তৃতীয় অধ্যায়: ময়দানে প্রত্যাবর্তন-তৃতীয় পরিচ্ছেদ: মিশরের অভিযান সমূহ
(পুর্ব প্রকাশের পর)
দ্বিতীয়ত: এ সকল অভিযানগুলো থেকে কী শিক্ষা অর্জিত হল?
এ ছিল আনওয়ার সাদাত হত্যার পর থেকে মিশরে জিহাদী অভিযান সমূহের সংক্ষিপ্ত ও সামান্য বিবরণ, যাতে অনেক বিস্তারিত বিবরণ এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে। এখন আমরা এই নিকট অতীত পর্যন্ত সেই ইতিহাসের প্রতি একটু অনুসন্ধানী দৃষ্টি ফেরাব, যাতে দেখতে পারি এ সকল অভিযানগুলো থেকে আমাদের কী শিক্ষা অর্জিত হল?
চিন্তাধারা সুস্পষ্ট হওয়ার জন্য আমরা আলোচনাটি দু’ভাগে ভাগ করব:
প্রথম ভাগ: মিশরের বিদ্যমান সাংঘাতমুখর পরিস্থিতি।
দ্বিতীয় ভাগ: এ সংঘাত থেকে অর্জিত শিক্ষা।
***
প্রথম ভাগ: মিশরের বিদ্যমান সংঘাত মুখর পরিস্থিতি
১- যাতে পাঠকদের নিকট আলোচনা দীর্ঘায়িত না হয়ে যায়, তার জন্য আমি হুসনি মোবারকের ক্ষমতাগ্রহণ থেকে আলোচনা শুরু করব:
আনওয়ার সাদাতের পর হুসনি মোবারক এক মিথ্যা গণপরিষদের মাধ্যমে ক্ষমতা গ্রহণ করে, যাদেরকে সেনাবাহিনী ও নিরাপত্তাবাহিনী প্রহরা দিত। হুসনি মোবারক পূর্ববর্তী নৈরাজ্যের পথে সফর পরিপূর্ণ করে।
ক. শাসনব্যবস্থা ও সমাজ থেকে শরীয়তকে নিশ্চিহ্ন করা এবং ইসলামী মূল্যবোধ ও রীতি-নীতির বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা।
খ. আমেরিকার প্রতি পরিপূর্ণ আত্মসমর্পণ এবং আমেরিকান সেনাবাহিনীর জন্য পুরো দেশকে উম্মুক্ত করে দেওয়া, ঘাটি স্থাপন ও গোয়েন্দাবৃত্তির সুযোগ প্রদান এবং সব ধরণের সুযোগ-সুবিধা প্রদান।
গ. ইসরাঈলের সাথে তেলবাজির পুরোনো রাজনীতিই চালিয়ে যাওয়া।
ঘ. ইরাকে আঘাত ও অবরোধ করতে আমেরিকা ও ইহুদিদেরকে সহযোগীতা করা। এমনকি প্রথমে আফগানিস্তান, পরে ইরাক যুদ্ধে সহযোগীতা করা। গাজা অবরোধে মৌলিক ভূমিকা পালন করা, তথ্য উদ্ধারের জন্য গাজার পরিবারগুলোর উপর নির্যাতনের স্টিমরোলার চালানো এবং এর মাধ্যমে ইহুদিদেরকে সাহায্য করা।
ঙ. জনগণের উপর জুলুম করা এবং যেকোন প্রতিবাদকারীর বিরুদ্ধে দমন-পীড়ন ও ইজ্জতের উপর সীমালঙ্ঘনের মাধ্যমসমূহ গ্রহণ করা।
চ. অর্থনৈতিক বিপর্যয়। অচল স্বার্থবাজ ও দুর্ণীতিবাজ শ্রেণীর অর্থনীতি, যা মিশরের শিল্পভিত্তিকে ধ্বংস ও কৃষিখাতকে বিরান করে দিয়েছে।
ছ. শান্তিপূর্ণ সংস্কার, এমনকি শান্তিপূর্ণ, কার্যকর ও ফলপ্রসূ প্রতিদ্বন্দ্বিতার পথও বন্ধ করে দিয়েছে।
জ. ক্ষমতা গ্রহণের দিন থেকেই উত্তরাধিকারের পথ সুসংহত করার ষড়যন্ত্র। পৃথিবীর মধ্যে সে-ই একমাত্র প্রেসিডেন্ট, যার কোন সহকারী নেই। এমনকি লোক দেখানো একজন সহকারীও নেই। যেহেতু সহকারী গ্রহণ করা আত্মঘাতি। কারণ হুসনি মোবারক নিজে একজন সহকারী ছিল, অতঃপর প্রেসিডেন্ট হয়ে গেছে।
ঝ. কিছু রাজনৈতিক খেলার মাধ্যমে উদারতা প্রদর্শন। যেমন কিছু নাম সর্বস্ব দল, সংবাদপত্র ও কিছু সাজানো নির্বাচন, যা সরকারের রাজনীতিতে কোনই প্রভাব ফেলে না, তার লাভ-ক্ষতির সাথে কোনই সম্পর্ক রাখে না এবং তাকে অব্যাহতভাবে তার অপরাধ চালিয়ে যেতেও বাধা প্রদান করে না। এ সব কিছু থেকে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল, আমেরিকান ও জায়নবাদি এজেন্ডাকে স্পর্শও করে না। বরং প্রকৃতপক্ষে এটাই তার অত্যাবশ্যকীয় বিষয়গুলোর একটি। যেমন- কোন সন্ত্রাসী আপনার স্বাস্থ্য ও সুস্থতা রক্ষার জন্য আপনাকে কিছু ভিটামিন খেতে দিল। তারপর আপনার জন্য ভিটামিনের বোতলে বিষ পরিবেশন করল। এখন আপনি যদি স্বেচ্ছায় সেটা গ্রহণ করেন, তাহলে সে যা চাইল, তা ই ঘটল। আর যদি আপনি সন্দেহ করেন বা অস্বীকার করেন, তাহলে তার রক্ষীবাহিনী আপনাকে ঘিরে ফেলবে, অতঃপর আপনাকে জোর করে তা গলাধ:করণ করাবে। কিন্তু কোন অবস্থাতেই আপনি নিরাপদ ও রোগমুক্ত হতে পারবেন না।
এটাই বিগত দিনের বাস্তব অবস্থা এবং এখনো তা চলমান, যা প্রতিটি আত্মমর্যাদাশীল সম্মানিত ব্যক্তির নিকট স্পষ্ট। তারপর যখনই কোন আপত্তিকারী আপত্তি করে, তখন অনেক চিৎকারকারী চিৎকার করে উঠে বলে: এখন দেশ স্বাধীনতা ও প্রগতির দিকে এগিয়েছে, আপনি কি সংবাদপত্রের দু:সাহসিকতা দেখেন না? আপনি কি নির্বাচনগুলো দেখছেন না, যেখানে পূর্বে তারা ১৫ আসন অর্জন করেছিল আর এখন ৮০ আসন অর্জন করেছে? আপনি কি দেখেন না, কত মানুষ কারাগার থেকে মুক্তি পেয়েছে? আপনি ইন্টারনেট চ্যানেল ও মিডিয়া সাইটগুলো দেখছেন না?
এ সব ঠিক আছে, কিন্তু দেশকে (ইসলামের সজিবতা থেকে) বিরান করা এবং আল্লাহর বান্দাদেরকে উচ্ছেদ করা তো অব্যাহতভাবেই চলছে। উম্মাহর আকিদা, স্বাধীনতা, সম্মান, তার সম্পদ ও ভূমির উপর আক্রমণ এবং ইরাক ও আফগানিস্তানের উপর আক্রমণ, অতঃপর গাজা অবরোধ তো অব্যাহতভাবেই চলছে। শুধু পচন ঢাকার চেষ্টা হিসাবে সাময়িক আতর ঢালা হয়েছে, যা নাক থেকে দুর্গন্ধ দূর করে। যা মিশরকে ইসলাম ও আরব বিশ্বের ঘাটি হওয়া থেকে এবং ক্রুসেডার ও তাতারদের বিরুদ্ধে ইসলামের পক্ষে প্রতিরোধকারীর অবস্থান থেকে আমেরিকার অনুগত আচলে পরিণত করে।
২- আমরা হুসনি মোবারকের শাসনামলের প্রথম কয়েক বছরের আলোচনায় ফিরে যাচ্ছি। আলোচনা দীর্ঘায়িত না করে বলব: এটা সুস্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল যে, এই বিশৃঙ্খলা ও ব্যাপক নৈরাজ্যকে প্রত্যাখ্যান করা ব্যতিত কোন সমাধান নেই। আর মুসলিমগণ নিজেদের দ্বীন থেকে যে শরয়ী পদ্ধতি শিখেছে এবং যার মাধ্যমে আল্লাহ তাদেরকে মর্যাদাবান করেছেন, তা হল: সৎকাজের আদেশ করা এবং অন্যায় কাজে বাধা প্রদান করা, যার সর্বোচ্চ চূড়া হল জিহাদ। কারণ এটা স্পষ্ট ছিল এবং যেকোন চক্ষুস্মান ইনসাফগারের নিকট এখনো সুস্পষ্ট যে: এই বিপর্যস্ত পরিস্থিতি নম্রতা ও সমঝোতার মাধ্যমে কখনো পরিবর্তন হওয়া সম্ভব নয় এবং শক্তি ছাড়া কিছুতেই পরিবর্তন হবে না।
৩- তাই কারাগার থেকে বের হয়ে আমরা এই জিহাদি পরিবর্তনের জন্য প্রস্তুতি নিতে লাগলাম। আমরা নিশ্চিত বিশ্বাসী ছিলাম যে, এর জন্য দীর্ঘ প্রস্তুতি, জনবল, সহযোগী ও সচেতনতা প্রয়োজন। একারণে আমরা আকিদাগত, চিন্তাগত ও রাজনৈতিক সচেতনতা অভিযান শুরু করলাম। সহযোগী জমা করা ও তাদেরকে শৃঙ্খলাবদ্ধ করা শুরু করলাম। আমরা একটি সামরিক বীজ প্রস্তুত করতে শুরু করলাম। তাকে প্রশিক্ষিত করার জন্যও আমরা আমাদের সাধ্যমত সর্বোচ্চ চেষ্টা করলাম। আমাদের টার্গেট ছিল, এ সামরিক বা জিহাদি বীজটিই আমাদের সরকার পরিবর্তনের মাধ্যম নয়, বরং এটা হল উম্মাহকে সচেতন ও জাগ্রত করার মাধ্যম। যার মাধ্যমে আজ কায়িদাতুল জিহাদ সফলতা লাভ করেছে, উম্মাহর প্রধান শত্রু ইহুদি ও আমেরিকানদের উপর পরিচালিত অভিযানগুলোর মাধ্যমে উম্মাহর পুনরায় সম্মানলাভের আশা ও আত্মবিশ্বাস ফিরিয়ে এনেছে এবং উম্মাহ জুলুম ও জালিমদের মোকাবেলায় অংশগ্রহণ করতে শুরু করেছে। আমরা আশা করতাম- যা আজ বাস্তবে ঘটেছে- আমরা আমেরিকা ও ইহুদিদের মোকাবেলা করলে এই নষ্ট ও নৈরাজ্যবাদি শাসনব্যবস্থা তাদের পক্ষে লড়াই করতে এমনিতেই ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে যাবে। এখন তাদের জনগণের সামনে এটা কার্যকরভাবেই স্পষ্ট হয়ে গেছে।
৪- নব্বয়ের দশকের শুরুর দিকে দু’টি গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন সাধিত হয়:
ক. সকল জিহাদি আন্দোলনগুলোর বিরুদ্ধে আমেরিকার নির্মূল অভিযানের সূচনা। প্রথমে আফগানিস্তান থেকে উচ্ছেদ করার মাধ্যমে শুরু করে, তারপর প্রতিটি স্থানেই পৌঁছে যায়। আমাদের পক্ষ থেকে আমেরিকার সাথে কোন ধরণের সংঘর্ষ ছাড়াই এটা শুরু করে।
খ. দ্বিতীয় বিষয় হল, আমাদের জামাআতুল জিহাদের বিরাট সংখ্যককে গ্রেফতার করা এবং তাদের মধ্যে ৮০০ কে সামরিক আদালতে পেশ করা, যেটা ‘বিজয়ের পূর্বাভাস’ মামলা হিসাবে পরিচিত। আদালত তাদের চারজনের বিরুদ্ধে মৃত্যুদণ্ডাদেশ জারি করে। সরকারী পত্রিকা জামাআতুল জিহাদের ৮০০ সদস্যকে একটিও গুলি ব্যবহার ব্যতিত গ্রেফতার করার সংবাদ খুব গর্বের সাথে প্রকাশ করে।
৫- আমরা সরকারের সাথে মোকাবেলায় জড়ানোর সিদ্ধান্ত নিলাম। অথচ আমাদের পূর্ববর্তী পরিকল্পনা ছিল ধৈর্য ধারণ করা, অপেক্ষা করা, প্রসার লাভ করা এবং সংস্কারযুদ্ধের প্রস্তুতি হিসাবে সৈন্য গঠন করা।
কেন আমরা সরকারের সাথে মোকাবেলায় জড়ানোর সিদ্ধান্ত নিলাম?
আমরা যুদ্ধে জড়ানোর সিদ্ধান্ত নিলাম নিজেরা বেঁচে থাকার জন্য, জিহাদি চেতনা বাঁচিয়ে রাখার জন্য এবং আমাদের মনোবল ও আমাদের পরবর্তী উম্মাহর মনোবল যেন ভেঙ্গে না পড়ে সেজন্য। আমরা যুদ্ধে জড়ানোর সিদ্ধান্ত নিলাম, জিহাদের সংকল্প অটুট রাখার জন্য এবং সরকারী ‘নিরাশকরণ অভিযান’ ব্যর্থ করার জন্য। আমরা মোকাবেলায় জড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছি, যাতে আমরা এমন উদ্ধাস্তুতে পরিণত না হই, যাদের সর্বোচ্চ আশা শুধু রাজনৈতিক আশ্রয় পাওয়া, কিংবা নিজ পরিবারবর্গকে হেফাজত করা কিংবা আত্মসমর্পণ ও পশ্চাদপসরণ। আমরা মোকাবেলার সিদ্ধান্ত নিলাম, যেন জিহাদী স্ফুলিঙ্গ নিভে না যায়, যদিও বা কোন এক পর্যায়ে আলোহীন হয়ে পড়ে। যাতে আমরা তা প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে স্থানান্তর করতে পারি, যাতে তা বিজয়ী প্রজন্ম পর্যন্ত পৌঁছতে পারে। হয়ত আল্লাহ আমাদেরকেও তাদের অন্তর্ভূক্ত করবেন। আমরা মোকাবেলার সিদ্ধান্ত নিয়েছি, যাতে আমাদের বীজ মাটিতে অবশিষ্ট থাকে, যা বসন্ত ঋতুর অপেক্ষায় থাকবে। এমন না হয় যে, আমরা নিজ হাতে তা উপড়ে ফেলি। আমরা মোকাবেলার সিদ্ধান্ত নিয়েছি, যাতে আমরা ঐ সকল মুজাহিদগণের জন্য আশ্রয়দানকারী দলে পরিণত হতে পারি, যারা এ সফরে যুক্ত হয় এবং যেন আমাদের জিহাদকে মুসলিম দেশগুলোর অন্যান্য মুজাহিদ ভাইদের সাথে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারি।
আজ আমি বর্তমান পরিস্থিতি ও নিকট অতীতের দিকে তাকিয়ে আমাদের উপর আল্লাহর অনুগ্রহ অনুভব করি। কারণ আমাদের প্রতিরোধ, অবিচলতা ও আত্মসমর্পণ না করার রাজনীতি সফলতা লাভ করেছে। আল্লাহর অনুগ্রহে এ কয়েক বছরে আমরা যা আশা করেছিলাম, তার থেকে বেশি বাস্তবায়িত হয়েছে।
Comment