তৃতীয় অধ্যায়: ময়দানে প্রত্যাবর্তন-তৃতীয় পরিচ্ছেদ-মিশরের অভিযান সমূহ
(পূর্ব প্রকাশের পর)
৯- আমাদের আল জামাআতুল ইসলামিয়ার ভায়েরা এক গাড়ির দোকান-মালিককে হত্যা করেন। কারণ আমাদের ভাই সায়্যিদ সালাহ তার দোকানের সামনে দিয়ে নিজ গাড়ি চালিয়ে যাওয়ার সময় সে তাকে চিনতে পেরে ধাওয়া করে। অতঃপর তিনি পেট্রল ষ্টেশনের সামনে থামলে সে এ সুযোগে তাকে ধরার জন্য লোকজনের মধ্যে জোরে চিৎকার মারে। ফলে লোকজন তাকে ধরে দেয়। অতঃপর সে তাকে পুলিশে সুপর্দ করে। এজন্য আমাদের ভায়েরা তার পরের রাতেই তাকে হত্যা করেন, কারণ সে সামরিক আদালতে আমাদের ভাইদের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিয়েছিল। ফলে এটা সামরিক আদালতের বিচারকের জন্য বড় ধাক্কা হয়। সে আমাদের ভাইদের তাকীবর ধ্বনির মাঝেই ইজলাস শুরু করে দিয়েছিল, কিন্তু তারপর সাথে সাথেই সমাপ্ত করে দেয়। ভাই সায়্যিদ সালাহ গ্রেফতারের সময়ই তাকে হুমকি দিয়েছিলেন যে, সে কিছুতেই আল্লাহর শাস্তি থেকে বাঁচতে পারবে না। ফলে আল্লাহ তার হুমকি সত্যে পরিণত করলেন।
১০- এমনিভাবে আমাদের জিহাদী জামাতের ভায়েরা হুসনি মোবারকের গাড়িবহরে হামলার জন্য সালাহ সালিম সড়কে একটি কমান্ডো দল প্রস্তুত করেন। কিন্তু সে ঈদের নামাযে যাওয়ার সময় এ পথে যায়নি। এর পর পরই সিদিপ্রাণী বিমান বন্দরে হুসনি মোবারককে হত্যা চেষ্টা চালানো হয়। অভিযানটি পরিচালনা করেছিলেন আল জামাআতুল ইসলামিয়ার ভাইগণ। কিন্তু আক্রমণ পরিচালনার পূর্বে তথ্য ফাঁস হয়ে যাওয়ার কারণে তা সফল হয়নি।
১১- রউফ খায়রাত ইসলামের বিরুদ্ধে যুদ্ধকারী রাষ্ট্রীয় গোয়েন্দা অফিসারদের মধ্যে একজন ভয়ংকর অফিসার ছিল। সে কয়েক ধরণের কঠোর নিরাপত্তা সতর্কতা গ্রহণ করত। যেমন, প্রতি কয়েক মাস পর পর বাসা চেঞ্জ করা, বাড়িতে কোন প্রহরী না রাখা, নিজের গাড়ি নিজেই ড্রাইভ করা। যেন একজন সাধারণ লোকের অবস্থা প্রকাশ পায়, যার সরকারের সাথে কোন সম্পর্ক নেই। কিন্তু আল-জামাআতুল ইসলামিয়ার ভায়েরা তার পর্যন্ত পৌঁছতে সমর্থ হন। সে তার বাসা থেকে বের হয়ে গাড়িতে আরোহনের সময় মুজাহিদ ভাইদের একজন তার নিকটবর্তী হয়ে গাড়ির ভিতরে হাতবোমা নিক্ষেপ করেন। সঙ্গে সঙ্গে সে নিহত হয়। পরবর্তীতে পুলিশ ভোজের সময় হুসনি মোবারক তার স্ত্রীকে একটি পদক উপহার দেয়। যদিও এটা তাকে জাহান্নামের আগুন থেকে রক্ষা করতে পারবে না।
১২- আল জামাআতুল ইসলামিয়া আরো উপরে উঠে গেল। ১৯৯৫ এর গ্রীষ্মে আদিস আবাবায় হুসনি মোবারকের গাড়িবহরের উপর হামলা করল। কিন্তু আক্রমণে ব্যবহৃত দু’টি গাড়ির একটি অচল হয়ে যাওয়ার কারণে আক্রমণ সফল হল না, হুসনি মোবারক বেঁচে গেল।
১৩- আমাদের জামাতুল জিহাদের ভায়েরা কাছাকাছি সময়ে দুটি আক্রমণ পরিচালনার প্ল্যান করলেন। একটি দেশের বাইরে ১৯৯৫ এর হেমন্তে ইসলামাবাদস্থ মিশরীয় দূতাবাস গুড়িয়ে দেওয়া। এটি আল্লাহর অনুগ্রহে সফল হয়েছে। আরেকটি দেশের ভিতরে, ইসরাঈলী পর্যটকদের বিরুদ্ধে। কিন্তু এটি বাস্তবায়নের পূর্বেই ফাঁস হয়ে যায়। সরকার এটাকে ‘খানখলিলী ট্রাজেডি’ নামে নামকরণ করেছে।
১৪- ১৯৯৬ সালের জুলাইয়ে আল জামাআতুল ইসলামিয়ার পক্ষ থেকে কথিত সহিংসতা বন্ধের একতরফা উদ্যোগ প্রকাশিত হয়। আসওয়ানে অবস্থানকারী আল জামাআতুল ইসলামিয়ার দায়িত্বশীল খালিদ ইবরাহিম এবং আল জামাতুল ইসলামিয়ার মামলায় গ্রেফতার আসামীগণ এর তত্ত্ববাধন করে। অতঃপর ১৯৯৭ এর জুলাইয়ে আল জামাআতুল ইসলামিয়ার আরেকটি মামলায় পুনরায় লিমান তোরা ও আকরাবে অবস্থানকারী আল জামাআতুল ইসলামিয়ার নেতৃবৃন্দের নামে ঘোষণা প্রকাশিত হয়। উক্ত ঘোষণায় আল জামাআতুল ইসলামিয়ার বাহিরের ও ভিতরের সদস্যদেরকে সকল ধরণের সামরিক অভিযান ও তার প্রতি উৎসাহমূলক বক্তব্য প্রদান বন্ধ করতে আহ্বান করা হয়। আর আল জামাআতুল ইসলামিয়া তাদের উদ্যোগের ব্যাপারে সরকারের পক্ষ থেকে সাড়া প্রদান কামনা করে।
১৫- ১৯৯৭ এর ১৮ই সেপ্টেম্বর। মুজাহিদ সাবির ফারহাত, তার ভাই ও তৃতীয় আরেকজন কায়রোর তাহরির স্কয়ারের পাশে অবস্থিত স্মৃতি জাদুঘরের সামনে ট্যুরিস্ট বাসের উপর হামলা পরিচালনা করেন। এই অভিযানের ফলাফল ছিল ১০ জন নিহত। যাদের মধ্যে ৯ জন জার্মানী। ভাই সাবির ফারহাত প্রাথমিক তদন্তের সময় উল্লেখ করেছেন যে, তিনি যা করেছেন, এটা নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে নিয়ে ইহুদিদের ঠাট্টা এবং ফিলিস্তীনী মুসলিমদের সাথে তাদের আচরণের প্রতিশোধ।
ইতিপূর্বে সাবের ফারহাত ‘সামিরামিস’ হোটেলে আইনসভার সদস্যদের উপর আক্রমণ করেছিলেন। সরকার তাকে পাগল বলে অপবাদ দিয়ে মানসিক হাসপাতালে রাখে। কিন্তু তিনি হাসপাতালের কর্মীদেরকে ঘুষ দিয়ে সেখান থেকে পলায়ন করতে সক্ষম হন। তারপর মিশরীয় যাদুঘরের বিরুদ্ধে অভিযানে অন্যান্য মুজাহিদগণের সাথে অংশগ্রহণ করেন।
সাবির ফারহাত তার আদালত-শোনানীর সময় সুস্পষ্টভাবে বলেছিলেন যে, তিনি জামাআতুল জিহাদের প্রচারপত্রগুলোর মাধ্যমে অনুপ্রাণিত হয়েছেন।
১৬- ১৯৯৭ সালের নভেম্বরে আল জামাআতুল ইসলামিয়ার একদল ভাই পশ্চিমা পর্যটকদের বিরুদ্ধে ‘আকসার’ এর অভিযান পরিচালনা করেন। মুজাহিদগণ আল জামাআতুল ইসলামিয়ার বন্দিদেরকে এবং মহান শায়খ ওমর আব্দুর রহমানকে মুক্তি দেওয়ার দাবি জানান। তারা স্পষ্টভাবে জানান যে, এই অভিযান আল জামাআতুল ইসলামিয়ার সেসকল ভাইদের প্রতিশোধের জন্য, যাদেরকে নির্যাতন করে হত্যা করা হয়েছে। কিন্তু নিরাপত্তা বাহিনী উক্ত স্থানে আক্রমণ করল এবং সেখানে যত লোক ছিল, সকলকে হত্যা করার পূর্ব পর্যন্ত নিবৃত্ত হল না। তারপর সরকার প্রচার করল: আক্রমণকারীরা ৮৫ জন পর্যটককে হত্যা করেছে!
১৭- ১৯৯৯ সালের আগষ্টে আল জামাআতুল ইসলামিয়ার অধীনস্ত চার ভাই মিশরের ভিতরেই ‘জিযা’ জেলার কোন এক গ্রামে একত্রিত হলে পুলিশের হাতে নিহত হন, যদিও আল জামাআতুল ইসলামিয়া সহিংসতা থেকে বিরত থাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তাদের মাঝে ছিলেন আল জামাআতুল ইসলামিয়ার মিনিয়া অঞ্চলের আমির ফরিদ সালিম কাদওয়ানী, যাকে দীর্ঘদিন ধরে পুলিশ খুঁজছিল।
১৮- ১৯৯৯ এর আগষ্ট মাস। হুসনি মোবারক তার চতুর্থ টার্মের প্রেসিডেন্সির বৈধতা আদায়ের জন্য প্রচারণা অভিযানের কাজে বুর সাঈদ জেলা সফরকালে তাকে হত্যার জন্য দু:সাহসী অভিযান চালান বাহাদুর সায়্যিদ হুসাইন মাহমদু সুলাইমান। বুর সাঈদের মহাসড়ক অতিক্রম করার সময় হুসনি মোবারক নিজ গাড়ির পিছনের ডান পাশের সিটে উপবিষ্ট ছিল। সে গাড়ির জানালা দিয়ে জনতার উদ্দেশ্যে হাত নাড়াতে নাড়াতে একটি নির্মাণাধীন ভবনের নিকট দিয়ে যাওয়ার সময় উক্ত বাহাদুর ভবনের দেয়াল থেকে লাফিয়ে পড়ে দ্রুত গাড়ির দিকে ছুটেন। হুসনি মোবারকের সাথে ঘেষা গাড়ির জানালার কাঁচ ধরার জন্য গাড়ির পিছনে পিছনে দৌড়াতে থাকেন। তার এক হাতে ছিল সালফিউরিক অ্যাসিড(আগুনের পানি)-ভর্তি একটি বোতল, অপর হাতে ছিল গরম করা ধারালো ছুরি। গাড়ির দিকে যেতে যেতে হুসনি মোবারককে লক্ষ্য করে আগুনের পানি নিক্ষেপ করতে থাকেন। তারপর এই বাহাদুর দ্রুত হুসনি মোবারকের উপর ছুরি দিয়ে আক্রমণ করেন। ফলে তার বাহুর উপরিভাগে আঘাত লাগে। এ মুহূর্তেই প্রেসিডেন্টের রক্ষীবাহিনীর প্রধান মেজর জেনারেল ইবরামি আশ শায়িব বাহাদুরকে প্রতিহত করে। ফলে তার হাতের আঙ্গুলে কঠিন আঘাত লাগে। তারপর রক্ষীবাহিনী এই বাহাদুর ভাইয়ের উপর আগুন ছুড়ে দেয়। ফলে তিনি তৎক্ষণাৎ নিহত হয়ে পড়ে গেলেন। আমরা আল্লাহর নিকট প্রার্থনা করি, তিনি তাকে শহীদগণের মাঝে কবুল করুন।
ইখওয়ানুল মুসলিমীন এ সুযোগকে গনিমত মনে করল। তারা এই হত্যাচেষ্টর নিন্দা প্রকাশ করল এবং বলল: “আমরা মহান প্রেসিডেন্টের মুক্তিতে আল্লাহর প্রশংসা করছি!”
১৯- ‘তাবা’ বোমা হামলাসমূহ।
ক. ২০০৪ সালের ৭ অক্টোবর বৃহস্পতিবার সন্ধায় হিল্টন তাবা হোটেলে বোমা বিস্ফোরণ ঘটে, যা ১৯৮২ সালে ইসরাঈল সিনাই থেকে প্রস্থানের পূর্বে নির্মাণ করেছিল। এরপরই আরো দু’টি বিস্ফোরণ ঘটে তাবার দক্ষিণে অবস্থিত ‘তারাবিন’ ও ‘রাস আল-সুলতান’ পর্যটন রিসোর্টদ্বয়ে।
খ. মিশরীয় পরিসংখ্যান মতে এ সকল বিস্ফোরণের সর্বশেষ ফলাফল হল ৩৪ জন নিহত, যার মধ্যে ৫ জন মিশরীয় এবং ২৩ জন ইসরাঈলী, ১৩৫ জন আহত এবং ৩০ জন নিখোঁজ।
গ. তাবা হিল্টন হোটেলে ৮১২ জন অতিথি ছিল, যার মধ্যে ১০৮ জন মিশরীয় এবং বাকিরা রাশিয়ান ও বৃটিশ বংশোদ্ভুত ইসরাঈলী। ইহুদিদের প্যারাসোট উৎসবের সাথে তাল মিলিয়ে ছুটি হয়েছিল, যে উৎসবে তারা হিব্রুয়ানদের সিনাই যাত্রার স্মৃতি পুনরুজ্জীবিত করে থাকে। এতে তারা কিছু হীন ও বৈষয়িক উদ্দেশ্যে (যেমন হোটেল মূল্য হ্রাস করা) সিনাই অভিমুখে সফর করাকে মর্যাদাকর মনে করে। সাধারণত: এ সময়ই বিশাল সংখ্যক ইহুদি ও ইসরাঈলীরা সিনাইয়ের স্বল্পমূল্যের রিসোর্টগুলোতে যায়। এমনকি ইসরাঈলী পরিসংখ্যানমতে তাদের সংখ্যা উক্ত বোমা হামলাগুলোর পূর্বে ৬১ হাজারে পৌঁছেছিল। আর বোমা হামলার সময় তাদের মধ্যে ১৫ হাজার অবশিষ্ট ছিল। কারণ ইসরাঈলী নিরাপত্তা বাহিনীর পক্ষ থেকে মিশর সফরের ব্যাপারে এই বলে সতর্ক করা হয়েছিল যে, তাদের বিরুদ্ধে হামলা হতে পারে। তাদের অধিকাংশই মিশর-ফিলিস্তীন সীমান্তের নিকটবর্তী তাবার রিসোর্টগুলোতে অবস্থান করেছিল।
প্রতি বছর অক্টোবর থেকে ফেব্রুয়ারী মাস পর্যন্ত সময়টিকে শীতকালীন ভ্রমণের ঋতু মনে করা হয়। এ সময় সিনাইয়ের বিভিন্ন শহর- যেমন তাবা, শারম আশ-শায়খ, নোয়েবা প্রভৃতি শহরে ভ্রমণ করা হয়। ৮০% এরও অধিক পর্যটনকারী থাকে ইসরাঈলী। বিশেষত: তাবা এলাকাটি সীমান্তের মাত্র ২০০ মিটারের ভিতরে হওয়ার কারণে এটি ইসরাঈলীদের পর্যটন রিসোর্ট হিসাবে পরিচিত। মিশরীয়গণ খুব বেশি এগুলো পরিদর্শনে আসে না। ইয়েডিট আহারনোট পত্রিকায় প্রকাশিত পরিসংখ্যানমতে ইসরাঈলী পর্যটন মন্ত্রী বলেছে: গত আগষ্ট মাসে ইসরাঈল থেকে সিনাই পর্যটনের একটি আনুমানিক সংখ্যা লিপিবদ্ধ করা হয়েছে, যেখানে দেখা গেছে, সিনাইয়ে সমাগম করার জন্য ৮৯ হাজার ইসরাঈলী সীমান্ত অতিক্রম করেছে।
মিশরীয় পর্যটন মন্ত্রী বলে:
“বছরে ৩ লাখ ইসরাঈলী পর্যটক সিনাইয়ে আসেন।” সে এটাও স্বীকার করে যে, “স্থানীয় পর্যটকদের তুলনায় তারাই সংখ্যাগরিষ্ট।”
ঘ. আল জামাআতুল ইসলামিয়ার পশ্চাদপসরণকারী নেতৃবৃন্দ এ ঘটনার সমালোচনা করে বলে: এটা উপযুক্ত স্থান ও সময়ে হয়নি। এমনভিাবে ইখওয়ানুল মুসলিমীনও তাবার বোমা হালমাগুলোর দায় চাপানোর ক্ষেত্রে এভাবে বিবৃতি প্রকাশ করে:
“আরব সরকারগুলো ফিলিস্তীনে ইসরাঈলী হত্যাযজ্ঞ এবং ইরাকে আমেরিকার বর্বর আক্রমণের ব্যাপারে নিরব হয়ে গেছে।”
বক্তব্যের এক পর্যায়ে উল্লেখ করে:
“এ সকল বোমা হামলাগুলোর মাধ্যমে একমাত্র উপকৃত হয় ইসরাঈলী প্রধানমন্ত্রী আরিয়েল শ্যারন। সে এর মাধ্যমে অধিকৃত ফিলিস্তীনে নিজের কৃত অপরাধযজ্ঞ থেকে লোকদের দৃষ্টি ফিরিয়ে রাখে আর ফিলিস্তীনের বৈধ প্রতিরোধ আন্দোলনের মাঝে ও সন্ত্রাসবাদের মাঝে যোগসূত্র খোঁজার পায়তারা করে। এভাবে ফিলিস্তীনী প্রতিরোধের বিরুদ্ধে সরকার ও জনগণের সমর্থন আদায়ের চেষ্টা করে।”
Comment