তৃতীয় অধ্যায়: ময়দানে প্রত্যাবর্তন
তৃতীয় পরিচ্ছেদ
মিশরের অভিযান সমূহ
তৃতীয় পরিচ্ছেদ
মিশরের অভিযান সমূহ
فَقَاتِلْ فِي سَبِيلِ اللّهِ لاَ تُكَلَّفُ إِلاَّ نَفْسَكَ وَحَرِّضِ الْمُؤْمِنِينَ عَسَى اللّهُ أَن يَكُفَّ بَأْسَ الَّذِينَ كَفَرُواْ وَاللّهُ أَشَدُّ بَأْسًا وَأَشَدُّ تَنكِيلاً
“সুতরাং (হে নবী!) তুমি আল্লাহর পথে যুদ্ধ কর। তোমার উপর তোমার নিজের ছাড়া অন্য কারো দায়ভার নেই। অবশ্য মুমিনদেরকে উৎসাহ দিতে থাক। অসম্ভব নয় যে, আল্লাহ কাফেরদের যুদ্ধক্ষমতা চূর্ণ করে দিবেন। আল্লাহর শক্তি সর্বাপেক্ষা প্রচণ্ড এবং তাঁর শাস্তি অতি কঠোর।”
হয়ত এখানে মিশর সরকারের বিরুদ্ধে পরিচালিত জিহাদী অভিযানগুলোর বিস্তারিত বর্ণনা দেওয়া সঙ্গত হবে না। তবে আমরা সংক্ষিপ্ত বিবরণ তুলে ধরব আর তার সাথে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাগুলো এবং শেষ পরিণতিতে মিশর সরকারের বিরুদ্ধে তার গভীর তাৎপর্য সমূহ নিয়ে আলোচনা করব। প্রথমে আমরা সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ অভিযানগুলো এবং তারপর এ সকল অভিযানগুলো থেকে অর্জিত শিক্ষাগুলো উল্লেখ করব।
প্রথমত: আনওয়ার সাদাত হত্যার পর মিশরে গুরুত্বপূর্ণ অভিযানসমূহ:
১- আমরা মিশরে অভিযানসমূহের সূচনা পর্যালোচনা করতে পারি কায়রোর ‘আইনে শামছ’ এ আগ্রাসী সরকারের আক্রমণ দিয়ে।
ক. ১৯৮৮ সালের ১২ আগষ্ট জুমআর দিন মাগরিবের নামাযের পর বিশাল পুলিশ বাহিনী ‘মসজিদে আদম’ এ হানা দিল, যেখানে আল-জামাআতুল ইসলামীয়ার সাপ্তাহিক সভা অনুষ্ঠিত হচ্ছিল। এখানে উল্লেখ করা বাঞ্ছনীয় যে, মসজিদে আদামে ইতিপূর্বেও কয়েকবার পুলিশ বাহিনী হানা দিয়েছে। আর মসজিদগুলোতে হানা দেওয়া পুলিশ বাহিনীর চিরাচরিত অভ্যাসে পরিণত হয়েছিল। তারা জুতা নিয়ে প্রবেশ করত, ভেতরে যা কিছু থাকত, পদদলিত করত, কিতাবসমূহ ছিড়ে ফেঁড়ে ফেলত এবং নির্বিচারে টিয়ারগ্যাস ও গুলি চালাত।
মসজিদসমূহের উপর অব্যাহত সীমালঙ্ঘন -এমনকি আজও পর্যন্ত- এটা আল্লাহর হুকুমে শাস্তি ছাড়া চলতে পারে না। এ সকল অপরাধগুলোর দায়িত্ব পালন করছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, হুসনি মোবারক ও সেই আমেরিকান সংস্থা, যার সম্মতিতে, যার জানা শোনা ও দেখার ভিতরে এবং যার রাজনীতি বাস্তবায়নের জন্যই এ সকল অপরাধগুলো চলছে। সে রাজনীতি হল: উক্ত অঞ্চলে ইসরাঈলী বসতি সম্প্রাসারণের বিরুদ্ধে জেগে উঠা ইসলামী প্রতিরোধ আন্দোলনকে দমন করা।
আক্রমণ শুরু হয় মসজিদের জানালাগুলো চুরমার করে দেওয়ার মাধ্যমে। অতঃপর মসজিদে অবস্থানকারীদেরকে বের হতে বাধ্য করার জন্য মসজিদের ভিতরে টিয়ার গ্যাস ও অগ্নিবোমা নিক্ষেপ করে। যখন তারা বের হতে শুরু করেন, তখনই পুলিশবাহিনী ঢুকে পড়ে মসজিদে এবং নির্বিচারে গুলি চালাতে থাকে।
এলাকাবাসী রোষে উঠার জন্য এ অপরাধটিই যথেষ্ট ছিল। তাই তারা স্বেচ্ছায় এসে পুলিশী জুলুমের বিরুদ্ধে ইসলামী দলের কর্মীদের সঙ্গে মিলিত হয়েছিল। ফলে সংঘর্ষ ছড়িয়ে পড়তে পড়তে পুরো এলাকায় বিস্তার হয়ে যায়।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ক্ষোভে-ক্রোধে পাগলের মত হয়ে গেল। গুলি চালানোর আদেশ দিতে থাকল। অসংখ্য শিশু, নারী, বৃদ্ধ যুবক পড়ে যেতে লাগল। সকল রাস্তা ও বাড়ি-ঘরগুলো রক্তাক্ত আহতে, নিহতে ভরে গেল। তেমনি পুলিশ-বিগ্রেডগুলোও শত শত বন্দিতে ভরে গেল।
খুব স্বাভাবিক ব্যাপার ছিল যে, গ্রামবাসীও আগ্রাসী আক্রমণের জবাব দিবে। তাই দু’জন অফিসার ও চার জন সৈন্য আক্রান্ত হল। অফিসার মুহাম্মদ যাকারিয়া মাথায় পাথরের আঘাতে নিহত হল।
ফলত: স্বাভাবিকভাবেই নিরাপত্তা বাহিনী এলাকার সকল রাস্তায় কারফিউ জারি করল। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয় উক্ত এলাকাকে শিক্ষা দেওয়ার জন্য বিভিন্ন বাহিনীর অন্তর্গত বিরাট সংখ্যক ফোর্স প্রেরণ করল।
খ. আইনে শামছ এলাকার উপর দ্বিতীয় হামলা হয়েছে ৭ ডিসেম্বর বুধবার ১৯৮৮ সালে, যখন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী যাকি বদরের নিকট তথ্য পৌঁছল যে, ‘আল জামাআতুল ইসলামিয়া’ অধিকৃত ফিলিস্তীনে ফিলিস্তীনী আন্দোলনের প্রতি সমর্থন প্রকাশ করতে গণভবনের দিকে শান্তিপূর্ণ যাত্রা নিয়ে আসছে।
কিন্তু মিশরীয় সরকারের দাম্ভিকতা এটা মেনে নিতে পারে না যে, আল জামাআতুল ইসলামিয়া প্রকাশ্যে মহাসড়কে নিজেদের অস্তিত্ত্বের জানান দিবে, চাই তা যে কারণেই হোক।
তাই পুলিশ ফজরের নামাযের পূর্বে মসজিদে আদামে হানা দিল। ভিতরে যারা ছিল সকলকে গ্রেফতার করল। আইনে শামছ, মাতরিয়্যাহ ও আলফ মাসকান এলাকা সমূহের ‘আল জামাআতুল ইসলামিয়া’ এর সকল সদস্যকে এবং আইনে শামছের সকল অধিবাসীকে ব্যাপক হারে গ্রেফতার করল। ১৮০ জনের অধিক ব্যক্তিকে গ্রেফতার করল।
সরকারী সংবাদ পত্র স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বিবৃতি প্রকাশ করল, যাতে অনেক বাস্তবতা ঘোলা করা হয়েছে। তাতে আইনে শামছের উপর আক্রমণ ও আল জামাআতুল ইসলামিয়ার কয়েক দশক সদস্যকে গ্রেফতার করার কথা যদিও স্বীকার করা হয়েছে, কিন্তু বিবৃতিতে দাবি করা হয়, গ্রেফতারকৃতদের কাছ থেকে অনেক লিফলেট ও অস্র পাওয়া গিয়েছে। আর এটাও স্বীকার করা হয় যে, পুলিশী ফোর্স মসজিদে আদাম বন্ধ করে দিয়েছে!! আল জামাতুল ইসলামিয়ার ওয়ান্টেড সদস্যদের খোঁজার জন্য পুরো এলাকায় চিরুনী অভিযান অব্যাহত থাকবে। কিন্তু বিবৃতিতে এটা উল্লেখ করা হয়নি যে, পলাতকদেরকে আত্মসমর্পণে বাধ্য করার জন্য তাদের স্ত্রী, মা, নিকত্মীয়, এমনকি শিশুদেরকেও মুক্তিপণ রূপে গ্রেফতার করা হয়েছে। আর তারা নিজ বাড়িতে থাকাবস্থায় কী কী নির্যাতনের শিকার হয়েছে, তাও উল্লেখ করা হয়নি।
গ. ঘটনাবলী দ্রুত ছড়িয়ে পড়ার মাঝেই আইনে শামছের জনৈক বিক্রেতা পূর্ব কায়রোর গোয়েন্দা এজেন্ট সিনিয়র পুলিশ অফিসার ইসাম শামছকে ছুরিকাঘাত করেন। ছুরিবিদ্ধ হয়ে অফিসার মারা যায়। বিক্রেতা তৎক্ষণাৎ পলায়ন করেন, প্রসিকিউশন তদন্তে যার নাম বেরিয়ে আসে শরীফ মুহাম্মদ আহমদ। তিনি কয়েকবার গোয়েন্দা অফিসারের হাতে ক্ষত সৃষ্টি হওয়ার মত মারপিটের শিকার হয়েছিলেন। এছাড়াও এই মাত্র উল্লেখিত আগষ্টের ঘটনাবলীতেও গ্রেফতার হয়ে আইনে শামছ থানায় পাশবিক নির্যাতনের শিকার হয়েছিলেন।
ঘটনাবলীর শেষটা ছিল অত্যন্ত বেদনাদায়ক। শরীফ মুহাম্মদ আহমাদ ও তার সাথে আরো দু’জন- খালিদ ইসমাঈল ও আশরাফ দরবেশকে গুলি করে হত্যা করা হয়। তারপর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এক বিবৃতিতে দাবি করে: নিহত তিনজন গ্রেফতারের সময় শিবরার কোন এক মহাসড়কে পুলিশের সঙ্গে তিন ঘন্টা ব্যাপী লড়াই করে। যদিও একজন অফিসার বা সৈন্যও গুলিবিদ্ধ হয়নি!!! বিবৃতিতে আরো দাবি করে যে, নিহত তিনজনের লাশের পাশে কিছু অস্ত্র পাওয়া গিয়েছে। পুলিশ উক্ত অঞ্চলের আল জামাআতুল ইসলামিয়ার একজন নেতাকেও হত্যা করে, যাকে জাবের মুহাম্মদ আহমাদ বলে উল্লেখ করা হয়। পুলিশ তাদের স্বাভাবিক নীতি অনুযায়ী দাবি করে, সেও সরকারি বাহিনীর সঙ্গে লড়াই করে এবং একজন অফিসারকে হত্যা করার চেষ্টা করে। ফলে পুলিশ তার উপর গুলি ছোঁড়তে বাধ্য হয়।
ঘটনার সাথে সাথেই উক্ত এলাকার সড়কগুলোতে কারফিউ জারি করা হয়। যাদের ব্যাপারেই ঘটনার সাথে সম্পৃক্ততার সামান্য সন্দেহ হয় তাদেরকে গণহারে গ্রেফতার করা হয়। কিন্তু উক্ত ঘটনার একটি কারণ ছিল, আইনে শামছ থানায় বন্দিদের উপর পাশবিক নির্যাতনে উক্ত অফিসারের ভূমিকা।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী যাকি বদর আল জামাআতুল ইসলামিয়ার পলাতক নেতৃবৃন্দের মা, স্ত্রী ও বোনদের মধ্য থেকে ৩০ জন সম্মানিত নারীকে গ্রেফতার করার নির্দেশ দেয়। আইনে শামছ থানায় নিকৃষ্ট নির্যাতনের সম্মুখীন হওয়ার পর তাদেরকে লাযুগলীতে রাষ্ট্রীয় গোয়েন্দা বিভাগে হস্তান্তর করা হয়। সেখানে তাদের বস্ত্র খুলে ফেলা হয় এবং তারা চড়, লাথি ও বিভিন্ন প্রকার নোংড়া ও নিকৃষ্ট গালি-গালাজের সম্মুখীন হন।
এভাবেই আইনে শামছের ঘটনাবলী আল জামাআতুল ইসলামিয়ার উপর, এমনকি উক্ত অঞ্চলের সকল জনগণের উপর প্রকাশ্য সীমালঙ্ঘনের ঘটনায় রূপ নেয়। এগুলোর লক্ষ্য সুস্পষ্ট: তা হল, উক্ত অঞ্চলের আল জামাআতুল ইসলামিয়া যে শান্তিপূর্ণ দাওয়াতি কর্মকাণ্ড পরিচালনা করত তা ধ্বংস করা। অথচ আল জামাতুল ইসলামিয়ার সদস্যদের সামাজিক কর্মকাণ্ড ও দাওয়াতী কর্মকাণ্ডের কারণে তারা সাধারণ মানুষের পূর্ণ সমর্থন পেয়েছিল। কিন্তু যে সরকার ইসলামী দলের সদস্যদের হত্যা করা এবং তাদের যেকোন কর্মকাণ্ডে বাধা দেওয়ার রাজনীতিকে আদর্শ হিসাবে গ্রহণ করেছিল, তারা এটাকে ছাড় দেওয়ার পাত্র ছিল না। যে রাজনীতি সে সময়ের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী যাকি বদরের ভাষায়: ‘হৃদপিণ্ডের মূলে আঘা করা এবং সূক্ষ্ম অনুতে আঘাত করা’র রাজনীতি।
২- আল জামাআতুল ইসলামিয়া জবাব দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিল। জবাব ছিল ১৯৮৯ সালের ২৬ ডিসেম্বরে যাকি বদরের গাড়ি বহরে গাড়িবোমা হামলার জন্য একটি কমাণ্ডো অভিযান প্রস্তুত করা। কিন্তু গাড়ির ভেতরে বিস্ফোরকযন্ত্রের ত্রুটির কারণে অভিযান ব্যর্থ হয় এবং গাড়ির চালক গ্রেফতার হন।
৩- জবাবে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ডক্টর আলা মুহিউদ্দীনকে ১৯৯০ এর ২ সেপ্টেম্বর দিনের আলোতে মহাসড়কের উপর হত্যা করে। আলা মুহিউদ্দীন রহ. আল জামাআতুল ইসলামিয়ার নেতৃবৃন্দের মধ্যে অন্যতম একজন ছিলন, যিনি সরকারের সাথে সংলাপ করার প্রতি আহ্বান করতেন। তিনি একাধিক অনুষ্ঠানে ‘স্বাধীন ও নিরপেক্ষ সংলাপকে স্বাগতম’ স্লোগান তুলে এটা প্রকাশ করতেন। কিন্তু এ রাজনীতি পূর্বে রাশিয়ার দালাল শাসকদের সাথে এবং বর্তমানে আমেরিকান দালাল শাসকদের সাথে পুরোপুরি ব্যর্থ প্রমাণিত হয়েছে।
আলা মুহিউদ্দীনের হত্যা ছিল আল জামাআতুল ইসলামিয়ার প্রতি এ ব্যাপারে সুস্পষ্ট বার্তা যে, সংলাপের আহ্বানের শাস্তি হল হত্যা এবং সরকার কোন জিহাদী জামাতের অস্তিত্বই মেনে নিবে না। সরকার নিজ যুক্তিতে সঠিকই ছিল, কারণ জিহাদী জামাত তার মোকাবেলার ক্ষেত্রে বিপদজনক প্রতিদ্বন্দ্বী ছিল। কারণ এটাই মুসলিম যুবকদেরকে একত্রিত করা ও বিচ্ছিন্ন করার ক্ষেত্রে সর্বাধিক শক্তিশালী জামাত। এটাই ইসরাঈলের সাথে তাল মিলিয়ে চলার রাজনীতির বিরুদ্ধে সবচেয়ে ভয়াবহ দল। আর যতক্ষণ পর্যন্ত ইসলামী জামাতসমূহের হুমকি বাকি থাকবে, ততক্ষণ পর্যন্ত ইসরাঈলের জন্য মিশরে অবস্থান কিছুতেই সুখময় হবে না।
Comment