দ্বিতীয় অধ্যায়: সাদাত নিহত, অতঃপর আসামী
পঞ্চম পরিচ্ছেদ
ফাতহি রিদওয়ান- ইচ্ছাকৃত অস্বীকারের যুগে গভীর উপলব্ধি
পঞ্চম পরিচ্ছেদ
ফাতহি রিদওয়ান- ইচ্ছাকৃত অস্বীকারের যুগে গভীর উপলব্ধি
উস্তাদ ফাতহি রিদওয়ান মুস্তফা কামিল রহ. এর প্রতিষ্ঠিত (সরকারীটা নয়) ‘আল হিযবুল ওয়াতানী’র একজন নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিত্ব। এরা মনে করত, দেশাত্ববোধের অর্থ হল ইসলামী রাষ্ট্রের সাথে তথা উসমানীয় খেলাফতের সাথে সম্বন্ধিত হওয়া। খলিফা মুস্তফা কামিলের নাম হল মুহাম্মদ ফরিদ, যিনি ‘তারিখুদ দাওলাতিল উসমানিয়া’কিতাবের লেখক। উক্ত কিতাবে তিনি বাগদাদের আব্বাসীয় খেলাফত পতনের ব্যাপারে বলেন:
“একারণে তারপর ইসলামের এমন কোন বড় রাষ্ট্র ছিল না, যা ইসলামের শির উঁচু রাখবে এবং তার বিভক্ত অঞ্চলগুলোকে একত্রিত করবে। বরং তার রাষ্ট্রীয় ঐক্য নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। প্রত্যেক শাসককে যে অঞ্চল বা প্রদেশের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল, সে নিজ অঞ্চল বা প্রদেশ নিয়ে স্বাধীন হয়ে গেল। অবস্থা এভাবেই চলতে থাকে, অবশেষে আল্লাহ ইসলামের জন্য প্রতাপশালি উসমানীয় সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার পথ সুগম করে দিলেন। ফলে তা অধিকাংশ ইসলামী রাষ্ট্রগুলোকে তার পতাকাতলে একত্রিত করে নিল, এমন অনেক অঞ্চল বিজয় করল, যা পূর্বে সত্য দ্বীনের ভূষণে অলঙ্কৃত ছিল না, ইসলামের শক্তি ফিরিয়ে আনল এবং ধরার মাঝে তার বাণীকে সুউচ্চ করল।”
একারণে ‘আল হিযবুল ওয়াতানী’ সর্বদাই ইসলামের ভাবধারার কাছাকাছি ছিল। উস্তাদ ফাতহি রিদওয়ান আনওয়ার সাদাতের প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন। সেপ্টেম্বর ১৯৮১ এর গ্রেফতার অভিযানের ধারাবাহিকতায় সাদাত তাকে গ্রেফতার করে। সাদাত তার বিদ্রুপাত্মক অতিরঞ্জনের মাধ্যমে তার ব্যাপারে বলে: এ লোকটি দীর্ঘ সত্তুর বছর যাবত আমাদেরকে ধোঁকা দিয়ে আসছে!!
ফাতহি রিদওয়ান এবারই প্রথম গ্রেফতার হননি, বরং ব্যাপার হল, এবার তিনি সত্তুর বছর বয়সে পা রেখেছিলেন। আনওয়ার সাদাত হত্যার কিছুদিন পরই যারা মুক্তি পেয়েছিল, তাদের মধ্যে ফাতহি দিরওয়ানকেও হুসনি মোবারক মুক্তি দেয়।
উস্তাদ ফাতহি রিদওয়ান স্বপ্রণোদিত হয়ে আমার পক্ষে ও ডক্টর সালাহ মেহুবের পক্ষে জিহাদ মামলায় আদালতে ওকালতি করেন। উস্তাদ মাহফুজ আয্যাম ও মুহাম্মদ ইমাদুদ্দিন সুবকির পর তিনি হলেন আমার পক্ষে লড়া তৃতীয় আইনজীবি। এটা হয়েছিল আমার ওকিল ও মামা উস্তাদ মাহফুজ আয্যামের সাথে তার সুদৃঢ় সম্পর্কের দরুণ।
আমি এখনো তার অনন্য বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত শোনানির বক্তব্যটি স্মরণ করি। শোনানির দিন উস্তাদ ফাতহি রিদওয়ান আদালতকক্ষে আসলেন। তার মাঝে বয়সের ছাপ সুস্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল। আমি বিস্মিত নেত্রে তার প্রতি লক্ষ্য করলাম, এত প্রবীণ বয়সে কারা জীবনের দুঃখ-যাতনা সত্ত্বেও কী ধীর-স্থির তার পদক্ষেপ?
শোনানি শুরু করার সাথে সাথেই উস্তাদ ফাতহি রিদওয়ান একজন তীব্র ও অনর্গলভাষী বক্তায় পরিণত হয়ে যান, যা আরবি ভাষার অবস্থা নষ্ট হওয়ার আগে মিশরের প্রাচীন যুগের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। তেমনিভাবে মামলার বিশদ বিবরণ উপস্থাপনকারী এক অনন্য বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত শক্তিশালী আইনজীবিতে পরিণত হন। ফাইলপত্র বা পর্যালোচনাগুলো না দেখে শুধুমাত্র আমার কিছু বক্তব্য উদ্ধৃত্য করে তীব্রভাবে জবাব দিতে লাগলেন।
উস্তাদ ফাতহি রিদওয়ান মামলার মূল আলোচ্য অংশটি নিয়ে কথা বললেন। তাতে তিনি মামলার ফাইলে উপস্থাপিত দলিলগুলোর স্ব-বিরোধিতা ও গোজামিলের বিষয়টি সুস্পষ্টভাবে ফুটিয়ে তোলেন। তারপর আমার ব্যাপারে কথা বলতে মনোযোগী হন। তিনি বলেন, তিনি স্বেচ্ছায় আমার পক্ষে মামলা লড়ার জন্য এসেছেন। কারণ তিনি শুধুমাত্র এমন মামলার শোনানি করেন, যা ন্যায়সঙ্গত বলে তিনি বিশ্বাস করেন। তিনি ব্যক্তিগতভাবে আমাকে চিনেন না। কিন্তু তিনি আয্যাম পরিবারের আমার মামাদেরকে চিনেন। যদিও বংশ মানুষের মর্যাদা উঁচু করে না, বরং মানুষের আমলই মানুষের মর্যাদা উঁচু করে। তবে আয্যাম পরিবার, মিশরে সম্মানিত পরিবার হিসাবে পরিচিত দু’টি পরিবারের একটি। অন্যটি হল আলুবা পরিবার।
তারপর তিনি আসামিদের যে নির্যাতন চালানো হয়েছে তার ব্যাপারে কথা বলেন। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন: আমি এ সকল যুবকদের উপর কী নির্যাতন হয়েছে তার কথা বলব না। আমি শুধু আমার উপর কী নির্যাতন হয়েছে তাই বলি, অথচ আমি একজন ৭০ এ পদার্পণকারি বৃদ্ধ। এতেই আদালতের পক্ষে বোঝা সম্ভব হবে যে, এ সকল যুবকদের উপর কী নির্যাতন করা হয়েছে। তিনি উল্লেখ করলেন, কিভাবে একজন বয়োবৃদ্ধ হওয়া সত্ত্বেও তাকে একাকি এক সেলে পূর্ণ একদিন খাবার-পানি ছাড়া ফেলে রাখা হয়েছে এবং আব্দুল আযীম আবুল আতার চিকিৎসা বঞ্চিত হয়ে কারাগারের হাসপাতালে মারা যাওয়ার দৃশ্য তিনি নিজে প্রত্যক্ষ করেছেন।
তারপর উস্তাদ ফাতহি রিদওয়ান শোনানির সাধারণ অংশ নিয়ে আলোচনা শুরু করেন। তিনি দেশের রাজনৈতিক অবস্থা সম্পর্কে কথা বলতে গিয়ে আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন। তিনি কান্নাজড়িত স্বতস্ফুর্ত কণ্ঠে চিৎকার করে বললেন: কেন এ দেশে, লেবাননে, ইরানে ও প্রতিটি স্থানে এ ঘটনাগুলো ঘটছে? কারণ বোতলের জিন জেগে উঠেছে। ইসলাম জেগে উঠেছে।
বিচারক অতি দ্রুত তার উদ্বিগ্নতাকে শান্ত করার জন্য বললেন: উস্তাদ ফাতহি রিদওয়ান, আপনি কি বিশ্রাম নিতে আগ্রহি? আপনার জন্য একটি চেয়ার ব্যবস্থা করব? কিন্তু তিনি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে শোনানি সমাপ্ত করলেন।
আমি এমন একজন ব্যক্তি থেকে এই শোনানি দেখে খুব প্রভাবিত হলাম, যিনি ব্যক্তিগতভাবে আমাকে চিনেন না। তিনি ইসলামি জিহাদি ধারার ব্যাপারে এতটা সচেতনতা রাখেন। তাই আমি তার নিকট একটি তাৎপর্যপূর্ণ হাদিয়া পাঠানোর জন্য আমার পরিবারের নিকট সংবাদ পাঠালাম। সে ডক্টর মুহাম্মদ মুহাম্মদ হুসাইন রহ. এর ‘আল-ইত্তিহাজাতুল ওয়াতানিয়্যাহ ফিল আদাবিল আরাবিল মুআসির ’ (আধুনিক আরবি সাহিত্যে দেশাত্ববোধের প্রসঙ্গগুলো) বইটি নির্বাচন করল।
মহান আল্লাহর আনুগ্রহে আমি মুক্তি লাভ করার পর উস্তাদ ফাতহি রিদওয়ানের নিকট তার অফিসে গেলাম, তার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশের জন্য। তিনি সম্মান ও আতিথেয়তার মাধ্যমে আমাকে অভ্যর্থনা জানালেন। আমাকে বললেন: আমি তার নিকট যে হাদিয়া পেশ করেছি, তিনি তার কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছেন এবং তিনি শুধু আমার কৃতজ্ঞতা ও অনুগ্রহবোধকেই তার জন্য অনেক মূল্যবান মনে করেন আর প্রকৃতপক্ষে তিনিই নাকি আমাদের নিকট কৃতজ্ঞতা প্রকাশের উপযুক্ত। কারণ সাদাত তোরা অভ্যর্থনা কারাগার প্রস্তুত করেছিল তার প্রতিদ্বন্দ্বীদের জন্য। সে নিয়ত করেছিল তাদেরকে সেখানে আটকে রাখবে, কখনো তাদেরকে সেখান থেকে ছাড়বে না। কিন্তু তোমরাই (অথাৎ তিনি বুঝাচ্ছিলেন: খালিদ আল-ইসলামবুলি রহ., তার সাথীগণ ও মুজাহিদ যুবকগণই) আমাদেরকে কারাগার থেকে মুক্ত করেছ।
আমি এই ঝানু বিরোধি রাজনীতিকের এমন গভীর উপলব্ধিতে খুব প্রভাবিত হলাম এবং খুব পরিতাপের সাথে তাকে বিভিন্ন ইসলামী আন্দোলনের ওই সকল নেতৃবৃন্দের সঙ্গে তুলনা করলাম, যাদেরকে খালিদ আল ইসলামবুলি রহ. ও তার সাথীগণ কারাগার থেকে মুক্ত করলেন। কিন্তু তারপর তারা দাবি করলেন, সাদাতকে হত্যা করা একটি অপরাধ ছিল এবং সাদাত শহীদ হয়ে মারা গেছে!
আর এখন তাকে ঐ সকল লোকদের সাথেও তুলনা করি, যারা সরকার থেকে মুক্তি লাভের জন্য সাদাত হত্যার ব্যাপারে দুঃখ প্রকাশ করার উদ্যোগ নিচ্ছে।
Comment