(২) ১৯৭৫ সালের সেপ্টম্বরে সংঘাত বন্ধের দ্বিতীয় চুক্তি:
এ সম্পর্কে প্রাক্তন যুদ্ধমন্ত্রী মুহাম্মদ ফাওযী বলেন:
“জানুয়ারি ১৯৭৪ এর সংঘাত বন্ধ করা ছিল সামরিক ক্ষেত্রে ইসরাঈলের স্বার্থে কিসিঞ্জারের গৃহিত সর্ববৃহৎ পদক্ষেপ, যেখানে তিনি ইসরাঈলী ছিটমহল মুক্ত করেন এবং ইসরাঈলকে গিরিপথে থাকার সুযোগ করে দেন। আর ১৯৭৫ এর সেপ্টেম্বরে দ্বিতীয় সংঘাত নিরসন চুক্তি ছিল ইসরাঈলের রাজনৈতিক স্বার্থরক্ষাকারী সর্ববৃহৎ পদক্ষেপ। তাতে যা ছিল:
ইসরাঈলের দিক থেকে: গিরিপথের পূর্ব রেখার দিকে সীমিত আকারে সরে আসার কার্যক্রম চালুর প্রতিশ্রুতি।
মিশরের দিক থেকে: প্রতিশ্রুতির প্রথম ধারা: মধ্যপ্রাচ্যে ইসরাঈল-মিশর দ্বন্দ্ব স্বশস্ত্র শক্তির মাধ্যমে সমাধান করা সম্ভব নয়। বরং বিভিন্ন শান্তিপূর্ণ উপায়ে করতে হবে।
দ্বিতীয় ধারায়: কোন পক্ষ অপর পক্ষের বিরুদ্ধে কোনরূপ শক্তি ব্যবহার বা এর মাধ্যমে হুমকি প্রদান বা সামরিক অবরোধ আরোপ না করার প্রতিশ্রুতি দিবে।
সপ্তম ধারায়: সুইজ খাল দিয়ে ইসরাঈল অভিমুখী যেকোন বেসামরিক জাহাজ অতিক্রম করা বা ইসরাঈল থেকে বের হওয়ার স্বাধীনতা থাকার মর্মে মিশর প্রতিশ্রুতি দিবে।
এভাবে সাদাত আংশিক সমাধানের জন্য আলোচনার শুরু থেকেই ইসরাঈলের শর্তগুলো মেনে নেওয়ার মাধ্যমে ইসরাঈলের সাথে সর্বপ্রকার যুদ্ধাবস্থা শেষ করে দেয়। পক্ষান্তরে ইসরাঈলী বাহিনী মিশরের ভূমিগুলো দখল করতে থাকে, কিন্তু মিশর তাকে বিতাড়নের জন্য কোন প্রকার সামরিক শক্তি ব্যবহারের অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়।
১৯৭১ সালে মিশরের নিকট এই আংশিক চুক্তির প্রস্তাব করা হয়েছিল। তখন ইসরাঈল পরবর্তী ধাপে আন্তর্জাতিক সীমানার দিকে সরে আসার প্রতিশ্রুতি না দেওয়ার কারণে মিশর তা প্রত্যাখ্যান করেছিল। আর অক্টোবরের যুদ্ধ ও তাতে মিশর যা কিছু সাফল্য অর্জন করেছিল, তারপরও সাদাত সেই আংশিক সমাধানেই একমত হয়ে গেল, যা ১৯৭১ সালে মিশর প্রত্যাখ্যান করেছিল।”
মাহমুদ রিয়াদ এই চুক্তি সম্পর্কে আরো বলেন:
“এই রাজনৈতিক চুক্তির মাঝে আশ্চর্যের বিষয় হল, ইসরাঈলের এই অন্যায় শর্তগুলোর কাছে মাথা নত করতে কোন কিছুই সাদাতকে লজ্জিত করল না, যা কিনা মিশরের নিজ ভূমিগুলোর উপরও কর্তৃত্ব করার অধিকার খর্ব করে। সাদাত এই চুক্তির মাধ্যমে মিশরের আরো বেশি রাজনৈতিক ও সামরিক ক্ষতি ছাড়া কিছুই বৃদ্ধি করেনি।”
চুক্তিতে অন্তর্ভূক্ত গোপন প্রতিশ্রুতিগুলোর দাবি অনুযায়ী- যার সংখ্যা ১২ টি প্রতিশ্রুতি- সাদাত মূলত: ইসরাঈলের সাথে ব্যক্তিগত সন্ধি করেছে। এমনিভাবে শুধু আরব বিশ্ব থেকে নয়, আফ্রিকা থেকেও সেভিয়েত ইউনিয়নকে বহিস্কার করার ক্ষেত্রে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে সহযোগীতা করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে।
খ. আল কুদস ভ্রমণ ও দু’টি শান্তিচুক্তি।
১৯৭৭ সালে সাদাতের আল কুদস ভ্রমণ এবং ১৯৭৮ সালে ক্যাম্প ডেভিড চুক্তিদ্বয়, অতঃপর ১৯৭৯ এর ১৭ ডিসেম্বরে মিশর-ইসরাঈল শান্তিুচুক্তি ছিল মধ্যপ্রাচ্যের ইতিহাসে ভয়াবহতম ঘটনা। এখানে আমি মিশরের যুদ্ধমন্ত্রী (১৯৭৪ এর ডিসেম্বর থেকে ১৯৭৮ এর অক্টোবর পর্যন্ত) আব্দুল গনী জামাসির মন্তব্যটি উল্লেখ করব। তিনি এমন একজন ব্যক্তি, যিনি একজন পেশাদার সামরিক ব্যক্তি হিসাবে পরিচিতি লাভ করেছেন, যার রাজনীতির সাথে কোন সম্পর্ক নেই, বরং তিনি হলেন প্রশাসনের লোক। তিনি সরকারের পক্ষ থেকে উচ্চ মর্যাদা লাভ করেছেন। এতদসত্ত্বেও এ ব্যক্তি এক্ষেত্রে নিরবতা সহ্য করতে পারেননি। তাই তিনি শান্ত ভাষায় এই দুঃখ ব্যক্ত করেছেন, যাতে সরকারের সাথে সংঘর্ষ বেঁধে না যায়। কিন্তু একই সময়ে তিনি সেই প্রকাশ্য বাস্তবতাকেও গোপন করতে পারেননি, যা প্রকাশ করলে যেকোন মিশরীয় সামরিক ব্যক্তিই সংঘাতে জড়িয়ে পড়তে বাধ্য। তিনি তার ‘স্মৃতিকথা’য় বলেন:
“ক্যাম্প ডেভিড চুক্তি ছিল মধ্যপ্রাচ্য সংঘাতের সর্বশেষ ধাপ। আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে আমেরিকান যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থে দু’টি বড় শক্তির মাঝে লড়াইয়ের অবসান ঘটেছে। যে লড়াই ১৯৫৬ সালে শুরু হয়েছিল, ১৯৬৭ সালে চূড়ান্ত বিন্দুতে পৌঁছেছিল এবং ১৯৭৮ সালে সমাপ্ত হয়েছে। আরব বিশ্বের প্রেক্ষাপটে এই চুক্তি মিশরকে আরব-ইসরাঈল যুদ্ধের গণ্ডি থেকে বের করে দেয়, যা এ লড়াইয়ে রাজনৈতিক ও সামরিকভাবে আরব রাষ্ট্রগুলোর অবস্থানকে দুর্বল করে দেয় আর ইসরাঈলকে উক্ত অঞ্চলে কৌশলগত শক্তিশালী অবস্থান দান করে এবং তাকে বর্তমান ধাপেই অবশিষ্ট ফিলিস্তীন গ্রাস করার জন্য স্বাধীনভাবে কাজ করা এবং পরবর্তী ধাপে প্রতিবেশি আরব রাষ্ট্রগুলোতেও নাক গলানোর সুযোগ করে দেয়। দেশীয় প্রেক্ষাপটে এই চুক্তি ও তৎপরবর্তী মিশর-ইসরাঈল শান্তি-চুক্তিগুলো আমাদেরকে কঠিন শর্তের অধীনে সিনাই উপত্যকা ফিরিয়ে দিলেও তা ইসরাঈলকে শক্তিশালী কৌশলগত অবস্থানে এবং মিশর-ইসরাঈল সংঘাতকে সর্বশেষ স্তরে নিয়ে যায়। যে স্তর শুরু হয়েছিল অক্টোবর ১৯৭৩ সালে, অতঃপর ১৯৭৭ সালে আল কুদস ভ্রমণের মাধ্যমে আর শেষ হয়েছে ১৯৭৮ এ ক্যাম্প ডেভিড চুক্তির মাধ্যমে। এ চুক্তি ও তারপর প্রতিশ্রুতির ধারাগুলো ঘোষণার মাধ্যমে এই অঞ্চলের ইতিহাসে নতুন একটি ধাপ শুরু হয়েছে। এমন ধাপ, মধ্যপ্রাচ্যে বৃহৎ দুই শক্তির সংঘাতে যার গভীর প্রতিফলন রয়েছে। যার গভীর প্রতিফলন রয়েছে আমাদের আরব ভূমিতেও। রয়েছে অনেক ফলাফল ও পরিণতি। সম্ভবত: তার মধ্যে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি হল, উক্ত অঞ্চলে নিরাপত্তা ব্যবস্থার পরিবর্তন। যার ফলে মধ্যপ্রাচ্যের নিরাপত্তা ব্যবস্থায় প্রধান খেলোয়ারের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র।”
অর্থাৎ জামাসি বলতে চাচ্ছেন, এই চুক্তি ইসরাঈলকে শক্তিশালী করেছে আর মিশরকে তার মোকাবেলা করতে অপারগ করে দিয়েছে। আর ক্যাম্প ডেভিড চুক্তি ও তার পরবর্তী শান্তিচুক্তির মাধ্যমে আমাদের দেশের উপর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কর্তৃত্বের যুগ শুরু হয়েছে।
গ. ১৯৮১ সালের সেপ্টেম্বরের গ্রেফতার অভিযান
এটা ছিল সাদাতের নির্দেশে গণগ্রেফতার অভিযান। এতে গ্রেফতারকৃতদের সংখ্যা সরকারের দাবি অনুযায়ীই ১৫০০ বন্দিতে পৌঁছেছে। এ সকল বন্দিদের সিংহভাগই ছিল ইসলামী আন্দোলনগুলোর সদস্য।
সাদাত এই গ্রেফতারের মাধ্যমে মৌলিকভাবে তার ইসরাঈলপন্থী রাজনীতির যেকোন প্রতিদ্বন্দ্বী থেকে মুক্ত হতে চেয়েছিল। যাদের মধ্যে একজন ছিলেন শায়খ আহমাদ আল মুহাল্লাবি, যাকে সাদাতের ভাষায়- ‘কুকুরের মত কারাগারে নিক্ষেপ করা হয়েছে’।
এই গণগ্রেফতার এবং তাতে যে সীমালঙ্ঘন হয়েছে, বিশেষত: শায়খ আহমাদ আল মুহাল্লাবির উপর, এগুলোই আনওয়ার সাদাত হত্যার প্রত্যক্ষ কারণগুলোর মধ্যে সর্বাধিক গুরত্বপূর্ণ।
সে বন্দিদেরকে ‘তোরা সংবর্ধনা কারাগার’ নামে একটি নতুন কারাগারে রাখে। যেটা শুধুমাত্র রাজনৈতিক বন্দি ও ইসলামি আন্দোলনের সদস্যদের রাখার জন্য বিশেষভাবে নির্মাণ করা হয়েছে। যা প্রমাণ করে সাদাত অনেক পূর্বেই এই গণগ্রেফতারের পরিকল্পনা করেছিল।
২- মিশরে জিহাদি চেতনার বিস্ফোরণ:
আনওয়ার সাদাত হত্যার মাধ্যমে মিশর ও আরব বিশ্বে জিহাদি চেতনার বিস্ফোরণ ঘটে। বরং এটা নিত্যদিনের বাস্তব ব্যাপার হয়ে যায়। শরীয়তের সাথে যুদ্ধকারী এবং আমেরিকা-ইসরাঈলের সাথে মিত্রতাকারী সরকারের বিরূদ্ধে যুদ্ধ যুগ-যুগান্তের লড়াইয়ে পরিণত হয়, যা আজ অবধি থামেনি। বরং উল্টো দিন দিন তার তীব্রতাই বাড়ছে, ধাপে ধাপে তার ক্ষেত্র বিস্তৃত হচ্ছে, পর্যায়ক্রমে তার সহযোগী বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং ওয়াশিংটন ও তেলআবিবে তার শত্রুদের জন্য তার হুমকি কঠিন থেকে কঠিনতর হচ্ছে। আনওয়ার সাদাত হত্যা ও তৎসংশ্লিষ্ট ঘটনাগুলো মুসলিম যুবকদের চিন্তা-চেতনার প্রধান বিষয়ে পরিণত হয়। এভাবে শরীয়ার শাসনকর্তৃত্ব, সরকারের ইসলামত্যাগ এবং আমেরিকা ও ইসরাঈলের দালালির বিষয়গুলো এমন স্বীকৃত বিষয়ে পরিণত হয়, যার জন্য মুসলিম যুবকগণ ময়দানে যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়, যার স্রোত প্রবাহিত করে গিয়েছিলেন আব্দুস সালাম ফাররাজ ও তার সাথীবৃন্দ (আল্লাহ তাদের প্রতি রহমত বর্ষণ করুন!) এবং যার ব্যাপারে খালিদ আল ইসলামবুলি রহ.কে প্রশ্ন করা হয়েছিল: আপনি কেন আনওয়ার সাদাতকে হত্যা করেছেন? তিনি উত্তর দিয়েছিলেন: যেহেতু সে শরীয়া দ্বারা শাসন করে না, ইসরাঈলের সাথে সন্ধি করেছে এবং ইসলামের আলেমগণকে লাঞ্ছিত করেছে।
৩- ১৪০১ হিজরীর ইসলামী বিদ্রোহ:
১৪০১ হিজরীর যিলহজ্জ মোতাবেক ১৯৮১ খৃষ্টাব্দের অক্টোবরের বিপ্লবের ঘটনাগুলো দুই ভাগে বিভক্ত:
প্রথম ভাগ: সরকারের মূল ভিত্তিগুলোর বিরাট সংখ্যককে হত্যা করার চেষ্টা হিসাবে ৬ অক্টোবরে সামরিক কুচকাওয়াজে সাদাত ও তার শাসনের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের উপর হামলা এবং হামলার পরেই বেতার কেন্দ্রের উপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার চেষ্টা।
এ অভিযান সাদাতকে হত্যা করার ব্যাপারে সফল হলেও তার সরকারের গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভলো বেঁচে যায়। এমনিভাবে রেডিওর নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার প্রচেষ্টাও সফল হয়নি।
দ্বিতীয় ভাগ: আসিয়ুত শহর নিয়ন্ত্রণে নেওয়ার জন্য স্বশস্ত্র বিপ্লব। আনওয়ার সাদাত হত্যার দু’দিন পর এ বিপ্লবটি সংঘটিত হয়। অর্থাৎ সেনাবাহিনী দেশে প্রভাব পুন:প্রতিষ্ঠা ও শাসনব্যবস্থা স্থিতিশীল করে ফেলার পর। এই প্রচেষ্টা কিছু কিছু থানা দখল করতে সফল হয়েছিল। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গেই বিশেষ ফোর্স ডেকে পাঠানো হল, যারা ভাইদের প্রতিরোধের ঘাটিগুলো ধ্বংস করে দিতে শুরু করল। ফলে মুজাহিদ যুবকগণ তাদের রসদ শেষ হয়ে যাওয়ার কারণে থানাগুলো ছেড়ে দিতে বাধ্য হন।
আসলে আসিয়ুতের স্বশস্ত্র বিপ্লব ব্যর্থ হওয়া অবধারিত ছিল। কারণ এটি একটি নিম্ন পরিকল্পনা বিশিষ্ট আবেগ তাড়িত বিপ্লব ছিল। যেমন এটা সাদাত হত্যার দু’দিন পর সংঘটিত হয়েছে! এছাড়াও শত্রুর সৈন্য ও অস্ত্রের কোন পরিমাণ জানা ছাড়া আসিয়ুত শহরের উপর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা এবং তারপর উত্তর দিকে কায়রো বিজয়ের জন্য অগ্রস হওয়ার এক অবাস্তব পরিকল্পনা করা হয়েছিল।
এভাবেই ১৪০১ হিজরী মোতাবেক ১৯৮১ সালের জিহাদী বিপ্লব তার একটি মৌলিক উদ্দেশ্য অর্জন করে সমাপ্ত হয়। আর তা হল: সাদাত হত্য। কিন্তু তার সাথে যে আরো কতগুলো প্রচেষ্টা হয়েছিল, সেগুলো বাস্তবে রূপ নেওয়া ভাগ্যে ছিল না। কারণ সেগুলোর জন্য অত্যাবশ্যকীয় ও পরিপূর্ণ প্রস্তুতি নেওয়া হয়নি। তবে বিষয়টির প্রতি সীমাবদ্ধ দৃষ্টি দিলে হবে না, যা শুধু এ ঘটনার সংকীর্ণ চিত্রগুলোর সাথেই সম্পর্কিত। বরং এ বিপ্লবের প্রতি সেই প্রশস্ত দৃষ্টি দিতে হবে, যা স্থান ও সময়কে ছাড়িয়ে যায় এবং যার প্রতিক্রিয়া ও ফলাফল সুবিস্তৃত।
এটা স্পষ্ট যে, এ আন্দোলন কতগুলো নিগূঢ় বাস্তবতা প্রকাশ করেছে। তা হল:
ক. মুসলিম মুজাহিদগণের উচ্চ মাত্রার বীরত্ব প্রকাশ করেছে, যারা এমন এক বাহিনীর উপর হামলা করেছেন, যে বাহিনী সৈন্য, অস্ত্র ও সামরিক অভিজ্ঞতায় তাদের থেকে বহুগুণ উপরে।
খ. এ ঘটনাগুলো ইসলামী জিহাদী আন্দোলনের আক্রমণের প্রকৃতি প্রকাশ করেছে, যারা এ শাসনব্যবস্থার প্রধানকে তার বাহিনী ও দলবলের মধ্যখানেই হত্যা করার মাধ্যমে এ শাসনব্যবস্থার মোকাবেলা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
গ. তেমনিভাবে এ ঘটনাগুলো প্রমাণ করেছে যে, ইসলাম থেকে বিচ্যুত এ শাসনব্যবস্থাকে পরিবর্তন করা এখন মুজাহিদ যুবকদের সার্বক্ষণিক চিন্তার কেন্দ্রবিন্দু হয়ে গেছে এবং তারা এর মাধ্যমে কুৎসিত শাসনব্যবস্থার চেহারাকে লাবণ্যময় করার জন্য আংশিক সংস্কার-কর্মসূচি, সংশোধন-নীতি এবং বিভিন্নরূপ উপায় অবলম্বনের পরিকল্পনা করেছে।
ঘ. এ ঘটনাগুলো প্রমাণ করেছে, শুধু সরকারের পক্ষ থেকে ইসলামী আন্দোলনের উপর একতরফা আক্রমণ করার দিন শেষ। এখন হোয়াইট হাউস ও তেলআবিবের নেতাবৃন্দ এবং কায়রোতে অবস্থানরত তাদের কর্মচারীদেরকে তাদের প্রতিটি নিধন অভিযানের জন্য কঠিন পাল্টা জবাবের অপেক্ষায় থাকতে হবে।
ঙ. এ ঘটনাগুলো প্রমাণ করেছে, সরকারী আইন-কানুনের ভেতরে থেকে কাজ করা এবং অসংখ্য মিথ্যা প্রস্তাবনা ও সরকারকে বৈধতা দানের স্বীকৃতি সংবলিত ধর্মনিরপেক্ষতাবাদী সংবিধানের কাছে মাথা নত করার চিন্তা মুজাহিদ যুবকদের দৃষ্টিতে এখন বাসি চিন্তা। তারা এখন সিদ্ধান্ত নিয়েছে, তাদের হারানো আকিদা, নিষিদ্ধকৃত শরীয়ত, ভূলুণ্ঠিত সম্মান ও নব্য সাম্রাজ্যবাদের দ্বারা গ্রাসকৃত মাতৃভূমি এবং ইসরাঈলের কাছে আত্মসমর্পণমূলক সন্ধিতে বিক্রিত পবিত্র স্থানসমূহ উদ্ধার করার জন্য হাতে অস্ত্র ধারণ করবে।
চ. তেমনিভাবে এ ঘটনাগুলো রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা বাহিনীর শোচনীয় ব্যর্থতা প্রকাশ করেছে, যাদের এটা জানা ছিল না যে, সমস্ত দেশ জিহাদী স্রোতে উদ্বেলিত হচ্ছে, যে স্রোত স্বশস্ত্র শক্তিগুলোকেও ভেদ করতে সক্ষম। শুধু তাই নয়, তারা তাদের কাছ থেকে কতগুলো রাসায়নিক অস্ত্র উদ্ধার করে এনেছে এবং তাদের সামরিক কুচকাওয়াজকে নিরাপত্তা দানের জন্য দীর্ঘ পদক্ষেপ থাকা সত্ত্বেও সামরিক পেরেড পর্যন্ত পৌঁছে গেছে।
আমাদের দেশের নিরাপত্তাবাহিনী এমন একদল বেতনভোগীর সমষ্টি, যারা নিজেদের চাকুরির জন্য নিজেদের দ্বীন বিক্রয় করে দিয়েছে। আল্লাহ ব্যতিত অন্য বস্তুর উপাসনা করছে। আর নৈতিকতা ও মানবিক মূল্যবোধের অধ:পতনের ক্ষেত্রে বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত। তার সাথে আছে সরকারপ্রদত্ব ক্ষমতা ও নিরাপত্তার কারণে আত্মপ্রবঞ্চনা ও অহংকার।
এমন লোকেরা সাধারণত ব্যর্থই হয়। সেসকল কবর খননকারীদের সাথে এদের কতই না মিল, যারা সর্বদা বিপদ আসার পরে নামায পড়ে। অথবা অপরাধি মুহাম্মদ আব্দুল ফাত্তাহ ওমর নিজ গ্রুপের যেমন সাদৃশ্য তুলে ধরেছিল- সে আমাকে তদন্তের শুরুতে নির্যাতনের হুমকি দিয়ে বলেছিল: ‘আমরা হলাম ফরেনসিক চিকিৎসকের মত, যারা সত্য খোঁজার জন্য মৃতদেহ অপারেশন করি’।
যেকোন তথ্য উদঘাটনের জন্য তাদের প্রধান উপায় হচ্ছে নিকৃষ্টতম নির্যাতন ও সম্মানিত ঘরণীদের উপর সীমালঙ্ঘন। সরকার ও তার পশ্চাতে আমেরিকা তাদেরকে পূর্ণ সহযোগীতা দেয় ইসলামি বিশ্বের একটি দেশে ইসলামি প্রতিরোধ মোকাবেলার জন্য। শুধু তাই নয়, আমেরিকা তাদের নিকট বন্দি প্রেরণ করে, যেন আমেরিকার বাইরে আমেরিকারই তত্ত্ববধানে বন্দিকে নির্যাতন করা যায়।
আনওয়ার সাদাত হত্যার পর আশা ছিল সরকার সকল পুরাতন ব্যর্থ নীতি থেকে মুক্ত হবে। কিন্তু তাদের সিংহভাগই সেই সরকারের একই রকম সেবা করে যেতে লাগল, যে সরকার নির্বুদ্ধিতা ও হীনতায় তাদের থেকে কম নয়।
গুরুত্বপূর্ণ জিহাদ মামলার তদন্তে একটি হাস্যকর ও ক্রন্দনোদ্রেককর ঘটনা হল, সেই পরস্পরবিরোধী প্রতিবেদনগুলো, যা তদন্ত বিভাগ প্রসিকিউশন দপ্তরে প্রদান করেছে, অতঃপর প্রসিকিউশন দপ্তর সে সকল স্ব-বিরোধি কথাবার্তাসহ তা আদালতের কাছে হস্তান্তর করেছে।
কিন্তু আদালত তা গ্রহণ করেনি। আদালত তার রায়ের প্রাসঙ্গিক আলোচনায় বলে:
“সরকারি তদন্ত বিভাগের প্রতিবেদনে যে তথ্যগুলো এসেছে, আদালত এ সকল প্রতিবেদনের ব্যাপারে পূর্বেই সাধারণভাবে তার রায় জানিয়ে দিয়েছে এবং তার প্রতি আশ্বস্ত না হওয়ার কথা প্রকাশ করেছে।”
তাদের আরেকটি হাস্যকর ও ক্রন্দনোদ্রেককর বিষয় হল, তদন্ত বিভাগের পক্ষ থেকে প্রসিকিউশন দপ্তরে আমার ব্যাপারে পেশকৃত একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে: আমি জনৈক ব্যক্তিকে ফাইলপত্র ভর্তি স্যামসোনেট ব্যাগ প্রদান করেছি, তাতে আরপিজি লাঞ্চার ছিল।
প্রসিকিউশন বিভাগ কোন ব্যাখ্যা বা সংযোজন ছাড়াই প্রতিবেদনটি আদালতে পাঠিয়ে দেয়। ফলে তা উপহাসের বস্তু হয়।
১ম
২য়
৩য়
৪র্থ
এ সম্পর্কে প্রাক্তন যুদ্ধমন্ত্রী মুহাম্মদ ফাওযী বলেন:
“জানুয়ারি ১৯৭৪ এর সংঘাত বন্ধ করা ছিল সামরিক ক্ষেত্রে ইসরাঈলের স্বার্থে কিসিঞ্জারের গৃহিত সর্ববৃহৎ পদক্ষেপ, যেখানে তিনি ইসরাঈলী ছিটমহল মুক্ত করেন এবং ইসরাঈলকে গিরিপথে থাকার সুযোগ করে দেন। আর ১৯৭৫ এর সেপ্টেম্বরে দ্বিতীয় সংঘাত নিরসন চুক্তি ছিল ইসরাঈলের রাজনৈতিক স্বার্থরক্ষাকারী সর্ববৃহৎ পদক্ষেপ। তাতে যা ছিল:
ইসরাঈলের দিক থেকে: গিরিপথের পূর্ব রেখার দিকে সীমিত আকারে সরে আসার কার্যক্রম চালুর প্রতিশ্রুতি।
মিশরের দিক থেকে: প্রতিশ্রুতির প্রথম ধারা: মধ্যপ্রাচ্যে ইসরাঈল-মিশর দ্বন্দ্ব স্বশস্ত্র শক্তির মাধ্যমে সমাধান করা সম্ভব নয়। বরং বিভিন্ন শান্তিপূর্ণ উপায়ে করতে হবে।
দ্বিতীয় ধারায়: কোন পক্ষ অপর পক্ষের বিরুদ্ধে কোনরূপ শক্তি ব্যবহার বা এর মাধ্যমে হুমকি প্রদান বা সামরিক অবরোধ আরোপ না করার প্রতিশ্রুতি দিবে।
সপ্তম ধারায়: সুইজ খাল দিয়ে ইসরাঈল অভিমুখী যেকোন বেসামরিক জাহাজ অতিক্রম করা বা ইসরাঈল থেকে বের হওয়ার স্বাধীনতা থাকার মর্মে মিশর প্রতিশ্রুতি দিবে।
এভাবে সাদাত আংশিক সমাধানের জন্য আলোচনার শুরু থেকেই ইসরাঈলের শর্তগুলো মেনে নেওয়ার মাধ্যমে ইসরাঈলের সাথে সর্বপ্রকার যুদ্ধাবস্থা শেষ করে দেয়। পক্ষান্তরে ইসরাঈলী বাহিনী মিশরের ভূমিগুলো দখল করতে থাকে, কিন্তু মিশর তাকে বিতাড়নের জন্য কোন প্রকার সামরিক শক্তি ব্যবহারের অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়।
১৯৭১ সালে মিশরের নিকট এই আংশিক চুক্তির প্রস্তাব করা হয়েছিল। তখন ইসরাঈল পরবর্তী ধাপে আন্তর্জাতিক সীমানার দিকে সরে আসার প্রতিশ্রুতি না দেওয়ার কারণে মিশর তা প্রত্যাখ্যান করেছিল। আর অক্টোবরের যুদ্ধ ও তাতে মিশর যা কিছু সাফল্য অর্জন করেছিল, তারপরও সাদাত সেই আংশিক সমাধানেই একমত হয়ে গেল, যা ১৯৭১ সালে মিশর প্রত্যাখ্যান করেছিল।”
মাহমুদ রিয়াদ এই চুক্তি সম্পর্কে আরো বলেন:
“এই রাজনৈতিক চুক্তির মাঝে আশ্চর্যের বিষয় হল, ইসরাঈলের এই অন্যায় শর্তগুলোর কাছে মাথা নত করতে কোন কিছুই সাদাতকে লজ্জিত করল না, যা কিনা মিশরের নিজ ভূমিগুলোর উপরও কর্তৃত্ব করার অধিকার খর্ব করে। সাদাত এই চুক্তির মাধ্যমে মিশরের আরো বেশি রাজনৈতিক ও সামরিক ক্ষতি ছাড়া কিছুই বৃদ্ধি করেনি।”
চুক্তিতে অন্তর্ভূক্ত গোপন প্রতিশ্রুতিগুলোর দাবি অনুযায়ী- যার সংখ্যা ১২ টি প্রতিশ্রুতি- সাদাত মূলত: ইসরাঈলের সাথে ব্যক্তিগত সন্ধি করেছে। এমনিভাবে শুধু আরব বিশ্ব থেকে নয়, আফ্রিকা থেকেও সেভিয়েত ইউনিয়নকে বহিস্কার করার ক্ষেত্রে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে সহযোগীতা করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে।
খ. আল কুদস ভ্রমণ ও দু’টি শান্তিচুক্তি।
১৯৭৭ সালে সাদাতের আল কুদস ভ্রমণ এবং ১৯৭৮ সালে ক্যাম্প ডেভিড চুক্তিদ্বয়, অতঃপর ১৯৭৯ এর ১৭ ডিসেম্বরে মিশর-ইসরাঈল শান্তিুচুক্তি ছিল মধ্যপ্রাচ্যের ইতিহাসে ভয়াবহতম ঘটনা। এখানে আমি মিশরের যুদ্ধমন্ত্রী (১৯৭৪ এর ডিসেম্বর থেকে ১৯৭৮ এর অক্টোবর পর্যন্ত) আব্দুল গনী জামাসির মন্তব্যটি উল্লেখ করব। তিনি এমন একজন ব্যক্তি, যিনি একজন পেশাদার সামরিক ব্যক্তি হিসাবে পরিচিতি লাভ করেছেন, যার রাজনীতির সাথে কোন সম্পর্ক নেই, বরং তিনি হলেন প্রশাসনের লোক। তিনি সরকারের পক্ষ থেকে উচ্চ মর্যাদা লাভ করেছেন। এতদসত্ত্বেও এ ব্যক্তি এক্ষেত্রে নিরবতা সহ্য করতে পারেননি। তাই তিনি শান্ত ভাষায় এই দুঃখ ব্যক্ত করেছেন, যাতে সরকারের সাথে সংঘর্ষ বেঁধে না যায়। কিন্তু একই সময়ে তিনি সেই প্রকাশ্য বাস্তবতাকেও গোপন করতে পারেননি, যা প্রকাশ করলে যেকোন মিশরীয় সামরিক ব্যক্তিই সংঘাতে জড়িয়ে পড়তে বাধ্য। তিনি তার ‘স্মৃতিকথা’য় বলেন:
“ক্যাম্প ডেভিড চুক্তি ছিল মধ্যপ্রাচ্য সংঘাতের সর্বশেষ ধাপ। আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে আমেরিকান যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থে দু’টি বড় শক্তির মাঝে লড়াইয়ের অবসান ঘটেছে। যে লড়াই ১৯৫৬ সালে শুরু হয়েছিল, ১৯৬৭ সালে চূড়ান্ত বিন্দুতে পৌঁছেছিল এবং ১৯৭৮ সালে সমাপ্ত হয়েছে। আরব বিশ্বের প্রেক্ষাপটে এই চুক্তি মিশরকে আরব-ইসরাঈল যুদ্ধের গণ্ডি থেকে বের করে দেয়, যা এ লড়াইয়ে রাজনৈতিক ও সামরিকভাবে আরব রাষ্ট্রগুলোর অবস্থানকে দুর্বল করে দেয় আর ইসরাঈলকে উক্ত অঞ্চলে কৌশলগত শক্তিশালী অবস্থান দান করে এবং তাকে বর্তমান ধাপেই অবশিষ্ট ফিলিস্তীন গ্রাস করার জন্য স্বাধীনভাবে কাজ করা এবং পরবর্তী ধাপে প্রতিবেশি আরব রাষ্ট্রগুলোতেও নাক গলানোর সুযোগ করে দেয়। দেশীয় প্রেক্ষাপটে এই চুক্তি ও তৎপরবর্তী মিশর-ইসরাঈল শান্তি-চুক্তিগুলো আমাদেরকে কঠিন শর্তের অধীনে সিনাই উপত্যকা ফিরিয়ে দিলেও তা ইসরাঈলকে শক্তিশালী কৌশলগত অবস্থানে এবং মিশর-ইসরাঈল সংঘাতকে সর্বশেষ স্তরে নিয়ে যায়। যে স্তর শুরু হয়েছিল অক্টোবর ১৯৭৩ সালে, অতঃপর ১৯৭৭ সালে আল কুদস ভ্রমণের মাধ্যমে আর শেষ হয়েছে ১৯৭৮ এ ক্যাম্প ডেভিড চুক্তির মাধ্যমে। এ চুক্তি ও তারপর প্রতিশ্রুতির ধারাগুলো ঘোষণার মাধ্যমে এই অঞ্চলের ইতিহাসে নতুন একটি ধাপ শুরু হয়েছে। এমন ধাপ, মধ্যপ্রাচ্যে বৃহৎ দুই শক্তির সংঘাতে যার গভীর প্রতিফলন রয়েছে। যার গভীর প্রতিফলন রয়েছে আমাদের আরব ভূমিতেও। রয়েছে অনেক ফলাফল ও পরিণতি। সম্ভবত: তার মধ্যে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি হল, উক্ত অঞ্চলে নিরাপত্তা ব্যবস্থার পরিবর্তন। যার ফলে মধ্যপ্রাচ্যের নিরাপত্তা ব্যবস্থায় প্রধান খেলোয়ারের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র।”
অর্থাৎ জামাসি বলতে চাচ্ছেন, এই চুক্তি ইসরাঈলকে শক্তিশালী করেছে আর মিশরকে তার মোকাবেলা করতে অপারগ করে দিয়েছে। আর ক্যাম্প ডেভিড চুক্তি ও তার পরবর্তী শান্তিচুক্তির মাধ্যমে আমাদের দেশের উপর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কর্তৃত্বের যুগ শুরু হয়েছে।
গ. ১৯৮১ সালের সেপ্টেম্বরের গ্রেফতার অভিযান
এটা ছিল সাদাতের নির্দেশে গণগ্রেফতার অভিযান। এতে গ্রেফতারকৃতদের সংখ্যা সরকারের দাবি অনুযায়ীই ১৫০০ বন্দিতে পৌঁছেছে। এ সকল বন্দিদের সিংহভাগই ছিল ইসলামী আন্দোলনগুলোর সদস্য।
সাদাত এই গ্রেফতারের মাধ্যমে মৌলিকভাবে তার ইসরাঈলপন্থী রাজনীতির যেকোন প্রতিদ্বন্দ্বী থেকে মুক্ত হতে চেয়েছিল। যাদের মধ্যে একজন ছিলেন শায়খ আহমাদ আল মুহাল্লাবি, যাকে সাদাতের ভাষায়- ‘কুকুরের মত কারাগারে নিক্ষেপ করা হয়েছে’।
এই গণগ্রেফতার এবং তাতে যে সীমালঙ্ঘন হয়েছে, বিশেষত: শায়খ আহমাদ আল মুহাল্লাবির উপর, এগুলোই আনওয়ার সাদাত হত্যার প্রত্যক্ষ কারণগুলোর মধ্যে সর্বাধিক গুরত্বপূর্ণ।
সে বন্দিদেরকে ‘তোরা সংবর্ধনা কারাগার’ নামে একটি নতুন কারাগারে রাখে। যেটা শুধুমাত্র রাজনৈতিক বন্দি ও ইসলামি আন্দোলনের সদস্যদের রাখার জন্য বিশেষভাবে নির্মাণ করা হয়েছে। যা প্রমাণ করে সাদাত অনেক পূর্বেই এই গণগ্রেফতারের পরিকল্পনা করেছিল।
২- মিশরে জিহাদি চেতনার বিস্ফোরণ:
আনওয়ার সাদাত হত্যার মাধ্যমে মিশর ও আরব বিশ্বে জিহাদি চেতনার বিস্ফোরণ ঘটে। বরং এটা নিত্যদিনের বাস্তব ব্যাপার হয়ে যায়। শরীয়তের সাথে যুদ্ধকারী এবং আমেরিকা-ইসরাঈলের সাথে মিত্রতাকারী সরকারের বিরূদ্ধে যুদ্ধ যুগ-যুগান্তের লড়াইয়ে পরিণত হয়, যা আজ অবধি থামেনি। বরং উল্টো দিন দিন তার তীব্রতাই বাড়ছে, ধাপে ধাপে তার ক্ষেত্র বিস্তৃত হচ্ছে, পর্যায়ক্রমে তার সহযোগী বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং ওয়াশিংটন ও তেলআবিবে তার শত্রুদের জন্য তার হুমকি কঠিন থেকে কঠিনতর হচ্ছে। আনওয়ার সাদাত হত্যা ও তৎসংশ্লিষ্ট ঘটনাগুলো মুসলিম যুবকদের চিন্তা-চেতনার প্রধান বিষয়ে পরিণত হয়। এভাবে শরীয়ার শাসনকর্তৃত্ব, সরকারের ইসলামত্যাগ এবং আমেরিকা ও ইসরাঈলের দালালির বিষয়গুলো এমন স্বীকৃত বিষয়ে পরিণত হয়, যার জন্য মুসলিম যুবকগণ ময়দানে যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়, যার স্রোত প্রবাহিত করে গিয়েছিলেন আব্দুস সালাম ফাররাজ ও তার সাথীবৃন্দ (আল্লাহ তাদের প্রতি রহমত বর্ষণ করুন!) এবং যার ব্যাপারে খালিদ আল ইসলামবুলি রহ.কে প্রশ্ন করা হয়েছিল: আপনি কেন আনওয়ার সাদাতকে হত্যা করেছেন? তিনি উত্তর দিয়েছিলেন: যেহেতু সে শরীয়া দ্বারা শাসন করে না, ইসরাঈলের সাথে সন্ধি করেছে এবং ইসলামের আলেমগণকে লাঞ্ছিত করেছে।
৩- ১৪০১ হিজরীর ইসলামী বিদ্রোহ:
১৪০১ হিজরীর যিলহজ্জ মোতাবেক ১৯৮১ খৃষ্টাব্দের অক্টোবরের বিপ্লবের ঘটনাগুলো দুই ভাগে বিভক্ত:
প্রথম ভাগ: সরকারের মূল ভিত্তিগুলোর বিরাট সংখ্যককে হত্যা করার চেষ্টা হিসাবে ৬ অক্টোবরে সামরিক কুচকাওয়াজে সাদাত ও তার শাসনের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের উপর হামলা এবং হামলার পরেই বেতার কেন্দ্রের উপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার চেষ্টা।
এ অভিযান সাদাতকে হত্যা করার ব্যাপারে সফল হলেও তার সরকারের গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভলো বেঁচে যায়। এমনিভাবে রেডিওর নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার প্রচেষ্টাও সফল হয়নি।
দ্বিতীয় ভাগ: আসিয়ুত শহর নিয়ন্ত্রণে নেওয়ার জন্য স্বশস্ত্র বিপ্লব। আনওয়ার সাদাত হত্যার দু’দিন পর এ বিপ্লবটি সংঘটিত হয়। অর্থাৎ সেনাবাহিনী দেশে প্রভাব পুন:প্রতিষ্ঠা ও শাসনব্যবস্থা স্থিতিশীল করে ফেলার পর। এই প্রচেষ্টা কিছু কিছু থানা দখল করতে সফল হয়েছিল। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গেই বিশেষ ফোর্স ডেকে পাঠানো হল, যারা ভাইদের প্রতিরোধের ঘাটিগুলো ধ্বংস করে দিতে শুরু করল। ফলে মুজাহিদ যুবকগণ তাদের রসদ শেষ হয়ে যাওয়ার কারণে থানাগুলো ছেড়ে দিতে বাধ্য হন।
আসলে আসিয়ুতের স্বশস্ত্র বিপ্লব ব্যর্থ হওয়া অবধারিত ছিল। কারণ এটি একটি নিম্ন পরিকল্পনা বিশিষ্ট আবেগ তাড়িত বিপ্লব ছিল। যেমন এটা সাদাত হত্যার দু’দিন পর সংঘটিত হয়েছে! এছাড়াও শত্রুর সৈন্য ও অস্ত্রের কোন পরিমাণ জানা ছাড়া আসিয়ুত শহরের উপর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা এবং তারপর উত্তর দিকে কায়রো বিজয়ের জন্য অগ্রস হওয়ার এক অবাস্তব পরিকল্পনা করা হয়েছিল।
এভাবেই ১৪০১ হিজরী মোতাবেক ১৯৮১ সালের জিহাদী বিপ্লব তার একটি মৌলিক উদ্দেশ্য অর্জন করে সমাপ্ত হয়। আর তা হল: সাদাত হত্য। কিন্তু তার সাথে যে আরো কতগুলো প্রচেষ্টা হয়েছিল, সেগুলো বাস্তবে রূপ নেওয়া ভাগ্যে ছিল না। কারণ সেগুলোর জন্য অত্যাবশ্যকীয় ও পরিপূর্ণ প্রস্তুতি নেওয়া হয়নি। তবে বিষয়টির প্রতি সীমাবদ্ধ দৃষ্টি দিলে হবে না, যা শুধু এ ঘটনার সংকীর্ণ চিত্রগুলোর সাথেই সম্পর্কিত। বরং এ বিপ্লবের প্রতি সেই প্রশস্ত দৃষ্টি দিতে হবে, যা স্থান ও সময়কে ছাড়িয়ে যায় এবং যার প্রতিক্রিয়া ও ফলাফল সুবিস্তৃত।
এটা স্পষ্ট যে, এ আন্দোলন কতগুলো নিগূঢ় বাস্তবতা প্রকাশ করেছে। তা হল:
ক. মুসলিম মুজাহিদগণের উচ্চ মাত্রার বীরত্ব প্রকাশ করেছে, যারা এমন এক বাহিনীর উপর হামলা করেছেন, যে বাহিনী সৈন্য, অস্ত্র ও সামরিক অভিজ্ঞতায় তাদের থেকে বহুগুণ উপরে।
খ. এ ঘটনাগুলো ইসলামী জিহাদী আন্দোলনের আক্রমণের প্রকৃতি প্রকাশ করেছে, যারা এ শাসনব্যবস্থার প্রধানকে তার বাহিনী ও দলবলের মধ্যখানেই হত্যা করার মাধ্যমে এ শাসনব্যবস্থার মোকাবেলা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
গ. তেমনিভাবে এ ঘটনাগুলো প্রমাণ করেছে যে, ইসলাম থেকে বিচ্যুত এ শাসনব্যবস্থাকে পরিবর্তন করা এখন মুজাহিদ যুবকদের সার্বক্ষণিক চিন্তার কেন্দ্রবিন্দু হয়ে গেছে এবং তারা এর মাধ্যমে কুৎসিত শাসনব্যবস্থার চেহারাকে লাবণ্যময় করার জন্য আংশিক সংস্কার-কর্মসূচি, সংশোধন-নীতি এবং বিভিন্নরূপ উপায় অবলম্বনের পরিকল্পনা করেছে।
ঘ. এ ঘটনাগুলো প্রমাণ করেছে, শুধু সরকারের পক্ষ থেকে ইসলামী আন্দোলনের উপর একতরফা আক্রমণ করার দিন শেষ। এখন হোয়াইট হাউস ও তেলআবিবের নেতাবৃন্দ এবং কায়রোতে অবস্থানরত তাদের কর্মচারীদেরকে তাদের প্রতিটি নিধন অভিযানের জন্য কঠিন পাল্টা জবাবের অপেক্ষায় থাকতে হবে।
ঙ. এ ঘটনাগুলো প্রমাণ করেছে, সরকারী আইন-কানুনের ভেতরে থেকে কাজ করা এবং অসংখ্য মিথ্যা প্রস্তাবনা ও সরকারকে বৈধতা দানের স্বীকৃতি সংবলিত ধর্মনিরপেক্ষতাবাদী সংবিধানের কাছে মাথা নত করার চিন্তা মুজাহিদ যুবকদের দৃষ্টিতে এখন বাসি চিন্তা। তারা এখন সিদ্ধান্ত নিয়েছে, তাদের হারানো আকিদা, নিষিদ্ধকৃত শরীয়ত, ভূলুণ্ঠিত সম্মান ও নব্য সাম্রাজ্যবাদের দ্বারা গ্রাসকৃত মাতৃভূমি এবং ইসরাঈলের কাছে আত্মসমর্পণমূলক সন্ধিতে বিক্রিত পবিত্র স্থানসমূহ উদ্ধার করার জন্য হাতে অস্ত্র ধারণ করবে।
চ. তেমনিভাবে এ ঘটনাগুলো রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা বাহিনীর শোচনীয় ব্যর্থতা প্রকাশ করেছে, যাদের এটা জানা ছিল না যে, সমস্ত দেশ জিহাদী স্রোতে উদ্বেলিত হচ্ছে, যে স্রোত স্বশস্ত্র শক্তিগুলোকেও ভেদ করতে সক্ষম। শুধু তাই নয়, তারা তাদের কাছ থেকে কতগুলো রাসায়নিক অস্ত্র উদ্ধার করে এনেছে এবং তাদের সামরিক কুচকাওয়াজকে নিরাপত্তা দানের জন্য দীর্ঘ পদক্ষেপ থাকা সত্ত্বেও সামরিক পেরেড পর্যন্ত পৌঁছে গেছে।
আমাদের দেশের নিরাপত্তাবাহিনী এমন একদল বেতনভোগীর সমষ্টি, যারা নিজেদের চাকুরির জন্য নিজেদের দ্বীন বিক্রয় করে দিয়েছে। আল্লাহ ব্যতিত অন্য বস্তুর উপাসনা করছে। আর নৈতিকতা ও মানবিক মূল্যবোধের অধ:পতনের ক্ষেত্রে বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত। তার সাথে আছে সরকারপ্রদত্ব ক্ষমতা ও নিরাপত্তার কারণে আত্মপ্রবঞ্চনা ও অহংকার।
এমন লোকেরা সাধারণত ব্যর্থই হয়। সেসকল কবর খননকারীদের সাথে এদের কতই না মিল, যারা সর্বদা বিপদ আসার পরে নামায পড়ে। অথবা অপরাধি মুহাম্মদ আব্দুল ফাত্তাহ ওমর নিজ গ্রুপের যেমন সাদৃশ্য তুলে ধরেছিল- সে আমাকে তদন্তের শুরুতে নির্যাতনের হুমকি দিয়ে বলেছিল: ‘আমরা হলাম ফরেনসিক চিকিৎসকের মত, যারা সত্য খোঁজার জন্য মৃতদেহ অপারেশন করি’।
যেকোন তথ্য উদঘাটনের জন্য তাদের প্রধান উপায় হচ্ছে নিকৃষ্টতম নির্যাতন ও সম্মানিত ঘরণীদের উপর সীমালঙ্ঘন। সরকার ও তার পশ্চাতে আমেরিকা তাদেরকে পূর্ণ সহযোগীতা দেয় ইসলামি বিশ্বের একটি দেশে ইসলামি প্রতিরোধ মোকাবেলার জন্য। শুধু তাই নয়, আমেরিকা তাদের নিকট বন্দি প্রেরণ করে, যেন আমেরিকার বাইরে আমেরিকারই তত্ত্ববধানে বন্দিকে নির্যাতন করা যায়।
আনওয়ার সাদাত হত্যার পর আশা ছিল সরকার সকল পুরাতন ব্যর্থ নীতি থেকে মুক্ত হবে। কিন্তু তাদের সিংহভাগই সেই সরকারের একই রকম সেবা করে যেতে লাগল, যে সরকার নির্বুদ্ধিতা ও হীনতায় তাদের থেকে কম নয়।
গুরুত্বপূর্ণ জিহাদ মামলার তদন্তে একটি হাস্যকর ও ক্রন্দনোদ্রেককর ঘটনা হল, সেই পরস্পরবিরোধী প্রতিবেদনগুলো, যা তদন্ত বিভাগ প্রসিকিউশন দপ্তরে প্রদান করেছে, অতঃপর প্রসিকিউশন দপ্তর সে সকল স্ব-বিরোধি কথাবার্তাসহ তা আদালতের কাছে হস্তান্তর করেছে।
কিন্তু আদালত তা গ্রহণ করেনি। আদালত তার রায়ের প্রাসঙ্গিক আলোচনায় বলে:
“সরকারি তদন্ত বিভাগের প্রতিবেদনে যে তথ্যগুলো এসেছে, আদালত এ সকল প্রতিবেদনের ব্যাপারে পূর্বেই সাধারণভাবে তার রায় জানিয়ে দিয়েছে এবং তার প্রতি আশ্বস্ত না হওয়ার কথা প্রকাশ করেছে।”
তাদের আরেকটি হাস্যকর ও ক্রন্দনোদ্রেককর বিষয় হল, তদন্ত বিভাগের পক্ষ থেকে প্রসিকিউশন দপ্তরে আমার ব্যাপারে পেশকৃত একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে: আমি জনৈক ব্যক্তিকে ফাইলপত্র ভর্তি স্যামসোনেট ব্যাগ প্রদান করেছি, তাতে আরপিজি লাঞ্চার ছিল।
প্রসিকিউশন বিভাগ কোন ব্যাখ্যা বা সংযোজন ছাড়াই প্রতিবেদনটি আদালতে পাঠিয়ে দেয়। ফলে তা উপহাসের বস্তু হয়।
১ম
২য়
৩য়
৪র্থ
Comment