আল হিকমাহ মিডিয়া কর্তৃক প্রকাশিত
দাওয়াতের পদ্ধতি ও জিহাদী মানহাজের হেফাযত
শাইখ উসামা মাহমুদ হাফিযাহুল্লাহ.
এর থেকে
পর্ব- ৩
==================================================
===============================
৩. জিদালে হাসানা:
অনেক সময় বুঝমান, সত্যানুসন্ধানী ব্যক্তিকেও সন্দেহ ঘিরে ধরে। আলোচনা ছাড়া তারও এতমিনান হয় না। তাদের জন্য হল জিদালে হাসান। বিষয়টিকে আয়াতে এভাবে বলা হয়েছে وَجَادِلْهُم بِالَّتِي هِيَ أَحْسَنُ অর্থাৎ যদি এমন পরিস্থিতি হয় তাহলে সর্বোত্তম পদ্ধতিতে ভদ্রতা, সঠিক দিকনির্দেশনা ও ইনসাফের সাথে মুনাযারা করবে। প্রতিপক্ষকে কোন অভিযোগ দিলে উত্তম পদ্ধতিতে দিবে। অযথা অন্তরে আঘাতকারী কথাবার্তা বলে ঝগড়ার পরিবেশ তৈরি করবে না। বিষয়টি এমনভাবে পেশ করতে হবে যেন অনেক দূর পর্যন্ত না গড়ায়। লোকদেরকে বোঝানো ও সত্য প্রতিষ্ঠা আমাদের উদ্দেশ্য হওয়া উচিৎ। কঠোরতা, খারাপ ব্যবহার, চাপাবাজি ও গোয়ার্তুমি দ্বারা কোন ফায়দা হয় না।
মুফতি শফি রহিমাহুল্লাহ দাওয়াতের পদ্ধতির ক্ষেত্রে আম্বিয়ায়ে কেরামের তরিকার বর্ণনা করতে গিয়ে বলেন: আল্লাহর পথে আহবান মূলত নবীগণের কাজ। ওলামায়ে কেরাম এ দায়িত্ব পালন করেন নবীদের নায়েব বা প্রতিনিধি হিসেবে। এজন্য জরুরি হলো, দাওয়াতের পদ্ধতি ও আদবও নবীদের থেকে শিখে নেওয়া। যে দাওয়াত তাদের তরিকার ওপর থাকবে না, তা দাওয়াতই নয়; বরং তা লড়াই বা ঝগড়ার কারণ হয়ে দাঁড়াবে। নববী দাওয়াতের মূলনীতি কেমন তা আমরা মুসা ও হারুন আলাইহিস সালামকে আল্লাহ তাআলা যে নির্দেশ দিয়েছেন তা থেকে শিখতে পারি। আল্লাহ তা’আলা বলেন:
فَقُولَا لَهُ قَوْلًا لَيِّنًا لَعَلَّهُ يَتَذَكَّرُ أَوْ يَخْشَى
অর্থাৎ ফেরাউনের সাথে নরম কথা বল, হয়ত সে বুঝবে অথবা ভীত হবে। [সুরা ত্বা-হা ২০:৪৪]
প্রত্যেক দাঈর সর্বদা এ বিষয়টি মাথায় রাখা উচিৎ যে, ফেরাউনের মত অহংকারী কাফের, যার মৃত্যুও আল্লাহর ইলম অনুযায়ী কুফর অবস্থায়ই হবে, তার ক্ষেত্রেও আল্লাহ তাআলা নিজের দাঈকে নরম ভাষায় কথা বলার নির্দেশ দিয়েছেন।
বর্তমানে আমরা যাদেরকে দাওয়াত দেই, তারা কেউ ফেরাউনের চেয়ে বড় গোমরাহ নয়। আর আমাদের কেউ মূসা ও হারুন আলাইহিমাস সালামের মতো দাঈও নই। অতএব যেই অধিকার আল্লাহ তা’আলা তাঁর দুই নবীকে দেননি যে, “মাদউর সাথে শক্ত ব্যবহার করবে, তাকে অপমান করবে” - সে অধিকার আমাদের কোথা থেকে অর্জন হয়ে গেলো?!
কুরআনে কারীমে নবীগণের দাওয়াত ও তাবলীগ এবং কাফেরদের সাথে মুনাযারার আলোচনা অনেক আছে। কোথাও দেখা যায় না যে, ইসলামের বিরোধিতাকারীদের জবাবে কোন নবী কখনও কোন শক্ত ভাষা ব্যবহার করেছেন। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তো এবিষয়েও খেয়াল রাখতেন যে, মাদউর অপমানও যেন না হয়। তাই কাউকে যদি তিনি কোন ভুল বা অন্যায় কাজে লিপ্ত দেখতেন, তখন তাকে কিছু না বলে সাধারণ মজলিসে বলতেন – “লোকদের কি হলো যে, তারা এমন এমন করে?”। এই সাধারণ সম্বোধনে যাকে শোনানোর উদ্দেশ্য সেও শুনতো এবং নিজের সংশোধনের ফিকিরে লেগে যেত।
সাধারণত নবীগণের অভ্যাস ছিলো শ্রোতাকে লজ্জা থকে বাঁচানো। তাই অনেক সময় যে কাজ শ্রোতার দ্বারা সংঘটিত হতো তা নিজের দিকে নিসবত করে সংশোধনের চেষ্টা করতেন। সূরা ইয়াসীনের মধ্যে আল্লাহ তা’আলা বলেন:
وَمَا لِي لاَ أَعْبُدُ الَّذِي فَطَرَنِي وَإِلَيْهِ تُرْجَعُونَ
আমার কি হল যে, যিনি আমাকে সৃষ্টি করেছেন এবং যার কাছে তোমরা প্রত্যাবর্তিত হবে, আমি তাঁর এবাদত করবো না?
[সুরা ইয়া-সীন ৩৬:২২]
আমার কি হল যে, যিনি আমাকে সৃষ্টি করেছেন এবং যার কাছে তোমরা প্রত্যাবর্তিত হবে, আমি তাঁর এবাদত করবো না?
[সুরা ইয়া-সীন ৩৬:২২]
এটা তো জানা কথা যে, আয়াতে উল্লেখিত এই দূত সর্বদা আল্লাহর ইবাদতেই লিপ্ত থাকতো, শুধু কাফের শ্রোতাকে শুনানোর উদ্দেশ্যই এই কাজকে নিজেদের দিকে নিসবত করে বলেছেন।
দাওয়াতের উদ্দেশ্য শুধু অন্যের সমালোচনা করা নয়, বরং অন্যকে নিজের কাছে ডেকে আনা। আর এই ডাকা তখন কার্যকর হবে যখন বক্তা-শ্রোতা উভয়ের মাঝে কোন একটি বিষয়ে একাত্মতা থাকবে। এজন্য পবিত্র কুরআনে নবীগণের দাওয়াতের অধিকাংশই يا قوم‘ইয়া কওমি’ (হে আমার সম্প্রদায়!) শিরোনামে এসেছে। নবীগণ ‘হে আমার সম্প্রদায়’ এই শব্দের দ্বারা প্রথমেই ভ্রাতৃত্বের বন্ধনের কথা উল্লেখ করেছেন। এরপর তাদের সংশোধনের আলোচনা করেছেন যে, – ‘আমরা তো ভ্রাতৃত্বের দিক থেকে একই জাতের মানুষ, আমাদের মাঝে তো কোন দূরত্ব নেই’ একথা বলেই তাদের সংশোধনের কাজ শুরু করতেন।
রসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রোম সম্রাটের নামে যে চিঠি পাঠিয়েছেন, তাতে তাকে ‘আযীমুর রোম’ তথা রোমের সম্মানিত বাদশা উপাধীতে সম্বোধন করেছেন। এখানে তাকে “রোমের সম্মানিত বাদশা” বলে সম্মান করেছেন। আর এই ‘আযীমুর রোম’ শব্দটি আল্লাহর রাসুল রোম সম্রাটের জন্য ব্যবহার করে তার সম্মানের স্বীকৃতি দিয়েছেন। তার এই সম্মানের স্বীকৃতি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রোমের অধিবাসীদের জন্য দিয়েছেন, নিজের জন্য নয়। তারপর কোরআনের নিম্মোক্ত আয়াতাংশটি শিরোনাম হিসেবে উল্লেখ করে দাওয়াত দিয়েছেন।
يَا أَهْلَ الْكِتَابِ تَعَالَوْاْ إِلَى كَلَمَةٍ سَوَاء بَيْنَنَا وَبَيْنَكُمْ أَلاَّ نَعْبُدَ إِلاَّ اللّهَ
অর্থ: “হে আহলে-কিতাব! একটি বিষয়ের দিকে আস যা আমাদের মধ্যে ও তোমাদের মধ্যে সমান, আমরা আল্লাহ ছাড়া অন্য কারও ইবাদত করবো না। [সুরা ইমরান ৩:৬৪]
এখানে প্রথমে পরস্পরের একমত হওয়ার একটি বিষয়কে উল্লেখ করা হয়েছে। তারপর খ্রিস্টানদের ভুলগুলো আলোচনা করা হয়েছে।
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসল্লামের সীরাহ নিয়ে যদি ফিকির করা হয়, তাহলে তালীম ও দাওয়াতের এধরণের অনেক আদব ও উসুল পাওয়া যায়। বর্তমানে তো দাওয়াত ও ইসলাহ এবং আমর বিল মারুফ নাহি আনিল মুনকারের কোন খেয়ালই নেই। আর যারা দাওয়াতের কাজে লিপ্ত আছে, তারা শুধু বাহাস-মুনাযারা, তর্ক-বিতর্ক, প্রতিপক্ষকে অভিযোগ করা, কথায় আটকানো এবং তাকে অপমান করাকেই দাওয়াত বানিয়ে নিয়েছে। যা সুন্নতের খেলাফ হওয়ার কারণে কখনই প্রভাব বিস্তারকারী ও উপকারী হয় না। তারা মনে করে আমরা ইসলামের অনেক খেদমত করে ফেলেছি। বাস্তবে তারা মানুষকে দূরে সরানোর কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
উক্ত আয়াতের তাফসীর থেকে জানা যায় যে, ইসলামের আসল উদ্দেশ্য হলো, আল্লাহর দিকে দাওয়াত দেয়া। আর এই দাওয়াতের মূলনীতি দুইটি, হেকমত এবং মাওয়ায়েযে হাসানা। তর্ক যদি করতে বাধ্য হয় তাহলে সেখানে ‘আহসান’ তথা উত্তম পন্থায় করার শর্তসহ জায়েয বলেছেন। কিন্তু এটি দাওয়াতের কোন স্বতন্ত্র বিভাগ নয়, বরং এটি দাওয়াতের নেতিবাচক দিকেরই একটি প্রচেষ্টা; এক্ষেত্রে কুরআনে কারীমে بِالَّتِي هِيَ أَحْسَنُ এর শর্ত লাগিয়ে একথা বলে দিয়েছেন যে, দাওয়াত কোমলতার সাথে কল্যাণকামিতা ও সহমর্মিতার আগ্রহ নিয়ে হওয়া উচিৎ। সেই সাথে শ্রোতার অবস্থা অনুযায়ী স্পষ্ট দলিলের মাধ্যমে হওয়া উচিৎ। শ্রোতাকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করা থেকে পরিপূর্ণ বেঁচে থাকতে হবে।
এরপর দাওয়াত ‘আহসান’ (সর্বোত্তম) হওয়ার জন্য জরুরি হলো বিষয়টি বক্তার জন্য ক্ষতিকর না হওয়া। অর্থাৎ দাওয়াতের মধ্যে বদ-আখলাক তথা হিংসা, বিদ্বেষ, অহংকার, পদমর্যাদার লোভ ইত্যাদির মিশ্রণ থাকতে পারবে না, যা বাতেনি কবিরা গুনাহ। আর বর্তমানে খুব কম মানুষই আছে যারা বাহাস-মুনাযারার মধ্যে এ সমস্ত খারাবী থেকে বেঁচে থাকতে পারে। অধিকাংশই বেঁচে থাকতে পারে না। ইমাম গাজালি রহিমাহুল্লাহ বলেন: “যেমনিভাবে মদ পান করা সমস্ত খারাবীর মূল -নিজের আত্মিক খারাবী এবং বহু শারীরিক খারাবীর জন্ম দেয়, তেমনিভাবে তর্ক বিতর্কের মধ্যে যদি উদ্দেশ্য থাকে অপর পক্ষের ওপর বিজয়ী হওয়া, নিজের ইলমকে অন্যের সামনে প্রকাশ করা, তাহলে এটাও অন্তরের সমস্ত খারাবীর মূল। কারণ এর দ্বারা অন্তরে অনেক রোগ সৃষ্টি হয়। হিংসা, বিদ্বেষ, অহঙ্কার, গিবত, অন্যের দোষ তালাশ করা, অন্যের দুঃখে খুশি হওয়া, অন্যের সুখে কষ্ট পাওয়া, সত্য গ্রহণে অহঙ্কার পোষণ ইত্যাদি গোনাহের সৃষ্টি হয়। এছাড়াও এই জাতীয় রোগে আক্রান্ত লোকেরা অপর পক্ষের কথায় চিন্তা-ফিকির বাদ দিয়ে পাল্টা উত্তর দেয়ার চেষ্টায় লিপ্ত হয় এবং তা করতে গিয়ে কুরআন হাদীসের যত তাবীলই করা লাগুক না কেন, তা-ই করে বসে। এটা তো এমন ধ্বংসাত্মক বিষয় যাতে মর্যাদাবান আলেমরাও লিপ্ত হয়ে পড়ে, এরপর বিষয়টি যখন তাদের অনুসারীদের পর্যন্ত পৌঁছে তখন তা ঝগড়া-ফাসাদ ও মারামারির রূপ ধারণ করে। ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাযিউন।
Comment