ছাত্র আন্দোলন-হাসিনার পলায়ন: কিছু অভিব্যক্তি
الحمد لله والصلاة والسلام على رسول الله، أما بعد
এক.হাসিনা পালানোর পর পুলিশ ও আওয়ামীলীগের যে ভয়ানক দুর্দশা হয়েছে তা দেখে আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের ঐ বাণীগুলো বার বার মনে পড়ছে, যেগুলোতে বলা হয়েছে: আখেরাতে আযাব যখন সম্মুখে দেখবে, তখন নেতারা তাদের অনুসারীদের থেকে এবং অনুসারীরা নেতাদের সাথে সম্পর্কচ্ছেদের ঘোষণা দিবে। নেতারা বলবে, অনুসারীরা নিজেরাই অন্যায় অপরাধ করেছে, তাদেরকে তা করতে বাধ্য করা হয়নি, তাদের দায়ভার আমাদের উপর না। অনুসারীরা বলবে, নেতারা তাদেরকে এ পথে এনেছে, তাদের বারংবার আদেশের কারণে, বুঝানোর কারণে তারা আল্লাহর নাফরমানী করেছে, তারা তাদেরকে বাধ্য করেছে, বিভ্রান্ত করেছে। তারা বলবে, আমরা এসব নেতার সাথে নাই। উপরন্তু তারা দাবি জানাবে:
رَبَّنَا آتِهِمْ ضِعْفَيْنِ مِنَ الْعَذَابِ وَالْعَنْهُمْ لَعْنًا كَبِيرًا [الأحزاب: 68]
“হে আমাদের প্রতিপালক, এদেরকে দ্বিগুণ শাস্তি দিন এবং এবং এদের উপর পতিত করুন মহা অভিসম্পাত।” –আহযাব: ৬৮সোমবার হাসিনার পালানোর পর পুলিশের কি দুর্দশা হয়েছে আপনারা দেখেছেন। থানায় থানায় ঘেরাও করে, রাস্তা-ঘাটে, পালানোর পথে যেখানে পাওয়া গেছে পুড়িয়ে-পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে। লাশ ঝুলানো হয়েছে। কয়েকদিন পর্যন্ত লাশ পড়ে রয়েছে কেউ নিতে আসার সাহস করে না। তারা পরিণত হয়েছে ‘জাতীয় ভিলেন’ এ। একই দশা আওয়ামীলীগ নেতা-কর্মীদেরও, যাদেরকে জনতা পেয়েছে।
এরপর আপনারা দেখেছেন, পুলিশরা দলগতভাবে, ব্যক্তিগতভাবে মিডিয়ার সামনে এসে কেউ কেঁদে কেঁদে, কেউ বা নেতাদের প্রতি ক্ষোভ ঝেড়ে নিজেদের নির্দোষ দাবি করে যাচ্ছে। তারা গুলি করতে চায়নি; এই হারুনরা, বিপ্লবরা, হাবিবরা তাদেরকে বাধ্য করেছে। তারা দাবি জানাচ্ছে: এদেরকে শাস্তির আওতায় আনা হোক।
তারা নিজেদের সংস্কার চেয়ে এগারো দফা দাবিও পেশ করেছে এবং মিছিল করেছে। নিজেদের পোশাক, নাম সব বদলানোর আবেদন করেছে।
কি বাস্তব আল্লাহর বাণী! দুনিয়ার এই সামান্য শাস্তির মুখেই এতোদিনের সম্পর্ক শেষ। যাদেরকে তারা বস বস করতো, আজ তাদেরকে ঘৃণা করছে, গালি দিচ্ছে, শাস্তির দাবি জানাচ্ছে।
অপরদিকে হাসিনা পালানোর সাথে সাথে আওয়ামীলীগ নামক দানবটা মূহুর্তে যেন দফ করে পড়ে শেষ হয়ে গেল। যে নেতা যেভাবে পেরেছে পালিয়েছে, গা ঢাকা দিয়েছে। সাধারণ এই পুলিশদেরকে, ছাত্র্রলীগকে, এই কর্মীদেরকে- যাদেরকে তারা এতোদিন ব্যবহার করেছে: জনতার হাতে ছেড়ে গেলো।
যারা এতোদিন নেতাদের আদেশে মুসলিমদের গুলি করে যাচ্ছিলে, সাবধান হও! যারা দুনিয়াতে জনতার হাত থেকে তোমাদের বাঁচাতে পারলো না, আল্লাহর শাস্তি থেকে আখেরাতে কিভাবে তোমাদের বাঁচাবে? কি ভয়ানক দশা হবে সেদিন তোমাদের!
ক’দিন আগেও পুলিশ যখন আলেম উলামাদের গুলি করতো, ধরে নিয়ে যেতো- বলতো, ‘হুজুর! উপরের আদেশ আছে।’ আজ তোমাদের উপরের আদেশদাতারা কোথায়?
পুলিশ ও ছাত্রলীগের ভাইয়েরা তাওবা করুন: এতোদিন যারা আওয়ামী হায়েনার দলে থেকে মুসলিমদেরকে, দেশের মানুষদেরকে নির্যাতন করে গেছেন, সবাইকে আহ্বান জানাবো: তাওবা করুন। ফিরে আসুন। উপরের আদেশকে প্রত্যাখ্যান করে আল্লাহর আদেশকে গ্রহণ করুন। নতুবা কি যে হতে পারে তা তো স্বচক্ষেই দেখলেন।
দুই.
মনে পড়ছে বিলকিস রাণীর সেই মন্তব্যটি সেটি আল্লাহ তাআলা সমর্থন করেছেন এবং কুরআনে কারীমে স্থান দিয়েছেন:
إِنَّ الْمُلُوكَ إِذَا دَخَلُوا قَرْيَةً أَفْسَدُوهَا وَجَعَلُوا أَعِزَّةَ أَهْلِهَا أَذِلَّةً [النمل: 34]
“রাজা-বাদশারা যখন (বিজয় করে) কোনো জনপদে প্রবেশ করে, সেটিকে তারা বিরানভূমিতে পরিণত করে এবং তথাকার বড় ব্যক্তিদেরকে হীন বানিয়ে ছাড়ে।” –নামল: ৩৪রক্তপাতের পর দেশের মানুষ যখন আজ আওয়ামী হায়েনাদের বিরুদ্ধে জয় লাভ করেছে, তখন এই আয়াতে কারীমার সত্যতা আমরা স্বচক্ষে দেখতে পাচ্ছি। আওয়ামীলীগ মন্ত্রী-এমপি ও নেতৃস্থানীয় সাপোর্টারদের বাড়িগুলো আর আস্ত নেই। জ্বলে পুড়ে শেষ। আর গণভবনের কি হাল তা তো সবাই দেখেছেন। দেখেছেন কি হলো শেখ মুজিবের বাড়ির সাথে আর তার মূর্তিগুলোর সাথে।
অপরদিকে এতোদিন, বরং সেই রোববারেও যাদের প্রতাপে দেশ কাঁপতো, আজ তারা কুকুরের চেয়েও নিকৃষ্টে পরিণত হয়েছে।
তিন.
মনে পড়ছে রাব্বুল আলামীনের এ বাণিটিও:
{قُلِ اللَّهُمَّ مَالِكَ الْمُلْكِ تُؤْتِي الْمُلْكَ مَنْ تَشَاءُ وَتَنْزِعُ الْمُلْكَ مِمَّنْ تَشَاءُ وَتُعِزُّ مَنْ تَشَاءُ وَتُذِلُّ مَنْ تَشَاءُ بِيَدِكَ الْخَيْرُ إِنَّكَ عَلَى كُلِّ شَيْءٍ قَدِيرٌ (26)} [آل عمران: 26]
“আপনি বলুন, হে সার্বভৌম ক্ষমতার মালিক আল্লাহ, আপনি যাকে চান ক্ষমতা দান করেন আর যার থেকে চান ক্ষমতা কেড়ে নেন। যাকে চান সম্মান দান করেন আর যাকে চান লাঞ্ছিত করেন। আপনারই হাতে সকল কল্যাণ। নিশ্চয়ই আপনি সব বিষয়ে ক্ষমতাবান।” –আলে ইমরান: ২৬চার.
আজকের আন্দোলন দীর্ঘদীনের চেপে থাকা ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ। আজ মুসলিমদের অন্তরের ক্ষোভ কিছুটা হলেও প্রশমিত হয়েছে। তবে আন্দোলনের স্লোগান ছিল বৈষম্য দূর করা এবং ফ্যাসিবাদ হটিয়ে গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনা। বৈষম্য হয়তো অনেকটাই দূর হবে, ফ্যাসিবাদও হয়তো দূর হবে বহুলাংশে, কিন্তু ফিরে আসবে গণতন্ত্র। মনে রাখতে হবে: মুমিনের চাওয়া হবে আল্লাহর যমিনে আল্লাহর দ্বীন বাস্তবায়ন। জুলুম ও বৈষম্য দূর করার জন্য আন্দোলন আমরা সমর্থন করি, কিন্তু মুসলিম ভাইয়েরা: গণতন্ত্র কুফর। এ কুফরি জীবনব্যবস্থা থেকে বের হবেন কবে? এর জন্য কবে আন্দোলন করবেন? সত্য যে, এই মূহুর্তে আপনি চাইলেও গণতন্ত্র থেকে বের হতে পারবেন না। ফ্যাসিবাদ সরে পড়ার পর খেলাফত ও ইসলামের শাসন চালু করার কথা বলতে পারবেন না। আপনার আন্দোলনে জুলুম দূর হোক, দূর হোক অযৌক্তিক দলান্ধ বৈষম্য। কিন্তু আপনি গণতন্ত্রের কুফরে ঘুরপাক খাবেন না। আপনি আল্লাহর বান্দা, এই যমিন আল্লাহর। তাগুতকে বর্জন করে ফিরে আসুন আল্লাহর শাসনের দিকে। আল্লাহর আইনের দিকে, যে আইন দিয়ে কেয়ামতের ময়দানে আপনার আমার বিচার হবে।
পাঁচ.
আজ সময় এসেছে আয়নাঘরের বিভিষিকাময় চিত্র তুলে ধরার। আপনারা মুখ খুলুন। যারা গুম হয়েছেন, নির্যাতন সয়েছেন কিন্তু বলতে পারেননি এতোদিন, আজ মুখ খুলুন। জাতি জানুক এরা কতটা বর্বর। কলেজ ভার্সিটির ভাইয়েরা যারা ছাত্রলীগের হাতে নির্যাতিত হয়েছেন, আপনারা আপনাদের সাথে ঘটে যাওয়া বাস্তবতার স্মৃতিচারণ করুন। জাতিকে জানান, তারা কতটা নির্দয়, কতটা পাষণ্ড, কতটা রক্তখেকো।
ছয়.
আওয়ামীলীগকে দলগতভাবে নিষিদ্ধ করার আওয়াজ তুলুন। একই সাথে তাদের নেতাদের উপর যেন নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়, যেন তারা আর কখনও রাজনীতিতে আসতে না পারে। এরা এতোদিন দেশের মানুষের সাথে যে অপরাধ করেছে এরপর কিভাবে তারা রাজনীতির ময়দানে বৈধ হতে পারে? এরা যদি কোনোভাবে আবার ক্ষমতায় আসতে পারে, তাহলে কি ঘটবে দেশের মানুষের সাথে তা ভাবলেও অন্তর কেঁপে উঠে।
সাত.
যেসব মুসলিম ভাই কোনো না কোনো পর্যায়ে দেশ গঠনে কিংবা আইন-সংবিধান প্রণয়নে কিছুটা হলেও প্রভাব রাখেন, তাদের প্রতি আমার আবেদন, আপনারা যদিও কুফর বিদূরিত করতে পারবেন না, কিন্তু একজন মুসলিম হিসেবে ইসলাম ও মুসলিমদের উপকারে আসে মতো ভূমিকা রাখতে আপনি চেষ্টার কোনো ত্রুটি করবেন না।
আট.
আওয়ামী হায়েনাদের ব্যাপারে সতর্ক থাকুন। মনে রাখতে হবে: এদের হাতে দেশের লুট করা টাকা ও অস্ত্র এখনও বিদ্যমান। এবং এরা লোকবলেও কম ছিলো না। এরা ঘাপটি মেরে আছে, যেকোনো সময় যে কারো উপর ঝাঁপিয়ে পড়তে পারে। এই শত্রুর ব্যাপারে সতর্ক থাকুন। বিশেষ করে ছাত্র ভাইয়েরা এবং যারা আগে থেকে আওয়ামী বিদ্বেষী বলে পরিচিত।
নয়.
সতর্ক থাকুন আমেরিকার আগ্রাসনের ব্যাপারে। সন্দেহ করা হয়: এই আন্দোলনে আমেরিকার হাত ছিল। কিংবা অন্তত এতটুকু অস্বীকার করার সুযোগ নেই যে, আমেরিকা আন্দোলন থেকে সুযোগ নিয়েছে। ড. ইউনুসকে ক্ষমতায় বসানো এর চাক্ষুষ প্রমাণ। আমরা হিন্দুদের আগ্রাসন থেকে বের হয়ে যেন আমেরিকার উপনিবেশে পরিণত না হই। আর ড. ইউনুসকে আমরা চিনি। এদেশের ঘরে ঘরে সুদের আগুন এই লোকটিই জ্বালিয়েছে।
দশ.
আমি স্কুল, কলেজ ও ভার্সিটির ছাত্র ভাইদের বলবো: এ বিজয় আপনাদের একার নয়। বহু দিনের বহু জনের কুরবানীর ফসল শুধু আপনারা আজ ঘরে তুলেছেন। আপনারা ধোঁকায় পড়বেন না। এদেশের উলামা তলাবা ও সাধারণ মুসলিমদের রক্তের দাগ এখনও লেগে আছে শাপলা চত্বরে। লেগে আছে প্রতিটি যিন্দানখানায়। রাস্তা ঘাটে। অলিতে গলিতে। সেই ধারাবাহিক কুরবানীর চূড়ান্ত ধাপই আপনাদের বিজয়। এদেশের মুসলিমদের রক্তের উপর দিয়েই অর্জিত হয়েছে আপনাদের বিজয়। তাদেরকে খাটো করে দেখবেন না, অবজ্ঞা করবেন না। তাদের সেই কুরবানীর ইতিহাস বাদ দিয়ে আপনারা আপনাদের বিজয়ের কথা ভাবতে পারবেন? মুসলিমদের রক্তের সাথে গাদ্দারি করবেন না।
জালিমদের গান-কামান-কপ্টারগুলো যেন আপনাদের নিষ্পেষিত না করে এর জন্য কত মুসলিম নীরবে-নিভৃতে আল্লাহর দরবারে কেঁদেছেন তা হয়তো আপনারা জানেন না। এই চোখের পানির সাথে গাদ্দারি করবেন না।
এগার.
সর্বশেষ আমি বলবো, এ বিজয় আল্লাহর অপরিসীম দয়া। নতুবা শেখ হাসিনা শেষ সময়েও রক্তপাত চেয়েছিল। সবাইকে নিঃশেষ করে হলেও সে ক্ষমতা ধরে রাখতে চেয়েছিল। অধিকন্তু তার হাতে যথেষ্ট শক্তি ছিল তখনও। সকল বাহিনি তার হাতে। ছাত্রলীগ তার হাতে। তার হাতে অস্ত্র। তার হাতে টাকা। তার সাথে আছে ভারত। এক মাস আগেও কেউ ভাবেনি হাসিনা এভাবে পালাবে। কিন্তু আল্লাহর দয়া হয়েছে এদেশের সরল মানুষদের উপর। এই শক্তিধর দানবের সকল পরিকল্পনা মাকড়সার জালের মতো উড়ে গেছে। আল্লাহ তাআলা হয়তো কিছু মানুষের অন্তরে দয়া জাগ্রত করেছেন, ফলে তারা রক্তপাত চাননি। আর হাসিনার অন্তরে হয়তো ঢুকিয়ে দিয়েছেন ভয়, বিধায় সেও সাহস রাখতে পারেনি। সর্বশেষ আওয়ামীলীগের নেতাদের অন্তরে এমন ভীতি সৃষ্টি করেছেন, তারা ঘুরে দাঁড়ানোর পরিবর্তে পালিয়ে জীবন বাঁচানোকেই প্রাধান্য দিয়েছে। আল্লাহর দয়ায়, আল্লাহর পরিকল্পনায়, আল্লাহর কুদরতে সব তছনছ হয়ে গেছে তাদের। রক্ষা পেয়েছে দেশের মুসলমানরা বড় এক সংঘাত, বড় এক রক্তপাত থেকে। আল্লাহর দয়া ছাড়া একে আপনি আর কি বলতে পারেন? কাজেই আল্লাহর উপর বিশ্বাস রাখুন। তিনি সবার সৃষ্টিকর্তা। তিনি সবার মালিক। তার হাতে সবার অন্তর। তার হাতে সকল ক্ষমতা। তার আছে অগুণিত অদৃশ্য বাহিনি। এ বিজয় নিয়ে এখন বিভিন্ন ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ দাঁড় করানো হবে। স্ট্র্যাটেজিক্যাল বিশ্লেষণ ঠিক আছে, তবে সাবধান, যেন আল্লাহর রহমত আর কুদরতের বিষয়টি এড়িয়ে যাওয়া না হয়। নতুবা এই অকৃতজ্ঞতার উপর আল্লাহ রাগান্বিত হবেন।
***
Comment