তৃতীয় অধ্যায়:
ময়দানে প্রত্যাবর্তন
প্রথম পরিচ্ছেদ
আফগানিস্তান- হিজরত ও প্রশিক্ষণ
ময়দানে প্রত্যাবর্তন
প্রথম পরিচ্ছেদ
আফগানিস্তান- হিজরত ও প্রশিক্ষণ
ثُمَّ إِنَّ رَبَّكَ لِلَّذِينَ هَاجَرُواْ مِن بَعْدِ مَا فُتِنُواْ ثُمَّ جَاهَدُواْ وَصَبَرُواْ إِنَّ رَبَّكَ مِن بَعْدِهَا لَغَفُورٌ رَّحِيمٌ
“যারা ফিতনায় আক্রান্ত হওয়ার পর হিজরত করেছে, তারপর জিহাদ করেছে ও সবর অবলম্বন করেছে, তোমার প্রতিপালক এ সব বিষয়ের পর অবশ্যই অতি ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।” (সূরা নাহল: ১১০)১- মহান আল্লাহ কারাগার থেকে মুক্তি দিয়ে অনুগ্রহ করার পর, তারই শক্তি ও সাহায্যে আমার সর্বপ্রথম চিন্তা ছিল মিশর থেকে বের হয়ে যাওয়া এবং ইসাম আল কামারিরর সাথে যৌথভাবে যে পরিকল্পনাগুলো করেছিলাম, তারই ভিত্তিতে জিহাদি কর্মকাণ্ডের জন্য সরকারের নাগালের বাইরে একটি ঘাটি প্রতিষ্ঠা করা।
এর প্রয়োজনীয়তা আরো তীব্রতর হল, যখন সরকার আমাকে দু’ধরণের নজরদারির মধ্যে রাখল। একটি প্রকাশ্য। যেটা হচ্ছে বাধ্যতামূলক নজরদারি, যা সাধারণ পুলিশরা দেখাশোনা করে। আর অপরটি গোপন, যা রাষ্ট্রীয় গোয়েন্দা বাহিনী দেখাশোনা করে। আমার নিকট এর একেবারে সুস্পষ্ট অর্থ ছিল, যেকোন গ্রেফতার অভিযানে আমি থাকব গ্রেফতার তালিকার শীর্ষে। এ নজরদারি হল, গ্রেফতারের সিদ্ধান্ত প্রকাশিত হওয়ার সাথে সাথে গ্রেফতারি নিশ্চিত করার একটি মাধ্যম।
এ নিয়ম মেনে চলার অর্থ হল, হয়ত আমি জিহাদি কাজ সম্পূর্ণরূপে ছেড়ে দিব, যাতে সরকার তার নজরদারি ও তদন্তের মাধ্যমে নিশ্চিত হতে পারে যে, আমি জিহাদ থেকে ফিরে এসেছি, মুখ ফিরিয়ে নিয়েছি। অথবা আমি ও আমার সাথীগণ যা কিছু গড়বো, প্রতিটি গ্রেফতার অভিযানের সাথে সাথে তা বিনাশ হয়ে যাবে। তারপর আসবে আদালতে শুনানির পালা, তারপর কারাদণ্ড, তারপর চলতে থাকবে চিরাচরিত ঘটনাগুলো।
আর যদি আমি এ নিয়ম মেনে চলা প্রত্যাখ্যান করি এবং জিহাদি কাজ চালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেই, তাহলে আমার সামনে দু’টি পথের যেকোন একটি পথই খোলা আছে। প্রথমটি হল, আমি আত্মগোপনে চলে যাব এবং মাটির নিচে জীবন যাপন করব। এটা নিরাপত্তা বাহিনীকে ভীষণ অস্থির করে তোলবে এবং তাদেরকে ব্যাপক তল্লাশী অভিযান পরিচালনা করতে বাধ্য করবে। যা কখনো আমার সাথে সম্পৃক্ত প্রতিটি ব্যক্তিকে গ্রেফতার করা এবং প্রয়োজনে তাদেরকে শাস্তি দেওয়া পর্যন্ত গড়াবে। যাতে আমাকে গ্রেফতার করতে পারে, এমনকি যদি আমি কোন কিছু নাও করি। অপরদিকে আমি সদ্য মুক্তিপ্রাপ্ত হওয়ার কারণে আত্মগোপনের পর্যাপ্ত উপায়ও নেই। আর দ্বিতীয় পথ, যেটা যৌক্তক সমাধান, তা হল: সমস্ত নবী-রাসুল ও পুণ্যবানদের পথ: আল্লাহর পথে হিজরত।
২- আমি পাকিস্তান অভিমুখে সফর করার সংকল্প করলাম। কিন্তু তার প্রায় ছ’মাস পর যখন মহান আল্লাহ তাআলা গোয়েন্দাদের আরোপিত ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞার অবরোধ থেকে বের হওয়া সহজ করে দিলেন, তখন মিশর ত্যাগ করতে সক্ষম হলাম। অতঃপর জেদ্দা গেলাম। সেখানে কাজের বিশেষ কিছু পরিস্থিতি কাভার করতে গিয়ে এক বছর থাকতে বাধ্য হলাম। সেখান থেকে পাকিস্তানের উদ্দেশ্যে সফর করলাম।
৩- ১৯৮০ এর গ্রীষ্মে কুদরতীভাবে আফগানিস্তানের সাথে আমার যোগাযোগ শুরু হয়। ওই সময় আমি ইসলামী চিকিৎসা সংস্থার অধীনস্ত সাইয়িদা যায়নাব ক্লিনিকে আমার এক সহকর্মীর স্থলে সাময়িকভাবে কর্তব্যরত ছিলাম। সাইয়িদা যায়নাব ছিলেন ইখওয়ানুল মুসলিমীনের একজন উদ্যমী কর্মী। এক রাতে ক্লিনিকের পরিচালক, যিনি ইখওয়ানের একজন সদস্য- আমার সাথে কথা বলে আফগান মুহাজিরদের চিকিৎসা সহযোগীতার কাজে পাকিস্তান সফরের ব্যাপারে আমার মতামত জানতে চাইলেন। আমি তৎক্ষণাৎ সম্মত হয়ে গেলাম। কারণ এ উপলক্ষে জিহাদী ময়দানগুলোর মধ্য থেকে অন্যতম একটি ময়দানের ব্যাপারে জানার সুবর্ণ সুযোগ পেয়ে গেলাম, যেটা মিশরে ও ইসলামী বিশ্বের হৃদপিণ্ড আরব বিশ্বে জিহাদের জন্য একটি ঘাটি বা সূতিকাগার হতে পারে। যেখানে মুসলমানদের মাঝে ও নব্য ক্রুসেডের প্রধান আমেরিকা, ইহুদী এবং তাদের রাজনীতি কার্যকরকারী আরব শাসকদের মাঝে ইসলামের রাজনৈতিক যুদ্ধ চলছে।
৪- শ্বাসরুদ্ধকর নিরাপত্তা বেষ্টিত সরক এবং এককেন্দ্রিক শাসনব্যবস্থার অধিকারী মিশরের ভিতরে যেসকল জিহাদী আন্দোলনগুলো যুদ্ধে জড়িয়েছে, তাদের দূরাবস্থা এবং সহজে নিয়ন্ত্রণ করার মত ভৌগলিক প্রকৃতির বিষয়গুলো লক্ষ্য করে মিশরের জিহাদী কর্মকাণ্ডের একটি ঘাটি আবিস্কার করার জটিল চিন্তা সর্বদা আমার মনকে ব্যস্ত রাখত। কারণ মিশর, বিস্তৃত দুই মরূভূমির মধ্যবর্তী সংকীর্ণ উপত্যকা, যার মাঝ দিয়ে প্রবাহিত হয়ে গেছে নীল নদ। আর তাতে নেই কৃষিক্ষেত বা পানি।
এ সকল প্রাকৃতিক পরিবেশই মিশরে গেরিলাযুদ্ধের উত্থানকে অসম্ভব করে তুলেছে। ফলশ্রুতিতে এর নাগরিকদের জন্য কেন্দ্রীয় সরকারের আনুগত্য করা আবধারিত হয়ে গেছে। ফলে সরকার সেঁচ নিয়ন্ত্রণ, জোরপূর্বক শ্রম ও সেনা নিয়োগ থেকে শুরু করে প্রতিটি অবাধ্য নড়াচড়া নির্মূল করার সুযোগ পাচ্ছে।
এ জাতির ইতিহাসে স্বৈরাচারী শাসকের জুলুম থেকে বের হওয়ার প্রতিটি চেষ্টাই একেকটি এমন পানির ছিদ্রের ন্যায় হয়েছে, যা একটি থেকে আরেকটি যথেষ্ট দূরত্বে অবস্থিত এবং এমন নির্বাপিত অঙ্গারের ন্যায় হয়েছে, যা যেকোন সময় কয়লাসহ দূরে নিক্ষেপিত হতে পারে। অথবা সেই ভূমিকম্পের ন্যায়, যার ব্যাপারে কেউ জানে না, কখন তার আঘাতে উপরস্থ সবকিছু নিয়ে ভূমি কেঁপে উঠতে পারে।
একারণে মিশরের সমসাময়িক ইসলামী আন্দোলনের ইতিহাস চল্লিশের দশক থেকে নিয়ে আজ পর্যন্ত একের পর এক নির্মূল অভিযানের ইতিহাসে পরিণত হওয়া বিরল কিছু নয়।
এজন্য আগফান মুহাজিরীনের চিকিৎসা কাজে অংশ গ্রহণের এ দাওয়াত আমার জন্য ভাগ্যের ফায়াসালা হিসাবে আবির্ভূত হয়। তাই আমি মিশরে জিহাদী কর্মকাণ্ড অব্যাহত রাখার জন্য একটি নিরাপদ ঘাটি প্রতিষ্ঠার উপযুক্ত ময়দান খোঁজার নিমিত্তে আন্তরিক আগ্রহ নিয়ে সম্মত হয়ে গেলাম। বিশেষ করে আনওয়ার সাদাতের শাসনামলে, যখন নব্য ক্রুসেডীয় আক্রমণের নিদর্শনগুলো প্রত্যেক জ্ঞানীর নিকট স্পষ্ট ছিল এবং উম্মাহর ব্যাপারে চিন্তাশীল প্রত্যেকের সামনে প্রকাশ্য ছিল, তখন এর প্রয়োজনীয়তা আরো বেশি অনুভব করি।
৫- কথামতই আমি একজন অ্যানেশেসিয়া বিশেষজ্ঞ সহকর্মীর সঙ্গে পাকিস্তানের পেশওয়ার শহরে সফর করি। তারপর অনতিবিলম্বেই আমাদের সঙ্গে আরেকজন প্লাস্টিক সার্জারী বিশেষজ্ঞ সহকর্মী এসে যুক্ত হন। আমরা তিন জনই ছিলাম প্রথম আরব সদস্য, যারা আফগান মুহাজিরদের ত্রাণকার্যের জন্য সেখানে পৌঁছেছি।
আমাদের পূর্বে পেশোয়ারে পৌঁছেছিলেন উস্তাদ কামাল আস-সানানিরী রহ.। আমরা যেখানে যেতাম সেখানেই তিনি তার নিরবতার দ্বারা আমাদের উপর অগ্রগামী হয়ে যেতেন। আমরা যে হাসপাতালে কাজ শুরু করলাম, তিনিই ছিলেন তার প্রথম প্রতিষ্ঠাতা। আমরা যেসকল মুজাহিদ নেতৃবৃন্দের সঙ্গে সাক্ষাত করতাম, তারাই আমাদেরকে তার সহযোগীতার কথা ও তাদের মাঝে ঐক্য প্রতিষ্ঠায় তার চেষ্টার কথা জানাত।
কামাল আস-সানানিরী রহ. এর সঙ্গে যদিও আমার সাক্ষাত হয়নি, তবে তার কার্যাবলী ও উদ্যমতার নিদর্শনগুলোই আল্লাহর পথে তার বিসর্জন ও আত্মত্যাগ প্রমাণ করে।
৬- একারণে সেপ্টেম্বর ১৯৮১ এর নিরাপত্তা আইনসমূহের মাধ্যমে যে গ্রেফতার অভিযান শুরু হয়েছিল তার ধারাবাহিকতায় কামাল আস-সানানিরী রহ. নিহত হওয়া কোন অস্বাভাবিক ছিল না। কামাল আস-সানানিরী রহ.কে নির্যাতনের মাধ্যমে হত্যা করা হয়। যার দায়িত্ব পালন করেছিল স্বরাষ্ট্রীয় তদন্তবিভাগের প্রধান ও পরবর্তীতে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হাসান আবু পাশা। কামাল আস-সানানিরীর হত্যার কাহিনীটি বর্ণনা করার জন্য অবশ্যই কিছু সময় বিরতি নেওয়া প্রয়োজন।
১৯৮১ সালের সেপ্টেম্বরে কামাল আস-সানানিরীকে গ্রেফতার করা হয়। ১৯৮১ সালের অক্টোবরে আনওয়ার সাদাত হত্যার পর সরকার উপলব্ধি করে যে, তার নিরাপত্তা বাহিনী, তথা স্বরাষ্ট্রীয় গোয়েন্দা বিভাগ, সামরিক গোয়েন্দা বিভাগ ও সাধারণ গোয়েন্দা বিভাগই হল তার সর্বশেষ ভরসা, যাদের মাধ্যমে জানা যাবে যে, মিশরে কী পরিমাণ সুপ্ত ক্রোধ ও ক্রমবর্ধমান বিদ্রোহ চলছে।
মিশরের ঘটনাবলীর ব্যাপারে রাষ্ট্রীয় গোয়েন্দা বিভাগের অজ্ঞতা এ পর্যায়ে পৌঁছেছিল যে, তারা আনওয়ার সাদাতকে আশ্বস্ত করেছিল যে, ১৯৮১ সালের সেপ্টেম্বরে বিরোধীদের উপর যে গ্রেফতার অভিযান পরিচালিত হয়েছে, তা দেশকে সাধারণভাবে যেকোন রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা ও বিশেষ করে ইসলামিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা থেকে নিরাপদ করে ফেলেছে।
একারণে গোয়েন্দা বিভাগ ইখওয়ানুল মুসলিমীনকে সমঝোতাবাদি হিসাবে আশ্বস্ত থাকা সত্ত্বেও নতুন করে তাদের বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু করে দেয়। দ্বিতীয় ও তৃতীয় শ্রেণীর গ্রুপটিকে তদন্ত করার প্রতি বেশি গুরুত্বারোপ করে, যাদের মধ্যে উস্তাদ কামাল আস-সানানিরী রহ. একাধিক দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ ছিলেন। তন্মধ্যে একটি হল: প্রধান দিকনির্দেশক ওমর আত-তালমাসানী এত দুর্বল ছিলেন যে, তার কোন শাস্তি সহ্য করার ক্ষমতা ছিল না। উপরন্তু ইখওয়ানের প্রধান দিকনির্দেশক হিসাবে তার যে তাৎপর্যপূর্ণ অবস্থা ছিল, এটা সরকারকে বিভিন্ন জটিলতায় ফেলতে পারত। আবার সরকার জানত যে, সকল কিছুর চাবি এবং ইখওয়ানের সকল কর্মকাণ্ডের বিস্তারিত অবস্থা উমর আত-তালমাসানীর হাতে ছিল না।
আরেকটি ব্যাপার হল, মিশরের ইখওয়ানের মাঝে আর বহির্দেশীয় সংগঠনগুলোর সাথে সংযোগ সৃষ্টি করার ক্ষেত্রে কামাল আস-সানানিরী রহ. গুরুদায়িত্ব পালন করতেন এবং এ লক্ষ্যে তিনি বারবার সফর করতেন। তিনি আফগানিস্তান ইস্যুর সাথে জড়িত হন, আফগান জিহাদের সহযোগীতায় অগ্রপথিকের ভূমিকা পালন করেন এবং আফগানের নেতৃবৃন্দের সঙ্গে যোগাযোগ সৃষ্টি করেন। আর ইখওয়ানুল মুসলিমীনের ভিতরে কামাল আস-সানানিরীর প্রভাবশালী অবস্থানও অন্যতম একটি কারণ।
এখানে উল্লেখ্য যে, ইখওয়ানুল মুসলিমীনের গঠন প্রক্রিয়া ছিল আশ্চর্য ধরণের গঠন প্রক্রিয়া। সাধারণ মানুষ ও সরকারের সামনে প্রকাশ্য নেতৃত্ব দিত প্রধান দিকনির্দেশক ওমর আত-তালমাসানী। কিন্তু প্রকৃত নেতৃত্ব মুস্তফা মাশহুর, ডক্টর আহমাদ আল-মালাত রহ. ও উস্তাদ কামাল আস-সানানিরী রহ. এর মত বিশেষ একটি গ্রুপের হাতে ছিল। একারণেই রাষ্ট্রীয় গোয়েন্দা বিভাগ এ ব্যাপারে আশ্বস্ত হয়েছিল যে, যদি ইখওয়ানুল মুসলিমীনের কোন গোপন সংগঠন থাকে, তাহলে সে গোপন ভেদ কামাল আস-সানানিরী রহ. এর নিকট থাকবে।
কামাল আস-সানানিরীর সঙ্গে নির্মম তদন্ত কার্য শুরু হল। ডক্টর আব্দুল মুনঈম আবুল ফুতুহ, যিনি কায়রোর চিকিৎসা কলেজে আমার সহকর্মী ছিলেন, তিনি ও আমি দূর্গের কারাগারে সেলের জানালা দিয়ে পরস্পর কথা বলার সময় তিনি আমার নিকট বর্ণনা করেছেন, কিভাবে উস্তাদ কামাল আস-সানানিরী রহ.কে তোরা অভ্যর্থনা কারাগারের এক সেলে তার সাথীদের মধ্য হতে (যাদের মাঝে আব্দুল মুনঈমও একজন) তুলে নিয়ে যাওয়া হয়। তিনি চাদর ও আবা পরিধান করতেন। এরপর আব্দুল মুনঈম আবুল ফুতুহ তাকে আর দেখেননি। একমাত্র প্রসিকিউটরের সমাজতান্ত্রিক ভবনেই দেখেছিলেন। যেখানে তার দেহ রোগে ফুলা ছিল। তার উপর ভীষণ নির্যাতনের চিহ্নগুলো প্রকাশ পাচ্ছিল। তিনি তাদের লক্ষ্য করে বলেন: তিনি এমন নির্যাতনের সম্মুখীন হয়েছেন, যা আব্দুন নাসেরের শাসনামলে অন্য কেউ সম্মুখীন হয়নি। তারপর এ নির্যাতনের কথা সমাজতান্ত্রিক প্রসিকিউটরের অনুগত তদন্তকারীর সামনে উল্লেখ করেন।
এর কিছুদিন পরই একজন দায়িত্বশীল কারাগারে আব্দুল মুনঈম আবুল ফুতুহকে সংবাদ জানায় যে, তাদের একজন ভাইকে আজ নির্যাতনের মাধ্যমে হত্যা করা হয়েছে। পরবর্তীতে তার নিকট স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল যে, এ হলেন উস্তাদ কামাল আস-সানানিরী রহ.।
যেমন উস্তাদ হামিদ আল আদাবি রহ., যিনি উস্তাদ কামাল আস-সানানিরীকে জীবনের সর্বশেষ রাতে নির্যাতনের সময় তার নিকট উপস্থিত ছিলেন, তিনি আমার নিকট বর্ণনা করেন: হাসান আবু পাশা তাকে ভীষণ নির্যাতন করছিল আর বারংবার জিজ্ঞেস করছিল: গোপন দিকনির্দেশক কে?? উস্তাদ কামাল আস-সানানিরী রহ. প্রচণ্ড ধরা গলায় উত্তর দিতেন: কোন গোপন দিকনির্দেশক নেই।
এমনিভাবে ভাই তালআত ফুআদ কাসিম, যিনি তোরা অভ্যর্থনা কারাগারে সানানিরীর পাশের সেলে অবস্থান করছিলেন, তিনি আমাকে জানান যে, এক রাতে তিনি শোরগোল শুনতে পেলেন। তাই সেলে দরজার উপরের ছিদ্র দিয়ে দেখার জন্য দরজার উপর চড়লেন। তখন তিনি দেখলেন তোরা অভ্যর্থনা কারগারের অফিসার কর্ণেল মুহসিন আস-সারসাবি খুব অস্থিরতা ও উদ্বেগের সাথে বলছে: শহিদের সেল কোনটি? সকলে তালআত ফুআদের সেলের পার্শ্বস্থ কামাল আস-সানানিরীর সেলটি খুলে দিল এবং সেখানেই মৃতদেহটি ঢোকাল।
এ বর্ণনা প্রমাণ করছে যে, উস্তাদ কামাল আস-সানানিরী রহ.কে সেলের বাইরে হত্যা করা হয়েছে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয়ের বিবৃতিতে যেমনটা দাবি করা হয়েছে তেমনটা নয়।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ঘোষণা দেয়: তিনি যে দড়ি জাতীয় পোষাক পরিধান করতেন, সে দড়ির মাধ্যমে তার সেলে অবস্থিত ড্রেনের পাইপের সাথে গলায় ফাঁস লাগিয়ে আত্মহত্যা করেছেন। আর সেলের দেয়ালে লিখে গেছেন: আমি আমার ভাইদের রক্ষা করার জন্য আত্মহত্যা করলাম।
ইখওয়ানুল মুসলিমিনের এ ব্যাপারটি খুবই আশ্চর্যজনক যে, তারা এ সব প্রসিদ্ধ বাস্তব ঘটনাগুলো নিশ্চিতভাবে বিশ্বাস করা সত্ত্বেও সানানিরীর রক্তের কিসাসের জন্য একটুও জেগে উঠেনি আর কখনো জাগবে বলেও মনে হয় না। অথচ তারা তার হত্যার বিস্তারিত ঘটনাবলী জানে। এমনকি অন্তত তার হত্যার জন্য দায়িত্বশীলদের বিরুদ্ধে বিচারের দাবি উত্থাপন করার কাজটুকুও করেনি। অথচ ওই সকল দায়িত্বশীলরা জানাশোনা। তাদের বিরুদ্ধে ঘটনা প্রমাণিত করাও সহজ। কারণ কামাল আস-সানানিরী রহ. নিজ পায়ে কারাগারে প্রবেশ করেছেন। আর নিথর মৃত দেহ হয়ে বের হন। সুতরাং কারা অফিসার, কারা কর্তৃপক্ষ ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ঘটনার জন্য দায়ী। আর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয় যে মিথ্যা ঘটনা আবিস্কার করেছে, লাশের শারিরিক অবস্থাই তার বিরুদ্ধে সুস্পষ্ট জবাব দেয়।
আমরা আল্লাহর নিকট প্রার্থনা করি, তিনি আমাদেরকে আমেরিকা, ইহুদী এবং তাদের মিত্র ও কর্মচারিদের থেকে তার ও প্রতিটি মুসলিম শহিদের রক্তের প্রতিশোধ গ্রহণ করার তাওফিক দান করুন।
৭- আফগান জিহাদি রণাঙ্গনের অভিজ্ঞতার মাধ্যমে ১৯৮০ সালে আমার নিকট এ ময়দানের সুদূর প্রসারী ফলাফল এবং এটা গোটা মুসলিম উম্মাহকে, বিশেষত: জিহাদী সংগঠনগুলোকে কতটা উপকৃত করতে পারে তা স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল। তাই আমি এ ময়দান থেকে উপকৃত হওয়ার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করলাম। একারণে প্রথমবার সেখানে প্রায় চার মাস থাকার পর ১৯৮১ এর মার্চে দ্বিতীয়বার ফিরে আসলাম এবং প্রায় দু’মাস থাকলাম। অতঃপর মিশরের প্রতিকূল পরিস্থিতির কারণে পুনরায় সেখানে ফিরে যেতে বাধ্য হলাম।
অতঃপর আল্লাহর ইচ্ছায় (নিশ্চয়ই আমার সুখে দুখে সর্বদাই তিনি প্রশংসিত) আমি তিন বছর মিশরের কারাগারে কাটাই, যা ১৯৮৪ এর শেষের দিকে সমাপ্ত হয়। কিন্তু আমার ব্যক্তিগত বিশেষ কিছু পরিস্থিতির কারণে পুনায় আফগান জিহাদের ময়দানে ফিরতে ১৯৮৬ এর মাঝামাঝি হয়ে গেল।
এ ময়দানের কর্মীদের সঙ্গে চলাফেরা ও কাজ-কর্ম করার মাধ্যমে আমার সামনে কয়েকটি নিগূঢ় বাস্তবতা খুব গুরুত্বের সাথে স্পষ্ট হয়েছে, যা এখানে লিপিবদ্ধ না করলেই নয়:
ক- জিহাদী আন্দোলনের জন্য এমন একটি জিহাদী ময়দান প্রয়োজন, যেটা তার জন্য ইনকিউবেটর হিসাবে কাজ করবে, যেখান থেকে অঙ্কুরিত বীজ বেড়ে উঠে। সেখান থেকে তারা সামরিক, রাজনৈতিক ও সাংগঠনিক ও কর্মগত অভিজ্ঞতা অর্জন করবে। যেমন ভাই শহীদ আবু উবাইদাহ পানশিরী রহ. বলেছেন: “আফগানিস্তানে এসে আমার বয়স এক শ’ বছর বৃদ্ধি পেয়েছে।”
খ- আফগানিস্তানের মুসলিম যুবকরা একটি বিশুদ্ধ ইসলামী চেতনার অধীনে মুসলিম দেশকে স্বাধীন করার লড়াইয়ে জড়িয়েছে। এটা অত্যন্ত মর্যাদাপূর্ণ বিষয়। কারণ আমাদের মুসলিম বিশ্বে চলমান অনেক স্বাধীনতা যুদ্ধেই ইসলামের সাথে বিভিন্ন দেশীয় জাতীয়তাবাদী চেতনার সংমিশ্রণ ঘটেছে। এমনকি কখনো কখনো বাম ও সাম্যবাদী চেতনাও যুক্ত হয়েছে। যা মুসলিম যুবকদের সামনে ইসলামী জিহাদী আকিদার মাঝে- যা একমাত্র আল্লাহর আনুগত্যের ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত হওয়া আবশ্যক- আর তার বাস্তব প্রয়োগের মাঝে ব্যবধান সৃষ্টি করে দিয়েছে।
ফিলিস্তীনের ঘটনা এর সর্বোত্তম দৃষ্টান্ত। যেখানে ফিলিস্তীনকে মুক্ত করার জন্য শয়তানের সাথে মিত্রতার স্লোগানের অধীনে বিভিন্ন রকম বিশ্বাস ও চেতনা সংমিশ্রিত হয়েছে। তারা শয়তানের সাথে মিত্রতা করেছে। ফলে ফিলিস্তীনকে মুক্ত করতে পারেনি, বরং তার সিংহভাগই ইসরাঈলের কাছে বিক্রি করে দিয়েছে।
গ- দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল: যে সকল যুদ্ধগুলোতে অনৈসলামিক চেতনা বা সংমিশ্রিত চেতনা প্রাধান্য বিস্তার করে আছে, এগুলো মুসলিম যুবকদের দৃষ্টি থেকে শত্রু-বন্ধু ব্যবধানকারী সীমা মুছে দিয়েছে। ফলে শত্রুর ব্যাপারেই সন্দেহ সৃষ্টি হয়ে গেছে: সে কি মুসলিম ভূমি জবরদখলকারী বহি:শত্রু, নাকি এমন অভ্যন্তরীণ শত্রু, যে ইসলামী শাসন নিষিদ্ধ করেছে, মুসলমানদের উপর আক্রমণ করছে এবং প্রগতি, স্বাধীনতা, জাতীয়তা ও মুক্তচিন্তার স্লোগানের আড়ালে পাপাচার ও লাগামহীনতা বিস্তার করছে, দেশকে বহি:শত্রুর নিকট আত্মসমর্পণকারী বানাচ্ছে ও আভ্যন্তরীণভাবে ধ্বংসের অতল গহ্বরে নিয়ে যাচ্ছে? যেটা নতুন বিশ্বব্যবস্থায় আমাদের অধিকাংশ দেশগুলোর বাস্তব অবস্থা।
ঘ- পক্ষান্তরে আফগানিস্তানে সবগুলো ছবি একেবারে স্পষ্ট ছিল: মুসলিম জনগণ ইসলামের পতাকাতলে জিহাদ করছেন। আর আগ্রাসী কাফের বহি:শত্রুকে অভ্যন্তরীণ পথভ্রষ্ট মুরতাদ সরকার সহযোগীতা করছে। এজন্য সেখানে বাস্তবতার সাথে থিওরীর সামঞ্জস্যতা একেবারে পরিস্কার ও স্পষ্ট ছিল।
এ পরিস্কার অবস্থা জিহাদের ময়দান থেকে পলায়নকারী অনেক ইসলামিক নেতাদের সংশয় অপনোদনে অবদান রেখেছে, যারা এমন ময়দান অনুপস্থিত থাকার অজুহাত দিত, যেখানে মুসলমান ও তাদের শত্রুকে আলাদাভাবে শনাক্ত করা যায়।
ঙ- এমনিভাবে আফগানিস্তানের ময়দান, বিশেষ করে রাশিয়ার প্রস্থানের পর- ওই সকল শাসকের বিরুদ্ধে জিহাদ করার বাস্তব নমুনা হয়েছে, যারা ইসলাম থেকে বের হয়ে গেছে এবং ইসলামের বহি:শত্রুদের সাথে মিত্রতা করেছে। কারণ আফগানিস্তানের নজিবুল্লাহ আমাদের শাসকদের স্থায়ী নমুনা ছিল। সে নামায পড়ত, রোজা রাখত, হজ্জ করত, আবার একই সময়ে ইসলামী শাসন প্রত্যাখ্যান করত, ইসলামের শত্রুদের সাথে মিত্রতা করত, তাদেরকে মুসলিম দেশে প্রবেশ করাত এবং মুসলিম মুজাহিদগণকে শাস্তি দিত। তাই যখন নজিবুল্লাহ ও তার সরকারের বিরুদ্ধে জিহাদ ফরজে আইন, তখন তার অনুরূপ সকল শাসকদের বিরদ্ধেও জিহাদ অনুরূপ ফরজে আইন।
চ- এমনিভাবে আফগানিস্তানের জিহাদের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ অবদান হল, তা মুসলিম মুজাহিদ যুবকদের অন্তর থেকে পরাশক্তির কল্প-কাহিনী দূর করে দিয়েছে। কারণ মুসলিম যুবকদের চোখের সামনে এবং তাদেরই অংশগ্রহণে বিশ্বের সর্ববৃহৎ স্থল শক্তির অধিকারী পরাশক্তি সেভিয়েত ইউনিয়ন আফগানিস্তানে চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে গেছে, পৃষ্ঠপ্রদর্শন করে পালিয়েছে।
সুতরাং এ জিহাদ মুসলিম মুজাহিদ যুবকদেরকে আরেক পরাশক্তি আমেরিকার বিরুদ্ধে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত করার গুরুত্বপূর্ণ প্রশিক্ষণ কোর্স হিসাবে কাজ করেছে, যে পরাশক্তি বর্তমানে এককভাবে বিশ্বের নেতৃত্ব দিচ্ছে।
ছ- অনুরূপ, আরব, পাকিস্তান, তুরস্ক, মধ্য ও পূর্ব এশিয়া এবং অন্যান্য দেশের মুসলিম মুজাহিদ যুবকদের অংশগ্রহণ ইসলামী বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আগত মুসলিম যুবকদেরকে আফগান জিহাদের ময়দানের সাথে পরিচিত হওয়ার সুযোগ করে দিয়েছে এবং ইসলামের শত্রুদের অভিমুখী অস্ত্রের সঙ্গী হওয়ার পাঠ দান করেছে।
এভাবে মুজাহিদ যুবক ও জিহাদী আন্দোলনগুলো পরস্পরের সাথে সুদৃঢ়ভাবে পরিচিত হল, অভিজ্ঞতা বিনিময় করল এবং তাদের ভাইদের সমস্যাগুলো অনুধাবন করল।
জ- আফগান জিহাদের ময়দানে মুসলিম যুবকদের, বিশেষত: আরব মুজাহিদগণের উপস্থিতির গুরুত্ব ছিল এই যে, এটা আফগানিস্তানের ইস্যুকে স্থানীয় ও আঞ্চলিক ইস্যু থেকে বৈশ্বিক ইসলামিক ইস্যুতে রূপান্তর করে দেয়, যাতে সমস্ত উম্মাহ অন্তর্ভূক্ত।
ঝ- আফগানের বাইরের মুজাহিদগণের গুরুত্ব ছিল এই যে, তারা এমন একটি দৃশ্য সৃষ্টি করেছেন, যা দীর্ঘকাল ব্যাপী মুসলিম উম্মাহর মাঝে অনুপস্থিত ছিল। এ সকল যুবক আফগানিস্তান, কাশ্মীর, বসনিয়া, চেচনিয়ায় যুদ্ধ করার মাধ্যমে এমন একটি ফরজ জীবিত করেছেন, যা থেকে দীর্ঘকাল ব্যাপী মুসলিম উম্মাহ বঞ্চিত ছিল।
ঞ- রাশিয়া বিরোধী প্রশিক্ষণ ঘাটি ও সামরিক ফ্রন্টগুলোর সঙ্গে থেকে মুজাহিদ যুবকদের মাঝে ব্যাপক সচেতনতা, ইসলামের বিরুদ্ধে পরিচালিত ষড়যন্ত্রের ব্যাপারে গভীর বুঝ এবং ইসলামের বহি:শত্রু ও তাদের অভ্যন্তরীণ কর্মচারীদের ক্ষেত্রে তাদের শরয়ী কর্তব্য কী তার সুদৃঢ় বুঝ সৃষ্টি হয়।
Comment