তারা জাহাজের মধ্যে একটা বড় ছিদ্র করে সমুদ্র থেকে পানি নেবে। নবিজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন ,’যদি জাহাজের উপরে থাকা লোকেরা তাদেরকে জাহাজে ছিদ্র করায় বাধা প্রদান না করতো, তবে জাহাজসহ সবাই ডুবে যেতো। [38]
সুবহান আল্লাহ্*! উপরোক্ত হাদিসটি ব্যক্তিস্বাতন্ত্রবাদের ভিত্তি যে কতোটা দূর্বল তা সুপষ্টভাবে প্রমাণ করে। এ হাদীস দ্বারা সমাজের বিরুদ্ধে গিয়ে নিজের ইচ্ছেকে প্রাধান্য দিয়ে মানুষের পক্ষে সুস্থ জীবনযাপন করা সক্ষম নয়-তাও প্রমাণ করে। কেননা ব্যতি সমাজের ও সমাজ ব্যক্তির ই অংশ। তাই এ দুয়ের মধ্যে সুস্থ সম্পর্ক থাকা জরুরী। ব্যক্তি ও সমাজ একে অপরের পরিপুরক।
উপরোক্ত দলীলগুলো এটাও প্রমাণ কর যে,ইসলাম সর্বকালের ও সর্বযুগের জন্য। একবিংশ শতাব্দিতে সৃষ্ট ফিৎনার ও সমাধান আল্লাহ্* তা’আলা চৌদ্ধশ বছর আগে ই বলে দিয়েছেন।
ইসলাম জাহাজের ডুবে যাওয়া তথা সামাজিক অবকাঠামো ভেঙে পড়াকে বাধাপ্রদান করে। আর এজন্য ইসলামের নিজস্ব কিছু মূলনীতি ও মূল্যবোধ রয়েছে। যেমনঃ ইনসাফ, দয়া, সহনশীলতা, অন্যায়ের প্রতিবাদ অরা, ভালো কাজে উৎসাহিত করা, জবাবদিহীতা ইত্যাদি। আর এগুলো শরীয়াহর উৎস তথা কোর’আন ,হাদীস, ইজমা ও ক্বিয়াসের মানদণ্ডে নির্ধারিত হয়।
শরীয়াহ এ মূল্যবোধগুলোকে দৃঢ়ভাবে ধারণ ও প্রচার করে থাকে।
যেমন :
১। নবিজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, “সর্বোত্তম জিহাদ হলো, জালিম শাসকের সামনে সত্য কথা বলা।”[39]
২। আল্লাহ্* তাআলা বলেন,
فَلَا ٱقۡتَحَمَ ٱلۡعَقَبَةَ ١١ وَمَآ أَدۡرَىٰكَ مَا ٱلۡعَقَبَةُ ١٢ فَكُّ رَقَبَةٍ ١٣ أَوۡ إِطۡعَٰمٞ فِي يَوۡمٖ ذِي مَسۡغَبَةٖ ١٤ يَتِيمٗا ذَا مَقۡرَبَةٍ ١٥ أَوۡ مِسۡكِينٗا ذَا مَتۡرَبَةٖ ١٦ ثُمَّ كَانَ مِنَ ٱلَّذِينَ ءَامَنُواْ وَتَوَاصَوۡاْ بِٱلصَّبۡرِ وَتَوَاصَوۡاْ بِٱلۡمَرۡحَمَةِ ١٧ أُوْلَٰٓئِكَ أَصۡحَٰبُ ٱلۡمَيۡمَنَةِ ١٨
“আর সে ধর্মের ঘাটিতে প্রবেশ করেনি। আপনি কি জানেন সে ঘাঁটি কি? তা হচ্ছে দাসমুক্তি। অথবা দুর্ভিক্ষের দিনে এতিম আত্মীয়কে অন্নদান, অথবা ধুলি-ধুসরিত মিসকিনকে। অতঃপর যারা ঈমান আনে ও পরস্পরকে ধৈর্যধারণের ও উদার হওয়ার উপদেশ দেয় তাদের অন্তর্ভুক্ত হওয়া। তাঁরাই সৌভাগ্যবান।”[40]
৩। সৎ কাজের নির্দেশ ও অসৎ কাজে নিষেধ প্রসঙ্গে আল্লাহ্* তা’আলা বলেন,
وَلۡتَكُن مِّنكُمۡ أُمَّةٞ يَدۡعُونَ إِلَى ٱلۡخَيۡرِ وَيَأۡمُرُونَ بِٱلۡمَعۡرُوفِ وَيَنۡهَوۡنَ عَنِ ٱلۡمُنكَرِۚ وَأُوْلَٰٓئِكَ هُمُ ٱلۡمُفۡلِحُونَ
“আর তোমাদের মধ্যে এমন একটি দল থাকা উচিৎ ,যারা সৎকর্মের দিকে আহ্বান জানাবে , ভালোকাজের নির্দেশ করবে ও অন্যায় কাজে নিষেধ করবে। আর তাঁরাই তো সফলকাম।”[41]
وَٱلۡمُؤۡمِنُونَ وَٱلۡمُؤۡمِنَٰتُ بَعۡضُهُمۡ أَوۡلِيَآءُ بَعۡضٖۚ يَأۡمُرُونَ بِٱلۡمَعۡرُوفِ وَيَنۡهَوۡنَ عَنِ ٱلۡمُنكَرِ وَيُقِيمُونَ ٱلصَّلَوٰةَ وَيُؤۡتُونَ ٱلزَّكَوٰةَ وَيُطِيعُونَ ٱللَّهَ وَرَسُولَهُۥٓۚ أُوْلَٰٓئِكَ سَيَرۡحَمُهُمُ ٱللَّهُۗ إِنَّ ٱللَّهَ عَزِيزٌ حَكِيمٞ
“আর ঈমানদার নারীপুরুষ একে অপরের সহায়ক। তারা সৎ কাজের আদেশ দেয় ও অসৎ কাজে নিষেধ করে। সালাত আদায় করে ও যাকাত প্রদান করে। আর তারা আল্লাহ্* ও তাঁর রাসুলের প্রতি ঈমান আনে। এদের উপরই আল্লাহ্* দয়া করবেন। নিশ্চয় আল্লাহ্* তা’আলা পরাক্রমশালী সুকৌশলী।।”( সূরা তাওবাঃ৭১)
৪। ইনসাফ প্রতিষ্ঠার প্রতি আহ্বান জানিয়ে আল্লাহ্* তা’আলা বলেন,
فَٱحۡكُم بَيۡنَهُم بِٱلۡقِسۡطِۚ إِنَّ ٱللَّهَ يُحِبُّ ٱلۡمُقۡسِطِينَ
“…ইনসাফের সাথে বিচার করুন, নিশ্চয়য় আল্লাহ্* তা’আলা সুবিচারকারিদের ভালোবাসেন।”[42]
…وَلَا تَأۡخُذۡكُم بِهِمَا رَأۡفَةٞ فِي دِينِ ٱللَّهِ إِن كُنتُمۡ تُؤۡمِنُونَ بِٱللَّهِ وَٱلۡيَوۡمِ ٱلۡأٓخِرِۖ
“…যদি তোমরা আল্লাহর প্রতি ও পরকালের প্রতি বিশ্বাসী হয়ে থাকো, তবে আল্লাহর বিধান কার্যকরের ক্ষেত্রে তাদের প্রতি(ব্যভিচারী ও ব্যাভিচারিণী) প্রতি তোমাদের অন্তরে দয়ার উদ্রেক না হয়।”[43]
يَٰٓأَيُّهَا ٱلَّذِينَ ءَامَنُواْ كُونُواْ قَوَّٰمِينَ لِلَّهِ شُهَدَآءَ بِٱلۡقِسۡطِۖ وَلَا يَجۡرِمَنَّكُمۡ شَنَ*َٔانُ قَوۡمٍ عَلَىٰٓ أَلَّا تَعۡدِلُواْۚ ٱعۡدِلُواْ هُوَ أَقۡرَبُ لِلتَّقۡوَىٰۖ وَٱتَّقُواْ ٱللَّهَۚ إِنَّ ٱللَّهَ خَبِيرُۢ بِمَا تَعۡمَلُونَ
“হে মুমিনগণ!, তোমরা আল্লাহর জন্য ন্যায় সাক্ষ্যদানের ব্যাপারে অবিচল থেকো। কোনো সম্প্রদায়ের প্রতি শত্রুতার কারণে সুবিচার করা থেকে বিরত থেকো না। সুবিচার করো কেননা এটিই তাক্বওার অত্যধিক নিকটবর্তী। আর তোমরা আল্লাহকে ভয় করো, নিশ্চয় আল্লাহ্* তোমাদের কর্মের ব্যাপারে সর্বাধিক অবগত।”[44]
۞يَٰٓأَيُّهَا ٱلَّذِينَ ءَامَنُواْ كُونُواْ قَوَّٰمِينَ بِٱلۡقِسۡطِ شُهَدَآءَ لِلَّهِ وَلَوۡ عَلَىٰٓ أَنفُسِكُمۡ أَوِ ٱلۡوَٰلِدَيۡنِ وَٱلۡأَقۡرَبِينَۚ إِن يَكُنۡ غَنِيًّا أَوۡ فَقِيرٗا فَٱللَّهُ أَوۡلَىٰ بِهِمَاۖ فَلَا تَتَّبِعُواْ ٱلۡهَوَىٰٓ أَن تَعۡدِلُواْۚ و…
“হে ঈমানদারগণ তোমরা ন্যায়ের উপর প্রতিষ্ঠিত থেকো । আল্লাহর ওয়াস্তে ন্যায়সঙ্গত সাক্ষ্যদান কর, তাতে তোমাদের নিজের বা বাবা-মা বা নিকটবর্তী আত্মীয়-স্বজনের কারো ক্ষতি হয় তবুও। কেউ যদি ধনী বা দরিদ্র হয়, তবে (জেনে রাখো) আল্লাহ্* তাদের শুভাকাঙ্খী তোমাদের চাইতে বেশি। অতএব তোমরা বিচার করতে গিয়ে প্রবৃত্তির অনুসরণ করো না।…” [45]
জাস্টিস ও মাইনরিটি ল’ ও লিবারেলিজমঃতূলনামূলক পর্যালোচনা
ইতিহাস এ ব্যাপারে সাক্ষ্য দেয় যে, ইসলামী খিলাফাহর অধীনে থাকা সমাজব্যবস্থায় ইসলামের এসকল মূল্যবোধ কঠোরভাবে পালন করা হতো।
ইসলামের ইতিহাসে জেরুজালেম জয়ের পর হযরত উমার রাদিয়াল্লাহু আনহুর মহানুভব আচরণের ব্যাপারে আমরা সবাই জ্ঞাত।জেরুজালেমের বাইজান্টাইন খ্রিস্টানরা ইহুদিদের টেম্পল মাউন্ট ও ওয়েলিং ওয়াল নামক দুটো ধর্মচর্চাকেন্দ্র নিষিদ্ধ করেছিল। তিনি ইহুদিদের সেসব স্থানে ধর্ম চর্চার অনুমতি প্রদান করেন। পাশাপাশি তিনি খ্রিস্টানদেরকে ও নিরাপত্তা প্রদান করেন। খ্রিষ্টানরা জেরুজালেম দখল কয়রে ইহুদিদের বিতাড়িত করেছিল কিন্তু তিনি ইহুদিদেরকে সেখানে বসবাসের অনুমতি দান করেন। চুক্তিবদ্ধ অমুসলিমরা যদি চুক্তি মেনে চলে তবে চুক্তির শর্ত পালন করা খলিফা ও সমস্ত মুসলমানের উপর অর্পিত দায়িত্ব হিসেবে গণ্য হবে বলে তিনি ব্যক্ত করেন। [46]
উমাইয়া খিলাফতের অধীনে অনেক ইহুদিদেরকে যোগ্যতা অনুসারে রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়োগ দেয়া হয়েছিল। ইহুদিরা নির্ভয়ে ধর্ম পালন করতে পারতো। [47]লিবারেলিজম যেভাবে অন্যদেরকে নিজেদের আদর্শ গ্রহণে বাধ্য করে(যার প্রমাণ আমাদের সামনে সুস্পষ্ট), এমন কিছুই ইহুদি বা খ্রিস্টানদের সাথে করা হয়নি।
সুলতান সালাহউদ্দিন আইয়ুবীর জেরুজালেম বিজয়ের পূর্বে মুসলিমদের উপর যে নিপীড়ন চালানো হয়েছিল তা সম্পর্কে সকলেই জ্ঞাত। তিনি জেরুজালেম দখলের পর চল্লিশদিনের মধ্যে সকল খ্রিস্টানদেরকে মুক্তিপণের বিনিময়ে জেরুজালেম ত্যাগের নির্দেশ দান করেন। যারা এ আদেশ মানবে না বা মানতে পারবে না তাদেরকে বন্দী করা হবে বলে ঘোষণা দেন। কিন্তু তিনি জেরুজালেমের মূল ভূখণ্ডে প্রবেশের পর অসংখ্য দরিদ্র খ্রিস্টানকে জেরুজালেমে দেখতে পেলেন। এসকল খ্রিস্টানদের মধ্যে অনেক ক্রুসেডার ও ছিল। চুক্তি অনুযায়ী যেখানে তাদেরকে বন্দী করার কথা ,সেখানে তিনি অসহায় মায়েদের সন্তানদেরকে, স্ত্রীদের স্বামীদেরকে, মেয়েদের বাবাদেরকে ও বিকলাঙ্গ, বৃদ্ধ এবং শিশুদের বিনা মুক্তিপণে বসবাসের অনুমতি দান করেন। বহু দরিদ্র ক্রুসেডারদেরকে দেশে ফিরে যাওয়ার ব্যবস্থা করেন। যেহেতো তিনি রাজ্য জয় করেছিলেন ও শর্ত দিয়েছিলেন তাই এসবের কোনোটাই কুরতে তিনি বাধ্য ছিলেন না। কিন্তু ইসলামপ্রদত্ত দয়া ও সহমর্মিতার আদর্শের ধারক ও বাহক সালাহউদ্দিন এক্ষেত্রে উদারতা প্রদর্শন করেন।[48] অপরপক্ষে লিবারেল স্টেটের অন্যতম প্রতীক ব্রিটেন অন্যায়ভাবে এশিয়া ও আফ্রিকার যেসমস্ত দেশসমূহে সামরিক আগ্রাসন চালিয়েছিল, ফ্র্যান্স ও আমেরিকা যেসব অঞ্চলে অন্যায়ভাবে সামরিক আগ্রাসন চালিয়েছে ও এখনও জারি রেখেছে সেগুলো তো কোনোভাবেই মুসলিমদের রাজ্যবিজয়ের সাথে তুলনাযোগ্য নয় ই, কেননা তাদের সামরিক, বুদ্ধিবৃত্তিক ও সাংস্কৃতিক সর্বপ্রকার আগ্রাসন ই অন্যায্য ও অন্যায়। কিন্তু দুটো সিস্টেমের তুলনামূলক পর্যালোচনার খাতিরে একথা উল্লেখ করা জরুরী যে, তারা তাদের তৎপরতা চালানো অঞ্চলগুলোর মাত্র একটির জনগণের প্রতি ও কখনো বিন্দুমাত্র সহমর্মিতা ও দয়া প্রদর্শন করেনি।
উসমানী খিলাফাহর অধীনে থাকা অমুসলিমদের অবস্থা প্রসঙ্গে অনেক মিথ্যাচার করা হয়। আমাদের প্রবন্ধটি ইতিহাস পর্যালোচনার জন্য নয়। বরং, লিবারেজিমের আগ্রাসন, এর অসারতা ও অগ্রহণযোগ্যতা প্রমাণের প্রচেষ্টা করা ই এর মূল লক্ষ্য। তাই আলোচনার ধারাবাহিকতা রক্ষার্থে, উসমানী খিলাফাহর অধীনে থাকা ইহুদিদের ব্যাপারে ইহুদি ঐতিহাসিক এমনন কোহেনের গবেষণার কথা বলা যায়। তিনি জেরুজালেমের সিজিল(শরীয়াহ কোর্ট) আর্কাইভে ষোড়শ শতাব্দির কিছু ডকুমেন্ট পান। সেসব ডকুমেন্ট নিয়ে গবেষণার পর তিনি নিজেই বলেছেন যে, জেরুজালেমে ইহুদিদের নিজস্ব আলাদা আদালত থাকা সত্ত্বেও বেশিরভাগ ইহুদি ইসলামী আদালতের শরণাপন্ন হতো। তাদের এরূপ কর্মকাণ্ডের পিছনে বহুবিদ কারণ থাকতে পারে। তবে এ থেকে বুঝা যায় যে, তারা ইসলামী শরিয়াহভিত্তিক আদালতে সুবিচার পাওয়ার ব্যাপারে তুলনামূলক অধিক নিশ্চিত ছিলো। এমনন কোহেন আরও বলেন যে, যদিও তাদের জানমালের নিরাপত্তার জন্য মুসলিম কর্তৃপক্ষের কাছে তাদেরকে জিজিয়া দিতে হতো, কিন্তু সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, তাদের অধিকার সংরক্ষিত ছিল। তাদের নিজেদের সংরক্ষিত কাগজপত্র তাদের সম্মান ও অধিকার রক্ষিত থাকার দিকে ই ইঙ্গিত করে। বিচারের বেলায় তাদেরকে অমুসলিম হওয়ার কারণে জুলুম করা হয়নি। বরং এক্ষেত্রে তারা মুসলিমদের ন্যায় সমান অধিকার ভোগ করতো। ইহুদিদের জন্য স্বতন্ত্র আদালতের ব্যবস্থা ছিল যাতে তারা মিজেদের আইনে বিচারকার্য সমাপদন করতে পারে। তবে যদি তারা ইসলামী আইনের অধীনে সুবিচার কামনা করে, এক্ষেত্রে তাদেরকে কোনোভাবেই নিরাশ করা হতো না। একারণে তারা তূলনামূলকভাবে ইসলামী আদালতে বেশি শরণাপন্ন হতো। ইহুদি মহিলাদেরকে ইসলামী আইন অনুসারে পুরুষের অর্ধেক সম্পদলাভের ব্যবস্থা ও মুসলিম আদালত কর্তৃক করা হয়। সর্বোপরি উসমানী খিলাফাহতে, শরীয়াহ আইনের অধীনে তারা সর্বোচ্চ সম্মান ও নিরাপত্তার সাথে বসবাস করার ব্যাপারে তিনি নিশ্চয়তা প্রদান করেন। [49]
কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর রিচার্ড ডব্লিউ বুলেটের মতে, ইসলামি শাসনব্যবস্থায় ধর্ম-বর্ণ, পদমর্যাদা নির্বিশেষে ইনসাফ প্রতিষ্ঠা করা হতো। ইহুদি ও নাসারাদের নিজস্ব ধর্মীয় কর্তৃপক্ষের কাছে বিচারের জন্য যাওয়ার অনুমতি ছিল। এতদসত্ত্বেও তারা অনেকক্ষেত্রে মুসলিমদের আদালতের শরণাপন্ন হতো।[50]
ফিলিপ মাসেল তার “Constantinople” গ্রন্থে এক রাব্বির বক্তব্য উদ্ধৃত করেছেন,
“Here in the land of the Turks we have nothing to complain of. We possesses great fortunes; much gold and silver are in our hands. We are not oppressed with heavy taxes and our commerce is free and unhindered…”[51]
স্পেনের ইসলামি ইমারাহর অধীনে ইহুদিদের জীবনযাপন প্রসঙ্গে এক ইহুদি ঐতিহাসিক হেনরিচ গ্রেজের(Henrich Graetz) বক্তব্যের সারাংশ হলো, মুসলিম শাসনের অধীনে ইহুদিরা অন্যান্য ধর্মের সম-অধিকার লাভ করে। তাদের প্রতি উদারতা প্রদর্শন করা হয়। তারা বহুকাল যাবত ধর্মীয় অধিকার থেকে বঞ্চিত ছিল। অবশেষে মুসলিম শাসকদের অধীনে তারা তাদের ধর্মীয় স্বাধীনতা লাভ করে। খ্রিস্টানদের মতো তারাও মুসলিমদেরকে জিজিয়া প্রদান করতো।”[52]
মুসলিম স্পেনের ইতিহাস নিয়ে যারা কাজ করেছেন তাদের একজন Reinhart Dozy, স্পেনের ইমারাহর শাসনাধীনে থাকা অমুসলিমদের অবস্থা বর্ণনা করতে গিয়ে তিনি বলেছেন,আরবরা(মুসলিমরা) সীমাহীন সহনশীলতা প্রদর্শন করেছে। ধর্মীয় ব্যাপারে তারা কখনো কাউকে জোরজবরদস্তি করেনি।[53]
স্পেনের ইতিহাস বিশেষজ্ঞ আরেকজন ঐতিহাসিক Ulick R Burke ও একই কথা বলেছেন : “স্পেনের মুসলিমদের দ্বারা খ্রিষ্টানরা কোনোভাবে অত্যাচারিত হয়নি। স্পেনীয় আরবরা খ্রিস্টানদের প্রতি যথাযথ উদারতা ও সহনশীলতা প্রদর্শনের পাশাপাশি কিছুক্ষেত্রে সমানাধিকার ও প্রদান করেছিল।”[54]
অপরদিকে লিবারেলিজমের ধারক বাহকদের সামরিক আগ্রাসনের ব্যাপারে আমরা সবাই অবগত। তাই এ ব্যাপারে আলোচনা করে মূল আলোচনাকে আমি দীর্ঘ করতে চাই না। তারা যে কখনোই সংখ্যালঘু ও নিপীড়িত সম্প্রদায়ের অধিকার রক্ষা করে না তা দিনের আলোর ন্যায় স্পষ্ট। ব্রিটেনের সামরিক উপনিবেশ, আফ্রিকায় ফ্রান্সের সামরিক আগ্রাসন, আমেরিকার রেড ইন্ডিয়ানদের হত্যা ও আফ্রিকানদের প্রতি অত্যাচার, দাসব্যবসা, এখনও অবধি আফ্রো-আমেরিকানদের প্রতি অবিচার, লিয়ারেল স্টেটগুলোতে মুসলিম নারীদের অসম্মান করা, কোথাও নিকাব কোথাও বা হিজাব অবধি নিষিদ্ধ করে দেয়া তাদের আদর্শের অসারতা প্রমাণ করে।
তাছাড়া চার্লস টেইলরের বক্তব্য ও লিবারেলিজমের অধীনে সংখ্যালঘুদের অধিকার প্রতিষ্ঠিত না হওয়ার দিকেই ইঙ্গিত কয়রে। তার মতে, লিবারেলিজম ভিন্ন ভিন্ন সংস্কৃতির মানুষকে স্থান দিতে সক্ষম নয়। কেননা ব্যক্তির সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য তাকে চিহ্নিত করণে যে ভূমিকা রাখে তা লিবারেলিজমে এর নিজস্ব মূল্যবোধের কারণে অনুপস্থিত। ফলে ভিন্ন সংস্কৃতির কোনো ব্যক্তি তার নিজস্ব সংস্কৃতি ও পদমর্যাদার কারণে লিবারেলিজমের অধীনে যথাযথ মর্যাদা ও সম্মান লাভ করে না।[55]
এ প্রবন্ধের প্রারম্ভে লিবারেলিজমের ধারক-বাহকদের এজেন্ডার ব্যাপারে বলা হয়েছিল। তারা নন-লিবারেল দেশগুলোতে লিবারেল আদর্শের বাস্তবায়নের স্বপ্ন দেখে। অপরদিকে ইসলাম অমুসলিমদের ধর্মীয় স্বাধীনতা প্রদান করেছে। কোরআনে স্পষ্ট বলা হয়েছে, “
لَآ إِكۡرَاهَ فِي ٱلدِّينِۖ قَد تَّبَيَّنَ ٱلرُّشۡدُ مِنَ ٱلۡغَيِّۚ
“ধর্ম নিয়ে কোনো জবরদস্তি নেই। নিশ্চয় সত্য পথ ভ্রান্ত পথ থেকে পৃথক হয়ে গিয়েছে…।”[56]
এ থেকে প্রমাণিত হয় যে, সংখ্যালঘু ও নিপীড়িতদের অধিকার সংরক্ষণে লিবারেলিজমের বিপরীতে ইসলাম বহুগুণ উত্তম ব্যবস্থা। তাই মুসলিমদের চেয়েও অমুসলিমদের নিজেদের স্বার্থে লিবারেলিজমের বদলে ইসলামী শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার দাবী উত্থাপন ও এ লক্ষ্যে বিভিন্ন কার্যক্রমে সক্রিয় ভূমিকা রাখা উচিৎ।
সিস্টেম প্রত্যাখ্যান করে আইন গ্রহণ
এ আপত্তিটা হয়তো উত্থাপিত হবে যে, এরূপ মূল্যবোধ ও নীতিমালা লিবারেল সিস্টেমের আওতাতে এনেও তো প্রতিষ্ঠিত করা সম্ভব। বাস্তবে তা সম্ভব না। কারণ কেবলমাত্র মূল্যবোধের ভিত্তিতে সমাজব্যবস্থা ঠিকে থাকে না। মূল্যবোধের পাশাপাশি সঠিক মডেল ও জরুরী। এ মূল্যবোধগুলোকে লিবারেল সিস্টেমের আওতায় আনা হলেও তা সফলতার মুখ দেখতে পাবে না, কেননা লিবারেল সিস্টেমের ভিত্তি যেসব মূলনীতির উপর প্রতিষ্ঠিত তা এক্ষেত্রে বাধা প্রদান করবে। লিবারেল সিস্টেম স্বাভাবিকভাবে ই ব্যক্তিস্বাতন্ত্রবাদকে প্রচার করে এবং দিনশেষে সবকিছুকে ব্যক্তিস্বাতন্ত্রবাদের দৃষ্টিভঙ্গিতেই দেকে। ফলে যদিও এধরণের মূল্যবোধগুলো প্রচারের প্রচেষ্টা করা হয়(যা আসলেই হয়ে থাকে), এরপরেও ব্যক্তিস্বাধীনতা বাধাগ্রস্থ হওয়ার অজুহাতে সেসব প্রচেষ্টা বাধাগ্রস্থ হয়। অর্থাৎ, ইসলামি মূল্যবোধ ও জাস্টিস সিস্টেম প্রতিষ্ঠিত করতে চাইলে সমাজে লিবারেল শাসনব্যবস্থা নয় বরং ইসলামী শাসনব্যবস্থা থাকাটা জরুরী।
উদাহরণস্বরূপ সম্পদের বণ্টন ও বিচার ব্যবস্থার কথা বলা যায়। লিবারেল সিস্টেমে সম্পদের বণ্টনের ক্ষেত্রে যে পদ্ধতির অনুসরণ করা হয়, তা হলো বিভিন্ন সংগঠন বিভিন্নভাবে অর্থ সঙ্গগ্রহ করে। কিন্তু এক্ষেত্রে লিবারেল ব্যবস্থার অধীনে ব্যক্তি এ কাজে অংশ নেয়ার ও না নেয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণের স্বাধীনতা লাভ করে। অপরদিকে ইসলামি শাসনব্যবস্থায় সম্পদের সুষ্ঠু বন্টন একটি আবশ্যিক বিষয়। এটিকে ইসলামি অর্থনীতিতে মৌলিক গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব হিসেবে দেখা হয়ে থাকে।
অর্থাৎ একই বিষয়ে সম্পূর্ণ ভিন্ন ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি সমাজে ঐ বিষয়টি প্রতিষ্ঠায় বাধা সৃষ্টি করে। এ থেকে আরো উপলদ্ধি করা যায় যে, লিবারেলিজম রাষ্ট্রের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারকেও ব্যক্তিস্বাতন্ত্রবাদের দৃষ্টিকোণ হতে দেখে।
ফিলিপ মাসেল কর্তৃক লিখিত গ্রন্থ “Constantinople” এ ইসলামে সম্পদের বণ্টন প্রসঙ্গে এক রাব্বির বক্তব্য উদ্ধৃত করা হয়েছেঃ
“Rich are the fruits of the earth. Everything is cheap and everyone of us lives in peace and freedom…”[57]
ইসলামি বিচার ব্যবস্থা ও লিবারেল সিস্টেমঃ তূলনামূলক পর্যালোচনা--
(পুরো অংশ জায়গা সংকীর্ণতার কারণে এখানে দেওয়া সম্ভব হলোনা। বাকি অংশসহ পুরোটা এই লিংক থেকে পড়ুন ইনশা আল্লাহ। পুরো লেখাটায় ৭০ হাজারের বেশি অক্ষর রয়েছে।
https://justpaste.it/7plws )
প্রাক ঔপনিবেশিক আমলের কথা বাদ দিই। ঔপনিবেশিক শাসনের সময়, এমনকি দেশ ভাগের অনেক পরেও সমাজে গরীবের সংখ্যা বর্তমানের তুলনায় বেশি থাকলেও বর্তমানের মতো ‘সরকারি চাকুরিজীবি/বিসিএস ক্যাডার স্বামী চাই ই চাই’ ও ‘জিপিএ ফাইভ’ ট্রেন্ড ছিলো না। সমাজে টাকা ও কাগুজে শিক্ষা সনদের অসুস্থ প্রতিযোগীতা ছিল না। প্রত্যেক বছর মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার ফলাফলের দিন শিক্ষার্থীদের আত্মহত্যার কোনো অস্তিত্বও ছিল না। সমাজে অনেক কুসংস্কার বিদ্যমান থাকলেও বর্তমানের তুলনায় বস্তুবাদী জীবনের তাড়না তাদের মধ্যে একপ্রকার ছিল না বলা চলে।
সেকালে উপমহাদেশীয় সমাজে নারী-পুরুষের অবাধ মেলামেশা অনৈতিক ও অন্যায় বলে গণ্য হতো। নারী-পুরুষের মেলামেশার কথা যদি বলি, আমাদের বাবা-মায়েরা যখন তরুণ ছিলেন, তখনও এ অবস্থার খুবেকটা পরিবর্তন হয়নি। অথচ এখন আমাদের সমাজের এক বিরাট অংশ এব্যাপারে নিজেদের দৃষ্টিভঙ্গি নিজের অজান্তে ই পালটে ফেলেছে।
গত পনের-বিশ বছর আগেও সমকামিতাকে ঘৃণার চোখে দেখা হতো। কিন্তু এখন সমাজের একটি অংশ এ কাজকে স্বাভাবিক মনে করতে শুরু করেছে। আর কয়েক দশক পর হয়তো বেশিরভাগ মানুষ ই সমকামিতাকে স্বাভাবিক মনে করবে। এ ধারণাকে ভুল ধারণা মনে করার কোনো কারণ নেই। পশ্চিমা সমাজে একসময় সমকামিতাকে স্বাভাবিক বিষয় হিসেবে দেখা হতো না। পরবর্তিতে ধীরে ধীরে সমকামিতাকে পশ্চিমা সমাজে তাদের নৈতিক ও আইনগত উভয় দিক থেকে স্বাভাবিক করা হয়েছে।
১৯০ বছরের ঔপনিবেশিক শাসনের অধীনে থাকার অর্থ হলো প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে একটি গোষ্ঠির দাসত্বে থাকা। সাদাদের দাসত্ব উপমহাদেশীয়দের উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত স্বভাব। এর ই ফলশ্রুতি হিসেবে পশ্চিমা সাদাদের জীবনযাপনের চাকচিক্য দেখে আমরা তাদেরকে সুখী হিসেবে ধরে নিয়েছি। আমাদের রব আমাদেরকে বলেছেন, “নগরীতে কাফিরদের চালচলন চাকচিক্য যেন তোমাদের প্রতারিত না করে,এতো সামান্য ফায়দা,এরপর তাদের ঠিকানা হবে দোযখ।আর সেটি অতি নিকৃষ্ট অবস্থান।”[1] তবুও সুখী হওয়ার লক্ষ্যে তাদের অনুসরণের সিদ্ধান্ত নিয়েছি। অতি আধুনিক হতে গিয়ে শালীনতাবোধ ধীরে ধীরে ত্যাগ করেছি। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা ও গণমাধ্যমের কল্যাণে পশ্চিমা সমাজ থেকে নারী মুক্তির নামে নারীর বেহায়াপনা, নির্লজ্জ্বপনাকে গ্রহণ করেছি। পশ্চিমা সমাজ শিখিয়েছে লম্বা পোশাকে মুক্তি মিলবে না। আমরা দাস-দাসী হিসেবে তা নিজের অজান্তে ‘জ্বি হুজুর’ বলে মেনে নিয়েছি। আমাদের রবের দাসত্বে আমাদের প্রচুর সমস্যা। কিন্তু সাদাদের দাসত্বে কোনো সমস্যা নেই। স্রস্টার দাসত্ব আমাদের প্রবৃত্তিকে আঘাত করে। কিন্তু আমাদের মতোই কিছু মানুষ, যাদের গায়ের চামড়া সাদা, তাদের দাসত্ব করলে আমাদের প্রবৃত্তি আঘাতপ্রাপ্ত হয় না। তারা যা বলে এবং যা দেখায়, তাই আমরা আধুনিকতা ভেবে ,সফলতার মাধ্যম ভেবে গ্রহণ করে নেই। যদিও তাতে আমাদের রবের আনুগত্য থেকে সরে আসা হয় তবুও! একে দাসত্ব না বলে আর কিই বা বলা যেতে পারে?
আধুনিক ও সুখী হওয়ার লক্ষ্যে সমাজব্যবস্থা তথা পরিবার ব্যবস্থা ভেঙ্গে দেয়ার যত পদ্ধতি আছে তা আমরা ধীরে ধীরে আমাদের সমাজে গ্রহণ করে নিয়েছি। স্বামী-স্ত্রীর সুন্দর সম্পর্ককে ওদের চোখে দেখা শুরু করেছি। পুঁজিবাদী অর্থনীতিতে দুজন শিল্পপতির মধ্যে সম্পদ অর্জনের যে প্রতিযোগীতার সম্পর্ক থাকে, আমরা আমাদের সম্পর্কগুলোকে ঠিক তেমনভাবে দেখা শুরু করেছি। সমকামিতাকে আমাদের সমাজের একটি অংশ গ্রহণ করে নিয়েছে ও অন্যদের মাঝেও এটিকে স্বাভাবিক করার প্রক্রিয়া তারা জারি রেখেছে। পশ্চিমা সমাজ শিশুকামিতাকে স্বাভাবিক বলা শুরু করেছে।[2] সামনে একই স্লোগান আমাদের দেশেও চালু হবে। পশ্চিমা সমাজ বিশ্বের সামনে অর্থকে সুখের মানদণ্ড হিসেবে দেখিয়েছে আর আমরা তা বাস্তব সত্য বলে মেনে নিয়েছি। যেভাবে প্রাচীন যুগে উপমহাদেশে বৌদ্ধ ও রামকে অবিনশ্বর সত্য বলে বিশ্বাস করা হতো, ঠিক সেভাবেই নিজেদের অজান্তে আমরা পশ্চিমা বিশ্বাস ও আদর্শকে গ্রহণ করেছি ও করছি। ইসলাম আমাদেরকে যে মানদণ্ড নির্ধারণ করে দিয়েছে সেটি বাদ দিয়ে আমরা পশ্চিমাদের দেখানো বস্তুবাদী ও পুঁজিবাদী ব্যবস্থাকে গ্রহণ করে নিয়েছি। ফলতঃ আমাদের বাবা-মায়েরা আমাদেরকে ইসলামী মানদণ্ড মেনে মানুষ করানো অপেক্ষা অর্থ উপার্জনের মেশিন বানানোর লক্ষ্যে কাজ করতে অধিক আগ্রহী। যার ফলাফল হিসেবে অসুস্থ বিসিএস ও জিপিএ ফাইভ প্রতিযোগীতা এবং সন্তানের উপর পড়াশুনার চাপ বৃদ্ধিসহ নানাবিধ সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে।
আমাদের সমাজে ধর্মত্যাগীর সংখ্যা ছিল একেবারেই নগণ্য। অথচ আজ চারিদিক থেকে ধর্মত্যাগীদের সংখ্যা ধীরে ধীরে বেড়ে চলেছে। আবার অনেকে বাহ্যিকভাবে মুসলিম থাকা সত্ত্বেও নিজেদের অজান্তে ইসলামের গণ্ডী থেকে বেরিয়ে গিয়েছে এবং যাচ্ছে।
দ্বিতীয় শ্রেণির তরুণদের সংখ্যা এত বেশি যা কল্পনায় আনাও অসম্ভব। কেবল ধর্মকর্ম না মানা মানুষই নয়, বরং সালাত আদায় করে, সাওম পালন করে তথা ইসলামের কিছু আনুষ্ঠানিক নিয়ম-কানুন মেনেও অনেকে ইসলামের গণ্ডী থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে। অনেকে আবার মুসলিম হয়েও পর্ণ দেখছে, হারাম সম্পর্কে লিপ্ত হচ্ছে বা নারীদের উত্তক্ত করছে। এরূপ পরিস্থিতিতে থেকে সুষ্ঠুভাবে দ্বীন মেনে চলা অত্যন্ত কষ্টকর বিধায় এসমস্ত ব্যক্তিবর্গের আচরণ ও কর্মকাণ্ড দ্বীন মেনে চলা মুসলিমদের জীবনযাত্রাকে নানাভাবে প্রভাবিত করছে। মানুষ সামাজিক জীব। ফলতঃ একজনের কাজ অন্যকে প্রভাবিত করা স্বাভাবিক। সমাজের একটি শ্রেণীর সমস্যার সাথে অন্য শ্রেণির সমস্যা ওতপ্রোতভাবে জড়িত।
যদি আমাদেরকে প্রশ্ন করা হয় , ‘এ মুহুর্তে যুবক সমাজের অধিকাংশের প্রধান সমস্যা কী?’
অনেকেই উত্তরে বলবেন সঠিক সময়ে বিয়ে করতে না পারা, কেউ কেউ বলবেন দ্বীন পালনে সমস্যা, কেউ বলবেন হারাম সম্পর্ক থেকে বেরিয়ে আসতে না পারা, কেউ কেউ বলবেন পর্ণ আসক্তি, কেউ কেউ হয়তো বলবেন মাদকাসক্তি, কেউ বলবেন ডিপ্রেশন, আবার কেউ কেউ হয়তো বলবেন বাবা-মায়েদের ও সমাজের বস্তুবাদী ও পুঁজিবাদী মানসিকতা, অল্প সংখ্যক ভাই-বোনেরা হয়তো বলবেন ধর্মত্যাগ করা। এ সমস্যার তালিকাটা বেশ দীর্ঘ।
এ সমস্যাগুলো অবশ্যই মুসলিম সমাজে বিদ্যমান। কিছু সমস্যার মধ্যে আন্তঃসম্পর্ক ওঃ রয়েছে। কিন্তু এগুলো মৌলিক সমস্যা নয়। আপনি যতদিন গাছের গোঁড়ায় আঘাত করার বদলে গাছের ডালপালা কাটার চেষ্টা চালিয়ে যাবেন, ততদিন আপনার পরিশ্রম পণ্ডশ্রম ব্যতীত কিছু ই হবে না। গাছের সব ডালপালা ও যদি আপনি কেটে ফেলেন, নতুন ডালপালা ঠিক ই গজাবে। তাই গাছ কেটে ফেলাটা খুব জরুরী। আর এজন্য সে গাছটিকে চেনা জরুরী। আপনি যদি না ই জানেন কোন গাছ, কেমন গাছ , তবে আপনি কীভাবে কাটবেন তাও ঠিক করতে পারবেন না। উপরোক্ত সমস্যাগুলোসহ এরূপ নানাবিধ অপরাধ সংঘটনের পিছনে মৌলিক যে বিষয়টি কাজ করে তা হলো, আল্লাহ্* সুবহানাহু ওয়া তা’আলার দাসত্বের বদলে নিজের নফসের(প্রবৃত্তির) দাসত্ব করা। নিজের যা ভালো লাগে তা করা ও নিজের যা ইচ্ছা করে না তা না করা। নিজের আক্বলকে ওয়াহীর(আল্লাহর বাণী/বিধান) উপর প্রাধান্য দেওয়া, যদিও তা আল্লাহর বিধান অস্বীকার করা বা পালন না করা হয়ে থাকে। নিজের নফস যাতে আনন্দ পায় সেটিকে সঠিক ও নফস যাতে আনন্দ পায় না কিংবা কষ্ট পায় তা নৈতিকতার মানদণ্ডে ভুল মনে করা।[3] অর্থাৎ এটি সম্পূর্ণ ভিন্ন একটি সিস্টেম। ভিন্ন জীবনব্যবস্থা তথা ভিন্ন ধর্ম। যে ধর্মে নিজের নফসকে আল্লাহ্*র ইচ্ছের উপর প্রাধান্য দেওয়া হয়। যে ধর্মে নিজের ইচ্ছে তথা নফসের ইচ্ছেকে প্রাধান্য দেওয়া হয় এবং অনিচ্ছেকে বাদ দেওয়া হয়। এককথায় বলতে গেলে নফসপূজো কিংবা প্রবৃত্তির দাসত্ব।
পশ্চিমা পরিভাষায় এটিকে বলা হয় Liberalism.
এ প্রবন্ধে লিবারেলিজমের স্বরূপ ও অসারতা আলোচনাপূর্বক এটি কীভাবে আধুনিক সমস্ত সমস্যার মূলে রয়েছে তা ব্যাখ্যা করা হবে। লিবারেলিজমের সাথে ইসলামি আইনের তূলনামূলক পর্যালচনাপূর্বক “ইসলাম লিবারেলিজম অপেক্ষা উত্তম ব্যবস্থা”-তা প্রমাণ করা হবে। পাশাপাশি লিবারেলিজমে প্রভাবিত মুসলিমদের কিছু যুক্তি ইসলামি দৃষ্টিকোণ হতে খণ্ডন করা হবে। পরিশেষে লিবারেলিজমের আঘাত থেকে আমাদের সমাজকে রক্ষা করতে কী কী পদক্ষেপ নেওয়া যায় তা নিয়ে সংক্ষিপ্ত আলাপ করা হবে, ইনশাআল্লাহ্*।
লিবারেলিজম
একজন মানুষ যেমন একই সময়ে হিন্দু ধর্ম ও ইসলাম ধর্মকে আকড়ে ধরতে পারে না, তেমনি একজন মানুষ একই সময়ে ইসলাম ধর্মের অনুসারী হয়ে লিবারেলিজমকে গ্রহণ করতে পারে না। একই সময়ে দুটো জীবনব্যবস্থা তথা দুটো দ্বীনের প্রতি বিশ্বাস রাখা ও সৎ হওয়া কখনোই এক আত্মার পক্ষে সম্ভব নয়, কিছুতেই নয়।
আল্লাহ্* সুবহানাহু ওয়া তা’আলা কোর’আনে এ প্রসঙ্গে বলেছেন,
ضَرَبَ ٱللَّهُ مَثَلٗا رَّجُلٗا فِيهِ شُرَكَآءُ مُتَشَٰكِسُونَ وَرَجُلٗا سَلَمٗا لِّرَجُلٍ هَلۡ يَسۡتَوِيَانِ مَثَلًاۚ ٱلۡحَمۡدُ لِلَّهِۚ بَلۡ أَكۡثَرُهُمۡ لَا يَعۡلَمُونَ
“আল্লাহ্* তা’আলা এক দৃষ্টান্ত বর্ণনা করেন। এক ব্যক্তির পরস্পরবিরোধী কয়েকজন মালিক আছে। আরেক ব্যক্তির মালিক মাত্র একজন। তাদের উভয়ের অবস্থা কি সমান? সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর। কিন্তু তাদের অধিকাংশই জানে না।” [4]
একসময় কালামী ভ্রান্ত দলগুলোর ব্যাপারে জানা ও সতর্ক থাকাকে যেভাবে গুরুত্ব দেয়া হতো, বর্তমানে লিবারেলিজম সম্বন্ধে জ্ঞানার্জনকে সেভাবেই গুরুত্ব দেয়া উচিৎ। কেননা লিবারেলিজম বর্তমান বিশ্বের প্রায় সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েছে। অথচ এটি কোনো সমাজের প্রত্যাশিত ব্যবস্থা হতে পারে না। লিবারেলিজম মুখে বলে সমাজে বাস্তবায়নের চেষ্টা চালানো হোক বা বলা ব্যতীতই লিবারেলিজমের আদর্শিক বাস্তবায়নের প্রচেষ্টা করা হোক দুটোই অগ্রহণযোগ্য। কেন? তা জানতে লিবারেলিজমের ব্যাপারে সংক্ষেপে তাত্ত্বিকভাবে জানাটা জরুরী।
লিবারেলিজম মূলত একটি রাজনৈতিক ও নৈতিক দর্শন। এটি এমন একটি মতবাদ, যে মতবাদে জাতিসংঘ কর্তৃক নির্ধারিত ৩০টি মানবাধিকার সংক্রান্ত প্রবন্ধকে সেভাবে বিশ্বাস করা হয় যেভাবে মুসলিমরা কোরআনকে আল্লাহ তাআলার কিতাব হিসেবে বিশ্বাস করে, হিন্দুরা রামের প্রতি ও প্রাচীন যুগের মানুষেরা তাদের দেবতাদের প্রতি বিশ্বাস করতো। Liberal Project এর অন্যতম মূল উদ্দেশ্য হলো, যে সমস্ত জাতি এ দর্শনকে গ্রহণ করেনি তাদের উপর মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার নামে এ দর্শনের আদর্শ ও বিশ্বাসকে চাপিয়ে দেওয়া।[5]
এ প্রসঙ্গে ইমেরিটাস অধ্যাপক জন কার্ভেট তার “The Liberal Project And Human Rights” বলেছেন, “…Liberal states must recognize that the liberal project for world order is unavoidably a long term one, which they need to persue with patience and persistence and not to be seduced by tempting short cuts….”
Liberalism এর সংজ্ঞায়ন করতে গিয়ে তিনি বলেছেন, “Liberalism in both theory and practice is concerned to promote social outcomes that are, as far as possible, the result of free individual choices. However, the choice of one person that does not respect the equal freedom and rights of others is invalid…The principle of equal liberty promotes social outcomes that are, as far as possible, the result of individual choice under circumstances in which all individuals can respect each other as equals. This principle makes no sense without the supporting belief that every normal adult human being has the capacity to decide for herself how she can best live her life and ought to have the right so to decide without being subject to the coercive authority of others.”[6]
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, জন লককে Liberalism এর জনক বলা হয়ে থাকে। জন লকের পর জেরেমি ব্যান্টন লিবারেলিজমে নৈতিকতার মানদণ্ডকে নতুনভাবে সংজ্ঞায়িত করেন। তিনি হেডোনিস্টিক দর্শন দ্বারা প্রভাবিত ছিলেন। তার মতে, মানুষ যা কিছু করতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে তা নৈতিকভাবে সঠিক ও এর বিপরীত হলে তা নৈতিকতার মানদণ্ডে ভুল।[7] জন স্টুয়ার্ট মিল ব্যান্টমের এই “Pleasure and Pain” তত্ত্ব দ্বারা বেশ ভালোভাবেই প্রভাবিত ছিলেন। ব্যান্টমের তত্ত্বের প্রভাব মিলের Harm Principle এ বেশ ভালোভাবেই প্রকাশ পেয়েছে। এছাড়া মিল লকের চিন্তাকে নতুনত্ব দান করেন। বিংশ শতাব্দিতে জন রলসের মতো দার্শনিকগণ এ দর্শনকে শক্তিশালী করতে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখেন। এ প্রবন্ধে এ দর্শন নিয়ে খুব বেশি একাডেমিক আলাপ করতে চাই না। বরং আমাদের মৌলিক সমস্যা হিসেবে Liberalism কে বুঝতে ও এ দর্শন কেন মানবজাতির জন্য কল্যাণকর কিছু নয় সে ব্যাপারে আলাপ করতে গিয়ে যতটুকু একাডেমিক আলাপ দরকার ততটুকু ই করবো।
Liberalism এমন একটি দর্শন যেটির অস্তিত্ব মূলত ব্যক্তিস্বাতন্ত্রবাদের ভিত্তিতে নির্ধারিত হয়েছে। জন গ্রে Liberalism এর ভিত্তি হিসেবে ব্যক্তিস্বাতন্ত্রবাদ, Universalism, Meliorism ও Egalitarianism-কে চিহ্নিত করেছেন। ব্যক্তিস্বাতন্ত্রবাদ হলো ব্যক্তির নৈতিক দৃষ্টিভঙ্গিকে সমাজের সামগ্রিক মূল্যবোধ ও কল্যাণের উপর প্রাধান্য দেওয়া তথা ব্যক্তিকে ই নিজের ভালো মন্দ ঠিক করার মাপকাঠি হিসেবে নির্ধারণ করা।[8]
অর্থাৎ লিবারেলিজম এমন এক আদর্শের কথা বলে,যে আদর্শের মূল লক্ষ্য হলো সামাজিক মূল্যবোধ ,নিয়মকানুন ও সামগ্রিক কল্যাণের উর্ধ্বে উঠে ব্যক্তিগত অধিকার সংরক্ষণ ও ব্যক্তিস্বাধীনতা বৃদ্ধিকরণ তথা ব্যক্তিস্বাতন্ত্রবাদ।
এখন প্রশ্ন হলো, ব্যক্তিস্বাতন্ত্রবাদ কি যৌক্তিক কোনো মতবাদ? যদি হয়ে থাকে তবে কিভাবে? আর যদি না ই হয় তবে Liberalism এর অস্তিত্বকে মেনে নেওয়ার কোনো যৌক্তিক কারণ নেই।
এপিস্টমলজিক্যাল আর্গুমেন্ট এগেইন্সট লিবারেলিজম
লিবারেলিজম ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদকে বিশেষভাবে গুরুত্ব দেয়। জাতিসংঘের মানবাধিকারের ধারাগুলো ব্যতীত এ দর্শনের বিশেষ কোনো ভিত্তি নেই । এখন এ প্রশ্ন উত্থাপন করা যেতে ই পারে, জাতিসংঘ মানবাধিকারের যে ধারাগুলো তৈরি করেছে সেগুলোর মানদণ্ড কী? এগুলো ই যে মানুষের অধিকার সংরক্ষণ করতে পারবে ও অন্য কোনো নীতিতে তা সম্ভব নয় তার ই বা প্রমাণ কী? লিবারেলিজম যে ব্যক্তিস্বাধীনতার কথা বলে সে ব্যক্তিস্বাধীনতার সংজ্ঞা কী? ব্যক্তিস্বাধীনতার সংজ্ঞা যে সত্য তা কীভাবে প্রমাণ করা সম্ভব? ব্যক্তিস্বাধীনতা যে একটি ভালো জিনিস তা লিবারেলরা কিভাবে প্রমাণ করবে?[9] পাশাপাশি অন্যদেরকে,বিশেষত মুসলিমদেরকে কেন লিবারেলিজমে বিশ্বাস করতে হবে? যদি বিশ্বাস করতে বাধ্য না হয়, তবে কেন অনেকক্ষেত্রে মুসলিমরা তাদের ধর্মীয় মতপ্রকাশে বাধাপ্রাপ্ত হয়? তাছাড়া যদি বিশ্বাস করতে বাধ্য না হয়, তবে কেন জন কার্ভেট তার বইয়ে নন-লিবারেলদের,বিশেষত মুসলিমদেরকে লিবারেলেক রুপান্তর করার কথা বলেছেন?
প্রথম প্রশ্নের উত্তরে বেশিরভাগ মানুষ জন স্টুয়ার্ট মিলের Harm Principle নিয়ে আসে। হিউমেন রাইটস ও লিবারেলিজমের কথা বলে। অন্তত তারা যা বলে, সে বক্তব্যের মূলনীতিগুলো মিলের এই তত্ত্বের মূলনীতির সাথে প্রায় মিলে যায়। অথচ এমনও হওয়া সম্ভব যে, তাদের অনেকে কখনো মিলের নাম ই শুনেনি। এখন কারো মনে এ প্রশ্ন আসতে ই পারে যে, মিলের নাম না জানা কেউ মিলের তত্ত্ব কীভাবে প্রয়োগ করবে? এতে অবাক হওয়ার কিছুই নেই। গণমাধ্যম ও শিক্ষাব্যবস্থার বদৌলতে অনেক আগেই আমাদের মগজ ধোলাই হয়ে গিয়েছে। যাইহোক, যারা প্রথম প্রশ্নের উত্তরে মিলের তত্ত্ব এনে কথা বলে, তাদের উত্তরের প্রত্যোত্তর হলো, লিবারেলিজম যেসকল ভিত্তির উপর দাঁড়িয়ে আছে সেসবের সাথে ব্যক্তিস্বাধীনতা বিশেষভাবে জড়িত। তাই লিবারেলিজম দিয়ে একে সংজ্ঞায়ন করা যাবে না। যৌক্তিকতার মানদণ্ডে তা টিকে না। জন স্টুয়ার্ট মিল ব্যক্তিস্বাধীনতাকে পূর্ববিদ্যমান তত্ত্ব হিসেবে ভিত্তি করে Harm Principle প্রবর্তন করেন। দুটো তত্ত্ব ই ব্যক্তিস্বাধীনতাকে সংজ্ঞায়ন করে না। একটি দর্শনের অস্তিত্ব প্রমাণের জন্য এর ভিত্তিগুলোর সংজ্ঞায়ন করা জরুরী। [10]এখন এ প্রশ্নের উত্তরে ঘুরেফিরে মানুষ Harm Principle এর মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে। কিন্তু আমরা কোনোকিছুকে প্রমাণ করার জন্য ঐ বিষয়টিকে ব্যবহার করতে পারি না। যদি তা করার চেষ্টা করি,তবে তা যৌক্তিক হবে না।
আরো একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, স্রস্টার অস্তিত্বে অস্বীকার করতে গিয়ে অনেকে ই বলে, “স্রস্টার অস্তিত্বের কোনো বৈজ্ঞানিক প্রমাণ নেই।” বৈজ্ঞানিক প্রমাণ আছে কি না তা ভিন্ন প্রসঙ্গ। কিন্তু তাদের যুক্তিতে, তাদেরকে এ প্রশ্ন করাটা কি ভুল হবে যে, ব্যক্তিস্বাধীনতার বৈজ্ঞানিক যুক্তি কী? লিবারেলিজমের বৈজ্ঞানিক যুক্তি কী? বৈজ্ঞানিক যুক্তি না পাওয়ার কারণে স্রস্টায় অবিশ্বাস রাখা ব্যক্তিবর্গ কিভাবে ব্যক্তিস্বাধীনতা ও এর ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত দর্শন লিবারেলিজমে বিশ্বাস রাখে?
আরব বংশদ্ভুত যুক্তরাজ্যের মুসলিম দাঈ ও তূলনামূলক ধর্মতত্ত্ব গবেষক, মুহাম্মদ হিজাব লিবারেলিজমের ইতিহাসকে তিনভাগে ভাগ করেছেন। জন লককে প্রবর্তক, মিলকে সংস্কারক ও রলসকে লিবারেলিজমের আধুনিক যুগের পুরোধা হিসেবে উপস্থাপন করে তিনি তাদের নিজেদের লেখনীর অসামঞ্জস্যতা তুলে ধরে তাদের আদর্শিক অবস্থান তথা লিবারেলিজমের অবস্থানকে প্রশ্নবিদ্ধ করেন।[11] এ ব্যাপারে আমি এখানে বিস্তারিত আলাপ করছি না।
জন স্টুয়ার্ট মিলের মূলনীতি অনুসারে কোনো লিবারেল, মুসলিমদের বা যে কোনো ধর্মের অনুসারিদেরকে তার বিশ্বাস মানতে বাধ্য করতে পারে না।[12] জন লক প্রদত্ত তত্ত্ব অনুসারে তারা কোনো ধর্মের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করতে পারে না, ধর্মীয় নিয়মকানুন পালনে বাধা দান করতে পারে না। অথচ তারা ই মুসলিমদের পোশাক নিয়ে মন্তব্য করে। তারাই ফ্র্যান্সে হিজাব নিষিদ্ধ করে, জার্মানের স্কুলে বোরখা নিষিদ্ধ করে, ব্রিটেনে নিক্বাব নিষিদ্ধ্বের দাবী উত্থাপন করে। মানবাধিকার লঙ্গনের নাম দিয়ে তারাই মুসলিম রাষ্ট্রগুলোতে আক্রমণ করে নিরপরাধ মুসলিমদের হত্যা করে। অর্থাৎ লিবারেলিজমের বাস্তবায়নের বেলায় তারা নিজেরাই নিজেদের নীতিতে সৎ না। এমনকি মিল যখন স্বাধীনতার ব্যাখ্যা দিচ্ছিলেন, Harm Principle তত্ত্ব এনেছিলেন, তখন তিনি নিজে কিন্তু ভারতীয়দের স্বাধীনতার বেলায় নিজের নীতিতে সৎ থাকতে পারেননি। যারা নিজেরা ই নিজেদের কল্পিত দর্শনের অনুসরণে সৎ না সে দর্শন অনুসরণ মানবজাতির জন্য কতটুকু সঠিক এ প্রশ্ন অবশ্যই উত্থাপনযোগ্য।
লিবারেলিজমের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট ও ব্যক্তিস্বাতন্ত্রবাদঃ বাস্তবতাবিবর্জিত এক আদর্শিক বিশ্বাস
ব্যক্তিস্বাতন্ত্রবাদের যৌক্তিকতা নিয়ে আলাপের আগে সংক্ষেপে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় উল্লেখ করা জরুরী। তা হলো লিবারেলিজমের উৎপত্তির পিছনে ক্যাথলিক চার্চ ও প্রটেস্টেন্টদের মধ্যকার সংঘাতের এক ইতিহাস রয়েছে। এক দীর্ঘ সংঘাতের ফলে সৃষ্ট পরিস্থিতি জন লক, থমাস হবস ও স্যামুয়েল পুফেন্ডর্ফদের মতো ব্যক্তিবর্গদের চিন্তাচেতনাকে প্রভাবিত করেছিল। এর ফলস্বরূপ তাদের হাতে লিবারেলিজমের ভিত্তিপ্রস্তর নির্মিত হয়।[13]
এ প্রসঙ্গে মুসলিম গবেষক ও দাঈ, হামজা জর্জিস বলেন,
“These theorists viewed the rights of the human being as independent to that of society, and therefore devised on the premise of individualism. This was perfectly consistent in preventing any further religiously inspired atrocities because this individualist viewpoint took the rights of a human being removed away from God’s perceived will for society. In this way an individual belonging to the Catholic or non-Catholic tradition could be tolerated. However this need for an individualist view on rights was based upon the fact that Catholicism did not have a tolerant attitude towards others.” [14]
ভালোভাবে উপরোক্ত বক্তব্যের দিকে লক্ষ্য করলে যে কেউই বুঝতে পারবেন যে, লিবারেলিজম যে তাত্ত্বিক বিশ্বাসের কথা বলে তার অনেকটাই, (“this individualist viewpoint took the rights of a human being removed away from God’s perceived will for society”) Secularism-এর আদর্শিক অবস্থানের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ।
লিবারেলিজম নামক দর্শনের চিন্তা কতটুকু সঠিক তা নিয়ে নন-লিবারেল মুসলিম ও অমুসলিম ঘরানায় বেশ আলাপ আলোচনা হয়েছে। যুক্তির খাতিরে যদি কেউ মেনে নেয় যে, এ চিন্তা সঠিক হতেও পারে, তবুও প্রশ্ন থেকে যায়। হামজা জর্জিস এ প্রসঙ্গে নিজের মত ব্যক্ত করতে গিয়ে বলেন, একটি নির্দিষ্ট ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটকে কেন্দ্র করে সৃষ্ট একটি দর্শন কিভাবে ঐ নির্দিষ্ট প্রেক্ষাপটের অবর্তমানে স্বীয় অবস্থানে যৌক্তিক বলে বিবেচ্য হবে?!
মাইকেল সেন্ডেল লিবারেলিজমের সমালোচনা করতে গিয়ে ব্যক্তিস্বাতন্ত্রবাদ তত্ত্বের যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন এবং তিনি দেখিয়েছেন যে এ তত্ত্ব ভিত্তিগত ভাবেই সমস্যাগ্রস্থ।[15] কেননা ব্যক্তিস্বাতন্ত্রবাদ ব্যক্তিকে সমাজ থেকে আলাদা করে নিজের অধিকার ও স্বাধীনতা চর্চার কথা বলে থাকে। অথচ ব্যক্তি কখনো সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে বেঁচে থাকতে পারে না। প্রত্যেক মানুষ একে অপরের উপর নির্ভরশীল। যেখানে সমাজ ব্যতীত ব্যক্তির অস্তিত্ব ই টিকিয়ে রাখা সম্ভব না, সেখানে কিভাবে ব্যক্তির নিজের ইচ্ছা আকাঙ্ক্ষাকে প্রাধান্য দেওয়ার জন্য সমাজের সামগ্রিক কল্যাণের বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়াটা যৌক্তিক হতে পারে? আর একটি অযৌক্তিক তত্ত্বের ভিত্তিতে সৃষ্ট একটি দর্শন মানুষের জন্য সঠিক দর্শন হিসেবে বিবেচিত হতে পারে? অর্থাৎ ব্যক্তিস্বাতন্ত্রবাদ নিজেই একটি মিথ্যা ও অবাস্তব তত্ত্ব, তাই এর ভিত্তিতে সৃষ্ট দর্শন তথা লিবারেলিজম ও একটি অবাস্তব ও অসত্য দর্শন।
মাইকেল সেন্ডেলের মতো চার্লস টেইলর ও লিবারেলিজমের সমালোচক ছিলেন।
তার মতে, নিছক ব্যক্তিগত অধিকারকে কেন্দ্র করে, ব্যক্তিকেন্দ্রিক একটি দার্শনিক আলাপ তৈরির প্রক্রিয়াটা নিজেই অদ্ভুত। ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদকে প্রাধান্য দিয়ে কেন একটা রাজনৈতিক দর্শন তৈরি হবে-এ প্রশ্ন অবশ্যই উত্থাপন করা যায়। আর তিনি এ প্রশ্ন উত্থাপন করেছেন এবং এ দর্শনকে এটমিজম(Atomism)বলে আখ্যা দিয়েছেন। [16]
মাইকেল সেন্ডেল প্রমুখ দার্শনিকদের বক্তব্য প্রমাণ করা অসম্ভব কিছু নয়।
কাউকে যদি বর্তমান বিশ্বের দুটো লিবারেল স্টেটের উদাহরণ জিজ্ঞেস করা হয়, তিনি প্রত্যোত্তরে অবশ্যই আমেরিকা ও যুক্তরাজ্যের নাম বলবেন। হেলেনা রোজেনব্লাট লিবারেলিজমের ইতিহাস প্রসঙ্গে আলোচনা করতে গিয়ে লিখেছেন, ‘The Lost History Of Liberalism’. তিনি তার বইটির একটি অধ্যায়ের নাম ই দিয়েছেন ‘Liberalism Becomes The American Creed’. এ থেকে বুঝা যায় পশ্চিমে লিবারেলিজমের অবস্থান কোন পর্যায়ে রয়েছে।
পশ্চিমা বিশ্বের দিকে তাকালে এটি দৃশ্যমান হয় যে, তাদের সমাজকাঠামো ধীরে ধীরে ভেঙে পড়েছে। ব্যক্তিস্বাধীনতা পরিভাষা ব্যবহার করে পশ্চিমারা নীতি নৈতিকতার তোয়াক্কা না করে নিজের যা ভালো লাগে তাই করছে। ফলাফলস্বরূপ পৃথিবীর সর্বোত্তম লিবারেল স্টেটগুলোতে সামাজিক অবক্ষয় চুড়ান্তরূপে এসে পৌঁছেছে। তাদের সমাজে ধর্ষণ,সমকামিতা, শিশুকামিতা ও ব্যভিচার সহ সর্বপ্রকার অমানবিক ও অনৈতিক কর্মকাণ্ড বৃদ্ধি পেয়েছে। এরমধ্যে কিছু কাজ আবার বৈধতা ও পেয়েছে। যেমনঃ পর্ণোগ্রাফি, ব্যভিচার, সমকামিতা ইত্যাদি। অর্থাৎ এসব অপরাধ ও অনৈতিক কার্যাবলির মূলে রয়েছে তাদের ব্যক্তিস্বাতন্ত্রবাদে বিশ্বাস, আরো ভালোভাবে বললে লিবারেলিজমে বিশ্বাস। সুতরাং এসমস্ত সমস্যার মূল হচ্ছে লিবারেলিজমের আদর্শিক ভিত্তি। খিলাফাহ পতনের কিছুকাল আগে থেকেই তারা বিভিন্ন কৌশল অবলম্বনের মাধ্যমে মুসলিম সমাজে এসব অবলীলায় প্রবেশ করিয়েছে। ফলস্বরূপ মুসলিম সমাজ ও কলুষিত হয়ে পড়েছে।
যেহেতো লিবারেলিজম দেশগুলোর রাজনৈতিক, সামাজিক সর্বোপরি সর্বক্ষেত্রে প্রভাব ফেলে, তাই সেখানে সৃষ্ট সমস্যাগুলোর দায়ভার অবশ্যই লিবারেল পলিসির উপর বর্তায়। অবশ্যই এসমস্ত বর্তমান পরিস্থিতি লিবারেলিজম বাস্তবায়নের ফলাফল হিসেবেই বিবেচ্য হবে। এর অন্যথা ভাবার কোনো সুযোগ নেই।
মোদ্দাকথা সামাজিক অবকাঠামোর ভঙ্গুর হাল ও সমাজে সৃষ্ট সমস্যাগুলোর মূলে রয়েছে লিবারেলিজম। সে সমস্যা কেবল যুবকদের সমস্যা তা নয় বরং পুরো সমাজের প্রধান সমস্যা। আর পুরো সমাজব্যবস্থার প্রধান সমস্যা নিঃসন্দেহে সমাজে বসবাসরত প্রতিটি শ্রেণীর ও প্রধান সমস্যা তথা যুবকদের ও প্রধান সমস্যা তা নতুন করে ব্যাখ্যা করার কোনও প্রয়োজন নেই। তাই এই মূলে আঘাত করাটা জরুরী। তানাহলে একটার পর একটা নতুন সমস্যা সৃষ্টি হতেই থাকবে।
আল্লাহ্* সুবহানাহু ওয়াতা’আলা আমাদেরকে তাঁর কালামে পাকে বলেই দিয়েছেন যে, প্রবৃত্তির দাসত্ব অনিষ্টতা ব্যতীত অন্যকিছু বয়ে আনবে না। কোরআনে বলা হয়েছেঃ
…وَلَوِ ٱتَّبَعَ ٱلۡحَقُّ أَهۡوَآءَهُمۡ لَفَسَدَتِ ٱلسَّمَٰوَٰتُ وَٱلۡأَرۡضُ
“…আর সত্য যদি তাদের প্রবৃত্তির অনুসরণ করতো তবে আসমান জমিন ও এর মধ্যকার সবকিছু বিশৃঙ্খলায় নিপতিত হতো।”[17]
আল্লাহু আকবর! আল্লাহ্* পাক যা বলেছেন এর ই বাস্তবায়ন পশ্চিমা সমাজে দৃশ্যমান। হামজা জর্জিস তার এক আর্টিকেলে ২০০৯ এ Children Society কর্তৃক “A Good Childhood : Searching For Values in A Competitive Age” শিরোনামে প্রকাশিত একটি রিপোর্ট উপস্থাপন করে প্রমাণ করেন যে, যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রে অন্যান্য রাষ্ট্রের তুলনায় বিবাহবিচ্ছেদের হার বেশি। এতে সন্দেহ নেই যে, বিবাহবিচ্ছেদ পরিবারপ্রথা ভেঙে দেয়ার অন্যতম মুখ্য এক মাধ্যম। রিপোর্টটিতে আরো বলা হয় যে, পরিবারগুলোর সদস্যদের নিজেদের মধ্যে আত্মিক সংযোগ নেই বলা চলে। পরিবারকাঠামোর এহেন অবনতির ফলস্বরূপ সেখানকার শিশুরা একে অপরের প্রতি অনেকক্ষেত্রে অমার্জিত হয়ে থাকে। তাদের মধ্যে মদ, মাদকদ্রব্য গ্রহণের হার অন্যদেশের তুলনায় বেশি। শুধু তাই নয় ,বরং তরুণীদের অন্তঃসত্ত্বা হওয়ার সম্ভাবনা ও অত্যধিক।[18]
ইংল্যান্ড ও ওয়েলসের পরিবার বিভাজন বিভাগের বিচারক, জনাব জাস্টিস কলেরিজ(Justice Coleridge) পরিবারব্যবস্থা ও সমাজ কাঠামো ভেঙ্গে যাওয়া প্রসঙ্গে বলেন,
“…never ending carnival of human misery – a ceaseless river of human distress.”[19]
মার্চ ২০১৮-মার্চ ২০১৯ অবধি কেবল ইংল্যান্ড ও ওয়েলসে ৬৭১ জন খুন হয়েছে। এর মধ্যে মহিলার সংখ্যা ২৪১। মহিলাদের মধ্যে ৩৮% মহিলা খুন হয়েছে তাদের তৎকালীন সঙ্গী বা পূর্বের সঙ্গীর হাতে। [20]
অন্যদিকে আমেরিকায় ২০১৮ সালে ১৬,২১৪ জনের খুন হয়। ৮,০৭,৪১০ জন নারী-পুরুষ Aggravated assault এর শিকার হয়। এছাড়া গাড়ি চুরির ঘটনা ঘটেছে ৭,৪৮,৮৪১টি, সিঁদেল চুরির ঘটনা ঘটেছে ১২,৩০,১৪৯টি, প্রতারণার মাধ্যমে চুরির ঘটনা ঘটেছে ৫,২১,৭,০৫৫টি, ডাকাতি ২,৮২,০৬১টি।[21]
ইউনি ব্রনফেনব্রেনার, “The State of Americans: This Generation and the Next” এর লেখক আমেরিকার সামাজিক সমস্যা প্রসঙ্গে মতব্যক্ত করতে গিয়ে বলেন,
“The signs of this breakdown are all around us in the ever growing rates of alienation, apathy, rebellion, delinquency and violence among American youth…” [22]
লিবারেল স্টেটে নারী ও শিশুদের অবস্থা
উপমহাদেশে বহুল প্রচলিত একটি স্লোগান হলো, “পশ্চিমে মেয়েরা ছোট ছোট পোশাক পরে, ওদের তো ধর্ষণ হয় না। সমস্যা ছেলেদের মানসিকতায়। মেয়েদের ঘরে বন্দী না রেখে, তাদের গায়ে বস্তা না পরিয়ে ছেলেদের দৃষ্টিভঙ্গি পালটানো উচিৎ।” পোশাকের জন্য ধর্ষণ হোক বা যে কারণেই ধর্ষণ হোক, কোনো কারণ ই ধর্ষণকে বৈধতা দিতে পারে না। কিন্তু মুসলিম নারীরা যখন রবের আদেশ মেনে তাদের শরীর ঢেকে রাখে, লিবারেলরা পশ্চিমের উদাহরণ এনে মুসলিম নারীদেরকে পশ্চিমাদের অনুসরণের আহ্বান জানায়। শরীর উলঙ্গ রাখাকে ব্যক্তিস্বাধীনতা ও সম্মানের বলে মুসলিম নারীদের মগজ ধোলাই করে। তাই এখন আমাদের আসলেই প্রশ্ন করা উচিৎ, পশ্চিমে মেয়েরা আসলেই ভালো আছে? উপরে একটা রিপোর্টে বলা হয়েছে কিশোরীদের অত্যধিক অন্তঃসত্ত্বা হওয়ার কথা। এতেই বুঝা যায় তারা কতটা ভালো আছে। তবুও এবার লিবারেলিজম নারীদের কতটুকু নিরাপত্তা দিয়েছে সে ব্যাপারে আরও একটু পরিসংখ্যান দেখে নেওয়া যাক।
CSEW তথা Crime Servey For England And Wales এর মার্চ ২০১৭ সালের রিপোর্ট মতে, ইঙ্গল্যান্ড এবং ওয়েলসে
– শতকরা ২০ ভাগ তথা ৩৪ লাখের কাছাকাছি মেয়েরা ১৬ বছর বয়সে যৌন নির্যাতনের শিকার হয়।
– কেবল ২০১৬ সালেই ৫ লক্ষ ১০ হাজার মেয়ে যৌন নিপীড়নের শিকার হয়েছে।
-৬ জনের ৫ জন নির্যাতিত মহিলা পুলিশের কাছে মামলা করে না।
RCEW(Rape Crisis England & Wales) এর এক রিপোর্টে বলা হয়েছে,
-NSPCC এর ২০১১ সালের রিপোর্ট মতে, ১৮-২৪ বছর বয়সী শতকরা ৩১ ভাগ নারী শৈশবে যৌন নিপীড়নের শিকার হয়েছে।[23]
২০১৩ সালে Ministry Of Justice, Home Office and the Office for National Statistics কর্তৃক “An Overview of Sexual Offending in England and Wales” নামে একটি আনুষ্ঠানিক রিপোর্ট প্রকাশিত হয়। রিপোর্টটি থেকে জানা যায়,
-ইংল্যান্ড ও ওয়েলসে প্রতি বছর গড়ে ৮৫,০০০ নারী ধর্ষণ ও যৌন নিপীড়নের শিকার হয়।
-প্রতি এক ঘন্টায় ১১ জন নারী যৌন নিপীড়নের শিকার হয়।
-১৬-৫৯ বছর বয়সী প্রতি বিশ জনের এক জন মেয়ে ১৬ বছর বয়সে সর্বাধিক ভয়াবহ ও নিকৃষ্ট পদ্ধতির যৌন নির্যাতনের শিকার হয়।
-প্রতি ৫ জনে একজন নারী ১৬ বছর বয়সের মধ্যেই অন্যান্য যৌন নিপীড়নের শিকার হয়। যেমন : শরীরের সংবেদনশীল স্থানে স্পর্শের মাধ্যমে নিপীড়ন, পোশাকের অংশবিশেষ খুলে ফেলা, যৌন নিপীড়নমূলক কথা বলে হুমকি দেয়া ইত্যাদির শিকার হওয়া।
-২০১২ সালে নির্যাতিত মহিলাদের শতকরা ৯০ ভাগের অপরাধীই তাদের পূর্ব পরিচিত।
-২০১২ সালে নির্যাতিতদের মধ্যে কেবল ১৫ ভাগ মহিলা পুলিশের কাছে রিপোর্ট করেছে।
-২০১১-১২ সালে সমগ্র ইংল্যান্ড ও ওয়েলসে পুলিশ রেকর্ডে ৫৩,৭০০ মামলা দায়ের করা হয়েছে। তাদের মধ্যে ভয়াবহভাবে নির্যাতিতের পরিমাণ শতকরা ৭১ ভাগ, যাদের মধ্যে ১৬০০০ মামলা ধর্ষণের ও ২২,১০০ মামলা ভয়াবহ যৌন নিপীড়নের। [24]
একই মন্ত্রণালয় থেকে ২০১৬ সালে প্রকাশিত রিপোর্ট “Violence Against Women And Girls Strategy থেকে জানা যায়:
-সেদেশে প্রতি ৪ জনের ১ জন নারী ডমেস্টিক এবিউজের শিকার হয়।
-প্রতি ৫ জনের ১ জন নারী জীবনে কখনও না কখনও যৌন নিপীড়নের শিকার হয়। [25]
এ পয়েন্টে যদিও পুরুষ নির্যাতিতদের কথা উল্লেখ করা কিছুটা অপ্রয়োজনীয় তাও আমি উল্লেখ করছি।
-CSEW এর পূর্বোক্ত রিপোর্ট অনুযায়ী ৬,৩১,০০০ পুরুষ যৌন নিপীড়নের শিকার হয়ে থাকে।
– কেবল ২০১৬ সালে ইংল্যান্ড ও ওয়েলসে ১৬-৫৯ বছর বয়সী ১,৩৮,০০০ পুরুষ যৌন নিপীড়নের শিকার হয়েছে।
-২০১৮ সালের মার্চ অবধি ইংল্যান্ড ও ওয়েলসে নির্যাতিত পুরুষের সংখ্যা পরিসংখ্যান অনুযায়ী ৬,৯৫,০০০। উল্লেখ্য, বহুপুরুষ নির্যাতনের ব্যাপারে কাউকে জানায় না। তাই প্রকৃত সংখ্যা এর থেকে বেশি হওয়া স্বাভাবিক।
CSEW এর রিপোর্ট অনুযায়ী সাধারণ পুরুষদের তুলনায় বিসেক্সুয়াল (নারী-পুরুষ উভয়ের প্রতি আকর্ষণ থাকা) ও পুরুষ সমকামীরা বেশি নির্যাতিত হয়। সমকামি পুরুষদের ক্ষেত্রে এ সম্ভাবনা সাধারণ পুরুষের তুলনায় দ্বিগুণ।[26]
অপরদিকে, আমেরিকায় RAINN অর্গানাইজেশনের Victims Of Sexual Violence Statistics রিপোর্ট অনুযায়ী,
প্রতি ৭৩ সেকেন্ডে একজন আমেরিকান যৌন নিপীড়নের শিকার হয়।
প্রতি বছর বার বছর উর্ধ্ব বয়সী ৪৩,৩,৬৪৮ জন যৌন নির্যাতনের শিকার হয়।
নির্যাতিতদের মধ্যে ১৮-৩৪ বছর বয়সীদের হার শতকরা ৫৪ ভাগ।
প্রতি ৬ জনে একজন মহিলার জীবনে একবার হলেও ধর্ষণের চেষ্টার কিংবা ধর্ষণের শিকার হতে হয়েছে।
১৬-১৯ বছর বয়সী মেয়েদের ধর্ষণের সম্ভাবনা যেকোনো মানুষের তুলনায় চারগুণ বেশি।
প্রাপ্ত বয়স্ক ধর্ষিতদের মধ্যে নারীদের হার ৯০ ভাগ।
শতকরা ১১ ভাগ শিক্ষার্থী(নারী-পুরুষ নির্বিশেষে) কোনো না কোনোভাবে যৌন নির্যাতনের শিকার হয়।[27]
৩৩ জনের একজন আমেরিকান পুরুষ জীবনের কখনও না কখনও ধর্ষণের চেষ্টা বা ধর্ষণের শিকার হয়েছে।
প্রতি দশজন ধর্ষণের শিকার নির্যাতিতদের মধ্যে একজন নির্যাতিত পুরুষ রয়েছে।
ট্রান্সজেন্ডার শিক্ষার্থিদের মধ্যে ২১ ভাগ ই যৌন নিপীড়নের শিকার হয়েছে।
ধর্ষিত নারীদের শতকরা ৩৩ভাগ আত্মহত্যার কথা ভেবে থাকে ও ১৩ ভাগ আত্মহত্যার চেষ্টা করে। [28]
এছাড়া, RAINN অর্গানাইজেশনের Children and Teens: Statistics রিপোর্ট মতে,
– আমেরিকায় প্রতি ৯ মিনিটে একজন শিশু যৌন নির্যাতনের শিকার হওয়ার অভিযোগ আসে।
-১৮ বছর বয়সের পূর্বেই ৯ জনের ১ জন মেয়ে ও ৩৩ জনের ১ জন ছেলে প্রাপ্তবয়স্ক কারো হাতে যৌন নির্যাতনের শিকার হয়।
-শিশুরা মাত্র ৭% অপরিচিত, ৫৯% পরিচিত ও ৩৪% পরিবারের সদস্যদের হাতে যৌন নির্যাতনের শিকার হয়। এর মধ্যে ৮৮% পুরুষ ও ৯% নারী হয়ে থাকে। বাকি ৩% এর ব্যাপারটা অজ্ঞাত। [29]
২০১৮ সালে আমেরিকায় ১ লক্ষ ৩৯ হাজার ৩৮০ জন (নারী-পুরুষ) ধর্ষণের শিকার হয়। ২০১৭ তে এ সংখ্যা ছিল ১,৩৫,৬৬৬ । [30]
উপরোক্ত তথ্যগুলো এমন একটি রাষ্ট্রের ,যে রাষ্ট্রে সম্মতির ভিত্তিতে বিয়ে বহির্ভূত শারিরিক সম্পর্ক বৈধ। লিবারেলিজমের শস্যভূমিতুল্য দেশগুলোতে যদি এত অধিক হারে অপরাধ সংঘটিত হয় ,তার অর্থ দাঁড়ায় যে, সিস্টেমেই সমস্যা। যদি লিবারেলিজম প্রকৃতপক্ষেই মানবজাতির জন্য উপকারি হতো তবে পৃথিবীর সর্বাধিক বৃহৎ লিবারেল রাষ্ট্রগুলো অবশ্যই এসব অপরাধের হার কমাতে সক্ষম হতো। যেহেতো তারা তা করতে সক্ষম হয়নি, এতে তাদের আদর্শিক বিশ্বাসের দূর্বলতা লিবারেলিজমের ফলে সামাজিক অবক্ষয়ের পরিমাণ বৃদ্ধি পাচ্ছে তা উপরোক্ত তথ্যগুলো থেকে দিনের আলোর ন্যায় পরিষ্কার।
২০১১ সালে বিশ্বের সর্বাধিক হতাশাগ্রস্ত(World’s most depressed countries) মানুষদের দেশের তালিকায় যুক্তরাষ্ট্র দ্বিতীয় স্থান লাভ করে। এমনকি প্রথম পাঁচটি দেশের চারটিই মূলত পশ্চিমা লিবারেল স্টেটস। [31]
অর্থাৎ লিবারেলিজমের ফলে কেবল সমাজে নৈরাজ্য সৃষ্টি হচ্ছে এবং পরিবার ব্যবস্থা ভেঙে যাচ্ছে তা নয়, বরং ব্যক্তিস্বাধীনতা তত্ত্ব তথা ব্যক্তিস্বাতন্ত্রবাদ প্রকৃতপক্ষে মানুষকে সুখী করতে পারে না। ডিপ্রেসড মানুষদের তালিকায় যুক্তরাষ্ট্রের দ্বিতীয় স্থান লাভ করা সেদিকে ই ইঙ্গিত করে। এ থেকে এটিও প্রমাণিত হয় যে, ব্যক্তিস্বাতন্ত্রবাদের স্লোগান সম্পূর্ণ মিথ্যা একটি স্লোগান বৈ কিছুই নয়। তাছাড়া যে দর্শন একটি রাষ্ট্রের সমাজকাঠামো ভেঙে দেয় ও বিভিন্ন সমস্যা সৃষ্টি করে, সে দর্শন কখনোই কল্যাণকর হতে পারে না।
অতএব, ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে মানবজাতির জন্য লিবারেলিজম একটি বাস্তবসম্মত জীবনব্যবস্থা হতে পারে না। তাই লিবারেলিজমে প্রভাবিত সাধারণ জনগণের অবশ্যই উচিৎ এমন একটি সিস্টেম প্রতিষ্ঠায় আগ্রহী হওয়া যে সিস্টেম তাদের জীবন,অর্থকে নিরাপদ রাখবে, যে সিস্টেমে নৈতিকতার ভিত্তি আপেক্ষিক না বরং সুনির্ধারিত ও যে সিস্টেম সমাজকাঠামোকে সুসংহত রাখে।
মুসলিম ও লিবারেলিজম
মুসলিম হিসেবে আমরা বিশ্বাস করি যে, সার্বভৌম ক্ষমতা একমাত্র আল্লাহ্* তাআলার। আমরা বিশ্বাস করি, আমাদের পৃথিবীতে আসাটা কোনো এক্সিডেন্টাল বিষয় নয়, বরং এর পিছনে নির্দিষ্ট উদ্দেশ্য রয়েছে।আমাদের জীবনের নির্দিষ্ট লক্ষ্য রয়েছে। আর এ লক্ষ্য হলো আল্লাহ্* তা’আলার দাসত্ব করা। আমরা তাঁর দাস। তাঁর দাসত্ব করা ই আমাদের কাজ। মানুষ তাঁর দাসত্বের জন্যই সৃষ্টি হয়েছে। আল্লাহ্* সুবহানাহু ওয়া তা’আলা কোরআনে এ ব্যাপারে স্পষ্ট ঘোষণা দিয়েছেন,
যেমন :
১। তিনি বলেছেন,
وَمَا خَلَقۡنَا ٱلسَّمَآءَ وَٱلۡأَرۡضَ وَمَا بَيۡنَهُمَا لَٰعِبِينَ
“ভূমণ্ডল ও নভোমণ্ডলের মাঝে যা কিছু আছে তা আমি ক্রীড়াচ্ছলে সৃষ্টি করিনি।”[32]
২। সূরা দুখানেও তিনি একই ঘোষণা দেওয়ার পর বলেন,
مَا خَلَقۡنَٰهُمَآ إِلَّا بِٱلۡحَقِّ وَلَٰكِنَّ أَكۡثَرَهُمۡ لَا يَعۡلَمُونَ
“আমি এগুলো যথাযথ উদ্দেশ্যে সৃষ্টি করেছি,কিন্তু তাঁদের অধিকাংশই বুঝেনা।”[33]
৩।
وَمَا خَلَقۡتُ ٱلۡجِنَّ وَٱلۡإِنسَ إِلَّا لِيَعۡبُدُون
“আমি জ্বিন ও মানুষকে কেবল আমার ইবাদতের জন্যই সৃস্টি করেছি.”[34]
মানুষের প্রকৃতিতে দাসত্ব মিশে আছে। মানুষ কখনোই এ দাসত্ব থেকে মুক্তি লাভ করতে পারবে না। যদি সে স্রস্টার দাসত্ব না করে, এর অর্থ এ না যে, সে দাসত্ব থেকে মুক্তি পেয়ে গিয়েছে। বরং নিজের খেয়াল খুশির অনুসরণের মাধ্যমে সে নিজের খেয়াল খুশির দাসত্ব করা শুরু করেছে। যার পরিণতি কখনোই সুখকর হয় না। একজন মানুষ যখন আল্লাহর দাসত্বের বদলে খেয়াল খুশির অনুসরণ শুরু করে, তখন তার নফস ই ন্যায়-নৈতিকতাবোধ ঠিক করে দেয়। এটা অস্বাভাবিক নয় যে, নীতি নৈতিকতার মানদণ্ড যদি হয় ম্নানুষের ইচ্ছা ও বিবেকবুদ্ধি, তখন এ মানদণ্ড একটি আপেক্ষিক মানদণ্ডে পরিণত হয়। আর লিবারেলিজমে এটিই নৈতিকতার মানদণ্ড। এখন, যে মানদণ্ড আপেক্ষিক তা কি সমাজে ন্যায়নীতি প্রতিষ্ঠা করতে আদৌ সক্ষম হবে? বরং এ আপেক্ষিকতার কথা বলে সাধারণ থেকে বড় বড় মানুষও নিজের পশুত্বকে বৈধতা দেয়। তাদের কাছে জীবন একবার ই, তাই তারা সেটিকে নিজের খেয়ালখুশি মতো অনুসরণ করে। পশ্চিমা সমাজে ব্যক্তিকেন্দ্রিক আপেক্ষিক নৈতিকতাবোধের মানদণ্ড ও ব্যক্তিস্বাধীনতার অধিকার পর্ণোগ্রাফির মতো অপরাধকেও বৈধতা দিয়ে দেয়। এ হলো লিবারেল মূল্যবোধের ভিত্তিতে তৈরি আইনের অবস্থা।
আল্লাহ্* তা’আলা বলেছেন :
أَفَرَءَيۡتَ مَنِ ٱتَّخَذَ إِلَٰهَهُۥ هَوَىٰهُ…. وَقَالُواْ مَا هِيَ إِلَّا حَيَاتُنَا ٱلدُّنۡيَا نَمُوتُ وَنَحۡيَا وَمَا يُهۡلِكُنَآ إِلَّا ٱلدَّهۡرُۚ وَمَا لَهُم بِذَٰلِكَ مِنۡ عِلۡمٍۖ إِنۡ هُمۡ إِلَّا يَظُنُّونَ
“আপনি কি তার প্রতি লক্ষ্য করেননি যে নিজের খেয়ালখুশিকে স্বীয় উপাস্যরূপে স্থির করেছে?…তারা বলে পার্থিব জীবন ই তো আমাদের শেষজীবন। আমরা মরি ও বাচি,মহাকাল ই আমাদের ধ্বংস করে,তাদের কাছে এ ব্যাপারে কোনো জ্ঞান নেই। তারা কেবল অনুমান করে কথা বলে।”[35]
অপরপক্ষে ইসলামে ন্যায়নীতির মানদণ্ড আপেক্ষিক কোনো বিষয় নয়। বরং, মানদণ্ড হলো আল্লাহ প্রদত্ত কোর’আন ও রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুন্নাহ। একারণে মুসলিমরা ইসলামপ্রদত্ত বিধানের বাইরে যেতে পারে না। ইসলাম নফসের অনুসরণকে সমর্থন করে না। আল্লাহ্* সুবহানাহু ওয়া’তা’আলা এ প্রসঙ্গে নবিজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে উদ্দেশ্য করে বলেছেন,
ثُمَّ جَعَلۡنَٰكَ عَلَىٰ شَرِيعَةٖ مِّنَ ٱلۡأَمۡرِ فَٱتَّبِعۡهَا وَلَا تَتَّبِعۡ أَهۡوَآءَ ٱلَّذِينَ لَا يَعۡلَمُونَ
“অতঃপর আমি আপনাকে রেখেছি এক বিশেষ শরীয়তের উপর। সুতরাং আপনি এর অনুসরণ করুন এবং মূর্খদের খেয়াল খুশির অনুসরণ করবেন না।”[36]
আল্লাহ্* সুবহানাহু ওয়া তা’আলা আরো ইরশাদ করেছেন,
أَمۡ حَسِبَ ٱلَّذِينَ ٱجۡتَرَحُواْ ٱلسَّيِّ*اتِ أَن نَّجۡعَلَهُمۡ كَٱلَّذِينَ ءَامَنُواْ وَعَمِلُواْ ٱلصَّٰلِحَٰتِ سَوَآءٗ مَّحۡيَاهُمۡ وَمَمَاتُهُمۡۚ سَآءَ مَا يَحۡكُمُونَ
“যারা দুস্কর্ম করেছে তারা কি মনে করে যে, আমি তাদেরকে সে লোকদের মত করে দেব যারা ঈমান আনে ও সৎকর্ম করে এবং তাদের জীবন ও মৃত্যু কি সমান হবে? তাদের এ দাবী কতই না মন্দ!”[37]
অতএব মুসলিমদের জন্য কখনোই বৈধ নয় লিবারেলিজমের মূলনীতিকে গ্রহণ করা। কেননা এটি সুস্পষ্ট শিরক ও কুফর। মুসলিমদের ধর্মীয় বিধিনিষেধ ছাড়াও লিবারেলিজম অন্য ধর্মাবলম্বীদের জন্যেও যে ক্ষতিকর তা আমরা ইতিমধ্যে প্রমাণ করার চেষ্টা করেছি। যেহেতো লিবারেলিজম একটি মিথ্যা কল্পনাপ্রসূত বিশ্বাসের ভিত্তিতে সৃষ্ট দর্শন ও যেহেতো এ দর্শন মানবকল্যাণে ভূমিকা রাখতে পারে না তা আমরা ইতিমধ্যেই প্রমাণ করেছি, এ অংশে আমরা লিবারেলিজমের বিকল্প হিসেবে ইসলাম কেন প্রয়োজনীয় ও উত্তম তা নিয়ে আলাপ করবো ইন শা আল্লাহ্*। এ আলোচনা করাটা অত্যন্ত জরুরী। কেননা সাংস্কৃতিক আগ্রাসন ও বুদ্ধিবৃত্তিক ঔপনিবেশিকতার ফলে মুসলিম বিশ্বে লিবারেলিজমের বিষাক্ত ছোবলের প্রভাব ইতিমধ্যেই ছড়িয়ে পড়েছে।
লিবারেলিজম ও ইসলাম
ইনসাফ ও সমাজ কাঠামো রক্ষা
লিবারেল মূল্যবোধের বাস্তবায়নের ফলে লিবারেল সমাজে সৃষ্ট সমস্যা সমাধানের জন্য ইসলাম নিঃসন্দেহে একটি সুন্দর সমাধান হিসেবে ভূমিকা রাখবে। নবিজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি একবার সাহাবীদেরকে একটি জাহাজের উদাহরণ দেন। ঘটনাটি ছিল এমন,
কিছুলোক জাহাজে করে সফরে বের হয়েছিলো। তাদের মধ্যকার কিছু লোক জাহাজের ভিতরে ডেকে আর কিছুলোক জাহাজের উপরে অবস্থান করছিল। ডেকের ভিতরের লোকেদের হঠাৎ পানির প্রয়োজন দেখা দিলে তারা পানি চাইলো। কিন্তু জাহাজের উপরের লোকেরা পানি দিতে অস্বীকার করে। তখন ডেকে থাকা লোকেরা ঠিক করলো তারা জাহাজের মধ্যে একটা বড় ছিদ্র করে সমুদ্র থেকে পানি নেবে। নবিজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন ,’যদি জাহাজের উপরে থাকা লোকেরা তাদেরকে জাহাজে ছিদ্র করায় বাধা প্রদান না করতো, তবে জাহাজসহ সবাই ডুবে যেতো। [38]
সুবহান আল্লাহ্*! উপরোক্ত হাদিসটি ব্যক্তিস্বাতন্ত্রবাদের ভিত্তি যে কতোটা দূর্বল তা সুপষ্টভাবে প্রমাণ করে। এ হাদীস দ্বারা সমাজের বিরুদ্ধে গিয়ে নিজের ইচ্ছেকে প্রাধান্য দিয়ে মানুষের পক্ষে সুস্থ জীবনযাপন করা সক্ষম নয়-তাও প্রমাণ করে। কেননা ব্যতি সমাজের ও সমাজ ব্যক্তির ই অংশ। তাই এ দুয়ের মধ্যে সুস্থ সম্পর্ক থাকা জরুরী। ব্যক্তি ও সমাজ একে অপরের পরিপুরক।
উপরোক্ত দলীলগুলো এটাও প্রমাণ কর যে,ইসলাম সর্বকালের ও সর্বযুগের জন্য। একবিংশ শতাব্দিতে সৃষ্ট ফিৎনার ও সমাধান আল্লাহ্* তা’আলা চৌদ্ধশ বছর আগে ই বলে দিয়েছেন।
ইসলাম জাহাজের ডুবে যাওয়া তথা সামাজিক অবকাঠামো ভেঙে পড়াকে বাধাপ্রদান করে। আর এজন্য ইসলামের নিজস্ব কিছু মূলনীতি ও মূল্যবোধ রয়েছে। যেমনঃ ইনসাফ, দয়া, সহনশীলতা, অন্যায়ের প্রতিবাদ অরা, ভালো কাজে উৎসাহিত করা, জবাবদিহীতা ইত্যাদি। আর এগুলো শরীয়াহর উৎস তথা কোর’আন ,হাদীস, ইজমা ও ক্বিয়াসের মানদণ্ডে নির্ধারিত হয়।
শরীয়াহ এ মূল্যবোধগুলোকে দৃঢ়ভাবে ধারণ ও প্রচার করে থাকে।
যেমন :
১। নবিজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, “সর্বোত্তম জিহাদ হলো, জালিম শাসকের সামনে সত্য কথা বলা।”[39]
২। আল্লাহ্* তাআলা বলেন,
فَلَا ٱقۡتَحَمَ ٱلۡعَقَبَةَ ١١ وَمَآ أَدۡرَىٰكَ مَا ٱلۡعَقَبَةُ ١٢ فَكُّ رَقَبَةٍ ١٣ أَوۡ إِطۡعَٰمٞ فِي يَوۡمٖ ذِي مَسۡغَبَةٖ ١٤ يَتِيمٗا ذَا مَقۡرَبَةٍ ١٥ أَوۡ مِسۡكِينٗا ذَا مَتۡرَبَةٖ ١٦ ثُمَّ كَانَ مِنَ ٱلَّذِينَ ءَامَنُواْ وَتَوَاصَوۡاْ بِٱلصَّبۡرِ وَتَوَاصَوۡاْ بِٱلۡمَرۡحَمَةِ ١٧ أُوْلَٰٓئِكَ أَصۡحَٰبُ ٱلۡمَيۡمَنَةِ ١٨
“আর সে ধর্মের ঘাটিতে প্রবেশ করেনি। আপনি কি জানেন সে ঘাঁটি কি? তা হচ্ছে দাসমুক্তি। অথবা দুর্ভিক্ষের দিনে এতিম আত্মীয়কে অন্নদান, অথবা ধুলি-ধুসরিত মিসকিনকে। অতঃপর যারা ঈমান আনে ও পরস্পরকে ধৈর্যধারণের ও উদার হওয়ার উপদেশ দেয় তাদের অন্তর্ভুক্ত হওয়া। তাঁরাই সৌভাগ্যবান।”[40]
৩। সৎ কাজের নির্দেশ ও অসৎ কাজে নিষেধ প্রসঙ্গে আল্লাহ্* তা’আলা বলেন,
وَلۡتَكُن مِّنكُمۡ أُمَّةٞ يَدۡعُونَ إِلَى ٱلۡخَيۡرِ وَيَأۡمُرُونَ بِٱلۡمَعۡرُوفِ وَيَنۡهَوۡنَ عَنِ ٱلۡمُنكَرِۚ وَأُوْلَٰٓئِكَ هُمُ ٱلۡمُفۡلِحُونَ
“আর তোমাদের মধ্যে এমন একটি দল থাকা উচিৎ ,যারা সৎকর্মের দিকে আহ্বান জানাবে , ভালোকাজের নির্দেশ করবে ও অন্যায় কাজে নিষেধ করবে। আর তাঁরাই তো সফলকাম।”[41]
وَٱلۡمُؤۡمِنُونَ وَٱلۡمُؤۡمِنَٰتُ بَعۡضُهُمۡ أَوۡلِيَآءُ بَعۡضٖۚ يَأۡمُرُونَ بِٱلۡمَعۡرُوفِ وَيَنۡهَوۡنَ عَنِ ٱلۡمُنكَرِ وَيُقِيمُونَ ٱلصَّلَوٰةَ وَيُؤۡتُونَ ٱلزَّكَوٰةَ وَيُطِيعُونَ ٱللَّهَ وَرَسُولَهُۥٓۚ أُوْلَٰٓئِكَ سَيَرۡحَمُهُمُ ٱللَّهُۗ إِنَّ ٱللَّهَ عَزِيزٌ حَكِيمٞ
“আর ঈমানদার নারীপুরুষ একে অপরের সহায়ক। তারা সৎ কাজের আদেশ দেয় ও অসৎ কাজে নিষেধ করে। সালাত আদায় করে ও যাকাত প্রদান করে। আর তারা আল্লাহ্* ও তাঁর রাসুলের প্রতি ঈমান আনে। এদের উপরই আল্লাহ্* দয়া করবেন। নিশ্চয় আল্লাহ্* তা’আলা পরাক্রমশালী সুকৌশলী।।”( সূরা তাওবাঃ৭১)
৪। ইনসাফ প্রতিষ্ঠার প্রতি আহ্বান জানিয়ে আল্লাহ্* তা’আলা বলেন,
فَٱحۡكُم بَيۡنَهُم بِٱلۡقِسۡطِۚ إِنَّ ٱللَّهَ يُحِبُّ ٱلۡمُقۡسِطِينَ
“…ইনসাফের সাথে বিচার করুন, নিশ্চয়য় আল্লাহ্* তা’আলা সুবিচারকারিদের ভালোবাসেন।”[42]
…وَلَا تَأۡخُذۡكُم بِهِمَا رَأۡفَةٞ فِي دِينِ ٱللَّهِ إِن كُنتُمۡ تُؤۡمِنُونَ بِٱللَّهِ وَٱلۡيَوۡمِ ٱلۡأٓخِرِۖ
“…যদি তোমরা আল্লাহর প্রতি ও পরকালের প্রতি বিশ্বাসী হয়ে থাকো, তবে আল্লাহর বিধান কার্যকরের ক্ষেত্রে তাদের প্রতি(ব্যভিচারী ও ব্যাভিচারিণী) প্রতি তোমাদের অন্তরে দয়ার উদ্রেক না হয়।”[43]
يَٰٓأَيُّهَا ٱلَّذِينَ ءَامَنُواْ كُونُواْ قَوَّٰمِينَ لِلَّهِ شُهَدَآءَ بِٱلۡقِسۡطِۖ وَلَا يَجۡرِمَنَّكُمۡ شَنَ*َٔانُ قَوۡمٍ عَلَىٰٓ أَلَّا تَعۡدِلُواْۚ ٱعۡدِلُواْ هُوَ أَقۡرَبُ لِلتَّقۡوَىٰۖ وَٱتَّقُواْ ٱللَّهَۚ إِنَّ ٱللَّهَ خَبِيرُۢ بِمَا تَعۡمَلُونَ
“হে মুমিনগণ!, তোমরা আল্লাহর জন্য ন্যায় সাক্ষ্যদানের ব্যাপারে অবিচল থেকো। কোনো সম্প্রদায়ের প্রতি শত্রুতার কারণে সুবিচার করা থেকে বিরত থেকো না। সুবিচার করো কেননা এটিই তাক্বওার অত্যধিক নিকটবর্তী। আর তোমরা আল্লাহকে ভয় করো, নিশ্চয় আল্লাহ্* তোমাদের কর্মের ব্যাপারে সর্বাধিক অবগত।”[44]
۞يَٰٓأَيُّهَا ٱلَّذِينَ ءَامَنُواْ كُونُواْ قَوَّٰمِينَ بِٱلۡقِسۡطِ شُهَدَآءَ لِلَّهِ وَلَوۡ عَلَىٰٓ أَنفُسِكُمۡ أَوِ ٱلۡوَٰلِدَيۡنِ وَٱلۡأَقۡرَبِينَۚ إِن يَكُنۡ غَنِيًّا أَوۡ فَقِيرٗا فَٱللَّهُ أَوۡلَىٰ بِهِمَاۖ فَلَا تَتَّبِعُواْ ٱلۡهَوَىٰٓ أَن تَعۡدِلُواْۚ و…
“হে ঈমানদারগণ তোমরা ন্যায়ের উপর প্রতিষ্ঠিত থেকো । আল্লাহর ওয়াস্তে ন্যায়সঙ্গত সাক্ষ্যদান কর, তাতে তোমাদের নিজের বা বাবা-মা বা নিকটবর্তী আত্মীয়-স্বজনের কারো ক্ষতি হয় তবুও। কেউ যদি ধনী বা দরিদ্র হয়, তবে (জেনে রাখো) আল্লাহ্* তাদের শুভাকাঙ্খী তোমাদের চাইতে বেশি। অতএব তোমরা বিচার করতে গিয়ে প্রবৃত্তির অনুসরণ করো না।…” [45]
জাস্টিস ও মাইনরিটি ল’ ও লিবারেলিজমঃতূলনামূলক পর্যালোচনা
ইতিহাস এ ব্যাপারে সাক্ষ্য দেয় যে, ইসলামী খিলাফাহর অধীনে থাকা সমাজব্যবস্থায় ইসলামের এসকল মূল্যবোধ কঠোরভাবে পালন করা হতো।
ইসলামের ইতিহাসে জেরুজালেম জয়ের পর হযরত উমার রাদিয়াল্লাহু আনহুর মহানুভব আচরণের ব্যাপারে আমরা সবাই জ্ঞাত।জেরুজালেমের বাইজান্টাইন খ্রিস্টানরা ইহুদিদের টেম্পল মাউন্ট ও ওয়েলিং ওয়াল নামক দুটো ধর্মচর্চাকেন্দ্র নিষিদ্ধ করেছিল। তিনি ইহুদিদের সেসব স্থানে ধর্ম চর্চার অনুমতি প্রদান করেন। পাশাপাশি তিনি খ্রিস্টানদেরকে ও নিরাপত্তা প্রদান করেন। খ্রিষ্টানরা জেরুজালেম দখল কয়রে ইহুদিদের বিতাড়িত করেছিল কিন্তু তিনি ইহুদিদেরকে সেখানে বসবাসের অনুমতি দান করেন। চুক্তিবদ্ধ অমুসলিমরা যদি চুক্তি মেনে চলে তবে চুক্তির শর্ত পালন করা খলিফা ও সমস্ত মুসলমানের উপর অর্পিত দায়িত্ব হিসেবে গণ্য হবে বলে তিনি ব্যক্ত করেন। [46]
উমাইয়া খিলাফতের অধীনে অনেক ইহুদিদেরকে যোগ্যতা অনুসারে রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়োগ দেয়া হয়েছিল। ইহুদিরা নির্ভয়ে ধর্ম পালন করতে পারতো। [47]লিবারেলিজম যেভাবে অন্যদেরকে নিজেদের আদর্শ গ্রহণে বাধ্য করে(যার প্রমাণ আমাদের সামনে সুস্পষ্ট), এমন কিছুই ইহুদি বা খ্রিস্টানদের সাথে করা হয়নি।
সুলতান সালাহউদ্দিন আইয়ুবীর জেরুজালেম বিজয়ের পূর্বে মুসলিমদের উপর যে নিপীড়ন চালানো হয়েছিল তা সম্পর্কে সকলেই জ্ঞাত। তিনি জেরুজালেম দখলের পর চল্লিশদিনের মধ্যে সকল খ্রিস্টানদেরকে মুক্তিপণের বিনিময়ে জেরুজালেম ত্যাগের নির্দেশ দান করেন। যারা এ আদেশ মানবে না বা মানতে পারবে না তাদেরকে বন্দী করা হবে বলে ঘোষণা দেন। কিন্তু তিনি জেরুজালেমের মূল ভূখণ্ডে প্রবেশের পর অসংখ্য দরিদ্র খ্রিস্টানকে জেরুজালেমে দেখতে পেলেন। এসকল খ্রিস্টানদের মধ্যে অনেক ক্রুসেডার ও ছিল। চুক্তি অনুযায়ী যেখানে তাদেরকে বন্দী করার কথা ,সেখানে তিনি অসহায় মায়েদের সন্তানদেরকে, স্ত্রীদের স্বামীদেরকে, মেয়েদের বাবাদেরকে ও বিকলাঙ্গ, বৃদ্ধ এবং শিশুদের বিনা মুক্তিপণে বসবাসের অনুমতি দান করেন। বহু দরিদ্র ক্রুসেডারদেরকে দেশে ফিরে যাওয়ার ব্যবস্থা করেন। যেহেতো তিনি রাজ্য জয় করেছিলেন ও শর্ত দিয়েছিলেন তাই এসবের কোনোটাই কুরতে তিনি বাধ্য ছিলেন না। কিন্তু ইসলামপ্রদত্ত দয়া ও সহমর্মিতার আদর্শের ধারক ও বাহক সালাহউদ্দিন এক্ষেত্রে উদারতা প্রদর্শন করেন।[48] অপরপক্ষে লিবারেল স্টেটের অন্যতম প্রতীক ব্রিটেন অন্যায়ভাবে এশিয়া ও আফ্রিকার যেসমস্ত দেশসমূহে সামরিক আগ্রাসন চালিয়েছিল, ফ্র্যান্স ও আমেরিকা যেসব অঞ্চলে অন্যায়ভাবে সামরিক আগ্রাসন চালিয়েছে ও এখনও জারি রেখেছে সেগুলো তো কোনোভাবেই মুসলিমদের রাজ্যবিজয়ের সাথে তুলনাযোগ্য নয় ই, কেননা তাদের সামরিক, বুদ্ধিবৃত্তিক ও সাংস্কৃতিক সর্বপ্রকার আগ্রাসন ই অন্যায্য ও অন্যায়। কিন্তু দুটো সিস্টেমের তুলনামূলক পর্যালোচনার খাতিরে একথা উল্লেখ করা জরুরী যে, তারা তাদের তৎপরতা চালানো অঞ্চলগুলোর মাত্র একটির জনগণের প্রতি ও কখনো বিন্দুমাত্র সহমর্মিতা ও দয়া প্রদর্শন করেনি।
উসমানী খিলাফাহর অধীনে থাকা অমুসলিমদের অবস্থা প্রসঙ্গে অনেক মিথ্যাচার করা হয়। আমাদের প্রবন্ধটি ইতিহাস পর্যালোচনার জন্য নয়। বরং, লিবারেজিমের আগ্রাসন, এর অসারতা ও অগ্রহণযোগ্যতা প্রমাণের প্রচেষ্টা করা ই এর মূল লক্ষ্য। তাই আলোচনার ধারাবাহিকতা রক্ষার্থে, উসমানী খিলাফাহর অধীনে থাকা ইহুদিদের ব্যাপারে ইহুদি ঐতিহাসিক এমনন কোহেনের গবেষণার কথা বলা যায়। তিনি জেরুজালেমের সিজিল(শরীয়াহ কোর্ট) আর্কাইভে ষোড়শ শতাব্দির কিছু ডকুমেন্ট পান। সেসব ডকুমেন্ট নিয়ে গবেষণার পর তিনি নিজেই বলেছেন যে, জেরুজালেমে ইহুদিদের নিজস্ব আলাদা আদালত থাকা সত্ত্বেও বেশিরভাগ ইহুদি ইসলামী আদালতের শরণাপন্ন হতো। তাদের এরূপ কর্মকাণ্ডের পিছনে বহুবিদ কারণ থাকতে পারে। তবে এ থেকে বুঝা যায় যে, তারা ইসলামী শরিয়াহভিত্তিক আদালতে সুবিচার পাওয়ার ব্যাপারে তুলনামূলক অধিক নিশ্চিত ছিলো। এমনন কোহেন আরও বলেন যে, যদিও তাদের জানমালের নিরাপত্তার জন্য মুসলিম কর্তৃপক্ষের কাছে তাদেরকে জিজিয়া দিতে হতো, কিন্তু সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, তাদের অধিকার সংরক্ষিত ছিল। তাদের নিজেদের সংরক্ষিত কাগজপত্র তাদের সম্মান ও অধিকার রক্ষিত থাকার দিকে ই ইঙ্গিত করে। বিচারের বেলায় তাদেরকে অমুসলিম হওয়ার কারণে জুলুম করা হয়নি। বরং এক্ষেত্রে তারা মুসলিমদের ন্যায় সমান অধিকার ভোগ করতো। ইহুদিদের জন্য স্বতন্ত্র আদালতের ব্যবস্থা ছিল যাতে তারা মিজেদের আইনে বিচারকার্য সমাপদন করতে পারে। তবে যদি তারা ইসলামী আইনের অধীনে সুবিচার কামনা করে, এক্ষেত্রে তাদেরকে কোনোভাবেই নিরাশ করা হতো না। একারণে তারা তূলনামূলকভাবে ইসলামী আদালতে বেশি শরণাপন্ন হতো। ইহুদি মহিলাদেরকে ইসলামী আইন অনুসারে পুরুষের অর্ধেক সম্পদলাভের ব্যবস্থা ও মুসলিম আদালত কর্তৃক করা হয়। সর্বোপরি উসমানী খিলাফাহতে, শরীয়াহ আইনের অধীনে তারা সর্বোচ্চ সম্মান ও নিরাপত্তার সাথে বসবাস করার ব্যাপারে তিনি নিশ্চয়তা প্রদান করেন। [49]
কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর রিচার্ড ডব্লিউ বুলেটের মতে, ইসলামি শাসনব্যবস্থায় ধর্ম-বর্ণ, পদমর্যাদা নির্বিশেষে ইনসাফ প্রতিষ্ঠা করা হতো। ইহুদি ও নাসারাদের নিজস্ব ধর্মীয় কর্তৃপক্ষের কাছে বিচারের জন্য যাওয়ার অনুমতি ছিল। এতদসত্ত্বেও তারা অনেকক্ষেত্রে মুসলিমদের আদালতের শরণাপন্ন হতো।[50]
ফিলিপ মাসেল তার “Constantinople” গ্রন্থে এক রাব্বির বক্তব্য উদ্ধৃত করেছেন,
“Here in the land of the Turks we have nothing to complain of. We possesses great fortunes; much gold and silver are in our hands. We are not oppressed with heavy taxes and our commerce is free and unhindered…”[51]
স্পেনের ইসলামি ইমারাহর অধীনে ইহুদিদের জীবনযাপন প্রসঙ্গে এক ইহুদি ঐতিহাসিক হেনরিচ গ্রেজের(Henrich Graetz) বক্তব্যের সারাংশ হলো, মুসলিম শাসনের অধীনে ইহুদিরা অন্যান্য ধর্মের সম-অধিকার লাভ করে। তাদের প্রতি উদারতা প্রদর্শন করা হয়। তারা বহুকাল যাবত ধর্মীয় অধিকার থেকে বঞ্চিত ছিল। অবশেষে মুসলিম শাসকদের অধীনে তারা তাদের ধর্মীয় স্বাধীনতা লাভ করে। খ্রিস্টানদের মতো তারাও মুসলিমদেরকে জিজিয়া প্রদান করতো।”[52]
মুসলিম স্পেনের ইতিহাস নিয়ে যারা কাজ করেছেন তাদের একজন Reinhart Dozy, স্পেনের ইমারাহর শাসনাধীনে থাকা অমুসলিমদের অবস্থা বর্ণনা করতে গিয়ে তিনি বলেছেন,আরবরা(মুসলিমরা) সীমাহীন সহনশীলতা প্রদর্শন করেছে। ধর্মীয় ব্যাপারে তারা কখনো কাউকে জোরজবরদস্তি করেনি।[53]
স্পেনের ইতিহাস বিশেষজ্ঞ আরেকজন ঐতিহাসিক Ulick R Burke ও একই কথা বলেছেন : “স্পেনের মুসলিমদের দ্বারা খ্রিষ্টানরা কোনোভাবে অত্যাচারিত হয়নি। স্পেনীয় আরবরা খ্রিস্টানদের প্রতি যথাযথ উদারতা ও সহনশীলতা প্রদর্শনের পাশাপাশি কিছুক্ষেত্রে সমানাধিকার ও প্রদান করেছিল।”[54]
অপরদিকে লিবারেলিজমের ধারক বাহকদের সামরিক আগ্রাসনের ব্যাপারে আমরা সবাই অবগত। তাই এ ব্যাপারে আলোচনা করে মূল আলোচনাকে আমি দীর্ঘ করতে চাই না। তারা যে কখনোই সংখ্যালঘু ও নিপীড়িত সম্প্রদায়ের অধিকার রক্ষা করে না তা দিনের আলোর ন্যায় স্পষ্ট। ব্রিটেনের সামরিক উপনিবেশ, আফ্রিকায় ফ্রান্সের সামরিক আগ্রাসন, আমেরিকার রেড ইন্ডিয়ানদের হত্যা ও আফ্রিকানদের প্রতি অত্যাচার, দাসব্যবসা, এখনও অবধি আফ্রো-আমেরিকানদের প্রতি অবিচার, লিয়ারেল স্টেটগুলোতে মুসলিম নারীদের অসম্মান করা, কোথাও নিকাব কোথাও বা হিজাব অবধি নিষিদ্ধ করে দেয়া তাদের আদর্শের অসারতা প্রমাণ করে।
তাছাড়া চার্লস টেইলরের বক্তব্য ও লিবারেলিজমের অধীনে সংখ্যালঘুদের অধিকার প্রতিষ্ঠিত না হওয়ার দিকেই ইঙ্গিত কয়রে। তার মতে, লিবারেলিজম ভিন্ন ভিন্ন সংস্কৃতির মানুষকে স্থান দিতে সক্ষম নয়। কেননা ব্যক্তির সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য তাকে চিহ্নিত করণে যে ভূমিকা রাখে তা লিবারেলিজমে এর নিজস্ব মূল্যবোধের কারণে অনুপস্থিত। ফলে ভিন্ন সংস্কৃতির কোনো ব্যক্তি তার নিজস্ব সংস্কৃতি ও পদমর্যাদার কারণে লিবারেলিজমের অধীনে যথাযথ মর্যাদা ও সম্মান লাভ করে না।[55]
এ প্রবন্ধের প্রারম্ভে লিবারেলিজমের ধারক-বাহকদের এজেন্ডার ব্যাপারে বলা হয়েছিল। তারা নন-লিবারেল দেশগুলোতে লিবারেল আদর্শের বাস্তবায়নের স্বপ্ন দেখে। অপরদিকে ইসলাম অমুসলিমদের ধর্মীয় স্বাধীনতা প্রদান করেছে। কোরআনে স্পষ্ট বলা হয়েছে, “
لَآ إِكۡرَاهَ فِي ٱلدِّينِۖ قَد تَّبَيَّنَ ٱلرُّشۡدُ مِنَ ٱلۡغَيِّۚ
“ধর্ম নিয়ে কোনো জবরদস্তি নেই। নিশ্চয় সত্য পথ ভ্রান্ত পথ থেকে পৃথক হয়ে গিয়েছে…।”[56]
এ থেকে প্রমাণিত হয় যে, সংখ্যালঘু ও নিপীড়িতদের অধিকার সংরক্ষণে লিবারেলিজমের বিপরীতে ইসলাম বহুগুণ উত্তম ব্যবস্থা। তাই মুসলিমদের চেয়েও অমুসলিমদের নিজেদের স্বার্থে লিবারেলিজমের বদলে ইসলামী শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার দাবী উত্থাপন ও এ লক্ষ্যে বিভিন্ন কার্যক্রমে সক্রিয় ভূমিকা রাখা উচিৎ।
সিস্টেম প্রত্যাখ্যান করে আইন গ্রহণ
এ আপত্তিটা হয়তো উত্থাপিত হবে যে, এরূপ মূল্যবোধ ও নীতিমালা লিবারেল সিস্টেমের আওতাতে এনেও তো প্রতিষ্ঠিত করা সম্ভব। বাস্তবে তা সম্ভব না। কারণ কেবলমাত্র মূল্যবোধের ভিত্তিতে সমাজব্যবস্থা ঠিকে থাকে না। মূল্যবোধের পাশাপাশি সঠিক মডেল ও জরুরী। এ মূল্যবোধগুলোকে লিবারেল সিস্টেমের আওতায় আনা হলেও তা সফলতার মুখ দেখতে পাবে না, কেননা লিবারেল সিস্টেমের ভিত্তি যেসব মূলনীতির উপর প্রতিষ্ঠিত তা এক্ষেত্রে বাধা প্রদান করবে। লিবারেল সিস্টেম স্বাভাবিকভাবে ই ব্যক্তিস্বাতন্ত্রবাদকে প্রচার করে এবং দিনশেষে সবকিছুকে ব্যক্তিস্বাতন্ত্রবাদের দৃষ্টিভঙ্গিতেই দেকে। ফলে যদিও এধরণের মূল্যবোধগুলো প্রচারের প্রচেষ্টা করা হয়(যা আসলেই হয়ে থাকে), এরপরেও ব্যক্তিস্বাধীনতা বাধাগ্রস্থ হওয়ার অজুহাতে সেসব প্রচেষ্টা বাধাগ্রস্থ হয়। অর্থাৎ, ইসলামি মূল্যবোধ ও জাস্টিস সিস্টেম প্রতিষ্ঠিত করতে চাইলে সমাজে লিবারেল শাসনব্যবস্থা নয় বরং ইসলামী শাসনব্যবস্থা থাকাটা জরুরী।
উদাহরণস্বরূপ সম্পদের বণ্টন ও বিচার ব্যবস্থার কথা বলা যায়। লিবারেল সিস্টেমে সম্পদের বণ্টনের ক্ষেত্রে যে পদ্ধতির অনুসরণ করা হয়, তা হলো বিভিন্ন সংগঠন বিভিন্নভাবে অর্থ সঙ্গগ্রহ করে। কিন্তু এক্ষেত্রে লিবারেল ব্যবস্থার অধীনে ব্যক্তি এ কাজে অংশ নেয়ার ও না নেয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণের স্বাধীনতা লাভ করে। অপরদিকে ইসলামি শাসনব্যবস্থায় সম্পদের সুষ্ঠু বন্টন একটি আবশ্যিক বিষয়। এটিকে ইসলামি অর্থনীতিতে মৌলিক গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব হিসেবে দেখা হয়ে থাকে।
অর্থাৎ একই বিষয়ে সম্পূর্ণ ভিন্ন ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি সমাজে ঐ বিষয়টি প্রতিষ্ঠায় বাধা সৃষ্টি করে। এ থেকে আরো উপলদ্ধি করা যায় যে, লিবারেলিজম রাষ্ট্রের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারকেও ব্যক্তিস্বাতন্ত্রবাদের দৃষ্টিকোণ হতে দেখে।
ফিলিপ মাসেল কর্তৃক লিখিত গ্রন্থ “Constantinople” এ ইসলামে সম্পদের বণ্টন প্রসঙ্গে এক রাব্বির বক্তব্য উদ্ধৃত করা হয়েছেঃ
“Rich are the fruits of the earth. Everything is cheap and everyone of us lives in peace and freedom…”[57]
ইসলামি বিচার ব্যবস্থা ও লিবারেল সিস্টেমঃ তূলনামূলক পর্যালোচনা--
(পুরো অংশ জায়গা সংকীর্ণতার কারণে এখানে দেওয়া সম্ভব হলোনা। বাকি অংশসহ পুরোটা এই লিংক থেকে পড়ুন ইনশা আল্লাহ। পুরো লেখাটায় ৭০ হাজারের বেশি অক্ষর রয়েছে।
https://justpaste.it/7plws )
Comment