তৃতীয় অধ্যায়: ময়দানে প্রত্যাবর্তন-তৃতীয় পরিচ্ছেদ-মিশরের অভিযান সমূহ
(পূর্ব প্রকাশের পর)
৪- আলজামাআতুল ইসলামিয়া আলা মুহিউদ্দীন রহ. এর হত্যার জবাব দেয় ওই সময়ের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আব্দুল হালিম মূসার জন্য একটি কমাণ্ডো দল নিযুক্ত করার মাধ্যমে। কিন্তু আল্লাহর ইচ্ছায় তার পরিবর্তে সংসদ প্রধান রাফআত মাহযুবের গাড়িবহর সেখান দিয়ে অতিক্রম করে। ফলে সে-ই কমান্ডো অভিযানের মধ্যে পড়ে এবং নিহত হয়।
এভাবে আল জামাআতুল ইসলামিয়া তাদের দীর্ঘদিনের দাওয়াতি কর্মপন্থা থেকে পরিবর্তিত হয়ে সরকারের সীমালঙ্ঘনের বিরুদ্ধে যুদ্ধের মাধ্যমে মোকাবেলা করার পদ্ধতিতে ফিরে আসে।
৫- নব্বইয়ের দশকের শুরুভাগে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটে। তা হল: আমাদের জামাতুল জিহাদের বিরাট সংখ্যককে গ্রেফতার করা এবং তাদের মধ্যে ৮ শ’ কে সামরিক আদালতের নিকট পেশ করা, যাদের মধ্যে ৪ জনের ব্যাপারে আদালত মৃত্যুদণ্ডাদেশ জারি করে।
সরকারি সংবাদপত্র জিহাদী জামাতের ৮ শ’ সদস্যকে একটিও গুলি খরচ করা ব্যতিত গ্রেফতার করাকে গর্বের সাথে প্রচার করে। তাই পূর্বে আমাদের “ছড়িয়ে পড়া ও সংস্কার যুদ্ধের প্রস্তুতির জন্য পূজি বিনিয়োগ করা”র নীতি থাকলেও এখন আমরা সরকারের সাথে মুখোমুখী লড়াইয়ে লিপ্ত হওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম।
৬- আমাদের জবাব ছিল ওই সময়ের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হাসান আলফীর গাড়ীবহরে বোমাভর্তি মটর গাড়ি নিয়ে হামলা করা। কিন্তু মন্ত্রী প্রাণে রক্ষা পায়। শুধু তার একটি হাত ভেঙ্গে চুরমার হয়ে যায়। তার পার্শ্বে রাখা এক গাদা ফাইল তার মৃত্যুর পথে আড়াল হয়ে যায়। অগ্নি স্ফুলিঙ্গগুলো ফাইলের গাদার উপর গিয়ে পড়ে।
৭- এর পরেই আল-জামাআতুল ইসলামিয়ার ভায়েরা তথ্যমন্ত্রী সাফওয়াত শরীফের উপর হামলা করেন। তথ্যমন্ত্রী আক্রমণ থেক রক্ষা পায়। একই সময়ে আল জামাআতুল ইসলামিয়া কেন্দ্রীয় সামরিক অঞ্চলের প্রধানের উপর আক্রমণ করেন, যেহেতু সে-ই সামরিক আদালতের আদেশগুলো অনুমোদনকারী সেনাপ্রধান। কিন্তু আক্রমণ সফল হয়নি। কারণ তার গাড়িটি বুলেটপ্রুফ ছিল।
৮- আমাদের জিহাদী জামাতের ভায়েরা প্রধানমন্ত্রী আতিফ সিদকীর গাড়িবহরে বোমাভর্তি গাড়ি নিয়ে হামলা করেন। কিন্তু প্রধামন্ত্রীর গাড়ির পিছনের অংশে কিছু স্ফুলিঙ্গ লাগতেই তা বিস্ফোরণ এড়িয়ার বাইরে চলে যাওয়াতে প্রধানমস্ত্রী আক্রমণ থেকে রক্ষা পায়।
উল্লেখিত আক্রমণের ফলে শিমা নামে এক কণ্যা শিশু নিহত হয়। সে পার্শ্ববর্তী একটি বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ছিল। সে ঘটনাস্থলের নিকটেই দাঁড়িয়ে ছিল।
সরকার শিশু শিমা (আল্লাহ তার প্রতি রহম করুন!) এর নিহত হওয়াকে সুযোগ হিসাবে কাজে লাগায়। ঘটনাকে এভাবে চিত্রিত করে যে, এটা জিহাদী জামাতের পক্ষ থেকে শিশু শিমার উপরই আক্রমণ ছিল। প্রধানমন্ত্রী আতিফ সিদকীর উপর ছিল না।
সংবাদপত্রগুলো শিমার পিতামাতার এমন ছবি প্রকাশ করে যে, তারা তাদের কণ্যার জন্য কাঁদছেন। আর শিমার অতি শিশুকালের ছবিগুলোও অঙ্কন করে। এ সকল কার*্যাবলীর মাধ্যমে জনগণের আবেগে নাড়া দেওয়ার চেষ্টা করে। যেন মুজাহিদগণ ও সরকারের মাঝে লড়াইয়ের মূখ্য বিষয়টি থেকে মানুষের দৃষ্টি দূরে সরে যায়।
এ কর্মপন্থাগুলো আমেরিকান সেনাবাহিনীর ‘সন্ত্রাস মোকাবেলা টিম’এর পক্ষ থেকে প্রদত্ত পরামর্শগুলোর সাথে মিলে যায়, যেখানে তারা শিমা (রহিমাহাল্লাহ)এর হত্যা প্রসঙ্গে এ কিতাবের (প্রথম সংস্করণের) কিছু বক্তব্য উদ্ধৃত করে এবং ‘শিমার স্মৃতি’ নামে নিজেদের পক্ষ থেকে একটি পরিভাষা আবিস্কার করে। তারপর তারা তাদের মন্তব্য হিসাবে যা বলেছে, তার অনুবাদ হল:
“মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সরকারের অবশ্যই উচিত এই প্রচারাভিযানে অর্থায়ন করা, যা জিহাদীদের বিরুদ্ধে মুসলিম জনমত তৈরীতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। তবে খুব সূক্ষ্ম ও পরোক্ষভাবে হতে হবে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে অবশ্যই ‘শিমার স্মৃতি’ নামক শক্তিটিকে বিশেষভাবে কাজে লাগাতে হবে। অর্থাৎ ওই সমস্ত জিহাদী আক্রমণের চিত্রগুলো প্রচার করার মাধ্যমে, যাতে মুসলিম শিশুদের হত্যা করা হয়েছে।
পূর্বোল্লেখিত পয়েন্টগুলোর আলোকে উক্ত অঞ্চলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রত্যক্ষ কার্যক্রমের ভয়াবহ প্রভাব সুস্পষ্ট হয়ে গেছে। তাই আমেরিকাকে অবশ্যই পর্দার আড়ালে থেকে কাজ করতে হবে।
একারণে পূর্বোক্ত পদ্ধতিতে প্রচারণা যুদ্ধ অবশ্যই পেশাদার ব্যক্তিদের পক্ষ থেকে বিশেষ গুরুত্বের মাধ্যমে পরিচালনা করতে হবে, যারা হুবহু সেই তথ্যপ্রযুক্তি ও বিশেষায়িত গ্রুপগুলো ব্যাবহার করবে, যা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র শীতলযুদ্ধে যোগ্যতার সাথে ব্যবহার করেছিল।”১
আমাদের হামলা কার্যকরকারী ভায়েরা আক্রমণ স্থলের তথ্য সংগ্রহের সময় একটি নির্মাণাধীন বিদ্যালয় ভবন দেখতে পেয়েছিলেন। তাই তারা ধারণা করেছিলেন সেটা শিক্ষার্থীশূণ্য। কিন্তু পরে জানা গেছে বিদ্যালয়ের বহিরাংশ শুধু সংস্কারাধীন ছিল, বাকি বিদ্যালয় চালু ছিল।
আমরা এই নিরপরাধ শিশুটির অনিচ্ছাকৃত হত্যায় ব্যথিত হয়েছি। কিন্তু আমাদের উপায় কী?? আমাদেরকে তো আল্লাহর শরীয়ার সাথে যুদ্ধকারী এবং আল্লাহর শত্রুদের সঙ্গে বন্ধুত্বকারীদের বিরুদ্ধে জিহাদ করে যেতে হবে।
আমরা অনেকবার জনগণকে সতর্ক করেছি, বিশেষত: স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হাসন আলফীর উপর আক্রমণের পরে- যেন তারা সরকারি বাহিনীর অবস্থান, বাসগৃহ ও তাদের চলাফেরার পথ থেকে দূরে থাকেন।
আর সরকারী সদস্যরা তো বাসগৃহ, অফিস ও যানবাহনের ক্ষেত্রে জনগণ থেকে বিশেষ দূরত্ব অবলম্বন করে না। বরং তারা জনগণের সাথে মিশে যায়, তাদের ভিড়ে আত্মরক্ষা করে। তাই আমাদের জন্য জনগণকে সতর্ক করার সাথে তাদের উপর আক্রমণ করা ব্যতিত কোন উপায় নেই।
ভাই সায়্যিদ সালাহকে প্রসিকিউশন তদন্তে শিশু শিমা হত্যার ব্যাপারে জানতে চাওয়া হলে তিনি তার বক্তব্যে এ অবস্থানটি সংক্ষেপে এভাবে তুলে ধরেছেন যে: তিনি এ শিশুর নিহত হওয়ায় দুঃখ প্রকাশ করছেন, কিন্তু জিহাদ থেমে থাকতে পারে না।
আমি এ মাসআলা আমার “শিফা উ সুদুরিল মুমিনীন” নামক পুস্তিকায় বিস্তারিত ব্যাখ্যা করেছি।
এ ধরণের নিক্ষেপের ফলে অনিচ্ছাকৃতভাবে মুসলিমগণ আক্রান্ত হয়ে যাওয়া সম্পর্কে যত মতামত পাওয়া যায়, তন্মধ্যে ইমাম শাফী রহ. এর মতটি আমরা গ্রহণ করলাম। তা হল: নিহতের অভিভাবকদেরকে দিয়্যত আদায় করা। যেহেতু এ মাসআলায় এ মতটিই সর্বাধিক সতর্কতাপূর্ণ।
একারণে আমরা মনে করি, এ ধরণের অভিযানে অনিচ্ছাকৃতভাবে মুসলিমদের নিহত হয়ে যাওয়া একটি দূর্ঘটনা। তাই আমাদেরকে নিহতের অভিভাবককে দিয়তের হক প্রদান করতে হবে।
আমার ওকীল আইনজীবি অধ্যক্ষ মাহফুজ আয্যাম আমার পক্ষ থেকে সাধারণ দায়িত্বপ্রাপ্ত হিসাবে মিশরীয় আদালতে একটি মামলা উত্থাপন করেন, যাতে তিনি কারাগারে আমার উপর চালানো নির্যাতনের বদলা দাবি করেন। তখন আদালত তার পক্ষে ৩০০০ পাউন্ড পরিমাণ ক্ষতিপূরণ প্রদানের রায় দেয় এবং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয় তাকে জানায়, ক্ষতিপূরণ রাষ্ট্রীয় গোয়েন্দা বিভাগের অফিসে বিদ্যমান আছে। আইমান আল-জাওয়াহিরী চাইলে তা গ্রহণ করতে আসতে পারে!!
আমার এ ক্ষতিপূরণ গ্রহণ করা সম্ভব নয় দু’কারণে: প্রথমত: এ রায় একটি ধর্মনিরপেক্ষ আদালত থেকে পাস হয়েছে, যা আল্লাহর অবতীর্ণ বিধান ব্যতিত ভিন্ন বিধান দিয়ে বিচার করে। দ্বিতীয়ত: আমি এ সকল অপরাধীদের থেকে যে নির্যাতনের সম্মুখীন হয়েছি, তা বিক্রি করতে চাই না। হয়ত তারা আল্লাহর নিকট তাওবা করে ইসলামে ফিরে আসবে। তখন আমি তাদের উপর আমার যত হক আছে, সব ছেড়ে দিব। অথবা তারা তাদের অপরাধের উপরই চলতে থাকবে। তখন আমি আমার হক ও প্রতিটি মুসলিমের হক দুনিয়া ও আখিরাতে তাদের নিকট দাবি করব। কারণ তারা আমাকে তাদের মাঝে ও আমার মাঝে ব্যক্তিগত মতবিরোধ থাকার কারণে নির্যাতন করেনি। বরং তারা ইসলামের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে আমাকে নির্যাতন করেছে।
আমি “আত-তাবরিআ” কিতাবে তা দাবি করেছিও। এখন আমি দ্বিতীয়বার আমার ওকীল আইনজীবি মাহফুজ আয্যামের নিকট আবেদন করছি, তিনি যেন রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা বিভাগকে এই অর্থ শিমার পিতাকে প্রদান করার আবেদন করেন। এটা তার দিয়্যাতের প্রাথমিক কিছু এবং আমার পক্ষ থেকে তার প্রতি শুভ ইচ্ছার ভূমিকা। আল্লাহর নিকট প্রার্থনা করি, তিনি যেন বাকিটা আদায় করার ব্যাপারে আমাদেরকে সাহায্য করেন।
আমরা যদি শিমার ঘটনাটিকে বিশুদ্ধ মাপকাঠিতে রাখতে চাই, তাহলে আমাদেরকে পাল্লার অপর পাশে আমাদের সেসকল কণ্যা ও স্ত্রীদের রাখতে হবে, যারা বিনা অপরাধে ইয়াতিম হয়েছেন, বিধবা হয়েছেন। বরং তাদের পিতা ও স্বামীগণ সর্বাধিক মর্যাদাপূর্ণ দায়িত্ব, তথা আল্লাহর পথে জিহাদের ফরজ দায়িত্ব পালন করার কারণে ইয়াতিম ও বিধবা হয়েছেন।
একবার সরকার আমাকে ও আমার সাথে ২৮৫ জন ভাইকে আদালতে নিয়ে যায়। সরকারপক্ষ আমাদের সকলের মৃত্যুদণ্ডের দাবি জানায়। অর্থাৎ আমার দুই শিশু কণ্যার উপরও মৃত্যুদণ্ডাদেশ জারির আবেদন জানায়, যারা মাত্র দু’বছর বয়সে পৌঁছেছিল। আমার ভায়ের কণ্যাদেরকেও ইয়াতিম করার আবেদন জানায়। তখন কে আমাদের কণ্যাদের জন্য কেঁদেছিল? কে তাদের জন্য পেরেশান হয়েছিল???
ভাই সায়্যিদ কারনীর গৃহে পুলিশ প্রবেশ করল। যখন পিস্তলের গুলিতে তার কণ্যা ভয় পেতে লাগল, তখন পুলিশ তৎক্ষণাৎ তাকেও নিহতের সারিতে পাঠিয়ে দিল। তখন কে সায়্যিদ কারনীর কণ্যার জন্য কেঁদেছিল?? রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা বাহিনীর হাতে কারারূদ্ধ, নির্যাতিত ও ভীত-সন্ত্রস্ত্র হাজারো পূত-পবিত্রা সরল মুসলিম বোনদের জন্য কে কেঁদেছিল?
এছাড়াও আমাদের আরো কয়েক দশক হাজার স্ত্রী, বোন ও মা গণ কারাগারের দরজায় দাঁড়িয়ে আছেন তাদের সন্তান, ভাই ও স্বামীদেরকে দেখার জন্য; কে তাদের দুর্দশা নিয়ে চিন্তা করে?
তোরা অভ্যর্থনা কারাগারের সামনে আব্দুর রহমানের স্ত্রী ও তার তিন বছর বয়সী কণ্যা খাদিজাকে পুলিশ অমানবিকভাবে আঘাত করার ফলে আব্দুর রহমানের স্ত্রীর হাত ভেঙ্গে যায়। কারণ একজন বন্দি কারাগার থেকে আদালতে যাওয়ার পথে অপেক্ষমান মা গণ কান্নাকাটি ও চিল্লাচিল্লি শুরু করেন। পুলিশ তাদেরকে বলল: “বন্দিরা মরবে, তোমরা যা ই করো। তোমরা এটর্নি জেনারেলের নিকট যাও।” আশ শাব’ পত্রিকা আব্দুর রহমানের স্ত্রী ও তার ব্যান্ডেজ করা হাতের ছবি প্রকাশ করে। তার পাশে ছিল তার কণ্যা খাদিজা।
তারপর আসুন, আমরা বিষয়টিকে এর চেয়ে স্পষ্ট দিক থেকে বিবেচনা করি। এই ভ্রান্ত শাসনব্যবস্থা আমাদের প্রতিটি কণ্যার ব্যাপারে কী চায়?? চাই শিমা হোক বা অন্য কেউ হোক।
কারা ইসলামী শিষ্টাচারিতার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে আমাদের কণ্যাদেরকে পশ্চিমা বেশ-ভূষা ও রীতি-নীতির উপর বাধ্য করার জন্য স্কুলগুলোতে হিজাব এবং বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে নেকাব নিষিদ্ধ করে? কারা মিডিয়ায় অশ্লীলতার প্রসার ঘটায় ও হীনকাজে উৎসাহিত করে?
বস্তুত আমরাই আমাদের কণ্যাদেরকে ও সমস্ত মুসলিমদের কণ্যাদেরকে এবং এই শিমাকে ও প্রতিটি শিমাকে হেফাজত করার জন্য ইসলামের বিরুদ্ধে যুদ্ধরত মুরতাদ সরকারের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছি।
.............
১. Stealing Al-Qa’ida’s Playbook, P: 18 &19.
Comment