তৃতীয় অধ্যায়: ময়দানে প্রত্যাবর্তন- প্রথম পরিচ্ছেদ- আফগানিস্তান- হিজরত ও প্রশিক্ষণ
(পূর্ব প্রকাশের পর)
৮- যখন আমেরিকা পাকিস্তান ও আফগান মুজাহিদ গ্রুপগুলোকে অর্থ ও রসদ দিয়ে সাহায্য করত, তখন আরব মুজাহিদ যুবকদের ক্ষেত্রে আমেরিকার অবস্থা ছিল সম্পূর্ণ বিপরীত।
বরং এ সকল যুবকদের উপস্থিতি, তাদের উন্নতি এবং তাদের সংখ্যাবৃদ্ধি মার্কিন রাজনীতির ব্যর্থতাগুলোর মধ্যে অন্যতম একটি ব্যর্থতা হিসাবে বিবেচিত হয়েছে এবং তার প্রসিদ্ধ নির্বুদ্ধিতার সমসাময়িক দলিল হিসাবে গণ্য হয়েছে। বস্তুত আফগানিস্তানে আরব মুজাহিদগণের অর্থের যোগান হত আফগানিস্তানের জন্য প্রদত্ত মুসলিম জনগণের সাহায্য থেকে। আর এ সাহায্যটা ছোট করে দেখার মত ছিল না।
আরব মুজাহিদগণ শুধু নিজেদের অর্থের যোগান দেওয়ার ভারই বহন করতেন না, বরং তারা আফগান মুজাহিদ ও মুহাজিরদের জন্য প্রদত্ত মুসলমানদের দান-অনুদানগুলোও বহন করতেন।
শায়খ উসামা বিন লাদেন রহ. আমাকে আফগান মুজাহিদগণের জন্য আরব জনগণের সাহায্যের পরিমাণ জানিয়েছেন যে: তার জানামতে তা দশ বছরে শুধু সামরিক খ্যাতেই দু’শো মিলিয়ন ডলারের বেশি। নিশ্চয়ই তিনি উত্তম সাক্ষী। তাহলে সামরিক খ্যাত ছাড়া অন্যান্য খ্যাত- যেমন চিকিৎসা, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, খাদ্য, সামাজিক কর্মকাণ্ড- যেমন ইয়াতিম, বিধবা ও অচলদের খরচ বহন- এগুলোর ক্ষেত্রে কী পরিমাণ হতে পারে?? আর ঈদ, রমজান ও এ জাতীয় মৌসুমগুলোতে যে কী পরিমাণ অনুদান আসত, তা বলাই বাহুল্য।
সরকারি কোন সাহয্য ব্যতিত শুধু জনগণের সাহায্য দ্বারাই আরব মুজাহিদগণ দাওয়াত ও প্রশিক্ষণের মারকাজগুলো প্রতিষ্ঠা করেছেন এবং ওই সকল ফ্রন্টগুলো তৈরী করেছেন, যা হাজার হাজার আরব মুজাহিদগণকে প্রশিক্ষণ ও প্রস্তুত করেছে এবং তাদের জীবিকা, আবাসন, ভ্রমণ ও সংগঠনের ব্যবস্থাপনা করেছে।
আমেরিকা ও তার দোসররা এবং ইসলামী আন্দোলনের শত্রুরা আফগানিস্তানের মুজাহিদগণের ব্যাপারে ‘আমেরিকার সৃষ্টি’ ধারণাটি সাপ্লাই দেওয়ার চেষ্টা করে। যেন মুসলিম উম্মাহর জনসাধারণকে বলতে পারে: এরা যদিও এখন আমেরিকার শত্রু, কিন্তু এরা পূর্বে আমেকিার কর্মী ছিল। তাই তাদের প্রতি আস্থা রেখ না।
আরব ও পশ্চিমা মিডিয়াগুলো এ সকল বহিরাগত যুবকদের ভাবমূর্তি বিকৃত করতে এবং এদেরকে এমন আধা পাগলরূপে চিত্রিত করতে উৎসাহি হয়ে উঠে, যারা পূর্বে আমেরিকা কর্তৃক প্রশিক্ষিত ও অর্থায়নকৃত হওয়ার পর এখন আমেরিকার অবাধ্য হয়ে উঠেছে। এ মিথ্যা অপবাদের বুলি আরো বৃদ্ধি পায়, যখন মুজাহিদ যুবকগণ নব্বয়ের দশকের মাঝামাঝিতে দ্বিতীয়বার আফগানিস্তানে ফিরে যান। বিশেষ করে নাইরোবি ও দারুস সালামে আমেরিকার দু’টি দূতাবাস ধ্বংস করে দেওয়ার পর।
ভাবমূর্তি বিকৃত করার এ হামলার লক্ষ্য সুস্পষ্ট, পরিস্কার। তা হল: আমেরিকা চেয়েছে মুসলিম উম্মাহকে বীরত্বের মর্যাদা থেকে বঞ্চিত করতে। যেন সে মুসলিমদের উদ্দেশ্যে বলতে চেয়েছে: “তোমরা যাদেরকে বাহাদুর ভাবছ, প্রকৃতপক্ষে তারা আমার প্রতিপালিত, আমার বেতনভূক্ত। তাদের সাহায্য বন্ধ করে দেওয়ার কারণে এখন তারা আমার উপর অবাধ্য হয়ে উঠেছে।”
আমেরিকা এই সংশয় প্রচার করার চেষ্টা করেছে, যাতে আরব মুজাহিদগণের হাতে তার পরাজয়ের তিক্ততা একটু হালকা করতে পারে, যা নিউইয়র্ক ও ওয়াশিংটনের অভিযানদ্বয়ের মাধ্যমে সর্বোচ্চ শিখরে পৌঁছেছিল। সেই ব্যক্তির মত, যে মাথায় আঘাত পেয়ে মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলল। অতঃপর দর্শকদের দিকে ঘুরে বলল: যত কিছুই হোক, যে আমাকে আঘাত করল, সে তো আমার শিষ্য, যাকে আমিই প্রশিক্ষণ দিয়েছি। যাতে সে আঘাতপ্রাপ্ত হয়েও নিজের ব্যাপারে কিছুটা গর্ব প্রকাশ করতে পারে। এটি একটি সরল প্রচারণামূলক যুক্তি, যা আমেরিকার সিনেমার ধ্যান-ধারণার সাথে সামঞ্জস্যশীল, যা গো-রক্ষকদের ফিল্মগুলো, রাম্বো এবং আমেরিকান কল্প-কাহিনীর প্রচার-মাধ্যমগুলো রিলিজ দিয়ে থাকে।
আমি আল্লাহকে সাক্ষী রেখে বলছি: আমেরিকা আরব মুজাহিদগণকে এক ডলারও দেয়নি, একটি গুলি দিয়েও তাদের সাহায্য করেনি এবং তাদের কাউকে প্রশিক্ষণ দেয়নি। আমি আমেরিকাকে চ্যালেঞ্জ করছি, তারা এর সামান্য কিছুও প্রমাণ করুক।
কেউ কেউ গাল ভরে যেটা বলে, সৌদি সরকার আফগানিস্তান সফরকারীদেরকে মূল্যছাড়ে টিকেট প্রদান করেছিল- এ টিকেট তো আমেরিকার পক্ষ থেকে ছিল না, বরং আফগানিস্তানের জন্য আরব জনগণ যে অনুদান দিয়েছিল তার কারণে দিয়েছিল। যে অনুদানগুলোর উপর সৌদি সরকার নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে রেখেছিল ‘ইসলামী সাহায্য সংস্থা’, ‘সৌদিয়ান লাল চাঁদ’ ও সালমান বিন আব্দুল আজিজের পরিচালিত ‘কল্যাণ সংস্থা’র মাধ্যমে।
আমি আবারো গুরুত্বের সাথে বলব যে: আরব মুজাহিদগণই তাদের আফগান ভাইদের জন্য জনগণের অনুদানের বিরাট অংশ বহন করেছিল।
আল-জাজিরা চ্যানেলের একটি সাক্ষাৎকারে এই মিথ্যা সম্পর্কেই শায়খ উসামা বিন লাদেন বলেছিলেন:
প্রশ্ন: “আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় সেভিয়েত ইউনিয়নের বিরুদ্ধে আফগান জিহাদে মার্কিন সাহায্যের কথা আলোচিত হয়েছে, যে জিহাদে আপনারা নিজেদের জান-মাল নিয়ে অংশগ্রহণ করেছেন। এমনিভাবে আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় উল্লেখ করা হয়েছে: আমেরিকার সাথে আপনাদের সম্পর্ক আছে বা আমেরিকান গোয়েন্দা সংস্থাই আপনাদের কর্মকাণ্ডে অর্থায়ন করছে এবং এ জিহাদে সহায়ত করছে। এ দাবিগুলোর বাস্তবতা কী? এবং ওই সময় আমেরিকার সাথে আপনাদের সম্পর্ক থাকার কথাটি কতটুকু সঠিক?”
উসামা:
“এটা আমেরিকার পক্ষ থেকে বিকৃতির চেষ্টা। সমস্ত প্রশংসা সেই আল্লাহর জন্য, যিনি তাদের চক্রান্তকে কুমন্ত্রণায় পর্যবসিত করেছেন। যত মুসলিম ভাল-মন্দ নির্ণয় করতে পারে এবং তার অন্তরে আমেরিকার প্রতি ঘৃণা আছে, ইহুদি ও নাসারাদের প্রতি ঘৃণা আছে, তা তো আমাদেরই আকিদার অংশ এবং আমাদের দ্বীনের অংশ। যখন থেকে আমি নিজের ব্যাপারে বুঝমান হয়েছি, তখন থেকেই আমি আমেরিকার বিরুদ্ধে যুদ্ধ, শত্রুতা, ঘৃণা ও বিদ্বেষ লালন করছি। তারা এসব যা বলছে, তা কখনো ঘটেনি।
আর তারা যে জিহাদে সাহায্য করা বা যুদ্ধে সাপোর্ট করার কথা বলেছে, সেটা যখন আমাদের নিকট স্পষ্ট হল, তখন দেখলাম প্রকৃতপক্ষে সেটা ছিল আরব রাষ্ট্রগুলোর পক্ষ থেকে, বিশেষ করে উপসাগরীয় রাষ্টগুলোর পক্ষ থেকে পাকিস্তানের জন্য প্রেরিত সাহায্য, যাতে পাকিস্তান জিহাদে সহায়তা করতে পারে। তবে সেটা আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতাআলার সন্তুষ্টির জন্য ছিল না, বরং রাশিয়ান হামলা থেকে নিজেদের গদি রক্ষার জন্য ছিল।
সে সময় আমেরিকার প্রেসিডেন্ট কার্টার কোন প্রতিক্রিয়াশীল কথা বলতে পারেনি। অবশেষে ২০ দিনের কিছু বেশি সময় অতিবাহিত হওয়ার পর ১৩৯৯ হিজরী, মোতাবেক জানুয়ারি ১৯৮০ তে সে বলল: রাশিয়ার পক্ষ থেকে উপসাগরীয় অঞ্চলগুলোতে কোন রকম অনুপ্রবেশ ঘটলে আমেরিকা এটাকে আমেরিকার উপর আক্রমণ বলে গণ্য করবে। কারণ সে এই অঞ্চলে কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করে আছে। পেট্টলের জন্য কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করে আছে। তাই সে বলল: যদি এরকম কোন অনুপ্রবেশ ঘটে, তাহলে আমরা সামরিক শক্তি ব্যবহার করব। তাই আমেরিকা যখন দাবি করে, কোন একদিনের জন্যও সে আমাদেরকে সাহায্য করেছে, তখন সে মিথ্যা কথা বলে। আমরা তাকে চ্যালেঞ্জ করছি, কোন একটি দলিলও থাকলে পেশ করুক! বরং আফগানিস্তানে তারা আমাদের উপর ও সমস্ত মুজাহিদীনের উপর নির্ভরশীল ছিল। আর কোন চুক্তি ছিল না। আমরা আফগানিস্তানে ইসলামকে সাহায্য করার জন্য আমাদের কর্তব্য পালন করছিলাম, যদিও এই কর্তব্য পালনটিই আমাদের ইচ্ছা ব্যতিত আমেরিকান স্বার্থের সাথে মিলে গেছে।
যখন মুসলিমগণ রোমানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছিলেন, আমরা জানি যে, তখন রোম ও পারস্যের মাঝে ভীষণ যুদ্ধ চলছিল এবং এটা দীর্ঘস্থায়ী ছিল। তখন কোন বুদ্ধিমানের পক্ষে এটা বলা সম্ভব ছিল না যে, মুসলিমগণ যখন মুতায় রোমানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করেছিলেন, তখন তারা পারস্যের কর্মী বা এজেন্ট ছিলেন। তবে পরস্পরের স্বার্থ মিলে গেছে। অর্থাৎ আপনি রোমানদেরকে হত্যা করেছেন- এটা আপনার দায়িত্ব, কিন্তু এটা পারস্যকেও খুশি করেছে। কিন্তু তারা কয়েকটি অভিযানের পর রোমানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ সমাপ্ত করে পারস্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করে। তাই স্বার্থ মিলে যাওয়া দালালি বুঝায় না। বরং আমরা সেই দিনগুলো থেকেই তাদের সাথে শত্রুতা পোষণ করি। তথা আল্লাহর অনুগ্রহে এর থেকে ১২ বছরেরও অধিক সময় পূর্ব হতে। সেই সময় হতেই আমেরিকান পণ্য বয়কট করার আবশ্যকীয়তা, আমেরিকান সৈন্যদের উপর আঘাত হানার আবশ্যকীয়তা এবং আমেরিকান অর্থনীতির উপর আঘাত হানার আবশ্যকীয়তার ব্যাপারে হিজাজে ও নজদে আমাদের কয়েকটি ভাষণ প্রকাশিত হয়েছে।”
৯- এ অপবাদের পরতে পরতে অনেক স্ব-বিরোধিতা। কেননা যদি আফগানিস্তানের মুজাহিদ যুবকগণ আমেরিকার সৃষ্ট হন, তাহলে আমেরিকা কেন দু’বছর ধরে তাদের ছত্রভঙ্গ করে চলল??
যদি আরব মুজাহিদগণ আমেরিকার বেতনভূক্ত হন, যারা এখন তার উপর অবাধ্য হয়ে উঠেছে, যেমনটা আমেরিকা অপবাদ দিয়ে থাকে..., তাহলে এখন কেন দ্বিতীয়বার তাদেরকে ক্রয় করতে পারছে না??
এখন কি তারা এবং তাদের মধ্যে প্রধানত উসামা বিন লাদেন আমেরিকান স্বার্থের উপর হুমকি সৃষ্টিকারী প্রথম বিপদ নয়?? আমেরিকা তাদের থেকে আত্মরক্ষার জন্য যা খরচ করছে, সেই বিশাল নিরাপত্তা ও প্রতিরক্ষা খরচের তুলনায় তাদেরকে ক্রয় করা অধিক লাভজনক ও কম কষ্টসাধ্য নয় কি??
আমেরিকা তার চিরাচরিত অভ্যাস- বড় করে তোলা, অতিরঞ্জন করা ও প্রসারিত করার নীতির মাধ্যমে সহজ ঘটনার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে মানুষের নিকট চেতনা বিক্রি করতে চায়। যে উসামা বিন লাদেন সৌদি আরবে তার ১৯৮৭ সালের বক্তব্যগুলোতে ফিলিস্তীন আন্দোলনকে শক্তিশালী করার জন্য আমেরিকান পণ্যসামগ্রী বয়কট করা অত্যাবশ্যক বলে ডাক দিয়েছেন, তিনি কি আফগানিস্তানে আমেরিকান কর্মচারী ও দালাল হওয়া সম্ভব??
আমি সেদিনের কথা স্মরণ করি, যেদিন তিনি পেশোয়ারস্থ হেলাল কুয়েতী হাসপাতালে আমাদের সাক্ষাতে এসে এসকল বক্তব্যগুলো সম্পর্কে আলোচনা করেন। আমার মনে পড়ে, আমি তাকে বলেছিলাম: এখন থেকে তো আপনার নিরাপত্তা ব্যবস্থা ও প্রহরা পদ্ধতি পরিবর্তন করা আবশ্যক। কারণ এখন থেকে আপনার মাথা শুধু কমিউনিষ্ট ও রাশিয়ানদের নিকটই নয়, আমেরিকান ও ইহুদীদের নিকটও ওয়ান্টেড হয়ে গেছে। কারণ আপনি এখন সাপের মাথায় আঘাত করছেন।
শহীদ আব্দুল্লাহ আয্যাম কি আমেরিকার দালাল হওয়া সম্ভব?? অথচ তিনি কখনো যুবকদেরকে আমেরিকার বিরুদ্ধে উৎসাহিত করতে এবং হামাসকে সর্বস্ব দিয়ে সাহায্য করতে ক্লান্ত হতেন না। মিশরের জিহাদী আন্দোলন কি আমেরিকার দালাল হওয়া সম্ভব, অথচ খালিদ ইসলামবুলী ও তার সাথীগণ উক্ত অঞ্চলে আমেরিকার প্রথম দালাল আনওয়ার সাদাতকে হত্যা করেছে, যে সময় আফগানিস্তানে আরব মুজাহিদগণের দৃশ্যই ফুটে উঠেনি??
মিশরের জিহাদী আন্দোলন কি আমেরিকার দালাল হওয়া সম্ভব, অথচ এ আন্দোলন তার যুবকদেরকে ইসরাঈল ও তার সাথে অনুষ্ঠিত সকল আত্মসমর্পণমূলক চুক্তি প্রত্যাখ্যান করার শিক্ষা দেয় এবং মনে করে যে, তার সাথে সন্ধি করা ইসলামী শরীয়ার সাথে সাংঘর্ষিক??
আসলে আমেরিকা অবাক হয়ে দেখেছিল যে, আরব মুজাহিদগণ এবং সত্যনিষ্ঠ আফগান মুজাহিদগণ আফগানিস্তানে তার পাতিলের খাবার নষ্ট করে দিল। আমেরিকা চেয়েছিল এটাকে রাশিয়ার বিরুদ্ধে প্রক্সিযুদ্ধ বানাতে, কিন্তু আল্লাহর অনুগ্রহে আরব মুজাহিদগণ এটাকে হারানো ফরজ- তথা জিহাদ ফি সাবিলিল্লাহকে পুনরুজ্জীবিত করার দাওয়াতে রূপান্তর করে দেন।
একারণেই আমেরিকা বসনিয়ায় এ আশঙ্কা সম্পর্কে সতর্ক হয়ে যায়। তাই দায়তুন চুক্তি বাস্তবায়নের পূর্বে প্রথম শর্ত ছিল বসনিয়া থেকে আরব মুজাহিদগণকে বিতাড়িত করা।
এ বিষয়ে ভাই আবু মুসআব আস সুরির অত্যন্ত মূল্যবান একটি বক্তব্য আছে, যাতে তিনি ভবিষ্যত ইতিহাসের জন্য নিজের সাক্ষ্য লিপিবদ্ধ করে রাখেন। তিনি তার ইনসাইক্লোপিডিক বই دعوة المقاومة الإسلامية العالمية (‘আন্তর্জাতিক ইসলামিক প্রতিরোধের দাওয়াত’) এ তা উল্লেখ করেন। আমি পাঠকের উপকারের জন্য তার চুম্বকাংশ তুলে ধরা সঙ্গত মনে করছি:
“আজ খুব বিস্ময়ের ব্যাপার যে, আন্তর্জাতিক ও এরাবিয়ান মিডিয়া প্রোগ্রামগুলো, তথা মুভি, টকশো, সংবাদ বিশ্লেষণ, সংবাদপত্র, বই-পুস্তক ও অন্যান্য সকল প্রচার মাধ্যমগুলো এসব মিথ্যাগুলোর পাশ দিয়ে সম্মানিত ব্যক্তির ন্যায় চলে যায় এবং এই ভেবে এগুলো বাদ দিয়ে অন্যান্য বিষয়ে জড়িয়ে পড়ে যে, এগুলো স্বীকৃত, প্রসিদ্ধ ও অতি স্বাভাবিক বিষয়। ফলে মানুষের সামনে গুরুতর মিথ্যাগুলোকে বাস্তব হিসাবে পেশ করে। সে মিথ্যাগুলোর সারকথা হল:
“আমেরিকান গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ সেভিয়েত ইউনিয়নকে ধ্বংস করার জন্যই আরবীয় আফগান বাহিনী ও শায়খ উসামা বিন লাদেন ও শায়খ আব্দুল্লাহ আয্যামের মত নেতৃবৃন্দকে সৃষ্টি করেছে। আর এই কর্ম তাদের নিজেদের বিরুদ্ধেই ঘুরে গেছে। ফলে তাদের কেউ নিউইয়র্ক ও ওয়াশিংটনে তাদের টাওয়ারগুলো ধ্বংস করে দিয়েছে। আর একই সময়ে তাদের অধিকাংশ নিজ নিজ দেশে ফিরে গেছে তাদের স্বার্থসমূহে আঘাত করা, তাদের প্রজাদেরকে হত্যা করা এবং তাদের বন্ধু আরব ও মুসলিম দেশসমূহের শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য।... আরব দেশের স্বশস্ত্র জিহাদ আফগান জিহাদেরই ফসল এবং সে হিসাবে আমেরিকান গোয়েন্দা সংস্থার সৃষ্টি, যারা এখন লাগাম থেকে বের হয়ে গেছে। আমেরিকার অবস্থা এখন তাদের নিকট প্রসিদ্ধ এই প্রবাদের মত: কে আছে নিজের বিরুদ্ধে বের হওয়ার জন্য ভূত তৈরি করবে?”
এ যুগের জিহাদ ও মুজাহিদীনের সুখ্যাতির জন্য ভয়ংকর এই অপবাদটির বাস্তবতা কী?
আল্লাহর তাওফিকে সামনের সংক্ষিপ্ত পয়েন্টগুলোর মাধ্যমে তা পরিস্কার করে তোলব:
- তাদের বক্তব্য- ‘আরব ও মুসলিম দেশগুলোতে স্বশস্ত্র জিহাদের চিত্রটি মূলত: আফগান জিহাদে আরবীয় আফগানদের জমায়েতেরই ফসল-’এটা বাস্তবতার দিক থেকে পুরো উল্টো। প্রকৃতপক্ষে আফগানিস্তানে আরবদের জিহাদই পূর্বে তাদের আরবে জিহাদের ফল, আরব দেশে এরাবিয়ান জিহাদি আন্দোলনগুলোর ফল, তারই একটি শাখা এবং তার ধারাবাহিক বিকাশ।
যেমন ইতিপূর্বে আলোচিত হয়েছে যে, আধুনিক জিহাদী আন্দোলনগুলো হল ত্রিশের দশকের শুরুভাগে সৃষ্টি হওয়া ইসলামী জাগরণের প্রসূত নবজাতক। ষাটের দশকের শুরুভাগে তা উক্ত ধারা থেকে পৃথক হয়ে যায়। ষাটের দশকের শুরুভাগ থেকে আশির দশকের শুরুভাগের মাঝামাঝি সময়ে অথাৎ আফগান জিহাদের বিশ বছর পূর্বে অনেকগুলো জিহাদী তৎপরতা চলেছে। এমনকি আফগানিস্তানে যত আরব জিহাদী কমান্ডারগণ ও গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিগণ ছিলেন, তারাও আরব জিহাদি আন্দোলনগুলোর বেঁচে যাওয়া শায়খ ও নেতৃবৃন্দই ছিলেন। যেমন শায়খ আব্দুল্লাহ আয্যাম হলেন ফিলিস্তীনের প্রবীণ মুজাহিদগণের মধ্যে একজন শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তি। জর্দান সরকার তার জিহাদী ভাষণ ও সরকারের সাথে প্রতিদ্বন্দ্বিতার কারণে তাকে আম্মান থেকে নির্বাসিত করে। আর শায়খ উসামা বিন লাদেন রহ. তো ইসলামী জাগরণের মাঝেই প্রতিপালিত হন। আরব দেশের বহু জিহাদি আন্দোলনকে সহায়তা করেন এবং আশির দশকের শুরুভাগে আফগানিস্তানে যাওয়ার পূর্বে সিরিয়ান জিহাদের সহায়তা করেন। এমনিভাবে অনেক শীর্ষস্থানীয় নেতা, তথা প্রথম সারির প্রশিক্ষক ও সামরিক কমান্ডারগণ, যাদের প্রত্যেকের নাম গণে গণে উল্লেখ করাও মুশকিল, যারা আফগানিস্তানে আরবীয় জিহাদের জন্য ঘাটি স্থাপন করেছেন এবং সংগঠন তৈরী করেছেন, তারা ছিলেন এরাবিয়ান জিহাদি আন্দোলনগুলোরই শীর্ষস্থানীয় নেতা, বিশেষ করে মিশর, সিরিয়া, লেবানন, ফিলিস্তীন ও অন্যান্য আরব রাষ্ট্রগুলোর।
তারাই ছিলেন আফগানিস্তানে আরব জামাতের প্রথম বীজ, যারা প্রশিক্ষণ, মিডিয়া, সামরিক কর্মকাণ্ড, ময়দানের সহায়তামূলক কর্মকাণ্ড এবং এজাতীয় কর্মকাণ্ডগুলো সম্পাদন করেছেন। অবশেষে বিভিন্ন আরব ও অন্যান্য ইসলামী রাষ্ট্রগুলো থেকে মুজাহিদগণ আসতে থাকেন এবং ১৯৮৪ সালে ছোট এক তারকার মাধ্যমে যে গ্রুপ শুরু হয়েছিল তা বৃদ্ধি পেতে থাকে। অতঃপর ১৯৮৭ থেকে ১৯৯১ এর মধ্যখানে তা আরোও বৃদ্ধি পায়। ফলে নব্বয়ের দশকের শুরুভাগে ৪০ হাজারের মত আরব মুজাহিদ হয়ে যায়।
- আর আমেরিকা ও তার ভিখারী সংস্থা সিআইএ এর সাথে আফগানিস্তানে আরব জিহাদের কথিত সম্পর্কের ব্যাপারে কথা হল, যদি এই দুর্বৃত্তদের কোন ভূমিকা থেকেই থাকে, তাহলে সেটা হল আরব ও মুসলিম দেশগুলোর বন্ধু শাসকদেরকে এই অনুমতি প্রদান করা ও সবুজ সংকেত দেওয়া যে, তারা যেন মুসলিম যুবকদেরকে তাদের প্রাকৃতিক অধিকার ও দ্বীনি হুকুম পালন করার সুযোগ দেয়, যেন তারা আফগানিস্তান যেতে পারে। আর ওই সমস্ত দেশের অপরাধী গোয়েন্দা সংস্থাগুলোও যেন তাদের পথরূদ্ধ না করে। মুসলিম যুবকগণ তাদের শরয়ী দায়িত্ব পালন করতে গেলে যেন তাদরেকে বাধা না দেয়। এমনিভাবে আফগান জিহাদকে সম্প্রচার করার ক্ষেত্রে আরব ও মুসলিম দেশগুলোর সংবাদ সংস্থাগুলোরও সীমিত ভূমিকা আছে। সৌদি সরকারকে এই অনুমতি প্রদানের ভূমিকাও আমেরিকার রয়েছে যে, সৌদি সরকার যেন সৌদির বেতনভোগী দ্বীনি প্রতিষ্ঠানকে এই ফাতওয়া প্রদানের অনুমতি দেয় যে, আফগানিস্তানে জিহাদ ফরজে আইন। যেন দাওয়াত ও সংস্কারের পুণ্যবান দায়ী ও ইমামগণকে এই শরয়ী বাস্তবতা জনসম্মুখে প্রকাশ করার সুযোগ দেয়, হারামাইনের দেশের জনগণকে তাদের দ্বীন ও আকিদার ভাইদের সাহায্যে অর্থ ব্যয় করে জিহাদের দায়িত্ব পালন করার সুযোগ দেয় এবং যুবকদেরকে সেখানে যেতে চাইলে উৎসাহিত করে। এমনকি এটা এ পর্যন্ত গিয়ে পৌঁছে যে, সৌদি এয়ার লাইন্স আফগান জিহাদে গমনিচ্ছুকদের জন্য আভ্যন্তরীণ ভ্রমণ ব্যয় হ্রাস করার নিমিত্তে সৌদি টু পাকিস্তান বিমানের টিকেটের মূল্য ৭৫% পর্যন্ত হ্রাস করে। কোন সন্দেহ নেই যে, এ ছাড়গুলোর প্রদানের মধ্যে সৌদির প্রচারণামূলক স্বার্থ ছিল।
এমনিভাবে আমেরিকা পাকিস্তানকে এই অনুমতি প্রদান করেও ভুমিকা পালন করেছে যে, যেন পাকিস্তানী দূতাবাস তার দেশের ভূমি অতিক্রম করে আফগানিস্তানে যাওয়ার জন্য যেকোন দেশ থেকে আগত আরব ও মুসলিম যুবকদেরকে ভিসা দিতে নিজ দূতাবাস উম্মুক্ত করে দেয়। যেন আরবদেরকে সংগঠন তৈরি করার স্বাধীনতা প্রদান করে, যা শেষ পর্যন্ত আরব মুজাহিদগণ কর্তৃক আফগানিস্তানের নিকটবর্তী পাকিস্তানের ভূমিতে সামরিক প্রশিক্ষণ ক্যাম্প খোলা এবং আফগান জিহাদকে লজিস্ট্রিক সাপোর্ট দেওয়া পর্যন্ত পৌঁছে।
কোন সন্দেহ নেই যে, এতে পাকিস্তানের আঞ্চলিক ও দেশীয় স্বার্থ ছিল। এখানে প্রত্যেকটি স্বার্থ গণে গণে উল্লেখ করার সুযোগ নেই। এমনকি এই বিশাল সম্পদ ও জনবল বহির্দেশ থেকে আফগানিস্তানে আসা-যাওয়ার পথে নিজ ভূমি ব্যবহার করার কারণে যুদ্ধে কোটিপতি হওয়া পাকিস্তানের সেনা, গোয়েন্দা ও পুলিশ অফিসারদের ব্যক্তিগত স্বার্থও ছিল।
এখন যদি নিজের হীন কর্মচারিদের প্রতি আমেরিকার এই অনুমতি প্রদানকে আফগানিস্তানে আরবদের জিহাদ সৃষ্টিতে আমেরিকার ভূমিকা হিসাবে দেখা হয়, তাহলে ব্যাপার এতটুকুই। এর চেয়ে বেশি নয়। আর এক্ষেত্রে তাদের হীন কর্মচারিবৃন্দ, তথা সৌদি, পাকিস্তান, মিশর ও অন্যান্য রাষ্ট্রগুলোরও নিজ নিজ স্বার্থ ছিল।
পক্ষান্তরে আমেরিকা আরবদেরকে প্রশিক্ষণ দিয়েছে বা তাদের প্রোগ্রাম বিন্যাস করেছে বা সামরিক কর্মকাণ্ডে তাদের সহযোগীতা করেছে বা যেকোন ধরণের বাস্তবিক প্রয়োগিক সম্পর্ক রেখেছে- এমন দাবি নিরেট মিথ্যা অপবাদ।
Comment