দ্বিতীয় অধ্যায়: সাদাত নিহত, অতঃপর আসামী
চতুর্থ পরিচ্ছেদ
ত্বহা আল বোটলি- খাটি মাটির মানুষ
ত্বহা আল বোটলি- খাটি মাটির মানুষ
সোহাগ প্রদেশেস্থ তামা অঞ্চলের ‘ত্বহা মাহমদু হুসাইন হাসনাইন আল বোটলি এমন একটি নাম, যা আমার স্মৃতি থেকে মুছে যাবে না। তার স্বতস্ফুর্ততা, সরলতা, রসবোধ, গুঞ্জরিত হাসি, সকলের সেবা ও অকৃত্রিম চলা ফেরার কথা এখনো মনে পড়ে। কিন্তু এসব কিছুর আড়ালে ঢাকা ছিল ত্বহা আল বোটলির দুঃখগুলো।
মিশরের লাখো বেদনাদায়ক ঘটনাগুলোর থেকে একটি বেদনাদায়ক ঘটনা, যা জুলুম, নিষ্পেষণ ও নিরীহ সরলদের উপর স্বেচ্ছাচারিতার মাধ্যমে সংঘটিত হয়েছে। কারাগারে ঢোকার সময় ত্বহা ত্রিশের মাঝামাঝিতে পা দেয়া এক যুবক ছিলেন। কিন্তু কেন তিনি কারাগারে প্রবেশ করলেন? এটাই হল মিশরের অসংখ্য দুঃখজনক, হাস্যকর ও ক্রন্দনোদ্রেককর ঘটনাবলির মাঝে একটি দুঃখজনক ঘটনা। কবি আবুত তাইয়িব যার বর্ণনা দিয়েছেন এভাবে: (কবিতার অর্থ)
• মিশরে কত হাস্যকর ঘটনা ঘটে!! কিন্তু তা এমন হাসি, যা কান্নার মত।
ত্বহা সবেমাত্র মিশরীয় সেনাবাহিনীতে দীর্ঘ বাধ্যতামূলক সেবা শেষ করেছেন। তিনি রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে বিশেষ ফোর্সের সদস্য হিসেবে সেবা দেন। অতঃপর অক্টোবর ১৯৭৩ এর যুদ্ধেও সেবা দেন। তারপর তমার স্থানীয় পরিষদে কর্মচারি হিসাবে কাজ করেন। অতঃপর “আল-হিজবুল ওয়াতানী”(যেটা সরকারি দল)এ যোগ দেন। তিনি তার একজন উদ্যমী কর্মী ছিলেন। গতানুগতিক অন্যান্য তরুণদের মত তিনিও গাজার ব্যবহারকে দোষ বা লজ্জার বিষয় মনে করতেন না। আল্লাহ তা’আলা তাকে যে দৈহিক শক্তি ও প্রশিক্ষিত শারিরিক অবকাঠামো দান করেছিলেন, তার কল্যাণে তিনি একটি জিম ক্লাবে কারাতে প্রশিক্ষণ দিতেন। এখানেই তার বিপদ শুরু হয়।
তা হল, আনওয়ার সাদাত হত্যার পর পুলিশী গোয়েন্দার মাধ্যমে এই তথ্য আসল যে, আল জামাআতুল ইসলামিয়ার সাথে সম্পৃক্ততায় সন্দেহভাজন জনৈক ব্যক্তি প্রকৌশল কলেজের শিক্ষার্থী। সে বয়সে বিশের কোঠায় পা দিয়েছে এবং সে তমায় কিছু যুবককে কারাতে প্রশিক্ষণ দিত। এই সন্দেহভাজনকে গ্রেফতার করার ব্যাপারে থানায় নির্দেশ জারি হল।
পুলিশের সোর্স প্রশিক্ষক হিসাবে শুধুমাত্র ত্বহা আল বোটলিকেই পেল। যদিও তার ব্যক্তিগত পরিচয় ও সন্দেহভাজনের ব্যক্তিগত পরিচয় সম্পূর্ণ ভিন্ন। সন্দেহভাজন ব্যক্তি হল বিশের কোঠায় পদার্পণকারী অবিবাহিত এক বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী। সে সেনাবাহিনীতে ভর্তি হয়নি এবং সে আল জামাআতুল ইসলামিয়ার সাথে সম্পৃক্ত। আর ত্বহা সামরিক সার্ভিস শেষ করলেন। তিনি কখনো বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হননি। একজন সরকারি চাকুরিজীবি, বিবাহিত, আল-হিযবুল ওয়াতানির সদস্য এবং চলাফেরায় সুশৃঙ্খল ধার্মিক নয়।
এতকিছু সত্ত্বেও পুলিশের সোর্স তাকে গ্রেফতার করল, যাদের কেউ কেউ তার সাথে একত্রে গাজাও ব্যবহার করেছে। গ্রেফতার করল যাতে শৈথিল্যের অভিযোগে অভিযুক্ত না হতে হয়।
ত্বহার কষ্টের যাত্রা শুরু হয়ে গেল। তারা তাকে জানাল, ব্যাপার সহজ। থানায় গেলে কয়েক মিনিটে সমাধান হয়ে যাবে। থানায় জানাল, ব্যাপার সহজ। প্রাদেশিক রাজধানিতে নিরাপত্তা অফিসে গেলে কয়েক মিনিটে সমাধান হয়ে যাবে। প্রাদেশিক রাজধানিতে জানাল, ব্যাপার সহজ। কায়রোতে গেলেই সমাধান হয়ে যাবে। ত্বহার সফর শুরু হল অন্য জগতের পথে, যেটাকে মিশরীয়গণ তাদের হাসি-কৌতুকের মধ্যে বলে: ‘সূর্যের বাইরে’।
তারা এই মর্মে তার একটি তদন্ত রেকর্ড বানাল যে, তার নাম যদিও ত্বহা মাহমুদ হুসাইন হাসনাইন আল-বোটলি, কিন্তু তার আরেকটি নাম আছে শুহরাহ রুবায়ী। যা তার মূল নামের সাথে কোন সম্পর্কই রাখে না। আর এটাই ওয়ান্টেড সন্দেহভাজনের নাম।
যে কেউ প্রথমবার শুনলে এ ঘটনাটিকে নির্বোধ তামাশা মনে হবে। কিন্তু আশ্চর্যালীর দেশ মিশরে এগুলো খুব স্বাভাবিক বিষয়। যেখানে একজন মানুষের শুধু ওই কালির সমপরিমাণ মূল্যই আছে, যার মাধ্যমে তদন্ত রেকর্ডটা লিখা হয়। আর মানবাধিকার ও সম্মান তো শুধু নেতৃস্থানীয় লোকদের জন্য, যারা এখনো পর্যন্ত এ সমস্ত বুলিগুলো ব্যবহার করে আসছে, যদিও তা আইনত: অকার্যকর। কিন্তু তা ‘মিশরীয় জনগণ’ এর অন্তর্ভূক্ত অন্যান্য সৃষ্টিজীবের জন্য নয়।
এ প্রসঙ্গে আমার মনে পড়ছে, আমি দূর্গের কারাগারে একাকি বন্দি থাকাবস্থায় কারা কর্তৃপক্ষ আমার সামনের সেলে শহিদ মুহাম্মদ আব্দুস সালাম ফাররাজের সাথে সম্পর্ক থাকার অভিযোগে একজন স্বশস্ত্র বাহিনীর বৈমানিককে এনে উপস্থিত করল। এই বৈমানিক আমাকে জানালেন, তাকে তদন্তের সময় তদন্তকারিরা বলল: “তুমি কি আমাদেরকে সহযোগিতা করতে চাও, তাহলে তোমার সাথে মানুষের মত ব্যবহার করব? (কারণ তিনি একজন অফিসার!) নাকি তুমি চাও, তোমার সাথে কারাগারের অন্যান্য মাখলুকের মত ব্যবহার করি?”
যাইহোক, আমরা ত্বহা আল বোটলির আলোচনায় ফিরে যাই। ত্বহা আল বোটলির উপর দিয়ে শাস্তির কষাঘাত পূর্ণোদ্দমে চলতে লাগল। তার শক্তিশালি দৈহিক গঠনের কারণে তাকে আরো বেশি নির্যাতন করল। প্রকৃত সন্দেহভাজনকে গ্রেফতার করা সত্ত্বেও এবং পরবর্তীতে ত্বহা কারাগারে ওই লোকের সাথে সাক্ষাৎ করা সত্ত্বেও তার দেশীয় পুলিশের সোর্সের প্রথম কলঙ্ক তার সাথে লেগেই থাকল। জিহাদি সংগঠনের নেতৃস্থানীয় লোক বলে অভিযোগ করে ত্বহা আল বোটলিকে ‘জরুরি রাজ্য সুরক্ষার উচ্চ আদালতে’ নিয়ে যাওয়া হয়, যা মিশরের বিচার বিভাগীয় ইতিহাসের সর্ববৃহৎ মামলাগুলো দেখে।
কারাগারেই সরকারের প্রকৃত চেহারা এবং আল হিযবুল ওয়াতানীর প্রকৃত চেহারার ব্যাপারে ত্বহা আল বোটলির হুশ ফিরল। ত্বহার বাহ্যিক অবস্থা ছিল অধিকাংশ আসামিদের অবস্থা থেকে ভিন্ন। কারণ তিনি ছিলেন ক্লিনসেভ ও ধুমপায়ি। কিন্ত তিনি তার পৌরষ ও উত্তম চরিত্রের কারণে সকলের প্রিয় ছিলেন। তিনি নিজের ধুমপানের মাধ্যমেও কাউকে কষ্ট দিতেন না। তিনি একা এক সেলে থাকতেন। কিন্তু ত্বহার উদার ও অমায়িক আচরণের কারণে এই সেলটিই হয়ে উঠে সকলের মিলনকেন্দ্র ও ওয়ার্ডের সমাবেশস্থল।
গোয়েন্দারা, যারা নিজেরাই ত্বহার উপর এ বিপদ টেনে এনেছিল, তারা তাকে কারাকর্মী বানানোর চেষ্টা করল। যেহেতু তিনি আল জামাআতুল ইসলামিয়ার অন্তর্ভূক্ত নন। তারা তাকে প্রতিশ্রুতি ও আশা দানের মাধ্যমে দাড়ি রেখে দিতে, ধুমপান ছেড়ে দিতে, বন্দিদের মাঝে ঢোকার চেষ্টা করতে এবং তাদের সংবাদসমূহ কারা তদন্ত অফিসারদের নিকট জমা দিতে প্রস্তাব করল। কিন্তু ত্বহা নিজ ব্যক্তিত্ব ও মহত্বের কারণে বীরত্বের সাথে তাদের মোকাবেলা করলেন। তিনি এ পথ গ্রহণ করতে অস্বীকৃতি জানালেন। এমনকি তার অন্যান্য বন্দি ভাইদের পক্ষ থেকে যেন তার উপর গুপ্তচরবৃত্তির অভিযোগ না উঠে, সেজন্য দাড়ি রাখতে ও ধুমপান ছেড়ে দিতেও অস্বীকৃতি জানান। তার সরল চিন্তা এভাবেই বিষয়টিকে তার সামনে ফুটিয়ে তুলেছিল।
আমি কারাগারে ত্বহার সঙ্গে পরিচিত হই। খুব তাড়াতাড়িই তার সাথে আমার পরিচয় ঘটে, যখন ট্রায়াল ওয়ার্ডে ধর্মঘটের উস্কানি দানের অভিযোগে আমি ও নাজিহ ইবরাহিম লিমান তোরার ট্রায়াল ওয়ার্ড থেকে নির্যাতন ওয়ার্ডে স্থানান্তরিত হলাম। সেখানে সবগুলো সেল ভরপুর ছিল। শুধু ত্বহার সেল ব্যতিত কোন সেলেই জায়াগা খালি ছিল না। তাই আমরা তার সাথেই থাকলাম। এটা ছিল রমযান মাস। আমাদের শাস্তি স্বরূপ সেলটি তালাবদ্ধ করে দেওয়া হয়। ইফতারের সময় ত্বহা তামাকের রোল জালাতেন। তাই তখন তিনি সেলের দরজার ছোট্ট ছিদ্রের মধ্যে মুখ রাখতেন। সেখান দিয়েই রোলের ধোঁয়া ছাড়তেন। যেন আমাদের অনুভূতিতে কষ্ট না লাগে।
তার মাঝে ও আমার মাঝে বন্ধুত্ব ও ভ্রাতৃত্ব বৃদ্ধি পেল, যেহেতু আমি তার মাঝে পৌরষ, সততা ও উদারতার ছোঁয়া পেয়েছিলাম। তার সেলটি তার অনেক সাথীদেরই চায়ের পানশালা ছিল। তিনি আমাকে শাইখুল আরব বলে অভিহিত করতেন। তিনি তার বিশেষ সময়গুলোতে আমাকে খোলাখুলিভাবেই বলতেন যে, কারাগারে আসার পূর্বে তার অনিয়মানুবর্তী চলাফেরার কারণেই তাকদিরি শাস্তি হিসাবে তার এই কারাবরণ এসেছে। তাই তিনি পূর্বের সবকিছু থেকে ফিরে আসার জন্য আল্লাহর সঙ্গে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হয়েছেন। তিনি আল হিযবুল ওয়াতানীর প্রকৃত চেহারা এবং তার দাজ্জালি ও কপটতার বীভৎস চিত্র উদঘাটন করতে পেরেছেন আর পূর্বে এ ধরণের দলে যুক্ত থাকার ব্যাপারেও অনুশোচনা করেন।
আদালতের প্রথম বৈঠকে ত্বহা আল বোটলি আসামিদের প্রথম খাঁচার শিকের উপর চড়লেন, যেটা ছাদ পর্যন্ত প্রলম্বিত ছিল। তারপর চিৎকার করে বিচারককে বললেন: আমি মাজলুম ত্বহা মাহমুদ হুসাইন হাসনাইন আল-বোটলি, আমি সিনাইয়ে মিশরের প্রতিরক্ষার জন্য লড়াই করেছি। আমি আমার মুক্তি চাচ্ছি, কারণ আমি কোন অপরাধে লিপ্ত হইনি।
আমি জনৈক ভাইকে শুনেছি, যিনি তাকে চিনতেন না- তিনি বিস্ময়ভরা দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে অন্য ভাইকে লক্ষ্য করে বললেন: এই ভাই এমন কার্যকলাপ করছে কেন? তখন অপর ভাই তাকে দুঃখের সঙ্গে বললেন: তাকে ছেড়ে দাও, সে যা মন চায় করুক।
যদিও মামলার কাগজপত্রে এমন কোন অভিযোগ ছিল না, যার দ্বারা ত্বহা আল-বোটলিকে আসামি সাব্যস্ত করা যায়, কিন্তু সেই জঘন্য রেকর্ডটি ছিল। ফলে বিচারক তাকে মুক্ত করলেন না। তিনি পরিপূর্ণ তিন বছর কারাগারে কাটালেন, নিজ শহর থেকে শত শত কিলোমিটার দূরে।
আদালতে ত্বহা তার দুই চাচাত ভাইয়ের সাক্ষ্য চাইলেন। ফলে তারা আমার শ্রুত সর্বাধিক বিরল সাক্ষ্য প্রদানের জন্য ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে আদালতে আসলেন। এই সাক্ষ্য দেওয়ার জন্য যে, তাদের সমানে দণ্ডায়মান লোকটি হল ত্বহা আল-বোটলি। তার ‘শুহরাহ’ বলে কোন নাম নেই। এমনকি অন্য কোন নামও নেই। এ হল মিশরের হাস্যকর ও ক্রন্দনোদ্রেককর ঘটনাবলী...
এক সময় ত্বহা আল-বোটলিকে মুক্তি দেওয়া হল। আমি তার পরে এক মাসেরও কম সময় কারাগারে থাকলাম। তারপর আমাকে মুক্তি দেওয়া হল। আমার মুক্তির অল্প কয়েকদিন পর ত্বহা আল-বোটলি কায়রোর প্রথম সফরে লিমান তোরা কারাগারে গেলেন। প্রহরীদের সাথে তার সম্পর্কের সুবাদে তার কারাবন্দি সাথীদের প্রতি তার সালাম পৌঁছে দেওয়ার আবেদন জানালেন, বিশেষ করে আমার প্রতি। তখন কারা ফটকের প্রহরীরা তাকে জানাল, আমাকে মুক্তি দেওয়া হয়েছে। আমি হতবাক হয়ে গিয়েছিলাম এটা দেখে যে, জনৈক কারারক্ষী কারাগারের অপজিটের এক দোকান থেকে আমাকে ফোনে কল করছে। আমাকে জানাচ্ছে, ত্বহা আল-বোটলি আমার সাথে আলাপ করতে চায়। তিনি আমাকে বললেন, আমি অবশ্যই আপনার সাথে সাক্ষাৎ করব। অতঃপর তিনি আমার ক্লিনিকে আমার সাথে সাক্ষাৎ করতে আসলেন। এ সময় আমি দু’রকমের নজরদারির মধ্যে ছিলাম, যেমনটা একটু পূর্বে উল্লেখ করেছি। একটি হল প্রকাশ্য বাধ্যতামূলক নজরদারি। অপরটি গোপন। আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম, এই ত্বহা! আমার সাথে যোগাযোগ করার পরিণতি সম্পর্কে তুমি কি ভয় পাও না? তিনি নিজের মার্জিত ভাব নিয়ে বললেন: চাচা... তারা তো কানাকে তার চোখের উপর আঘাত করেছে। দুঃখ... দুঃখ...। আমি তার বিশ্বস্ততা ও মহত্বে মুগ্ধ হলাম। তাকে বললাম, হে ত্বহা, আমি বাধ্যতামূলক নজরদারিতে আছি। আমার চলাফেরা সীমাবদ্ধ। তিনি আমাকে বললেন: ইনশাআল্লাহ অচিরেই এই কঠিন অবস্থা শেষ হয়ে যাবে এবং আপনি সফর করবেন। কিন্তু যখন সফর করবেন, তখন আমাদেরকে ভুলে যাবেন না। আমার জন্য সৌদি আরবে একটি কাজের চুক্তি করার চেষ্টা করুন। কারণ আমার অবস্থা সংকটাপন্ন।
আমি তার জন্য এটার ব্যবস্থা করতে পারিনি। আর এর ইচ্ছাও করেনি। আমি আশা করছি, এখন তার আবেদনের দীর্ঘ ২৫ বছর পর ত্বহা আমাকে ক্ষমা করবেন এবং বুঝতে চেষ্টা করবেন যে, আমি তার স্বার্থেই তার আবেদনে সাড়া দেইনি। যেন নতুন করে তার বিপদ না আসে।
আমার মনে পড়ে, তোরা অভ্যর্থনা কারাগারে ত্বহার আরেকজন কারাবন্দি বন্ধু ছিল। আমার মনে পড়ছে, তাকে ‘আহমাদের চাচা’নামে ডাকা হত। তার ব্যাপারে অভিযোগ ছিল অস্ত্র ব্যবসা। আদালত বৈঠকে তাদের সাক্ষাৎ হত। উভয়ে মিলে গেছে। উভয়েই অকৃত্রিম। আর কেউই আল-জামাআতুল ইসলামিয়ার সাথে সম্পৃক্ত নয়। তারা আসামিদের খাঁচার পিছনের করিডোরের এক পাশে চলে যেতেন। সেখানে পরস্পর কথা বলতেন।
একদা আমরা আদালত থেকে ফেরার পর ত্বহা আমাকে বললেন: জানেন, আজ আহমাদের চাচা আমাকে কী বলল? আমি বললাম, কী বলল? বললেন: আমি আহমাদের চাচার সঙ্গে বসা অবস্থায় হঠাৎ লক্ষ্য করলাম, তার চক্ষুদ্বয় অশ্রুতে ভরে গেছে। তিনি আমাকে বললেন: এই অফিসারটিকে দেখ, যে আজ আদালত প্রহরিদেরকে ডাকল। সে তদন্তের সময় চাবুক দিয়ে আমার দেহটা চূর্ণ-বিচূর্ণ করে দিয়েছে।
আহমাদের চাচা কারাগারে থাকাবস্থায়ই কিছু ভাইয়ের মাঝে ও একজন অফিসারের মাঝে সংঘর্ষ বাঁধে, যে অফিসারটি তাদের উপর সীমালঙ্ঘন করেছিল। ফলে তোরা অভ্যর্থনা কারাগার কর্তৃপক্ষ কারাগারের সকল বন্দিদের উপর শাস্তি অভিযান চালানোর সিদ্ধান্ত নিল। কারা তদন্ত বিভাগ আহমাদের চাচাকে ডেকে পাঠাল। তাকে বলল: আমরা এখন আল-জামাআতুল ইসলামিয়ার এ সকল বন্দিদের শায়েস্তা করার জন্য এক মাস ব্যাপি শাস্তি অভিযান পরিচালনা করব। আমরা চাই তোমাকে এখান থেকে স্থানান্তর করতে, কারণ তুমি তাদের দলভূক্ত নও। তখন তিনি নিজ অকৃত্রিম সরলতা, বুদ্ধিমত্তা ও সচ্চরিত্রের সাথে তাদেরকে বললেন: আমাকে আপনারা কোথায় স্থানান্তর করবেন? অফিসার বলল: তোরা ফার্ম কারাগারে। আহমাদের চাচা বললেন: অর্থাৎ আপনি আমাকে এক কারাগার থেকে আরেক কারাগারে স্থানান্তর করবেন। যাদের সাথে একসঙ্গে খেয়েছি তাদের ফেলে একা চলে যাওয়া আমাদের নিকট দুষণীয়। আমরা সুখে-দুখে একসাথেই থাকব।
আহমাদের চাচা এক মাস ব্যাপী শাস্তি ও কষ্ট সহ্য করেন। তবু তার কারাগারের সাথীদেরকে বিপদের সময় ছেড়ে যান না!!
তাই, যারা সমঝোতা, পিছুটান, লাভ-ক্ষতির হিসাব, আমেরিকান বিশ্বায়নের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলা, অপরাধিদের নেতাদের সঙ্গে সন্ধিচুক্তি করা ও নিকৃষ্ট কষাইদের সঙ্গে এক সুরে গান গাওয়ার স্রোতে ভেসে গেছেন, তাদের কি এই আদর্শ ও মূল্যবোধ থেকে কিছু শিখা সম্ভব হবে?
Comment