মানবজীবনে এমন কিছু প্রতিবন্ধকতা রয়েছে যা শ্রেষ্ঠ অন্তরসমূহ এবং উৎকৃষ্ট আকাঙ্ক্ষাসমূহকে ফলপ্রসূ কাজে অংশগ্রহণে এবং শ্বাশ্বত কর্তব্য পালনে বাঁধা প্রদান করে। এসকল বাঁধাগ্রস্থ ব্যাক্তিবর্গ মূলনীতি ও নিজস্ব চিন্তাভাবনার প্রতিযোগিতার মাঝে দিনাতিপাত করে। জাঁকজমকপূর্ণ সভা-সেমিনারের জৌলুসপূর্ণ আলোচনা এবং কাগজের পাতায় যা লেখা থাকে তার সৌন্দর্য মানুষ খুব সহজেই অনুভব করে। কিন্তু যখনই তারা তাত্ত্বিক আলোচনা এবং চিন্তাভাবনার গণ্ডি থেকে বের হয়ে বাস্তবতা ও প্রয়োগক্ষেত্রের সম্মুখীন হয়, তখন এক বড় ধাক্কা খায়। তারা ব্যর্থ হয় চাকচিক্যময় চিন্তাচেতনাকে বাস্তবতার সাথে সমন্বয় সাধন করতে। ফলশ্রুতিতে এরা ক্ষতিগ্রস্থ হয় এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রে নিন্দিত হয়।
উদাহরণত, যখন কোনো আলেম বিবাহিত ব্যাক্তির যিনার হদ নিয়ে শরিয়তের শ্রেষ্ঠত্ব ও হিকমতের আলোচনাকরতঃ বলেন যে, ‘একজন পুরুষ ও মহিলাকে (যিনার অভিযুক্ত) শক্ত করে বেঁধে জনসম্মুখে উপস্থিত করা হলো। তারপর পাথর জড়ো করা হলো। অতঃপর মানুষজন যিনাকারীদের প্রতি এই পাথরগুলো ছুড়তে লাগল তাদের নিহত হওয়া অবধি’। এ বিষয়টির একদিকে রয়েছে বাস্তব অনুভূতি এবং অপরদিকে রয়েছে মানুষের উপর এর প্রভাব।
যখন আপনি এ দৃশ্যটি নিয়ে চিন্তা করবেন তখন পুর্বেকার প্রফুল্লতা ও আনন্দের স্থলে জায়গা করে নিবে অপরাধীর প্রতি সহানুভূতি। অপরাধীর কান্না, অঝোর ধারায় অশ্রুবর্ষণকারী অবস্থায় তার সন্তানকে আটকে রাখার দৃশ্য অস্থির করে তুলবে আপনার অন্তরকে। এ জাতীয় দৃশ্য সামনে রেখে যে কোনো আলেমের পক্ষে শরীয়তের মহত্ব ও হিকমতকে ফুটিয়ে তোলা কষ্টসাধ্য হবে। উক্ত আলেম নিজেই হয়তো রক্ত দেখে মূর্ছা যাবে। হয়তো রজমকৃত ব্যাক্তির ভূপাতিত মৃতদেহ দেখে শায়খ উর্ধ্বশ্বাসে দৌড়ে পালাবে। কেননা, চমকপ্রদ কল্পনা আর বাস্তবতার মাঝে রয়েছে বিশাল ফারাক।
একইভাবে, মানুষ জিহাদ নিয়ে কথা বলে যেহেতু জিহাদ ফি সাবিলিল্লাহ্* অত্যন্ত শ্রুতিমধুর একটি শব্দ। কিন্তু বাস্তব জিহাদ, জিহাদের প্রতিটি ঘটনাপ্রবাহ কিন্তু সুখকর নয়। জিহাদ কোনো ঝংকার তোলা বক্তৃতা বা সুন্দর সুন্দর কথার নাম নয়। জিহাদ মানেই গনীমত কিংবা বন্দীলাভ নয়। আর জিহাদ কোনো অনলবর্ষী বক্তার বক্তৃতাও নয়।
বরঞ্চ, জিহাদের মাঝে রয়েছে প্রিয় ব্যাক্তিদের মৃত্যু, বন্ধুর আহত হওয়ার দৃশ্য, মাথার ঠিক উপর দিয়ে শেল উড়ে যাওয়া, ধনসম্পদ হারিয়ে ফেলা এবং কোনো সাহায্যকারী না থাকা। বরং অন্যভাবে বলতে গেলে, জিহাদের মাঝে রয়েছে সর্বপ্রকারের ভয়ংকর সব কষ্ট।
জিহাদের ময়দানে সৈন্যসমাবেশ ঘটে। মানুষের মাঝে ঝগড়া-বিবাদ হয়ে থাকে। এ তাকে মারে, সে তাজে ধরে, ও ঝগড়া করে ইত্যাদি ইত্যাদি। সর্বোপরি জিহাদ হলো গণআন্দোলন। স্বাভাবিকভাবেই তাই এর মাঝেও রয়েছে ভুলভ্রান্তি, ইজতিহাদ, অপব্যাখ্যা ইত্যাদি। কখনো বিষয়গুলো সুখকর হয়, কখনো হয় না। এখানেও রয়েছে নির্দিষ্ট কিছু সীমাবদ্ধতা; সুখকর কল্পনা ও বাস্তবতার মধ্যকার এক বিরাট ব্যাবধান।
আমরা যদি ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে মানুষের কাল্পনিক ধ্যানধারণা ও চিন্তাচেতনার দিকে তাকাই তাহলে দেখতে পাব যে, অধিকাংশ মানুষ স্বপ্নের জগতে বসবাস করছে। তাদের দৃষ্টিভঙ্গী বাস্তবতা থেকে বহু দূরে। তাদের এই স্বপ্নের জগতে রয়েছে মনোরম দৃশ্যাবলী, অভিবাদন জানানোর জন্য গালিচা, মনোমুগ্ধকর রঙিন সব দৃশ্যকল্প আর সর্বদা বৃষ্টি বর্ষণকারী সুবিশাল এক আকাশ ইত্যাদি।
আর শত্রুরা যেন সদাসর্বদা ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে আছে এই ভেবে যে, যুদ্ধের ময়দানে ফেরেশতাগণ সার্বক্ষণিক আমাদের সাথে থেকে যুদ্ধ করে।
তারা ভাবতে ভালোবাসে যে, ইসলামী রাষ্ট্রে থাকবে না দারিদ্র্য আর অসুস্থতা। তারা যা চাইবে তার সবই তাদের সামনেই থাকবে। কিন্তু যদি আমরা নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর রাষ্ট্রের দিকে তাকাই তাহলে তা জান্নাততূল্য দেখতে পাব কি?
বরঞ্চ আমরা দেখতে পাব যে, মদিনার ইসলামী রাষ্ট্রে সাহাবাদের (রাদ্বিয়াল্লাহু ‘আনহুম) যন্ত্রনা-দুর্ভোগ মক্কার চাইতেও বেশি ছিল। সাহাবায়ে কেরামের (রাঃ) খন্দকের যুদ্ধের ভয়ংকর পরিস্থিতির সম্মুখীন কি মক্কাতে হয়েছিলেন? আল্লাহ্* তা’আলা বলেন,
“যখন তারা তোমাদের কাছে উপর-নিচ থেকে আসছিল তখন তোমাদের চোখ বিস্ফোরিত হচ্ছিল, প্রাণ কণ্ঠাগত হচ্ছিল। আর তোমরা আল্লাহ্*র ব্যাপারে বিরূপ ধারণা করছিলে। তখন মুমিনদেরকে পরীক্ষা করা হয়েছিল এবং তারা প্রকম্পিত হয়েছিল”। (সূরা আহযাব, ৩৩:১০-১১)
এই দৃশ্যপটকে বর্তমান সময়ে উলামা-মাশায়েখ কর্তৃক চিত্রিত ইসলামী রাষ্ট্রের মিলিয়ে দেখুন। তারা এমন রাষ্ট্রের প্রতিশ্রুতি দেন যাতে কোনো দুঃখ-কষ্ট থাকবে না, অস্তিত্ব থাকবে না কোনো ভয়ভীতির। প্রত্যেক মানুষের জন্য থাকবে বাসস্থান, প্রতিটি পেটের জন্য থাকবে খাদ্য। আর মানুষ তাদের এই স্বপ্ন বা প্রতিশ্রুত রাষ্ট্রের জন্যই বিভিন্ন কর্মসূচী বা তানজীমের সাথে সম্পৃক্ত হয়।
এর উপর ভিত্তি করে মানুষ আমদের কাছে এবং আমাদের জামাতের নিকটবর্তী হয়। কেননা তাদের মতিস্কে একথা ঘুরপাক খাচ্ছে যে, আমরা অন্যান্য জামাতের তুলনায় অধিকতর দুনিয়াবী নিয়ামতের নিরাপত্তা দিব।
কিন্তু আমি আপনাদের বলি, নিশ্চয়ই খুলাফায়ে রাশিদীনের তিনজনই হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন। আর তারা নিজেদের হত্যার পরিকল্পনার ব্যাপারে অবগত থাকা সত্ত্বেও কোনো মানুষের সহায়তা নেন নি।
উমার (রাঃ) সালাতুল ফজরের সময় মুসলিম উম্মাহর উলামা-মাশায়েখ, সেনানায়ক ও নেতৃবৃন্দের উপস্থিতিতে আল্লাহ্*র দুশমন আবু লুলুর হাতে শহীদ হোন।
উসমান (রাঃ) কিছু বিদ্রোহীর হাতে নিহত হোন। তারা মদীনায় প্রভাব বিস্তার করার পর উসমান (রাঃ) এর গৃহাভ্যন্তরে প্রবেশ করে। শহরের প্রাণকেন্দ্রে তারা সিয়ামরত উসমান রাঃ কে স্বগৃহে হত্যা করে ফেলে অজস্র মানুষের উপস্থিতি সত্ত্বেও।
আলী ইবন আবী তালিব (রাঃ) মসজিদে দাড়িয়ে ফজরের সময় মানুষদের সলাতের জন্য ডাকছিলেন। তার চারপাশে একদল লোকও ছিল। এমতাবস্থায় ইবন মুলজিম খারেজী তরবারী দ্বারা আলী রাঃ এর মাথায় আঘাত হানে।
এটা ছিল খেলাফাতে রাশেদার যুগ। আর পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহ তো সবারই জানা আছে।
যারা বাস্তবতাবিবর্জিত ইসলামী বিশ্ব নিয়ে আলীক স্বপ্ন দেখছে তারা গোলকধাঁধার মাঝে ঘুরপাক খাচ্ছে। তারা কল্পনার জগতে বসবাস করছে যা কি না তাদের পিছিয়ে পড়ার কারণ হচ্ছে। তাদের কল্পনায় যা আছে তারা তা বাস্তবায়নে সক্ষম নয়। কেননা, এজাতীয় চিন্তাধারা কাগজ-কলম আর কল্পনাতেই কেবল সম্ভব। এজাতীয় চিন্তাভাবনা আদৌ ইসলাম নয়।
বরং, ইসলাম হলো জীবন-সংগ্রামের নাম। যে সংগ্রামের মাঝে ত্রুটি-বিচ্যুতি, শুদ্ধ-অশুদ্ধ সবই বিদ্যমান। এই সংগ্রামী জীবন সঠিক বিষয়গুলিকে সহায়তা ও শক্তিশালী করে আর ভুলত্রুটিকে শুধরে দেয়।
ইসলামী বিশ্বে যেমন আদল-ইনসাফ থাকে, তেমনই থাকে জুলুমের অমানিশাও। এতে সত্যের যেমন উপস্থিতি রয়েছে, তেমনই রয়েছে মিথ্যাও। ইসলামী সমাজে প্রত্যেকেরই নিজ নিজ একটা অবস্থান রয়েছে।
ইসলাম ভুলের অস্তিত্বকে স্বীকার করে, সৃষ্টির মাঝে ভুল থাকাকে অনর্থক মনে করে না। ভুলের অস্তিত্ব রয়েছে বলেই আল্লাহ তা'আলা হুদুদ ও শাস্তি নাযিল করেছেন। নাযিল করেছেন আহকাম।
আল্লাহ্* সুবহানাহু ওয়া তা'আলার অলঙ্ঘনীয় বাণী প্রতিটি মুসলিম, মুওয়াহহিদ ও মুজাহিদ সমাজের জন্য। এই চিরন্তন বাণী কোনো কাফির-মুশরিকের জন্য নয়। এতদসত্ত্বেও ফিতনার সময়ে আলী রাঃ এবং আয়িশা রাঃ ও মুআবিয়া রাঃ এর মাঝে দ্বন্দ্ব হয়েছিল।
যদি আমরা বাস্তবতা অনুসন্ধানের চেষ্টা করি এবং গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করি, তবে এমন বিষয়াদির উপস্থিতি দেখতে পাই যা শিশুকে বৃদ্ধ বানিয়ে ছাড়ে। অথচ তা ছিল খাইরুল কুরুন তথা সর্বোত্তম প্রজন্মের সময় সংঘটিত।
উদাহরণত,
ঘটনা ১ঃ খারেজী ফিতনা। চার হাজার খাওয়ারিজ আলী রাঃ এর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার সংকল্প করে। আলী রাঃ তাদের কাছে প্রস্তাব পাঠান, "এসো আমাদের এবং তোমাদের প্রতিপক্ষ মুআবিয়া রাঃ কে প্রতিহত করি"। তারা তা প্রত্যাখ্যান করে এবং আলী রাঃ কে তাকফির করে এবং তাঁকে তাওবা করতে বলে। এতেই তারা ক্ষান্ত থাকেনি। আব্দুল্লাহ্* ইবন খাব্বাব ইবনুল আরাত রাঃ ও উনার গর্ভবতী স্ত্রীকে নির্মমভাবে শহীদ করে দেয়। অতঃপর নাহরাওয়ানের ভূমিতে আলী রাঃ যুদ্ধাহত চারশত খারেজী ব্যতীত বাকি সকল খাওয়ারিজকে হত্যা করেন।
ঘটনা ২ঃ জামাল যুদ্ধ। যা সংঘটিত হয়েছিল বসরার উপকণ্ঠে। উমর ইবন শাইবার রেওয়াত অনুযায়ী এ যুদ্ধটি সংঘটিত হয়েছিল মুসলিমদের দুই গোষ্ঠীর মধ্যে। বরং বলা চলে দুই গোত্রের মাঝে (মুদার গোত্রের বিরুদ্ধে মুদার গোত্রের, রবীয়া গোত্রের বিরুদ্ধে রবীয়া গোত্রের ...) একই জাতিগোষ্ঠী দ্বীন রীতিনীতির ভাইয়ে-ভাইয়ে যুদ্ধ।
এ যুদ্ধে তালহা রাঃ ও যুবায়ের রাঃ শহীদ হোন। যারা ছিলেন আশারায়ে মুবাশশিরার অন্তর্ভুক্ত।
ঘটনা ৩ঃ সিফফিনের যুদ্ধ। সন্ধির প্রতি উৎসাহিত করা সত্ত্বেও এ যুদ্ধটি সংঘটিত হয় আলী রাঃ ও মুআবিয়া রাঃ এর মাঝে। কিছু মানুষ বলছিল শামবাসী (যারা ছিল মুআবিয়া রাঃ এর অধীন) ধ্বংসের পর কে শামের সীমান্তের নিরাপত্তা দিবে? ইরাকবাসী (যারা ছিল আলী রাঃ এর অধীন) ধ্বংসের পর কে ইরাকের সীমান্তের নিরাপত্তা দিবে? নারী-শিশুদেরই বা কী হবে?
দুর্বল এক রেওয়ায়েতে এ যুদ্ধে ভয়ানক হত্যাকাণ্ডের কথা উল্লেখ রয়েছে। যাই হোক, এতে কোনো সন্দেহ নেই এটি একটি বড় যুদ্ধ ছিল।
ঘটনা ৪ঃ ইসলাম গ্রহণের পর কিছু লোকের পুনরায় খ্রিস্টধর্মে ফিরে যাওয়া। এমনকি তারা একথা পর্যন্ত বলতে থাকে,"আমরা যে ধর্মত্যাগ (অর্থাৎ খ্রিস্টধর্ম) করেছি তা ইসলাম অপেক্ষা উত্তম। অযথা রক্তপাত, মুসাফিরদের ভীতসন্ত্রস্তকরণ এবং ধনসম্পদের লুটপাট থেকে ইসলাম নিরাপত্তা দিতে পারে না"। (তাবারী)
আলী রাঃ তাদের রিদ্দাহ (ধর্মত্যাগ) এর ফলাফলস্বরূপ তাদের সকলকে হত্যা করেন।
এখানেই থেমে থাকেনি। অতঃপর হুসাইন রাঃ এর শাহদাত, আব্দুল্লাহ্* ইবন যুবাইরের যুদ্ধ ইত্যাদি একের পর এক সংঘটিত হয়; যার তালিকা অনেক লম্বা। আর এটাই মানবজীবনের বাস্তবতা। তাই কোনো বুদ্ধিমান ব্যাক্তির জন্য সংগত নয় এবিষয়গুলো ভুলে থাকা এবং কঠিন বাস্তবতার হাল ছেড়ে দেয়া।
মানুষ মনে করে একজন মুসলিমের জীবন জুড়ে থাকবে শুধু রাতের সালাত, দিনের সিয়াম, ক্ষমা, দানশীলতা প্রভৃতি। সর্বোপরি সর্বপ্রকার কল্যাণের সমাবেশ। এমনকি সাধারণ মানুষের কল্পনার ক্যানভাসে থাকে প্রত্যেক মুসলিম মানে আল্লাহ্*র ওলী হওয়ার চিত্র। এমনটা কেবল কল্পনাতেই সম্ভব, বাস্তবে যার কোনো ভিত্তি নেই। এব্যাপারে ইবন কুতাইবার 'আল-মাআরিফ' দেখুন। জেনে রাখুন,
ওলী, একজন মাটির তৈরী মানুষ।
মুজাহিদ, একজন একজন মাটির তৈরী মানুষ।
প্রকৃতপক্ষে ইসলাম ও মুসলিমদের সম্পর্কে অতিমানবীয় ও বাস্তবতাবিবর্জিত ধারণা দানকারী চলচ্চিত্র নির্মাণ করা, জিন ও ফেরেশতাদের নিয়ে বানানো ছবি থেকেও অধিকতর অবমাননাকর।
তাই এজাতীয় কল্পনাবিলাসী ব্যাক্তিদের ব্যাপারে আমরা বলব যে, তারা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়াদি ছেড়ে ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র বিষয়ে মশগুল হয়ে আছে। তাদের এই অতিসংবেদনশীলতা তাদেরকে ভুলভ্রান্তির ডাস্টবিনে নিক্ষেপ করেছে এবং আল্লাহ্*র অনুগ্রহ, কল্যাণ ও নিয়ামত অবলোকন করা থেকে দূরে ঠেলে দিয়েছে। (কেননা তারা অন্যের ছোটখাটো বিচ্যুতিকেও স্বাভাবিকভাবে গ্রহণ করতে পারে না, ফলে তুচ্ছাতিতুচ্ছ বিষয় নিয়ে ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়ে)।
নিশ্চয়ই জিহাদ ফি সাবিলিল্লাহ্* একটি গণআন্দোলন, যাতে বিভিন্ন স্বভাব-প্রকৃতির মানুষ শামিল হয়। যার দায়িত্ব অস্ত্র নিয়ে বেরিয়ে পড়া হবে তার জন্য অস্ত্রের মোকাবিলা অস্ত্র দিয়েই করতে হবে। অগ্নিঝরা বক্তৃতা কিংবা ক্ষুরধার লেখনী দ্বারা শত্রুর বুলেটকে প্রতিহত করা নিশ্চয়ই তার কাজ নয়। বরং, তার কাজ হলো স্বীয় জীবনকে বারুদের উত্তাপ আস্বাদন করানো। আর এটাই আল্লাহ্* তা'আলার অমোঘ নীতি।
মনে করিয়ে দিতে চাই, নিশ্চয়ই তিন শহীদ খলিফার কেউই কাফিরের হাতে নিহত হোন নি। বরং মুসলিম নামধারী পাপিষ্ঠ বিদআতীদের হাতে নিহত হয়েছেন। উমার রাঃ এর হত্যাকারী আবু লু'লু সম্পর্কে কাতাদা রহঃ এর অভিমত হলো - সে মুশরিকদের অন্তর্ভুক্ত নয়, যদিও তাকে মুশরিকদের দিকে সম্বোধন করা হয়।
উসমান রাঃ এর হত্যাকারী বিদ্রোহীরা মুসলিমই ছিল। যাদের কেউ কেউ পরবর্তীতে আলী রাঃ এর বাহিনীর সেনানায়কও হয়েছিল।
আলী রাঃ এর হত্যাকারী ইবন মুলযিম ছিল খারেজী।
তাই যে এই রাস্তায় পা রাখবে এবং অস্ত্র তুলে নিবে তার লক্ষ্য হবে আল্লাহ্*র জমিনে জিহাদের মাধ্যমে দ্বীন প্রতিষ্ঠা করা। যারা স্বীয় জীবনকে আল্লাহ্*র পথে ওয়াকফ করে দিবে তাগুতের সিংহাসন ধ্বংসের মাধ্যমে তাগুতের দম্ভ চূর্ণ করে ইনসাফ ফিরিয়ে আনতে। এই কণ্টকাকীর্ণ পথের পথিকের মাঝে ত্রুটিবিচ্যুতি বিদ্যমান থাকতেই পারে। তবে এটা ঠিক, সেই আরামপ্রিয় ব্যাক্তি ভুলের ঊর্ধ্বে থাকতে পারে, যে কি না নিষ্ক্রিয়তাকে বেছে নিয়ে নিজেকে এপথের কাঠিন্যের সম্মুখীন হওয়া থেকে বাঁচিয়ে রেখেছে।
জিহাদের পথ তো তাই এমনই যে- হয় তা ইনসাফ ফিরিয়ে দিবে কিংবা যুদ্ধের তীব্রতা বাড়িয়ে দিবে। জিহাদ ও কিতাল সম্পর্কে আমি বলব, আশাবাদী ও উদ্যমী হোন। নিজের মাঝে হিম্মতের সঞ্চার ঘটান। আব্দুল্লাহ্* আজ্জাম, উমার আব্দুর রহমান, আনওয়ার শাবান(ইউসুফ আল উয়াইরী), তালাল কাসেমী এবং আব্দুল্লাহ্* আহমাদ আপনাদের থেকে বেশী দূরে নয়। হে আল্লাহ্*র বান্দা, অনুসরণীয় দৃষ্টান্ত হিসেবে তাঁরা আপনার জন্য যথেষ্ট। তাঁরা ছিলেন স্বীয় যমানার সিংহপুরুষ।
সমালোচনা কিংবা অভিযোগ করার পূর্বে থামুন ও চিন্তা করুন। লোকজন আমাকে জটিলতা ও কঠিন অবস্থায় ফেলেছে এমন কথা বলা থেকে বিরত থাকুন। আপনাকে কেউ কোনো কিছুতে জড়ায়নি। আমরা আপনাকে নিশ্চয়তা দেই না যে, জিহাদের পথে আসার ফলে আপনাকে পদ-পদবী বা মন্ত্রিত্ব দেয়া হবে। আমরা আপনাকে একথাও বলি না যে, আপনার সাথে(সাহায্যের জন্য) মালাইকাগণ যুদ্ধ করবেন। আমরা একথারও জামিনদার নই যে, আসমান হতে ছয় ডানাবিশিষ্ট ফেরেশতা এসে কে কাফির আর কে মুমিন তা আপনার জন্য চিহ্নিত করে দিবে। আবার আমরা একথাও বলি না যে, যুদ্ধক্ষেত্রে সেনাপতি হিসেবে থাকবেন একজন নবী যার উপর ওহী নাযিল হবে।। আমরা আজকে আপনার সামনে একটি বিষয় উপস্থাপন করি, যা থেকে প্রয়োজনের তাগিদে হয়তো পরদিনই ফিরে আসি। আর এটাই হচ্ছে বাস্তবতা।
জিহাদের ময়দানে অতি সংবেদনশীলতা বা মাত্রাতিরিক্ত আবেগের কোনো স্থান নেই। আমরা যা দেখি তাই বলি আমরা শুধু তারই সাক্ষ্য দেই যা আমরা জানি। আর আমরা অদৃশ্যের সংবাদের সংরক্ষকই নই। আপনি যদি কল্পনার ভেলায় চড়ে চাঁদে অবতরণের স্বপ্ন দেখেন, স্বভাবিকভাবেই আপনি ব্যর্থ হবেন।
অধিকাংশ মানুষ শান্তি ও নিরাপত্তার মসৃণ সড়কে চলতে ভালোবাসে। তারা চড়ুই পাখির ন্যায় স্ত্রী-সন্তান নিয়ে বাসায় বসে খাওয়া-দাওয়া করে এবং সুমিষ্ট পানীয় পান করে। কাঁচঘেরা বাড়িতে বসে জীবনকে পর্যবেক্ষণ করতে থাকে। অথচ, এখন প্রতিরোধের সময়, বসে থাকার সময় না। যখন কেউ নীরবে সময় কাটায় তখন তারা উপদেশের ফুলঝুড়ি নিয়ে উপস্থিত হয়। তারা স্বীয় জিহ্বাকে প্রসারিত করে বাকস্ফুরণ ঘটায়- "আমরা আশা করি..., আমরা সতর্ক করি..." ইত্যাদি ইত্যাদি।
"... যখন বিপদ কেটে যায় তখন তারা ধনসম্পদের লালসায় বাকচাতুরীতে লিপ্ত হয়"। (সূরা আহযাব, ৩৩:১৯)
পেছনে পড়ে থাকা নিষ্ক্রিয় লোকজনের অধিকাংশই খেলতামাশায় মত্ত। অথচ তারাই আবার জোরগলায় ময়দানের মুজাহিদ নেতৃবৃন্দের ব্যাপারে ক্ষমতালোভী হওয়ার অভিযোগ আরোপ করে। নিশ্চয়ই আল্লাহ্* তা'আলা সাক্ষী আছেন যে, এই মহান নেতৃবর্গই যুদ্ধের ময়দানে রক্ত প্রবাহিত করছে এবং রক্তের মাঝে লুটোপুটি খাচ্ছে।
______
(শায়খ আবু কাতাদা আল ফিলিস্তিনি হাফিজাহুল্লাহ'র 'সিলসিলাতু বাইনা মানহাজাইন' থেকে গৃহীত ও পরিমার্জিত।)
উদাহরণত, যখন কোনো আলেম বিবাহিত ব্যাক্তির যিনার হদ নিয়ে শরিয়তের শ্রেষ্ঠত্ব ও হিকমতের আলোচনাকরতঃ বলেন যে, ‘একজন পুরুষ ও মহিলাকে (যিনার অভিযুক্ত) শক্ত করে বেঁধে জনসম্মুখে উপস্থিত করা হলো। তারপর পাথর জড়ো করা হলো। অতঃপর মানুষজন যিনাকারীদের প্রতি এই পাথরগুলো ছুড়তে লাগল তাদের নিহত হওয়া অবধি’। এ বিষয়টির একদিকে রয়েছে বাস্তব অনুভূতি এবং অপরদিকে রয়েছে মানুষের উপর এর প্রভাব।
যখন আপনি এ দৃশ্যটি নিয়ে চিন্তা করবেন তখন পুর্বেকার প্রফুল্লতা ও আনন্দের স্থলে জায়গা করে নিবে অপরাধীর প্রতি সহানুভূতি। অপরাধীর কান্না, অঝোর ধারায় অশ্রুবর্ষণকারী অবস্থায় তার সন্তানকে আটকে রাখার দৃশ্য অস্থির করে তুলবে আপনার অন্তরকে। এ জাতীয় দৃশ্য সামনে রেখে যে কোনো আলেমের পক্ষে শরীয়তের মহত্ব ও হিকমতকে ফুটিয়ে তোলা কষ্টসাধ্য হবে। উক্ত আলেম নিজেই হয়তো রক্ত দেখে মূর্ছা যাবে। হয়তো রজমকৃত ব্যাক্তির ভূপাতিত মৃতদেহ দেখে শায়খ উর্ধ্বশ্বাসে দৌড়ে পালাবে। কেননা, চমকপ্রদ কল্পনা আর বাস্তবতার মাঝে রয়েছে বিশাল ফারাক।
একইভাবে, মানুষ জিহাদ নিয়ে কথা বলে যেহেতু জিহাদ ফি সাবিলিল্লাহ্* অত্যন্ত শ্রুতিমধুর একটি শব্দ। কিন্তু বাস্তব জিহাদ, জিহাদের প্রতিটি ঘটনাপ্রবাহ কিন্তু সুখকর নয়। জিহাদ কোনো ঝংকার তোলা বক্তৃতা বা সুন্দর সুন্দর কথার নাম নয়। জিহাদ মানেই গনীমত কিংবা বন্দীলাভ নয়। আর জিহাদ কোনো অনলবর্ষী বক্তার বক্তৃতাও নয়।
বরঞ্চ, জিহাদের মাঝে রয়েছে প্রিয় ব্যাক্তিদের মৃত্যু, বন্ধুর আহত হওয়ার দৃশ্য, মাথার ঠিক উপর দিয়ে শেল উড়ে যাওয়া, ধনসম্পদ হারিয়ে ফেলা এবং কোনো সাহায্যকারী না থাকা। বরং অন্যভাবে বলতে গেলে, জিহাদের মাঝে রয়েছে সর্বপ্রকারের ভয়ংকর সব কষ্ট।
জিহাদের ময়দানে সৈন্যসমাবেশ ঘটে। মানুষের মাঝে ঝগড়া-বিবাদ হয়ে থাকে। এ তাকে মারে, সে তাজে ধরে, ও ঝগড়া করে ইত্যাদি ইত্যাদি। সর্বোপরি জিহাদ হলো গণআন্দোলন। স্বাভাবিকভাবেই তাই এর মাঝেও রয়েছে ভুলভ্রান্তি, ইজতিহাদ, অপব্যাখ্যা ইত্যাদি। কখনো বিষয়গুলো সুখকর হয়, কখনো হয় না। এখানেও রয়েছে নির্দিষ্ট কিছু সীমাবদ্ধতা; সুখকর কল্পনা ও বাস্তবতার মধ্যকার এক বিরাট ব্যাবধান।
আমরা যদি ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে মানুষের কাল্পনিক ধ্যানধারণা ও চিন্তাচেতনার দিকে তাকাই তাহলে দেখতে পাব যে, অধিকাংশ মানুষ স্বপ্নের জগতে বসবাস করছে। তাদের দৃষ্টিভঙ্গী বাস্তবতা থেকে বহু দূরে। তাদের এই স্বপ্নের জগতে রয়েছে মনোরম দৃশ্যাবলী, অভিবাদন জানানোর জন্য গালিচা, মনোমুগ্ধকর রঙিন সব দৃশ্যকল্প আর সর্বদা বৃষ্টি বর্ষণকারী সুবিশাল এক আকাশ ইত্যাদি।
আর শত্রুরা যেন সদাসর্বদা ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে আছে এই ভেবে যে, যুদ্ধের ময়দানে ফেরেশতাগণ সার্বক্ষণিক আমাদের সাথে থেকে যুদ্ধ করে।
তারা ভাবতে ভালোবাসে যে, ইসলামী রাষ্ট্রে থাকবে না দারিদ্র্য আর অসুস্থতা। তারা যা চাইবে তার সবই তাদের সামনেই থাকবে। কিন্তু যদি আমরা নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর রাষ্ট্রের দিকে তাকাই তাহলে তা জান্নাততূল্য দেখতে পাব কি?
বরঞ্চ আমরা দেখতে পাব যে, মদিনার ইসলামী রাষ্ট্রে সাহাবাদের (রাদ্বিয়াল্লাহু ‘আনহুম) যন্ত্রনা-দুর্ভোগ মক্কার চাইতেও বেশি ছিল। সাহাবায়ে কেরামের (রাঃ) খন্দকের যুদ্ধের ভয়ংকর পরিস্থিতির সম্মুখীন কি মক্কাতে হয়েছিলেন? আল্লাহ্* তা’আলা বলেন,
“যখন তারা তোমাদের কাছে উপর-নিচ থেকে আসছিল তখন তোমাদের চোখ বিস্ফোরিত হচ্ছিল, প্রাণ কণ্ঠাগত হচ্ছিল। আর তোমরা আল্লাহ্*র ব্যাপারে বিরূপ ধারণা করছিলে। তখন মুমিনদেরকে পরীক্ষা করা হয়েছিল এবং তারা প্রকম্পিত হয়েছিল”। (সূরা আহযাব, ৩৩:১০-১১)
এই দৃশ্যপটকে বর্তমান সময়ে উলামা-মাশায়েখ কর্তৃক চিত্রিত ইসলামী রাষ্ট্রের মিলিয়ে দেখুন। তারা এমন রাষ্ট্রের প্রতিশ্রুতি দেন যাতে কোনো দুঃখ-কষ্ট থাকবে না, অস্তিত্ব থাকবে না কোনো ভয়ভীতির। প্রত্যেক মানুষের জন্য থাকবে বাসস্থান, প্রতিটি পেটের জন্য থাকবে খাদ্য। আর মানুষ তাদের এই স্বপ্ন বা প্রতিশ্রুত রাষ্ট্রের জন্যই বিভিন্ন কর্মসূচী বা তানজীমের সাথে সম্পৃক্ত হয়।
এর উপর ভিত্তি করে মানুষ আমদের কাছে এবং আমাদের জামাতের নিকটবর্তী হয়। কেননা তাদের মতিস্কে একথা ঘুরপাক খাচ্ছে যে, আমরা অন্যান্য জামাতের তুলনায় অধিকতর দুনিয়াবী নিয়ামতের নিরাপত্তা দিব।
কিন্তু আমি আপনাদের বলি, নিশ্চয়ই খুলাফায়ে রাশিদীনের তিনজনই হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন। আর তারা নিজেদের হত্যার পরিকল্পনার ব্যাপারে অবগত থাকা সত্ত্বেও কোনো মানুষের সহায়তা নেন নি।
উমার (রাঃ) সালাতুল ফজরের সময় মুসলিম উম্মাহর উলামা-মাশায়েখ, সেনানায়ক ও নেতৃবৃন্দের উপস্থিতিতে আল্লাহ্*র দুশমন আবু লুলুর হাতে শহীদ হোন।
উসমান (রাঃ) কিছু বিদ্রোহীর হাতে নিহত হোন। তারা মদীনায় প্রভাব বিস্তার করার পর উসমান (রাঃ) এর গৃহাভ্যন্তরে প্রবেশ করে। শহরের প্রাণকেন্দ্রে তারা সিয়ামরত উসমান রাঃ কে স্বগৃহে হত্যা করে ফেলে অজস্র মানুষের উপস্থিতি সত্ত্বেও।
আলী ইবন আবী তালিব (রাঃ) মসজিদে দাড়িয়ে ফজরের সময় মানুষদের সলাতের জন্য ডাকছিলেন। তার চারপাশে একদল লোকও ছিল। এমতাবস্থায় ইবন মুলজিম খারেজী তরবারী দ্বারা আলী রাঃ এর মাথায় আঘাত হানে।
এটা ছিল খেলাফাতে রাশেদার যুগ। আর পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহ তো সবারই জানা আছে।
যারা বাস্তবতাবিবর্জিত ইসলামী বিশ্ব নিয়ে আলীক স্বপ্ন দেখছে তারা গোলকধাঁধার মাঝে ঘুরপাক খাচ্ছে। তারা কল্পনার জগতে বসবাস করছে যা কি না তাদের পিছিয়ে পড়ার কারণ হচ্ছে। তাদের কল্পনায় যা আছে তারা তা বাস্তবায়নে সক্ষম নয়। কেননা, এজাতীয় চিন্তাধারা কাগজ-কলম আর কল্পনাতেই কেবল সম্ভব। এজাতীয় চিন্তাভাবনা আদৌ ইসলাম নয়।
বরং, ইসলাম হলো জীবন-সংগ্রামের নাম। যে সংগ্রামের মাঝে ত্রুটি-বিচ্যুতি, শুদ্ধ-অশুদ্ধ সবই বিদ্যমান। এই সংগ্রামী জীবন সঠিক বিষয়গুলিকে সহায়তা ও শক্তিশালী করে আর ভুলত্রুটিকে শুধরে দেয়।
ইসলামী বিশ্বে যেমন আদল-ইনসাফ থাকে, তেমনই থাকে জুলুমের অমানিশাও। এতে সত্যের যেমন উপস্থিতি রয়েছে, তেমনই রয়েছে মিথ্যাও। ইসলামী সমাজে প্রত্যেকেরই নিজ নিজ একটা অবস্থান রয়েছে।
ইসলাম ভুলের অস্তিত্বকে স্বীকার করে, সৃষ্টির মাঝে ভুল থাকাকে অনর্থক মনে করে না। ভুলের অস্তিত্ব রয়েছে বলেই আল্লাহ তা'আলা হুদুদ ও শাস্তি নাযিল করেছেন। নাযিল করেছেন আহকাম।
আল্লাহ্* সুবহানাহু ওয়া তা'আলার অলঙ্ঘনীয় বাণী প্রতিটি মুসলিম, মুওয়াহহিদ ও মুজাহিদ সমাজের জন্য। এই চিরন্তন বাণী কোনো কাফির-মুশরিকের জন্য নয়। এতদসত্ত্বেও ফিতনার সময়ে আলী রাঃ এবং আয়িশা রাঃ ও মুআবিয়া রাঃ এর মাঝে দ্বন্দ্ব হয়েছিল।
যদি আমরা বাস্তবতা অনুসন্ধানের চেষ্টা করি এবং গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করি, তবে এমন বিষয়াদির উপস্থিতি দেখতে পাই যা শিশুকে বৃদ্ধ বানিয়ে ছাড়ে। অথচ তা ছিল খাইরুল কুরুন তথা সর্বোত্তম প্রজন্মের সময় সংঘটিত।
উদাহরণত,
ঘটনা ১ঃ খারেজী ফিতনা। চার হাজার খাওয়ারিজ আলী রাঃ এর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার সংকল্প করে। আলী রাঃ তাদের কাছে প্রস্তাব পাঠান, "এসো আমাদের এবং তোমাদের প্রতিপক্ষ মুআবিয়া রাঃ কে প্রতিহত করি"। তারা তা প্রত্যাখ্যান করে এবং আলী রাঃ কে তাকফির করে এবং তাঁকে তাওবা করতে বলে। এতেই তারা ক্ষান্ত থাকেনি। আব্দুল্লাহ্* ইবন খাব্বাব ইবনুল আরাত রাঃ ও উনার গর্ভবতী স্ত্রীকে নির্মমভাবে শহীদ করে দেয়। অতঃপর নাহরাওয়ানের ভূমিতে আলী রাঃ যুদ্ধাহত চারশত খারেজী ব্যতীত বাকি সকল খাওয়ারিজকে হত্যা করেন।
ঘটনা ২ঃ জামাল যুদ্ধ। যা সংঘটিত হয়েছিল বসরার উপকণ্ঠে। উমর ইবন শাইবার রেওয়াত অনুযায়ী এ যুদ্ধটি সংঘটিত হয়েছিল মুসলিমদের দুই গোষ্ঠীর মধ্যে। বরং বলা চলে দুই গোত্রের মাঝে (মুদার গোত্রের বিরুদ্ধে মুদার গোত্রের, রবীয়া গোত্রের বিরুদ্ধে রবীয়া গোত্রের ...) একই জাতিগোষ্ঠী দ্বীন রীতিনীতির ভাইয়ে-ভাইয়ে যুদ্ধ।
এ যুদ্ধে তালহা রাঃ ও যুবায়ের রাঃ শহীদ হোন। যারা ছিলেন আশারায়ে মুবাশশিরার অন্তর্ভুক্ত।
ঘটনা ৩ঃ সিফফিনের যুদ্ধ। সন্ধির প্রতি উৎসাহিত করা সত্ত্বেও এ যুদ্ধটি সংঘটিত হয় আলী রাঃ ও মুআবিয়া রাঃ এর মাঝে। কিছু মানুষ বলছিল শামবাসী (যারা ছিল মুআবিয়া রাঃ এর অধীন) ধ্বংসের পর কে শামের সীমান্তের নিরাপত্তা দিবে? ইরাকবাসী (যারা ছিল আলী রাঃ এর অধীন) ধ্বংসের পর কে ইরাকের সীমান্তের নিরাপত্তা দিবে? নারী-শিশুদেরই বা কী হবে?
দুর্বল এক রেওয়ায়েতে এ যুদ্ধে ভয়ানক হত্যাকাণ্ডের কথা উল্লেখ রয়েছে। যাই হোক, এতে কোনো সন্দেহ নেই এটি একটি বড় যুদ্ধ ছিল।
ঘটনা ৪ঃ ইসলাম গ্রহণের পর কিছু লোকের পুনরায় খ্রিস্টধর্মে ফিরে যাওয়া। এমনকি তারা একথা পর্যন্ত বলতে থাকে,"আমরা যে ধর্মত্যাগ (অর্থাৎ খ্রিস্টধর্ম) করেছি তা ইসলাম অপেক্ষা উত্তম। অযথা রক্তপাত, মুসাফিরদের ভীতসন্ত্রস্তকরণ এবং ধনসম্পদের লুটপাট থেকে ইসলাম নিরাপত্তা দিতে পারে না"। (তাবারী)
আলী রাঃ তাদের রিদ্দাহ (ধর্মত্যাগ) এর ফলাফলস্বরূপ তাদের সকলকে হত্যা করেন।
এখানেই থেমে থাকেনি। অতঃপর হুসাইন রাঃ এর শাহদাত, আব্দুল্লাহ্* ইবন যুবাইরের যুদ্ধ ইত্যাদি একের পর এক সংঘটিত হয়; যার তালিকা অনেক লম্বা। আর এটাই মানবজীবনের বাস্তবতা। তাই কোনো বুদ্ধিমান ব্যাক্তির জন্য সংগত নয় এবিষয়গুলো ভুলে থাকা এবং কঠিন বাস্তবতার হাল ছেড়ে দেয়া।
মানুষ মনে করে একজন মুসলিমের জীবন জুড়ে থাকবে শুধু রাতের সালাত, দিনের সিয়াম, ক্ষমা, দানশীলতা প্রভৃতি। সর্বোপরি সর্বপ্রকার কল্যাণের সমাবেশ। এমনকি সাধারণ মানুষের কল্পনার ক্যানভাসে থাকে প্রত্যেক মুসলিম মানে আল্লাহ্*র ওলী হওয়ার চিত্র। এমনটা কেবল কল্পনাতেই সম্ভব, বাস্তবে যার কোনো ভিত্তি নেই। এব্যাপারে ইবন কুতাইবার 'আল-মাআরিফ' দেখুন। জেনে রাখুন,
ওলী, একজন মাটির তৈরী মানুষ।
মুজাহিদ, একজন একজন মাটির তৈরী মানুষ।
প্রকৃতপক্ষে ইসলাম ও মুসলিমদের সম্পর্কে অতিমানবীয় ও বাস্তবতাবিবর্জিত ধারণা দানকারী চলচ্চিত্র নির্মাণ করা, জিন ও ফেরেশতাদের নিয়ে বানানো ছবি থেকেও অধিকতর অবমাননাকর।
তাই এজাতীয় কল্পনাবিলাসী ব্যাক্তিদের ব্যাপারে আমরা বলব যে, তারা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়াদি ছেড়ে ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র বিষয়ে মশগুল হয়ে আছে। তাদের এই অতিসংবেদনশীলতা তাদেরকে ভুলভ্রান্তির ডাস্টবিনে নিক্ষেপ করেছে এবং আল্লাহ্*র অনুগ্রহ, কল্যাণ ও নিয়ামত অবলোকন করা থেকে দূরে ঠেলে দিয়েছে। (কেননা তারা অন্যের ছোটখাটো বিচ্যুতিকেও স্বাভাবিকভাবে গ্রহণ করতে পারে না, ফলে তুচ্ছাতিতুচ্ছ বিষয় নিয়ে ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়ে)।
নিশ্চয়ই জিহাদ ফি সাবিলিল্লাহ্* একটি গণআন্দোলন, যাতে বিভিন্ন স্বভাব-প্রকৃতির মানুষ শামিল হয়। যার দায়িত্ব অস্ত্র নিয়ে বেরিয়ে পড়া হবে তার জন্য অস্ত্রের মোকাবিলা অস্ত্র দিয়েই করতে হবে। অগ্নিঝরা বক্তৃতা কিংবা ক্ষুরধার লেখনী দ্বারা শত্রুর বুলেটকে প্রতিহত করা নিশ্চয়ই তার কাজ নয়। বরং, তার কাজ হলো স্বীয় জীবনকে বারুদের উত্তাপ আস্বাদন করানো। আর এটাই আল্লাহ্* তা'আলার অমোঘ নীতি।
মনে করিয়ে দিতে চাই, নিশ্চয়ই তিন শহীদ খলিফার কেউই কাফিরের হাতে নিহত হোন নি। বরং মুসলিম নামধারী পাপিষ্ঠ বিদআতীদের হাতে নিহত হয়েছেন। উমার রাঃ এর হত্যাকারী আবু লু'লু সম্পর্কে কাতাদা রহঃ এর অভিমত হলো - সে মুশরিকদের অন্তর্ভুক্ত নয়, যদিও তাকে মুশরিকদের দিকে সম্বোধন করা হয়।
উসমান রাঃ এর হত্যাকারী বিদ্রোহীরা মুসলিমই ছিল। যাদের কেউ কেউ পরবর্তীতে আলী রাঃ এর বাহিনীর সেনানায়কও হয়েছিল।
আলী রাঃ এর হত্যাকারী ইবন মুলযিম ছিল খারেজী।
তাই যে এই রাস্তায় পা রাখবে এবং অস্ত্র তুলে নিবে তার লক্ষ্য হবে আল্লাহ্*র জমিনে জিহাদের মাধ্যমে দ্বীন প্রতিষ্ঠা করা। যারা স্বীয় জীবনকে আল্লাহ্*র পথে ওয়াকফ করে দিবে তাগুতের সিংহাসন ধ্বংসের মাধ্যমে তাগুতের দম্ভ চূর্ণ করে ইনসাফ ফিরিয়ে আনতে। এই কণ্টকাকীর্ণ পথের পথিকের মাঝে ত্রুটিবিচ্যুতি বিদ্যমান থাকতেই পারে। তবে এটা ঠিক, সেই আরামপ্রিয় ব্যাক্তি ভুলের ঊর্ধ্বে থাকতে পারে, যে কি না নিষ্ক্রিয়তাকে বেছে নিয়ে নিজেকে এপথের কাঠিন্যের সম্মুখীন হওয়া থেকে বাঁচিয়ে রেখেছে।
জিহাদের পথ তো তাই এমনই যে- হয় তা ইনসাফ ফিরিয়ে দিবে কিংবা যুদ্ধের তীব্রতা বাড়িয়ে দিবে। জিহাদ ও কিতাল সম্পর্কে আমি বলব, আশাবাদী ও উদ্যমী হোন। নিজের মাঝে হিম্মতের সঞ্চার ঘটান। আব্দুল্লাহ্* আজ্জাম, উমার আব্দুর রহমান, আনওয়ার শাবান(ইউসুফ আল উয়াইরী), তালাল কাসেমী এবং আব্দুল্লাহ্* আহমাদ আপনাদের থেকে বেশী দূরে নয়। হে আল্লাহ্*র বান্দা, অনুসরণীয় দৃষ্টান্ত হিসেবে তাঁরা আপনার জন্য যথেষ্ট। তাঁরা ছিলেন স্বীয় যমানার সিংহপুরুষ।
সমালোচনা কিংবা অভিযোগ করার পূর্বে থামুন ও চিন্তা করুন। লোকজন আমাকে জটিলতা ও কঠিন অবস্থায় ফেলেছে এমন কথা বলা থেকে বিরত থাকুন। আপনাকে কেউ কোনো কিছুতে জড়ায়নি। আমরা আপনাকে নিশ্চয়তা দেই না যে, জিহাদের পথে আসার ফলে আপনাকে পদ-পদবী বা মন্ত্রিত্ব দেয়া হবে। আমরা আপনাকে একথাও বলি না যে, আপনার সাথে(সাহায্যের জন্য) মালাইকাগণ যুদ্ধ করবেন। আমরা একথারও জামিনদার নই যে, আসমান হতে ছয় ডানাবিশিষ্ট ফেরেশতা এসে কে কাফির আর কে মুমিন তা আপনার জন্য চিহ্নিত করে দিবে। আবার আমরা একথাও বলি না যে, যুদ্ধক্ষেত্রে সেনাপতি হিসেবে থাকবেন একজন নবী যার উপর ওহী নাযিল হবে।। আমরা আজকে আপনার সামনে একটি বিষয় উপস্থাপন করি, যা থেকে প্রয়োজনের তাগিদে হয়তো পরদিনই ফিরে আসি। আর এটাই হচ্ছে বাস্তবতা।
জিহাদের ময়দানে অতি সংবেদনশীলতা বা মাত্রাতিরিক্ত আবেগের কোনো স্থান নেই। আমরা যা দেখি তাই বলি আমরা শুধু তারই সাক্ষ্য দেই যা আমরা জানি। আর আমরা অদৃশ্যের সংবাদের সংরক্ষকই নই। আপনি যদি কল্পনার ভেলায় চড়ে চাঁদে অবতরণের স্বপ্ন দেখেন, স্বভাবিকভাবেই আপনি ব্যর্থ হবেন।
অধিকাংশ মানুষ শান্তি ও নিরাপত্তার মসৃণ সড়কে চলতে ভালোবাসে। তারা চড়ুই পাখির ন্যায় স্ত্রী-সন্তান নিয়ে বাসায় বসে খাওয়া-দাওয়া করে এবং সুমিষ্ট পানীয় পান করে। কাঁচঘেরা বাড়িতে বসে জীবনকে পর্যবেক্ষণ করতে থাকে। অথচ, এখন প্রতিরোধের সময়, বসে থাকার সময় না। যখন কেউ নীরবে সময় কাটায় তখন তারা উপদেশের ফুলঝুড়ি নিয়ে উপস্থিত হয়। তারা স্বীয় জিহ্বাকে প্রসারিত করে বাকস্ফুরণ ঘটায়- "আমরা আশা করি..., আমরা সতর্ক করি..." ইত্যাদি ইত্যাদি।
"... যখন বিপদ কেটে যায় তখন তারা ধনসম্পদের লালসায় বাকচাতুরীতে লিপ্ত হয়"। (সূরা আহযাব, ৩৩:১৯)
পেছনে পড়ে থাকা নিষ্ক্রিয় লোকজনের অধিকাংশই খেলতামাশায় মত্ত। অথচ তারাই আবার জোরগলায় ময়দানের মুজাহিদ নেতৃবৃন্দের ব্যাপারে ক্ষমতালোভী হওয়ার অভিযোগ আরোপ করে। নিশ্চয়ই আল্লাহ্* তা'আলা সাক্ষী আছেন যে, এই মহান নেতৃবর্গই যুদ্ধের ময়দানে রক্ত প্রবাহিত করছে এবং রক্তের মাঝে লুটোপুটি খাচ্ছে।
______
(শায়খ আবু কাতাদা আল ফিলিস্তিনি হাফিজাহুল্লাহ'র 'সিলসিলাতু বাইনা মানহাজাইন' থেকে গৃহীত ও পরিমার্জিত।)
Comment