আস-সালামু আলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহ
সম্মানিত মুজাহিদ ভাইয়েরা! আলহামদু লিল্লাহ আপনাদের সামনে ফুরসান নিয়ে হাজির হলাম। এখন থেকে নিয়মিত পোষ্ট হবে ইনশাআল্লাহ। পুরো বইটি একসাথে পেতে আরো কিছুদিন অপেক্ষা করতে হবে। অনুবাদকারী ভাই বলেছেন, উনার একবার রিভিও করা মোটামোটি শেষ। কিন্তু পিডিএফ আকারে দেওয়ার জন্য আরো একবার রিভিও করা প্রয়োজন। তাই পুরোটা একসাথে পাওয়ার জন্য আরো কিছুদিন অপেক্ষা করার অনুরোধ করছি।
অনুবাদটিতে লেখকের উদ্দেশ্য পরিস্কারভাবে ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করা হয়েছে। সহজ-সাবলীল, প্রাঞ্জল ও ঝরঝরে ভাষায় অনুবাদ করার চেষ্টা করা হয়েছে। আল্লাহ তা’আলা সকল ভাইকে এর দ্বারা উপকৃত করুন! আমীন!
“আর আমি চাচ্ছিলাম, সে দেশে যাদেরকে দুর্বল করে রাখা হয়েছিল, তাদের প্রতি অনুগ্রহ করতে, তাদেরকে নেতা বানাতে এবং তাদেরকেই (সে দেশের ভূমি ও সম্পদের) উত্তরাধিকারী বানাতে। এবং সে দেশে তাদেরকে ক্ষমতাসীন করতে আর ফেরাউন, হামান ও তাদের সৈন্যদেরকে সেই জিনিস দেখিয়ে দিতে, যা থেকে বাঁচার জন্য তারা কলাকৌশল করছিল। আমি মূসার মায়ের প্রতি এলহাম করলাম, তুমি তাকে দুধ পান করাতে থাক। যখন তার ব্যাপারে কোন আশঙ্কা বোধ করবে, তখন তাকে নদীতে ফেলে দিও। আর ভয় পেয়ো না ও দু:খ করো না। বিশ্বাস রেখ, আমি অবশ্যই তাকে তোমার কাছে ফিরিয়ে দেব এবং তাকে রাসূলগণের মধ্য হতে একজন রাসূল বানিয়ে দেব।” (সূরা কাসাস: ৫-৭)
১- মিশরের বর্তমান জিহাদী আন্দোলন সরকারের বিরুদ্ধে তাদের পথ চলা শুরু করেছিল ষাটের দশকের মধ্যভাগে, যখন ১৯৬৫ সালে নাসিরী সরকার ইখওয়ানুল মুসলিমীনের বিরুদ্ধে তাদের প্রসিদ্ধ হামলা চালিয়েছিল, ১৭ হাজার মুসলিমকে জেলে ভরেছিল এবং সায়্যিদ কুতুব রহ.কে তার দুই সঙ্গীসহ ফাঁসি দিয়েছিল। সরকার ধারণা করেছিল, এর মাধ্যমে মিশরের জিহাদী আন্দোলনকে চিরতরে শেষ করে দিয়েছে। কিন্তু আল্লাহ তা’আলা চাইলেন এ ট্রাজেডিগুলোই মিশরে সরকারের বিরুদ্ধে জিহাদী আন্দোলনের প্রথম স্ফুলিঙ্গ হবে।
ইতিপূর্বে মিশরের জিহাদী আন্দোলন যদিও ইসলামের শত্রুদের বিরুদ্ধে জিহাদ করেছে, কিন্তু তাদের সাধারণ পরিকল্পনাগুলো ক্ষমতাসীন সরকারকে টার্গেট করে ছিল না। বরং তা প্রধানত বহি:শত্রুকে লক্ষ্য করে ছিল। আন্দোলনের চিন্তাধারা ও প্রচারণা যথাসম্ভব ক্ষমতাসীন সরকারের নৈকট্য অর্জন এবং তাকে দেশের শরয়ী শাসক অভিধায় সম্বোধন করতে সচেষ্ট ছিল।
বহি:শত্রু ও অভ্যন্তরীণ দালালদের মাঝে এই মারাত্মক বিভাজন অনেক বিপদ ও দুর্যোগ ডেকে আনে। কারণ জিহাদী আন্দোলনের কর্মীরা তাদের বুকের মাধ্যমে বহি:শত্রুর মোকাবেলা করত, কিন্তু নিজেদের পিঠ তাদের (বহি:শত্রুর) বন্ধুদের জন্য উম্মুক্ত রেখে দিত। ফলে বুক দিয়ে যাদের মোকাবেলা করছে, তাদেরই আদেশে পেছন দিক থেকে তাদের বন্ধুদের হাতে আঘাত প্রাপ্ত হত।
আব্দুন নাসের ও তার পশ্চাতে কমিউনিজমের পৃষ্ঠপোষকরা শহীদ উস্তাদ সায়্যিদ কুতুব রহ.কে হত্যার ষড়যন্ত্র করল। কারণ তিনিই ইসলামে তাওহিদের বিষয়টির গুরুত্ব ফুটিয়ে তোলার উপর জোর দিয়েছেন এবং তিনিই এ ধারণা পেশ করেছেন যে: ইসলাম ও তার শত্রুদের মধ্যকার যুদ্ধ মূলত তাওহিদী আকিদার যুদ্ধ বা শাসনকর্তৃত্ব ও ক্ষমতা কার জন্য হবে, আল্লাহর বিধান ও শরীয়তের জন্য হবে, নাকি দেশীয় নীতি, বস্তুবাদী আদর্শ বা স্রষ্টা ও সৃষ্টির মাঝে মধ্যস্থতার দাবিকারীর জন্য হবে??
ইসলামী আন্দোলনের জন্য এই গুরুত্বারোপের সুস্পষ্ট প্রভাব ছিল তাদের শত্রুদেরকে চেনা ও সংজ্ঞায়িত করার ক্ষেত্রে এবং এই উপলব্ধি সৃষ্টির ক্ষেত্রে যে, অভ্যন্তরীণ শত্রুর ভয়াবহতাও বহি:শত্রু থেকে কোন অংশেই কম নয়। বরং এটি হল একটি যন্ত্র, যাকে বহি:শত্রুরা ব্যবহার করছে। এটি একটি আবরণ, যাকে ইসলামের বিরুদ্ধে যুদ্ধে আড়াল হিসাবে ব্যবহার করছে।
সায়্যিদ কুতুব রহ. এর সঙ্গে যুক্ত দলটি সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, তারা বর্তমান সরকারকে ইসলমের সাথে শত্রুতাকারী, আল্লাহর বিধান থেকে বিচ্যুত ও আল্লাহর শরীয়তের শাসন প্রত্যাখ্যানকারী হিসাবে যুদ্ধের লক্ষবস্তু বানিয়ে আঘাত হানবে।
কিন্তু এ গ্রুপটির পরিকল্পনা ছিল খুব সাধারণ। তারা সরকার পরিবর্তন বা সরকারকে অপসারণ করার টার্গেট করেনি। বরং তাদের টার্গেট ছিল শুধু, যখন সরকার মুসলমানদের বিরুদ্ধে নতুন কোন শাস্তিমূলক আক্রমণের ষড়যন্ত্র করবে, তখন তাদের উপর আত্মরক্ষা, প্রতিবাদ ও প্রতিশোধ মূলক হামলা করবে।
কিন্তু এ পরিকল্পনার মাঝে বস্তুগত শক্তির চেয়ে মনস্তাত্ত্বিক তাৎপর্যটিই ছিল বড়। কারণ এর সুস্পষ্ট অর্থ হল: তারা সরকারকে ইসলামের শত্রু হিসাবে গণ্য করে তার বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করে দিয়েছে। অথচ ইতিপূর্বে তাদের নীতি ও আদর্শ ছিল: বহি:শত্রুই শুধু ইসলামের শত্রু, যা এখনো তাদের কেউ কেউ বুলি হিসাবে আওড়ায়।
যদিও সায়্যিদ কুতুব রহ. এর দলটি নাসিরী সরকারের আগ্রাসনের শিকার হয়েছে, তার সদস্যদেরকে শাস্তি দেওয়া হয়েছে, কিন্তু তা সত্বেও মুসলিম যুব সমাজের মাঝে এ দলটির বিরাট প্রভাব ঠেকাতে সরকার ছিল ব্যর্থ।
কারণ সায়্যিদ কুতুব রহ. আল্লাহর একত্বকে নিখাদ করা, আল্লাহর শাসনকর্তৃত্বের নিকট পরিপূর্ণ আত্মসমর্পণ করা এবং আল্লাহ প্রদত্ত জীবন ব্যবস্থার নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা করার যে দাওয়াত দিয়েছেন, তা ইসলামের ভেতর-বাহিরের শত্রুদের বিরুদ্ধে ইসলামী আন্দোলনের শিখা প্রজ্জলিত করার প্রথম স্ফুলিঙ্গ হিসাবে কাজ করেছিল এবং এখনো পর্যন্ত তার রক্তাক্ত পাঠগুলো প্রতিদিন নতুন রূপে আবির্ভূত হচ্ছে।
সেই বিপ্লব, যা প্রতিদিনই আকিদায় সুদৃঢ় হচ্ছে, আদর্শে সুস্পষ্ট হচ্ছে, লড়াইয়ের প্রকৃতিতে অভিজ্ঞ হচ্ছে এবং পথের দুস্তরতায় সজাগ হচ্ছে। এটাই সমস্ত নবী, রাসূল ও কিয়ামত পর্যন্ত আগত তাদের অনুসারীদের পথ।
এটাই সে পথ, বিংশ শতাব্দির শেষভাগে বিশেষত: মিশরের এবং সাধারণভাবে সমস্ত আরব অঞ্চলের মুসলিম যুবকদেরকে যে পথে পরিচালনা করার ক্ষেত্রে সায়্যিদ কুতুব রহ. এর বিরাট অবদান ছিল।
সায়্যিদ কুতুব রহ.এর শাহাদাতে তার কথাগুলো এমন মর্যাদা লাভ করেছে, যা অন্য অনেকের কথাই লাভ করেনি। বক্তার রক্তে অংকিত এ কথাগুলোই মুসলিম যুবকদের চোখে এক দীর্ঘ সম্মানজনক পথের নিদর্শন হয়ে গেছে এবং সায়্যিদ কুতুব রহ. এর তাওহিদের দাওয়াতে নাসিরী সরকার ও তার কমিউনিষ্ট মিত্ররা কী পরিমাণ ভীত-সন্ত্রস্ত ছিল তাও স্পষ্ট হয়েছে।
উস্তাদ সাইয়িদ কুতুব রহ. বলেন:
“সব কথা অন্যদের হৃদয়ে পৌঁছে না, হৃদয়কে নাড়া দেয় না। অন্তরসমূহকে একত্রিত ও তাড়িত করে না। একমাত্র রক্তের কালিতে লিখা কথাই তা পারে। কারণ তা জীবিত মানুষের অন্তরসমূহের খোরাক যোগায়। যে কথাই বেঁচে থেকেছে, তা মানুষের অন্তরের খোরাক যুগিয়েই বেঁচে থেকেছে। পক্ষান্তরে যে সকল কথা মুখে জন্ম নিয়েছে, যবান ছুঁড়ে মেরেছে এবং তার সাথে আল্লাহ প্রদত্ত জীবন্ত উৎস মিলিত হয়নি, তা মৃতভাবেই জন্ম লাভ করেছে, তা মানবতাকে এক বিন্দুও আদর্শের দিকে এগিয়ে নিয়ে যায়নি। কেউ সেটাকে গ্রহণ করে নিবে না, কারণ তা মৃতভাবে জন্ম লাভ করেছে। আর মানুষ মৃত বস্তু গ্রহণ করে না।”
সায়্যিদ কুতুব রহ. সত্য কথা বলার এক আদর্শ ও হকের উপর অটল থাকার এক নমুনা হয়ে গেছেন। কারণ তিনি তাগুত জালিমের সামনে সত্য কথা বলেছেন আর এর মূল্য দিয়েছেন নিজের জীবন দিয়ে। আর তার কথার মূল্য বহুগুণে বৃদ্ধি করে দিয়েছে তার সেই মহান অবস্থান, যখন তিনি জামাল আব্দুন নাসেরের নিকট ক্ষমার আবেদন করতে অস্বীকৃতি জানিয়ে তার সেই প্রসিদ্ধ কথাটি বলেছিলেন:
“যে শাহাদাত আঙ্গুল প্রতিদিন নামাযে আল্লাহর একত্ববাদের সাক্ষ্য দেয়, তা কখনো জালিমের নিকট অনুগ্রহের আবেদন লিখতে পারে না।”
নাসিরী সরকার ধারণা করেছিল যে, সায়্যিদ কুতুব রহ.কে তার কতক সঙ্গীসহ হত্যা করা এবং ইসলামী আন্দোলনের হাজার হাজার কর্মীদের কারারূদ্ধ করার দ্বারা ইসলামী আন্দোলনের কফিনে শেষ পেরেক ঠুকে দিয়েছে, কিন্তু আবরণের উপরের বাহ্যিক নিরবতার আড়ালে ছিল সায়্যিদ কুতুব রহ. এর চিন্তাধারা ও দাওয়াতের তাৎক্ষণিক প্রভাব এবং মিশরে আধুনিক জিহাদী আন্দোলনের অঙ্কুরোদগম।
এভাবেই সেই বীজের অঙ্কুরোদগম হয়েছিল, যার সঙ্গে এই লেখক ও জামাতুল জিহাদ সম্পৃক্ত।
১৯৬৫ সালে নাসিরি সরকারের আগ্রাসী হামলা মিশরীয় জনগণকে এতটা আঘাত করে, যা ইতিপূর্বে করেনি। এটা ছিল ইসলামী আন্দোলনের প্রতি নাসিরি সরকারের সর্বাধিক কঠিন হামলা। এ আঘাত মিশরীয় সমাজে দু’টি প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে:
প্রথম প্রতিক্রিয়া: কারাবন্দিদের থেকে ছড়ানো ঘটনাবলী, বিভিন্ন অভিযানের সংবাদ এবং তাতে সরকার যে বীভৎস কর্মকাণ্ড ও অপরাধযজ্ঞ সংঘটিত করে, তার কারণে ত্রাস। যা মিশরীয় জনগণের মাঝে গভীর নেতিবাচক উপলব্ধি, সরকারের ব্যাপারে নাক গলানো থেকে দূরে থাকার মানসিকতা এবং জীবনোপকরণ অর্জনের প্রতি অনিহা সৃষ্টি করে।
দ্বিতীয় প্রতিক্রিয়া: যারা ক্ষমতার নেশায় ইসলাম ও মুসলিমদের উপর সীমালঙ্ঘন করল এবং প্রতিটি হারামকে হালাল বানিয়ে ফেলল তাদের ব্যাপারে ক্রমবর্ধমান সুপ্ত ক্রোধ ও প্রতিশোধের স্পৃহা। এ উপলব্ধিই সাধারণভাবে মিশরীয় জনগণকে, যাদের সিংহভাগই দ্বীনদার- ইখওয়ানুল মুসলিমীনের প্রতি সহানুভূতিশীল করে তুলে। বিশেষ করে যখন তারা ঘরের সম্মানিত বস্তু, তথা নারীদের উপর সরকারের সীমালঙ্ঘনের বিষয়ে জানতে পারল।
সম্মানিত মুজাহিদ ভাইয়েরা! আলহামদু লিল্লাহ আপনাদের সামনে ফুরসান নিয়ে হাজির হলাম। এখন থেকে নিয়মিত পোষ্ট হবে ইনশাআল্লাহ। পুরো বইটি একসাথে পেতে আরো কিছুদিন অপেক্ষা করতে হবে। অনুবাদকারী ভাই বলেছেন, উনার একবার রিভিও করা মোটামোটি শেষ। কিন্তু পিডিএফ আকারে দেওয়ার জন্য আরো একবার রিভিও করা প্রয়োজন। তাই পুরোটা একসাথে পাওয়ার জন্য আরো কিছুদিন অপেক্ষা করার অনুরোধ করছি।
অনুবাদটিতে লেখকের উদ্দেশ্য পরিস্কারভাবে ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করা হয়েছে। সহজ-সাবলীল, প্রাঞ্জল ও ঝরঝরে ভাষায় অনুবাদ করার চেষ্টা করা হয়েছে। আল্লাহ তা’আলা সকল ভাইকে এর দ্বারা উপকৃত করুন! আমীন!
প্রথম অধ্যায়
মূর্তির পতন ও স্বাধীন শক্তির অভ্যূদয়
মূর্তির পতন ও স্বাধীন শক্তির অভ্যূদয়
প্রথম পরিচ্ছেদ:
সূচনা
সূচনা
وَنُرِيدُ أَن نَّمُنَّ عَلَى الَّذِينَ اسْتُضْعِفُوا فِي الْأَرْضِ وَنَجْعَلَهُمْ أَئِمَّةً وَنَجْعَلَهُمُ الْوَارِثِينَ، وَنُمَكِّنَ لَهُمْ فِي الْأَرْضِ وَنُرِي فِرْعَوْنَ وَهَامَانَ وَجُنُودَهُمَا مِنْهُم مَّا كَانُوا يَحْذَرُونَ، وَأَوْحَيْنَا إِلَى أُمِّ مُوسَى أَنْ أَرْضِعِيهِ فَإِذَا خِفْتِ عَلَيْهِ فَأَلْقِيهِ فِي الْيَمِّ وَلَا تَخَافِي وَلَا تَحْزَنِي إِنَّا رَادُّوهُ إِلَيْكِ وَجَاعِلُوهُ مِنَ الْمُرْسَلِينَ
{القصص ৫-৭.}
{القصص ৫-৭.}
“আর আমি চাচ্ছিলাম, সে দেশে যাদেরকে দুর্বল করে রাখা হয়েছিল, তাদের প্রতি অনুগ্রহ করতে, তাদেরকে নেতা বানাতে এবং তাদেরকেই (সে দেশের ভূমি ও সম্পদের) উত্তরাধিকারী বানাতে। এবং সে দেশে তাদেরকে ক্ষমতাসীন করতে আর ফেরাউন, হামান ও তাদের সৈন্যদেরকে সেই জিনিস দেখিয়ে দিতে, যা থেকে বাঁচার জন্য তারা কলাকৌশল করছিল। আমি মূসার মায়ের প্রতি এলহাম করলাম, তুমি তাকে দুধ পান করাতে থাক। যখন তার ব্যাপারে কোন আশঙ্কা বোধ করবে, তখন তাকে নদীতে ফেলে দিও। আর ভয় পেয়ো না ও দু:খ করো না। বিশ্বাস রেখ, আমি অবশ্যই তাকে তোমার কাছে ফিরিয়ে দেব এবং তাকে রাসূলগণের মধ্য হতে একজন রাসূল বানিয়ে দেব।” (সূরা কাসাস: ৫-৭)
১- মিশরের বর্তমান জিহাদী আন্দোলন সরকারের বিরুদ্ধে তাদের পথ চলা শুরু করেছিল ষাটের দশকের মধ্যভাগে, যখন ১৯৬৫ সালে নাসিরী সরকার ইখওয়ানুল মুসলিমীনের বিরুদ্ধে তাদের প্রসিদ্ধ হামলা চালিয়েছিল, ১৭ হাজার মুসলিমকে জেলে ভরেছিল এবং সায়্যিদ কুতুব রহ.কে তার দুই সঙ্গীসহ ফাঁসি দিয়েছিল। সরকার ধারণা করেছিল, এর মাধ্যমে মিশরের জিহাদী আন্দোলনকে চিরতরে শেষ করে দিয়েছে। কিন্তু আল্লাহ তা’আলা চাইলেন এ ট্রাজেডিগুলোই মিশরে সরকারের বিরুদ্ধে জিহাদী আন্দোলনের প্রথম স্ফুলিঙ্গ হবে।
ইতিপূর্বে মিশরের জিহাদী আন্দোলন যদিও ইসলামের শত্রুদের বিরুদ্ধে জিহাদ করেছে, কিন্তু তাদের সাধারণ পরিকল্পনাগুলো ক্ষমতাসীন সরকারকে টার্গেট করে ছিল না। বরং তা প্রধানত বহি:শত্রুকে লক্ষ্য করে ছিল। আন্দোলনের চিন্তাধারা ও প্রচারণা যথাসম্ভব ক্ষমতাসীন সরকারের নৈকট্য অর্জন এবং তাকে দেশের শরয়ী শাসক অভিধায় সম্বোধন করতে সচেষ্ট ছিল।
বহি:শত্রু ও অভ্যন্তরীণ দালালদের মাঝে এই মারাত্মক বিভাজন অনেক বিপদ ও দুর্যোগ ডেকে আনে। কারণ জিহাদী আন্দোলনের কর্মীরা তাদের বুকের মাধ্যমে বহি:শত্রুর মোকাবেলা করত, কিন্তু নিজেদের পিঠ তাদের (বহি:শত্রুর) বন্ধুদের জন্য উম্মুক্ত রেখে দিত। ফলে বুক দিয়ে যাদের মোকাবেলা করছে, তাদেরই আদেশে পেছন দিক থেকে তাদের বন্ধুদের হাতে আঘাত প্রাপ্ত হত।
আব্দুন নাসের ও তার পশ্চাতে কমিউনিজমের পৃষ্ঠপোষকরা শহীদ উস্তাদ সায়্যিদ কুতুব রহ.কে হত্যার ষড়যন্ত্র করল। কারণ তিনিই ইসলামে তাওহিদের বিষয়টির গুরুত্ব ফুটিয়ে তোলার উপর জোর দিয়েছেন এবং তিনিই এ ধারণা পেশ করেছেন যে: ইসলাম ও তার শত্রুদের মধ্যকার যুদ্ধ মূলত তাওহিদী আকিদার যুদ্ধ বা শাসনকর্তৃত্ব ও ক্ষমতা কার জন্য হবে, আল্লাহর বিধান ও শরীয়তের জন্য হবে, নাকি দেশীয় নীতি, বস্তুবাদী আদর্শ বা স্রষ্টা ও সৃষ্টির মাঝে মধ্যস্থতার দাবিকারীর জন্য হবে??
ইসলামী আন্দোলনের জন্য এই গুরুত্বারোপের সুস্পষ্ট প্রভাব ছিল তাদের শত্রুদেরকে চেনা ও সংজ্ঞায়িত করার ক্ষেত্রে এবং এই উপলব্ধি সৃষ্টির ক্ষেত্রে যে, অভ্যন্তরীণ শত্রুর ভয়াবহতাও বহি:শত্রু থেকে কোন অংশেই কম নয়। বরং এটি হল একটি যন্ত্র, যাকে বহি:শত্রুরা ব্যবহার করছে। এটি একটি আবরণ, যাকে ইসলামের বিরুদ্ধে যুদ্ধে আড়াল হিসাবে ব্যবহার করছে।
সায়্যিদ কুতুব রহ. এর সঙ্গে যুক্ত দলটি সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, তারা বর্তমান সরকারকে ইসলমের সাথে শত্রুতাকারী, আল্লাহর বিধান থেকে বিচ্যুত ও আল্লাহর শরীয়তের শাসন প্রত্যাখ্যানকারী হিসাবে যুদ্ধের লক্ষবস্তু বানিয়ে আঘাত হানবে।
কিন্তু এ গ্রুপটির পরিকল্পনা ছিল খুব সাধারণ। তারা সরকার পরিবর্তন বা সরকারকে অপসারণ করার টার্গেট করেনি। বরং তাদের টার্গেট ছিল শুধু, যখন সরকার মুসলমানদের বিরুদ্ধে নতুন কোন শাস্তিমূলক আক্রমণের ষড়যন্ত্র করবে, তখন তাদের উপর আত্মরক্ষা, প্রতিবাদ ও প্রতিশোধ মূলক হামলা করবে।
কিন্তু এ পরিকল্পনার মাঝে বস্তুগত শক্তির চেয়ে মনস্তাত্ত্বিক তাৎপর্যটিই ছিল বড়। কারণ এর সুস্পষ্ট অর্থ হল: তারা সরকারকে ইসলামের শত্রু হিসাবে গণ্য করে তার বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করে দিয়েছে। অথচ ইতিপূর্বে তাদের নীতি ও আদর্শ ছিল: বহি:শত্রুই শুধু ইসলামের শত্রু, যা এখনো তাদের কেউ কেউ বুলি হিসাবে আওড়ায়।
যদিও সায়্যিদ কুতুব রহ. এর দলটি নাসিরী সরকারের আগ্রাসনের শিকার হয়েছে, তার সদস্যদেরকে শাস্তি দেওয়া হয়েছে, কিন্তু তা সত্বেও মুসলিম যুব সমাজের মাঝে এ দলটির বিরাট প্রভাব ঠেকাতে সরকার ছিল ব্যর্থ।
কারণ সায়্যিদ কুতুব রহ. আল্লাহর একত্বকে নিখাদ করা, আল্লাহর শাসনকর্তৃত্বের নিকট পরিপূর্ণ আত্মসমর্পণ করা এবং আল্লাহ প্রদত্ত জীবন ব্যবস্থার নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা করার যে দাওয়াত দিয়েছেন, তা ইসলামের ভেতর-বাহিরের শত্রুদের বিরুদ্ধে ইসলামী আন্দোলনের শিখা প্রজ্জলিত করার প্রথম স্ফুলিঙ্গ হিসাবে কাজ করেছিল এবং এখনো পর্যন্ত তার রক্তাক্ত পাঠগুলো প্রতিদিন নতুন রূপে আবির্ভূত হচ্ছে।
সেই বিপ্লব, যা প্রতিদিনই আকিদায় সুদৃঢ় হচ্ছে, আদর্শে সুস্পষ্ট হচ্ছে, লড়াইয়ের প্রকৃতিতে অভিজ্ঞ হচ্ছে এবং পথের দুস্তরতায় সজাগ হচ্ছে। এটাই সমস্ত নবী, রাসূল ও কিয়ামত পর্যন্ত আগত তাদের অনুসারীদের পথ।
এটাই সে পথ, বিংশ শতাব্দির শেষভাগে বিশেষত: মিশরের এবং সাধারণভাবে সমস্ত আরব অঞ্চলের মুসলিম যুবকদেরকে যে পথে পরিচালনা করার ক্ষেত্রে সায়্যিদ কুতুব রহ. এর বিরাট অবদান ছিল।
সায়্যিদ কুতুব রহ.এর শাহাদাতে তার কথাগুলো এমন মর্যাদা লাভ করেছে, যা অন্য অনেকের কথাই লাভ করেনি। বক্তার রক্তে অংকিত এ কথাগুলোই মুসলিম যুবকদের চোখে এক দীর্ঘ সম্মানজনক পথের নিদর্শন হয়ে গেছে এবং সায়্যিদ কুতুব রহ. এর তাওহিদের দাওয়াতে নাসিরী সরকার ও তার কমিউনিষ্ট মিত্ররা কী পরিমাণ ভীত-সন্ত্রস্ত ছিল তাও স্পষ্ট হয়েছে।
উস্তাদ সাইয়িদ কুতুব রহ. বলেন:
“সব কথা অন্যদের হৃদয়ে পৌঁছে না, হৃদয়কে নাড়া দেয় না। অন্তরসমূহকে একত্রিত ও তাড়িত করে না। একমাত্র রক্তের কালিতে লিখা কথাই তা পারে। কারণ তা জীবিত মানুষের অন্তরসমূহের খোরাক যোগায়। যে কথাই বেঁচে থেকেছে, তা মানুষের অন্তরের খোরাক যুগিয়েই বেঁচে থেকেছে। পক্ষান্তরে যে সকল কথা মুখে জন্ম নিয়েছে, যবান ছুঁড়ে মেরেছে এবং তার সাথে আল্লাহ প্রদত্ত জীবন্ত উৎস মিলিত হয়নি, তা মৃতভাবেই জন্ম লাভ করেছে, তা মানবতাকে এক বিন্দুও আদর্শের দিকে এগিয়ে নিয়ে যায়নি। কেউ সেটাকে গ্রহণ করে নিবে না, কারণ তা মৃতভাবে জন্ম লাভ করেছে। আর মানুষ মৃত বস্তু গ্রহণ করে না।”
সায়্যিদ কুতুব রহ. সত্য কথা বলার এক আদর্শ ও হকের উপর অটল থাকার এক নমুনা হয়ে গেছেন। কারণ তিনি তাগুত জালিমের সামনে সত্য কথা বলেছেন আর এর মূল্য দিয়েছেন নিজের জীবন দিয়ে। আর তার কথার মূল্য বহুগুণে বৃদ্ধি করে দিয়েছে তার সেই মহান অবস্থান, যখন তিনি জামাল আব্দুন নাসেরের নিকট ক্ষমার আবেদন করতে অস্বীকৃতি জানিয়ে তার সেই প্রসিদ্ধ কথাটি বলেছিলেন:
“যে শাহাদাত আঙ্গুল প্রতিদিন নামাযে আল্লাহর একত্ববাদের সাক্ষ্য দেয়, তা কখনো জালিমের নিকট অনুগ্রহের আবেদন লিখতে পারে না।”
নাসিরী সরকার ধারণা করেছিল যে, সায়্যিদ কুতুব রহ.কে তার কতক সঙ্গীসহ হত্যা করা এবং ইসলামী আন্দোলনের হাজার হাজার কর্মীদের কারারূদ্ধ করার দ্বারা ইসলামী আন্দোলনের কফিনে শেষ পেরেক ঠুকে দিয়েছে, কিন্তু আবরণের উপরের বাহ্যিক নিরবতার আড়ালে ছিল সায়্যিদ কুতুব রহ. এর চিন্তাধারা ও দাওয়াতের তাৎক্ষণিক প্রভাব এবং মিশরে আধুনিক জিহাদী আন্দোলনের অঙ্কুরোদগম।
এভাবেই সেই বীজের অঙ্কুরোদগম হয়েছিল, যার সঙ্গে এই লেখক ও জামাতুল জিহাদ সম্পৃক্ত।
১৯৬৫ সালে নাসিরি সরকারের আগ্রাসী হামলা মিশরীয় জনগণকে এতটা আঘাত করে, যা ইতিপূর্বে করেনি। এটা ছিল ইসলামী আন্দোলনের প্রতি নাসিরি সরকারের সর্বাধিক কঠিন হামলা। এ আঘাত মিশরীয় সমাজে দু’টি প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে:
প্রথম প্রতিক্রিয়া: কারাবন্দিদের থেকে ছড়ানো ঘটনাবলী, বিভিন্ন অভিযানের সংবাদ এবং তাতে সরকার যে বীভৎস কর্মকাণ্ড ও অপরাধযজ্ঞ সংঘটিত করে, তার কারণে ত্রাস। যা মিশরীয় জনগণের মাঝে গভীর নেতিবাচক উপলব্ধি, সরকারের ব্যাপারে নাক গলানো থেকে দূরে থাকার মানসিকতা এবং জীবনোপকরণ অর্জনের প্রতি অনিহা সৃষ্টি করে।
দ্বিতীয় প্রতিক্রিয়া: যারা ক্ষমতার নেশায় ইসলাম ও মুসলিমদের উপর সীমালঙ্ঘন করল এবং প্রতিটি হারামকে হালাল বানিয়ে ফেলল তাদের ব্যাপারে ক্রমবর্ধমান সুপ্ত ক্রোধ ও প্রতিশোধের স্পৃহা। এ উপলব্ধিই সাধারণভাবে মিশরীয় জনগণকে, যাদের সিংহভাগই দ্বীনদার- ইখওয়ানুল মুসলিমীনের প্রতি সহানুভূতিশীল করে তুলে। বিশেষ করে যখন তারা ঘরের সম্মানিত বস্তু, তথা নারীদের উপর সরকারের সীমালঙ্ঘনের বিষয়ে জানতে পারল।
Comment