তৃতীয় অধ্যায়: ময়দানে প্রত্যাবর্তন- প্রথম পরিচ্ছেদ- আফগানিস্তান- হিজরত ও প্রশিক্ষণ
(পূর্ব প্রকাশের পর)
.................................................. ..
আর মিডিয়া যাদেরকে ‘সিআইএ’এর সাথে সম্পর্ক রাখার অপবাদ দিয়ে থাকে এবং বলে, সেভিয়েত ইউনিয় ধ্বংস করার জন্য সিআইএ তাদেরকে সৃষ্টি করেছে, এটিও একটি ভ্রান্ত কথা। উদাহরণ স্বরূপ, যারা এই অপবাদে জর্জরিত হয়েছেন, তাদের মাঝে অন্যতম প্রশিদ্ধ ব্যক্তি হলেন শায়খ আব্দুল্লাহ আয্যাম রহ.।
.................
শহীদ শায়খ আবু মুহাম্মদ আব্দুল্লাহ আয্যাম রহ. এর অডিও ক্যাসেট, বই, ভাষণ ও উত্তরাধিকার সম্পদগুলোর মাঝে অনুসন্ধানকারি যে কেউ দেখতে পাবে যে, তিনি তার অনুসারি ও পাঠকদের অন্তরে আমেরিকা ও তার সহযোগী গোষ্ঠীর ব্যাপারে এবং মুরতাদ শাসকশ্রেণী ও তাদের বন্ধুদের ব্যাপারে কী পরিমাণ পবিত্র ঘৃণা ও পবিত্র বিদ্বেষের বীজ বপন করেছেন। কেন তিনি এটা করবেন না? কারণ তিনি নিজেই ফিলিস্তীনে, জর্দানে, অতঃপর পাকিস্তানে তাদের দুর্বৃত্তিপনার বলি হয়েছেন। বেনজির ভুট্টো ও তার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বাবরের শাসনামলে পাকিস্তান সরকার আমেরিকার নির্দেশে তাকে হত্যা করে। যাদের থেকে কিসাস গ্রহণের গুরুদায়িত্ব মুজাহিদ প্রজন্মের ঘাড়ে এখনো আমানত হিসাবে রয়ে গেছে । আল্লাহ অপরাধীদের ধ্বংস করুন আর তাকে শহীদদের মাঝে কবুল করে নিন।
আরেকটি অভিযোগ- তিনি তার মূল্যবান কিতাব ‘মুসলিম ভূমির প্রতিরক্ষা করা সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ ফরজে আইন’ এ আগ্রাসী রাশিয়ার বিরুদ্ধে জিহাদের জন্য আমেরিকান সহযোগীতা গ্রহণ করা বা তার উল্টোটা করা জায়েয হওয়ার ফাতওয়া দেন.. এটা সঠিক। এটা অনন্যোপায় অবস্থায়, যখন মুসলিমগণ এটা করতে বাধ্য হন, যখন আগ্রাসী শত্রু তাদের উপর আক্রমণ করে আর তারা ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে উপনীত হন...। এটি একটি ভালো বিষয়। ফুকাহায়ে কেরাম বিভিন্ন শর্তের মাধ্যমে এটাকে সীমাবদ্ধ করেছেন। শায়খ আফগানদের জন্য আমেরিকার এবং আরব-অনারবের মুরতাদ শাসকদের সাহায্য গ্রহণ করার ফাতওয়া দেন। তবে আরব জিহাদি গ্রুপটি ছিল দাতা, গ্রহিতা নয়। কারণ তাদের নিকট মুসলমানদের যাকাত ও সাধারণ অনুদানের কোটি কোটি ডলার আসত। তারা তা থেকে নিজেদের প্রয়োজনাদি, তথা জিহাদ ও প্রশিক্ষণের খরচ এবং আরব মুজাহিদ ও শহীদদের পরিবারের ভরণ-পোষণের খরচ মেটানের পর অধিকাংশ অর্থই স্বয়ং আফগান জিহাদের জন্য খরচ করতেন। এমনিভাবে আফগান জিহাদের জন্য ওয়াকফকৃত যত আমানতের অর্থ আসত, আরব মুজাহিদগণ সেগুলো তার প্রাপক তথা মুজাহিদ, মুহাজির এবং তাদের ইয়াতিম-বিধবা উত্তরসূরীদের নিকট ও প্রয়োজনার্থীদের নিকট পৌঁছে দিতেন। এ ছিল শায়খ আয্যামের ভূমিকার কথা।
আর শায়খ উসামা বিন লাদেন হাফিজাহুল্লাহ এর অবস্থা:
......................................
আর ‘আমেরিকানরা আল-কায়েদার মুজাহিদগণকে ও অন্যান্য আরব মুজাহিদগণকে প্রশিক্ষণ দিয়েছে বা তাদেরকে কোন ধরণের সাহায্য করেছে’ এটা ডাহা মিথ্যা কথা। কারণ এটা কোনভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়, এমনকি ঠাট্টাচ্ছলেও নয়। কারণ আরব জিহাদি অঙ্গনটি- যাদের চিন্তা-চেতনায় ‘আল-ওয়ালা ওয়াল-বারা’ এবং ‘জিহাদি সালফী আদর্শ’ প্রভাব বিস্তার করে ছিল, তারা সৌদি প্রশাসনের এমন কতিপয় ব্যক্তির প্রতিই ক্ষুব্ধ ছিলেন, যারা সাহায্য পেশ করতে আসত বা কখনো কখনো উম্মুক্ত সাধারণ ক্যাম্প ও মেহমানখানাগুলোতে প্রবেশ করত (যেমন সৌদিয়ান দূতাবাসের সামরিক বিশেষজ্ঞ: আবু মাযিন।), তাহলে কিভাবে ভিনদেশী বা আমেরিকানদের ক্ষেত্রে এধরণের চিন্তা করা যায়?
তাই যারা তার উপর এ অপবাদ আরোপ করেছেন যে, তিনি রাশিয়ানদের বিরুদ্ধে জিহাদের সময় আমেরিকানদের সাথে মিলে কাজ করেছেন, তারপর তাদের বিরুদ্ধেই ঘুরে গেছেন- এটা ভ্রান্ত ধারণা, যার ভিত্তি স্বেচ্ছাচারিতা ও বিদ্বেষ অথবা অজ্ঞতার উপর এবং যা বিরোধী সংবাদ মাধ্যমগুলোর প্রোপাগান্ডার ফল।
সংক্ষিপ্তভাবে ঘটনাটি হল, ওই সময় একটি সাধারণ বিভক্তি আফগানিস্তানের উপর জুলুমকারী রাশিয়ার বিরুদ্ধে তাকে ও সকল মুসলমানকে আমেরিকার সাথে একত্রিত করে দেয়। অতঃপর যখন যুদ্ধ শেষ হল, তখন সকলেই এ ব্যাপারে সজাগ হল যে, পরবর্তী শত্রু হল সেই একক শক্তি, যারা এককভাবে গোটা বিশ্ব পরিচালনা করছে, একটি নতুন বৈশ্বিক ব্যবস্থা সৃষ্টি করেছে, হারামাইনের দেশের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছে এবং মধ্যপ্রাচ্যের উপর ক্রুসেড হামলা পরিচালনা করছে।
অতঃপর ইবনে লাদেন কর্তব্য পরিপূর্ণ করলেন। তিনি নিজ দলবল নিয়ে সেই শক্তির বিরুদ্ধে জিহাদ ঘোষণা করলেন, যারা নিজেদের দলবল নিয়ে সীমালঙ্ঘন করতে আসল। এমনিভাবে যারা তার সঙ্গে জিহাদ করতে ইচ্ছুক ছিলেন বা যারা তার থেকে স্বতন্ত্রভাবে জিাহদ করতে ইচ্ছুক ছিলেন (যেমন আমি ও আমার মত অনেকে) তাদের সিংহভাগও একই কাজ করলেন।”
‘আমেরিকা আরব মুজাহিদীনকে অর্থায়ন করেছে, প্রশিক্ষণ দিয়েছে’-এ সংশয় নিরসনে পরিশেষে এখানে আমি ‘১১ সেপ্টেম্বর পরিষদ’র প্রতিবেদনে উল্লেখিত মার্কিন কংগ্রেসের একটি সাক্ষ্য উপস্থাপন করব, যা আমেরিকা কর্তৃক আরব মুজাহিদগণকে কোনরূপ সাহায্য না করার বিষয়টিকে শক্তিশালীভাবে প্রমাণিত করে। উক্ত প্রতিবেদনে বলা হয়:
“বিন লাদেনের চেষ্টা-প্রচেষ্টা আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে অনন্য বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত ছিল। কারণ সৌদি আরব ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আফগানিস্তানে রাশিয়ান আগ্রাসনের বিরুদ্ধে যুদ্ধকারী বিপ্লবী দলগুলোকে গোপন সাহায্য করার মূল্য হিসাবে কোটি কোটি ডলার ব্যয় করেছিল। পাকিস্তানী বা আইসিআইডি এর সাধারণ পরিসেবার গোয়েন্দা সংস্থার মাধ্যমে পৌঁছা এই সাহায্য বিপ্লবীদেরকে প্রশিক্ষণ দান ও তাদের মাঝে অর্থ বন্টনে সহযোগীতা করেছে।
কিন্তু বিন লাদেন ও তার সাথীদের অর্থ সাপোর্ট ও প্রশিক্ষণ লাভের নিজস্ব উৎস ছিল। তারা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে খুব কম সাহায্য নিয়েছে বা একেবারেই নেয়নি।”
তার (আমেরিকার) পরিবারেরই একজন সাক্ষ্য দিল।
১০- আফগানিস্তানের মুসলিম মুজাহিদগণকে আমেরিকার কর্মী বলে অপবাদ আরোপের পশ্চিমা মিডিয়া ষড়যন্ত্র অব্যাহতভাবে চলতে লাগল। এমনকি তাদের ব্যাপারে যে নামটি ব্যবহার করেছে- ‘আরবীয় আফগান’- এটিও ষড়যন্ত্রমূলক। কারণ তারা শুধু আরব ছিলেন না। বরং গোটা বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের মুসলিমগণ ছিলেন। যদিও আরবগণ তাদের মাঝে বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত একটি দল ছিল।
১১- স্বভাবতই আন্তর্জাতিক মোড়লগণ তাদের অবাধ্যতাকারী এবং তাদেরকে অস্তিত্ব-সংকটের সম্মুখীনকারী এ দৃশ্য মেনে নিতে পারবে না, যা দিন দিন বিকশিতই হচ্ছিল, যদিও মুসলিম দেশসমূহের পশ্চিমা ও সাম্যবাদী আগ্রাসীরা দীর্ঘ এক যুগ ধরে ধারাবাহিক চেষ্টা করে এসেছে মুসলিম জাতিকে মিথ্যা শাসনব্যবস্থা, আইন, নির্বাচন, অভিবাসন ও জাতীয়তার নীতি এবং সকল পরিবর্তিত অবস্থার সামনে আজ্ঞাবহ করার জন্য।
একারণেই আরব মুজাহিদগণকে পাকিস্তান থেকে বিতাড়নের জন্য তারা নব্বয়ের দশকের শুরু থেকেই চাপ শুরু করে এবং ১৯৯২ সালে তা সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছে।
তাদের সাথে ঘৃণ্য আচরণের সিংহভাগ দায়িত্ব পালন করল ধর্মনিরপেক্ষতাবাদী দালাল পাকিস্তানী সরকার। যারা পাকিস্তানেরই সীমান্ত প্রতিরক্ষা করেছিল, তাদেরকে সর্বপ্রকার হীন উপায়ে অজানার পথে নির্বাসিত করল।
পাকিস্তান-আফগানিস্তান সীমান্তবর্তী তুরখুম ক্রসিং এলাকার আফগান অংশে এমন একটি কবরস্থান পাওয়া যাবে, যেখানে আফগানিস্তানে যুদ্ধকারী আরব মুজাহিদগণের প্রায় এক শ’ শহীদের ধ্বংসাবশেষ বিদ্যমান। যা সাম্যবাদী হুমকির মোকাবেলায় নিজ সীমান্ত প্রতিরক্ষাকারীদের সাথে পাকিস্তান সরকারের নিকৃষ্ট আচরণের প্রমাণ হিসাবে অবস্থান করছে এবং মুসলমানদের ইতিহাসে ইসলামাবাদের শাসকগোষ্ঠী কর্তৃক মুসলিমদের সাথে গাদ্দারি এবং আমেরিকাকে সন্তুষ্ট করার উদগ্র বাসনার এক অধ্যায় লিপিবদ্ধ করে রেখেছে।
১২- আফগানিস্তান সম্পর্কিত এ পরিচ্ছেদের সর্বশেষে আমি সেই বিরাট সংগ্রামের কথা ভুলে থাকতে পারব না, যা ১৯৮৬ থেকে ১৯৯২ এর মধ্যবর্তী সময়ে জামাআতুল জিহাদের কয়েকজন ভাই যুদ্ধ, দাওয়াত, প্রশিক্ষণ, প্রস্তুত করণ, সচেতনতা সৃষ্টি এবং সংগঠন ও সমন্বয়ের ক্ষেত্রে সম্পাদন করেছেন।
আমার আফসোস হয় যে, আমি এখানে নিরবে আত্মবিসর্জনকারী একনিষ্ঠদের সকলের নাম উল্লেখ করতে পারছি না। বস্তুত: আল্লাহই তাদের পর্যবেক্ষক। কারণ তাদের অনেকেই তাগুতদের কর্তৃত্বাধীন। তারা তাদেরকে তাদের উম্মাহর সম্মান রক্ষার যুদ্ধের জন্য জিজ্ঞাসাবাদ করছে এবং তারা আমেরিকাকে সন্তুষ্ট করার জন্য আমাদের উপর যে লাঞ্ছনা চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেছিল, তার অবাধ্যতা করার শাস্তি দিচ্ছে।
Comment