তৃতীয় অধ্যায়: ময়দানে প্রত্যাবর্তন-তৃতীয় পরিচ্ছেদ: মিশরের অভিযান সমূহ
(পুর্ব প্রকাশের পর)
কোন প্রশ্নকারী প্রশ্ন করতে পারে: এখানে নতুন কী হল? এগুলো কি বরকতময় মিশরের নিত্যদিনের ঘটনা নয়? নির্যাতন করা, আঘাত করা, পিটানো, নারীদেরকে বন্ধকরূপে আটক করা। উত্তর: ঠিক বলেছেন, কিন্তু এবার সরকারের চেহারা এমনভাবে উম্মোচিত হয়ে পড়েছে, যেভাবে ইতিপূর্বে হয়নি। সিনাইয়ে নিকৃষ্ট ইসরাঈলী বাণিজ্যের কারণে সরকার এ ধরণের দলবদ্ধ অপরাধগুলোতে লিপ্ত হয়েছে এবং এ ধরণের নিষ্ঠুরতা ও নিম্নতা ঘটিয়েছে।
কেউ প্রশ্ন করতে পারে: কতকাল পর্যন্ত এ পশুগুলো এ সকল অপরাধযজ্ঞ চালিয়ে যাবে? উত্তর: যতক্ষণ পর্যন্ত আমরা তাদের প্রতিরোধ না করব এবং তাদেরকে শক্তিবলে তাদের সীমার মধ্যে থামিয়ে না দিব। আর এটা কখনো জিহাদ ছাড়া হবে না।
আরেকটা প্রশ্ন সৃষ্টি হতে পারে: এটাই কি সেই সরকার, যারা শিমার জন্য মায়াকান্না দেখাত? এটাই কি সেই সরকার, কিছু কিছু লোক আমাদেরকে ইসরাঈলের বিরুদ্ধে যাদের সাথে ঐক্যবদ্ধ হতে বলে? এটাই কি সেই সরকার, যাদেরকে আল জামাআতুল ইসলামিয়ার পশ্চাদপদ নেতাগণ ইসলামী সরকার বলে গণ্য করে এবং তার প্রধান অপরাধীকে মুসলিমদের দায়িত্বশীল বলে গণ্য করে। এই সরকারেরই কি ইখওয়ানুল মুসলিমীন সাফাই গায় এবং তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ-জিহাদ করার নিন্দা করে।
ট- স্বভাবতই সিনাইয়ের গোত্রগুলো এ সকল জুলুম ও অপরাধের বিরুদ্ধে জেগে উঠবে। তাই সরকার ২০০৫ এর ফেব্রুয়ারির প্রথমদিকে গ্রোত্রীয় পুরুষদের বিরুদ্ধে আসামীদেরকে আশ্রয় প্রদানের অভিযোগ তুলে তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের জন্য ৫ হাজার সৈন্যবাহিনী নিয়ে হামলে পড়ল। সরকারী বাহিনী বিশাল ক্ষয়-ক্ষতির সম্মুখীন হলেও তা গোপন করল। শুধুমাত্র তিনজন পুলিশ সদস্য নিহত হওয়ার সংবাদ প্রচার করল।
২০- ২০০৫ এর মার্চে জনৈক মিশরী মধ্য কায়রোতে দু’জন হাঙ্গেরিয়ান পর্যটককে আমেরিকান ভেবে ছুরিকাঘাত করেন। যেটাকে পুলিশ ফিলিস্তীন ও ইরাকের ব্যাপারে পশ্চিমা রাজনীতির পাল্টা জবাব বলে অভিহিত করে।
২১- আল আযহারের ঘটনা:
২০০৫ এর এপ্রিলের ৭ম তারিখে মুজাহিদ হাসান রাফাত বাসিন্দি আল আযহার এলাকার জাওহারুল কায়িদ রোডে একটি ইস্তেশহাদি হামলা করেন। তাতে হামলা পরিচালনাকারী ভাই, দুই ফরাসি ও এক আমেরিকান সহ মোট চারজন নিহত হয় এবং অন্য ১৮ জন আহত হয়। যাদের অর্ধেক মিশরীয়, বাকিরা ভিনদেশি। চারজন আমেরিকান, তিনজন ফরাসি, একজন ইতালিয়ান এবং একজন তুর্কি।
এর প্রতিক্রিয়া হিসাবে সরকারি বাহিনী শিবরাল খিমায় (হাসান রাফাত বাসিন্দির এলাকা) ন্যাক্কারজনক হামলা চলাল। সেখানকার হাজার হাজার মানুষকে গ্রেফতার করল। যাদের মধ্যে ছোট ছোট মেয়ে শিশু ও যুবতী মেয়েরাও ছিল। গ্রেফতারকৃতদের মধ্যে কিছুসংখ্যক নির্যাতনের মুখে নিহত হন। আর স্বাভাবিকভাবেই হাসান বাশিন্দির সম্পূর্ণ পরিবারকে গ্রেফতার করে, যাদের মধ্যে আছে তার মা বোন, এমনকি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ছাত্রী তার শিশু বোনকেও। এমনিভাবে তার খালা ও তার কন্যাদেরকেও।
ইখওয়ানুল মুসলিমীনের পশ্চাদপদ নেতারা যথারীতি এই হামলার নিন্দা জানিয়ে বলেন: এই বোমাবাজি শরীয়ত বিরোধী, এটা শত্রুদের স্বার্থসেবা করবে। আমি জানি না, কারা শত্রুদের স্বার্থসেবা করছে?
২২- ২০০৫ এর ৩০ এপ্রিল মুজাহিদ ইহাব ইসরি ইয়াসিন, যিনি আযহারের ঘটনায় একজন আসামি- মধ্য কায়রোর মিশরীয় জাদুঘরের নিকটে আব্দুল মুনঈম রিয়াদ ময়দানে ইস্তেশহাদি হামলা করেন, যাতে চারজন পর্যটক গভীর জখমসহ আহত হয়। দুই ইসরাঈলী, এক সুইডিশ এবং এক ইতালিয়ান।
এছাড়া ইয়াসরি ইয়াসিনের মুক্তির সম্বল ও ইবরাহিম খামিসের ঈমানের প্রতীক দুই মুজাহিদা ‘সায়্যিদা আয়েশা চত্তরে’ পর্যটন বাসে হামলা করেন। উক্ত ঘটনায় উভয়েই শাহাদাত বরণ করেন। সংবাদসূত্রগুলো নিশ্চিত করে যে, এ অভিযানদু’টি ছিল আযহারের ঘটনার জনৈক আসামীর চাচাত ভাই মুহাম্মদ সুলাইমান ইউসুফ কারাগারে তদন্তকালে মৃত্যু বরণ করার প্রতিশোধ।
ইখওয়ানুল মুসলিমীন এ ঘটনার নিন্দা জানায় এবং দাবি করে, এটা আমেরিকান ও ইহুদি এজেন্ডার গোড়ায় পানি ঢালবে।
২৩- শারম আশ শায়খের বোমা হামলাসমূহ:
২৩ জুলাই ২০০৫ সিনাইয়ের শারম আশ শায়খ শহরে মোট তিনটি বোমা হামলা হয়। তন্মধ্যে দু’টি বোমাভর্তি গাড়ি বিস্ফোরিত হয়: একটি গাযালা জারদান্স হোটেলে, অপরটি পুরান বাজার এলাকায়। আর একটি বোমা বিস্ফোরিত হয় হোটেলের নিকটবর্তী কার পার্কিং গ্যারেজে।
সরকারি সূত্রগুলো দাবি করে, উক্ত ঘটনায় ৬৮ জন মানুষ নিহত হয়, যাদের অধিকাংশই মিশরীয়।
বিদেশী নিহতরা বিভিন্ন দেশের ছিল। যাদের মাঝে বহু সংখ্যক বৃটিশ, তুর্কি, চেক, ডাচ, রাশিয়ান ও ইউক্রেনীয়ানরা ছিল। আরো মনে করা হয় যে, নিহতদের মধ্যে এক জন এরাবিয়ান ইসরাঈলীও ছিল।
সকলেই জানেন যে, শারম আশ শায়খ শহরে জুয়ার ক্যাসিনো আছে, যেখানে ইসরাঈলী পর্যটকরা অংশগ্রহণ করে থাকে, যেহেতু ইহুদি সমাজে নিষিদ্ধ জুয়ার প্রচলন রয়েছে।
এ বোমা হামলাগুলোর সময়টা ছিল তাবার বোমা হামলার ঘটনায় অভিযুক্তদের বিচার শুনানির কয়েক ঘন্টা পূর্বে।
শারম আশ শায়খকে মিশরের সর্বোচ্চ নিরাপত্তাঘেরা রিসোর্ট মনে করা হয়। কারণ শারম আশ শায়খ হল সর্বোচ্চ গুরুত্বপূর্ণ শহর, যেখানে ইহুদিবাদিরা কোন প্রবেশ-ভিসা ছাড়া পৌঁছে যেতে পারে।
শুধু তাই নয়, এটা পুরো দেশের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্ট। যেহেতু এটাই সর্বোচ্চ নিরাপত্তাবেষ্টিত শহর। দেশীয় রাজনীতির দিক থেকেও সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ, যেহেতু প্রেসিডেন্ট হুসনি মোবারক সারা বছরের দীর্ঘ সময় এখানে কাটায়। আর বহির্রাজনীতির দিক থেকেও সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ, যেহেতু রাজনৈতিক সভা-সম্মেলনের জন্যই এটা সর্বাধিক প্রসিদ্ধ শহর। চাই ফিলিস্তীন ইস্যু সম্পর্কিত হোক কিংবা ইরাক ইস্যু সংক্রান্ত হোক।
২৪- আগষ্ট ২০০৫। সিনাইয়ে বহুজাতিক বাহিনীর একটি গাড়িতে বিস্ফোরণ ঘটানো হয়। উক্ত বাহিনী তাদের দুই সদস্য নিহত হওয়ার কথা স্বীকার করে।
২৫- দাহব রিসোর্টে বোমা হামলাসমূহ:
২৪ এপ্রিল ২০০৬ সাল। দাহবের পর্যটন রিসোর্টে একই সময়ে তিনটি বোমা বিস্ফোরণ ঘটে, যা তাবা ও শারম আশ শায়খের মাঝামাঝি সিনাইয়ের পূর্ব উপকূলে অবস্থিত এবং যেখানে ইসরাঈলী পর্যটকদের খুব ভীড় থাকে, যারা সেখানে ভিসা ছাড়াই প্রবেশ করতে পারে। এই বিস্ফোরণের ফলে ৩০ জন নিহত এবং ১২০ জন আহত হয়।
আল কুদস পত্রিকা ‘হামাস সংগঠন’ সম্পর্কে একটি সংবাদ প্রকাশ করে, তাতে আসে:
“ফিলিস্তীনী প্রধানমন্ত্রী সরকারি সাপ্তাহিক সম্মেলনের শুরুতেই বলেন:
“মিশরের উত্তর সিনাইয়ের দাহব অঞ্চলে যে ন্যাক্কারজনক অপরাধ সংগঠিত হয়েছে, আমরা নতুন করে তার নিন্দা ও প্রতিবাদ জানাচ্ছি। আমরা মনে করি, এটা মিশরের জাতীয় নিরাপত্তার সাথে সম্পৃক্ত...”
.......................
সরকারী মুখপাত্র গাজী আহমাদ বলেন:
................
ফিলিস্তীন সরকার অত্যন্ত কঠোরভাবে এ ধরণের কর্মকাণ্ডের নিন্দা জানাচ্ছে, যাকে আমরা নৈতিকতা ও মূল্যবোধেরও পরিপন্থি মনে করি। এটা মিশরের জাতীয় নিরাপত্তাকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে।
হামাসের মুখপাত্র মুশির আল-মিশরী বলেন:
“নাগরিকদের বিরুদ্ধে এ ধরণের হামলা গ্রহণযোগ্য নয়। আরব ও ইসলামী অঙ্গনে এমন যেকোন বিশৃঙ্খলাই অগ্রহণযোগ্য, যা দেশের শৃঙ্খলা ও স্থিতিশীলতায় প্রভাব ফেলতে পারে।”
“উক্ত মিশরী প্রতিটি আরব ও ইসলামী রাষ্ট্রে স্থিতিশলীতার প্রতি গুরুত্বারোপ করেন এবং এ ব্যাপারে হুশিয়ারি করেন যে, মিশরের স্থিতিশীলতাই আমাদের ফিলিস্তীন অঞ্চলেরও স্থিতিশীলতা।”
....................
প্যারিসে গত মঙ্গলবার, পররাষ্ট্রমন্ত্রী ফিলিপ ডৌষ্ট ব্লজি ফিলিস্তীনী সরকারের দাহব হামলার নিন্দাকে তার বৈদেশিক নীতির উন্নতি হিসাবে বিবেচনা করেছেন।
............................
ডৌষ্ট ব্লজি আরো বলেন:
“এ হামলাকে শুধু দেশের প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাসই নিন্দা করেননি, বরং এই প্রথমবারের মত হামাসও এর প্রতি নিন্দা জানিয়েছে।”
একই পত্রিকা একই পৃষ্ঠায় ফিলিস্তীনের ইসলামী জিহাদী আন্দোলনের একটি বিৃবতিও পেশ করে, তাতে আসে:
“আমাদের সংগ্রামি আন্দোলন এ ধরনের মিথ্যাচারকে সম্পূর্ণ অস্বীকার করছে। এটা তার বিরুদ্ধে এবং ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের বিরুদ্ধে উস্কানী। আমাদের সংগঠন এ ধরণের হামলার নিন্দা জানাচ্ছে। তেমনিভাবে যেকোন আরব রাষ্ট্রের উপর যেকোন প্রকার হামলার নিন্দা জানায়, চাই উক্ত রাষ্ট্রের ব্যাপারে যতই সংশয় থাকুক।”
২৬- ২৬ এপ্রিল ২০০৬। দু’জন মুজাহিদ উত্তর সিনাইয়ে দু’টি ইস্তেশহাদি হামলা পরিচালনা করেন। একটি জৌর বিমানবন্দরের নিকট বহুজাতিক বাহিনীর ঘাটিতে। উক্ত বাহিনী তাদের দুই সদস্য আক্রান্ত হওয়ার প্রতিবেদন প্রকাশ করে। দ্বিতীয়টি মিশরীয় পুলিশের একটি গাড়িতে, যারা তাদের সাহায্যের জন্য এসেছিল। পুলিশ তাদের দুই সদস্য নিহত হওয়ার কথা স্বীকার করে।
Comment