আর শায়খ সালাহ আবু ইসমাঈলের সাক্ষ্যও অত্যন্ত স্পর্শকাতর সাক্ষ্য ছিল, যা পরিপূর্ণ দু’দিন সময় নিয়েছে। কারণ তাতে মিশরের শাসনব্যবস্থার সাথে সম্পর্কিত অনেক বিপদজনক বিষয়াবলী ও ইসলামের সাথে তার অবস্থানের ব্যাপারে সুস্পষ্ট উত্তর এসেছে।
শায়খ সালাহ আবু ইসমাঈল এ সাক্ষ্যে এ কথার উপর গুরুত্বারোপ করেন যে, আনওয়ার সাদাত “ধর্মে কোন রাজনীতি চলবে না এবং রাজনীতিতে কোন ধর্ম চলবে না” মর্মে ঘোষণা দেওয়ার মাধ্যমে ইসলাম থেকে হাত ঝেড়ে ফেলেছে। শায়খ সালাহ এ সাক্ষ্যে গণপরিষদের মাধ্যমে শরিয়া আইন প্রণয়ন করার ব্যাপারে তার চেষ্টা এবং পরিশেষে সরকারের ধারাবাহিক ধোঁকা ও ষড়যন্ত্রের কারণে নির্বাচন ও গণপরিষদের পন্থায় শরীয়া বাস্তবয়ানের ব্যাপারে নিরাশ হয়ে যাওয়ার কথা তুলে ধরেন।
এ নির্বাচনগুলো ছিল ওই সকল লোকদের জন্য বেদনাদায়ক শিক্ষা, যারা এই দাবি করে ওই পথ অবলম্বন করেছেন যে, তারা শরিয়ার বিরোধিতার মধ্য দিয়ে শরিয়ার শাসন ও ইসলামী স্বার্থ বাস্তবায়ন করে ফেলবেন। যাদের অসাড় দাবি হচ্ছে: বর্তমান পরিস্থিতি শরয়ী রাজনীতি বিষয়ক বর্ণনাসমূহ পালন করার ক্ষেত্রে নমনীয়তার দাবি করে। ফলে তারা দ্বীন হারায়, কিন্তু দুনিয়াও অর্জন করতে পারে না।
অতঃপর আদলতের রায় সরকার, তার নিরাপত্তাবাহিনী ও রাষ্ট্রপক্ষের জন্য বিস্ময়কর হিসাবে আবির্ভূত হয়। কারণ আদালত একটিও মৃত্যুদণ্ডাদেশ জারি করেনি। আর ৩০২ জন আসামী থেকে ১৯৪ জনকে নির্দোষ সাব্যস্ত করেছে।
এ রায়ের প্রেক্ষাপটটাই রায় থেকে অধিক গুরুত্বপূর্ণ ও স্পর্শকাতর ছিল। যেমন:
- আদালত এটা স্বীকার করে নিয়েছে যে, মিশর ইসলামী শরিয়া দ্বারা শাসন করে না।
- আরো স্বীকার করে নিয়েছে যে, ইসলামী শরিয়া দ্বারা শাসন করা ওয়াজিব। এটা প্রত্যেক মুসলিমেরই আশা।
- আরো স্বীকার করেছে যে: মিশরীয় সংবিধান ও আইন ইসলামী বিধানাবলীর সাথে সাংঘর্ষিক।
- আরো স্বীকার করেছে: মিশরীয় সমাজে আইনের ছত্রছায়ায় অনাচার ও ইসলামের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ প্রসার লাভ করেছে।
- আরো স্বীকার করেছে: আসামীদের উপর এমন শারিরিক নির্যাতন করা হয়েছে, যা তাদের কারো কারো স্থায়ী অক্ষমতা সৃষ্টি করেছে। অতঃপর তিনি দায়িত্বশীলদেরকে তদন্তের জন্য শাস্তি পরিহার করার আবেদন করেছেন।
মিশরের বিচার বিভাগীয় ইতিহাসের সর্ববৃহৎ মামলায় আদালতের রায়ের ভূমিকায় এসেছে-
“দ্বিতীয় আলোচ্য বিষয়টির ব্যাপারে আদালত যে সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছে তা হল: আরবীয় প্রজাতন্ত্র মিশরে ইসলামী শরীয়ার বিধি-বিধান কার্যকর করা হয়নি। এ তত্ত্বটি প্রথম তত্ত্বটিরই সারনির্যাশ। তা হল: শরীয়া কার্যকর করার আবশ্যকীয়তা।”
তারপর বিচারক শাসনতন্ত্রে শরীয়ার অনুপস্থিতির কতগুলো প্রমাণ পেশ করেন, যেমন:
“মিশরীয় সমাজে এমন পরিবেশের উপস্থিতি, যা মহান শরীয়ার বিধি-বিধানের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। যেমন গান-বাদ্য, যাতে ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপ যুক্ত থাকে এবং তা রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে অনুমোদিত। বহু মদ কারাখানা, যেগুলো প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে রাষ্ট্রীয় অনুমতি রয়েছে। মদ বিক্রয় ও পরিবেশন কেন্দ্রসমূহ, যেগুলো রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে অনুমোদিত। ইলেক্ট্রনিক ও প্রিন্ট মিডিয়া সমূহ, যা এমন বিষয়াবলী প্রচার ও প্রসার করে, যা ইসলামী শরীয়ার বিধি-বিধানের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। যেমন নারীদের লাগামহীনতা। এ সকল বিষয়গুলো রাষ্ট্রধর্ম ইসলামের বর্ণনাসমূহের বিপরীত।”
এমনিভাবে আদালত রায়ের প্রেক্ষাপটের আরেক স্থানে বলে:
“প্রকৃতপক্ষে সংবিধানের সংশোধিত দ্বিতীয় ধারাটি সুস্পষ্টভাবে একথা বলে যে, ইসলাম হল রাষ্ট্রের রাষ্ট্রীয় ধর্ম। আরবী ভাষা হল তার রাষ্ট্রীয় ভাষা। ইসলামী শরীয়ার আদর্শগুলোই আইন প্রণয়নের মৌলিক উৎস। কিন্তু সংবিধানের বিধানগুলো যে ইসলামী শরীয়ার বিধানগুলোর সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়, তার প্রমাণ হিসাবে ওমর আব্দুর রহমান মুসলমানদের একজন আলেম হিসাবে তার বক্তব্যগুলোই যথেষ্ট। তিনি ১৯৮৩ সালের ৩ সেপ্টেম্বরের বৈঠকে আদালতের সামনে প্রমাণ করেছেন যে, এ সংবিধান ইসলামী শরীয়ার সাথে সাংঘর্ষিক এবং শরীয়া দ্বারা শাসন করে না। কারণ সংবিধানের ৮৬, ১০৭, ১০৮, ১০৯, ১১২, ১১৩ ও ১৮৯ ধারা পার্লামেন্ট সদস্যদেরকে আইন প্রণয়ন ও বিধান তৈরী করার অধিকার দেয়। কিন্তু ইসলামে তা শুধুমাত্র আল্লাহর জন্য। এমনিভাবে সংবিধানের ৭৫ ধারা রাষ্ট্র প্রধানের জন্য মুসলমান হওয়া ও পুরুষ হওয়া শর্ত করে না। আর এটা এমন বিষয়, যা ফুকাহায়ে কেরামের ইজমার বিরোধী। সংবিধানের ১৬৫ ধারা সুস্পষ্টভাবে বলে যে, আদালতের রায় হবে ওই আইনের ভিত্তিতে, যেগুলো উৎস ও বর্ণনার দিক থেকে ইসলামী শরীয়ার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়।”
আদালত রায়ের প্রেক্ষাপটে আরেক স্থানে এ ঘটনাগুলোর পূর্বে মিশরীয় সমাজের অবস্থা বর্ণনা প্রসঙ্গে বলে:
“আরবীয় প্রজাতন্ত্র মিশরে আল্লাহর শরীয়ার অনুপস্থিতি”- এটার ব্যাপারে আদালত অকাট্য দলিলের মাধ্যমে প্রমাণ পেশ করেছে, যা এখন আমরা পুনরাবৃত্তি করার প্রয়োজন মনে করছি না। কিন্তু এখন শুধু এ বিষয়টির প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করছে যে, ইসলামী শরীয়ার বিধি-বিধানকে আইন হিসাবে স্বীকৃতি দেওয়ার ক্ষমতা এখনো শেষ হয়ে যায়নি। এ কাজ শুরু হয়েছিল ১৯৭৯ সালে।
এছাড়াও মিশরীয় সমাজে এমন পরিবেশ বিদ্যমান, যা কোনভাবেই ইসলামের মূলনীতির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। তাই এটা কল্পনা করা যায় না যে, একটি রাষ্ট্রের ধর্ম হবে ইসলাম আর তাতে ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপ সম্পন্ন বিনোদনের অনুমোদন দেওয়া হবে। মদ উৎপাদন বা মদ বিক্রয় ও পানকেন্দ্রের অনুমোদন দেওয়া হবে অথবা ইলেক্ট্রনিক বা প্রিন্ট মিডিয়াকে সরাসরি এমন বিষয়াবলী প্রচার-প্রসার করার অনুমতি দেওয়া হবে, যা আল্লাহর শরীয়ার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয় বা এমনভাবে নারী-বেহায়াপনার অনুমোদন দেওয়া হবে, যা ইসলামী বর্ণনাসমূহের বিরোধী।”
‘মধ্যপ্রাচ্য’ পত্রিকা এ (ফুরসান) বইয়ের প্রথম সংস্করণের যে বিকৃত ও কাটছাট করা কপি ছাপিয়েছে, যা তারা আমেরিকান গোয়েন্দা সংস্থা থেকে পেয়েছিল, তাতে পত্রিকাটি আমার ব্যাপারে এই দাবি করেছে যে, আমি আইন উপদেষ্টা আদালত প্রধান মুহাম্মদ আব্দুল গাফ্ফারের প্রশংসা করেছি এবং বলেছি, তার রায়গুলো ইসলাম পন্থিদের জন্য ইনসাফপূর্ণ হয়েছে। পত্রিকার বক্তব্যটি:
“যদিও জাওয়াহিরি তার বইয়ে সামরিক আদালতকে ভ্রান্ত বলেছেন এবং এটাকে ইসলামপন্থি ও তার (জাওয়াহিরির) কথিত সামরিক ধর্মনিরপেক্ষতাবাদিদের মাঝে মুখোমুখি লড়াইয়ের নিয়মিত রূপ হিসাবে গণ্য করেছেন, কিন্তু তিনি আইন উপদেষ্টা আদালত প্রধান আব্দুল গাফ্ফারের প্রশংসা করে বলেছেন: তার রায়গুলো ইসলামপন্থিদের জন্য ইনসাফপূর্ণ হয়েছে।”
এ হল মধ্যপ্রাচ্য পত্রিকা আমার ব্যাপারে যত মিথ্যা অপবাদ একত্রিত করেছে, তন্মধ্যে একটা। এটা কখনোই হতে পারে না যে, আমি মানব রচিত আইন দ্বারা বিচারকারী একজন ধর্মনিরপেক্ষ বিচারকের প্রশংসা করবো এবং তাকে ন্যায়পরায়ণ বলব। অথচ আল্লাহ তা’আলা বলেছেন:
وَمَن لَّمْ يَحْكُم بِمَا أنزَلَ اللّهُ فَأُوْلَـئِكَ هُمُ الظَّالِمُونَ
“যারা আল্লাহর নাযিলকৃত বিধান অনুসারে ফায়সালা করে না তারা জালেম।”
তাই ধর্মনিরপেক্ষতাবাদি বিচারক জালিম, যদিও সে সঠিক রায় দিক না কেন। কারণ সে পূত-পবিত্র রবের শাসনকর্তৃত্ব স্বীকার করেনি। উস্তাদ শহিদ সাইয়িদ কুতুব রহ. বলেন:
“আল্লাহর অবতীর্ণ বিধান দ্বারা শাসন করা এবং অন্য কিছু দ্বারা শাসন না করাই যে ‘আল্লাহর দ্বীন’, এটার কোন ব্যত্যয় নেই। এটাই আল্লাহর ক্ষমতা প্রকাশকারী, আল্লাহর শাসন কর্তৃত্ব প্রকাশকারী এবং একথা প্রকাশকারী যে, আল্লাহ ব্যতিত কোন উপাস্য নেই।
এই আবশ্যকীয়তা, অর্থাৎ ‘আল্লাহর দ্বীন’ ও আল্লাহর অবতীর্ণ বিধান দ্বারা শাসন করার মাঝে অবিচ্ছেদ্য যোগসূত্র থাকার আবশ্যকীয়তা শুধু একারণেই নয় যে, মানবজাতি নিজেদের জন্য যত নীতি, আদর্শ, পদ্ধতি ও নিয়ম-নীতি প্রণয়ন করে তার থেকে আল্লাহর অবতীর্ণ বিধানই উত্তম; বরং এটা হল এই আবশ্যকীয়তার অনেকগুলো কারণ থেকে একটি কারণ। এটাই প্রথম ও প্রধান কারণ নয়। এই অবিচ্ছেদ্য যোগসূত্রের আবশ্যকীয়তার প্রথম ও প্রধান কারণ হল, আল্লাহর অবতীর্ণ বিধান দ্বারা শাসন করাই আল্লাহর ‘উলুহিয়্যাহ’(উপাস্য হওয়া) এর স্বীকৃতি এবং আল্লাহ ব্যতিত অন্য কারো জন্য উলুহিয়্যাহ থাকা বা তার বৈশিষ্ট্যগুলো থাকার অস্বীকৃতি।
এটাই ইসলাম আভিধানিক অর্থেও- তথা আত্মসমর্পণ অর্থে এবং এটাই ইমলাম পারিভাষিক অর্থেও, তথা যে অর্থ নিয়ে সমস্ত দ্বীনগুলো এসেছে। অর্থাৎ আল্লাহর নিকট আত্মসমর্পণ করা এবং আল্লাহর সাথে অন্য কারো জন্য উলুহিয়্যাহর দাবি বা উলুহিয়্যাহর বিশেষ বৈশিষ্ট্যগুলোর দাবি করা থেকে মুক্ত হওয়া। সেই বিশেষ বৈশিষ্ট্যগুলো হল, যেমন ক্ষমতা, শাসনকর্তৃত্ব এবং বান্দাকে জীবনব্যবস্থা ও আইন-কানুন দেওয়ার মাধ্যমে নিজের অনুগত ও দাস বানানোর অধিকার।
মানুষ নিজেরা নিজেদের জন্য আল্লাহর শরীয়ার সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ বিধি-বিধান প্রণয়ন করলেও, এমনকি হুবহু আল্লাহর শরিয়ার বিধানগুলো প্রণয়ন করলেও যথেষ্ট হবে না, যতক্ষণ পর্যন্ত তারা সেগুলোকে নিজেদের দিকে সম্বন্ধিত করবে এবং তার উপর নিজেদের ব্যাজ লাগাবে। যতক্ষণ পর্যন্ত আল্লাহর ক্ষমতার কাছে আত্মসমর্পণ না করবে, তাঁর উলুহিয়্যাহকে ও তাঁর উলুহিয়্যাহর একত্বকে স্বীকার করতঃ তাঁর দিকে না ফিরবে এবং আল্লাহর নামেই তা কার্যকর না করবে। উলুহিয়্যার মধ্যে আল্লাহর একত্বের বিশ্বাসই বান্দাকে ক্ষমতা ও শাসনকর্তৃত্বের অধিকার থেকে মুক্ত করে। তবে বান্দা শুধুমাত্র আল্লাহর শরিয়ার বাস্তবায়ন হিসাবেই তা করতে পারে।”
১ম পর্ব
২য় পর্ব
৩য় পর্ব
৪র্থ পর্ব
৫ম পর্ব
৬ষ্ঠ পর্ব
৭ম পর্ব
৮ম পর্ব
শায়খ সালাহ আবু ইসমাঈল এ সাক্ষ্যে এ কথার উপর গুরুত্বারোপ করেন যে, আনওয়ার সাদাত “ধর্মে কোন রাজনীতি চলবে না এবং রাজনীতিতে কোন ধর্ম চলবে না” মর্মে ঘোষণা দেওয়ার মাধ্যমে ইসলাম থেকে হাত ঝেড়ে ফেলেছে। শায়খ সালাহ এ সাক্ষ্যে গণপরিষদের মাধ্যমে শরিয়া আইন প্রণয়ন করার ব্যাপারে তার চেষ্টা এবং পরিশেষে সরকারের ধারাবাহিক ধোঁকা ও ষড়যন্ত্রের কারণে নির্বাচন ও গণপরিষদের পন্থায় শরীয়া বাস্তবয়ানের ব্যাপারে নিরাশ হয়ে যাওয়ার কথা তুলে ধরেন।
এ নির্বাচনগুলো ছিল ওই সকল লোকদের জন্য বেদনাদায়ক শিক্ষা, যারা এই দাবি করে ওই পথ অবলম্বন করেছেন যে, তারা শরিয়ার বিরোধিতার মধ্য দিয়ে শরিয়ার শাসন ও ইসলামী স্বার্থ বাস্তবায়ন করে ফেলবেন। যাদের অসাড় দাবি হচ্ছে: বর্তমান পরিস্থিতি শরয়ী রাজনীতি বিষয়ক বর্ণনাসমূহ পালন করার ক্ষেত্রে নমনীয়তার দাবি করে। ফলে তারা দ্বীন হারায়, কিন্তু দুনিয়াও অর্জন করতে পারে না।
অতঃপর আদলতের রায় সরকার, তার নিরাপত্তাবাহিনী ও রাষ্ট্রপক্ষের জন্য বিস্ময়কর হিসাবে আবির্ভূত হয়। কারণ আদালত একটিও মৃত্যুদণ্ডাদেশ জারি করেনি। আর ৩০২ জন আসামী থেকে ১৯৪ জনকে নির্দোষ সাব্যস্ত করেছে।
এ রায়ের প্রেক্ষাপটটাই রায় থেকে অধিক গুরুত্বপূর্ণ ও স্পর্শকাতর ছিল। যেমন:
- আদালত এটা স্বীকার করে নিয়েছে যে, মিশর ইসলামী শরিয়া দ্বারা শাসন করে না।
- আরো স্বীকার করে নিয়েছে যে, ইসলামী শরিয়া দ্বারা শাসন করা ওয়াজিব। এটা প্রত্যেক মুসলিমেরই আশা।
- আরো স্বীকার করেছে যে: মিশরীয় সংবিধান ও আইন ইসলামী বিধানাবলীর সাথে সাংঘর্ষিক।
- আরো স্বীকার করেছে: মিশরীয় সমাজে আইনের ছত্রছায়ায় অনাচার ও ইসলামের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ প্রসার লাভ করেছে।
- আরো স্বীকার করেছে: আসামীদের উপর এমন শারিরিক নির্যাতন করা হয়েছে, যা তাদের কারো কারো স্থায়ী অক্ষমতা সৃষ্টি করেছে। অতঃপর তিনি দায়িত্বশীলদেরকে তদন্তের জন্য শাস্তি পরিহার করার আবেদন করেছেন।
মিশরের বিচার বিভাগীয় ইতিহাসের সর্ববৃহৎ মামলায় আদালতের রায়ের ভূমিকায় এসেছে-
“দ্বিতীয় আলোচ্য বিষয়টির ব্যাপারে আদালত যে সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছে তা হল: আরবীয় প্রজাতন্ত্র মিশরে ইসলামী শরীয়ার বিধি-বিধান কার্যকর করা হয়নি। এ তত্ত্বটি প্রথম তত্ত্বটিরই সারনির্যাশ। তা হল: শরীয়া কার্যকর করার আবশ্যকীয়তা।”
তারপর বিচারক শাসনতন্ত্রে শরীয়ার অনুপস্থিতির কতগুলো প্রমাণ পেশ করেন, যেমন:
“মিশরীয় সমাজে এমন পরিবেশের উপস্থিতি, যা মহান শরীয়ার বিধি-বিধানের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। যেমন গান-বাদ্য, যাতে ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপ যুক্ত থাকে এবং তা রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে অনুমোদিত। বহু মদ কারাখানা, যেগুলো প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে রাষ্ট্রীয় অনুমতি রয়েছে। মদ বিক্রয় ও পরিবেশন কেন্দ্রসমূহ, যেগুলো রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে অনুমোদিত। ইলেক্ট্রনিক ও প্রিন্ট মিডিয়া সমূহ, যা এমন বিষয়াবলী প্রচার ও প্রসার করে, যা ইসলামী শরীয়ার বিধি-বিধানের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। যেমন নারীদের লাগামহীনতা। এ সকল বিষয়গুলো রাষ্ট্রধর্ম ইসলামের বর্ণনাসমূহের বিপরীত।”
এমনিভাবে আদালত রায়ের প্রেক্ষাপটের আরেক স্থানে বলে:
“প্রকৃতপক্ষে সংবিধানের সংশোধিত দ্বিতীয় ধারাটি সুস্পষ্টভাবে একথা বলে যে, ইসলাম হল রাষ্ট্রের রাষ্ট্রীয় ধর্ম। আরবী ভাষা হল তার রাষ্ট্রীয় ভাষা। ইসলামী শরীয়ার আদর্শগুলোই আইন প্রণয়নের মৌলিক উৎস। কিন্তু সংবিধানের বিধানগুলো যে ইসলামী শরীয়ার বিধানগুলোর সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়, তার প্রমাণ হিসাবে ওমর আব্দুর রহমান মুসলমানদের একজন আলেম হিসাবে তার বক্তব্যগুলোই যথেষ্ট। তিনি ১৯৮৩ সালের ৩ সেপ্টেম্বরের বৈঠকে আদালতের সামনে প্রমাণ করেছেন যে, এ সংবিধান ইসলামী শরীয়ার সাথে সাংঘর্ষিক এবং শরীয়া দ্বারা শাসন করে না। কারণ সংবিধানের ৮৬, ১০৭, ১০৮, ১০৯, ১১২, ১১৩ ও ১৮৯ ধারা পার্লামেন্ট সদস্যদেরকে আইন প্রণয়ন ও বিধান তৈরী করার অধিকার দেয়। কিন্তু ইসলামে তা শুধুমাত্র আল্লাহর জন্য। এমনিভাবে সংবিধানের ৭৫ ধারা রাষ্ট্র প্রধানের জন্য মুসলমান হওয়া ও পুরুষ হওয়া শর্ত করে না। আর এটা এমন বিষয়, যা ফুকাহায়ে কেরামের ইজমার বিরোধী। সংবিধানের ১৬৫ ধারা সুস্পষ্টভাবে বলে যে, আদালতের রায় হবে ওই আইনের ভিত্তিতে, যেগুলো উৎস ও বর্ণনার দিক থেকে ইসলামী শরীয়ার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়।”
আদালত রায়ের প্রেক্ষাপটে আরেক স্থানে এ ঘটনাগুলোর পূর্বে মিশরীয় সমাজের অবস্থা বর্ণনা প্রসঙ্গে বলে:
“আরবীয় প্রজাতন্ত্র মিশরে আল্লাহর শরীয়ার অনুপস্থিতি”- এটার ব্যাপারে আদালত অকাট্য দলিলের মাধ্যমে প্রমাণ পেশ করেছে, যা এখন আমরা পুনরাবৃত্তি করার প্রয়োজন মনে করছি না। কিন্তু এখন শুধু এ বিষয়টির প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করছে যে, ইসলামী শরীয়ার বিধি-বিধানকে আইন হিসাবে স্বীকৃতি দেওয়ার ক্ষমতা এখনো শেষ হয়ে যায়নি। এ কাজ শুরু হয়েছিল ১৯৭৯ সালে।
এছাড়াও মিশরীয় সমাজে এমন পরিবেশ বিদ্যমান, যা কোনভাবেই ইসলামের মূলনীতির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। তাই এটা কল্পনা করা যায় না যে, একটি রাষ্ট্রের ধর্ম হবে ইসলাম আর তাতে ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপ সম্পন্ন বিনোদনের অনুমোদন দেওয়া হবে। মদ উৎপাদন বা মদ বিক্রয় ও পানকেন্দ্রের অনুমোদন দেওয়া হবে অথবা ইলেক্ট্রনিক বা প্রিন্ট মিডিয়াকে সরাসরি এমন বিষয়াবলী প্রচার-প্রসার করার অনুমতি দেওয়া হবে, যা আল্লাহর শরীয়ার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয় বা এমনভাবে নারী-বেহায়াপনার অনুমোদন দেওয়া হবে, যা ইসলামী বর্ণনাসমূহের বিরোধী।”
‘মধ্যপ্রাচ্য’ পত্রিকা এ (ফুরসান) বইয়ের প্রথম সংস্করণের যে বিকৃত ও কাটছাট করা কপি ছাপিয়েছে, যা তারা আমেরিকান গোয়েন্দা সংস্থা থেকে পেয়েছিল, তাতে পত্রিকাটি আমার ব্যাপারে এই দাবি করেছে যে, আমি আইন উপদেষ্টা আদালত প্রধান মুহাম্মদ আব্দুল গাফ্ফারের প্রশংসা করেছি এবং বলেছি, তার রায়গুলো ইসলাম পন্থিদের জন্য ইনসাফপূর্ণ হয়েছে। পত্রিকার বক্তব্যটি:
“যদিও জাওয়াহিরি তার বইয়ে সামরিক আদালতকে ভ্রান্ত বলেছেন এবং এটাকে ইসলামপন্থি ও তার (জাওয়াহিরির) কথিত সামরিক ধর্মনিরপেক্ষতাবাদিদের মাঝে মুখোমুখি লড়াইয়ের নিয়মিত রূপ হিসাবে গণ্য করেছেন, কিন্তু তিনি আইন উপদেষ্টা আদালত প্রধান আব্দুল গাফ্ফারের প্রশংসা করে বলেছেন: তার রায়গুলো ইসলামপন্থিদের জন্য ইনসাফপূর্ণ হয়েছে।”
এ হল মধ্যপ্রাচ্য পত্রিকা আমার ব্যাপারে যত মিথ্যা অপবাদ একত্রিত করেছে, তন্মধ্যে একটা। এটা কখনোই হতে পারে না যে, আমি মানব রচিত আইন দ্বারা বিচারকারী একজন ধর্মনিরপেক্ষ বিচারকের প্রশংসা করবো এবং তাকে ন্যায়পরায়ণ বলব। অথচ আল্লাহ তা’আলা বলেছেন:
وَمَن لَّمْ يَحْكُم بِمَا أنزَلَ اللّهُ فَأُوْلَـئِكَ هُمُ الظَّالِمُونَ
“যারা আল্লাহর নাযিলকৃত বিধান অনুসারে ফায়সালা করে না তারা জালেম।”
তাই ধর্মনিরপেক্ষতাবাদি বিচারক জালিম, যদিও সে সঠিক রায় দিক না কেন। কারণ সে পূত-পবিত্র রবের শাসনকর্তৃত্ব স্বীকার করেনি। উস্তাদ শহিদ সাইয়িদ কুতুব রহ. বলেন:
“আল্লাহর অবতীর্ণ বিধান দ্বারা শাসন করা এবং অন্য কিছু দ্বারা শাসন না করাই যে ‘আল্লাহর দ্বীন’, এটার কোন ব্যত্যয় নেই। এটাই আল্লাহর ক্ষমতা প্রকাশকারী, আল্লাহর শাসন কর্তৃত্ব প্রকাশকারী এবং একথা প্রকাশকারী যে, আল্লাহ ব্যতিত কোন উপাস্য নেই।
এই আবশ্যকীয়তা, অর্থাৎ ‘আল্লাহর দ্বীন’ ও আল্লাহর অবতীর্ণ বিধান দ্বারা শাসন করার মাঝে অবিচ্ছেদ্য যোগসূত্র থাকার আবশ্যকীয়তা শুধু একারণেই নয় যে, মানবজাতি নিজেদের জন্য যত নীতি, আদর্শ, পদ্ধতি ও নিয়ম-নীতি প্রণয়ন করে তার থেকে আল্লাহর অবতীর্ণ বিধানই উত্তম; বরং এটা হল এই আবশ্যকীয়তার অনেকগুলো কারণ থেকে একটি কারণ। এটাই প্রথম ও প্রধান কারণ নয়। এই অবিচ্ছেদ্য যোগসূত্রের আবশ্যকীয়তার প্রথম ও প্রধান কারণ হল, আল্লাহর অবতীর্ণ বিধান দ্বারা শাসন করাই আল্লাহর ‘উলুহিয়্যাহ’(উপাস্য হওয়া) এর স্বীকৃতি এবং আল্লাহ ব্যতিত অন্য কারো জন্য উলুহিয়্যাহ থাকা বা তার বৈশিষ্ট্যগুলো থাকার অস্বীকৃতি।
এটাই ইসলাম আভিধানিক অর্থেও- তথা আত্মসমর্পণ অর্থে এবং এটাই ইমলাম পারিভাষিক অর্থেও, তথা যে অর্থ নিয়ে সমস্ত দ্বীনগুলো এসেছে। অর্থাৎ আল্লাহর নিকট আত্মসমর্পণ করা এবং আল্লাহর সাথে অন্য কারো জন্য উলুহিয়্যাহর দাবি বা উলুহিয়্যাহর বিশেষ বৈশিষ্ট্যগুলোর দাবি করা থেকে মুক্ত হওয়া। সেই বিশেষ বৈশিষ্ট্যগুলো হল, যেমন ক্ষমতা, শাসনকর্তৃত্ব এবং বান্দাকে জীবনব্যবস্থা ও আইন-কানুন দেওয়ার মাধ্যমে নিজের অনুগত ও দাস বানানোর অধিকার।
মানুষ নিজেরা নিজেদের জন্য আল্লাহর শরীয়ার সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ বিধি-বিধান প্রণয়ন করলেও, এমনকি হুবহু আল্লাহর শরিয়ার বিধানগুলো প্রণয়ন করলেও যথেষ্ট হবে না, যতক্ষণ পর্যন্ত তারা সেগুলোকে নিজেদের দিকে সম্বন্ধিত করবে এবং তার উপর নিজেদের ব্যাজ লাগাবে। যতক্ষণ পর্যন্ত আল্লাহর ক্ষমতার কাছে আত্মসমর্পণ না করবে, তাঁর উলুহিয়্যাহকে ও তাঁর উলুহিয়্যাহর একত্বকে স্বীকার করতঃ তাঁর দিকে না ফিরবে এবং আল্লাহর নামেই তা কার্যকর না করবে। উলুহিয়্যার মধ্যে আল্লাহর একত্বের বিশ্বাসই বান্দাকে ক্ষমতা ও শাসনকর্তৃত্বের অধিকার থেকে মুক্ত করে। তবে বান্দা শুধুমাত্র আল্লাহর শরিয়ার বাস্তবায়ন হিসাবেই তা করতে পারে।”
১ম পর্ব
২য় পর্ব
৩য় পর্ব
৪র্থ পর্ব
৫ম পর্ব
৬ষ্ঠ পর্ব
৭ম পর্ব
৮ম পর্ব
Comment