দ্বিতীয় অধ্যায়:
সাদাত: নিহত, অতঃপর আসামী
প্রথম পরিচ্ছেদ:
নিজ উৎসবের দিনে ফেরাউন ভূপাতিত হল
সাদাত: নিহত, অতঃপর আসামী
প্রথম পরিচ্ছেদ:
নিজ উৎসবের দিনে ফেরাউন ভূপাতিত হল
এই পরিচ্ছেদে আনওয়ার সাদাত হত্যা ও তৎসংশ্লিষ্ট ঘটনাবলী সংক্ষেপে নিম্নের শিরোনামগুলোর অধীনে আলোচনা করব ইনশাআল্লাহ :
১- সাদাতের হত্যার পূর্ববর্তী ঘটনাবলী।
ক. মিশরীয় সেনাবাহিনীর পরাজয় এবং অবৈধ চুক্তিসমূহের মাধ্যমে মিশরের নিরাপত্তাকে হুমকির সম্মুখীন করা।
খ. আল-কুদস ভ্রমণ ও দু’টি শান্তিচুক্তি।
গ. ১৯৮১ সালের সেপ্টেম্বরের গণগ্রেফতার।
২- মিশরে জিহাদী চেতনার বিস্ফোরণ।
৩- যিলহাজ্জ ১৪০১ হিজরীর ইসলামী বিদ্রোহ।
৪- নির্যাতনের স্টিমরোলার।
৫- প্রসিকিউশন তদন্তের প্রহসন।
৬- সামরিক আদালত।
***
১- আনওয়ার সাদাত হত্যাকাণ্ডের পূর্ববর্তী ঘটনাবলী
সাদাতের যুগ ছিল পূর্ববর্তী যুগের মতই ধর্মনিরপেক্ষতাবাদি শাসনের যুগ। কিন্তু তা বিশেষভাবে দুর্ণীতি, আত্মসাৎ, ইসলামের বিরুদ্ধে যুদ্ধ এবং ইসলামের হৃদপিণ্ডসম অঞ্চলে আমেরিকা ও ইহুদীদেরকে জায়গা দেওয়ার বৈশিষ্ট্যে বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত ছিল। এ বিষয়গুলোর কারণেই তার হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়েছিল। এখানে আমি তন্মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো সংক্ষেপে তুলে ধরছি:
ক. মিশরীয় সেনাবাহিনীর পরাজয় এবং অবৈধ চুক্তিসমূহের মাধ্যমে মিশরের নিরাপত্তাকে হুমকির সম্মুখীন করা:
(১) ১৯৭৪ সালের জানুয়ারীতে প্রথম চুক্তি:
মুহাম্মদ আব্দুল গণি আল জামাসি এ চুক্তি সম্পাদনের পদ্ধতি, এ ঘটনাগুলোর ভয়াবহতা এবং ইসরাঈল বিরোধী লড়াইয়ে মুসলিম উম্মাহর স্বার্থের উপর এর যে ধ্বংসাত্মক প্রভাবসমূহ পড়েছে, তা সুস্পষ্টভাবে বর্ণনা করতে গিয়ে বলেন:
“আসওয়ানে আমার কাজের মূল পর্ব শুরু হয়, যখন মিশরীয় ও আমেরিকান প্রতিনিধি দলের মাঝে সংঘটিতব্য সংলাপ অনুষ্ঠানে আমাকে ডাকা হয়। ইতিপূর্বে প্রেসিডেন্ট সাদাত আমাকে তার মাঝে ও কিসিঞ্জারের মাঝে পূর্ব-সম্পাদিত এমন কোন চুক্তির ব্যাপারে ঘূর্ণাক্ষরেও বলেননি, যা তাদের মাঝে আলোচিত কোন সামরিক বিষয়ে সম্পাদিত হয়েছে, যা চুক্তির অন্তর্ভূক্ত হবে।
...........
আমরা একটি কার্যকরী ও গোপন সংলাপ পরিচালনার জন্য প্রায় দু’ঘন্টাব্যাপী বৈঠক করলাম। এতে কিছু রাজনৈতিক ও কিছু সামরিক বিষয়ে পর্যালোচনা হল। কিসিঞ্জার উপস্থিত নেতৃবৃন্দকে চুক্তির সেই শর্তগুলোর প্রতি গুরত্বারোপ করতে বলেন, যা সামরিক বিষয়ে প্রেসিডেন্ট সাদাতের সাথে চূড়ান্ত হয়েছে। তখনই আমি ও উপস্থিত নেতৃবৃন্দ পিলে চমকে উঠলাম, যখন কিসিঞ্জার উল্লেখ করলেন যে, প্রেসিডেন্ট সাদাত পূর্বতীরে সেনার পরিমাণ হ্রাস করতে সম্মত হয়েছেন। ফলে সেখানে থাকবে ৭ হাজার সৈন্য, ৩০ টি ট্যাংক এবং অল্পকিছু গোলাবরুদ। আমি উপলব্ধি করলাম, কী পরিমাণ শক্তি হ্রাস হবে। অথচ ইতিপূর্বে আমাদের দু’টি বাহিনীর সেনা ছিল, যাদের সৈন্যসংখ্যা নতুন সংখ্যার দশগুণের বেশি হবে। আমরা চাইলে পূর্বতীরে ৩০০ টি ট্যাংক রাখতে পারতাম। এছাড়া প্রাকৃতিক পরিবেশের দাবি হিসাবেও আমাদের বিরাট সংখ্যক গোলন্দাজ বাহিনী থাকার কথা ছিল, সিনাই এর বাহিনীকে সাহায্য করার জন্য। আমার মনে পড়ে, আমি শক্তির পরিমাণ হ্রাস করার প্রস্তাবিত শর্ত প্রকাশ্যে প্রত্যাখ্যান করি। আমি ডাক্তার কিসিঞ্জারকে তীব্র ভাষায় বললাম: আপনি ইসরাঈলকে তাদের বাহিনীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করার সবকিছুই দিচ্ছেন আর আমাদেরকে আমাদের বাহিনীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করার সবকিছু থেকে বঞ্চিত করছেন...। আমি এর উপর একমত পোষণ করতে পারি না। কোন স্বশস্ত্র বাহিনীর সামরিক কমান্ডারের জন্যই তার স্বশস্ত্র বাহিনীর সামনে এ ধরণের চুক্তির বৈধতা উপস্থাপন করা সম্ভব নয়।
কিসিঞ্জার বললেন: “এটা তো ভবিষ্যৎ শান্তিতে কৌশলগত ভূমিকা রাখবে। এটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এটার ভিত্তিতেই পূর্বতীরে প্রস্তাবিত সংখ্যক মিশরীয় সেনা ও অস্ত্র রাখার উপর চুক্তি হয়েছে।”
আমি তাকে বললাম: আমি তো শান্তি নিয়ে কথা বলছি না। আমি আমাদের বাহিনীর নিরাপত্তা নিয়ে কথা বলছি...। আমার চক্ষুদ্বয় অশ্রুতে ভরে গেল। আমি আবেগাপ্লুত হয়ে সভাকক্ষ ত্যাগ করে বাথরুমের দিকে রওয়ানা দিলাম...।
ইসমাঈল ফাহমি বলেন: আমি কক্ষ ত্যাগ করার পরই সকলে গুঞ্জন করতে লাগল, মিশরীয় প্রতিনিধি দলের অনুভূতি প্রভাবিত হল। তারাও হুবহু জামাসির মতই অনুভব করতে লাগলেন। আর যে কেউ মার্কিন প্রতিনিধি দলের চেহারা দেখেও বুঝতে পারত যে, তারাও মিশরের উপর জুলুম হওয়ার বিষয়টি বুঝতে পেরেছে। কিন্তু কিসিঞ্জার শুধুমাত্র নিজ স্বার্থ চিন্তা করছে। তার রংও ফ্যাকাশে হয়ে গেছে। সে আমতা আমতা করে বলতে লাগল: আমি কী ভুলটা বলেছি?
তারপর আমি এ নিয়তে সভাকক্ষে ফিরে আসলাম যে, সভা শেষ হওয়া পর্যন্ত নিরব থাকব।
.........
পরের দিন প্রেসিডেন্ট আমাকে আসওয়ানের লাউঞ্জে নিজ অফিসে ডেকে নিলেন।
...........
আমি প্রেসিডেন্টের সামনে সামরিক দৃষ্টিভঙ্গি ব্যাখ্যা করলাম এই বলে যে: পূর্বতীরে আমাদের সেনার প্রস্তাবিত পরিমাণ কখনোই আমাদের দেশের সুরক্ষা নিশ্চিত করবে না, যার প্রায় ১০০ কিলোমিটার আমাদের সেনারা লড়াই করে মুক্ত করেছে। অক্টোবরের যুদ্ধে ইসরাঈলের যে পরাজায় হয়েছে তা ইসরাঈল কখনো ভুলতে পারবে না। এজন্য তাদের পক্ষ থেকে আমাদের সেনাদের উপর আক্রমণের সম্ভাবনা আমরা অস্বীকার করতে পারব না।
..........
আমার কথার শেষ পর্যায়ে গিয়ে আমি প্রেসিডেন্টের কাছে প্রস্তাব রাখলাম (সেই সময়ের প্রতিরক্ষামন্ত্রী) আহমাদ ইসমাঈলকে আসওয়ানে ডেকে পাঠানোর জন্য, যাতে উক্ত বিষয়ে পর্যালোনা করা যায় ও তার মতামত জানা যায়।
প্রেসিডেন্ট জবাব দিলেন: তিনি কখনো আহমাদ ইসমাঈলকে ডাকবেন না এবং আমেরিকার সাথে যে রাজনৈতিক কূননৈতিক পরিবেশ বিরাজ করছে তার স্বার্থে তার মাঝে ও কিসিঞ্জারের মাঝে সংঘটিত চুক্তি মেনে চলা আবশ্যক। তিনি এ বলে প্রত্যাখ্যান করলেন যে: “সেনাসংখ্যা যা নির্ধারণ করা হয়েছে তার মাধ্যমেই পূর্বতীর সুরক্ষার উপযুক্ত পরিকল্পনা নিতে হবে।”
সাংলাপ নিয়ে যা উল্লেখ করা হল তা থেকে কয়েকটি বিষয় উঠে আসে:
১- সর্বপ্রথম যে জিনিসটি মানুষ উদঘাটন করার চেষ্টা করবে তা হল, সাদাত তার মন্ত্রীপরিষদ ও সহকারীদের সাথে কী নীতি অবলম্বন করত? সে একাকি কিসিঞ্জারের সাথে মিলিত হল। তারপর কিসিঞ্জারকে বলল, তারা কী কী বিষয়ে একমত হয়েছে তা তাদেরকে জানিয়ে দিতে।
২- এর থেকেও দূর্লভ বিষয় হল, এ সকল মন্ত্রী ও সহযোগীরা সাদাতের বাতলে দেওয়া এসব মারাত্মক লাঞ্ছনাগুলো মেনে নিল।
৩- তারপর যে বিষয়গুলোকে তারা দেশের অধিকার নষ্ট করা ও দেশের নিরাপত্তা হুমকিতে ফেলে দেওয়া বলে মনে করে, অর্থাৎ যেগুলোকে স্পষ্ট বিশ্বাসঘাতকতা ও ইসরাঈলের কাছে আত্মসমর্পণ বলে মনে করে, সেগুলোর ব্যাপারে চুপ থাকে, আনুগত্য করে যায়, এত কিছু সত্ত্বেও এসকল রাজনীতি বাস্তবায়নে অংশগ্রহণ করে, এসকল চুক্তিতে স্বাক্ষর করে এবং নিজ নিজ পদে বহাল থাকে, বরং আরো উন্নতি লাভ করে।
এক্ষেত্রে জামাসিই সবচেয়ে স্পষ্ট উদাহরণ। সে তার পদে থাকাবস্থায়, সিভিল সার্ভিস থেকে অব্যাহতি পাওয়ার পর এবং ‘স্মৃতিকথা’ লেখার সময় এই জুলুম ও অন্যায় উপলব্ধি করা সত্ত্বেও এ উপলব্ধি তাকে সরকারের সেবায় বহাল থাকতে বাঁধা দিল না, যে সরকারের সে বারবার সমালোচনা করেছে। এমনকি লাগাতার পদোন্নতিও লাভ করেছে। অবশেষে প্রধানমন্ত্রীর সহকারী ও যুদ্ধমন্ত্রী এবং তারপর সাদাতের সামরিক উপদেষ্টার পদ পর্যন্ত প্রমোশন পেয়েছে।
জামাসির অবস্থা এ পর্যন্ত পৌঁছেছে- যেমনটা তিনি নিজেই বর্ণনা করেছেন- যে, তিনি নিজের সামনে ইসরাঈলের নিকট আত্মসমর্পণ এবং মার্কিন অহংকারের কাছে মাথা নত করতে দেখে তীব্র লাঞ্ছনায় কাঁদতে কাঁদতে আলোচনার মজলিস থেকে বের হয়ে গেছেন। মার্কিনীদের প্রতিনিধি হয়ে কিসিঞ্জার মিশরীয়দেরকে এটা জানাতে আসেন যে, তাদেরকে কী কী বাস্তবায়ন করতে হবে এবং তিনি সাদাতের সাথে কী কী বিষয়ে চুক্তি করেছেন। এই প্রত্যাখ্যান সত্ত্বেও জামাসি কমিটি-প্রধানের পদমর্যাদায় এই চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন, যদিও তিনি তা প্রত্যাখ্যান করে কাঁদতে কাঁদতে হল পরিত্যাগ করেছিলেন।
এখানে কয়েকটি প্রশ্ন উঠে: আমাদের জাতির অবস্থা কেন এ পরিমাণ আত্মসমর্পণ, অপমান সহ্য করা ও লাঞ্ছনা মেনে নেওয়ার পর্যায়ে পৌঁছল? কেন মিশরীয় সেনাবাহিনীকে প্রতিটি ব্যক্তিত্ববান ও স্বীয় প্রতিপালকের প্রতি আত্মমর্যাদাশীল মুমিন থেকে পবিত্র করা হল? যার ফলে শুধুমাত্র প্রতিটি এমন লোকই অবশিষ্ট রয়ে গেল, যারা বেতন ও পদোন্নতির জন্য নিজেকে লাঞ্ছিত করতে পারে এবং আত্মসমর্পণ করতে পারে? এর কারণ কি অব্যাহত আগ্রাসী হামলা ছাড়া অন্য কিছু হতে পারে? যে হামলা ধর্মনিরপেক্ষ শাসকগোষ্ঠী নিজ দ্বীন, উম্মাহ ও সম্মানের ব্যাপারে আত্মমর্যাদাশীল প্রতিটি মুমিন ও মুসলিমের বিরুদ্ধে চল্লিশের দশক থেকে আজও পর্যন্ত মিশরে চালিয়ে আসছে?
অব্যাহত আগ্রাসন ও নিধন অভিযান, মর্যাদাশীল লোকদের জন্য একটিই পথ খোলা রেখেছে। তা হল, তারা তাদের অস্র তুলে নিয়ে যুদ্ধে নেমে পড়বে। লড়াইয়ের পরিণতি হিসাবে বন্দিত্ব ও হত্যা বরদাশ্ত করবে। পক্ষান্তরে যে বিকল্পটি কোন মর্যাদাশীল মানুষের পক্ষে গ্রহণ করা সম্ভব নয়, তা হচ্ছে এ সকল অবস্থা, যা এ যাবত মিশরে চলে এসেছে এবং এখনো চলছে তা মেনে নেওয়া। দেশ বিক্রি করে দেওয়া হয় আর বেতনের পূজারীরা একের পর এক চুক্তির কাছে মাথা নত করে রাখে। বরং তা সম্পাদনে তারা নিজেরা অংশগ্রহণ করে। এই চুক্তির ব্যাপারে জামিয়া আরাবিয়ার সাবেক প্রধান নির্বাহি মিশরের সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাহমুদ রিয়ায বলেন:
“সাদাত শান্তির নামে একের পর এক যে চুক্তিগুলো স্বাক্ষর করেন, তারই ধারাবাহিকতায় প্রথম ধাপ ছিল এ চুক্তিটি। প্রতিটা চুক্তিই পূর্বেরটার তুলনায় অধিক হীনতা বহন করত।”
***
১ম পর্ব
২য় পর্ব
৩য় পর্ব
Comment