তৃতীয় অধ্যায়: ময়দানে প্রত্যাবর্তন- প্রথম পরিচ্ছেদ- আফগানিস্তান- হিজরত ও প্রশিক্ষণ
(পূর্ব প্রকাশের পর)
আমি নিজে সামরিক প্রশিক্ষণ ক্ষেত্রগুলোতে কাজ করেছি এবং চিন্তাগত ও আদর্শিক ক্ষেত্রে একজন প্রভাষক হিসাবে দায়িত্ব পালন করেছি এবং আমি আফগানিস্তানে আরব জিহাদের নেতৃবৃন্দের সাথেও সম্পর্কিত ছিলাম, এগুলোর মধ্য দিয়ে আমি সাক্ষ্য দিতে পারি এবং জোর দিয়ে বলতে পারি যে, এ দাবিগুলোর কোন ভিত্তি নেই। আফগানিস্তানে আরব জিহাদের ইতিহাস নিয়ে বিশদ আলোচনার এখানে সুযোগ নেই। অন্যথায় সেখানে প্রশিক্ষণের ঘটনা ও কর্ম-উপাদানগুলোর বিশদ বিবরণ দিতাম।
একনিষ্ঠভাবে স্ব স্ব উদ্যোগে প্রচেষ্টাকারী একটি গ্রুপও ছিল, যা প্রবীণ জিহাদি নেতৃবৃন্দ এবং বিভিন্ন আরব ও ইসলামী দেশগুলোর সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত ও বরখাস্তকৃত পেশাদার সামরিক ব্যক্তিদের মাধ্যমে শুরু হয়েছিল। তাদের অংশগ্রহণেরও খুব উপকারি ভূমিকা ছিল। তারপর ময়দানে নবসৃষ্ট নেতৃবৃন্দেরও অভিজ্ঞতা সঞ্চিত হতে থাকে।
আফগানিস্তানে ও অন্যান্য অঞ্চলে আরব জিহাদি নেতৃবৃন্দ ও তাদের কর্মীদের চিন্তাগত, মনস্তাত্ত্বিক ও আদর্শিক অবস্থা সম্পর্কে অবগত এবং আমেরিকা, পশ্চিমা বিশ্ব ও সাধারণভাবে সকল কাফেরদের প্রতি, এমনকি আমাদের শাসকদের প্রতি, এমনকি তাদের ছোট্ট চ্যালাদের প্রতিও তাদের দৃষ্টিভঙ্গি কী, এ সম্পর্কে অবগত যেকোন ব্যক্তিই জানবে যে, এ সকল দাবিগুলো অবাস্তব ও অসম্ভব।
আরেকটি দাবি- সেভিয়েতন ইউনিয়নের বিরুদ্ধে যুদ্ধের ফলে এর সাথে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত পূর্বোল্লেখিতদের ব্যতিতও জোটের সকল পক্ষেরই স্বার্থ ও লক্ষ্য বাস্তবায়িত হয়েছে, প্রত্যেকের আলাদাভাবেও হয়েছে এবং যৌথ টার্গেটের কারণে সমষ্টিগতভাবেও- এটা একটা বাস্তব সত্য। রাজনীতির জগতে এরকম অনেক হয়েছে। ইতিহাসের বাকে বাকে স্বার্থমিলের এরকম ঘটনা অনেক ঘটেছে। আর এখানে ওখানে এটা ঘটতেই থাকবে। এটা বস্তুর প্রকৃতিগত বিষয়।
আমেরিকা সেভিয়েত ইউনিয়নকে পরাজিত করতে এবং শীতল যুদ্ধের প্রতিশোধ নিতে চেয়েছিল। যেহেতু ইতিপূর্বে সেভিয়েত ইউনিয়ন ও ওয়ার্সো জোট একাধিক স্থানে তাকে বেদনাদায়ক আঘাত করেছে। আফগানিস্তানের ঘটনাটি ছিল আমেরিকার জন্য সোনালী সুযোগ। আমেরিকা তা যথাযথভাবেই ব্যবহার করেছে এবং নেক্সন তার বিখ্যাত বইয়ে যেটাকে ‘বিনা যুদ্ধে জয়’ বলে নামকরণ করেছেন তা অর্জন করেছে। তারা তাদের সর্বোচ্চ যোগ্যতা দিয়ে এটা বাস্তবায়ন করেছে।
পশ্চিমা ইউরোপীয়ান ও ন্যাটো জোট চেয়েছে সেখানে নিজেদের পদচারণার ক্ষেত্র তৈরি করতে এবং বিভিন্ন স্বার্থ সিদ্ধি করতে। ফলে তারা ইউরোপীয়ান ইউনিয়ন হিসাবে বিশেষ স্বার্থে এবং প্রত্যেকের আলাদা আলাদা স্বার্থে ওই দেশে অংশগ্রহণ করেছে এবং প্রত্যেকেই যা চেয়েছে তা আনুপাতিক হারে অর্জনও করেছে। এখনো বিভিন্ন ইউরোপীয়ান সংস্থাগুলো আফগানিস্তান নামক খেলার মাঠ থেকে অগ্রবর্তী ও পরবর্তী হিসাবে নিজ নিজ স্বার্থ লুণ্ঠনের জন্য মানবসেবার শ্লোগানের আড়ালে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে।
পাকিস্তান নিজেদের জাতীয় ও আঞ্চলিক স্বার্থ অর্জন করতে চেয়েছে, যার পরিপূর্ণ বিবরণ দিলে এখানে স্থান সংকুলান হবে না। পাকিস্তান যা অর্জন করেছে তা উল্লেখ করার জন্যই একটি স্বতন্ত্র বইয়ের প্রয়োজন হবে। এছাড়াও আফগানের খেলার মাঠ থেকে আমেরিকা যে যে সেবাগুলো চেয়েছিল, পাকিস্তান তাও পেশ করেছে। প্রথমত: আফগান জিহাদকে সহযোগীতা করা, তারপর দ্বিতীয়ত তার অর্জনগুলো চূর্ণ-বিচূর্ণ করে দেওয়া, তারপর তৃতীয়ত: গৃহযুদ্ধের মধ্য দিয়ে আফগানিস্তানকে ধ্বংস করে দেওয়া, তারপর চতুর্থত: তালেবানদের উপর আক্রমণ করে তাদের রাষ্ট্রের পতন ঘটানো, তারপর পঞ্চমত: আরব মুজাহিদগণকে হত্যা করা এবং তাদেরকে তাদের দুশমনদের হাতে তুলে দেওয়া, তারপর ষষ্ঠত: এখনো কাশ্মীর ইস্যুর ব্যবসা করা, অতঃপর অষ্টমত: পাকিস্তানের অভ্যন্তরে ইসলামপন্থিদের সংগঠনগুলো ধ্বংস করা.........এভাবে পাকিস্তান সরকার সর্বদাই আমেরিকান ইচ্ছাগুলো বাস্তবায়ন করেছে। আল্লাহর অভিশাপ বর্ষিত হোক জালিম ও মুনাফিকদের উপর।
একইভাবে আফগানিস্তানে সৌদি আরব, মিশরসহ অন্যান্য রাষ্ট্রগুলোর ভূমিকা নিয়েও একই কথা বলতে পারেন। ভারত, মধ্য এশিয়ার রাষ্ট্রগুলো এবং প্রতিবেশী ইরান ও চীনের ভূমিকা নিয়েও একই কথা বলতে পারেন, যারা নিজ নিজ খেলা খেলেছে। সর্বশেষে সাধারণ ইসলামী আন্দোলনগুলো ও জিহাদি আন্দোলনগুলোর কথা এবং আফগানের খেলায় অংশগ্রহণকারি প্রত্যেকের কথাই বলতে পারেন, যাদের কেউ লাভবান হয়েছে, কেউ ব্যর্থ হয়েছে।
এ কথাগুলো আফগানিস্তানে উপস্থিত হওয়া বিভিন্ন আরবী ও ইসলামী সংগঠনগুলোর ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য।
সংক্ষিপ্ত কথায়, আফগান জিহাদের ইস্যুটি একটি আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক যৌথ স্বার্থের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে, যার অনুরূপ দ্বিতীয়বার ঘটা বিরল। সকলেই সেভিয়েত ইউনিয়নের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হয়েছে। আর প্রত্যেকেরই নিজস্ব নিয়ত ও টার্গেট ছিল।
নন জিহাদি ইসলামিক আন্দোলনগুলোর স্বার্থ বিভিন্ন ধরণের। কারো নেক নিয়ত ছিল, নিজ দ্বীন ও আকিদার ভাইদের সেবা করা। কারো নিজ নিজ সংগঠনের স্বার্থ অর্জন করা- তা দাওয়াতি, সাংগঠনিক বা বস্তুগত স্বার্থও হতে পারে। এমনকি পরিশেষে কারো কারো ব্যক্তিগত স্বার্থও ছিল।
এবার আসি, তাহলে জিহাদিদের টার্গেট কী ছিল আফগানিস্তানে উপস্থিত হওয়ার দ্বারা?
আল্লাহর পথে জিহাদ করা, ফরজ দায়িত্ব পালন করা এবং শাহাদাত লাভের উদ্দেশ্যের পর তাদের অবশিষ্ট টার্গেটগুলো বেশিরভাগ নেতৃবৃন্দ ও সদস্যদের দিক থেকে সীমাবদ্ধ ছিল। তাদের টার্গেট ছিল দু’টি কৌশলগত বিষয়। এখন আমি উভয়টিকেই আপন আপন গুরুত্ব অনুযায়ী এবং আমি প্রত্যক্ষভাবে জড়িত হওয়ার ফলে, এমনকি জিহাদি আন্দোলনের একজন সদস্য হওয়ার ফলে তা যতটুকু উপলব্ধি করেছি সে হিসাবে উল্লেখ করব। যেহেতু আমি ওই গ্রুপেরই একজন, যাদের ব্যাপারে তারা ‘আরবীয় আফগান’ বলে সুন্দর ড্রামাটিক নাম ব্যবহার করেছে, যাকে আমি ভালোবাসি এবং যার সাথে আমি সম্পৃক্ত হই। সে দু’টি বিষয় হল:
১- অধিকাংশ জিহাদি দল, সংগঠন ও নেতৃবৃন্দের প্রধান টার্গেট ছিল তাদের নিজ নিজ দেশের সমস্যার জন্য প্রস্তুতি, প্রশিক্ষণ, দল বিন্যাস, নেতৃবৃন্দকে একত্রিত করণ, সৈন্য গঠন, সাধারণ সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করা, অনুদানের অর্থ সংগ্রহ করা ও সংগঠনের সদস্যদের প্রশিক্ষণ দেওয়া। এই টার্গেটটিই (প্রত্যেকের না হলেও) অধিকাংশ আরবী ও অনারবী জিহাদি দলের চিন্তা-ভাবনায় প্রভাবশালী ছিল। তা হল: স্ব স্ব দেশে বিদ্যমান মুরতাদ সরকারগুলোর পতন ঘটানো এবং এমন ইসলামী সরকার প্রতিষ্ঠিত করা, যারা আল্লাহর শরীয়া দ্বারা শাসন করবে।
২- আফগানিস্তান স্বাধীন করা এবং সেখানে ইসলামী শরীয়া ভিত্তিক এমন একটি সরকার প্রতিষ্ঠিত করা, যা আল্লাহর যমীনে আল্লাহর শরীয়া প্রতিষ্ঠার কেন্দ্রবিন্দু হবে এবং ফিলিস্তীন ইস্যু থেকে শুরু করে, ইসলামের চাওয়া-পাওয়া আছে এমন প্রতিটি ইস্যুতে ইসলামের বিভিন্ন রকম শত্রুদের বিরুদ্ধে জিহাদ করার জন্য নিরাপদ ঘাটি ও আশ্রয়স্থল হবে।
এ দু’টি লক্ষ্যের মাঝেই সকলের নিয়তগুলো সীমাবদ্ধ ছিল। যদিও গুরুত্বের পার্থক্য হিসাবে কারো তুলনামূলক কম ছিল, কারো বেশি ছিল।
Comment