আল-ক্বাদিসিয়াহ মিডিয়া
কর্তৃক পরিবেশিত
জিহাদের পথে স্থায়ী ও অবিচল বিষয় সমূহ
-শাইখ ইউসূফ আল উয়াইরি
[এর উপরে লেকচার দিয়েছেন ইমাম আনোয়ার আল-আওলাকি (রহিমাহুল্লাহ)||
এর থেকে
৪র্থ পর্ব
==================================================
===============================
কর্তৃক পরিবেশিত
জিহাদের পথে স্থায়ী ও অবিচল বিষয় সমূহ
-শাইখ ইউসূফ আল উয়াইরি
[এর উপরে লেকচার দিয়েছেন ইমাম আনোয়ার আল-আওলাকি (রহিমাহুল্লাহ)||
এর থেকে
৪র্থ পর্ব
==================================================
===============================
অধ্যায়ঃ ২
দ্বিতীয় বৈশিষ্ট্যঃ জিহাদ কোন ব্যক্তি বা ব্যক্তিবর্গের উপর নির্ভরশীল নয়
﴿وَمَا مُحَمَّدٌ إِلَّا رَسُولٌ قَدْ خَلَتْ مِنْ قَبْلِهِ الرُّسُلُ أَفَإِنْ مَاتَ أَوْ قُتِلَ انْقَلَبْتُمْ عَلَى أَعْقَابِكُمْ وَمَنْ يَنْقَلِبْ عَلَى عَقِبَيْهِ فَلَنْ يَضُرَّ اللَّهَ شَيْئًا وَسَيَجْزِي اللَّهُ الشَّاكِرِينَ﴾
“আর মুহাম্মদ একজন রসূল বৈ তো নয়! তাঁর পূর্বেও বহু রসূল অতিবাহিত হয়ে গেছেন। তাহলে কি তিনি যদি মৃত্যুবরণ করেন অথবা নিহত হন, তবে তোমরা পশ্চাদপসরণ করবে? বস্তূতঃ কেউ যদি পশ্চাদপসরণ করে, তবে তাতে আল্লাহর কিছুই ক্ষতি-বৃদ্ধি হবে না। আর যারা কৃতজ্ঞ, আল্লাহ তাদের সওয়াব দান করবেন।”
দ্বিতীয় বৈশিষ্ট্যঃ জিহাদ কোন ব্যক্তি বা ব্যক্তিবর্গের উপর নির্ভরশীল নয়
কোন নেতা বা নির্দিষ্ট কোন ব্যক্তিকে অগ্রাহ্য করে জিহাদ চলতেই থাকবে। কেউ কেউ বলে যে, আল্লাহর দ্বীন নির্দিষ্ট ব্যক্তিবর্গের উপর নির্ভরশীল নয়, আর যদি আল্লাহর দাসরা আল্লাহর পথে মৃত্যু বরণ করে, তবে আল্লাহ্ তাদের স্থলে অন্য ঈমানদারদের নিয়ে আসবেন যারা আল্লাহর কাজে অগ্রসর হবে। এটা সত্য। কিন্তু দেখা যায় যে, অধিকাংশ মানুষ যারা তা বলে, কেবলমাত্র কথা বলার মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখে। অন্যভাবে বললে, তারা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করে যে, জিহাদ ফী সাবিলিল্লাহ্ নির্দিষ্ট কিছু ব্যাক্তিবর্গ বা দলের উপর নির্ভরশীল। আমরা এটা প্রমাণ করব যে, জিহাদ কোন নির্দিষ্ট নেতৃত্ব বা নির্দিষ্ট ব্যক্তিবর্গের উপর নির্ভরশীল নয়।
প্রথম প্রমাণঃ
যদি আমরা বিশ্বাস করি যে জিহাদ কোন ব্যক্তির উপর নির্ভরশীল, তাহলে এটা আমাদের আক্বীদাকে দূর্বল করে দেয়, কেননা এটি ভুল আক্বীদা। এবং এটি “জিহাদ কিয়ামত পর্যন্ত চলবে”- এই নীতিকে বদলে দেয়। কেননা, আমরা জিহাদের সাথে কিছু বিশেষ ব্যক্তিবর্গকে সংশ্লিষ্ট করে ফেলছি এবং আমাদের কথাবার্তায় পরোক্ষভাবে প্রকাশ পায় যে, যদি অমুক-অমুক মারা যায়, তাহলে জিহাদ বন্ধ হয়ে যাবে। উল্লেখ্য যে, ইবন ক্বাদামাহ رحمه الله বলেছেন যে, “ইমামের অনুপস্থিতি যেন জিহাদ বিলম্বিত বা স্থগিত করার কারণ না হয়।”
দ্বিতীয় প্রমাণঃ
আল্লাহ্ সাহাবাদের এমনভাবে গড়ে তুলেছেন যার ফলে সাহাবাগণ তাঁর উপরই নির্ভর করত এবং সম্পূর্ণভাবে ইসলামকে আকড়ে ধরে ছিল।
রসূল ﷺ তাদের দেখিয়েছেন যে, নির্দিষ্ট কোন ব্যক্তির উপর নির্ভর করা ঠিক না, কারণ যখন সেই ব্যক্তি মারা যায়, তখন জিহাদও বন্ধ হয়ে যায়। একই সাথে, আল্লাহ্ রসূল ﷺ-এর উপরও নির্ভর না করার জন্য আয়াত নাযিল করেন।
﴿وَمَا مُحَمَّدٌ إِلَّا رَسُولٌ قَدْ خَلَتْ مِنْ قَبْلِهِ الرُّسُلُ أَفَإِنْ مَاتَ أَوْ قُتِلَ انْقَلَبْتُمْ عَلَى أَعْقَابِكُمْ وَمَنْ يَنْقَلِبْ عَلَى عَقِبَيْهِ فَلَنْ يَضُرَّ اللَّهَ شَيْئًا وَسَيَجْزِي اللَّهُ الشَّاكِرِينَ﴾
“আর মুহাম্মদ একজন রসূল বৈ তো নয়! তাঁর পূর্বেও বহু রসূল অতিবাহিত হয়ে গেছেন। তাহলে কি তিনি যদি মৃত্যুবরণ করেন অথবা নিহত হন, তবে তোমরা পশ্চাদপসরণ করবে? বস্তূতঃ কেউ যদি পশ্চাদপসরণ করে, তবে তাতে আল্লাহর কিছুই ক্ষতি-বৃদ্ধি হবে না। আর যারা কৃতজ্ঞ, আল্লাহ তাদের সওয়াব দান করবেন।”
এই আয়াতটি সাহাবাদের এটা শিক্ষা দিতেই নাযিল হয়েছিল যে, কোন ইবাদতই নির্দিষ্ট ব্যক্তির উপর নির্ভরশীল নয়। ইসলাম কেবল আল্লাহরই অধিকারভূক্ত আর কারও নয়। অতএব, আল্লাহর উপর তাওয়াক্কুল কর, মুহাম্মদ ﷺ বা অন্য কারও উপর নয়।
এখানে আমরা শিরক বা আল্লাহর সাথে কোন ব্যক্তিকে শরীক করা নিয়ে আলোচনা করছি না বরং বলতে চাচ্ছি যে, কিছু মানুষ মনে করে যে, আল্লাহ অমুককে নেতৃত্ব দিয়েছেন বা অমুককে জিহাদের অংশ করেছেন বলেই জিহাদ সফল হয়েছে। এটা একটি ভুল ধারণা।
এবার এই আয়াতের তাফসীর নিয়ে আলোচনা করা যাক। ইমাম ইবন কাসীর رحمه الله বলেছেন যে, এই আয়াতটি নাযিল হয়েছিল উহুদ যুদ্ধের সময় যখন এক কুরাইশ রসূল ﷺ-কে পাথর দিয়ে আঘাত করেছিল এবং ভেবেছিল সে তাঁকে হত্যা করেছে। সে তার লোকদের নিকট গিয়ে এটা প্রচার করে দিল। এই গুজব চারদিকে ছড়িয়ে পড়লে তা মুসলিমদের কানেও এলো যে, মুহাম্মদ ﷺ মৃত্যুবরণ করেছেন। এ কারণে কিছু মুসলিম হতাশ হয়ে পড়লে আল্লাহ্ এই আয়াতটি তখন নাযিল করলেন যে, “মুহাম্মদ ﷺ একজন রসূল ব্যতীত আর কিছুই নয়। এবং এর আগে আরও রসূল এসেছিল। এখন যদি সে মৃত্যু বরণ করে, তবে কি তোমরা পশ্চদপসরণ করবে এবং দ্বীন ত্যাগ করবে?” তোমরা কি তাঁর উপর নির্ভরশীল, না আল্লাহর উপর? এই আয়াত দ্বারা কিছু সাহাবাদের সমালোচনা করা হয়েছে। এই খবর দ্বারা কিছু মুসলিম প্রভাবিত হয়েছিল। আবার কিছু মুসলিমের উপর এর কোন প্রভাবও পড়েনি।
আনসারদের মধ্য থেকে একজন মুসলিম বলেছিলঃ “যদি তিনি মারা গিয়েও থাকেন, তিনি তো তাঁর বার্তা পৌছিয়েই গিয়েছেন। অতএব, তার জন্য যুদ্ধ কর এবং তাঁর মত মৃত্যু বরণ করে নাও।” এই সাহাবী এ গুজবের কারণে ভেঙ্গে পড়ার বদলে বরং আরও শক্তিশালী ও দৃঢ় চিত্তের অধিকারী হয়েছিল। কেননা যেই পৃষ্ঠপ্রদর্শন করেছে, তারা কেবল নিজেদেরই ক্ষতি সাধন করেছিল।
যখন রসূল ﷺ মৃত্যুবরণ করেছিলেন, আবু বকর (রাযিঃ) রসূল ﷺ -এর বাড়িতে আয়শা (রাযিঃ) -এর ঘরে গেলেন এবং তিনি রসূল ﷺ-এর কপালে চুম্বন করলেন আর বললেন, “জীবিত অবস্থায় আপনি ছিলেন পবিত্র এবং মৃত অবস্থায়ও, আল্লাহ্ আপনাকে দু’বার মৃত্যুর স্বাদ আস্বাদন করাবেন না।” এরপর তিনি মসজিদ গেলেন যেখানে উমর (রাযিঃ) মানুষদের সাথে কথা বলছিল। উমর (রাযিঃ) এটা শুনতেই চাচ্ছিলেন না যে, রসূল ﷺ মারা গেছেন। সে মানুষকে বলে বেড়াতে লাগল, “যে-ই বলবে যে রসূল ﷺ মারা গেছেন আমি তার শিরচ্ছেদ করব। মূসা যেমন আল্লাহর সাথে দেখা করতে গিয়েছিলেন, ঠিক তেমনি মুহাম্মদ ﷺ-ও আল্লাহর সাথে সাক্ষাত করতে গিয়েছেন। অতএব, তিনি ফিরে আসবেন।” আবু বকর (রাযিঃ) উমর (রাযিঃ) -কে থামিয়ে বললেমঃ “হে মানুষ! যে মুহাম্মদের ﷺ ইবাদত করত, সে জানুক যে মুহাম্মদ ﷺ মারা গিয়েছেন। আর যে আল্লাহর ইবাদত করত, সে জানুক যে আল্লাহ্ জীবিত এবং তিনি চিরঞ্জীব।” এরপর তিনি এই আয়াতটি তিলাওয়াত করলেন, সবাই এই আয়াতটি জানত কিন্তু যখন তারা এটি আবু বকর (রাযিঃ)-এর মুখে আবার শুনল, তখন এমন লাগল যেন, এটি তারা এই প্রথম শুনছে। কেননা, তারা এমন এক মানসিক অবস্থায় ছিল, যাতে করে তারা সবই ভুলে গিয়েছিল। এরপর সবাই পুনঃ পুনঃ এই আয়াতটিই তিলাওয়াত করতে থাকল।
সবাইকেই তার নির্দিষ্ট সময়ে মৃত্যু বরণ করতে হবে। এটিই ছিল শিক্ষা। আল্লাহ্ বলেনঃ
﴿ وَمَا كَانَ لِنَفْسٍ أَنْ تَمُوتَ إِلَّا بِإِذْنِ اللَّهِ كِتَابًا مُؤَجَّلًا ﴾
“আর আল্লাহর হুকুম ছাড়া কেউ মরতে পারে না -সেজন্য একটা সময় নির্ধারিত রয়েছে ...।”
আল্লাহ্ মহামহিম আরও বলেনঃ
﴿... وَمَا يُعَمَّرُ مِنْ مُعَمَّرٍ وَلَا يُنْقَصُ مِنْ عُمُرِهِ إِلَّا فِي كِتَابٍ إِنَّ ذَلِكَ عَلَى اللَّهِ يَسِيرٌ ﴾
“... কোন বয়স্ক ব্যক্তি বয়স পায় না। এবং তার বয়স হ্রাস পায় না; কিন্তূ তা লিখিত আছে কিতাবে। নিশ্চয় এটা আল্লাহর পক্ষে সহজ।”
লেখক বলেন, কেবল এই দুইটি আয়াতই কাপুরুষদের সাহসী বানাতে এবং আল্লাহর জন্য তাদের জীবন উৎসর্গ করে যুদ্ধ করতে উৎসাহ দিতে যথেষ্ট। কারণ সাহসিকতা কারও আয়ুষ্কাল কমায় না আর কাপুরুষতা আয়ুষ্কাল বৃদ্ধি করে না। আর আপনার যত ভয়ই থাকুক না কেন, তা আপনার আয়ু একটুও বাড়াবে না। যদি কোন মু’মিন এই পর্যায়ের ইয়াক্বীনের অধিকারী হয়, যখন সে অনুধাবন করতে পারে যে, মৃত্যু এটা নির্দিষ্ট সময়েই হবে এবং কোন কিছুই তাকে প্রতিহত করতে পারবে না, তখন সে হয়ে উঠে ভীষণ সাহসী, কোন কিছুই তাকে ভীত করতে পারে না। সে আল্লাহর সমস্ত শত্রুকে কেবল সেই সব সৃষ্টি হিসেবে দেখবে, যাদেরকে আল্লাহ্ই নিয়ন্ত্রণ করে। তাহলে ওদেরকে কিসের ভয়?
খালিদ বিন ওয়ালিদ এতই সাহসী ছিলেন যে, তিনি নিজেকে শত্রুবাহিনীর মাঝে ছুড়ে দিতেন। তিনি নিজের সম্পর্কে বলেছেনঃ “আমি নিজেকে শত্রুবাহিনীর মাঝে এমনভাবে ছুড়ে দিতাম যে, নিশ্চিতভাবে আমি জানতাম যে এখান থেকে বেঁচে ফেরা সম্ভব না। আর দেখ, এই বিছানাতেই আমার মৃত্যু হচ্ছে! অতএব, কাপুরুষদের চোখ যেন কোনদিন ঘুম না দেখে।” তিনি কাপুরুষদের বিরুদ্ধে দো’আ করলেন এটা বোঝানোর জন্য যে, কি করে মানুষ কাপুরুষ হতে পারে, যেখানে সাহসিকতা তাকে মারতে পারে নি।
লেখক এখানে ইরাকে পার্সিয়ান রাজত্বের ফুতুহাত (বিস্তার) এর সময়কার হাজ্জাজ বিন উদয় নাম্নী এক মুসলিমের কাহিনী বর্ণনা করেছেন। মুসলিম ও পার্সিয়ান সেনাবাহিনীর মাঝে একটি নদী ছিল। তো হাজ্জাজ মুসলিমদের বললঃ “নদী পার হয়ে তোমরা শত্রুর সাথে মিলিত হচ্ছো না কেন?” সে তার ঘোড়ার উপর বসে ছিল এবং ঘোড়া নিয়ে সে নদী পার হওয়া শুরু করলে অন্য মুসলিমরাও তাকে অনুসরণ করতে থাকল। পার্সিয়ান সেনাবাহিনী মুসলিমদের এভাবে ঘোড়া নিয়ে নদী পার হওয়ার দৃশ্য দেখে ভীষণ ঘাবড়িয়ে গেল। তারা চিৎকার করে উঠলঃ “দাইওয়ান! দাইওয়ান!” যার অর্থ- “জিন! জিন! তারা সবাই পালিয়ে গেল। এখানেই যুদ্ধের ইতি ঘটল। হাজ্জাজ এই ঘটনার পক্ষে যুক্তি দিতে গিয়ে বলেঃ “আল্লাহর হুকুম ব্যতিরেকে কেউই মৃত্যু মুখে পতিত হয় না। যদি আল্লাহ্ চান কেবল তাহলেই আমাদের মৃত্যু হবে। মৃত্যু থেকে আমরা কেউই সুরক্ষিত নই। যদি আমাদের মৃত্যু না হওয়ার থাকে, তাহলে আল্লাহ্ই আমাদের রক্ষা করবেন।”
যাদ বিন মাসীর গ্রন্থের লেখক তার তাফসীরে বলেছেন যে, ইবন আব্বাস (রাযিঃ) বলেছেনঃ “শয়তান উহুদের ময়দানে চিৎকার করে ঘোষণা দিয়েছিল যে মুহাম্মদ ﷺ মারা গিয়েছেন।” তখন কিছু মুসলিম বলল যে, “যদি মুহাম্মদ ﷺ মারা গিয়ে থাকেন, তো চল আমরা আত্মসমর্পন করি। এরা তো আমাদেরই গোত্র, স্বজন। যদি মুহাম্মদ ﷺ বেঁচে থাকতেন, তবে আমরা পরাজিত হতাম না।” তারা আসলে যুদ্ধ না করার পক্ষে যুক্তি বের করেছিল। আব্দুল হাক বলেনঃ কিছু মুনাফিকুন বলল যে, “মুহাম্মদ ﷺ তো মারা গেছেন, চল আমরা আমাদের পূর্বের ধর্মে ফিরে যাই।”
আল্লাহ্ মানুষদের পরীক্ষা করেন এবং এই পরীক্ষার ফলাফল বিভিন্ন হয়। পরীক্ষার প্রতি আমাদের প্রতিক্রিয়া কেমন হয় এর উপরই ফলাফল নির্ভরশীল। আমাদের জীবন এরকম বিভিন্ন পরীক্ষা দিয়ে পরিপূর্ণ। আমরা যদি এমন পরীক্ষায় পাশ করে যেতে পারি, তবে আমরা ক্রমান্বয়ে বিশুদ্ধ থেকে বিশুদ্ধতর হতে পারি।
আশ-শাউকানি رحمه الله উল্লেখ করেন কিভাবে শয়তান উহুদের দিনে চিৎকার করেছিল এবং কিছু মুসলিম বলে উঠলঃ “মুহাম্মদ ﷺ যদি রসূল হয়ে থাকেন, তবে তিনি মরবেন না।” অতঃপর আল্লাহ্ এই আয়াতটি নাযিল করেন। আল্লাহর আদেশেই তাঁর রসূলগণের কেউ কেউ নিহত হতে পারে।
কিছু মুসলিম বললঃ “চলো, আব্দুল্লাহ্ ইবন উবাইয়ের কাছে চলো। তাকে কুরাইশদের কাছে আমাদের আত্মসমর্পনের মধ্যস্থতা করে দিতে বলি।” ওরা তার কাছে গেল কেননা ওরা জানত যে কুফ্ফারদের সাথে তার ভাল সম্পর্ক ছিল।
আনসারদের একজন আনাস বিন নাদ্র (রাযিঃ) বলেছিলেনঃ “যদিও বা মুহাম্মদ ﷺ নিহত হয়ে থাকেন, আল্লাহ্ তো নিহত হননি। অতএব, চল আল্লাহর দ্বীনের জন্য আমরা লড়াই করি।” সে কিছু মুসলিমকে যুদ্ধ ময়দানে বসে থাকতে দেখে তাদের জিজ্ঞাসা করল, “কি ব্যাপার তারা কি করছে।” তারা জবাব দিলঃ “মুহাম্মদ ﷺ নিহত হয়েছেন। (এখন) আমরা কি করব?” তিনি তাদের বললঃ “যদি মুহাম্মদ ﷺ নিহত হয়ে থাকেন, তবে তোমরা উঠে দাড়াও, যুদ্ধ কর এবং তাঁর মত তোমরাও নিহত হও।” তার কথা শুনে কিছু মুসলিম তাই করল এবং নিহত হল।
সঠিক এবং ভ্রান্ত ধারণাঃ
যারা ভ্রান্ত ধারণার বশবর্তী হয়েছিল তাদের ২টি শ্রেণীতে ভাগ করা যায়-
ক. যারা রসূল ﷺ-এর মৃত্যুর সংবাদের কারণে অকৃতকার্য হয়েছিল। তারা দূর্বল হয়ে পড়েছিল এবং এই ধাক্কা সামাল দিয়ে উঠতে পারে নি। তারা শান্তি চেয়েছিল এবং মৃত্যু এড়াতে চেয়েছিল।
খ. এরচেয়েও খারাপ অবস্থানে ছিল তারা, যারা কুফরের দিকে ফিরে গিয়েছিল।
জিহাদ রসূল ﷺ-এর উপর নির্ভরশীল নয়। যে দু’শ্রেণীর লোকেরা ভ্রান্ত পথ অবলম্বন করেছিল, তাদের মতই আজকের অনেক মুসলিমদের অবস্থা। আমরা অনেক মুসলিমকেই বলতে শুনি যে, যদি তালেবানরা সঠিক পথের উপর থাকত, তবে তারা পরাজিত হত না। কিছু লোক বলেছিল, ইসলাম ভুল ধর্ম, কেননা মুহাম্মদ ﷺ যুদ্ধের ময়দানে মৃত্যুবরণ করেছে। ঠিক একই ঘটনা আমরা এখনও দেখি, যখন মুসলিমরা বলে যে, তালেবানরা ভুল ছিল, কেননা তারা যুদ্ধে হেরে গিয়েছে। এটা বলাটাই ভুল। কেউ কেউ বলে যে আরব মুজাহিদীনদের যার যার দেশে ফিরে গিয়ে সরকারের সাথে শান্তি প্রতিষ্ঠা করা এবং তাদের সাথে হাত মিলানো উচিত। এটা মুসলিমদের আব্দুল্লাহ্ ইবনে উবাইর নিকট গিয়ে কুরাইশদের নিকট তাদের আত্মসমর্পন করার ব্যবস্থা করতে বলারই মত। ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি ঘটে। দেখা যায় যে, আজ যারা পথভ্রষ্ট তারা আসলে তাদের পূর্বেরই কারও মত একই ভুল পথ অনুসরণ করেছে।
যারা সঠিক পথ অবলম্বন করে তারা আনাস বিন নাদর (রাযিঃ)-এর মত যে মানুষদের বলেছিল, “তোমরা বসে আছ কেন?” তারা বসেছিল কারণ মুহাম্মদ ﷺ নিহত হয়েছেন। তিনি বলেছিলনেঃ “তাহলে তোমরা কিসের জন্য বেঁচে থাকবে? উঠে দাঁড়াও এবং তাঁর মত যুদ্ধ কর।” তারা আবু বকর (রাযিঃ) -এর মতও যিনি বলেছিলেন, “যে মুহাম্মদ ﷺ ইবাদত করে সে জানুক ... তিনি চিরঞ্জীব।” তারা আলী বিন আবু তালিব (রাযিঃ) -এরও মত যিনি বলেছিলেন, “যদি মুহাম্মদ ﷺ নিহত হয়ে থাকেন, তবে আমি তার দ্বীনের জন্য লড়াই করব।” এই মানুষরাই সঠিক ধারণার অনুরসরণ করে, জিহাদ কোন ব্যক্তির উপর নির্ভরশীল নয়, যদিও বা সে ব্যক্তি মুহাম্মদ ﷺ -ও হয়।
আল্লাহ্ বলেনঃ
﴿ وَلَا تَهِنُوا وَلَا تَحْزَنُوا وَأَنْتُمُ الْأَعْلَوْنَ إِنْ كُنْتُمْ مُؤْمِنِينَ ﴾
“আর তোমরা নিরাশ হয়ো না এবং দুঃখ করো না। যদি তোমরা মুমিন হও তবে, তোমরাই জয়ী হবে।”
“আর তোমরা নিরাশ হয়ো না এবং দুঃখ করো না। যদি তোমরা মুমিন হও তবে, তোমরাই জয়ী হবে।”
এই আয়াতটি উহুদ যুদ্ধের পরে নাযিল হয়েছিল সাহাবাদের এটা বোঝাতে যে- পারিপার্শ্বিক অবস্থা যাই হোক না কেন, তা যেন কখনই তাদেরকে দূর্বল না করে দেয়, কেননা তারা সবসময়ই মর্যাদায় উচ্চ এবং শেষ সফলতা মুত্তাকীদের জন্যই।
পরম দয়ালু আল্লাহ বলেনঃ
﴿ أَوَلَمَّا أَصَابَتْكُمْ مُصِيبَةٌ قَدْ أَصَبْتُمْ مِثْلَيْهَا قُلْتُمْ أَنَّى هَذَا قُلْ هُوَ مِنْ عِنْدِ أَنْفُسِكُمْ إِنَّ اللَّهَ عَلَى كُلِّ شَيْءٍ قَدِيرٌ ﴾
“যখন তোমাদের উপর একটি মুসীবত এসে পৌঁছাল, অথচ তোমরা তার পূর্বেই দ্বিগুণ কষ্টে পৌঁছে গিয়েছ, তখন কি তোমরা বলবে, এটা কোথা থেকে এল? তাহলে বলে দাও, এ কষ্ট তোমাদের উপর পৌঁছেছে তোমারই পক্ষ থেকে। নিশ্চয়ই আল্লাহ্ প্রত্যেক বিষয়ের উপর ক্ষমতাশীল।”
অতএব, ঈমানদারদের এই আয়াতটি তিলাওয়াত করা উচিত যখন তারা পরাজিত হয়, যাতে আল্লাহর উপর তাদের ঈমান ও ইয়াক্বীন বৃদ্ধি পায় এবং তারা আল্লাহর সত্যিকার আউলিয়ায় পরিণত হতে পারে। তাদের আরও তিলাওয়াত করা উচিতঃ
﴿ وَلَا تَهِنُوا وَلَا تَحْزَنُوا وَأَنْتُمُ الْأَعْلَوْنَ إِنْ كُنْتُمْ مُؤْمِنِينَ ﴾
“আর তোমরা নিরাশ হয়ো না এবং দুঃখ করো না। যদি তোমরা মুমিন হও তবে, তোমরাই জয়ী হবে।”
জয়, পরাজয় সম্পূর্ণভাবে আল্লাহর তরফ থেকে আসেঃ
বিজয় আল্লাহর অধিকারভূক্ত, আমাদের নয়। আমরা এটা অর্জন করিনি বা একে এতদূরে নিয়েও আসিনি। এটা পুরোটাই আল্লাহর পক্ষ থেকে আমাদের জন্য উপহার, যেমন আল্লাহ্ বলেনঃ
﴿ فَلَمْ تَقْتُلُوهُمْ وَلَكِنَّ اللَّهَ قَتَلَهُمْ وَمَا رَمَيْتَ إِذْ رَمَيْتَ وَلَكِنَّ اللَّهَ رَمَى وَلِيُبْلِيَ الْمُؤْمِنِينَ مِنْهُ بَلَاءً حَسَنًا إِنَّ اللَّهَ سَمِيعٌ عَلِيمٌ ﴾
“সুতরাং তোমরা তাদের হত্যা করনি, বরং আল্লাহই তাদের হত্যা করেছে। আর তুমি মাটির মুষ্টি নিক্ষেপ করনি যখন তা নিক্ষেপ করা হয়েছিল, বরং তা নিক্ষেপ করেছিলেন আল্লাহ স্বয়ং, যেন ঈমানদারদের প্রতি যথাযথ ইহসান করতে পারেন; নিঃসন্দেহে আল্লাহ শ্রবনকারী ও পরিজ্ঞাত।
এবং
﴿ وَمَا جَعَلَهُ اللَّهُ إِلَّا بُشْرَى لَكُمْ وَلِتَطْمَئِنَّ قُلُوبُكُمْ بِهِ وَمَا النَّصْرُ إِلَّا مِنْ عِنْدِ اللَّهِ الْعَزِيزِ الْحَكِيمِ ﴾
“বস্তূতঃ এটা তো আল্লাহ তোমাদের সুসংবাদ দান করলেন, যাতে তোমাদের মনে এতে সান্ত¡না আসতে পারে। আর সাহায্য শুধুমাত্র পরাক্রান্ত, মহাজ্ঞানী আল্লাহরই পক্ষ থেকে।”
কুরআনে কখনই বিজয়, মু’মিনদের উপর আরোপ করা হয়নি। এটা সবসময় আল্লাহর করুণা হিসেবে পরিগণিত হয়েছে। আর যদি ঈমানদাররা বিজয়ী হয়, তবে তারা বলবেঃ
﴿ وَاذْكُرُوا إِذْ أَنْتُمْ قَلِيلٌ مُسْتَضْعَفُونَ فِي الْأَرْضِ تَخَافُونَ أَنْ يَتَخَطَّفَكُمُ النَّاسُ فَآَوَاكُمْ وَأَيَّدَكُمْ بِنَصْرِهِ وَرَزَقَكُمْ مِنَ الطَّيِّبَاتِ لَعَلَّكُمْ تَشْكُرُونَ ﴾
“স্মরণ কর, তোমরা ছিলে স্বল্প সংখ্যক, পৃথিবীতে তোমরা দুর্বলরূপে পরিগণিত হতে। তোমরা আশংকা করতে যে, লোকেরা তোমাদেরকে অকস্মাৎ ধরে নিয়ে যাবে। অতঃপর তিনি তোমাদেরকে আশ্রয় দেন, স্বীয় সাহায্য দ্বারা তোমাদেরকে উত্তম বস্তুসমূহ জীবিকাসরূপ দান করেন যাতে তোমরা কৃতজ্ঞ হও।”
আল্লাহর সাহায্য ও ভালবাসার প্রতি আমাদের বিশ্বাস ও আস্থা বাড়ানোই এর উদ্দেশ্য। অতএব, আমরা বিজয়ী বা বিজিত হই এটা আমাদেরই ভালোর জন্য, কেননা এতে আমাদের ঈমান ও ইয়াক্বীন বৃদ্ধি পায়। আল্লাহ্ এতেই সন্তুষ্ট হন যে, আমাদের কাজকর্ম সবই আল্লাহর আদেশ নিষেধ অনুযায়ী হবে।
আরও পড়ুন
Comment