আল হিকমাহ মিডিয়া কর্তৃক প্রকাশিত
দাওয়াতের পদ্ধতি ও জিহাদী মানহাজের হেফাযত
শাইখ উসামা মাহমুদ হাফিযাহুল্লাহ.
এর থেকে
পর্ব- ৪
==================================================
===============================
দাওয়াতের পদ্ধতি ও জিহাদী মানহাজের হেফাযত
শাইখ উসামা মাহমুদ হাফিযাহুল্লাহ.
এর থেকে
পর্ব- ৪
==================================================
===============================
আল্লাহ তা’আলা বলেন –
ادْعُ إِلَىٰ سَبِيلِ رَبِّكَ بِالْحِكْمَةِ وَالْمَوْعِظَةِ الْحَسَنَةِ ۖ وَجَادِلْهُم بِالَّتِي هِيَ أَحْسَنُ ۚ إِنَّ رَبَّكَ هُوَ أَعْلَمُ بِمَن ضَلَّ عَن سَبِيلِهِ ۖ وَهُوَ أَعْلَمُ بِالْمُهْتَدِينَ ﴿١٢٥﴾
অর্থ: আপন পালনকর্তার পথের দিকে আহবান করুন হিকমত ও সুন্দর উপদেশের মাধ্যমে এবং তাদের সাথে অতি উত্তম পন্থায় বিতর্ক করুন। নিশ্চয় আপনার পালনকর্তাই ঐ ব্যক্তি সম্পর্কে বিশেষভাবে জ্ঞাত রয়েছেন, যে তাঁর পথ থেকে বিচ্যুত হয়ে পড়েছে এবং তিনিই ভালো জানেন তাদেরকে, যারা সঠিক পথে আছে। [সুরা নাহল ১৬;১২৫]
ইমাম রাজি রহিমাহুল্লাহ এই আয়াতের অধীনে বলেন: “এই আয়াতের উদ্দেশ্য হলো, তোমরা শুধু এই তিন তরিকায় দাওয়াত দেয়ার জন্য আদিষ্ট। মানুষের হেদায়াত দেয়া তোমাদের কাজ নয়। আল্লাহই ভালো জানেন কে গোমরাহ, আর কে হেদায়াত গ্রহণকারী। আমার মতে নফস বা অন্তর সত্তাগতভাবে বিভিন্ন ধরণের হয়। প্রথমত কিছু অন্তর নূরে পরিপূর্ণ ও পাক পবিত্র, যা বস্তুর দিকে কম ধাবিত হয়, আর রুহানিয়াতের দিকে বেশি ধাবিত হয়। আর কিছু অন্তর অন্ধকারে পরিপূর্ণ যা বস্তুর প্রতি আগ্রহী বেশি, আর রুহানিয়াতের দিকে ধাবিত হয় কম। সুতরাং যার অন্তরাত্মা যেমন সে তার বিপরীতটা খুব কমই গ্রহণ করে। এজন্য আল্লাহ তা’আলা বলেন, তোমরা তিন তরিকায় দাওয়াত দাও। আর সব মানুষের হেদায়াতের পিছনে পড়ে থেকো না। আল্লাহ পথভ্রষ্টদের গোমরাহি এবং পবিত্র অন্তরের পবিত্রতা সম্পর্কে ভালো জানেন।”
শায়খ আব্দুল্লাহ আযযাম রহিমাহুল্লাহ বলেন: “আমর বিল মারুফ নাহি আনিল মুনকারের জন্য মানুষের সাথে মুহাব্বত সৃষ্টিকারী লোকের প্রয়োজন। এমন লোক যার মন বড় ও জবান পবিত্র। কোন মুসলমানকে কোন খারাপ কাজ করতে দেখলে একথা বলবে না যে, আমি তোমাকে আল্লাহর জন্য ঘৃণা করি, কারণ তুমি এই এই খারাপ কাজ কর। আল্লাহর ওয়াস্তে তোমরা এই পদ্ধতি অবলম্বন করো না। বরং তাকে এভাবে বল; আমি তোমাকে আল্লাহর জন্য ভালোবাসি, কিন্তু তোমার অমুক কাজটা খারাপ, তা পরিত্যাগ করা উচিৎ।”
শহীদে উম্মাত শায়খ উসামা বিন লাদেন রহিমাহুল্লাহ তাঁর একটি চিঠিতে লিখেছেন: “জিহাদি মিডিয়ায় এমন শব্দ, বাক্য ও কথা, বলা এবং লেখা থেকে বিরত থাকতে হবে যা একজন মুসলমানের শানের খেলাফ। যে কোন মুসলমানের সাথেই ঘৃণা, গালমন্দ, ভাষার ভুল ব্যবহার উচিৎ নয়। মিডিয়ায় লেখা বা বলার সময় শরয়ী নীতিমালার প্রতি লক্ষ্য রাখা জরুরি। এ বিষয়টি দেখতে হবে যে, আমাদের এই কথা দ্বারা জিহাদের ফায়দা হবে? না ক্ষতি হবে? আপনারা খুব ভালো করেই জানেন যে, মুজাহিদদের জন্য এ বিষয়টির প্রতি লক্ষ রাখা কত জরুরি। আমার খেয়াল হলো, এখনই আমাদের সমস্ত মিডিয়াকে কঠোরভাবে তদারকি করতে হবে। কারণ এই মিডিয়াই উম্মত পর্যন্ত আমাদের আওয়াজ পৌঁছায় এবং উম্মতের সাথে আমাদের সম্পর্কের একমাত্র মাধ্যম। এই মিডিয়াই আমাদেরকে উম্মতের সামনে তুলে ধরে। এজন্য জরুরি হলো আমাদের মিডিয়া উম্মতের বুঝ অনুযায়ী হবে এবং তাদের দুঃখ-দুর্দশায় সহানুভূতি জানাবে। তেমনিভাবে আরেকটি বিষয় মিডিয়ার ভাইদের জন্য জরুরি, তাদের প্রকাশনাগুলো যেন সাধারণ মানুষকে কেন্দ্র করে হয়। উম্মাহকে অন্ধকারের গভীরতা থেকে বের করে নিয়ে আসার ফিকির তাদের মধ্যে থাকতে হবে।”
মুজাহিদ আলেমে দ্বীন শায়েখ আতিয়াতুল্লাহ রহিমাহুল্লাহ বলেন: “মুজাহিদ নেতাদের জন্য জরুরি হলো নিজেরা এই গুণ অর্জন করবে, এবং নিজ সাথীদেরকে এমন তরবিয়ত করবে যে, তারা যেন মানুষের ওপর দয়াকারী ও সহজকারী হয়। তাদের ভুল-ত্রুটি ও অন্যায় দেখে শাস্তি, হত্যা ও প্রতিশোধের হুমকি প্রদানকারী না হয়। বরং কোমলতা ও নমনীয়তার সাথে ধীরে ধীরে সংশোধনের চেষ্টা চালিয়ে যাবে। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখনই কোন জামাত পাঠাতেন বা কাউকে কোন দলের আমীর বানাতেন তখনই নসিহত করতেন:
يسِّروا ولا تعسِّروا، وبشِّروا ولا تنفِّروا متفق عليه
আনাস রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, তোমরা সহজ কর, কঠিন করো না এবং (লোকদেরকে) সুসংবাদ দাও। তাদের মধ্যে ঘৃণা সৃষ্টি করো না।’’ [সহীহ বুখারি ৬৯, ৬১২৫, সহীহ মুসলিম ১৭৩৪, মুসনাদে আহমদ ১১৯২৪, ১২৭৬৩]
আমরা কি কখনও এটা নিয়ে চিন্তা করেছি? এর ওপর আমল করেছি?” আল্লাহ এ সমস্ত ওলামায়ে কেরাম ও জিহাদের নেতাদেরকে সমস্ত উম্মতের পক্ষ থেকে যথাযথ প্রতিদান দান করুন। এবং আমরা যেন সুন্নত অনুযায়ী দাওয়াতের কাজ করতে পারি সে তাওফিক দান করুন। আমীন।
প্রিয় ভাইয়েরা আমার!
আমরা মুজাহিদগণ দ্বীন ও জিহাদের দাঈ। জিহাদও আমাদের ময়দান, একই সাথে দাওয়াতও আমাদের ময়দান। যে সমস্ত শক্তিধর ব্যক্তিরা অস্ত্র দিয়ে আমাদের ওপর কুফুরি শাসনব্যবস্থা চাপিয়ে দিয়েছে, তাদের বিরুদ্ধে আমরা অস্ত্র নিয়ে ময়দানে আছি, এবং মুসলিম জাতিকে আমাদের সাথে জিহাদে শরিক হওয়ার প্রতি আহবানও জানাচ্ছি। জিহাদের ময়দানের চাহিদা ভিন্ন, আর দাওয়াতের নিয়মনীতিও ভিন্ন। রাসূল সাল্লাল্লা্হু আলাইহি ওয়াসল্লাম জিহাদের ময়দানে কঠোরতা করেছেন, রক্ত প্রবাহিত করেছেন, হত্যা করা ও নিহত হওয়ার প্রতি উদ্বুদ্ধ করেছেন। রাসূল সাল্লাল্লা্হু আলাইহি ওয়াসল্লামের সিরাত সাক্ষী যে, দাওয়াতের ক্ষেত্রে তাঁর তরিকায় কোনো কঠোরতা নেই বরং কোমলতা। কারণ হলো দাওয়াত ও জিহাদ উভয়টির মাধ্যম, পদ্ধতি ও লক্ষ্য ভিন্ন ভিন্ন। জিহাদের মধ্যে শক্তিকে শক্তির মাধ্যমে দমন করতে হয়। অস্ত্র বহন করা, রক্ত প্রবাহিত করা, শরীরের অঙ্গ উড়িয়ে দেয়া উদ্দেশ্য হয়। এজন্য জিহাদে অত্যন্ত কঠোরতা দরকার। জিহাদ তো এই কঠোরতারই নাম, এটা ব্যতিত জিহাদ জিহাদই থাকে না। আর এখানে কঠোরতার মধ্যেই সাওয়াব। এটা ভিন্ন কথা যে, শরিয়ত এক্ষেত্রেও সীমারেখা ও আদাবের উল্লেখ করেছে। কিন্তু এটি কঠোরতারই ময়দান। এখানে প্রভাব বিস্তারের জন্য কঠিন শব্দ, কঠোর আচরণ জরুরি। কিন্তু এই কঠোরতা যদি দাওয়াতের ক্ষেত্রে চলে আসে, এখানেও যদি কথা ও ভাব এমন গ্রহণ করা হয়, যার দ্বারা শ্রোতার মন-মস্তিষ্ক উদ্বুদ্ধ না হয়ে হিংসা, শত্রুতা, প্রতিশোধের প্রতি ধাবিত হয়, তাহলে এর দ্বারা দাওয়াতের উদ্দেশ্যই নষ্ট হয়ে যায়। জিহাদি আন্দোলনের দুর্ভাগ্যই হবে যদি জিহাদের পদ্ধতি দাওয়াতের ক্ষেত্রে প্রয়োগ শুরু হয়।
একদিকে জিহাদ অন্তরের রাগ-গোস্বা দমনের জায়গা। সেখানে আক্রমণ করে জালিম অহংকারীদের মস্তিষ্ক চূর্ণ করা হয়। আর তাদের বস্তুগত শক্তি খতম করে তাদের যুদ্ধ করার শখ মিটিয়ে দেয়া হয়। অন্যদিকে দাওয়াতের বিষয়টা সম্পূর্ণ ভিন্ন। এখানে রাগ ও গোস্বা প্রকাশ না করে বরং দমন করা হয়। শ্রোতাকে নিচু করা অপমান করা মূল উদ্দেশ্য নয়। তাকে আগ্রহী করা, নিকটবর্তী করা, তার মনে জায়গা করা হল উদ্দেশ্য। দলিলভিত্তিক আলোচনা, ধৈর্য, সহনশীলতা, ক্ষমা, কোমলতা, এহসান ও দয়াই হলো দাওয়াতের ময়দানের চাহিদা। দাওয়াতের ময়দানে জরুরি হলো নিজে যথাযথ আমল করবে। কিন্তু শ্রোতাকে হক বোঝানো, হক বুঝের যোগ্য হওয়া ও গ্রহণীয় হওয়ার জন্য (শরীয়তের সীমার মধ্যে থেকে) যথেষ্ট চেষ্টা করবে। এই কারণে দাওয়াতের মধ্যে সুন্দর সুন্দর কথা, সুন্দর তরিকার প্রতি লক্ষ রাখা হয়। শ্রোতা যদি শত্রুতা ও বিরোধিতার প্রকাশ করে তাহলে দাঈ শত্রুতা করবে না, বরং সে (সর্বোত্তমভাবে মুনাযারা) এর ওপর আমল করবে।
ঝগড়া- ফাসাদের জায়গায়ও তাকে এই আয়াত রাস্তা দেখায়। ভালো খারাপ এক হতে পারে না। আপনি শক্ত কথার জবাব এমনভাবে দিবেন যা খুব ভালো। এমন করার দ্বারা দেখবেন যে, যার সাথে শত্রুতা ছিলো সে কেমন যেন অন্তরঙ্গ বন্ধু হয়ে গেছে। আর ধৈর্যশীলরাই এটা অর্জন করতে পারে, ভাগ্যবানদেরই এটি অর্জিত হয়। সুতরাং প্রচণ্ড বাকবিতণ্ডার মধ্যেও দাঈর দৃষ্টি দলিল থেকে সরে না। এই অবস্থায়ও সে সুন্দর কথা সুন্দর ব্যবহার করে, খারাপ আচরণ থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে রাখে। এমনিতেই যখন খারাপ আচরণের জবাব ভালো আচরণ দ্বারা দেয়া হয়, বাড়াবাড়ির জবাব ক্ষমা, ইনসাফ ও দয়া দ্বারা দেয়া হয়, তখন শ্রোতার পাথরের মত শক্ত অন্তরও মোমের মত গলে যায়। শত্রুতার আগুন ঠাণ্ডা হয়ে যায়। এভাবেই দাঈর জানের দুশমনও তার রক্ষক হয়ে যায়।
Comment